॥ ৬ ॥
পরদিন সকালে উঠে দেখি আকাশ মেঘলা, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আমার একটা ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট ছিল, সেটা গায়ে চাপিয়ে নিলাম। ফেলুদা আর লালমোহনবাবু দু’জনেই ম্যাকিনটশ চাপিয়েছে।
ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে ফেলুদা বলল, ‘মিস্টার জটায়ু, আপনাকে বলে রাখি যে এটাই হল লন্ডনের স্বাভাবিক চেহারা। কাল যে খটখটে দিন আর ঝলমলে রোদ পেয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে ব্যতিক্রম।’
‘এখানে কলকাতার মতো জল জমে না নিশ্চয়ই।’
‘তা জমে না। আর খুব যে মুষলধারে বৃষ্টি হয় তাও নয়।’
আন্ডারগ্রাউন্ডে দেখি সকলেরই তাড়া, কেউ আস্তে হাঁটছে না। আমরাও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললাম।
‘এই স্পীডটা দেখছি ছোঁয়াচে,’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘কলকাতায় এমন রুদ্ধশ্বাসে হাঁটবার কথা কল্পনাই করতে পারি না।’
চেঞ্জ করার সময়ও সেই একই তাড়া। এক লাইন থেকে আরেক লাইনে যেতে হচ্ছে, মিনিটে মিনিটে ট্রেন আসছে যাচ্ছে, সময় যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য লোকে উঠে পড়ে লেগেছে।
রিচমন্ড পৌঁছলাম এগারোটা বেজে পাঁচে। নিশানাথবাবু বলে দিয়েছিলেন হাতে কত সময় রাখতে হবে, তাই কোনো অসুবিধা হল না।
স্টেশনের বাইরে বেরোতেই একজন ষাট-বাষট্টি বছরের সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক হাসিমুখে ফেলুদার দিকে এগিয়ে এলেন। এখানে বৃষ্টি হচ্ছে না, যদিও আকাশে মেঘ।
‘ওয়েলকাম টু রিচমন্ড!’
ফেলুদা ভদ্রলোককে সম্ভাষণ জানিয়ে আমাদের দু’জনের পরিচয় দিয়ে দিল।
‘আপনি রাইটার?’ লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। ‘কতকাল যে বাংলা বই পড়িনি তার হিসেব নেই।’
‘আপনি দেশে যান না মাঝে মাঝে?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘লাস্ট গেছি সেভনটি থ্রীতে। তারপর আর না। কার জন্যেই বা যাবো বলুন। আমার পুরো ফ্যামিলিই ত এখানে। আমার বাড়িতে অবিশ্যি আমি আর আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ থাকে না, কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই ইংল্যান্ডেই রয়েছে আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে, নাতি-নাতনী।’
ভদ্রলোকের গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করা ছিল; বললেন, ‘এখানে তবু কম; লন্ডনে গাড়ি পার্কিং হচ্ছে একটা বিরাট সমস্যা। আপনি হয়ত সিনেমা যাবেন, গাড়ি পার্ক করতে হবে সিনেমা হাউস থেকে আধ মাইল দূরে।’
আমরা গাড়িতে উঠলাম। ভদ্রলোক নিজেই ড্রাইভ করেন, ফেলুদা ওঁর পাশে বসে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে নিল। ব্যাপারটা দেখে একটু অবাক হয়ে লালমোহনবাবু আমার দিকে চাইতে বললাম, ‘এখানে গাড়িতে সামনের সিটে বসলে স্ট্র্যাপ লাগানো নিয়ম।’
‘কেন?’
‘যাতে অ্যাক্সিডেন্ট হলে লোকে মুখ থুবড়ে না পড়ে।’
নিশানাথবাবু গাড়ি চালু করে দিয়ে বললেন, ‘আমার বাড়ি এখান থেকে দেড় মাইল। এখানে এখনো মাইল চলে। দেশে ত কিলোমিটার, কিলোগ্রাম হয়ে গেছে, তাই না?’
রিচমন্ড যে খুব ছোট জায়গা তা মনে হল না, কারণ দোকানপাট সবই রয়েছে। অক্সফোর্ড স্ট্রীটে যে সব দোকানের নাম দেখেছিলাম, তার কিছু কিছু এখানেও দেখলাম।
নিশানাথ সেনের বাড়ি একটা সুন্দর নিরিবিলি জায়গায়, চারিদিকে গাছপালা, গাছের পাতায় শরৎকালের হলদে আর বাদামী রং। দোতলা বাড়িটাও সুন্দর, সামনের বাগানে ফুল—একেবারে পোস্টকার্ডের ছবি।
আমরা একতলায় বসবার ঘরে বসলাম। আজ বেশ ঠাণ্ডা আর স্যাতসেঁতে, তাই ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে।
আমরা বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন বয়স্ক মেমসাহেব এসে ঢুকলেন মুখে হাসি।
‘আমার স্ত্রী এমিলি,’ বললেন নিশানাথবাবু। আমরা নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দিয়ে দিলাম।
‘আপনাদের জন্য একটু কফি করি?’ মহিলা জিজ্ঞেস করলেন। ফেলুদা সম্নতি জানিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে দিল। এবার নিশানাথবাবুও ফেলুদার সামনে একটা কাউচে বসে বললেন, ‘কী জানতে চান বলুন।’
‘আপনি কাল বলছিলেন রঞ্জন মজুমদারের বাবাকে চিনতেন। আমি রঞ্জন মজুমদার সম্বন্ধে কিছু তথ্য সংগ্রহ করছি।’
‘রঞ্জনের বাপ রজনী আর আমি প্রায় একই সঙ্গে ফর্টি এইটে বিলেতে আসি। ও আমার চেয়ে ষোল-সতের বছরের বড় ছিল। আলাপটা হয় পরে। তত দিনে আমি এডিনবরায় ডাক্তারি পাশ করে লন্ডনে প্র্যাকটিস শুরু করেছি, আর রজনী মজুমদার সেন্ট মেরিজ হাসপাতালের সঙ্গে অ্যাটাচ্ড রয়েছেন। একটা থিয়েটারে আমাদের পাশাপাশি সীট পড়েছিল। কী নাটক তাও মনে আছে—মেজর বারবারা। ইন্টারমিশনে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওর সঙ্গে ওর স্ত্রীও ছিলেন। ও থাকত গোলডার্স গ্রীনে, আর আমি—তখনও আমার বিয়ে হয়নি—হ্যাম্পস্টেডে।’
‘আর ওঁর ছেলে?’
‘ছেলেও এখানে এসে কিছু দিনের মধ্যেই স্কুলে ভর্তি হয়।’
‘কী স্কুল মনে আছে?’
‘আছে বৈকি—ওয়ারেনডেল। এপিং-এ। তারপর কেমব্রিজে যায়।’
‘কোন কলেজ?’
যদ্দূর মনে পড়ে—ট্রিনিটি। সেই সময়ই আমার সঙ্গে রজনী মজুমদারের আলাপ।’
‘কিরকম লোক ছিলেন রজনী মজুমদার?’
নিশানাথবাবু একটু ভেবে বললেন, ‘পিকিউলিয়ার।’
‘কেন—পিকিউলিয়ার বলছেন কেন?’
‘আমার মনে হয় ওদের পুরো ফ্যামিলটাই একটু অদ্ভুত ধরনের ছিল। রজনী মজুমদারের বাবা রঘুনাথ মজুমদার ইয়াং বয়সে টেররিস্ট ছিলেন, বোমা-টোমা তৈরি করেছেন। পরে উনি নামকরা হার্ট স্পেশালিস্ট হন। তখন আর সাহেবদের উপর কোনো বিদ্বেষ নেই। এমন কি তিনিই জোর করে রজনীকে বিলেত পাঠান। তাঁর শখ তাঁর নাতি সাহেব ইস্কুলে পড়বে আর ছেলে লন্ডনে প্র্যাকটিস করবে। এরকম রূপান্তর বড় একটা দেখা যায় না। আর রজনী যে ভাবে দেশে ফিরে গেল সেও অদ্ভুত। ওর একটা ধারণা ছিল যে ইংরেজরা এখনো ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখে। আমি ওকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে ব্যাপারটা সত্যি নয়। এই বিদ্বেষের দু-একটা আইসোলেটেড ঘটনা হয়ত ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু এখানে বহু ভারতীয় ইংরেজদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছে, দুই জাতের মধ্যে কোনো ক্ল্যাশ নেই।
‘কিন্তু রজনী মজুমদার আমার কথা মানতে রাজি হয়নি। একটা সামান্য ব্যাপারে—ওরই এক ব্রিটিশ পেশেন্টের একটা কথায়—ও হঠাৎ স্থির করে দেশে ফিরে যাবে।’
‘ততদিনে ত ওঁর ছেলের অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে?’
‘তা গেছে। সেই ছেলে এখন কী করছে? তার ত পঞ্চাশের উপর বয়স হওয়া উচিত।’
‘হ্যাঁ। উনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।’
‘তার মানে এখানকার পড়াশুনা ওর কোনই কাজে লাগেনি? কলকাতায় ফিরে গিয়ে নতুন করে পড়াশুনা করতে হয়?’
‘তাই ত মনে হয়। ইয়ে—রঞ্জনের বন্ধুবান্ধব সম্বন্ধে কিছু জানতেন কি?’
‘না। নাথিং অ্যাট অল।’
ইতিমধ্যে কফি এসে গিয়েছিল, আর আমাদের খাওয়াও হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা উঠে পড়লাম। ভদ্রলোক ফেরার পথেই একরকম জোর করেই আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিলেন।