৬. কর্নেল জিপে উঠে বলেছিলেন

কর্নেল জিপে উঠে বলেছিলেন, মোহন সিং! তুমি আমাদের মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে নামিয়ে দিয়ে বাংলোয় ফিরে যেয়ো। এ বেলা আর আমার গাড়ির দরকার নেই।

নদীর ব্রিজ পেরিয়ে যাবার সময় হালদারমশাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কোথায় তাকে কেউ অতর্কিতে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। কূলে কূলে ভরা হলেও নদীতে কোথাও-কোথাও পাথর মাথা উঁচিয়ে আছে। তিনি যে নদীর সঙ্গে কী প্রচণ্ড লড়াই দিয়েছেন, আবার তা বর্ণনা করছিলেন।

ফার্মের গেটের কাছে আমাদের নামিয়ে দিয়ে সেলাম ঠুকে মোহন সিং জিপ নিয়ে চলে গেল। দিনের আলোয় ফার্ম দেখে অবাক হয়েছিলুম। প্রায়। তিন একর অসমতল জমি ফুট ছয়েক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের ওপর লোহার অ্যাঙ্গেলে আঁটা কাঁটাতার। একটা বাঘের পক্ষে দুই ঠ্যাঙে ভর করে কাঁটাতারের কাছে মুখ দেখানো খুবই সহজ। এমন কি লাফ দিয়ে পেরুনোও কঠিন নয়।

শিউশরণ গেট খুলতে আসছিল। কিন্তু জিপটা চলে গেল দেখে সে অ্যাটেনশন দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকল। গেটের একটা পাশ খোলা ছিল। সুদর্শন সিংহরায়কে দেখা গেল। তিনি বাঁদিকে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ভেতর দাঁড়িয়ে দুজন মজুরকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

আমাদের দেখতে পেয়ে তিনি এগিয়ে এলেন। তার সেই বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর একটু হেসে চাপাস্বরে বললেন, মিঃ হালদারকে দেখে কারও সাধ্য নেই যে চিনতে পারে ইনিই সেই হেকিমসাহেব।

হালদারমশাই শুধু নিঃশব্দে হাসলেন। কর্নেল বললেন, জয়ন্তকে ফার্ম ঘুরিয়ে আনা দরকার। ওর কাগজে রেপোর্টাজ লিখবে। বরং গোপালবাবুকে ওর সঙ্গে পাঠান।

হালদারমশাই বললেন, আমিও যামু। আমার অন দা স্পট কিছু ইনভেস্টিগেশনের ইচ্ছা আছে। কুকুর দুইটা বান্ধা আছে তো?

আছে। এখন ডগহাউসে ওদের খাওয়ানো হচ্ছে। তাই সাড়াশব্দ নেই।

পাঁচু খাওয়াইতাছে!

 মিঃ সিংহরায় বেরিয়ে গিয়ে ডাকলেন, গোপালবাবু! এদিকে একবার আসুন।

লম্বা বারান্দা। সারবন্দি একতলা ঘর। একধারে টিনের শেড দেওয়া গোডাউন। সেখান থেকে গোপালবাবু হন্তদন্ত এলেন। আমাকে নমস্কার করে হালদারমশাইয়ের দিকে তাকালেন। মিঃ সিংহরায় বললেন, ইনি কর্নেলের এক বন্ধু মিঃ কে. কে. হালদার! গোপালবাবু! এঁদের ফার্ম দেখিয়ে আনুন।

গোপালবাবু উৎসাহে পা বাড়ালেন। তারপর শুরু হলো তার বক্তৃতা। একটা করে উঁচু, নিচু বা মাঝারি গাছপালাঝোঁপ দেখিয়ে বিচিত্র ভেষজ গুণাগুণের। বর্ণনা দিতে থাকলেন। কর্নেলের কলকাতার বাড়ির ছাদেও এমন নানা বিদঘুঁটে আর বিচিত্র গড়নের উদ্ভিদ অবশ্য দেখেছি। কিন্তু এ যেন আরও বিচিত্র সমাবেশ। মনে হচ্ছিল, অন্য কোনো গ্রহে এসে গেছি।

হালদারমশাই একবার মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিলেন, স্যাফ্রন গাছগুলি দেখলে– তারপর চুপ করলেন। গোপালবাবু বললেন, জাফরানখেতের কথা বলছেন কি?

হালদারমশাই বললেন, হঃ! শুনেছিলাম, মিঃ সিংহরায় মিডল ইস্ট হইতে লইয়া আইছিলেন

গোপালবাবু একটু হেসে বললেন, আপনি ওপার বাংলা থেকে এসেছেন?

 ঠিক ধরছেন। বলে হালদারমশাই আমার দিকে তাকালেন।

কথা ঘুরিয়ে দিতে বললুম, কোথায় বাঘ দেখেছিলেন মিঃ সিংহরায়?

গোপালবাবু বললেন, একেবারে শেষদিকে। আসুন। দেখাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে দুধারে ঢালু রুক্ষ টাড় জমিতে সারবন্দি গুল্মগুলো দেখিয়ে গোপালবাবু বললেন, ওই দেখুন জাফরানখেত। এবার একটু সাবধানে আসবেন। বাঁদিকের ঝোঁপগুলোর পাতা বিছুটি পাতার মতো মারাত্মক। সিংহরায়সাহেবের সঙ্গে এক মুসলমান হেকিমসাহেব এসেছিলেন। তিনি না জেনে ওগুলোর কাছ ঘেঁষে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস গায়ে জোব্বা ছিল। নৈলে অ্যালার্জি বেরিয়ে চামড়ায় দাগড়া-দাগড়া ঘা হতো।

হালদারমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হঃ! সাংঘাতিক গাছ। জোর বাঁচিয়ে গেছেন।

কথা বলতে বলতে পূর্বদক্ষিণ কোণে আবার ঘন ঝোঁপঝাড়ের ধারে পৌঁছলুম। গোপালবাবু বললেন, এগুলো বাসকপাতার গাছ। ভেতরে ঢুকে লাভ নেই। কর্নেলসায়েব ঢুকেছিলেন। বাঘের মাথা যেখানে দেখা গিয়েছিল, সেখানে গিয়ে বোধ করি বাঘের লোম খুঁজছিলেন! বলে গোপালবাবু আঙুল তুলে জায়গাটা দেখালেন।

প্রাইভেট ডিকেটিভের কাণ্ড! তিনি বাসকপাতার ঝোপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে দুহাতে পাঁচিলের ওপরটা ধরে মাথা উঁচু করে ওধারে কী দেখতে থাকলেন। ঢ্যাঙা মানুষ। তা ছাড়া প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব।

গোপালবাবু হাঁ-হাঁ করে উঠেছিলেন। কিন্তু তাকে এবং আমাকে হতবাক করে হালদারমশাই পাঁচিলে উঠে সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে লাফ দিলেন এবং অদৃশ্য হলেন। আমি ডাকলুম, মিঃ হালদার!

গোয়েন্দাপ্রবরের কোনো সাড়া এল না। গোপালবাবু হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কী সাংঘাতিক কাণ্ড! ভদ্রলোকের মাথায় কি গণ্ডগোল আছে জয়ন্তবাবু?

বললুম, তা-ই তো মনে হচ্ছে।

ওধারে ঘন জঙ্গল। শেয়াকুল কাটার ঝোপঝাড়ও আছে। তা ছাড়া সাপটাপের উৎপাতও আছে। ফার্মে একরকম গাছ আছে। তার গন্ধে সাপ ঢুকতে পারে না। ড্রেনের ফুটোয় জাল আছে। তবু কারবলিক অ্যাসিড তুলোয় ভিজিয়ে ফেলে রাখা হয়। বলে গোপালবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আপনি ঘুরুন জয়ন্তবাবু! আমি গিয়ে দেখি, পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন নাকি?

গোপালবাবু হন্তদন্ত গেটের দিকে চলে গেলেন। তারপর তিনি উধাও হয়ে গেলেন।

আমি বাসকঝোপের ভেতর এগিয়ে গিয়ে হালদারমশাইয়ের অবস্থা দেখব ভাবলুম। আমার মাউন্টেনিয়ারিঙে ট্রেনিং নেওয়া আছে। পাঁচিলে উঠতে পারব। কাঁটাতার বাঁচিয়ে অন্তত ওপারটা দেখতে পারব।

কিন্তু বাসকঝোপে ঢুকতেই দেখি, হালদারমশাই ওধার থেকে মুণ্ডু বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারপর তিনি সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো বাইরে বাঁকা হয়ে ঝুঁকে থাকা কাঁটাতারের বেড় লম্বা পায়ে পেরিয়ে পাঁচিলের মাথায় উঠলেন এবং দুই পা ঝুলিয়ে নেমে এলেন। বললুম, কী অদ্ভুত!

হালদারমশাই শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, সেই ছ্যামড়া–পাঁচুর বউর লগে। কথা কইতাছিল কাইল। পালাইয়া গেল। যা জঙ্গল!

আপনি কী করে টের পেলেন সে ওখানে আছে?

আমার চোখ জয়ন্তবাবু! ওয়ালের প্যারালালে একটুখানি চুল দেখছিলাম। কাঁটাতারে ছড়ে-উড়ে যায়নি তো?

নাহ্! হালদারমশাই হাসলেন। জয়ন্তবাবু! পুলিশলাইফে কাঁটাতারের বেড়া টপকানোর ট্রেনিং লইছিলাম। এখনও ভুলি নাই। বলে তিনি অবাক হলেন। গোপালবাবু কই গেলেন?

আপনার খোঁজে।

খাইছে। বলে গোয়েন্দাপ্রবর পা বাড়ালেন। চলেন! আমি আপনারে ফার্মের একরকম গাছ দেখাইতাছি। পাতার গন্ধ এক্কেরে–কী কমু, য্যান ইসের মতন! হঃ! পাকা আমের মতন।

কয়েক পা এগিয়ে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। চোখদুটো গুলিগুলি হয়ে উঠল। গোঁফ উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপতে লাগল। বললুম, কী ব্যাপার?

পাঁচুর বউ নিমফুল কুড়াইতাছে।

তাতে কী হয়েছে?

অর লগে কথা আছে। কাম অন!

বেগতিক দেখে বললুম, প্লিজ হালদারমশাই! আর সিন ক্রিয়েট করবেন না!

না, না। দ্যাখেন মজাটা।

ডানদিকে পাঁচিলের ধারে কয়েকটা ঝাকড়া নিমগাছ। নিমফল ধরেছে প্রচুর। তার তলায় একটি মধ্যবয়সী মেয়ে ঝুড়িতে পাকা নিমফল কুড়োচ্ছিল। আমাদের। দেখে সে ঘোমটা দিল।

হালদারমশাই তার কাছে গিয়ে বললেন, কী কুড়াও দিদি? ওগুলিরে কী কয়?

পাঁচুর বউ মৃদুস্বরে বলল, আজ্ঞে নিমফল।

হঃ! একটা কথা জিগাই। ঠিক ঠিক কইবা।

পাঁচুর বউ অবাক হয়ে মুখ তুলল। ঘোমটা ঘসে গেল। বলল, আজ্ঞে?

কাইল নিচের ঘাসজমিতে তুমি ছাগল চরাইতাছিলা। তাই না?

আজ্ঞে?

ঠিকঠিক কইবা দিদি! কালোমতো এক ছ্যামড়া–মানে একজন লোক উপরের জঙ্গলের ফাঁকে খাড়াইয়া ছিল। তুমি তার লগে কথা কইতাছিলা। কে সে?

পাঁচুর বউয়ের মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। বলল, আপনারা পুলিশ?

হঃ।

আমার দেওর তো কারও চুরি করেনি মশাই! রিকশ চালিয়ে খায়।

 কী নাম তোমার দেওরের?

আজ্ঞে কেনারাম। সবাই কিনু বলে ডাকে।

কিনুর লগে কী কইতাছিলা কও?

পাঁচুর বউ খুব ঘাবড়ে গেল। সে কঁদো-কঁদো মুখে বলল, সায়েব ওকে পছন্দ করেন না। তাই সে লুকিয়ে দেখা করতে আসে। তার শরীরে অনেক রোগ। ঠাকুরমশাইয়ের কাছে একটা মন্তরপড়া মাদুলি যোগাড় করে দিতে বলছিল।

আমি বলে উঠলুম, ঠাকুরমশাই তাকে তো একটা মাদুলি অনেক আগে দিয়েছিলেন। সেটা কী হলো?

পাঁচুর বউ আরও ভয় পেয়ে গেল। কান্নাজড়ানো গলায় বলল, সেটা কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। তাই নতুন মাদুলি যোগাড় করতে বলছিল। আমার দেওরের কোনো দোষ নেই মশাই! বদমাস লোকের পাল্লায় পড়ে খারাপ হয়েছিল। এখন আর বদমাইসি করে না।

বললুম, ঠিক আছে। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কাকেও এসব কথা বোলো না।

পাঁচুর বউ ঘোমটা টেনে আবার পাকা নিমফল কুড়োতে থাকল। আমরা সোজা এগিয়ে গেলুম ফার্মহাউসের দিকে। হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, পুরান মাদুলির কথা কর্নেলস্যারও কইছিলেন!

বললুম, বোঝা গেল ওটা কিনুরই মাদুলি। কাঁটাতারে আটকে ছিঁড়ে পড়েছিল।

হালদারমশাই ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় গেটের কাছে গোপালবাবুকে দেখা গেল। ভেতরে এসে তিনি সন্দিগ্ধদৃষ্টে হালদারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী অবাক কাণ্ড! আপনি কি সার্কাসের দলে ছিলেন মশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, ছিলাম। তবে খেলাটা দেখাইতে হইল ক্যান, শোনেন! এক ছামড়া–মানে ইয়ংম্যান, কালো কুচকুচে গায়ের রঙ, পাঁচিলের ওধারে খাড়াইয়া ছিল।

গোপালবাবু হাসলেন। কিনু! কিনু! আমাদের পাঁচুর ভাই। সিংহরায়সায়েবের ভয়ে দাদাবউদির বাড়ি পর্যন্ত ঢুকতে পারে না। তাই আড়াল থেকে দাদা বা। বউদিকে ইশারায় ডাকে। আসলে একসময় কিনু ছিঁচকে চোর ছিল। একবার ফার্ম থেকে গুলঞ্চলতা চুরি করে শাঁটুল কোবরেজকে বেচেছিল। তাই সাহেব হুকুম দিয়েছেন, কিনু যেন ফার্মের ত্রিসীমানায় না আসে। এলে ওকে গুলি করে মারবেন। বলে গোপালবাবু আরও কাছে এলেন। ফিসফিস করে বললেন, প্লিজ! কিনুর ব্যাপারটা আপনারা সায়েবকে যেন বলবেন না। খামোকা পাঁচু আর তার বউয়ের চাকরি যাবে। গরিব মানুষ।

হালদারমশাই হাসলেন। ঠিক আছে। আপনি যখন রিকোয়েস্ট করলেন, তখন মিঃ সিংহরায়েরে কিছু কমু না।

এইসময় গোডাউনের পাশে একটা ঘর থেকে সুদর্শন সিংহরায় এবং কর্নেল বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে মিঃ সিংহরায় বললেন, এরই মধ্যে আপনাদের ফার্ম দেখা হয়ে গেল?

বললুম, মোটামুটি দেখলুম। আপনি বরং ফার্ম সম্পর্কে কোনো লিটারেচার থাকলে আমাকে দেবেন।

আছে। দেব। আসুন এবার! একপ্রস্থ কফি খাওয়া যাক কর্নেলসায়েবের অনারে। গোপালবাবু! আপনি গিয়ে দেখুন। মজুরদের আজকাল কাছে দাঁড়িয়ে কাজ না করালে ফাঁকি দেয়। গোড়ার ঘাস যেন এক চিলতে না থাকে। ভেরি সেন্সিটিভ হেম্প।

কিছুক্ষণ পরে হরিঠাকুর কফি-বিস্কুট এনে সেন্টার টেবলে রাখলেন। তারপর আড়চোখে হালদারমশাইকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

মিঃ সিংহরায়কে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। কফি খেতে খেতে আস্তে বললেন, আমার সন্দেহ যে হয়নি, তা নয়। বরং একটা চোখ এদিকে ছিল। কিন্তু সিওর হতে পারিনি। এবার সিওর হলুম।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমি একটা কথা প্রায়ই বলি। কথাটা হলো : আমরা অনেকসময় জানি না যে আমরা কী জানি।

ঠিক বলেছেন। আমিও জানতুম না যে আমি কী জানি!

কর্নেল বললেন, মিঃ হালদারকে হেকিমি দাওয়াইয়ের বাকসোেটা সময়মতো পৌঁছে দেবেন। এটা নিয়ে তাড়াহুড়োর কারণ নেই।

হালদারমশাই শুধু বললেন, হঃ!

কফি খাওয়া শেষ হলে কর্নেল বললেন, ওঠা যাক্। আবার দেখা হবে।

 সুদর্শন সিংহরায় বললেন, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি চলুন।

না, না। আমরা পায়ে হেঁটেই যাব। যাবার পথে কোনো বিশেষ প্রজাতির পাখির দেখা পেলে ছবি তোলার চেষ্টা করব। বাঁধের ধারে জঙ্গলে পরগাছা বা অর্কিডও পেতে পারি।

মিঃ সিংহরায় গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার যা অভিরুচি।..

মোরামরাস্তায় পৌঁছে হালদারমশাই ব্যস্তভাবে কিনুসংক্রান্ত ঘটনাটা সবিস্তারে কর্নেলকে শোনালেন। কর্নেল শুধু বললেন, বাহ!

আমি বললুম, মিঃ সিংহরায়ের কুড়িয়ে পাওয়া মাদুলিটা কিনুর। পাঁচুর বউ পরোক্ষে স্বীকার করেছে।

কর্নেল কোনো মন্তব্য করলেন না। হঠাৎ থেমে বাইনোকুলারে সম্ভবত পাখি দেখতে থাকলেন। একটু পরে তিনি বললেন, সাধারণ প্রজাতির হর্নবিল! চলো। বাংলোয় ফেরা যাক। আকাশে মেঘ জমছে। ছায়ায় হাঁটতে কষ্ট হবে না তোমাদের।

হাঁটতে হাঁটতে বললুম, রায়সাহেবের মেয়ে সুপর্ণাকে আপনার কিন্তু কিছু উপহার দেওয়া উচিত। অন্তত এক প্যাকেট চকোলেট! কারণ সে-ই প্রথম কিনুর কথা বলেছিল আপনাকে। তার ব্লু সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কিনুই হালদারমশাইকে ধাক্কা মেরে নদীতে–

কর্নেল হেসে উঠলেন। কিন্তু ছিঁচকে চোর ছিল। কিংবা এখনও ছোটখাটো চুরি করে। শাটুল কোবরেজকে ফার্ম থেকে গুলঞ্চলতা চুরি করে বেচেছিল, তাও হয়তো ঠিক। হয়তো বলে আরেকটা পয়েন্ট যোগ করছি। গুলঞ্চলতা চুরি করতে গিয়ে কুকুরের তাড়া খেয়ে তার বাহুতে লালসুতোয় বাঁধা মাদুলি কাঁটাতারে আটকে ছিঁড়ে পড়তেও পারে। কিন্তু হালদারমশাই কিনুকে তার বউদির সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন। কিনু লিকলিকে রোগাটে গড়নের যুবক। তাই না হালদারমশাই?

হালদারমশাই বললেন, ঠিক কইছেন। পুলিশলাইফে দেখছি, সিঁদকাটা চোর বা ছিঁচকে চোরেরা রোগাটে গড়নের হয়। শরীর তাগড়াই হলে তারা ডাকাত হইত। ছিচকা চোর হইব ক্যান? আর সিঁদ কাইট্যা ঢুকতে হইলে শরীর লিকলিকা হওন দরকার।

তা হলে নদীর ধারে কাল সন্ধ্যার হালদারমশাইকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলার ক্ষমতা তার থাকার কথা নয়।

হালদারমশাই সায় দিয়ে বললেন, না। হেভি ধাক্কা। লোকটারে না দেখলেও তার গায়ের জোর আছে, তা বুঝছিলাম।

কাজেই জয়ন্তের এই থিয়োরিটা ধোপে টেকে না। কর্নেল আবার বাইনোকুলারে কিছু দেখে নিয়ে বললেন, আমি বরাবর জয়ন্তকে অবভাসতত্ত্বের কথা বলি। ইংরেজিতে কথাটা ঠিকভাবে বলা চলে। হোয়াট অ্যাপিয়ারস্ ইজ নট রিয়্যাল। ট্রেনের লাইনে দাঁড়িয়ে দূরে লক্ষ্য করলে মনে হবে লাইনদুটো যেন ক্রমশ কাছাকাছি এসে মিশে গেছে। অথচ তা সত্য নয়।

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, কী তত্ত্ব কইলেন য্যান?

বাংলায় বলে অবভাসতত্ত্ব।

হালদারমশাই বিড়বিড় করে শব্দটা আওড়ে নিয়ে বললেন, হঃ। মাইনষের ভুল হইতেই পারে। এখন ভাবতাছি, পরশু সন্ধ্যায় অট্টহাসের জঙ্গলে সত্যিই কি বাঘ দেখছিলাম?

আপনি ঝোপের মধ্যে বাঘের মুখ দেখেছিলেন। তাই নয়?

তা দেখছিলাম। বলে হালদারমশাই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। নাহ্। ঠিক দেখছিলাম। টর্চের আলোয় চোখের ভুল হইতে পারে না। ইন্সট্যান্ট রিঅ্যাকশনে দুইখান গুলিও ছুঁড়ছিলাম। গুলি লাগে নাই। তাই বাঘও গর্জন করে নাই।

বললুম, মিঃ সিংহরায় বলছিলেন, এলাকার বাঘগুলো ছিল সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের তুলনায় ছোট। জঙ্গলে খাওয়ার মতো জন্তু • নেই। বলেই পাঁচুর ছাগল বা হাঁস-মুরগি খেতে হানা দেয়।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি কি জানো কুকুরের মাংস বাঘের সবচেয়ে উপাদেয় খাদ্য?

হালদারমশাই আবার উত্তেজিতভাবে বললেন, ঠিক! ঠিক! তাই বাঘটা ফার্মের পাঁচিল টপকে সিংহরায় সায়েবের কুকুর শিকারের জন্যই আসে। উঁকি দিয়া কুকুর দুইটারে দেইখ্যা লয়। কোনটারে বাগে পাইবে, সেই চিন্তা করে।

কর্নেল বললেন, বাঘের গন্ধ পেয়েই বিদেশি কুকুর দুটো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসে।….

কথা বলতে বলতে আমরা বাংলোয় পৌঁছুলুম। তারপর দেখলুম, বাংলোর বারান্দায় এক বৃদ্ধ আদিবাসী উবু হয়ে বসে আছে। চৌকিদার রামভরোসা তার সঙ্গে কথা বলছে।

আমাদের দেখে চৌকিদার এগিয়ে এসে সেলাম দিল। তারপর কর্নেলকে বলল, স্যার! আপনি মানকু হাড়ামকে আসতে বলেছিলেন। আমি খবর ভেজেছিলাম। সে আসল।

আমরা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসলুম। বৃদ্ধ আদিবাসী মানকু হাড়াম এসে করজোড়ে মাথা একটু নুইয়ে বলল, গড় করি গ বুঢ়া সাহেবকে। আপনার লেগে আজ ছুটি লিলম। মাটি কাটার কামে যাইনি গ সাহেব। মজুরিটো ধরিয়ে দিবেন বটে!

কর্নেল বললেন, তুমিই মানকু?

 বৃদ্ধ সাঁওতাল হাসল। হ। হাড়াম বটে গ। বুঢ়া হলাম। তাই হাড়াম হলাম গ।

 তুমি অট্টহাসের জঙ্গলে আর শিকারে যাও না?

না গ সাহেব! বাঘ ডাকলে সেই জঙ্গলে যাব ক্যানে? বস্তির কেহু যায় না আর।

বাঘের ডাক তুমি শুনেছ?

হঁ হঁ। সবাই শুনেছে। বাঘটো কুনো জঙ্গল হঁতে এস্যে ঢুকেছে গ! ই জঙ্গলে বাঘ ছিল না।

সিংহরায় সায়েব তো বড় শিকারি। একসময় কত বাঘ মেরেছেন। তাকে বলেনি কেন?

মানকু হাড়াম ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে বলল, উ রাজার বেটা গ সাহেব! জঙ্গলে ঠাকুরমায়ের যি থান ছিল, সেটা উয়াদের দুষে ভেঙ্গে গেল। সেই থানে জঙ্গল হলো। আমি সিখানে কাঁড় ছুঁড়ে কত শিকার করেছি। এখুন ঠাকুরমায়ের থানের জঙ্গলে বাঘ এল। ক্যানে এল :গ? রাজার ব্যাটা আর উই যি গোপালবাবু। আছে, দুইজনা সেখানে থান খুঁড়ছিল। তাই ত বাঘ এল।

ওঁরা থান খুঁড়ছিলেন? তুমি দেখেছিলে?

হঁ-অঁ! দেখেছিলাম। ত আমাকে বুলল, চলি যা ইখান থেকে। বন্ধুক মাড়ি দিব–হঁ।

কর্নেল আবার বললেন, থান–মন্দিরের জায়গায় ওঁরা মাটি খুঁড়ছিলেন?

সাহেব বুঝে না গ! আমি লুকাঞে দেখছিলাম। উদের কাছে যেঞে বুললম, কী কর গ রাজার বেটারা? তখন আমাকে বন্ধুক দেখাই বুলল, বন্ধুক। মারি দিব। চলি যা! আমি চলি এলাম।

ঠিক আছে। তোমার মাটি কাটার মজুরি কত?

মানকু প্রথমে দুহাতের সবগুলো আঙুল দেখিয়ে আবার এক হাতের পাঁচটা আঙুল দেখাল। চৌকিদার বলল, কর্নিলসাব! পনের টাকা বলছে।

কর্নেল পার্স বের করে দুটো দশ টাকার নোট দিলেন বৃদ্ধ আদিবাসীকে। সে নোটদুটো দুহাতে নিয়ে মাথা নোয়াল। হাসিমুখে বলল, বড় সাহেব গ আপনি! উদিকে এক বস্তি আছে বটে। সিখানে এক সাহেব থাকে। খেরেস্টান বস্তি গ। হঁ! ফাদার বুলে ডাকে। আপুনি সেই ফাদার বটে কি না?

কর্নেল হাসলেন। না মানকু! আমি ফাদার নই। তবে অনেকে আমাকে দেখে ফাদার বলে ভুল করে। ঠিক আছে। তুমি এবার যাও।..

মানকু হাড়াম চলে যাওয়ার পর হালদারমশাই নড়ে বসলেন। বললেন, হেভি মিস্ট্রি!

আমি বললুম, ওঁরা দুজনে কি গুপ্তধন খুঁজছিলেন?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, একটু রেস্ট নিয়ে লাঞ্চ খেয়ে আবার বেরুব। হালদারমশাই! ঘরে গিয়ে আপনিও রেস্ট নিন।

হালদারমশাই তার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আমি বললুম, আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি কর্নেল!

কর্নেল আস্তে বললেন, গুপ্তধন নয়। সম্ভবত বহু বছর আগেকার পুঁতে রাখা একটা ডেডবডি খুঁড়ে বের করছিলেন মিঃ সিংহরায়। আমার পাটিগণিত তা-ই বলছে। ডেডবডিটার ওখানে থাকা হয়তো খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল ওঁর কাছে। তাই ওটার হাড়গোড় সবকিছু খুঁড়ে বের করে উনি গোপালবাবুর সাহায্যে–হ্যাঁ, নদীতেই ফেলে থাকবেন। কিন্তু উনি বুঝতে পারেননি, এক বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে তাকে অন্য বিপদে পড়তে হবে।…