ইদানীং কানাইদারোগার দিনে বা রাতে মোটেই ঘুম হচ্ছে না। একটু ঝিমুনির মতো এলেও বিকট সব স্বপ্ন দেখে চমকে ওঠেন, চটকা ভেঙে যায়। ঘুমের সঙ্গে সঙ্গে খিদেও উধাও। মাংস-পোলাওয়ের দিকেও তাকাতে ইচ্ছে করে না, এতই অরুচি। ফলে তাঁর শরীর শুকোতে শুকোতে একেবারে দরকচা মেরে সিকিভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেকার জামা-প্যান্ট সব ঢলঢলে হচ্ছে বলে দরজিকে দিয়ে ছোট করাতে হয়েছে। ঘনঘন জলতেষ্টা আর বাথরুম পাচ্ছে। গত কালই খবর এসেছে যে, সরকার বাহাদুরের তরফ থেকে রাখালহরিকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরে দিলে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু সেটা কানাইবাবুর পক্ষে কোনও আশার বাণী নয়, বরং আশঙ্কারই কথা। এর অর্থ হল, রাখালহরি যে কতটা ভয়ংকর তা সরকার বাহাদুরও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পুরস্কারের নোটিশটা থানার নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়ার কথা, তার উপর ঢোল সহরত করে প্রচারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু কানাই সাহস করে উঠতে পারেননি। নোটিশ দিলে রাখালহরি পালটা নোটিশ দেবে। যতই ভাবেন ততই মাথা ঝিমঝিম করে। ডাক্তার বলেছে, রক্তচাপ খুব বেশি, উত্তেজনা একদম বারণ।। |||||||||| আগে একজোড়া বেশ পুরুষ্টু গোঁফ ছিল কানাইবাবুর। অনেকটা ঝাঁটার মতো। রোগা হয়ে যাওয়ায় মুখে গোঁফটা মানাচ্ছে না দেখে হেঁটে ছোট করে ফেলেছেন। সকালে থানায় নিজের ঘরে বসে সরু গোঁফে তা দেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন তিনি। এমন সময় বিশাল চেহারার নসিবাবু ভারী হাসি হাসি মুখ করে ঘরে ঢুকে বললেন, “নমস্কার দারোগাবাবু! তা আপনিই এ থানার নতুন দারোগা বুঝি! বেশ বেশ! কানাইদারোগাটা কোনও কাজের ছিল না মশাই! তার আমলেই এ তল্লাটে চুরি-ডাকাতির একেবারে মোচ্ছ। লেগে গিয়েছিল। কী বলব মশাই, আমার ছেলে কাশীরাম তো তিন তিনটে দুর্ধর্ষ ডাকাতি করার পরও দিব্যি গায়ে ফু দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কানাইদারোগা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। এই আপনি এসে তাকে পাকড়াও করলেন। তা তাকে কি সদরে চালান করা হয়েছে নাকি দারোগাবাবু? চালান করাই উচিত। সে অতি বিপজ্জনক লোক।”
কানাইদাবোগা নাক কুঁচকে একটা তাচ্ছিল্যের ফুঃ দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো হাতের ভঙ্গি করে বললেন, “হুঁ, কাশীরাম করবে ডাকাতি! এ যে বানরে সংগীত গায়, শিলা জলে ভাসি যায়, মশাই! যে রাতে বিড়াল ডাকলে ভয় পায়, দু’কেজি মাল টানতে হাঁপিয়ে পড়ে, বিশ কদম হাঁটতে গিয়ে টাল্লা খায়, সে করবে ডাকাতি! তাও একটা-দুটো নয়, তিনটে! সত্যযুগ এসে গেল নাকি মশাই?”
নসিবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, “আহা, কার ভিতরে কোন প্রতিভা লুকিয়ে আছে তা কি বাইরে থেকে টপ করে বোঝা যায় ? কিন্তু আপনি নতুন মানুষ, কাশীরাম সম্পর্কে এত কথা জানলেন কী করে?”
কানাইবাবু খ্যাঁক করে উঠে বললেন, “কে বলেছে আমি নতুন মানুষ? আমিই কানাইদারোগা। আপনি চোখের ডাক্তার দেখান।”
নসিরাম হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “ইস, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে তো! ভাল করে দেখে এখন আপনাকে কানাইদারোগা বলেই মনে হচ্ছে যেন! তা এই তত দিন বিশেক হল কাশীরামকে আপনার সেপাইরা গিয়ে ধরে নিয়ে এল! রীতিমতো ওয়ারেন্ট দেখিয়ে। এখন বললেই হল যে তাকে ধরা হয়নি?”
কানাইদারোগা ফুঁসে উঠে বললেন, “আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে, কাশীরামকে ধরতে যাব! ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ কানাইদারোগা করে না। আমার এখন পাহাড়-পর্বতের মতো বিরাট বিরাট ডাকাত নিয়ে কারবার। আপনার ওই ননির পুতুল ছেলে কাশীরামকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। বিশ্বাস না হয়, নিজেই গিয়ে লকআপটা দেখে আসুন। দু’জন ছিচকে চোর ছাড়া আর কেউ নেই।”
নসিরাম মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “সর্বনাশ! তা হলে কাশী গেল কোথায়? তাকে লকআপে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়নি তো?”
গম্ভীর হয়ে কানাইদারোগো বললেন, “দেখুন নসিবাবু, পুলিশেরও ঘেন্নাপিত্তি আছে। যে ফুলের ঘায়ে মূৰ্ছা যায় তাকে ধরে এনে পেটানোর মতো আহাম্মক তারা নয়। ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখুন গে, হয়তো বুচিকে বিয়ে করার ভয়ে কোথাও গিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে।”
“সর্বনাশ! সর্বনাশ!” বলতে বলতে নসিবাবু তাড়াতাড়ি থানা থেকে বেরিয়ে ছুটতে লাগলেন।
আর ঠিক এই সময় নীলপুরের ভয়াল জঙ্গলের একেবারে ভিতরে একটা ভারী নিরিবিলি জায়গায় কাশীবাবু বিশ ফুট উঁচুতে শূন্যে একটা দড়িতে ঝুল খেয়ে এক গাছ থেকে আর-একটা গাছে যাচ্ছেন। বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই তিনি দড়ি ধরে ঝুলছেন, তেমন কোনও বিকার নেই তাঁর মুখে। বরং একটু যেন হাসি হাসি ভাবই লেগে আছে। এর আগে ভোরবেলা উঠে চাটি ভেজানো ছোলা আর আদা খেয়ে মাইল চারেক দৌড়োত হয়েছে তাঁকে। তারপর দুশো ডন আর দুশো বৈঠক, মুগুর ভাঁজা, যুযুৎসু অনুশীলন এবং কুস্তি করতে হয়েছে তাঁকে। নির্বিকারভাবেই করে গেছেন। প্রথম কয়েক দিন হাঁফ ধরে যেত, গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হত। আজকাল আর ওসব হয় না।।
দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে এক গাছ থেকে একশো ফুট দূরের আর এক গাছে গিয়ে উঠতে তাঁর বেশ মজাই লাগছে। বিশ ফুট নীচে উর্ধ্বমুখে দাঁড়িয়ে তাঁর এই কসরত খুব মন দিয়ে দেখছে রাখালহরি আর তার প্রায় পঞ্চাশজন স্যাঙাত। প্রত্যেকের মুখেই বেশ শ্রদ্ধার ভাব। রাখালের মুখে একটু তৃপ্তির হাসি। স্যাঙাতদের দিকে চেয়ে বলল “ওরে, ওকে আমি ঠিকই চিনেছিলুম। গায়ে আমার রক্তটা তো আছে। যা এলেম দেখাচ্ছে তাতে একদিন আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে। কী বলিস তোরা ?”
সবাই একমত হয়ে হর্ষধ্বনি করল। কাশীবাবু একশো ফুট পার হয়ে গাছের ডালে উঠে পড়লেন। তারপর সাবলীল ভঙ্গিতে নেমে মাটিতে পা রাখতেই রাখালহরি এসে তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “শাবাশ, এই তো চাই। মাত্র কুড়ি দিনে তোর যা উন্নতি দেখলাম, অন্যদের এক বছরে হয় না।”
এই সাধুবাদে কাশীবাবুর অবশ্য কোনও ভাবান্তর হল না। আজকাল তিনি খুবই নির্বিকার হয়ে গেছেন। যা বলা হচ্ছে যন্ত্রের মতো তাই করে যাচ্ছেন। রাখালহরি এবার ভারী আদুরে গলায় বলল, “বাবা খাঁদু, এবার যে তোর হাতে-কলমে পরীক্ষা। আজ রাতেই তোর ডাকাতির হাতেখড়ি। আমি ঠাকুরমশাইকে দিয়ে পাঁজি দেখিয়ে রেখেছি। সন্ধের পর একটা জোর মাহেন্দ্রক্ষণ আছে।”
কাশীবাবু বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, “যে আজ্ঞে।”
“প্রথম কাজটা সোজাই দিচ্ছি। বিপদের তেমন ভয় নেই। খুনখারাপি বা মারকাট আমি কোনওদিনই পছন্দ করি না। ডাকে হাঁকে-হুমকিতে কাজ হয়ে গেলে রক্তপাত না করাই ভাল। আজ তুই দলবল নিয়ে সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়বি। সোজা মামুনগড় শশীরামের বাড়ি। তোর চেনা বাড়ি, অন্ধিসন্ধি সবই জানা। ভয়ডরের ব্যাপার নেই। শশীবাবুর একটা একনলা বন্দুক আছে বটে, তবে সেটা মরচে ধরে গেছে বলেই খবর। পারবি না?”
কাশীবাবু খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে বললেন, “খুব পারব।”
খুশি হওয়ার দুটো কারণ আছে কাশীবাবুর। এক কথা, এত দিন পর বাড়ি যাবেন। দু’নম্বর হল, বাপ-দাদাকে একটা শিক্ষা দিয়ে আসা যাবে। কথাটা ভেবে তিনি বেশ চনমনে বোধ করতে লাগলেন।
রাখালহরি তার দলের দিকে ফিরে বলল, “ওরে তোরা সবাই শোন, মহিষবাথানের জঙ্গল থেকে ছিচকে ডাকাতগুলো আমাকে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, আমার ভাইপো খাঁদু গড়াই নাকি এখন ওদের কজ্জায়, দশ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ পেলে ছেড়ে দেবে। সঙ্গে খাঁদু গড়াইয়ের একটা ছবিও পাঠিয়েছে। মর্কটের মতো দেখতে একটা হাড়গিলে চেহারার লোক। দেখে হেসে বাঁচি না। তা আমার টাকা-পয়সার লোভে অনেকেই এখন আমার ভাইপো হতে চাইবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আমি ওদের জানিয়ে দিয়েছি, ওরা যা খুশি করতে পারে, আমি এক পয়সাও দেব না।”
সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল। খবরটা শুনে কাশীবাবুর কোনও হেলদোল হল না। দুপুরে তিনি মাংস দিয়ে প্রচুর ভাত খেয়ে ঘুমোলেন। তারপর বিকেলে উঠে জীবনে প্রথম ডাকাতির জন্য তৈরি হতে লাগলেন।
ঘড়ি ধরে একেবারে মাহেন্দ্রক্ষণে ঠাকুরমশাই এসে মন্ত্রপাঠ করে সকলের কপালে তেল-সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে প্রসাদী জবাফুল মাথায় ঠেকিয়ে শুভযাত্রায় রওনা করিয়ে দিলেন।
জিপ গাড়িতে উঠে ভারী ফুর্তি হচ্ছিল কাশীবাবুর। এই না হলে জীবন! তিনি গুনগুন করে গাইতে লাগলেন, ‘হারে-রে-রে-রে-রে— আমায় ছেড়ে দে রে, দে রে…’তারপর গাইলেন, ‘কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট…’
চোখে একটু আনন্দাশ্রু এসে গিয়েছিল, সেটা মুছে মন্ত্র স্বরে আবৃত্তি করতে লাগলেন, “আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান, না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ..” তারপর গাইলেন, “উর্ধ্বগগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল…”
মামুনগড়ে তাঁদের বাড়ির সামনে এসে যখন জিপগাড়ি থামল, তখন মোটে রাত আটটা। কমলেকামিনী দেবী ঠাকুরঘরে বসে মালা জপছেন, নবদুর্গা দেবী রান্নাঘরে রাঁধুনিকে তেলকই রান্নার কায়দা শেখাচ্ছেন, নরহরি তার ঘরে বসে সুর করে রামায়ণ পড়ছে, শশীরাম দুধ, খই আর মর্তমান কলা দিয়ে তাঁর নৈশাহার সেরে নিচ্ছেন, আর নসিরাম গাঁয়ের জনাচারেক মাতব্বরের সঙ্গে বাইরের বারান্দায় বসে নিচু স্বরে শলাপরামর্শ করছেন। কাশীরাম যে তিন তিনটে ডাকাতি করেছেন, একথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারেননি তিনি। কাশীকে যে পুলিশে নিয়ে গেছে একথা শুনেও সবাই মুখ টিপে হেসেছেন, কারও প্রত্যয় হয়নি। তবে কাশীরাম যে নিরুদ্দেশ, এতে সকলেই উদবিগ্ন। কেউ বলছেন কাশী বিয়ের ভয়ে পালিয়েছে, কেউ বলছেন যে সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছে, কারও ধারণা বাবা আর দাদুর শাসনে অতিষ্ঠ হয়েই সে বিবাগী হয়ে গেছে।
ঠিক এই সময়ে কাশীরাম জিপ থেকে লাফ দিয়ে নামলেন। সঙ্গে আরও দশ-বারোজন বিশালদেহী ডাকাত, সকলেরই মুখে ভুসোকালি মাখা। চেনার জো নেই। কাশীরামের কোমরের দু’দিকে দুটো খাপে-ভরা পিস্তল, হাতে এ কে ফর্টি সেভেন। নেমেই তিনি “রে-রে-রে-রে-রে…,” বলে একটা গর্জন ছাড়লেন। গত পনেরো দিন যাবৎ এই গর্জনটা তাঁকে অনেক সাধনা করে শিখতে হয়েছে। ঠিক গর্জন নয়, একে বলে নাদ। নাভিমূল কাঁপিয়ে সেখান থেকে নাদটিকে পেটের ভিতর দিয়ে বুকে তুলে তবে গলা দিয়ে ছাড়তে হয়। এর শব্দে চারদিকে একটা বায়ুকম্প ওঠে। তাতে গাছের শুকনো পাতা সব খসে পড়ে, নেড়ি কুকুরেরা লেজ গুটিয়ে কুঁইকুই করে পালায়, গেরস্তদের দাঁতকপাটি লাগে।
নিতান্তই এটা বীরের বাড়ি বলে কারও দাঁতকপাটি লাগল না বটে, কিন্তু স্তম্ভন হল। যেমন কলা সাপটানো দুধ আর খইয়ের মণ্ডটা মুখে চালান করতে গিয়ে শশীরাম ওই অবস্থাতেই ফ্রিজ হয়ে গেলেন, নসিরাম কানাইদারোগার নিন্দে করতে গিয়ে সবে “কা” উচ্চারণ করেছেন, ওই হাঁ আর বন্ধ হল না। রাঁধুনি কই মাছ তেলে ছাড়তে গিয়ে সেই যে কাঠ হয়ে গেল, আর তেলের সঙ্গে মাছের দেখাই হল না। কমলেকামিনী দেবীর মালা টপকানোর আঙুল এমন জট পাকিয়ে গেল যে, মালা তার ঘূর্ণনবেগ হারিয়ে নেতিয়ে ঝুলে রইল, নবদুর্গা বসা অবস্থা থেকে উঠতে গিয়ে অর্ধেক উঠে সেই যে থেমে গেলেন, আর ওঠাও হল না, বসাও হল না। নরহরি রামায়ণের একটা সর্গ শেষ করে ভারী রামায়ণখানা তুলে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করছিল, সেই প্রণাম আর শেষ হচ্ছিল না। বারান্দায় বসা গাঁয়ের মাতব্বরদের কয়েকজনের মুছার মতো হয়েছিল, আর কয়েকজন বায়ুকম্পে কেতরে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন। কাশীবাবু বীরদর্পে বাড়িতে ঢুকে চারদিকের দৃশ্য দেখে ভারী খুশি হলেন। হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হেসে স্যাঙাতদের বললেন, “এইবার লুটপাট শুরু হোক।”
তাঁর স্যাঙাতরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে তাঁকে দেখছিল। তারাও হাঁকার দিয়ে থাকে বটে, কিন্তু তাতে এরকম কাজ হয় না। এ লোকটা এক হাঁকারেই বাড়িসুদ্ধ লোককে স্ট্যাচু বানিয়ে দেওয়ায় তারা ভারী অবাক। “যে আজ্ঞে,” বলে তারা কাজ শুরু করে দিল। একমাত্র রাখালহরিই এরকম হাঁকার দিতে পারে।।
শশীরাম শক্ত ধাতের মানুষ। স্তম্ভনটা চট করে কাটিয়ে উঠে তিনি পিটপিট করে চেয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন, “ও নসে, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি?”
নসিরামও সামলে উঠেছেন। বললেন, “হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে! অ্যাই তোরা কারা? ডাকাত নাকি? সিংহের গুহায় ঢুকেছিস ব্যাটারা, সে খেয়াল আছে? ও গিন্নি হাত-দাখানা দাও তো, দেখাচ্ছি মজা।”
শশীরাম তাড়াতাড়ি দুধ-খইয়ের হাত ধুতির খুঁটে মুছে নিয়ে আলমারি খুলতে খুলতে চেঁচাতে লাগলেন, “কই, আমার বন্দুকটা! ব্যাটাদের আজ মুন্ডু উড়িয়ে দেব।”
ফের অট্টহাসি হেসে কাশীরাম বললেন, “নসিবাবু, নারকেলের ছোবড়া কেটে কেটে আপনার হাত-দা কবেই ভোঁতা হয়ে গেছে। আর শশীবাবু, আপনার একনলা বন্দুকে যে মরচে ধরেছে, সে খবর কি আমাদের জানা নেই ভেবেছেন?”
শশীরাম হঠাৎ থতমত খেয়ে বললেন, “ওরে ও নসে, এই ডাকাতের গলাটা যে অবিকল আমার কেশোর মতো!”
নসিবাবুও একটু ঘাবড়ে গেছেন। আমতা আমতা করে বললেন, “হ্যাঁ, গলাটা সেরকমই তো মনে হচ্ছে।”
কাশীরাম পূর্ব অপমানের কথা সামলাতে না পেরে হঠাৎ অত্যন্ত দুঃখের গলায় গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন, “কারও কেউ নই গো আমি, কেউ আমার নয়, কোনও নাম নেই কো আমার শোনো মহাশয়…”।
শশীরাম গান শুনতে শুনতে তালে তালে মাথা নেড়ে ফের চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে নসে, এ যে আমাদের কাশীই রে! ভুল হওয়ার জো নেই।”
নসিরাম মাথা চুলকে বললেন, “তাই তো? এ তো কাশীই মনে হচ্ছে বাবা!”
“ওরে, আমি তখনই জানতাম, আমার কেশোর মতো ডাকাবুকো ছেলেকে আটকে রাখার মতো জেলখানা এখনও এদেশে তৈরি হয়নি। ওরে, কাশী জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছে! দ্যাখ, দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ, কেমন তেজি চেহারা! কেমন টগবগ করছে এনার্জিতে! ওর পুরুষকার জেগে উঠেছে! ও গিন্নি, উলুটুলু দাও! শাঁখটাখ বাজাও ! পাঁচজনে এসে দেখুক…”
কাশীরাম পেল্লায় এক ধমক দিয়ে বললেন, “চোপ! একদম চেঁচামেচি নয়! কাজে কোনওরকম বাধা দিলেই গুলি ছুটবে কিন্তু! নিন, আলমারিটা খুলে ফেলুন, টাকাপয়সা যা আছে বের করে দিন।”
শশীরাম অতি আলগোছের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “বটেই তো! বটেই তো! কাজের সময় বাজে কথা বলতে নেই। তা এই নে বাপু চাবি, সব চেঁছেপুঁছে নিয়ে যা দেখে আমি দু’চোখ সার্থক করি। ওঃ, এত দিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন! আহা, লুটেপুটে নে তো ভাই, আমি দু’চোখ ভরে দেখি!”
কাশীবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “বুড়োদের এই এক বদ স্বভাব। কেবল বকবক করবে। ওরে, তোরা ওঘরে গিয়ে নসিবাবুর বিছানার তোশকটা তুলে দ্যাখ তো!”
নসিবাবু ভারী আপ্যায়িত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ বাবারা, ভাল করে দ্যাখো, আমার তোশকের তলায় বেশ কয়েক হাজার টাকা আছে বটে। এই আনন্দের দিনে কিছু ফেলে যেয়ো না। গুনেগেঁথে নাও গে যাও।”
কাশীবাবু সদর্পে কমলেকামিনী দেবীর ঘরে ঢুকে বললেন, “এই যে দিদিমা, হাতের বালা দুটো চটপট খুলে দিন তো! একদম সময় নষ্ট করবেন না।”
কমলেকামিনী দেবী ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে আমার কাশী, ডাকাত হয়েছিস বলে কি সম্পর্ক উলটে দিলি দাদা? কোন আকেলে নিজের ঠাকুরমাকে ‘দিদিমা বলে ডাকছিস রে মুখপোড়া? কোন সুবাদে আমি দিদিমা হতে গেলুম বল তো হনুমান! এইটুকু বয়স থেকে বুকে করে মানুষ করলুম, মরার আগে তোর মুখে দিদিমা ডাক শুনব বলে? বালাজোড়া চাস, এই নে, খুলে দিচ্ছি, তোর বউকে এই বালা দিয়ে আশীর্বাদ করব বলেই রেখেছিলুম যা, নিয়ে যা। পুলিশের গুঁতো খেয়ে মাথাটাই তোর খারাপ হল কিনা কে জানে!”
কাশীবাবু হতাশায় মাথা নেড়ে আপনমনে বললেন, “ওফ, বুড়োবুড়িদের সঙ্গে আর পারা যায় না।”
রান্নাঘরে হানা দিয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে কাশীবাবু বললেন, “এই যে মাসিমা, গলার হারছড়া খুলে দিন আর গয়নাগাটি কোথায় আছে চটপট বের করুন। আমাদের সময় নেই।”
নবদুর্গা হাঁ করে চেয়ে বললেন, “ও বাবা কাশী, মুখে কালি মেখে কি মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় বাবা আমার! ভাবছিস মাসি ডেকে চোখে ধুলো দিবি। তাই কি হয় রে বাবা! ডাকাতি করছিস না হয় কর। কিন্তু অত খাটুনি কি তোর সইবে বাবা! শুকিয়ে যে আধখানা হয়ে গেছিস। পিড়ি পেতে বোস তো বাপ, গরম গরম দুটো ভাত খা। তেলকই আছে, পোস্তর বড়া, ধোঁকার ডালনা আর শেষ পাতে পায়েস। গয়নাগাঁটি যা চাস বের করে দিচ্ছি বাবা, শুধু মাথার দিব্যি, দুটি খেয়ে যা!”
কাশীরাম সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, “লৌকিকতার কোনও দরকার নেই। এখন আমাদের কাজের সময়। তাড়াতাড়ি করুন।”
নবদুর্গা তাড়াতাড়ি হার খুলে দিলেন। আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে হাতে দিয়ে বললেন, “আলমারির কোথায় কী আছে সবই তো জানিস বাবা, বের করে নিগে যা। ওরে শোন, ছেলেবেলায় আমাদের গাঁয়ের কালুডাকাতকে দেখেছি, রোজ দু’সের করে মাংস, পাঁচ পো দুধ আর আধসের করে ভেজানো ছোলা খেত।”
বাজে কথা শোনার সময় নেই কাশীরামের। তিনি চটপট শোওয়ার ঘরে গিয়ে গয়নার বাক্স বের করে নিলেন।
আধঘণ্টার মধ্যেই ডাকাতি শেষ করে সবাই মিলে গিয়ে জিপে উঠে রওনা হয়ে গেলেন।
শশীরাম আহ্লাদে গদগদ হয়ে বললেন, “দেখলি নসে?”
নসিবাবুর মুখও উজ্জ্বল, বললেন, “দেখলুম বই কী?” মাতব্বররাও সব আড়াল-আবডাল থেকে বেরিয়ে এলেন।
উপেনবাবু বললেন, “নসিবাবু, ক্ষমা করবেন। আপনার কথা প্রথমটায় বিশ্বাস করিনি। আমাদের নড়েভোলা কাশী যে জীবনে এত উন্নতি করবে সেটা তো কল্পনাও করিনি মশাই।”
যোগেনবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “নসিবাবু, একটু দেখবেন। কাশীরামের যা দাপট দেখলাম, আমরা গরিবরা না বেঘোরে পড়ি!”
বিরিঞ্চি পোদ্দার গম্ভীর মুখে বললেন, “না না, এটা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। শত হলেও কাশীরাম যে সমাজবিরোধী হয়ে গেল, এটা মোটেই ভাল হল না।”
খগেন পাল খিচিয়ে উঠে বলে, “রাখুন তো মশাই সমাজবিরোধী! সমাজবিরোধী না হলে এ-যুগে তালেবর হওয়া যায় নাকি? একটা তালেবর লোক খুঁজে বের করুন তো, যে সমাজবিরোধী নয়। এই যে কানাইদারোগা থানায় বসে বসেই রোজ কাঁড়ি কাঁড়ি ঘুষ খাচ্ছে, সে সমাজবিরোধী নয়? নগদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, মুরগি, মাছ, পাঁঠা, হাঁড়ি-ভরতি রসগোেল্লা, বউয়ের জন্য শাড়ি, কী না নিচ্ছে বলুন?”
ফের একটা তর্ক বেধে উঠল এবং সবাই উত্তেজিতভাবে আলোচনায় বসে গেলেন।
ওদিকে নগেন মহিষের বাড়িটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় কাশীবাবুর মাথায় চিড়িক করে একটা পুরনো ঘটনা খেলে গেল। অনেক দিন আগে গাঁয়ে বাগদিবাড়ির বউ’ বলে একটা যাত্রাপালা হয়েছিল। কাশীবাবু তখন খুব ছোট, পালিয়ে গিয়ে চুপিচুপি যাত্রার আসরের তাঁবুর ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন। নগেন মহিষ তাঁকে ধরে ফেলে এবং টিকিটবাবুদের হাতে তুলে দেয়। টিকিটবাবু আচ্ছাসে কান মলে বের করে দিয়েছিল তাঁকে।
মনে পড়তেই ‘রোখকে, রোখকে’ বলে জিপ থামিয়ে লাফ দিয়ে নামলেন কাশীবাবু, তারপর সেই ‘রে-রে-রে’ গর্জন। চারদিকে ফের বায়ুকম্প, কুকুরেরা কেঁউ কেঁউ, কাকেরা কা কা করতে থাকল, বাড়ির ভিতর নগেন মহিষের মহিষী মূৰ্ছা গেলেন এবং নগেন মহিষ ডাল মাখা ভাতের গরাস মুখে দিতে গিয়ে নিজের ডান কানে খুঁজে দিলেন।
পদাঘাতে দরজা ভেঙে বীরদর্পে ঘরে ঢুকলেন কাশীরাম। একটা অট্টহাসি হেসে বললেন, “এই যে নগেনবাবু, এবার?”
নগেন মহিষ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “প্রাণে মেরো না বাবা, যা আছে নিয়ে যাও।”
স্যাঙাতরা যথাসাধ্য লুটপাট চালাতে লাগল বটে, কিন্তু হাবু বলল, “ওস্তাদ, ভুল বাড়িতে ঢোকেননি তো! এ লোকটা নিতান্তই ছিচকে দেখছি। দামি জিনিসটিনিস নেই!”
কাশীরাম হুকুম দিলেন, “যা আছে তাই নাও। একে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।”
হঠাৎ নগেন মহিষও কাশীরামকে চিনতে পারলেন। একগাল হেসে বলে উঠলেন, “ওরে, তুই আমাদের কাশী না? হ্যাঁ কাশীই তো। ওরে তোকে যে কত কোলেপিঠে করেছি, সব ভুলে গেলি!”
কাশীবাবু পেল্লায় এক ধমক মারলেন, “চোপ! গোলমাল করলে খুলি উড়িয়ে দেব।”
“তা তো দিবি বাবা, কিন্তু পুরনো কথা কি সব ভুলে গেলি? সেই যে গুটিগুটি পায়ে এসে বাটি ভরে সত্যনারায়ণের সিন্নি খেয়ে যেতিস, মনে নেই। আর সেই যে সেবার, তোর গ্যাসবেলুনটা হাত ফসকে উড়ে গিয়েছিল বলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছিলি, দেখে আমি তোকে হরগোবিন্দর দোকান থেকে পঞ্চাশ পয়সার লজেঞ্জুস কিনে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে?”
কাশীবাবু বুক চিতিয়ে মন্দ্র স্বরে আবৃত্তি করতে লাগলেন, “ক্ষুদিরাম মোর নাম, নিবাস নীলপুর ধাম, খুল্লতাত রাখাল গড়াই, গহীন জঙ্গলে বসে, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস, সকলের সর্বস্ব সরাই।”
নগেন মহিষ গদগদ হয়ে বলেন, “ওরে চুরি-ডাকাতি করতে গেলে যে নাম ভাঁড়াতে হয়, তা কি আমি জানি না? যে নামই নিস
কেন বাবা, তুই যে আমাদের আদরের সেই ছোট্ট কাশী তা কি ভুলতে পারি? তুই নসিবাবুর ছেলে, শশীরামের নাতি!”
কাশীবাবু নাটুকে ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, “ওরে, বাপ-দাদা নাই, নাই বৃথা বসে ক্রন্দন, ওরে গৃহ নাই, নাই ফুলশেজ-রচনা। আছে শুধু কাকা, যেন অমিতাভ বচ্চন, ঊষা-দিশাহারা-নিবিড় তিমির আঁকা। ওরে ক্ষুদিরাম, ওরে ক্ষুদিরাম মোর। এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা।”
.
ঠিক এই সময় মাইল আষ্টেক দুরে মহিষবাথানের জঙ্গলে মশালের আলোয় একটা মস্ত শিশুগাছের তলায় একটা মিটিং বসেছে। চেয়ারম্যান প্রহ্লাদের হাতে একখানা খোলা চিঠি, তার জ্ব কোঁচকানো, মুখ গম্ভীর। সে বলল, “ভাইসব, চিঠির বয়ান পড়ে মনে হচ্ছে রাখালহরি তার ভাইপোর জন্য মুক্তিপণ দিতে রাজি নয়।”
সড়কি সতীশ বলল, “তখনই তো বলেছিলাম দাদা, ওরকম মর্কটের মতো চেহারার একটা হাড়গিলের জন্য দরটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। দরটা কম করে দিলে খেয়ে যেত।”
লেঠেল ললিত বলল, “আহা, দর তো বেশি দেওয়ারই দস্তুর। পার্টি কষাকষি করলে দর নামানো যেত। কিন্তু এ তো মোটেই দরাদরিই করল না। ফস করে লিখে পাঠাল যে, এক পয়সাও দেব না, যা খুশি কর। খুড়ো হয়ে ভাইপোর উপর এতটা নৃশংস হওয়া কি রাখালহরির ঠিক হল? নাঃ, দিনকাল যা পড়েছে, সম্পর্কের আর দামই নেই।”
গুঁফো গণেশ ভারী হতাশার গলায় বলে, “নাঃ, এত মেহনত জলেই গেল। কেত্তনের দল নিয়ে গিয়ে কত কায়দা করে পাঁকাল মাছ ধরার মতো করে ধরে নিয়ে এলাম, বসিয়ে বসিয়ে কয়েক দিন ভালমন্দ খাওয়ালাম, তার একটা দাম নেই?”।
মারকুটে মহেশ বলল, “কিন্তু পাক্কা খবর ছিল রাখালডাকাত তার লাখো লাখো টাকা আর কয়েক মন সোনা, সেই সঙ্গে দল চালানোর ভার দেওয়ার জন্য হন্যে হয়ে তার ভাইপোকে খুঁজছে। তা আমরা তো সেই ভাইপোকেই খুঁজে দিচ্ছি। ভাইপোর চেয়ে কি টাকাটা বেশি হল? ওরে বাপু, ক’দিন পরে ওই খাঁদুই তো রাখালডাকাতের টাকার পাহাড়ের উপর গ্যাঁট হয়ে বসে হাওয়া খাবে।”
“না, খাবে না।” বলে চাকু চপল উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের ইনফর্মেশন নেটওয়ার্ক খুব খারাপ। আমি অনেক দিন ধরেই বলছি, আধুনিক টেকনোলজি আর সফিস্টিকেটেড নেটওয়ার্ক ছাড়া এ যুগে আমাদের কাজকর্ম চালানো সম্ভব নয়। মান্ধাতার আমলের ইনফ্রাস্ট্রাকচার কি এই ইলেকট্রনিকের যুগে চলে?”
প্রহ্লাদ বলল, “আহা, তোমার মোদ্দা কথাটাই ভেঙে বলো না বাপু! নেটওয়ার্কের ডেভেলপমেন্ট করতে তো সময় লাগবে। রাতারাতি তো হবে না। বলি ব্যাপারটা কী?”
চাকু চপল অত্যন্ত ব্যথিত গলায় বলল, “আপনারা একটা ভুল লোককে খাঁদু গড়াই ভেবে ধরে এনেছেন। ও খাঁদু ওরফে ক্ষুদিরাম গড়াই নয়। আসল খাঁদু গড়াই অলরেডি রাখালহরির ছত্রছায়ায় তৈরি হতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হল, ট্রেনিং পিরিয়ডে ক্ষুদিরাম গড়াই যে এলেম দেখিয়েছে, তাতে রাখালহরির ধারণা হয়েছে, খাঁদু তাকেও ছাড়িয়ে যাবে।।
সভায় প্রবল গুঞ্জন শুরু হল। সবাই খাড়া হয়ে বসল, কয়েকজন গলা তুলে বলল, “ভেঙে বলো হে! আমরা ডিটেলস শুনতে চাই।”
প্রহ্লাদও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, “বলো কী হে? এরকম ভুল হওয়ার তো কথা নয়! এ-খবর তোমাকে কে দিল হে?”
“আজ্ঞে ঘোড়ার মুখের খবর। আমার মেসোমশাইয়ের মাসতুতো ভাই হল গাব্ব। সে এই বছরখানেক হল জুনিয়র অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে রাখালহরির দলে ঢুকেছে রীতিমতো কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে। হালে সিনিয়র অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে অ্যাকশনে নেমেছে। মাধবপুরের হাটে গত কালই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। চেহারার চেনাই দেখলে হিংসে হয়। ফেডেড জিন্স, ইতালিয়ান টি শার্ট, হাতে দু-দুটো হাইফাই মোবাইল, চোখে গুচ্চি গল। চেহারা একেবারে ছমছম করছে। কথায় কথায় বলল, ওদের নতুন লিডার এসে গেছে এবং সে নাকি পুরো সুপারম্যান। প্রথমটায় ভাঙছিল না, পরে স্বীকার করল, লিডার হল রাখালহরির ভাইপো ক্ষুদিরাম গড়াই।”
গুঁফো গণেশ ডুকরে উঠল, “বলিস কী! তা হলে এ কে? এ কি খাঁদু গড়াই নয়?”
চাকু গম্ভীর মুখে বলল, “দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, না, এ খাদু গড়াই নয়। এ জালি মাল।”
সভায় তুমুল শোরগোল উঠল।
প্রহ্লাদ হাঁক দিয়ে বলল, “চুপ, চুপ! সাইলেন্স! খবরটার সত্যতা বিচার না করেই উত্তেজিত হওয়া বিচক্ষণের লক্ষণ নয়। ধরেই নিচ্ছি, চাকু ঠিক কথাই বলেছে, এ-বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি তৈরি হোক। তদন্তের রিপোর্ট দেখে…”
ছিনতাই ছানু কম কথার লোক। এতক্ষণ কথা বলেওনি। এবার সে ব্যাপারের ভিতর থেকে মুন্ডু বের করে বলল, “প্রহ্লাদভায়াকে আর তদন্ত কমিটি করতে হবে না। বরং যাকে ধরে এনেছ তার পেটে গুঁতো দিয়ে কথা বের করে নাও। খামোখা সময় নষ্ট।”
সকলে হর্ষধ্বনি সহযোগে সমর্থন জানাল।
প্রহ্লাদের হুকুমে আটজন সশস্ত্র ডাকাত খাঁদুকে একেবারে ঘিরে ধরে নিয়ে এল প্রহ্লাদের সামনে। এত ভয়ংকর ডাকাতের মাঝখানে থেকেও লোকটার এতটুকু হেলদোল নেই। বেশ নিশ্চিন্ত মনে আছে।
প্রহ্লাদ রোষকষায়িত লোচনে লোকটাকে একেবারে গেঁথে ফেলে হুংকার দিয়ে উঠল, “অ্যাই, তুই কে?”
লোকটা বিগলিত হয়ে বলে, “আজ্ঞে, কেন বলুন তো? আমি তো খাঁদু গড়াই।”
সভা গর্জন করে উঠল, “মিথ্যে কথা!”
খাঁদু সকলের দিকে মিটমিট করে চেয়ে নিপাট ভালমানুষের মতো বলে, “তা আমার খাঁদু নামটা অনেকের পছন্দ নয় বটে। তা পছন্দ না হলে একটা নাম দিয়ে নিলেই তো হয়।”
চাকু বলল, “তুমি একজন ইমপর্টার।”
গুঁফো গণেশ বিচক্ষণ লোক। বলল, “আহা, ওকে একটু বলতে দাও না হে। বাপু খাঁদু, তুমি কি রাখালহরির আপন ভাইপো?”
“যে আজ্ঞে।”
“তিনি তোমার নিজের খুড়ো তো?”
“আজ্ঞে, আগেরটা হলে, পরেরটা তো হতেই হবে। আমি তার আপন ভাইপো হলে, তিনি পরের খুড়ো হন কী করে?”
“কিন্তু তাই যে হচ্ছে হে খাঁদু? তুমি আপন ভাইপো ভাবলে কী হবে? রাখালডাকাত যে পরের খুড়ো হয়ে বসে আছে!”
খাঁদু পিটপিট করে চারদিকে চেয়ে যেন ভারী ঘাবড়ে গেছে, এমন ভাব করে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল, “কথাটার মধ্যে কি একটা প্যাঁচ আছে নাকি মশাই?”
গণেশ মাথা নেড়ে বলে, “না। আমাদের কথায় প্যাঁচ নেই, কিন্তু বাপু, তোমার কথায় আছে। তাই বলছি, প্যাঁচটা একটু খোলল। রাখালহরির, যত দূর জানি, একটার বেশি দুটো ভাইপো নেই। খবর হচ্ছে, তার হাতে এখন একটা ভাইপো মজুত আছে। তা হলে তুমি হিসেবে আসছ কী করে?”
খাঁদু ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে, “তাই তো মশাই, বড্ড ভাবনায় ফেলে দিলেন!”
“ভাবনার কী আছে হে! আসল কথাটা পকেট থেকে বের করে ঝপাস করে সকলের সামনে ফেলে দাও। তুমি আসলে কে?”
“বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। বিশ্বাস না করারই কথা। তবু যখন চাপাচাপি করছেন, তখন কপাল ঠুকে বলেই ফেলি। আমি আসলে হচ্ছি দয়ালহরি গড়াইয়ের ছেলে ক্ষুদিরাম গড়াই, রাখালহরি গড়াইয়ের ভাইপো। ছেলেবেলায় সবাই ‘খাঁদু, খাঁদু বলে ডাকত, সেই থেকে খাঁদু গড়াই।”
গুঁফো গণেশ মৃদু হেসে বলে, “ওই ঢপের চপ তো আমরা একবার খেয়েছি, আর কেন?”
খাঁদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝতে পারছি মশাই, আমাকে আপনাদের মোটেই মনে ধরছে না। ভাবছেন, বেগুনের বদলে ঝিঙে কিনে এনেছেন। যাচাই করে দ্যাখেননি। তাই যদি হবে তা হলে ছেড়ে দেন না কেন, ফেরত যাই।”
মারকুটে মহেশ লাফিয়ে উঠে বলে, “ছেড়ে দেব মানে? তার আগে ছাল ছাড়িয়ে নেব না!”
খাঁদু কুঁকড়ে গিয়ে বলে, “মারধর করবেন না মশাই। মারধর আমার মোটেই সহ্য হয় না। সেবার গিরীনবাবুর বাগান পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা আধুলি পেয়ে ট্যাঁকে খুঁজেছিলুম। ন্যায্য পাওনা মশাই। তা সেই দোষে গিরীনবাবু কাঁকালে এমন গুঁতো মেরেছিলেন যে, তিন মাস আমাশায় ভুগে উঠলুম।”
গুঁফো গনশা মিষ্টি হেসে বলল, “এবার একটু কাজের কথায় এলে হয় না? মারধর করারও তো একটা মেহনত আছে বাপু?”
খাঁদু একগাল হেসে বলল, “যে আজ্ঞে, তা আর নেই! ঝুটমুট মেহনত করবেনই বা কেন?”
“মেহনত আমরা মোটেই করতে চাইছি না। আমরা শুধু জানতে চাই, তুমি আসলে কে? কেনই বা রাখালহরির ভাইপো বলে পরিচয় দিয়ে কী মতলবে এখানে এসেছ? আর ঝুটমুট আমাদের হয়রানটাই বা করলে কেন?”
খুব ভাবিত হয়ে খাঁদু এবার তার মাথা চুলকে নিয়ে বলল, “মুশকিলটা হয়েছে কী জানেন? আমার খুড়ো রাখালহরি চার হাত লম্বা, দশাসই চেহারা। আর আমি রোগাভোগা খেকুরে মানুষ। তাই কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে, আমি তার ভাইপো। আমি তাই ভাবছি, এবার একদিন কাছারিতে গিয়ে এফিডেবিট করে নামটাই পালটে ফেলব। ভাইপো হয়ে কোনও সুখ নেই মশাই। খুড়ো হলেও
হয় হত। কথায় আছে ‘নাল্পে সুখমস্তি, খুড়ৈব সুখম্।’”
গণেশ বলল, “কথা ঘোরাচ্ছ হে। অন্যের কথা ছেড়ে দাও, তোমার খুড়োই তো তোমাকে ভাইপো বলে মানতে চাইছে না। মাত্র দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিলাম, রাখালডাকাত একটা পয়সাও উপুড় হস্ত করতে রাজি নয়। তার চেয়েও বড় দুঃসংবাদ, তার আসল ভাইপো খাঁদু গড়াই এখন রাখালহরির ডান হাত হয়ে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছে।”
খাঁদু চোখ বড় বড় করে ভারী অবাক হয়ে বলল, “বলেন কী মশাই, মাত্র দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছেন! খুড়োমশাইয়ের যে কোটি কোটি টাকা! ওই জন্যেই তো তার বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছেন, এত কম যখন চাইছে তখন নিশ্চয়ই সে আমার আসল ভাইপো নয়। হায়, বড় ভুল করে ফেলেছেন মশাই!”
মহেশ রুখে উঠে বলল, “হ্যাঁ, বড্ড ভুল হয়েছে হে। তবে এবার আর ভুল করছি না। গণেশদাদা, তুমি সরো তো! ভাল কথায় কাজ হওয়ার নয়, অন্য ওষুধ দরকার।”
একথায় সভাস্থলে অন্যরাও ‘রে-রে করে উঠল। প্রহ্লাদ আর গণেশ চেষ্টা করেও আটকাতে পারল না। কুড়ি-পঁচিশজন তাগড়াই ডাকাত হাউড়ে এসে পড়ল খাঁদু গড়াইয়ের উপর। প্রবল ঝটাপটির মধ্যে কিল-চড়-লাথি পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। চারদিকে তুমুল চেঁচামেচি আর গন্ডগোল।
যা কাণ্ড ঘটছিল তাতে খাঁদুর বেঁচে থাকার কথাই নয়। ঝটাপটির ভিতর থেকে প্রথমে টলতে টলতে বেরিয়ে এল মল্লিক, তার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। প্রহ্লাদের দিকে চেয়ে কঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “টেকো টগরের কাণ্ডটা দেখলেন! এমন ঘুসো মেরেছে যে, নির্ঘাত নাকের হাড় ভেঙেছে! একটু পরেই ক্যাকাতে ক্যাকাতে লেঠেল ললিত বেরিয়ে মাজা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে বলল, “কোন বদমাশ যে গোদা পায়ের লাথিটা ঝাড়ল, মাজাটা গেছে।”
দু’মিনিট পরে হাড়ভাঙা হারাধন চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে করুণ গলায় বলতে লাগল, “আমার শখের বাবরি চুল, কোন শয়তান যে ভিড়ের মধ্যে একগোছা উপড়ে নিয়ে গেল। কঁকা ব্রহ্মতালু নিয়ে এখন কোন লজ্জায় লোকালয়ে বেরোই!”
প্রহ্লাদ গম্ভীর হয়ে বলল, “ওরে আর নয়। এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে গেছে। এবার খ্যামা দে বাবারা। লাশটা একটা গর্ত করে পুঁতে ফ্যাল। খুনখারাপি আমার পছন্দ নয়। কিন্তু কী আর করা!”
ঝটাপটি এক সময়ে থামল বটে, কিন্তু অনেক খুঁজেও খাদু গড়াইয়ের লাশটা পাওয়া গেল না।
ওদিকে নীলপুরের জঙ্গলে গভীর রাতে বিজয়গর্বে ফিরে এসেছেন কাশীরাম। মোট পাঁচখানা ডাকাতি করেছেন। স্যাঙাতরা শতমুখে কাশীবাবুর বীরত্বের কথা রাখালহরিকে শোনাচ্ছিল। রাখালহরি তার চেয়ারখানায় জুত করে বসে গোঁফ চোমরাতে চোমরাতে হাসি হাসি মুখ করে শুনছিল। দুলে দুলে বলল, “হবে না! ওসব হল জিনের ব্যাপার। কার রক্ত শরীরে বইছে সেটা দেখতে হবে তো! পরস্পকে নিজস্ব করতে পারাটা একটা জেনেটিক আর্ট। নাঃ, খাঁদুকে যতই দেখছি ততই ভরসা হচ্ছে। আমার ট্র্যাডিশনটা ধরে রাখতে পারবে। যা বাবা খাঁদু, আজ অনেক মেহনত করেছিস, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়।”
পোলাও-মাংস দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে নিজের তাবুতে ঢুকে খাটিয়ার বিছানায় কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পেটে শান্তি, মনে প্রশান্তি, চোখে সুষুপ্তি নিয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেন কাশীরাম।।
শেষ রাতে ভারী ভাল একটা স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। একটা বিশাল রাজবাড়িতে ডাকাতি করতে ঢুকেছেন দলবল নিয়ে। সেপাইসান্ত্রিরা তাঁকে দেখেই অস্ত্রশস্ত্র ফেলে সেলাম জানাল। জরির
পোশাক পরা স্বয়ং রাজা এসে তাকে খাতির করে কোথায় ধনরত্ন আছে তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। এমন সময় মন্ত্রীমশাই এসে তার হাতে সসম্মানে একটা টেলিগ্রাম দিল। কাশীবাবু টেলিগ্রাম খুলে দেখলেন, তাতে বাংলায় লেখা, সরকার বাহাদুর এবার আপনাকে ডাকাতরত্ন’ পুরস্কারে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঠিক এই সময়েই কী করে যেন রাজার তলোয়ারের খাপটা তার বুকে একটা খোঁচা দিল। কাশীরাম ককিয়ে উঠলেন, “এ কী!”
চাপা গলায় কে যেন বলল, “আস্তে! সবাই শুনতে পাবে যে!”
কাশীরাম ধড়মড় করে উঠে বললেন, “কে?”
“ওঃ, তোফা আছেন মশাই! ভাল খাট, বিছানা, বিলিতি কম্বল!”
গলাটা চেনা চেনা ঠেকছে। কাশীরাম উবিগ্ন হয়ে অন্ধকারকেই জিজ্ঞেস করলেন, “খাঁদু নাকি হে?”
“ও নামটা তো শুনলুম আপনি দখল করে বসে আছেন! তা আমাকে পাঁচুটাচু কিছু একটা বলে ডাকলেই হবে। খাঁদু নিয়ে বড় টানাটানি হচ্ছে মশাই।”
কাশীবাবু উদবেগের গলায় বললেন, “তুমি এখানে এসে উদয় হয়েছ কেন বলো তো! মতলবটা কী তোমার?”
খাঁদু অতিশয় আহত গলায় বলল, “দেখুন কাশীবাবু, আমার নাম, আমার খুড়ো সবই বেবাক দখল করে বসে আছেন। তার জন্য কি কিছু বলেছি আপনাকে? লোকের ঘটিবাটি চুরি যায়, টাকা-পয়সা চুরি যায়, সে একরকম। কিন্তু নাম চুরি, খুড়ো চুরি কখনও শুনেছেন? আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! এর পর পুকুর চুরি শুনলেও অবাক হব না। কিন্তু সেসব কথা থাক। আমি তো আর ওসব ফেরত চাইছি না মশাই!”
কাশীরাম এই শীতেও কপালের ঘাম মুছে বললেন, “তবে কী চাও? চটপট বলে সরে পড়ো, নইলে আমি লোক ডাকব।”
খাঁদু অতিশয় দুঃখের গলায় বলে, “তা তো ডাকবেনই। মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ বলেও কী যেন একটা কথা আছে। সেটাও কি বিস্মরণ হল আপনার?”
“কীসের কৃতজ্ঞতা? কী বাবদে কৃতজ্ঞতা?”
“এই যে অমন ভাল নামটা দিয়ে দিলুম, অমন শাঁসালো খুড়োকে পর্যন্ত আপনার হাতে সঁপে দিলুম, সে বাবদে কি কৃতজ্ঞতাটুকুও পাওনা হয় না আমার! তার উপর তোক ডাকবেন বলে শাসাচ্ছেন!”
“ওহে বাপু, আজ বড্ড ধকল গেছে। সোজা কাজ তো নয়, এক রাতে পাঁচ-পাঁচখানা ডাকাতি! তা খাটুনির পর মানুষের তো একটু ঘুমও দরকার হয়, নাকি? অত ভ্যাজর ভ্যাজর না করে আসল কথাটা বলে ফেললেই তো হয়।”
“বলছিলাম কী, বাংলায় একটা কথা আছে, খাচ্ছিল তাঁতি তাত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে। কথাটা শোনা আছে কি?”
“খুব আছে। ক্লাস সেভেনে বাক্য রচনায় এসেছিল।”
“সেইটেই বলতে আসা।”
“তা বাপু, এটা এমন কী কথা যে, মাঝরাতে একটা হাক্লান্ত লবেজান লোকের ঘুম ভাঙিয়ে বলতে হবে!”
“আপনি তো মাঝরাতে ঘুম ভাঙানোটা দেখছেন। জানেন কি, এ কথাটা আপনাকে বলার জন্য কত বিপদ ঘাড়ে করে, কত মেহনত করে আসতে হয়েছে? খুড়োমশাইয়ের কল কি সোজা? চারদিকে প্রতিটি গাছে মাচান বেঁধে পাহারার বন্দোবস্ত, হুমদো হুমদো সব সেপাইসান্ত্রি ভয়ংকর চেহারার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চারদিকে পায়চারি করছে। মাছিটিও গলতে পারে না।”
“তাও তো বটে! তা হলে তুমি গলে এলে কী করে?”
“আজ্ঞে, সে নিতান্তই ব্রাহ্মণের আশীর্বাদে।”
“শুধু গলেই আসোনি, এই অন্ধকার জঙ্গলে আমার ভাবুটাও খুঁজে বের করেছ। তার ব্যাখ্যা কী?”
“খুব সোজা। আপনার নাকের ডাক, খেয়াল করলে দেখবেন, সকলের নাক একরকম ডাকে না। কারও বাঘের গর্জন তো কারও শ্যামের বাঁশি, কারও বোমা ফাটার আওয়াজ তো কারও গড়াগড়ার গুড়ুক গুড়ুক শব্দ।”
“তা আমারটা কেমন?”
“তবলা লহরা শুনেছেন তো! অনেকটা সেরকম।” কাশীরাম একটা মস্ত হাই তুলে বলেন, “কথা শেষ হয়েছে তো! তা হলে এবার কেটে পড়ো।”
“যে আজ্ঞে। সকালে যখন ঘুম ভাঙবে তখন ঠান্ডা মাথায় কথাটা ভাল করে ভেবে দেখবেন।”
মাইল দশেক দূরে থানায় নিজের চেয়ারে কেতরে বসে কানাইদারোগা হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন। সদর থেকে হুকুম এসেছে আজ থানায় সবাইকে রাতে তৈরি থাকতে হবে। হঠাৎ চমকে উঠে খাড়া হয়ে বললেন, ঘরে কে একটা ঢুকেছে। মোটা রুলটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, “কে তুই?”
খাঁদু গড়াই হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বিগলিত হেসে বলে, “দণ্ডবৎ বড়বাবু, এই কাগজখানা দেখাতেই আসা।”
বলে সে একখানা চিরকুটের মতো জিনিস এগিয়ে দিল। সেটা পড়ে কানাইদারোগা বলে উঠল, “বাপ রে! আপনি?”
“ঘাবড়াবার দরকার নেই। সর্বত্র স্প্রে করা আছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনও অসুবিধে হবে না। শুধু গতরখানা নাড়লেই হবে।”
“যে আজ্ঞে।” বলে কানাই শশব্যস্তে বেরিয়ে পড়ল।
খাঁদু গড়াই বাইরে এসে ইদিক-উদিক একটু দেখে নিয়ে অন্ধকারে সুট করে সরে পড়ল।