৬৮তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের যথাযথ বৃত্তান্তবর্ণন
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অনবীর্য্যসম্পন্ন অর্জ্জুন নিতান্ত ক্রুদ্ধ ধর্ম্মপরায়ণ রাজা যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে ধর্ম্মরাজ! অদ্য আমি সংশপ্তকগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলাম, ইত্যবসরে কৌরবসৈন্যগণের অগ্রসর মহাবীর অশ্বত্থামা আশীবিষসদৃশ নিতান্ত ভীষণ শরনিকর পরিত্যাগ করিয়া সহসা আমার সমক্ষে সমুপস্থিত হইলেন। তাঁহার সৈন্যগণ আমার মেঘগম্ভীরনিঃস্বন রথ নিরীক্ষণ করিয়াই পরিবেষ্টন করিতে লাগিল; আমিও সেই সমস্ত সৈন্যমধ্যে পাঁচশত ব্যক্তিকে বিনাশ করিয়া অশ্বত্থামার সম্মুখীন হইলাম। তিনি আমাকে অবলোকন করিয়া, গজেন্দ্র যেমন সিংহের অভিমুখে আগমন করে, তদ্রূপ আমার অভিমুখে আগমন করিলেন এবং নিহন্যমান কৌরবগণকে পরিত্রাণ করিবার নিমিত্ত একান্ত অভিলাষী হইয়া পরম প্রযত্নসহকারে বিষাগ্নি সদৃশ সুনিশিত শরনিকরে আমাকে ও বাসুদেবকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তৎকালে গুরুপুত্রের আট আর্টটি গো-সংযোজিত আটখানি শকটপরিপূর্ণ যে অসংখ্য শর ছিল, তিনি আমাকে লক্ষ্য করিয়া তৎসমুদয়ই পরিত্যাগ করিলেন, আমিও বায়ু যেমন জলদজালকে ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলে, তদ্রূপ তাঁহার শরনিকর খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলাম। তখন তিনি শরাসন আকর্ণ আকর্ষণ করিয়া শিক্ষা, অস্ত্রবল ও প্রযত্ন প্রদর্শনপূর্ব্বক বর্ষাকালে কৃষ্ণমেঘ যেমন বারিধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ অনবরত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় তিনি যে আমার কোন্ পার্শ্বে অবস্থান করিলেন এবং কখন শরসন্ধান আর কখনই বা শর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন, তাহা কিছুই অবধারণ করিতে সমর্থ হইলাম না। তৎকালে কেবল তাঁহার শরাসন মণ্ডলাকার নিরীক্ষিত হইতে লাগিল। অনন্তর দ্রোণাত্মজ আমাকে ও বাসুদেবকে পাঁচ পাঁচ শরে বিদ্ধ করিলেন; আমিও নিমেষমধ্যে বজ্রকল্প ত্রিংশৎশরে তাঁহাকে নিতান্ত নিপীড়িত করিলাম। তখন তিনি ক্ষণকালমধ্যে আমার শরনিকরে একান্ত বিদ্ধ হইয়া শল্লকীর [সজারুর] ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তাঁহার কলেবর হইতে অনবরত রুধিরধারা নিঃসৃত হইতে লাগিল। অনন্তর আচাৰ্য্যপুত্র স্বীয় সৈন্যগণকে আমার শরজালে একান্ত অভিভূত ও রুধিরলিপ্তদেহ নিরীক্ষণ করিয়া সূতপুত্রের রথসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ হস্তী ও অশ্বগণকে ধাবমান এবং যোদ্ধাদিগকে সাতিশয় শঙ্কিত অবলোকন করিয়া পঞ্চাশৎ মহারথসমভিব্যাহারে সত্বর আমার অভিমুখে সমুপস্থিত হইল। আমি সেই মহারথগণের বধ সাধনপূর্ব্বক কর্ণকে পরিত্যাগ করিয়া সত্বর আপনার দর্শনার্থ আগমন করিয়াছি। এক্ষণে গো-সমূহ যেমন কেশরীকে অবলোকন করিয়া ভীত হয়, তদ্রূপ পাঞ্চালগণ কর্ণকে নিরীক্ষণ করিয়া শঙ্কিত হইতেছে। প্রভদ্রকগণ সূতপুত্রের সম্মুখীন হইয়া যেন মৃত্যুর ব্যাদিতবদনে পতিত হইয়াছে। মহাবীর কর্ণ প্রভদ্রকদিগের সাতশত রথীকে নিহত করিয়াছে; ফলতঃ ঐ মহাবীর যে পৰ্য্যন্ত না আমাদিগকে দর্শন করিয়াছিল, তদবধি কিছুমাত্র শঙ্কিত হয় নাই। হে মহারাজ! মহাবীর অশ্বত্থামা আপনাকে পূর্ব্বে ক্ষতবিক্ষত করিয়াছে এবং তৎপরে কর্ণের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছে। আমি এই কথা শ্রবণ করিয়া নিশ্চয় করিলাম যে, আপনি কর্ণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক শিবিরে আগমন করিয়াছেন। হে ধর্ম্মরাজ! আমি পূর্ব্বে মহাবীর কর্ণের এইরূপ অদ্ভুত অস্ত্রপ্রভাব নিরীক্ষণ করিয়াছি। অদ্য তাঁহার বলবীৰ্য্য সহ্য করিতে পারে, সৃঞ্জয়গণমধ্যে এমন আর কেহই নাই। অতএব মহাবীর সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার চক্ররক্ষক হউন এবং মহাবলপরাক্রান্ত যুধামন্যু ও উত্তমৌজা আমার পৃষ্ঠরক্ষা করুন। আজ আমি যদি সূতপুত্রকে সংগ্রামস্থলে দেখিতে পাই, তাহা হইলে বৃত্রাসুরের সহিত সমাগত সুররাজের ন্যায় সেই নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ মহাবীরের সহিত সমবেত হইয়া যোরতর যুদ্ধ করিব। হে মহারাজ! এক্ষণে আপনি আসিয়া আমাদের উভয়েরই যুদ্ধ সন্দর্শন করুন। ঐ দেখুন, প্রভদ্রকগণ সূতপুত্রের প্রতি ধাবমান হইতেছে এবং রাজপুত্রগণ স্বর্গলাভার্থে নিহত হইতেছেন। আজ যদি আমি বলপূর্ব্বক বন্ধু বান্ধবগণের সহিত কর্ণকে বিনাশ না করি, তাহা হইলে অঙ্গীকৃত প্রতিপালন পরাঙ্মুখ ব্যক্তির যে গতি, আমারও যেন সেই কৃচ্ছ্র [কষ্টকর] গতি লাভ হয়। হে মহারাজ এক্ষণে আপনি যুদ্ধে আমার জয় প্রার্থনা করুন। ঐ দেখুন, ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ ভীমসেনকে নিপীড়িত করিতেছে; অতএব আমাকে অবিলম্বে সংগ্রামস্থলে গমন করিতে হইবে। আমি সমুদয় সৈন্য ও শত্রুগণ এবং সূতপুত্রকে সংহার করিব, সন্দেহ নাই।’ ”