০৬. কাজল চৌধুরীর কাহিনি
প্রথম স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন শ্রীময়ী, শিয়রে শমন বলছিস কেন? জোসেফ লোকটা কি এতই ভয়ানক? কে সে? গুণ্ডা, না ডাকাত?
অঞ্জনের মুখে বিচিত্র হাসি ফুটল, ডাকাত বা গুণ্ডা হলে ভয় পেতাম না। আমার ক্ষমতার সামান্য পরিচয় তোমার মেয়ে পেয়েছে। কিন্তু জোসেফকে আমিও ভয় পাই। কারণ, জোসেফ হচ্ছে এক ভয়ংকর জীব। সে যে কে এবং কী, তা আমিও ভালো করে জানি না।
সীমা ভয় পেয়েছিল। শ্রীময়ী সহজে বিচলিত হন না, তিনি বললেন, ব্যাপারটা ধাঁধার মতো লাগছে। জোসেফকে ভয় করার কারণ কী? অন্তত স্পষ্ট করে সেকথাটা আমাদের বল। তার সঙ্গে তোরই বা সম্পর্ক কী?
সবই বলব, অঞ্জন চিন্তিত ভাবে বলল, তবে এখন থেকে তোমাদের সব ভারই আমাকে নিতে হবে। জোসেফের নির্দেশ মেনে চললে অবশ্য ভয় নেই। তোমাদের সঙ্গে যদি সম্পর্ক ছিন্ন করি, আমাদের মধ্যে যদি কোনোদিন সাক্ষাৎকার না ঘটে, তাহলে ভয়ের কারণ থাকে না।
সীমা বলল, আপনি তো অনেক আগেই আমায় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিলেন। আজ হঠাৎ আমাদের জন্য এমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন?
শ্রীময়ীর মুখের রেখাগুলো কঠিন হয়ে উঠল। তার মনোভাব বুঝেই হাত তুলে তাকে নীরব থাকতে ইঙ্গিত করল অঞ্জন, তারপর দৃষ্টিপাত করল সীমার দিকে, আমি ভুল করেছিলাম, সীমা। তোমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সেদিন আমার সঙ্গে সংস্রব রাখতে নিষেধ করেছিলাম। আমার আশঙ্কা অবশ্য পরে সত্য হয়েছে। বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুঝলাম কাপুরুষের মতো কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়া উচিত নয়। শুধু কর্তব্যের কথা বলব কেন? আমার মধ্যেই কি শূন্যতাবোধ ছিল না? মায়ের আদর আর স্নেহের স্পর্শ পাওয়ার জন্য আমার মনেও কি লোভ হয়নি? আমি জানতাম–
বাধা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, টাকাটা রেখে দিয়ে তুই যখন চোরের মতো পালিয়ে গেলি, তখনই মনে হয়েছিল তুই আর এখানে আসবি না। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইলে পরিচয় দিতে কোনো বাধা তো ছিল না। তবে আমাদের জন্য যে তোর প্রাণ কেঁদেছে, টাকাটাই তার প্রমাণ। সেইজন্যই ওই বারো-শো টাকা নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করলে, কোনো সম্পর্ক না রাখলে, ভবিষ্যতে তোর থেকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করবনা, এটাও আমি স্থির করেছিলাম।
-জানি মা। তোমাকে আমি চিনি না?… চলে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু মনটা তোমার কাছেই পড়েছিল। একটা অদ্ভুত লজ্জা আর অপরাধবোধের জন্য সেদিন পরিচয় দিতে পারিনি। বাবার মৃত্যুসংবাদও আমায় বিহ্বল করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমি যদি সম্পর্ক রাখতাম তাহলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি বাবার মৃত্যু হত না আর তোমাদেরও এমন অভাব-অনটনের মধ্যে পড়তে হত না। বিশ্বাস করো মা, তোমার জন্যই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, হয়তো পরে নিজে থেকেই তোমাদের কাছে ফিরে আসতাম তুমি যে আমায় চিনেছ আর ক্ষমা করেছ, প্রকারান্তরে সেটা তুমি আমায় জানিয়ে দিয়েছিলে; কাজেই আসতে বাধা ছিল না কিন্তু অন্য দিক থেকে বাধা এল ভয়ংকর ভাবে। আজও সেই বাধা রয়েছে। তবু সব বিপদ আর ভয় তুচ্ছ করে আমি ফিরে এলাম মা, এখন থেকে তোমাদের সব দায়িত্বই আমার।
আমার কথাটা কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন অঞ্জনবাবু সীমা বলে উঠল, আপনার কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য আমি নিতে রাজি নই। শুধু মা নন, আমার কথাও আপনাকে ভাবতে হবে। আপনি বলেছিলেন আপনার কাছে কিছু গ্রহণ করলে আমাদের অসম্মান নেই। কারণটাও জানাবেন বলেছেন, কিন্তু এখনও জানাননি। সেই কারণটা না জানা পর্যন্ত আমার পক্ষে আপনার কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, একথা তুমি বলতে পারো, অঞ্জন মাথা নীচু করে ক্ষণেক চিন্তা করল, তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল সীমার দিকে, আমি তোমার বড়ো ভাই। আমার কাছ থেকে সব কিছু নেবার অধিকার তোমার তো আছেই, এমন কি দাবিও আছে।
বড় ভাই! দাদা! অস্ফুটস্বরে বলল সীমা। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বোধহয় এই অপ্রত্যাশিত সংবাদটা গ্রহণ করার চেষ্টা করল, তারপর বলে উঠল, কিন্তু আমি তো কোনোদিন আমার কোনো ভাই-এর কথা মা বাবার কাছে শুনিনি।
তারা কেন বলেননি, তাঁরাই জানেন, অঞ্জন বলল, বাবা নেই, এখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন মা। তবে তাদের নীরবতার কারণটা অনুমান করতে পারি। খুব সম্ভব ছেলের উপর অভিমানেই তারা চুপ করে থেকেছেন, আমার অস্তিত্বের কথাটা পর্যন্ত তোমাকে জানানো দরকার মনে করেননি।
তুমি ঠিকই বলেছ। আমি হয়তো হারিয়ে-যাওয়া দাদার কথা সীমাকে বলতাম, কিন্তু ওর বাবা নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন যে-ছেলে বাপকে এমন নিষ্ঠুরভাবে আঘাত দিয়ে চলে যেতে পারে, তার অস্তিত্ব আমি কোনেদিন স্বীকার করব না, বলতে বলতে শ্রীময়ীর গলার স্বর ভারি হয়ে উঠল, কাজল, পুরুষমানুষের চোখের জল ফেলতেও দেখেছি। তাঁর কষ্ট লাঘব করার ক্ষমতা আমার ছিল না, তাই ওঁর চোখের জল দেখেও না-দেখার ভান করেছি। এই ব্যাপারে নিজেকেও কিছুটা দায়ী করেছি। কাজটা তোর উচিত হয়নি কাজল।
হ্যাঁ মা, সেটা অনেক পরে বঝেছি, সেই জন্যই তো প্রায়শ্চিত্ত করতে ফিরে এলাম কাজল বলল, কিন্তু মা তুমি নিজেকে দায়ী মনে করবে কেন? গৃহত্যাগের জন্য তোমাকে বা বাবাকে দায়ী করা যায় না, সব দোষই আমার। সুবুদ্ধি যখন হল তখন দেরি হয়ে গেছে বাবাকে আর দেখতে পেলাম না। কিন্তু মা তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে না?
শ্রীময়ী উত্তর দিলেন না। তার ক্লিষ্ট অধরে স্নিগ্ধ হাসির রেখাঁটি নীরবেই তার মনোভাব প্রকাশ করে দিল।
সীমা এতক্ষণ চুপ করে ছিল, সামনে উপবিষ্ট যুবকটি তার বড়ো ভাই জেনেও আনন্দ বা উল্লাসের চিহ্ন তার মুখে দেখা দেয়নি। বোধহয় অপ্রত্যাশিত সংবাদের বিস্ময়কর চমকটা সে তখনও পরিপাক করে উঠতে পারেনি।
এবার নিজেকে সামলে নিয়ে সে মুখ খুলল, বুঝলাম আপনি—
বাধা দিয়ে কাজল বলল, আপনি নয় সীমা তুমি।
সীমার মুখে কাষ্ঠহাসি ফুটল, বেশ, না হয় তুমিই হল। অনেকদিন আগে, বোধহয় আমার জন্মেরও আগে আমার বড়ো ভাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল বুঝতে পারছি। কিন্তু রাতারাতি ছোটো বোনের অধিকার জাহির করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সংসারের দায়িত্ব যদি মা তাঁর বড়ো ছেলের কাঁধে চাপিয়ে দেন, আমি সেখানে আপত্তি করতে পারি না।
কাজল বলল,বেশ ভাববাচ্যে চার্লিয়ে গেলে দেখছি। মাকে আর বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়া আমার অন্যায় হয়েছিল সেকথা তো আমি স্বীকার করেছি। কিন্তু মা যখন আমায় ক্ষমা করেছেন সেখানে ছোটো বোন হয়ে তুমি দূরে সরে থাকবে কেন সীমা?
সীমা মাথা নীচু করল, সকলের চরিত্র সমান হয় না। সম্পর্কটা সত্য কাজেই আমিও তা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এই মুহূর্ত থেকেই ছোটো বোনের দাবি নিয়ে দাঁড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
জোর করে আর যাই হোক, ভালোবাসা আদায় করা যায় না কাজল বুঝি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল, তবে তোমাকে আমার প্রথম দিন থেকেই খুব ভালো লেগেছিল। একটা আকর্ষণ বোধ করেছিলাম। হয়তো সেটাই রক্তের টান। যাইহোক আমার কর্তব্য করতে যদি বাধা না দাও, তাহলেই আমি খুশি হব। এর বেশি চাওয়ার অধিকার বোধহয় আমার নেই।
কাজলের কথার মধ্যে এমন একটা বেদনার্ত করুণ সুর ছিল যে, সীমার মনও বিচলিত হয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাজলের দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব অনুমান করার চেষ্টা করল সীমা। নতমুখ যুবকের মুখে ছায়া পড়ায় ভাবের কোনো অভিব্যক্তি সীমার চোখে ধরা পড়ল না, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে হতাশা ও বিষাদ ছিল অতিশয় স্পষ্ট।
একমুহূর্তেই সীমা মনস্থির করে নিল, এগিয়ে এসে কাজলের কাঁধে হাত রাখল সে, দাদা, তুমি যে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলে সেটা বুঝতে পারছি। কেন গিয়েছিলে? এতদিন ছিলেই বা কোথায়? এই প্রশ্নগুলো আমার মনে ভিড় করছে। সংক্ষেপে হলেও মোটামুটি সব কথা আমায় বলতে হবে। একটা কথা তো মানবে- মায়ের পক্ষে তোমায় গ্রহণ করা যত সহজ আমার পক্ষে সেটা তত সহজ নয়।
কাজলের একটা হাত সীমার হাতের উপর এসে পড়ল, প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই সরে গেল। মুহূর্তের জন্য হলেও সেই স্নেহের স্পর্শ বুঝতে সীমার ভুল হল না। একটু থেমে বোধহয় অন্তরের আবেগ সংহত করে নিয়ে কাজল বলল, আমার সব কথা শোনার অধিকার তোমাদের আছে। যদিও সময় বেশি নেই, তবু সংক্ষেপে সব কথা বলছি। এখন থেকে
বাধা দিয়ে সীমা বলল, সময় নেই বলছ কেন? এখানেই যা হোক কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়বে। কাল সকালে যা ভালো হয় করো।
না রে সীমা, কাজল হাসল, কাল তো নয়ই, আর কোনোদিনই সার্কাসে ফিরব না। তোদের আশ্রয়েই থেকে যাব। সার্কাসের মালিক হয়তো ঝঞ্জাট করতে চাইবে, তবে তাকে বোধহয় আমি অসুবিধার দিকটা বোঝাতে পারব। কিন্তু
-সত্যি! সত্যিই তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে দাদা?
-হ্যাঁ রে সত্যি। অবশ্য মা যদি আমায় তাড়িয়ে না দেন।
শ্রীময়ী কপট ক্রোধে ভ্রু কুঞ্চিত করলেন, হ্যাঁ রে বেইমান ছেলে! মা-ই তো তোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ বছর আগে।
বিশ বছর আগে! সীমা সবিস্ময়ে বলল, বিশ বছর আগে তুমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলে? কিন্তু কেন?
কেন আবার, মায়ের উপর রাগ করে, শ্রীময়ী বললেন, আমি একটা গুরুতর অপরাধ করেছিলাম, তাই আমায় শাস্তি দিতেই গৃহত্যাগ করেছিলেন গুণধর ছেলে।
যাঃ? কী যা-তা বলছ সীমা মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে দাদার দিকে তাকাল, বলো না দাদা, কেন পালিয়েছিলে বাড়ি থেকে?
গভীর পরিতাপে মাথা নীচু করল কাজল, পরিহাস করে বললেও কথাটা সত্যি–
–সে কী! কী অপরাধ করেছিলেন মা?
–মায়ের কোনো অপরাধ ছিল না। অপরাধ আমার।
–হেঁয়ালি ভালো লাগে না স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলল।
–স্পষ্ট করেই বলছি, শোনো। আমরা ভাই-বোন, কিন্তু তুমি আমার সহোদরা নও।
তার মানে?
মানে বুঝলি না? শ্রীময়ী হাসলেন, আমি ওর সম্রা, নিজের মা নই।
–বলো কী?
–ঠিকই বলছি রে সীমা। তোর বাবার প্রথম স্ত্রী যখন মারা গেলেন, কাজলের বয়স তখন দশ। আরও পাঁচ বছর পরে তোর বাবা আমায় ঘরে নিয়ে আসেন। আমি সেই বিয়েতে আপত্তি করিনি। সেটা আমার প্রথম অপরাধ। দ্বিতীয় অপরাধ যে, সতীনের ছেলেটার উপর দারুণ অত্যাচার চার্লিয়েছিলাম, তাই—
মা! কাজল উঠে দাঁড়াল, আমি জানি তুমি ঠাট্টার ছলে আমায় তিরস্কার করছ। কিন্তু তার দরকার আছে কি? আমি কি আমার অপরাধ স্বীকার করিনি? তোমার কথা সত্যি– বাবা দ্বিতীয়বার বিবাহ করায় আমি অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। আত্মীয়-স্বজন, বিশেষ করে আমার এক বিধবা পিসি, প্রতিমুহূর্তে আমার মনে বিষ ঢেলেছে। তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছি, তুমি আসায় অনেকেরই স্বার্থ বিপন্ন হয়েছিল। একটা নিঃসঙ্গ মানুষের যন্ত্রণা বোঝার বয়স আমার তখনও হয়নি, কুচক্রী আত্মীয় স্বজনের কথায় বাবার উপর বিরক্ত হয়েছিলাম। পরে সেই বিরক্তি ক্রোধে পরিণত হয়েছিল। লজ্জার কথা কী বলব মা, তোমার সম্পর্কেও বিদ্বেষ পোষণ করতাম। অথচ তুমি আমার জন্য যথেষ্ট করেছ। নিজের ছেলের মতোই আমায় ভালোবেসেছিলে তুমি পড়াশুনা ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেওয়া, সিনেমা দেখা, সহ্য করোনি, শাসন করেছ নিজের ছেলের মতোই, আর তোমায় ভুল বুঝে বাবার উপর রাগ করে আমি ঘর ছাড়লাম।
তীব্র উত্তেজনায় ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘরে এসে হঠাৎ সীমার সামনে একটা মোডা টেনে নিয়ে বসে পড়ল কাজল, শোন সীমা, আমাদের মায়ের মতো মা হয় না। নিজের ছেলেকে তো সব মা-ই ভালোবাসে, পরের ছেলেকে নিজের বলে আপন করে নিতে পারে কয়জন? কিন্তু নতুন-মা ভস্মে ঘি ঢেলেছিলেন, তাঁর স্নেহের মর্যাদা আমি রাখতে পারিনি।
চেষ্টা সত্ত্বেও অবরুদ্ধ আবেগ দমন করতে পারল না কাজল, উত্তেজিত স্বরে বলতে লাগল, অল্প বয়সে মায়ের মৃত্যু দেখেছিলাম, কষ্টও পেয়েছিলাম খুব। পরে সেই কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম বাবার আদরে। তবে আমার দিকে বেশি মন দিতে পারেননি বাবা। তাঁর কাজকর্ম ছিল। সংসারের ভার পড়েছিল দূর সম্পর্কের এক বিধবা পিসির উপর। পিসি সংসার চালাত, বাবার টাকা পয়সা তার কাছেই থাকত। আমি চাইলে টাকা দিতে আপত্তি করত না পিসি। ছেলে যে আদর্শ ছাত্রের মতো জীবনযাপন করছে না সে-কথা বাবাও বুঝতেন না তা নয়, তবু মা-মরা ছেলেকে বোধহয় শাসন করতে পারতেন না। তার ফলে যা হয় তাই হল। কথায় বলে আদরে বাঁদর হয়। আমিও একদিকে বাবার ঔদাসীন্য আর অপরদিকে পিসির অবাধ প্রশ্রয়ে একটি আস্ত বাঁদর হয়ে উঠেছিলাম। নতুন-মা এসে সেই বাঁদরটাকে মানুষ করার চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগলেন। আমার সেটা অসহ্য বোধ হত। আড়ালে মায়ের সম্পর্কে পিসির বিরূপ সমালোচনাও মনের উপর ক্রিয়া করত। ব্যাপারটা বোধহয় নতুন-মা বুঝতে পেরেছিলেন; কিছুদিন পরেই পিসিকে বিদায় নিতে হল। চোখের জলে ভেসে পিসি আমায় জানিয়ে গেল যে, নতুন মায়ের জন্যই তাকে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। তখন রাগ হলেও পরে বুঝেছিলাম আমার ভালোর জন্যই নতুন-মা পিসিকে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। তবু একটা–
বাধা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, বহরমপুরে যেখানে তোর পিসি ছিল, সেখানে মাসে মাসে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ওই মহিলাটিকে এখানে রেখে তোমার পরকাল ঝরঝরে করতে পারিনি। ছেলের জন্য শক্ত হওয়ার দরকার ছিল।
একটু থেমে শ্রীময়ী আবার বললেন, বিয়ের পরেই উনি আমাকে বলেছিলেন ছেলেটা অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, আমাকেই তাকে মানুষ করার ভার নিতে হবে। দ্বিতীয়বার বিবাহের সেটাই নাকি প্রধান কারণ। সেইজন্যই নির্বিকারভাবে তোকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করতে পারিনি, প্রয়োজনে শাসন করার চেষ্টাও করেছি– ফল হল উলটো।
শুধু কি শাসনই করেছ? কাজল শ্রীময়ীর দিকে তাকাল, আদরের কথাও আমার মনে আছে বৈকি। কত রাত্রে শোয়ার আগে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছ, উপদেশ দিয়েছ, কত সময়ে নিজে পড়াতে বসেছ সে-সব কথা কিছুই ভুলিনি, মা।
একটু থেমে আবার ফেলে-আসা কথার সূত্র ধরল অঞ্জন, হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সীমা। মায়ের আদর মাঝে মাঝে ভালো লাগত, স্বীকার করতে লজ্জা নেই দুর্বল মুহূর্তে ভালো ভাবে চলার প্রতিশ্রুতিও দিতাম। তারপর আবার সব ভুলে যেতেও দেরি হত না। আসলে দীর্ঘকাল খুশিমতো চলার ফলে দস্তুর মতো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলাম, নিয়ম-শৃঙ্খলার বাঁধন সহ্য করতে পারতাম না। একদিন লুকিয়ে সিনেমা দেখে মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। এক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যার পর অঙ্ক করতে যেতাম, বন্ধুটি মেধাবী ছাত্র ছিল, অঙ্কে তার মাথা ছিল খুব পরিষ্কার। তাই বাবা কিংবা নতুন-মায়ের আপত্তি হয়নি। তারা জানতেন আমি সন্ধ্যার পর ওখানেই নিয়মিত অঙ্ক করি। কিন্তু মাঝে মাঝে সেখানে না গিয়ে ওই সময়টা যে আমি সিনেমা দেখে কাটিয়ে দিতাম, সেটা কারো জানা ছিল না। দৈবক্রমে একদিন নতুন-মা আমার জামার পকেট হাতড়ে আগের দিনের পরিত্যক্ত সিনেমার টিকিট আবিষ্কার করলেন। নিতান্তই বুদ্ধির দোষ টিকিটটা ফেলে দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। কে জানত যে, ভদ্রমহিলা হঠাৎ আমার জামার পকেট সার্চ করবেন! ধরা পড়তেই কৈফিয়ত তলব! আমি আজেবাজে কথা বলে ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতেই মুখের উপর একটা চড় পড়ল। বাবার কাছে কোনোদিন মার খাইনি, চড়টা পড়তেই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম, কিন্তু মনে মনে তখনই বাড়ি ছাড়ার সঙ্কল্প স্থির করে ফেলেছিলাম। পরের দিনই পালিয়ে গেলাম বাড়ি ছেড়ে।
শ্রীময়ী হেসে বললেন, বুঝে দ্যাখ সীমা, তোর মায়ের জোর কতখানি। একটা পনেরো-ষোল বছরের ছেলেকে বাড়ি থেকে ছিটকে ফেলে দিলাম এক থাপ্পড়ে!
সীমা হাসল না, মায়ের দিকে দৃকপাত না করে কাজলকে বলল, কোথায় পালালে? এতদিন কোথায় ছিলে? সব বলতে হবে।
কাজল চুপ করে রইল। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ শ্রীময়ীর পায়ের দিকে।
শ্রীময়ী বললেন, আগের ব্যাপারটা জানা থাকলেও গৃহত্যাগের পরবর্তী অধ্যায়টা আমারও জানা নেই। বল না হতভাগা, বাড়ি ছেড়ে কোথায় গেলি?
কয়েকদিন আগে একটা সার্কাস দেখে এসেছিলাম। সার্কাসে বাঘের খেলা দারুণ ভালো লেগেছিল। আরো ভালো লেগেছিল সেই লোকটাকে, যে বাঘের খেলা দেখাচ্ছিল। তাকে গিয়ে ধরলাম, বললাম, সার্কাসে বাঘের খেলা শিখতে চাই। লোকটা তো প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দিল। আমি না-ছোড়বান্দা। বললাম, বাপ-মা নেই। পিসি আর পিসেমশাইয়ের কাছে থাকি। তারা খেতে দেয় না, অত্যাচার করে–
দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে শ্রীময়ী বললেন, এমন ডাহা মিথ্যে কথা বলতে আটকাল না?
কাজল হেসে ফেলল, কই আর আটকাল? তাছাড়া আত্মরক্ষার জন্য মিছে কথা বললে দোষ হয় না। যাইহোক, অনেকক্ষণ কাকুতি-মিনতি করবার পর লোকটার মন গলল। বলল, যদি পুলিশের হাঙ্গামা হয় তাহলে কী হবে? জোর দিয়ে বললাম হাঙ্গামার সম্ভাবনা নেই, আমি চলে গেলে পিসি আর পিসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। লোকটা আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। বুক আর হাতের পেশি টিপে বলল, না-খেয়ে এমন চেহারা বাগানো যায় না। বললাম, একটা আখড়ায় বক্সিং লড়ি আর ব্যায়াম করি– আখড়ার শিক্ষক ভালোবাসে, তাই নিজের পয়সায় খাওয়ায়। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। জানকীবাবু ছিলেন বক্সিং-এর গুরু, সত্যিই খুব ভালোবাসতেন আমাকে–~ তবে খাওয়ানোর কথাটা যে মিথ্যে, তা তো বুঝতেই পারছ। লোকটাকে শেষ পর্যন্ত জমিয়ে ফেললাম, তারপর আর বাড়ি ছাড়তে কতক্ষণ? সার্কাস পার্টির সঙ্গে প্রথমেই গেলাম মাদ্রাজে যাওয়ার আগে অবশ্য বালিশের নীচে বাবাকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলাম—
একটু থেমে শ্রীময়ীর দিকে তাকাল কাজল, চিঠিটা নিশ্চয়ই পেয়েছিলে তোমরা?
শ্রীময়ী ঘাড় নাড়লেন। পেয়েছিলেন। তবে খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। মহাদেবই বারণ করেছিলেন। যে-ছেলে এমনভাবে মা-বাপকে ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে, তাকে ফিরিয়ে আনতে চাননি তিনি। শ্রীময়ীর আবেদন আর অনুনয়ও ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর কাছে।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল কাজল। সীমা হঠাৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠল, তারপর কি হল? তুমি কি সেই সার্কাস পার্টির সঙ্গে এই বিশ বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছ? এর আগে একবারও কলকাতায় আসোনি? একবারও মনে পড়েনি আমাদের কথা?
কাজল সস্নেহে বলল, না, বোনটি, তোমার কথা মনে পড়েনি। তোমার অস্তিত্বই তো জানতাম না তখন। তবে বাবা আর মায়ের কথা মনে পড়েছে বার বার। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে দেখা করব কেমন করে? আমি তো এখানে অর্থাৎ ভারতবর্ষে ছিলাম না।
–তবে কোথায় ছিলে?
–ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সার্কাস দলের সঙ্গে ঘুরেছি। একবার জাপানেও গিয়েছিলাম।
–জাপানেও গেছ? ওই সার্কাস পার্টির সঙ্গে?
না। তবে সব কথা খুলেই বলি। ইউরোপ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছিল ভাগ্যের কৃপায়। মাদ্রাজে থাকতে আমার বুনো জানোয়ারের খেলা দেখে এক সাহেব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ওই সাহেব ছিলেন আমেরিকার বাসিন্দা। তার ভাই-এর সার্কাস পার্টি ছিল। এখানে নয়, ইউরোপে। সেই সাহেবই চিঠিপত্র লিখে ভাই-এর ওখানে আমার একটা চাকরির বন্দোবস্ত করেছিলেন এবং আরও অনেক ঝঞ্জাট সামলে তিনি আমায় সাগরপাড়ে পাঠিয়েছিলেন। পশ্চিম জার্মানিতে তখনকার এক ভ্রাম্যমাণ সার্কাস-দলে আমি কাজ পেয়ে গেলাম। তারপর ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি, ওই সার্কাস ছেড়ে অন্য সার্কাসে যোগ দিয়েছি। পরপর তিনবার বিভিন্ন সার্কাসে দল বদল করলাম। চতুর্থবার মোটা টাকার বিনিময়ে যোগ দিলাম আর একটি নতুন সার্কাস দলে। তাদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হলাম ইতালিতে। সেখানে একটা ছোটো শহরে এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হল।…
সেদিন সন্ধ্যার পর বেড়াতে বেরিয়েছি। নতুন দেশ দেখার কৌতূহল ছিল। কয়েকদিন পরে খেলা শুরু হবে, এখন ছুটি–মনটাও ছিল বেশ খুশিখুশি। হঠাৎ খেয়াল হল বেশ রাত হয়েছে, আশেপাশে দোকানগুলো অধিকাংশই বন্ধ। যেগুলো খোলা আছে, সেগুলোতে বন্ধ করার তোড়-জোড় চলছে। ফিরে আসার জন্য পিছন ফিরলাম। সঙ্গেসঙ্গে কোথা থেকে চারমূর্তি এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াল। তাদের ভাষা না বুঝলেও ইঙ্গিতটা বুঝলাম; হাতের ঘড়ি আর পকেটের টাকা তাদের হাতে সমর্পণ না করলে পরিত্রাণ নেই। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। সামনের লোকটা চোয়ালে ঘুসি খেয়ে সটান শুয়ে পড়ল মাটির উপর।
এমন ব্যবহার বোধহয় আমার মতো লোকের কাছে গুণ্ডারা আশা করেনি। তারা বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই আবার আঘাত করলাম– আরও একজন পেট চেপে ধরে বসে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে তাদের দুই সঙ্গীর হাতে ঝক ঝক করে উঠল ধারাল ছুরি। আমি একটু পিছিয়ে প্রস্তুত হলাম আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য। সেদিন বোধহয় আমার মৃত্যই হত, কিন্তু রাখে হরি মারে কে? হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এল আর একটি লোক। তারপরে ব্যাপারটা কি হল ঠিক বুঝতে পারলাম না, শুধু দেখলাম একটা লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল গুণ্ডা দুটোর উপর এবং কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই আমার দুই আততায়ী লম্বমান হল রাজপথে। আগন্তুক আমার হাত ধরে ছুট দিল। গলির পর গলির গোলকধাঁধার ভিতর দিয়ে অনেকদুর এসে আমরা যখন আবার বড়ো রাস্তার উপর এসে পড়লাম, তখন আমার রক্ষাকর্তা হাত ছেড়ে দিল। এতক্ষণে আমার রক্ষাকর্তার মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পেলাম। মঙ্গোলীয় চেহারা। ইংরাজিতে ধন্যবাদ জানালাম। আমার সৌভাগ্য, লোকটি ইংরেজি ভাষাটা জানত। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচয় জমে উঠল। লোকটি জাপানি, মার্শাল আর্টে সুদক্ষ। প্রাচ্যদেশীয় পদ্ধতিতে ওই লড়াইয়ের কথা আগে শুনেছিলাম, এইবার চাক্ষুষ করলাম। সেদিনের পরিচয় পরে বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। আমাকে ঘেরাও হতে দেখেছিল সে, তাই ছুটে এসেছিল আমাকে বাঁচাতে। মার্শাল আর্টের কৌশল দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। ঝোঁক চাপল যেমন করেই হোক প্রাচ্যদেশীয় পদ্ধতিতে লড়াই-এর ওই কৌশল আমায় আয়ত্ত করতেই হবে।
আমার রক্ষাকর্তা দেখেছিল আমি গুণ্ডাদের কাছে আত্মসমর্পণ করিনি, দস্তুরমতো লড়াই করেছিলাম। আমার সাহস আর ঘুসি চালানোর কায়দা তার ভালো লেগেছিল। তার কাছে প্রস্তাব করতেই সে আমায় মার্শাল আর্টের প্রাথমিক শিক্ষা দিতে রাজি হল। কিছুদিন তার কাছে ব্যাপারটা বুঝে নিলাম। অত্যন্ত কঠিন সাধনার ব্যাপার। কয়েকমাসে কিছু আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। আমার রক্ষাকর্তা বা শিক্ষক যা-ই বলো, ইতালিতে ব্যবসা করত। আমাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমাকে সার্কাসের খেলার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হত। বুঝলাম, এভাবে কিছু হবে না। সার্কাস পার্টিতে ইস্তফা দিলাম। তারপর আমার শিক্ষক তোজোর পরামর্শ অনুসারে তারই চিঠি নিয়ে জাপানের একজন ক্যারাটেকা অর্থাৎ ক্যারাটে শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করলাম। আমায় নানাভাবে পরীক্ষা করে ওই ক্যারাটেকা আমায় উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শিক্ষা দিতে সম্মত হলেন। একসময় বক্সিং শিখেছিলাম, সেটা এবার কাজে লাগল। কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সাধনায় কিছুটা সিদ্ধিলাভ করলাম। এর মধ্যে অন্য ওস্তাদের কাছেও গেছি। ক্যারাটে, হপকিভো, কুংফু প্রভৃতি মার্শাল আর্টের কৌশলগুলিকে যথাসাধ্য আয়ত্ত করলাম। এর মধ্যে টাকা ফুরিয়ে এসেছিল, সুতরাং আবার ফিরে গিয়ে ইউরোপের এক সার্কাস দলে যোগ দিতে বাধ্য হলাম। কয়েক বছরের ওই ঘটনাবহুল জীবনেও বাবার কথা মনে হত, আর–
সীমা প্রশ্ন করল, আর কী? থামলে কেন?
–আর নতুন-মায়ের কথাও মনে পড়ত বার বার। সত্যিকার ভালোবাসা বোধ হয় মানুষ ভুলতে পারে না। তাই নতুন-মাকেও বার বার মনে পড়ত। মাতৃস্নেহের মর্যাদা দিইনি বলে একটা অপরাধ বোধও মনকে পীড়া দিত। অবশেষে হঠাৎ সুযোগ হল ভারতে আসার। ভারতে এক সার্কাস-ব্যবসায়ী তখন আমেরিকায় ছিল। দৈবক্রমে আমিও সেই সময় আমেরিকাতেই বিভিন্ন স্থানে খেলা দেখাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক তো আমার খেলা দেখে মুগ্ধ; আমার সঙ্গে দেখা করে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমাকে তার ভারতীয় সার্কাসে যোগ দিতে অনুরোধ করলেন। বলাই বাহুল্য, তৎক্ষণাৎ রাজি হলাম। যে-পার্টিতে সেই সময়ে কাজ করছিলাম, তাদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ তখন ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই নতুন দলে যোগ দিতে বাধা ছিল না। কিন্তু একটা দুষ্কর্ম করে ফেললাম।
দুষ্কর্ম! সীমা বিস্মিত হল, সেটা কী রকম?
শ্রীময়ীর কৌতূহল দৃষ্টিও সঞ্চালিত হল ছেলের মুখের উপর।
কাজল বলল, আমি যেখানে কাজ করতাম, সেই সার্কাস পার্টি আমার অনুরোধে একটা ব্ল্যাক জাগুয়ার কিনেছিল।
সীমা বলল, ব্ল্যাক জাগুয়ার। সেটা কি বস্তু?
শ্রীময়ী বলে উঠলেন, দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চলে, বিশেষত ব্রেজিলে জাগুয়ার নামে এক ধরনের বিড়াল জাতীয় জানোয়ার পাওয়া যায়। জাগুয়ারের চেহারা অনেকটা লেপার্ড বা চিতাবাঘের মতো। তবে চিতাবাঘের চাইতে জাগুয়ার বড়ো হয়, গায়ের জোরও তার বেশি। ভীষণ হিংস্র জন্তু। ওদের মধ্যে কোনো কোনোটা একেবারে কুচকুচে কালো। ইংরেজিতে তাদেরই ব্ল্যাক জাগুয়ার বলা হয়।
সপ্রশংস দৃষ্টিতে শ্রীময়ীর দিকে তাকাল কাজল, সত্যি, এসব খবরও তুমি রাখো!
মুখ টিপে হেসে শ্রীময়ী বললেন, অবসর সময়ে একটু-আধটু বই পড়ার অভ্যাস ছিল। ওইসব বই-এর দৌলতেই কিছু কিছু তথ্য জানতে পেরেছি।
সীমা আবার ধৈর্য হারাল, ব্ল্যাক জাগুয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমি জানতে চাই না। জন্তুটাকে নিয়ে তুমি কোন দুষ্কর্ম করলে তাই বলল।
কাজল বলল, জাগুয়ার নিয়ে, বিশেষত কালো জাগুয়ার নিয়ে খেলা দেখানো খুব কঠিন। কিন্তু কঠিন কাজ সম্পন্ন করতেই আমার বেশি ভালো লাগে। সার্কাসের মালিককে বলে কয়ে ওই জানোয়ারটা কেনার ব্যবস্থা করলাম, তারপর বিমানযোগে সেই জ্যান্ত বিভীষিকাকে নিয়ে আমরা ফিরলাম ভরতবর্ষে।
-কিন্তু এর মধ্যে তোমার দুষ্কর্মের কোনো সন্ধান তো পাচ্ছি না।
সবটা শোন। জন্তুটার নাম দিয়েছিলাম শয়তান। এমন সার্থকনামা জীব আমি দেখিনি। আফ্রিকার সিংহ থেকে শুরু করে সাইবেরিয়ার দুর্দান্ত বাঘ পর্যন্ত অনেক রকম হিংস্র জন্তু জানোয়ার নিয়ে খেলা দেখিয়েছি, কিন্তু শয়তান নামে এই ব্ল্যাক জাগুয়ারকে কিছুতেই বাগ মানাতে পারলাম না। ওদিকে সার্কাসে খেলা শুরু হওয়ার দিন স্থির হয়ে গেছে, শহরে পোস্টার পড়েছে– আমি ভেবেই পাচ্ছি না কী করব- সীমা, আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছিস?
পারছি দাদা। তবে এবার তোমাকে যখন পেয়েছি, আর সার্কাসের তাঁবুতে তোমায় ফিরতে দেব না। এসব ভয়ানক জন্তুকে নিয়ে খেলা দেখালে যেকোনো সময়ে বিপদ হতে পারে।
—তা তো পারেই। একবার একটা বাঘ আমার পাঁজরে থাবা বসিয়েছিল। সেই দাগও তোদের চোখে পড়েছিল। মনে পড়ে? নখের আঁচড়ে তিনটি সমান্তরাল ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়েছিল।
–তুমি কিন্তু মিছে কথা বলেছিলে। বলেছিলে একটা বনবেড়াল আঁচড়ে দিয়েছে।
-মোটেই মিছে কথা বলিনি। বাঘ হচ্ছে বিড়াল জাতীয় প্রাণী। ইংরেজিতে বাঘ-সিংহকে বিগ ক্যাট বলে।
চালাকি! ঘুরিয়ে মিছে কথা বলেছ।
-উঁহু। তোদর কাছে আমি একবারও মিছে কথা বলিনি। নিজের নাম বলেছিলাম অঞ্জন ঘোষ। অঞ্জন মানে যে কাজল তা তো জানিস। ওই নামটাই অবশ্য সর্বত্র চালু করেছিলাম, তোদেরও তাই বলেছি। তারপর পদবিটাও মিছে বলি নি। আমরা তো আসলে ঘোষ, উপাধি চৌধুরী। বাবা বলতেন ঘোষ চৌধুরী শুনতে ভালো নয়, তাই তিনি ঘোষ উড়িয়ে দিয়ে শুধু চৌধুরী বলতেন। আমি চৌধুরী উড়িয়ে দিয়ে ঘোষকেই প্রাধান্য দিয়েছি। মিথ্যেটা কোথায় বললাম?
এখানেও চালাকি!… বেশ মানলাম এটাও পুরোপুরি মিথ্যে বলোনি। কিন্তু বাবার নামটা কি ঠিক বলেছিলে?
–ঠিকই বলেছিলাম। ভেবে দ্যাখ।
-বলেছিলে বিশ্বনাথ ঘোষ… ওঃ হো? মহাদেবের আর এক নাম বিশ্বনাথ! ঘোষ উপাধিও সত্যি, তবে ব্যবহার করা হয় না বলে খেয়াল করিনি। দাদা! খুব ধোঁকা দিয়েছে আমাদের!
বহুবচন ব্যবহার করিস না সীমা, শ্রীময়ী হাসলেন, আমি হতভাগাকে চিনতে পেরেছিলাম।
আর তখনই বুঝি অঞ্জন ঘোষের খোলস ছিঁড়ে কাজল চৌধুরীকে আবিষ্কার করলে? কাজল হেসে বলল, আসলে হাতের জডুলটা হঠাৎ তোমার চোখে পড়ে গেল, তাই ধরা পড়লাম। না হলে আমায় চিনতে পারতে না।
না রে কাজল, শ্রীময়ী বললেন, আগেই সন্দেহ হয়েছিল। বিশ বছরে অনেক বদলে গেছিস, কিন্তু আমার চোখে ধুলো দিতে পারিসনি। তবে জডুলটা দেখার পর যেটুকু সন্দেহ ছিল, সেটুকুও চলে গেল নিশ্চিত বুঝলাম, গুণধর ছেলে বাপকে একবার দেখতে এসেছে।
শুধু বাপকে নয়, কাজল চোখ টিপে হাসল, যে অত্যাচারী মহিলাটির থাপ্পড় খেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম, তার জন্যও বড়ো মন কেমন করছিল।
তাহলে চোরের মতো পালিয়ে গেলি কেন?
–কেমন যেন সঙ্কোচ হল। হয়তো পরে আসতাম।
বাজে কথা, ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল সীমা, আমাকে তুমি সার্কাসের তাঁবুতে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছ। মাকেও তোমার কথা জানাতে নিষেধ করেছিলে। আজ তুমি আমাদের কাছে এসেছ বটে, কিন্তু সেদিন পর্যন্ত তুমি আমাদের এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করেছ। আমার কথা অস্বীকার করার চেষ্টা করো না দাদা।
অস্বীকার করছি না বোন, সত্যি কথাই বলছি। প্রথমে সঙ্কোচ হয়েছিল বলেই পরিচয় দিইনি। পরে নিশ্চয়ই আসতাম, পরিচয়ও দিতাম। কিন্তু তারপরই বাধা এল।
–বাধা! কীসের বাধা?
কাজলের মুখের হাসি হঠাৎ মিলিয়ে গেল, শুষ্কস্বরে সে বলল, বাধা দিয়েছিল জোসেফ।
আমাদের সে চিনল কী করে? সীমা সবিস্ময়ে বলল, মাকে সে কখনো দেখেনি। সার্কাসে সে আমায় দেখতে পারে, কিন্তু তার আগে আমার অস্তিত্ব তার জানার কথা নয়। অবশ্য তোমার মুখ থেকে আমাদের কথা সে জানতে পারে বটে।
আমি তাকে কোনো কথাই বলিনি, ক্লান্তস্বরে কাজল বলল, আমার বলাবলির অপেক্ষা রাখে না সে। আমি তাকে কিছু বলার আগেই আমার মা আর বোনের খবর সে আমাকেই জানিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, তাদের থেকে দুরে না থাকলে আমার অমঙ্গল হবে। মা-বোনের সংস্রব নাকি আমার পক্ষে ক্ষতিকর।
আবার একটা হেঁয়ালি, সীমা রুষ্টকণ্ঠে বলল, আমাদের কথা সে কেমন করে জানল? ওই জোসেফ নামক ব্যক্তিটির সঙ্গে তোমার যোগাযোগই বা হল কী করে? তোমার আত্মকাহিনি তো শুনলাম, এবার জোসেফের রহস্যটা একটু পরিষ্কার করে। একটা অজানা আতঙ্কের ভাব আমার ভালো লাগছে না, দাদা।
হ্যাঁ, জোসেফের ব্যাপারটা তত তাদের বলতেই হবে, কাজল বাঁ হাতের কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখল, এখন খাওয়ার ঝামেলা সেরে ফেলা যাক। অনেক রাত হয়েছে। খাওয়ার পর জোসেফের কথা বলব। সতর্ক হওয়ার জন্য বিপদের সত্যিকার চেহারাটা তোদেরও জেনে রাখা দরকার।