দুৰ্য্যোধন কর্তৃক বিদুরের অবমাননা
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! তুমি ধৃতরাষ্ট্রতনয়দিগের নিন্দা ও তদীয় শক্রগণের গুণকীর্তন করিয়া শ্লাঘা করিয়া থাক। তুমি যাহাদের প্রতি অনুরক্ত, তাহা আমরা সবিশেষ অবগত আছি। তুমি আমাদিগকে বালকের ন্যায় সর্ব্বদা অবমাননা করিয়া থাক। লোকের নিন্দ ও প্রশংসার ভাবভঙ্গি দেখিয়াই তাহার মনোগত বিরুদ্ধ অভিপ্ৰায় অনায়াসে বুঝিতে পারা যায়। তোমার জিহ্বাই তোমার মনের প্রতিকূল ভাব প্রকাশ করিতেছে। তুমি আমাদের পক্ষে ক্রোড়স্থিত ব্যালের ন্যায় হইয়াছ ও মার্জারের ন্যায় প্রতিপালকের অহিতচিন্তা করিতেছ। লোকে কি ভর্তৃহন্তা ব্যক্তিকে পাপী বলে না? হে বিদুর! তবে তুমি কি নিমিত্ত সেই পাপে ভয় করিতেছ না? আমরা শত্রুগণকে জয় করিয়া মহৎ ফললাভ করিয়াছি। তুমি আমাদিগকে পরুষবাক্য কহিও না। তুমি সতত আমাদের শক্রগণের সহিত আত্মীয়তা করিতে বাসনা কর এবং মোহবশতঃ আমাদিগের নিন্দা করিয়া থাক। লোকে অযোগ্য বাক্যপ্রয়োগ দ্বারাই অন্যের শত্রু হইয়া উঠে। দেখ, শত্রুর নিকটে নিগৃঢ় বিষয় গোপন করিয়া রাখাই কর্তব্য; অতএব হে নির্লজ্জ! তুমি আমাদের আশ্রিত হইয়াও কি কারণে উক্ত বিষয়ের বিরুদ্ধ আচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছ? তুমি ইচ্ছানুসারে তিরস্কার কর, কিন্তু আর তুমি আমাদিগকে অবমাননা করিও না; আমরা তোমার মন বুঝিয়াছি; তুমি বৃদ্ধগণের সমীপে বুদ্ধিগ্রহণ কর, যশোরক্ষা কর এবং শক্ৰকাৰ্য্যে আর ব্যাপৃত থাকিও না। হে বিদুর! তুমি “আমি কর্তা” এই মনে করিয়া আমাদের অবমাননা করিও না। আমি তোমার নিকট আপনার হিত জিজ্ঞাসা করি না। ক্ষত্তঃ! তুমি ক্ষমাশীলগণকে হিংসা করিও না। একজনই এই জগতের শাস্তা, দ্বিতীয় ব্যক্তি শাস্তা নাই। সেই শাস্তা মাতৃগর্ভে শয়ান শিশুকেও শাসন করেন। জল যেমন নিম্নপ্রদেশে ধাবমান হয়, তদ্রুপ আমি সেই শাস্তার শাসনানুসারে কাৰ্য্য করিয়া থাকি। যিনি মস্তক দ্বারা শৈলাভেদ করেন, যিনি সর্পকে ভোজন করান, তাহার বুদ্ধিই কাৰ্য্যানুশাসন করে, আর যে ব্যক্তি বলপূর্ব্বক অন্যকে অনুশাসন করে, সে অমিত্র। পণ্ডিত ব্যক্তি মিত্ৰতা-বিরুদ্ধাচারীকে উপেক্ষা করেন। যে ব্যক্তি প্ৰদীপ্ত হুতাশন উত্তেজিত করিয়াও পলায়ন না করে, তাহার সর্ব্বনাশ হয়। হে ক্ষত্তঃ! শত্রুপক্ষীয় ব্যক্তিকে, বিশেষতঃ অহিতকারী মনুষ্যকে স্বীয় আবাসে রাখিবে না। অতএব হে বিদুর! তোমার যথা ইচ্ছা হয় গমন কর, দেখ, অসতী স্ত্রীকে উত্তমরূপে সান্ত্বনা করিলেও সে স্বামীকে পরিত্যাগ করে।”
তিতিক্ষশীল বিদুরের উপদেশ
বিদুর কহিলেন, “হে রাজন্! এই প্রকার অত্যঙ্গমাত্র কারণবশতঃ যে ব্যক্তি মনুষ্যকে পরিত্যাগ করে, তাহার সখ্য কখন চিরস্থায়ী হয় না। রাজাদিগের চিত্ত অতি অল্পেই বিকৃত হইয়া যায়; ইহারা অগ্ৰে সান্ত্বনা করিয়া পশ্চাৎ মুষল দ্বারা প্রহার করে। হে মন্দমতি রাজপুত্র! তুমি আপনাকে বিজ্ঞ ও আমাকে অনভিজ্ঞ বলিয়া বোধ করিতেছ, কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখ, যে ব্যক্তি অগ্রে একজনের সহিত বন্ধুতা করিয়া পশ্চাৎ তাহার প্রতি দোষারোপ করে, সেই নিতান্ত অবিজ্ঞ। মন্দবুদ্ধি ব্যক্তি শ্রোত্ৰিয় গৃহে স্থিত ব্যভিচারিণী স্ত্রীর ন্যায় কখনই মঙ্গলকর হয়। না। যেমন কুমারী স্ত্রী ষষ্টিবৰ্ষবয়স্ক বৃদ্ধপতিকে তাচ্ছিল্য করে, তদ্রুপ তুমি আমার বাক্য অগ্রাহ্য করিতেছ। হে রাজন! তুমি যদি সমুদয় হিতাহিতকাৰ্য্যে প্রিয়বাক্য শ্রবণ করিতে বাঞ্ছা কর, তবে স্ত্রী, জড় ও পঙ্গু প্রভৃতি ব্যক্তিগণকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা কর। এই ভূমণ্ডলে প্রিয়ভাষী পাপাত্মা মনুষ্য অনেক আছে; কিন্তু অপ্রিয় অথচ হিতকর বাক্যের বক্তা ও শ্রোতা নিতান্ত দুর্লভ। যে ধর্ম্মনিরত ব্যক্তি প্রিয় বা অপ্রিয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়া হিতকর অপ্রিয় বাক্য কহে, সেই যথার্থ সহায়। হে মহারাজ! এক্ষণে তুমি অব্যাধিজ, কটুজ, তীক্ষ্ণ, উষ্ণ, যশোনাশক, পরুষ, সাধুগণের অশ্রাব্য ও অসাধুগণের শ্রবণসুখজনক বাক্য শ্রবণ কর; আর ক্ৰোধ করিবার আবশ্যকতা নাই। আমি কেবল ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁহার পুত্ৰগণের ধন ও যশোবৃদ্ধি করিবার বাঞ্ছায় তোমাকে সদুপদেশ দিয়াছিলাম। এক্ষণে তোমার যাহা ইচ্ছা, তাহাই কর; তোমাকে নমস্কার’, ব্রাহ্মণগণ আমার মঙ্গল করুন। হে কুরুনন্দন! পণ্ডিত ব্যক্তি নেত্রবিষ বিষধরকে ক্রোধান্বিত করেন না, আমি সেই অভিপ্ৰায়েই তোমাকে উপদেশ দিতেছিলাম।”