৬৬তম অধ্যায়
কৌরবগণের সমরে সন্দেহ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, যেমন মত্ত-মাতঙ্গ অঙ্কুশাঘাতে প্রতিনিবৃত্ত হয়, সেইরূপ পলায়নোন্মুখ [পলায়নে উদ্যত] দুৰ্য্যোধন মহাত্মা অর্জ্জুনের বাক্যে আহূত হইয়া মহারথে আরোহণপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। ভুজঙ্গ যেমন পদাঘাত সহ্য করিতে পারে না, তদ্রূপ অর্জ্জুনের তিরস্কার তাঁহার নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল। হেমমালী [সূবর্ণমাল্যধারী] কর্ণ তাঁহাকে প্রতিনিবৃত্ত দেখিয়া স্বীয় ক্ষত-বিক্ষত গাত্র সুস্থির করিয়া তাঁহারা উত্তরদিক দিয়া পার্থকে আক্রমণ করিলেন। মহাবাহু ভীষ্ম প্রত্যাবৃত্ত হইয়া দুর্য্যোধনের পশ্চিমদিক রক্ষা করিতে লাগিলেন। দ্রোণ, কৃপ, বিবিংশতি ও দুঃশাসন প্রতিনিবৃত্ত দুৰ্য্যোধনের সাহায্যাৰ্থ ধনুর্ব্বাণ ধারণপূর্ব্বক অতি শীঘ্ৰ পুরোভাগে উপস্থিত হইলেন। হংস যেমন উদয়োন্মুখ মেঘরাজির সম্মুখীন হয়, সেইরূপ তপস্বী ধনঞ্জয় মহাপ্রবাহসদৃশ সেই সেনানিচয়কে প্রতিনিবৃত্ত দেখিয়া তাহাদিগের অভিমুখে উপস্থিত হইলেন। যেমন ঘনঘটা পর্ব্বতোপরি বারিধারা বর্ষণ করে, সেইরূপ কৌরবসেনা অর্জ্জুনের চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল।
গাণ্ডীবধন্বা ধনঞ্জয় অস্ত্ৰ দ্বারা কৌরব-অস্ত্র-সকল প্ৰতিহত করিয়া অনিবাৰ্য্য সম্মোহন অস্ত্র আবির্ভূত ও শর-সমূহে দশদিক আচ্ছন্ন করিয়া গাণ্ডীবনির্ঘোষে কৌরবগণের হৃদয় ব্যথিত করিলেন। পরে অতি ভীমরব মহাশঙ্খ আত্মাত করিলে দিক বিদিক, আকাশ ও পৃথিবী প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। কুরুবীরগণ অর্জ্জুনের শঙ্খনাদে সম্মোহিত হইয়া দুর্দ্ধর্ষ শরাশন পরিত্যাগপূর্ব্বক একেবারে চেষ্টাশূন্য হইয়া ধরাশয্যায় শয়ন করিল। তখন ধনঞ্জয় উত্তরার বাক্য স্মরণ করিয়া উত্তরকে কহিলেন, “হে বীর! কৌরবগণ এখন সংজ্ঞা শুন্য হইয়াছে; অতএব তুমি সত্বর হইয়া দ্রোণাচাৰ্য্য ও কৃপাচাৰ্য্যের শুক্ল বস্তুদ্বয়, কর্ণের পীত বস্ত্র এবং অশ্বত্থামা ও দুৰ্য্যোধনের নীল বস্ত্ৰদ্ধয় অপহরণ কর। ভীষ্ম এই অন্ত্রের [পূর্ব্ব ব্যবহৃত সম্মোহন অস্ত্ৰ] প্রতিঘাত-কৌশল অবগত আছেন; বোধ হয় উনি চেতনাশূন্য হয়েন নাই, অতএব উঁহার অশ্বগণকে বামদিকে রাখিয়া সতর্কতাপূর্ব্বক গমন করিতে হইবে।”
মহাত্মা বিরাটপুত্র রশ্মি [অশ্বরঙ্গু] পরিত্যাগ ও রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক মহারথিগণের বস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিয়া পুনরায় স্বরথে আরোহণ করিলেন। অনন্তর সেই শ্বেতবর্ণ অশ্বচতুষ্টয়কে পরিচালন করিলে তাহারা তৎক্ষণাৎ সৈন্যগণকে অতিক্রমপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে লইয়া রণক্ষেত্র হইতে বহির্গত হইবে, এমন সময়ে তপস্বী ভীষ্ম পুরুষপ্রবীর অর্জ্জুনকে শরাঘাত করিতে লাগিলেন। এ দিকে ধনঞ্জয় তাঁহার অশ্বগণকে নিহত করিয়া তাঁহাকেও দশ বাণে আহত করিলেন; অর্জ্জুন এইরূপে ভীষ্মকে পরাজিত ও উত্তরকে আশ্বস্ত করিয়া, রথীবৃন্দ হইতে বিমুক্ত হইয়া মেঘমালানিঃসৃত দিবাকরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।
অর্জ্জুনশরে কৌরব-সম্ভাষণ—দুৰ্য্যোধনের মুকুটকৰ্তন
অনন্তর কুরুবীরগণ সংজ্ঞা লাভ করিয়া দেখিলেন, সুরেন্দ্ৰকল্প সব্যসাচী সমরকৃত্য পরিত্যাগ করিয়া একাকী দণ্ডায়মান আছেন; তখন দুৰ্য্যোধন অতিমাত্র ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্ব্বক কহিলেন, “আপনারা কি নিমিত্ত অর্জ্জুনকে পরিত্যাগ করিয়াছেন? উহাকে এরূপ আহত করুন যে, আর বিমুক্ত হইতে না পারে।”
তখন ভীষ্ম হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘দুৰ্য্যোধন!! এতক্ষণ তোমার বলবুদ্ধি কোথায় প্রস্থান করিয়াছিল? তোমরা যখন হতচেতন হইয়া সমুদয় বাণ ও বিচিত্র ধনু পরিত্যাগ করিয়াছিলে তখন মহাবীর পার্থ কদাচ পাপকর্ম্মে সংযুক্ত হয় না। ত্ৰৈলোক্য লাভ হইলেও ইনি স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করেন না; এই নিমিত্তই এই সংগ্রামে তোমরা সকলে নিহত হও নাই। এক্ষণে সত্বর হইয়া কুরুদেশে প্রস্থান কর; অর্জ্জুন গোধনসকল লইয়া গমন করুন। যাহাতে তোমার স্বার্থবিঘাত [স্বার্থহানি-নিজ উদ্দেশ্য নাশ] না হয়, এরূপ উপায় অনুসন্ধান কর।’
অমর্ষপরবশ দুৰ্য্যোধন পিতামহ-মুখে হিতকর বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক স্বাভীষ্ট-বিষয়ে হতাশ্বাস হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন। অন্যান্য বীরগণ ভীষ্মবাক্যের হিতকারিতা অবগত হইয়া এবং ধনঞ্জয়ারূপ হুতাশন বিবৰ্দ্ধমান দেখিয়া দুৰ্য্যোধনকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রতিনিবৃত্ত হওয়াই স্থির করিলেন।
তখন মহাধনুৰ্দ্ধর ধনঞ্জয় কুরুবীরগণকে প্রস্থান করিতে অবলোকন করিয়া প্রফুল্ল-চিত্তে মুহূর্ত্তকাল শর দ্বারা তাঁহাদিগের সহিত সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন। তিনি বিচিত্র শর দ্বারা পিতামহ ভীষ্ম, আচাৰ্য্য দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচাৰ্য্য ও মান্যতম কৌরবগণকে প্ৰণিপাত করিয়া দুৰ্য্যোধনের বিচিত্ৰ মুকুটচ্ছেদন করিলেন; অনন্তর অন্যান্য বীরগণকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক গাণ্ডীবঘোষে সমস্ত লোক প্ৰতিধ্বনিত করিতে লাগিলেন; পরে দেবদত্ত শঙ্খনিনাদে আরাতিগণের হৃদয় বিদীর্ণ এবং সহেমজাল ধ্বজ দ্বারাসমুদয় শত্রুগণকে অভিভূত করিয়া বিরাটপুত্রকে কহিলেন, “উত্তর! এক্ষণে অশ্বগণকে আবর্ত্তিত করা; তোমার পশুসকল প্রত্যাহৃত হইয়াছে, উহারা অগ্ৰে গমন করুক, পশ্চাৎ তুমি হষ্টচিত্তে গমন করিবে।”
অন্তরীক্ষে দেবগণ কুরুগণের সহিত অর্জ্জুনের অদ্ভুত যুদ্ধ অবলোকন করিয়া মনে মনে তদ্বিষয়ের আন্দোলন করিয়া হষ্টচিত্তে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।