প্রভাত হইল রাত্রি উদিত তপন।
সভা করি বসিলেন যত বন্ধুগণ।।
বাজিল আনন্দবাদ্য জনক-ভুবন।
বিদায় মাগেন গিয়া বশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ।।
জনক বলেন অতি হইয়া কাতর।
রাম সীতা রাখি যাও একটি বৎসর।।
হাসিয়া বলেন তবে অজের নন্দন।
শরীর লইয়া যাব রাখিয়া জীবন।।
বলেন জনক রাজা শুন হে রাজন।
সকলে আমার ঘরে করিবে ভোজন।।
ভাল ভাল বলিয়া দিলেন অনুমতি।
আয়োজন করিলেন জনক ভূপতি।।
রাজা রাণী ঘরে গিয়া দেখেন রন্ধন।
সুক্ষ্ম অন্ন সহ তার পঞ্চাশ ব্যঞ্জন।।
স্নান করি আসিয়া সকল প্রজাগণ।
আনন্দিত হৈয়া সবে করেন ভোজন।।
ভোজন করেন রাম পরম হরিষে।
দধি দুগ্ধ দিল রাজা ভোজনাবশেষে।।
সুতৃপ্ত হইয়া রাম করে আচমন।
কর্পূর তাম্বুলে করে মুখের শোধন।।
সে রাত্রি থাকেন রাম তথা পূর্ব্ববৎ।
প্রাতঃকালে বিদায় মাগেন দশরথ।।
রাম সীতা চতুর্দ্দোলে করি আরোহণ।
দীন দ্বিজ দুঃখীরে করেন বিতরণ।।
দিব্য বস্ত্র পরিধান, মাথায় টোপর।
দূর্ব্বাদলশ্যাম রাম হাতে ধনুঃশর।।
পরে তিন ভ্রাতা চাপিলেন চতুর্দ্দোলে।
পরম আনন্দে রাজা অযোধ্যায় চলে।।
দেবরথে চড়িলেন বশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ।
কিন্তু চতুর্দ্দিকে রাজা দেখে অলক্ষণ।।
রাজা বলিলেন শুন বশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ।
চারিদিকে দেখি কেন এত অলক্ষণ।।
কি জানি কেমন হবে বিপদ ঘটন।
বশিষ্ঠ বলেন শুন অজের নন্দন।।
চারিদকে চারি পুত্র দেখে বিদ্যমান।
কে করিতে পারে তব অশুভ বিধান।।
বাজনার মহাশব্দ উঠিল আকাশ।
পরশুরামের চিত্তে লাগিল তরাস।।
মিথিলাতে শুনি কেন বাদ্যের বাজন।
সীতাকে বিবাহ করে বুঝি কোন্ জন।।
মনে মনে যুক্তি করে সেথা মুনিবর।
হেথা রাজা বিদায় করেন কন্যা-বর।।
লক্ষ লক্ষ চুম্ব দিয়া বদনকমলে।
জনক করিয়া কোলে জানকীরে বলে।।
করিলাম বহু দুঃখে তোমাকে পালন।
বারেক মিথিলা বলি করিও স্মরণ।।
শ্বশুর শাশুড়ী প্রতি রাখিও সুমতি।
রাগ দ্বেষ অসূয়া না কর কার প্রতি।।
সুখ দুঃখ না ভাবিও যা আছে কপালে।
স্বামীসেবা সীতা না ছাড়িহ কোন কালে।।
ঝিয়ারী বহুরী যত আসিয়া তখন।
গলায় ধরিয়া সবে যুড়িল ক্রন্দন।।
আমা সবা এড়িয়া কি চলিলা জানকী।
আর কি হইবে দেখা সীতা চন্দ্রমুখী।।
রাম সীতা বিদায় করিলেন জনক।
দ্বিজেরে দিলেন দান সহস্র সংখ্যক।।
হেনকালে জামদগ্ন্য হাতেতে কুঠার।
রহ রহ বলিয়া ডাকিছে বার বার।।
খড়্গ চর্ম্ম ধনুঃশর শরীরে গ্রথিত।
ভীমবেশে ভার্গব হইল উপস্থিত।।
মহাভয়ানক বেশ দেখিয়া মুনির।
দশরথ ভূপতির কম্পিত শরীর।।
এক হাতে ধরি রামে অপরে লক্ষ্মণে।
মুনির চরণে রাজা দিল সেইক্ষণে।।
মুনি বলে, দশরথ বলি হে তোমারে।
ধনুক ভাঙ্গিল কেবা জনকের ঘরে।।
দশরথ কহেন আমার পুত্র রাম।
গুণ দিতে ধনুকে ভাঙ্গিল ধনুখান।।
মহাকোপে জ্বলিয়া বলেন ভৃগুরাম।
মমসম করি রাখিয়াছে পুত্র নাম।।
আমি ত পরশুরাম বিদিত ভূতলে।
হেন জন আছে কে যে রামনাম বলে।।
এ কথা শুনিয়া রাম বলেন বচন।
দোষ ক্ষমা কর প্রভু তপস্বী ব্রাহ্মণ।।
বলেন পরশুরাম আরক্ত নয়ন।
তুচ্ছজ্ঞান কর দেখি তপস্বী ব্রাহ্মণ।।
নিঃক্ষত্রিয় ভূমি করি তনি সপ্তবার।
রক্তে নদী বহাইল আমার কুঠার।।
সমস্ত পৃথিবী করি কশ্যপের দান।
তপস্বী ব্রাহ্মণ বলি কর অপমান।।
আমার গুরুর ধনু ভাঙ্গিলেক যেই।
তাহাকে বধিয়া তার প্রতিফল দেই।।
ভূপতি বলেন ভয়ে কম্পিত শরীর।
বালকের অপরাধ ক্ষম মহাবীর।।
রুষিয়া কহেন শক্ত সুমিত্রা কুমার।
কথায় কি ফল, কর বীরের আচার।।
ক্ষত্রিয় বিনাশ তুমি করেছ যখন।
তখন না জন্মেছিল শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
এতেক বলিল যদি সুমিত্রা-নন্দন।
কূপিত পরশুরাম কহেন বচন।।
জীর্ণ ধনু ভাঙ্গিয়া যে দেখাইলা গুণ।
আমার ধনুকে রাম দেহ দেখি গুণ।।
এতেক কহিয়া ধনু দিলেন তখন।
জানকী ভাবেন নম্র করিয়া বদন।।
একবার ধনুক ভাঙ্গিয়া অকস্মাৎ।
করিলেন আমারে বিবাহ রঘুনাথ।।
আরবার ধনুক আনিল ভৃগুমুনি।
না জানি হইবে মোর কতেক সতিনী।।
ধনুখান ভৃগুরাম দিল বড় দাপে।
মরে ত মরুক রাম ধনুকের চাপে।।
ধনুক দেখিয়া অতি প্রসন্ন অন্তরে।
হাসিয়া ধরেন রাম ধনু বাম করে।।
শ্রীরাম বলেন, হে লক্ষ্মণ ধনুর্দ্ধার।
এ ধনুকের গরিমা করেন মুনিবর।।
শ্রীরাম বলেন শুন ওহে বীরবর।
ধনু যদি দিলে, তবে দেহ এক শর।।
সুবুদ্ধি পরশুরামে কুবুদ্ধি লাগিল।
তখন রামের হাতে মুনি শর দিল।।
আপনার তেজ রাম সকল হরিল।
আপনার তেজ রাম লইল যখন।।
হইল মুনির পুত্র সামান্য ব্রাহ্মণ।
শ্রীরাম বলেন, শুন মুনির নন্দন।।
ধনুকেতে গুণ দিব কিসের কারণ।।
তোমার ধনুকে যদি গুণ দিতে পরি।
তোমার ধনুক বাণে তোমার সংহারি।।
লক্ষ্মণেরে জিজ্ঞাসা করেন রাম শেষে।
ধনুকেতে গুণ দিই মুনির আদেশে।।
লক্ষ্মণ বলেন, শুন জ্যেষ্ঠ মহাশয়।
ধনুকেতে গুণ দিয়া দূর কর ভয়।।
এ কথা শুনিয়া রাম হাসিয়া কৌতুকে।
ধনু নোঙাইয়া গুণ দিলেন ধনুকে।।
ধনুক-টঙ্কার গিয়া লাগিল গগন।
পাতালে বাসুকি কাঁপে স্বর্গে দেবগণ।।
পাতালে বাসুকি বলে দেব রঘুবীর।
ধনুখান তোল, মোর বুক হোক্ স্থির।।
লক্ষ্মণ বলেন, শুন অগ্রজ শ্রীরাম।
ধনুখান তোল যে বাসুকি পায় ত্রাণ।।
এই কথা শুনিয়া হাসিয়া রঘুনাথ।
তুলিলেন সেই ধনু সবার সাক্ষাৎ।।
শ্রীরাম বলেন, শুন মুনির নন্দন।
তোমারে না মারি ব্রহ্মবধের কারণ।।
অব্যর্থ আমার বাণ হইবে কেমন।
স্বর্গরোধ করি কিম্বা পাতাল ভুবন।।
যে আজ্ঞা বলিয়া বলে মুনির নন্দন।
চিনিলাম তোমারে যে তুমি নারায়ণ।।
ধর্ম্ম দ্বারা স্বর্গ পায় নাহি হয় আন।
স্বর্গপথ রুদ্ধ কর দেব ভগবান।।
এক শর মারিলেন না করিয়া ক্রোধ।
পরশুরামের করে স্বর্গপথ রোধ।।
শ্রীরামেরে স্তুতি করে শ্রীপরশুরাম।
তপস্যা করিতে মুনি যান নিত্যধাম।।
দশরথ পাইলেন যেন হারাধন।
আনন্দিত তেমনি হইল তাঁর মন।।
পুত্র পুত্র বলিয়া করেন রামে কোলে।
লক্ষ লক্ষ চুম্ব দেন বদনকমলে।।
ভূপতি বলে, শুন বশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ।
বাজনায় আর কিছু নাহি প্রয়োজন।।
চতুর্দ্দোলে শ্রীরাম করেন আরোহণ।
অযোধ্যায় দ্রুততর করেন গমন।।
সিদ্ধাশ্রমে শ্রীরাম দিলেন দরশন।
প্রণাম করেন সবে মুনির চরণ।।
মুনিপত্নী আইল শ্রীরামে দেখিবারে।
রামসীতা দেখে তাঁরা হরিষ অন্তরে।।
ইহার জননী ধন্যা, ধন্য এঁর পিতা।
যেমনি গুণের রাম, তেমনি এ সীতা।।
তথা হইতে চলিলেন পরম হরিষে।
উত্তরিল গিয়া সবে আপনার দেশে।।
অযোধ্যায় সে শোভা তা বর্ণিতে না পারি।
আনন্দ সাগরে মগ্ন বাল বৃদ্ধ নারী।।
নানাবর্ণ পতাকা উড়িছে নানা স্থলে।
উপরে চাঁদোয়া শোভে গগনমণ্ডলে।।
কুলবধূ আর যত প্রজার কুমারী।
ঘৃতের প্রদীপ জ্বালে দ্বারে সারি সারি।।
সুবর্ণের পূর্ণকুম্ভে দিল আম্রসার।
গুবাক কদলী নারিকেল রাখে আর।।
গ্রাম প্রদক্ষিণ করে অজের নন্দন।
গ্রামের নিকটে গিয়া বাজায় বাজন।।
কৌশল্যা কৈকেয়ী আর সুমিত্রা রমণী।
চারি বধূ আনিতে চলিল তিন রাণী।।
সঙ্গেতে চলিল রঙ্গে পুরবাসী নারী।
সানন্দ সকল পুরী, বাজে তুরী ভেরী।।
দেবগণ বরিষণ করে পুষ্পরাশি।
জয় দিয়া নাচে সবে আনন্দে উল্লাসি।।
চারি বধূ কক্ষে দিল সুবর্ণ-কলসী।
ব্যবহার মত কর্ম্ম করে পুরবাসী।।
কক্ষে দিল কলসী, মস্তকে দিল ডালা।
ছড়াইয়া ফেলে সেইখানে খই কলা।।
শুভক্ষণে রাণীরা দেখিল বধূমুখ।
নিরখিয়া চন্দ্রমুখ জুড়াইল বুক।।
নানাবিধ যৌতুক দিলেন সর্ব্বজন।
মণিময় আভরণ বসন ভূসণ।।
যৌতুকেতে রাম পান যত অলঙ্কার।
তাহাতে হইল পূর্ণ তাঁহার ভাণ্ডার।।
পাইলেন সীতাদেবী যতেক যৌতুক।
নিজে লক্ষ্মী তিনি, তাঁর এ নহে কৌতুক।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ আর ভরত শত্রুঘ্ন।
বন্দিলেন গিয়া সবে মায়ের চরণ।।
চারি পুত্রে আশীর্ব্বাদ করে রাণীগণ।
চিরজীবী হও, পাও বহু পুত্র ধন।।
চারি পুত্র লয়ে রাজা সুখী বহুতর।
সুখে রাজ্য করে যেন স্বর্গে পুরন্দর।।
কৃত্তিবাস রচে গীত অমৃত সমান।
এতদূরে আদিকাণ্ড হৈল সমাধান।।
আদিকাণ্ড সমাপ্ত।