৬৪. সঙ্কুলযুদ্ধ—পাণ্ডবপরাজয়

৬৪তম অধ্যায়

সঙ্কুলযুদ্ধ—পাণ্ডবপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় কর্ণ সমরাগ্রবর্তী মহারথ কৈকয়গণকে শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন এবং তাহারা তাঁহার নিবারণে যত্নবান হইলে তাহাদের পঞ্চদশ রথীর প্রাণসংহার করিলেন। যোধগণ কর্ণের শরনিকরে পীড়িত হইয়া তাঁহার পরাক্রম নিতান্ত দুঃসহ বোধ করিয়া আত্মরক্ষার্থ ভীমসেনের সমীপে আগমন করিতে লাগিল। এইরূপে সূতপুত্র একাকী শরনিকরে সেই বিপুল রথসৈন্য ভেদ করিয়া যুধিষ্ঠিরের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। ঐ সময় রাজা যুধিষ্ঠির শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত ও বিচেতনপ্রায় হইয়া নকুল ও সহদেবকে চক্ররক্ষক নিযুক্ত করিয়া ধীরে ধীরে শিবিরে গমন করিতেছিলেন, তখন সূতপুত্র দুৰ্য্যোধনের হিতকামনায় সুতীক্ষ্ণ তিনবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন যুধিষ্ঠির কর্ণের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া তিনবাণে তাঁহার সারথি ও চারিবাণে অশ্বচতুষ্টয়কে নিপীড়িত করিলেন। অনন্তর তাঁহার চক্ররক্ষক শত্রুতাপন মন্ত্রীপুত্র নকুল ও সহদেব তাহাকে অভয় প্রদানপূর্ব্বক কর্ণের প্রতি ধাবমান হইয়া যথোচিত যত্নসহকারে তাঁহার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। প্রতাপশালী সূতনন্দনও দুই শিতধার ভল্লদ্বারা শত্রুঘাতন মহাত্মা নকুল ও সহদেবকে বিদ্ধ করিয়া অম্লানমুখে যুধিষ্ঠিরের মনোমারুতগামী কৃষ্ণপুচ্ছ শ্বেত অশ্বগণকে সংহারপূর্ব্বক একভল্লে তাঁহার শিরস্ত্রাণ পাতিত করিলেন এবং অবিলম্বে নকুলের অসমুদয় সংহারপুর্ব্বক রথেষা ও শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে যুধিষ্ঠির ও নকুল রথাশ্ববিহীন ও শরনিপীড়িত হইয়া সহদেবের রথে আরোহণ করিলেন।

শল্য-কৌশলে কর্ণের যুধিষ্ঠিরসহ যুদ্ধত্যাগ

“পাণ্ডবগণের মাতুল শত্রুসূদন মদ্ররাজ কৃপাপরতন্ত্র হইয়া কর্ণকে কহিলেন, ‘হে রাধেয়! অদ্য তোমাকে অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে। তবে কি নিমিত্ত একান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া যুধিষ্ঠিরের সহিত যুদ্ধ করিতেছ? ধর্ম্মরাজের সহিত সংগ্রাম করিয়া তোমার অস্ত্রশস্ত্র অল্পমাত্রাবশিষ্ট, কবচ ছিন্নভিন্ন এবং সারথি ও বাহনগণ পরিশ্রান্ত হইলে তুমি শত্রুশরে সমাচ্ছন্ন হইয়া যদি অর্জ্জুনসমীপে গমন কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই উপহাস্যাস্পদ হইবে।’

“হে মহারাজ। কর্ণ মদ্ররাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়াও সুতীক্ষ্ণ শরনিকরে ধর্ম্মরাজ ও মাদ্রীনন্দনদ্বয়কে বিদ্ধ করিয়া হাস্যমুখে যুধিষ্ঠিরকে সমরবিমুখ করিলেন। তখন শল্য সূতপুত্রকে যুধিষ্ঠিরের সংহারে একান্ত সমুৎসুক অবলোকন করিয়া হাস্যমুখে পুনরায় কহিলেন, ‘হে কর্ণ! যুধিষ্ঠিরকে বিনাশ করিয়া তোমার কি ফল হইবে? দুৰ্য্যোধন যাহার বধের নিমিত্ত তোমার সম্মান করিয়া থাকে, তুমি সেই অর্জ্জুনকে অগ্রে বিনাশ কর। ঐ বাসুদেব ও ধনঞ্জয়ের শঙ্খনিঃস্বন এবং বর্ষাকালীন মেঘগর্জ্জিতের ন্যায় গাণ্ডীবনির্ঘোষ শ্রবণগোচর হইতেছে। ঐ দেখ, অর্জ্জুন শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক মহারথগণকে নিপীড়িত করিয়া আমাদিগের সমস্ত সেনা সংহার করিতেছে। যুধামন্যু ও উত্তমৌজা তাহার পৃষ্ঠদেশ, মহাবীর সাত্যকি উত্তরদিকের চক্র ও ধৃষ্টদ্যুম্ন দক্ষিণদিকের চক্র রক্ষা করিতেছেন। ঐ দেখ, ভীমসেন রাজা দুর্য্যোধনের সহিত যুদ্ধ করিতেছে। অতএব যাহাতে বৃকোদর আজ আমাদিগের সমক্ষে তাঁহাকে বিনাশ করিতে না পারে, তুমি তাহার উপায়বিধান কর। ঐ দেখ, সমরনিপুণ দুর্য্যোধন ভীমসেনকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াছেন। অদ্য তুমি তাঁহাকে মুক্ত করিতে পারিলে সকলেই চমৎকৃত হইবে। অতএব সত্বর গমন করিয়া সংশয়াপন্ন রাজাকে পরিত্রাণ কর। যুধিষ্ঠির ও মাদ্রীতনয়দ্বয়কে বিনাশ করিয়া তোমার কি লাভ হইবে?

“হে মহারাজ! বীর্য্যবান কর্ণ মদ্ররাজের বাক্যশ্রবণানন্তর দুৰ্য্যোধনকে ভীমহস্তে নিপতিত দর্শন করিয়া যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবকে পরিত্যাগপূর্ব্বক কুরুরাজের পরিত্রাণার্থ ধাবমান হইলেন। তাঁহার অশ্বগণ মদ্ররাজকর্ত্তৃক সঞ্চালিত হইয়া আকাশগামীর ন্যায় গমন করিতে লাগিল। এইরূপে সূতপুত্র তথা হইতে প্রস্থান করিলে শরবিক্ষত পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরও সহদেবের বেগবান অশ্বযুক্ত রথে উপবিষ্ট ও নিতান্ত লজ্জিত হইয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের সহিত শিবিরে প্রতিগমনপূর্ব্বক রথ হইতে অবরোহণ করিয়া অবিলম্বেই শয়ন করিলেন। অনন্তর তাঁহার সমবেদনা অপনীত হইলে তিনি মহারথ মাদ্রীপুত্র নকুল ও সহদেবকে কহিলেন, ‘হে ভ্রাতৃদ্বয়! মহাবীর বৃকোদর মেঘের ন্যায় গভীর গৰ্জন করিয়া যুদ্ধ করিতেছে; অতএব তোমরা শীঘ্র তাঁহার সৈন্যমধ্যে গমন কর।’ মহারথ নকুল ও সহদেব যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞানুসারে পবনতুল্য বেগশালী অশ্বসংযোজিত অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক ভীমসেনের সমীপে উত্তীর্ণ হইলেন এবং তথায় বিবিধ যোধগণকে নিপাতিত দর্শন করিয়া সৈনিকসমভিব্যাহারে অবস্থান করিতে লাগিলেন।”