বিলপমানা দ্রৌপদীর প্রতি ভীষ্মসান্ত্বনা
দ্রৌপদী কহিলেন, “রে দুষ্প্রজ্ঞ দুষ্ট দুঃশাসন! তুই ক্ষণকাল প্রতীক্ষা কর, আমি যে প্রশ্ন করিয়াছি, সর্ব্বাগ্রেই তাহার প্রত্যুত্তর লওয়া কর্তব্য, কিন্তু এখনও তাহার যথার্থ উত্তর পাইলাম না। এই মহাবল বলপূর্ব্বক আমাকে আকর্ষণ করায় একান্ত বিহ্বল হইয়াছি এবং কৌরবসভায় কুরুদিগকে নানাপ্রকারে অপ্রিয় কহিতেছি। পূর্ব্বে এই সকল অপ্রিয় বাক্য একবারও মুখে আনি নাই, কিন্তু এক্ষণে আর আমার অপরাধ কি?” তখন দুঃখে নিতান্ত কাতরা দ্রৌপদী সভামধ্যে নিপতিত হইয়া এক প্রকার আর্তস্বরে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন! ‘হায়! আমি স্বয়ংবরকালে রঙ্গ মধ্যে সমাগত ভূপালগণের নেত্রপথে একবার নিপতিত হইয়াছিলাম, ইতিপূর্ব্বে যাহারা আর আমাকে দেখেন নাই, এক্ষণে আমি তাঁহাদেরই সম্মুখে সভামধ্যে উপস্থিত হইয়াছি। যাহাকে পূর্ব্বে গৃহমধ্যে বায়ু ও আদিত্য পৰ্য্যন্ত দেখিতে পান নাই। এক্ষণে তাঁহাকে সভামধ্যে সর্ব্বজনসমক্ষে উপস্থিত হইতে হইল! যে পাণ্ডবেরা পূর্ব্বে গৃহমধ্যে আমাকে বায়ু স্পর্শ করিলে সহ্য করিতে পারিত না, আদ্য সেই পাণ্ডবেরাই দুরাত্মা দুঃশাসন যে আমাকে স্পর্শ করিতেছে, তাহা অনায়াসেই সহ্য করিয়া আছেন। সেই কৌরববর্গেই স্নুষাকে ক্লেশে ক্লিশ্যমানা দেখিয়া অনায়াসে সহ্য করিতেছেন, সুতরাং এক্ষণে স্পষ্ট বোধ হইতেছে, কালক্রমে সকলই ঘটিয়া থাকে। আমি স্ত্রীলোক ও সতী, আমার ইহা অপেক্ষা কি কষ্ট আছে? শুনিয়াছি, ধর্ম্মপরায়ণা স্ত্রীলোককে সভামধ্যে আনয়ন করিতে নাই, কিন্তু এই অভাগিনী সভাপ্রবেশ করিয়াছে; এক্ষণে ক্ষিতিপালদিগের সেই সনাতন ধর্ম্ম কোথায় রহিল? যখন পাণ্ডবদিগের সহধর্মিণী, পার্ষতের ভগিনী, কৃষ্ণের প্রিয়সখী দ্রৌপদীকে সভায় আনিয়াছে, তখন কৌরবদিগের পূর্ব্বপুরুষপরম্পরাগত নিত্যধর্ম্ম নষ্ট হইল। আমি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সবর্ণ ভাৰ্য্যা, আমাকে দাসীই বল বা নাই বল, উভয়পক্ষেই সম্মত আছি। এই ক্ষুদ্রাশয় কৌরবদিগের কুলকলঙ্ক দূত দুঃশাসন বলপূর্ব্বক আমাকে আকর্ষণ করিয়া ক্লেশ দিতেছে, আমি আর সহ্য করিতে পারি না। হে ভূপালগণ! আমাকে জিতা বা অজিতাই বোধ করুন, আমি যে প্রশ্ন করিয়াছি, তাহার প্রত্যুত্তর দেন, তৎপরে যাহা বলিবেন, তাহাই করিব।”
ভীষ্ম কহিলেন, “হে কল্যাণি! ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম, বিজ্ঞেরাও তাঁহা সম্যক নিরূপণ করিতে পারেন না। বলবান লোক ধর্ম্মানুসারে চলিয়া থাকেন, কিন্তু সেই ধর্ম্ম অভিভূত হইয়া অধর্ম্মকে প্রশ্রয় দিতেছে। কাৰ্য্যের সূক্ষ্মত্ব, গহনত্ব ও গৌরবত্বপ্রযুক্ত এক্ষণে তোমার এই প্রশ্নের সিদ্ধান্তপক্ষে কিছুই নির্ণয় হইতেছে না, কৌরবেরাও লোভ ও মোহের বশীভূত হইয়াছে, অতএব বোধ হয়, অচিরাৎ ইহাদিগের বংশলোপ হইবে। তুমি যে কুলের পরিগ্রহ, সেই কুলজাত লোকেরা অত্যন্ত দুঃখাভিহিত হইলেও কদাপি ধর্ম্ম হইতে বিচলিত হয়েন না; অতএব হে পাঞ্চালি! তুমি এইরূপ দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াও যে ধর্ম্মপথ নিরীক্ষণ করিতেছ, ইহা তোমার সমুচিতই হইয়াছে। এই সমস্ত ধর্ম্মবেত্তা বৃদ্ধ দ্রোণাদি গতাসুর ন্যায় আনত হইয়া শূন্যশরীরে অবস্থান করিবেন, এক্ষণে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই প্রশ্নের যেরূপ সিদ্ধান্ত করিবেন, তাহাই প্রমাণ হইবে, তুমি জিতা বা অজিত হইয়াছ ইনি তাহার সম্যক নিরুপণ করুন।”