আপনাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। কেন বলুন তো?
কীরকম?
স্যাড অ্যান্ড ক্রেস্টফলেন। মনে হচ্ছে কান্নাকাটিও করেছেন।
আপনি আমার এত বড় ক্ষতিটা কেন করলেন শবরবাবু?
ক্ষতি। সে কী! আমি কী করলাম?
মানুষটাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। দিব্যি ছিলাম। কেন আপনি আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেলেন?
ম্যাডাম, রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া তো কিছু নয়।
ক’দিন ধরে আমি রাতে ঘুমোতে পারছি না, সবসময়ে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।
কেন?
ওরকম মারা-খাওয়া চেহারা, ওরকম ভেঙে-পড়া, আর হাতজোড় করে ওই ক্ষমা চাওয়া–কী করে ভুলি! কতবার ইচ্ছে হয়েছে একাই গিয়ে দেখা করি, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করি, কিংবা কী যে সব মাথামুণ্ডু ভেবেছি।
এবং কেঁদেছেন!
হ্যাঁ।
কান্নার কী আছে?
বেশ করেছি। কেঁদেছি যে কেউ কাঁদবে।
শবর হাসল, আর কী হল বলুন। কোনও সিদ্ধান্তে এলেন?
কী সিদ্ধান্তে আসব? আপনাদের মামলা কতদূর?
শেষের দিকে।
তার মানে কী। চার্জশিট দেওয়া হয়ে গেছে?
চার্জশিট তৈরি হচ্ছে।
তা হলে ওর রেহাই নেই।
না। উনি রেহাই পেলেই বা আপনার কী?
তা ঠিক। কিন্তু–
কিন্তু কী?
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
তা তো হতেই পারে। কিন্তু তা বলে তো একজন ক্রিমিন্যালকে ক্ষমা করা যায় না।
ক্ষমা না হয় না-ই করলেন। অপরাধ করে থাকলে শাস্তি হোক। কিন্তু ওরকমভাবে মারে কেউ?
মানছি মারটা একটু বেশি হয়ে গেছে। অন্য কেউ হলে হয়তো মরেই যেত। ভজন আচাৰ্য খুব শক্ত ধাতুতে গড়া। হান্ড্রেড পারসন।
স্বাস্থ্য ভাল বলে বলছেন?
না। স্বাস্থ্যের চেয়েও মজবুত ওর মন। এ কারেজিয়াস ম্যান।
কী লাভ আর তাতে?
লাভ নেই। অবশ্য।
কী পানিশমেন্ট হবে ওর বলুন তো! ফাঁসি?
যাবজ্জীবনও হতে পারে।
যাবজ্জীবন তো চৌদ্দো বছর, তাই না?
হ্যাঁ। তবে ভাল বিহেভ করলে মেয়াদ কিছু কমে যায়।
কত কমবে?
চার-পাঁচ বছরও হতে পারে।
তাও তো দশ বছর। কম কী?
হ্যাঁ। জীবনের সবচেয়ে প্রসপারাস সময়টায় দশ বছর আটক থাকাটা দুঃখজনক।
ওর দোষ কি সন্দেহাতীতভাবে প্ৰমাণ হয়েছে?
কিছু ফাঁক তো থাকবেই। তবে প্রমাণ হয়ে যাবে।
আমি ঠিক করেছি, আপনারা আমাকে সাক্ষী হিসেবে ডাকলে আমি ওর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলব না।
সে কী ম্যাডাম! আপনি যে ইম্পট্যান্ট উইটনেস।
সেজন্যই আমি উলটো কথা বলব।
কী মুশকিল। আপনার সঙ্গে ওঁর মিট করানোটাই যে ভুল হল।
মিট করালেন কেন? আমার যে কী সর্বনাশ করলেন।
লোকটাকে কি ক্রিমিনাল মনে হয়নি। আপনার?
তা বলছি না।
তা হলে কী বলছেন ম্যাডাম?
কী বলছি তা আমিও জানি না। সেই মেয়েটা কি রিঙ্কু?
কোন মেয়েটা?
রতন যার কথা শুনতে পেয়েছিল ওর ঘরে।
ডাউটফুল।
তা হলে একটা লুপ হোল তো আছে।
তা আছে। আমি জিপ নিয়ে এসেছি। আজ যাবেন?
হঠাৎ মুখখানা উজ্জ্বল হল বিভাবরীর। বলল, হ্যাঁ। আমাকে দু’মিনিট সময় দিন।
দু’মিনিট মাত্র! অত তাড়া নেই। মেয়েদের সাজতে একটু সময় লাগে জানি। টেক ইয়োর টাইম, আমি বসছি।
সাজব! সাজব কেন? জাস্ট পোশাকটা পালটে আসছি।
দু’মিনিটই লাগল। মুখে পাউডারটুকুও না ছুইয়ে বেরিয়ে এল বিভাবরী, চলুন।
জিপে শবর বলল, আপনার ভিসিবল চেঞ্জ হয়েছে।
হয়েছে, আমিও তা জানি।
দ্যাটস গুড।
ও এখন কেমন আছে?
বেটার। মাচ বেটার।
ওর যদি যাবজজীবন হয় তা হলে গ্যারেজীটার কী হবে?
আপনাদের যখন ডিভোর্স হয়নি তখন ওই গ্যারেজের ওপর আপনারও অধিকার আছে।
যাঃ।
আইন তো তাই বলে।
আমি গ্যারেজ নিয়ে কী করব? গাড়ির কিছুই জানি না।
তা হলে বেচে দিতে পারেন। অনেক খিদের আছে। ভাল দামও পাবেন।
পাগল! ও অত সাধ করে গ্যারেজ করেছিল, বেচব কেন?
সেও ঠিক কথা। তা হলে বেচবেন না।
ও কি আমার কথা কিছু বলেছে?
হ্যাঁ।
কী বলেছে?
আপনাকে এই নোংরা মোকদ্দমায় টেনে আনার জন্য ভজনবাবু আমাদের ওপর একটু অসন্তুষ্ট।
ও।
উনি হয়তো আপনাকে এখনও ভালবাসেন।
কী যে বলেন!
ভুলও বলে থাকতে পারি। আমি তো শুখা মানুষ।
আমি ভাবছি ও রিঙ্কুকে রিফিউজ করল কেন। আর রিফিউজ করে রেপই বা করবে কেন, খুনই বা করবে কেন?
আপনিই বলুন।
আপনারা ভাল করে তদন্ত করেননি।
আপনার ইন্সটিংক্ট কী বলে?
বলে এটা অসম্ভব ব্যাপার।
আজ উনি অনেকটাই সুস্থ। ওঁকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন।
আমার কাছে বলবে কেন?
কেন তার কোনও কারণ নেই। হয়তো বলবেন।
আমি কিন্তু আদালতে কিছু বলব না ওর বিরুদ্ধে।
মুশকিল।
কিছুতেই বলব না।
তা হলে তো সাক্ষী হিসেবে আপনাকে বাদ দিতে হয়।
তা কেন দেবেন? আমারও তো বক্তব্য আছে।
আপনি যে মামলা কাঁচিয়ে দেবেন।
দেবই তো।
মিস ভট্টাচাৰ্য, আপনি কি ভজনবাবুর প্রতি সফট হয়ে পড়ছেন?
আমি সিমপ্যাথেটিক। ওকে আমার ক্রিমিন্যাল মনে হচ্ছে না।
লজিকটা কী?
ওই তো বললাম, যে ওকে বিয়ে করতে চায় তাকে ও হঠাৎ রেপ করতে যাবে কেন?
গুড লজিক। কিন্তু এমন তো হতে পারে সেই রাতের মেয়েটা রিঙ্কু ছিল না।
হতে পারে। আপনারা ঠিকমতো তদন্ত করলেন না যে!
শবর একটু হাসল।
ভজন ধীরে ধীরে তার স্নান, করুণ, ব্যথাতুর মুখখানা তুলল।
কষ্ট পেয়ো না। আমার বুদ্ধির দোষ।
তোমার দোষ? নাকি পুলিশ মিথ্যে করে সাজিয়েছে?
মিথ্যেটা তো সত্যি হয়নি।
তার মানে?
পুলিশ খুনিকে ধরেছে।
কী বলছ?
হাবু বলে ছেলেটা।
কই, আমাকে শবরবাবু কিছু বলেননি তো!
ভজন একটু হাসল, সারপ্রাইজ দিতে ভালবাসেন বোধহয়।
ভজনের দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরে বাঁকুনি দিয়ে বিভাবরী উত্তেজিত গলায় বলল, সত্যি বলছি? সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল বিভাবরী। টেবিলে উপুড় হয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইল ভজন। কী করবে বুঝতে পারল না।
ছায়ার মতো নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল শবর।
ম্যাডাম, দি ড্রামা ইজ ওভার।
চোখের জলে মাখামাখি মুখ তুলে তীব্র দৃষ্টি হেনে বিভাবরী বলল, আপনি কেন বলেননি। আমাকে?
আপনি একজন অ্যান্টিরোমান্টিক লোককে বিয়ে করেছেন দেখছি। এই সময়ে এর তো কিছু রোমান্টিক অ্যাডভানসেস করার সুযোগ ছিল। কিন্তু দেখুন কেমন পাথরের মতো বসে আছেন।
বিভাবরী বেঁঝে উঠে বলল, এরকমই ভাল।
ভজনবাবুরিলিজ হয়ে গেছেন। এবার চলুন মিস ভট্টাচাৰ্য।
থাক আর ইয়ারকি করতে হবে না।
কীসের ইয়ারকি?
আপনি আমাকে এখন থেকে মিসেস আচাৰ্য বলে ডাকতে পারেন।