“ওই হচ্ছে শুখানালা! এবার আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর যাব না।”
তিনু ভ্রূ কুঁচকে বলে, “যাবে না মানে! আলবাত যাবে। শুখানালা-ফালা আমরা জানি না। আমরা অভয় সরকারকে চাই। যতক্ষণ তাকে পাওয়া না যাচ্ছে ততক্ষণ তুমি তার জামিন।”
কালু কাতর মুখে বলে, “শুখানালা ভীম সরকারের এলাকা। এখানে কেউ ঢোকে না। এখানে নানারকম ভুতুড়ে কাণ্ড হয়। আঁতুড়ে ছেলের কান্না শোনা যায়, নালায় জল আসে, আরও সব। আমাকে ছেড়ে দিন।”
তিনু তার চপারটার চওড়া দিক দিয়ে কালুর পিঠে সজোরে মেরে ভয়ঙ্কর গলায় বলল, “বেশি ট্যাঁ-ফোঁ করলে কিন্তু কেটে রেখে যাব!”
ট্যাঁ-ফোঁ করার অবস্থা অবশ্য কার নয়। তার কোমরে শক্ত করে দড়ি বাঁধা, সেই দড়ির প্রান্ত তিনুর বাঁ হাতে জড়ানোকালু যদি দড়ি ছিঁড়ে পালায়ও, তবে পেছনের তিনজনের তিনটে পিস্তল তাকে ঝাঁঝরা করে দেবে। তাই সে ভয়ে ঘামতে লাগল। কাতর স্বরে বলল, “আমাদের এ এলাকায় ঢোকা বারণ।”
তিনু বলল, “শোনো বুন্ধু, আমরা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করি না। আমরা খুব প্র্যাকটিক্যাল লোক। যেমন-তেমন করে কাজ হাসিল করতেই আমরা ভালবাসি। ভূতপ্রেত যদি থেকেও থাকে তবে জেনো, তারাও আমাদের ভয় খায়।”
শুখানালার পাত দেখা গেল একটা বাঁশঝাড়ের পরেই। কালু দাঁড়িয়ে গেল, “ওই যে।”
“ওটাই শুখানালা! তা বেশ। অভয় সরকার ভিতু লোক, সে গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য অবশ্যই খাতের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকবে। সন্তু, দেখ তো, খাতের ভেতর কোথাও ঘাসটাস
বে-গোছ হয়েছে কিনা।”
সন্তু অত্যন্ত অভ্যস্ত চোখে খাতের ধারে গিয়ে একটু দেখেই বলল, “এই তো এখানে ঘষটানোর দাগ রয়েছে। কুমড়োপটাশটা বোধ হয় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ তিনুদা, ওই যে ঘাসটাস লণ্ডভণ্ড করে জলহস্তীর মতো গেছে।”
তিনুর মুখে হাসি ফুটল, “তা হলে শিকার বেশিদূর যেতে পারেনি। ওই থলথলে শরীর নিয়ে আর কতদূরই বা যাবে।”
ল্যাংড়া বলল, “সে তো ঠিক কথা। কিন্তু এদিকে যে রোদ মরে আসছে তা দেখতে পাচ্ছ? অন্ধকার হয়ে গেলে কাজটা কঠিন হবে।”
তিনু ঘড়ি দেখল এবং আকাশের দিকে চাইল। তারপর বলল, “আমরা খাতে না নেমে যদি ধার দিয়ে দিয়ে যাই তা হলে ওকে স্পট করতে সুবিধে হবে।”
কালু হঠাৎ গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “আমি আর যাব না। আপনারা খুনখারাপি করবেন, সেটা চোখে দেখা আমার সহ্য হবে না। শুখানালার সীমানা ডিঙোলেও আমাদের বিপদ আছে, সে আপনারা ভূতপ্রেত মানুন বা না-মানুন।”
তিন মোলায়েম স্বরে বলে, “আমরা পাঁচজন শক্তপোক্ত পুরুষ-মানুষ যদি ভয় খাই তবে অভয় সরকারের মতো ভেড়য়া শুখানালায় ঢুকল কী করে? তার ভয়ডর নেই? ওসব চালাকি ছাড়ো। গাঁয়ের লোকের অনেক কুসংস্কার থাকে। ওসব আমরা মানি না। আর খুনের কথা বলছ? অভয় সরকারকে যদি না পাই তা হলে তোমার নিজের দশা কী হবে জানো? যা বলেছি ঠিক তাই রব, দু-আধখানা করে কেটে ফেলে রেখে যাব জঙ্গলে। চলল!”
কালু তবু সভয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনু তাকে দমাস করে এমন একখানা ঘুসি মারল মুখে যে, কালু ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। সামনের একটা দাঁত উপড়ে গিয়ে গলগল করে রক্তে ভেসে গেল তার মুখ।
“ওঠ শয়তান।” হুকুম দিল তিনু।
কালু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। হাতে তার নিজের ওপড়ানো দাঁতখানা রক্তে ডুবে আছে। চোখে জল এল কালুর। নীরবে সে মুখ ফিরিয়ে চলতে শুরু করল। পেছনে চার সশস্ত্র নিষ্ঠুর খুনি, তার পালানোর উপায় নেই।
তীক্ষ্ণ চোখে চারজন তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখছে শুখানালার খাত। অভ্যস্ত চোখে ধরা পড়ছে অভয় সরকারের গমনপথ। তারা বেশ দ্রুতই এগোতে লাগল। শিকার আর দূরে নেই।
হঠাৎ এক জায়গায় দেখা গেল, খাতের মধ্যে মথিত ঘাসের চিহ্ন শেষ হয়েছে। অর্থাৎ খাতের মধ্যে অভয় সরকার ওখানেই ঘাপটি মেরে আছে।
তিনু চাপা গলায় বলে, “এইবার! শয়তানটা ওখানেই নিশ্চয় নেতিয়ে পড়ে আছে। লেট আস ফিনিশ হিম।”
কালুকে পেছন থেকে একটা লাথি মারল তিনু। কালু লাথি খেয়ে গড়িয়ে খাতের মধ্যে পড়ে গেল। পেছনে চারজন নেমে এল বেড়ালের মতো তৎপর পায়ে। চপার দিয়ে চারদিককার আগাছা সাফ করে যখন তারা সন্দেহজনক জায়গাটায় এল তখন দেখা গেল, সেখানে অভয় সরকার নেই।
পচা হঠাৎ চাপা গলায় বলল, “ব্যাটা ওখান দিয়ে উঠে গেছে। ওই যে মাটির গায়ে দাগ।”
খাত থেকে অভয় যেখানে উঁচু পাড়ে উঠেছিল সে জায়গায় নরম মাটিতে তার হাঁচোড়-পাঁচোড়ের দাগ এখনও টাটকা। পাঁচজন জায়গাটা দেখছিল।
আচমকা দূরে এক জলকল্লোল শুনতে পেল পাঁচজনই। তিনু কালুর দিকে ফিরে বলল, “এখানে ঝরনা আছে কোথাও? শব্দ কিসের? এতক্ষণ তো শুনতে পাইনি!”
কালুর মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে। ঠোঁট কাঁপছে। সে মাথা নেড়ে জানাল, এখানে ঝরনা নেই।
তিনু জলের শব্দ যেদিক দিয়ে আসছে সেদিকে চেয়ে থেকে বলল, “এ তো দেখছি সাঙ্ঘাতিক স্রোতের শব্দ! নিশ্চয়ই পাহাড়ি নদীটদী আছে।”
কালু অস্ফুট গলায় বলল, “কাজটা আপনারা ভাল করেননি। এই এলাকা ভীম সরকারের। আমরা কেই ওকে চটাই না।”
“চোপ!” বলে তিনু একটা ধমক দিল। বস্তুত সে বুঝছিল না যে, জলের শব্দ শুনে কালুর এত ভয় পাওয়ার কী আছে। ঝরনা বা পাহাড়ি নদীর শব্দ তো এরকমই হয়!
পচা বলল, “অভয় তা হলে আরও কিছুটা এগিয়ে গেছে! তিনুদা, আজ আর আমাদের সন্ধের গাড়িটা ধরা হল না।
অলরেডি সন্ধে হয়ে এল। দেখেছ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক।”
তিনু চিন্তিতভাবে ঘড়ি দেখে বলল, “দেখছি। কিন্তু আমার হিসেবমতো অন্ধকার হতে আরও আধঘণ্টা লাগা উচিত। এত তাড়াতাড়ি তো আলো মরে যাওয়ার কথা নয়!”
ল্যাংড়া বলে, “জঙ্গলে তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়, এ তো সবাই জানে।”
তিনু তবু চিন্তিতমুখে ভ্রূ কুঁচকে আকাশটা দেখল। আর আচমকাই সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “ও কী?”
প্রত্যেকেই চমকে সামনের দিকে ঘুরে তাকাল। দূরের জলকল্লোল কাছে চলে এসেছে এবং মেলট্রেনের মতোই ধেয়ে আসছে প্রলয়ঙ্কর জলরাশি। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে সফেন জলরাশির শীর্ষে ঢেউ যেন লক্ষ হাত তুলে প্রবল এক প্রতিবাদেই ধেয়ে আসছে।
তিনুকে এই প্রথম ভয় পেতে দেখা গেল, সে চেঁচিয়ে কালুকে ধমকাল, “এই বদমাশ! ওঠ ওপরে, আমাকে টেনে তোল।”
কালু তিলমাত্র দেরি না করে এক লাফে ওপরে উঠে গেল। তিনু আর তার তিন সঙ্গীও উঠে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে দিয়ে উত্তাল জলরাশি কূল ছাপিয়ে ধেয়ে এল। তীর থেকে তাদের চারজনকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে তরঙ্গে-তরঙ্গে লোফালুফি করতে করতে নিয়ে চলে গেল!
কালুরও যাওয়ার কথা। কিন্তু ভাগ্য ভাল, কোমরের দড়ির প্রান্তটা তিনু ধরে রাখতে পারেনি।
কালু আর দাঁড়াল না। প্রাণপণে পিছু ফিরে ছুটতে লাগল। ছুটতে-ছুটতেই দেখতে পেল, শুখানালা খটখট করছে শুকনো। কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই। শব্দ নেই। স্রোত নেই।
কুঞ্জগুড়ো পুরস্কারের পরিমাণ দৃ লাখ পর্যন্ত বাড়িয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিলেন। ঢ্যাঁড়াওয়ালা যখন থানার সামনে দিয়ে ঢ্যাঁড়া বাজিয়ে চোঙা ঠুকে সুসংবাদটি প্রচার করে গেল তখন আর সুদর্শনবাবু থাকতে পারলেন না। মোট চারজন নির্ভরযোগ্য সেপাইকে ডেকে লাইন আপ করিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, “তোমরা কে কে দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত?”
সেপাই লালারাম এই কথায় বুক ফুলিয়ে বলল, “দেশের জন্য হুজুর, জান তো জান, এক মাহিনার তলব ভি দিয়ে দিব।”
সেপাই মগন বলল, “দো মাহিনাকা তলব আর জান ভি।”
কিচলু বলল, “হাঁ হাঁ জরুর, কিউ নেহি। জান লিবেন সো তো আচ্ছা বাত। আউর হামার তিন মাহিনাকা তনখা আর দোটো ভৈঁস ভি দিয়ে দিব মালিক।”
রামু বলল, “আজ্ঞে, আমার ছেলেবেলা থেকেই ক্ষুদিরামের মতো দেশের জন্য ফাঁসিতে ঝোলার বড় শখ। তা হুজুরের দয়ায় সেরকমটা হলে বড় ভাল হয়। আর ফাঁসিতে যেতে-যেতে ওই গানটাও কিন্তু আমাকে গাইতে দিতে হবে, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী…”।
লালারাম বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, “হজৌর, জান কখুন দিতে হোবে? জারা আগারি বললে থোড়া বহুত রোটি আর মূলি কি সজী খায়ে লিব। আউর এক লোটা দুধ।”
মগন বলল, “হমি জারা রামজিকি ভজন ভি কোরে লিব। আউর এক দফে পূজা চড়িয়ে দিব বজরঙ্গবলী কি মন্দিরমে।”
কিচলু মাথা চুলকে বলে, “এক দফে হরদোয়ার ঘুমে আসলে দেশকা লিয়ে জান দেনে সে কোই হরজা নেহি।”
রামু বলল, “আমার ওসব নয় বাবা। কলকাতার রায়ট রেস্টুরেন্টের কবিরাজি কাটলেট আর মোগলাই পরোটা একবারটি খেয়ে নিলেই হবে। আর একটা হিন্দি সিনেমা।”
সুদর্শনবাবু রুমালে কপাল মুছতে মুছতে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে খানিকক্ষণ পায়চারি করে বললেন, “ওসব মতলব ছাড়ো। দেশ তোমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করতে ডাকছে। এখনই,
এই মুহূর্তে। আর সময় নেই। একটু আগে শুনলে তো, চোঙা ফুকে কী বলে গেল!”
লালারাম অবাক হয়ে বলে, “উতো কুঞ্জবাবুকা কোঠি মে ডাকাকা বাত। উনকো লুটা মাল আপস লানে পর কুছ মিলেগা!”
সুদর্শনবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, “কুছু নয় রে বাবা, কুছ নয়। কুছ বলে তুচ্ছ করিস না। দু লাখ! বুঝলি!দু লাখ!”
“হ হাঁ, দো-চার লাখ কোই বাত নেহি।”
সুদর্শনবাবু অবাক হয়ে বলেন, “বলিস কী? দু-চার লাখ কোনও কথাই নয়! দু লাখে কত হয় জানিস? দু’শো হাজার টাকা!”
“হবে মালিক। হামি গরিব আমি। দো-পাঁচ জানি, দো-চারশো জানি, লেকিন উসকা জেয়াদা কুছু জানি না।”
রামু বিরক্ত হয়ে বলে, “কিন্তু কী করতে হবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না বড়বাবু।”
“বলছি, বলছি। ডাকাতরা শুখানালার সরকারদের পোড় বাড়িতে সব মাল মজুদ করেছে। মালটা আমাদের উদ্ধার করতে হবে।”
শুখানালার নাম শুনেই চারজন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। লালারাম বলল, “উ হোবে না মালিক।”
একগাল হেসে সুদর্শনবাবু বললেন, “শোন রে শোন, আমি ঠিক করেছি তোদের চারজনকে পাঁচ… না, পাঁচ কেন, দশ-দশ হাজার করেই দেব। বাকি লাখ-দেড়েক আমার থাকবে।”
“উ হোবে না মালিক।” রামু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “মোটে দশ হাজার! ধুস!”
সুদর্শনবাবু বললেন, “আচ্ছা, না হয় আরও হাজার টাকা ১০০ দিলুম।”
রামু মাথা নাড়ল, “পোষাচ্ছে না সার।”
বেশ কিছুক্ষণ দরাদরির শেষে ঠিক হল, সেপাইরা পঁচিশ হাজার করে পাবে। সুদর্শনবাবু পুরো এক লাখ। স্টেশনের লাখন, গাঁয়ের নেতাই, রেমো, আর অক্ষয়কে নিতে হবে। তারা শুখানালা যাওয়ার একটা শর্টকাট চেনে। তবে ওদের কোনও ভাগ দেওয়া হবে না। পঞ্চাশটা করে টাকা ফেলে দেওয়া হবে শুধু। কাল শেষ রাতেই রওনা দিতে হবে।
তূপের ওপর সারারাত লাঠি হাতে বসে রইল অভয়। বসে বসেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ঘুম যখন ভাঙল তখন চারদিকে যেন স্বর্গের ছবি। কুয়াশামাখা আকাশে দিপ-দিপ করছে নিবন্ত সব তারা। পাখি ডাকছে। আর শরীরে যেন আনন্দের ঢল নেমে এসেছে অভয়ের। মনটা হালকা, শরীরটাও ভারী ফুরফুরে। সে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখল। এখনও ফরসা হয়নি বটে, কিন্তু শেষ রাতের মরা-জ্যোৎস্নায় অনেকটা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এবাড়িতে ছিল বিশাল বাগান, পুকুর, আস্তাবল, গোয়াল, ছিল নহবতখানাওয়ালা ফটক, কাছারি। কালের অমোঘ নিয়মে সব মাটিতে মিশে গেছে। তবু এই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তার খুব চেঁচাতে ইচ্ছে করল আনন্দে। তাই সে চেঁচাল, “এই হচ্ছে আমার বাড়ি! আমার বাড়ি!”
সেই শুনে যেন একটা পাথরের পরি তার শেষ ঠেকনোটা ভেঙে হঠাৎ গড়িয়ে পড়ল। দু-আধখানা হয়ে গেল ভেঙে।
“আহা রে।” বলে এগিয়ে গিয়ে অভয় পরিটাকে তুলতে গেল। এবং সবিস্ময়ে দেখল, পরির ফাঁপা পেটের ভেতরে একটা লোহার বাক্স। কাঁপা হাতে সে বাক্সটা তুলে নিয়ে খুলল। যা দেখল তা অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
বাক্সটা বুকে ধরে চুপ করে বসে রইল অভয়। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠল। অভয় উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আমি আবার সব গড়ে তুলব।”
নিজের গলার স্বর শুনে অভয় চমকাল না বটে, কিন্তু চারদিক চমকাল। অভয় নিজে বুঝতেও পারল না সে কতটা বদলে গেছে এক রাতে। সেই থলথলে, ভিতু, করুণার পাত্র অভয় আর নেই। বদলে দাঁড়িয়ে আছে এক শক্তিমান পুরুষ, অকুতোভয়। তার চোখে ঝলকাচ্ছে আত্মবিশ্বাস।
অভয় জানতেও পারল না, জঙ্গলের ভেতরে ঝোঁপঝাড় ভেঙে সুদর্শনবাবু আর তাঁর দলবল একটা বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। চারজনের হাতে রাইফেল, সুদর্শনবাবুর হাতে রিভলভার, নেতাই, অক্ষয় আর রেমোর হাতে পাকা বাঁশের লাঠি।
রেমো বলল, “হুজুর, এই হল সরকার বাড়ির চৌহদ্দি। আমাদের চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য ভাল যে, এই অবধি আসতে পেরেছি।”
একটু ধরা গলায় অক্ষয়ও বলল, “ভীম সরকারের এলাকায় কখন যে কী ঘটে যায় কিছু বলা যায় না।”
বাঁশঝাড়ের আড়াল পেরিয়ে তারা ধ্বংসস্তৃপটার মুখোমুখি হল।
সুদর্শনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “ওটা কে রে, ওই উঁচুতে দাঁড়িয়ে? ডাকাত নাকি?”
আচমকাই অক্ষয় বিকট আর্তনাদ করে উঠল, “ওরে বাবা, ও যে ভীম সরকার। সেই ন্যাড়ামাথা! সেই তেজী চেহারা! ওরে বাবা রে…”
রেমো চোখ বুজে “রাম, রাম করতে করতে কাঁপা গলায় বলল, “বড়বাবু! আজ আর রক্ষে নেই। কাঁচাখেগো দেবতা যে! ওই তো ভীম সরকার.”।
নেতাই হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, “আপনার জন্যই এই সর্বনাশটা হল বড়বাবু! ভীম সরকার আর রক্ষে রাখবে না…”
তিনজন ঘুরে দোড়তে শুরু করতে-করতেই চারজন সেপাই “আই বাপ রে” বলে তাদের পিছু নিল। ভয় জিনিসটা অতি সংক্রামক, সুদর্শনবাবু অতি সাহসের সঙ্গে আরও ছয় সেকেন্ড দাঁড়িয়ে লোকটার দিকে হাঁ করে চেয়ে ছিলেন। হ্যাঁ, ভীম সরকার হতেও পারে।
দু লাখ টাকার কথা বেবাক ভূলে সুদর্শনবাবুও ঘুরে দৌড়তে লাগলেন। তাঁর ভুড়ি প্রবলবেগে লাফাতে লাগল। প্রতিবাদ করতে লাগল হাঁটু। তবু প্রাণের ভয় বড় ভয়। তিনি তিলেক দাঁড়ালেন না। শুধু বলতে লাগলেন, “ওরে, তোরা আমাকে একা ফেলে যাসনি। ধর্মে সইবে না। দুনিয়ায় দারোগাদের মতো দুর্গতি আর কারও নেই রে বাপ। কবে যে তোরা দারোগার দুঃখ বুঝবি?”
আর-একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ এক মানুষও অভয়কে দেখছিলেন। তিনি ব্রহ্মদৈত্য। অভয়কে চিনতে তাঁর বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয়নি। তবু তিনি দেখছিলেন, আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে একটা মানুষ কত বদলে যায়। কালকেও এ-লোকটা ছিল অসহায়, দুর্বল, ভিতু। আর আজ!
জঙ্গলের ওপর দিয়ে একটা ঝটকা হাওয়া বয়ে গেল। একটা সবুজ পাতা খসে পড়ল অভয়ের ন্যাড়া মাথায়। যেন এইমাত্র কেউ সবুজ একটা রাজমুকুট পরিয়ে দিল তার মাথায়। ক্লান্ত দেখাচ্ছিল অভয়কে। তবু মনে হল, রণক্লান্ত এক দিগ্বিজয়ী রাজা।
গৌরবর্ণ পুরুষটি স্মিত হাসলেন। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, “দুঃখী মানুষ, তোমার ভাল হোক।”