দ্ৰৌপদীকে দাসী করার আদেশে দুৰ্য্যোধনের প্রতি বিদুরের ভর্ৎসনা
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! তুমি শীঘ্ৰ গিয়া পাণ্ডবগণের প্ৰণয়িনী দ্রৌপদীকে আনয়ন কর। অপুণ্যশীলা কৃষ্ণা এখানে আসিয়া দাসীগণ-সমভিব্যাহারে আমাদিগের গৃহ মার্জনা করুক।”
বিদুর কহিলেন, “রে মূঢ়। তুমি আপনাকে পাশবদ্ধ ও পতনোন্মুখ না জানিয়াই এইরূপ দুর্ব্বাক্য কহিতেছ! তুমি মৃগ হইয়া অনুক্ষণ ব্যাঘ্রগণকে কুপিত করিতেছ। রে মন্দাত্মন! ত্রুুদ্ধ কালভূজঙ্গগণ তোমার মস্তকোপরি রহিয়াছে, তুমি উহাদিগকে পুনরায় কুপিত করিয়া যমালয়ে গমনের কাৰ্য্য করিও না। দেখ, কৃষ্ণা কখনই দাসী হইবার উপযুক্ত নহেন, আমার মতে রাজা যুধিষ্ঠির তাহার অনধিকারী হইয়া তাহাকে পণে ন্যাস্ত করিয়াছেন। বংশ যেমন আত্মবিনাশের নিমিত্ত ফল ধারণ করে, তদ্রুপ এই মদমত্ত ধৃতরাষ্ট্রতনয় সমূলে নির্মূল হইবার নিমিত্ত দ্যূতক্রীড়া করিয়া মহৎ বৈর ও মহাভয় উৎপাদন করিতেছে। অন্যের মর্ম্মপীড়া দিবে না; কাহাকেও নিষ্ঠুর বাক্য কহিবে না; সমাগত ব্যক্তির সহিত অশ্রদ্ধাপূর্ব্বক ব্যবহার করিবে না; এবং যে কথা কহিলে অন্যে বিরক্ত হয়, এবস্তৃত বাক্য প্রয়োগ করিবে না। দুর্ব্বাক্য লোকের মুখ হইতে বিনির্গত হয়, কিন্তু যাহাকে লক্ষ্য করিয়া ঐ বাক্য উচ্চারিত হয়, উহা তাহার মর্ম্মস্পৃক [মর্ম্মস্পর্শী-হৃদয়বিদারক] হইয়া অহোরাত্র তাহাকে যন্ত্রণা দেয়; পণ্ডিতগণ অন্যকে লক্ষ্য করিয়া কদাপি সেরূপ বাক্য উচ্চারণ করেন না। হে ধৃতরাষ্ট্রনন্দন! কাপুরুষেরাই শত্রুর অস্ত্ৰাঘাত সহ্য করে, অতএব তোমরা এই নীতিবাক্যের অনুসরণপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের শত্রুতা করিও না; তাহা হইলে অবশ্যই তোমাদিগকে শমনসদনে গমন করিতে হইবে। হে দুৰ্য্যোধন! তুমি যেরূপ দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ করিতেছ, পাণ্ডবগণ কি বনচর, কি গৃহবাসী, কি হতবিদ্য, কি তপস্বী, কাহাকেও ঐরূপ কটুক্তি প্রয়োগ করেন না। অতি নীচ লোকেরাই ঐ প্রকার কুবাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকে। ধৃতরাষ্ট্রতনয় ঘোরতর নরকের দ্বারে সমুপস্থিত হইয়াছে বলিয়া বুঝিতে পারিতেছে না। দুঃশাসন প্রভৃতি কুরুবংশীয়গণ দ্যূতক্রীড়ায় দুৰ্য্যোধনের অনুগামী হইয়াছে। বরং অলাবু জলে মগ্ন হইতে পারে, প্রস্তর ভাসমান হইতে পারে এবং নৌকা নিমগ্ন হইতে পারে, কিন্তু মন্দবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রাত্মজ কদাচ আমার সদুপদেশ কর্ণপাত করিবে না। দুৰ্য্যোধন লোভপরতন্ত্র হইয়া সুহৃজ্জনের সদুপদেশে শ্রবণ করিতেছে না, অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে, কুরুবংশীয়গণ অচিরাৎ সমুলে উন্মলিত হইবে।”