৬১তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিররক্ষাৰ্থ কৃষ্ণের অর্জ্জুন সতর্কতা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাত্মা হৃষীকেশ ধনঞ্জয়ের রথচালন করিয়া তাঁহাকে কহিলেন ‘হে পার্থ! ঐ দেখ, কৌরবপক্ষীয় মহাবলপরাক্রান্ত মহাধনুর্দ্ধরগণ তোমার ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের বিনাশবাসনায় দ্রুতবেগে উঁহার অনুগমন করিতেছে। যুদ্ধদুর্ম্মদ অপরিমিতবলশালী পাঞ্চালগণ ধর্ম্মরাজের রক্ষার্থ ক্রোধভরে উঁহার পশ্চাৎ ধাবমান হইয়াছে। কবচধারী রাজা দুৰ্য্যোধনও রথারোহণপূর্ব্বক আশীবিষসদৃশ যুদ্ধবিশারদ ভ্রাতৃগণের সহিত সর্ব্বলোকাধিপতি যুধিষ্ঠিরের অনুগমন করিতেছে। হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিগণও ধর্ম্মরাজের নিধনকামনায় রত্নগ্রহণে ধাবমান অর্থলোলুপের ন্যায় উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইতেছে। ঐ দেখ, অনল ও পুরন্দর যেমন অমৃতহরণোদ্যত দৈত্যগণকে রোধ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর সাত্যকি ও ভীমসেন ধর্ম্মরাজের অভিমুখে গমনোদ্যত কৌরবসৈন্যগণের গতিরোধ করিতেছেন; কিন্তু মহারথগণের সংখ্যা অধিক হওয়াতে উহারা শঙ্খবাদন, শরাসন বিঘূর্ণন ও সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক ঐ বীরদ্বয়কে অতিক্রম করিয়া সমুদ্রগমনোদ্যত বর্ষাকালীন জলরাশির ন্যায় যুধিষ্ঠিরের অভিমুখে গমন করিতেছে। এক্ষণে কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির দুৰ্য্যোধনের আয়ত্ত হওয়াতে উহাকে কালগ্রাসে পতিত ও হুতাশনে আহূত বলিয়া বোধ হইতেছে। এক্ষণে দুর্য্যোধনের যেরূপ কৌরবসৈন্য অবলোকন করিতেছি, তাহাতে বোধ হয়, দেবরাজ ইন্দ্রও উহার নিকট হইতে মুক্তিলাভে সমর্থ নহেন।
‘হে পার্থ! ক্রুদ্ধ অন্তকের ন্যায় তেজস্বী, শরধারাবর্ষী, ক্ষিপ্রহস্ত, মহাবীর দুর্য্যোধনের শরবেগ সহ্য করা কাহার সাধ্য? মহাবীর দুৰ্য্যোধন, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য্য ও কর্ণ—ইঁহাদিগের এক এক জনের বাণবেগে পর্ব্বতও বিশীর্ণ হইয়া যায়। হে ধনঞ্জয়! যুদ্ধবিশারদ শত্রুপাতন যুধিষ্ঠির অদ্য একবার কর্ণকর্ত্তৃক পরাভূত হইয়াছেন। ফলতঃ সূতপুত্র মহাবলপরাক্রান্ত ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের সহিত মিলিত হইয়া পাণ্ডবশ্রেষ্ঠকে পীড়ন করিতে পারে, সন্দেহ নাই। মহারাজ যুধিষ্ঠির কর্ণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে অন্যান্য মহারথেরাও তাঁহাকে প্রহার করিয়াছে। উপবাসব্রতধারী ভরতসত্তম ধর্ম্মরাজ নিয়ত ক্ষমাগুণে ভূষিত; ক্ষত্রিয়জনোচিত নিষ্ঠুরাচরণে সমর্থ নহেন। উনি কর্ণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হওয়াতে উহার জীবন নিতান্ত সংশয়ারূঢ় হইয়াছে। হে অর্জ্জুন! যখন অমর্ষপরায়ণ ভীমসেন বারংবার কৌরবগণের সিংহনাদ ও শঙ্খনাদ সহ্য করিতেছেন, তখন মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অবশ্যই অমঙ্গল সঙঘটিত হইয়াছে। ঐ দেখ, মহাবীর কর্ণ যুধিষ্ঠিরকে নিহত কর বলিয়া কৌরবগণকে প্রেরণ করিতেছে। মহারথগণ স্থূণাকর্ণ ইন্দ্রজাল, পাশুপতাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্রজালে রাজাকে সমাচ্ছন্ন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। যখন ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ জলনিমগ্ন ব্যক্তির উদ্ধারবাসনায় ধাবমান বলবান্ ব্যক্তিদিগের ন্যায় সত্বর ধর্ম্মরাজের অনুগমন করিতেছে, তখন নিশ্চয়ই তিনি অরাতিশরে নিতান্ত ব্যথিত ও অবসন্ন হইয়াছেন। উহার রথকেতু আর নয়নগোচর হইতেছে না; উহা নিঃসন্দেহ কর্ণের শরে ছিন্ন হইয়াছে।
‘ঐ দেখ, মাতঙ্গ যেমন নলিনীবনকে বিদলিত করে তদ্রূপ মহাবীর কর্ণ নকুল, সহদেব, সাত্যকি, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীমসেন, শতানীক এবং পাঞ্চাল ও চেদিগণের সমক্ষেই পাণ্ডবসেনা বিনাশ করিতেছে। হে পাণ্ডুনন্দন! ঐ দেখ, তোমাদিগের মহারথগণ রথ লইয়া কিরূপে ধাবমান হইয়াছে। মাতঙ্গগণ কর্ণের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া আর্ত্তনাদ করিয়া দশদিকে পলায়ন করিতেছে এবং সূতপুত্রের হস্তিকক্ষা কেতু ইতস্ততঃ সঞ্চারিত হইতেছে। ঐ দেখ, মহাবীর কর্ণ শত শত শর নিক্ষেপপূর্ব্বক পাণ্ডবসেনাগণকে বিনাশ করিয়া ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইয়াছে। পাঞ্চালগণ কর্ণশরে বিদ্রাবিত হইয়া পুরন্দরবিদলিত দৈত্যগণের ন্যায় চারিদিকে পলায়ন করিতেছে। এক্ষণে মহাবীর কর্ণ পাণ্ডু, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে পরাজিত করিয়া চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করাতে বোধ হইতেছে যে, ঐ বীর তোমাকে অন্বেষণ করিতেছে। মহাবীর সূতনন্দন এক্ষণে কার্ম্মুক বিস্ফারিত করিয়া শত্রুজয়ে পরমাহ্লাদিত সুরগণপরিবেষ্টিত পুরন্দরের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছে। ঐ দেখ, কৌরবগণ রাধেয়ের বিক্রমদর্শনে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণকে বিত্রাসিত করিতেছে। মহাবীর কর্ণ আমাদিগের সৈন্যগণের মনে ভয় সঞ্চারিত করিয়া কৌরবসৈন্যদিগকে কহিতেছে,—হে বীরগণ! তোমরা শীঘ্র ধাবমান হও; তোমাদিগের মঙ্গল হউক; যেন সৃঞ্জয়গণ জীবিত সত্ত্বে তোমাদিগের হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিতে না পারে; আমরাও তোমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছি। হে পার্থ! সূতপুত্র এই বলিয়া শরবর্ষণপূর্ব্বক সৈন্যগণের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছে। ঐ দেখ, চন্দ্রোদয়ে উদয়াচল যেরূপ শোভিত হয়, আজ মহাবীর কর্ণ শতশলাকাযুক্ত শ্বেতচ্ছত্রদ্বারা তদ্রূপ শোভমান হইয়াছে। ঐ বীর শরাসন বিকম্পিত করিয়া আশীবিষসদৃশ শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক তোমার প্রতি কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছে; এক্ষণে নিশ্চয়ই এইদিকে আগমন করিবে।
‘হে ধনঞ্জয়। ঐ দেখ, সূতপুত্র তোমার বানরধ্বজ অবলোকনে তোমার সহিত সংগ্রামে অভিলাষী হইয়া হুতাশনে পতনোঙ্মুখ শলভের ন্যায় তোমার অভিমুখে আগমন করিতেছে। ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুর্য্যোধন কর্ণকে একাকী দেখিয়া উহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত স্বীয় রথসৈন্যসমভিব্যাহারে আগমন করিতেছে। এক্ষণে তুমি রাজ্য, যশ ও সুখলাভার্থী হইয়া যত্নপূর্ব্বক উহাদিগের সহিত দুরাত্মা সূতপুত্রকে বিনাশ কর। হে অর্জ্জুন! তুমি ও কর্ণ দেবদানবের ন্যায় অকাতরে সমরে প্রবৃত্ত হইলে ক্রোধপরায়ণ দুৰ্য্যোধন তোমাদের দুইজনকে ক্রুদ্ধ সন্দর্শন করিয়া কিছুই করিতে সমর্থ হইবে না। অতএব তুমি এই সময়ে আপনার পবিত্রতা ও যুধিষ্ঠিরের প্রতি সূতপুত্রের ক্রোধ অনুধাবন করিয়া এখনকার সমুচিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হও; যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া মহারথ কর্ণের প্রতি গমন কর। ঐ দেখ, পাঁচশত মহাবলপরাক্রান্ত রথী, পাঁচসহস্র হস্তী, দশসহস্র অশ্ব এবং অযুত পদাতি একত্র মিলিত হইয়া পরস্পরকে রক্ষাপূর্ব্বক তোমার প্রতি ধাবমান হইতেছে। অতএব তুমি স্বয়ং মহাবেগে মহাধনুৰ্ধর সূতপুত্রের সমীপে সমুপস্থিত হও। ঐ দেখ, কর্ণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পাঞ্চালগণের প্রতি ধাবমান হইয়াছে। উহার রথকেতু ধৃষ্টদ্যুম্নের অভিমুখে লক্ষিত হইতেছে।
কৃষ্ণের কৌরবপরাজয়বিষয়ক আশ্বাসবাণী
‘হে ধনঞ্জয়। এক্ষণে তোমাকে এক মঙ্গলসংবাদ প্রদান করিতেছি। ঐ দেখ, ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির নিরাপদে অবস্থিতি করিতেছেন; মহাবীর ভীমসেন ও সাত্যকি সৃঞ্জয়সৈন্যে পরিবৃত হইয়া সেনামুখে অবস্থিত রহিয়াছেন। ঐ দেখ, মহাবীর ভীমসেন ও মহাত্মা পাঞ্চালগণ নিশিতশরনিকরে কৌরবগণকে বিনাশ করিতেছেন। দুর্য্যোধনের সৈন্যগণ ভীমশরে নিপীড়িত ও রুধিরোক্ষিত হইয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক ধাবমান হইতেছে। শস্যহীন বসুন্ধরার ন্যায় উহাদের আকার এক্ষণে নিতান্ত বিকৃতভাবাপন্ন হইয়াছে। ঐ দেখ, শ্বেত, রক্ত, পীত ও কৃষ্ণবর্ণ এবং চন্দ্র, সূৰ্য্য ও নক্ষত্রে ভূষিত পতাকা ও ছত্রসকল ইতস্ততঃ বিকীর্ণ হইতেছে। সুবর্ণরজতনির্ম্মিত তেজঃসম্পন্ন অসংখ্য কেতু এবং হস্তী ও অশ্বসমুদয় চারিদিকে নিপতিত রহিয়াছে। রথীগণ পাঞ্চালদিগের বিবিধ বাণে নিহত হইয়া রথ হইতে নিপতিত হইতেছে। পাঞ্চালগণ কৌরবপক্ষীয় আরোহিবিহীন হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয়ের অভিমুখে মহাবেগে ধাবমান হইতেছে এবং ভীমসেনের সাহায্যে প্রাণপণে শত্রুদল বিমর্দ্দিত করিয়া সিংহনাদ ও শঙ্খধ্বনি করিতেছে। হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে পাঞ্চালদিগের ক্ষমতা অবলোকন কর; উহারা নিরায়ুধ হইয়াও শত্রুপক্ষের অস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক সেই অস্ত্রদ্বারাই উহাদিগকে বিনাশ করিতেছে। ঐ দেখ, অরাতিগণের মস্তক ও বাহুসকল চতুর্দ্দিকে নিপতিত হইতেছে। পাঞ্চালপক্ষীয় গজারোহী, অশ্বারোহী ও রথারোহী বীরগণ সকলেই প্রশংসনীয়। হংসাবলী যেমন মানসসরোবর হইতে ভাগীরথীতে উপস্থিত হয়, তদ্রূপ পাঞ্চালগণ মহাবেগে ধৃতরাসৈন্যমধ্যে সমুপস্থিত হইয়াছে। ঐ দেখ, বৃষভগণ যেমন বৃষভদিগের নিবারণার্থে পরাক্রম প্রকাশ করে, তদ্রূপ কৃপ ও কর্ণপ্রমুখ বীরগণ পাঞ্চালদিগের নিবারণের নিমিত্ত বিক্রম প্রদর্শন করিতেছেন। ধৃষ্টদ্যুমপ্রমুখ বীরগণ ভীমাস্ত্রে মর্দ্দিত কৌরবপক্ষীয় সহস্র সহস্র মহারথ নিহত করিতেছে। ঐ দেখ, অরাতিগণ পাঞ্চালদিগকে অভিভূত করাতে মহাবীর বৃকোদর নির্ভীকচিত্তে শত্রুগণকে আক্রমণ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক শরবর্ষণে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কৌরবসৈন্যগণের অধিকাংশই অবসন্ন হইয়াছে; রথীগণ ভয়ে পলায়ন করিতেছে। ঐ দেখ, কতকগুলি হস্তী ভীমের নারাচে বিদীর্ণকলেবর হইয়া বজ্রাহত পৰ্বতচূড়ার ন্যায় ভূতলে নিপতিত এবং কোন কোনটা সন্নতপর্ব্বশরে বিদ্ধ হইয়া স্বপক্ষীয় সৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিয়া ধাবমান হইতেছে। ঐ মহাবীর ভীমসেন অরাতিপরাজয়ে পরমপরিতুষ্ট হইয়া ভীষণ সিংহনাদ করিতেছেন। ঐ দেখ, একজন গজারোহী গর্জনপূর্ব্বক দণ্ডপাণি অন্তকের ন্যায় তোমার হস্তে করিয়া ভীমের বিনাশবাসনায় আগমন করিতেছিল; মহাবীর ভীমসেন সুৰ্য্য ও অগ্নিসদৃশ সুতীক্ষ্ণ দশ নারাচে উহার ভুজদ্বয় ছেদনপুৰ্ব্বক উহাকে বিনাশ করিয়া শক্তি ও তোমরসমূহদ্বারা মহামাত্রসমধিষ্ঠিত [১] নীলাম্বুদসন্নিভ অন্যান্য হস্তিগণের বিনাশে প্রবৃত্ত হইতেছেন। ঐ দেখ, তিনি নিশিতশনিকরে একবারে সাত সাত মাতঙ্গ নিহতপূর্ব্বক ধ্বজপতাকাসকল ছিন্ন করিয়া দশ দশ বাণে এক এক হস্তী নিপাতিত করিতেছেন। হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে পুরন্দরসদৃশ মহাবীর বৃকোদর ক্রুদ্ধ হইয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়াতে কৌরবসৈন্যের সিংহনাদ আর শ্রুতিগোচর হইতেছে না। দুর্য্যোধনের তিন অক্ষৌহিণী সৈন্য ভীমসেনের সম্মুখে সমাগত হইয়াছিল; বৃকোদর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাহাদের সকলকেই নিবারণ করিয়াছেন।
“হে মহারাজ! তখন মহাবীর অর্জ্জুন ভীমসেনের সেই সুদুষ্কর কাৰ্য্য অবলোকন করিয়া নিশিতশরনিকরে অবশিষ্ট সৈন্যগণকে বিমর্দ্দিত করিতে লাগিলেন। সংশপ্তকগণ অর্জ্জুনের শরে নিহন্যমান হইয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক দশদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল এবং অনেকে প্রাণপরিত্যাগপূর্ব্বক ইন্দ্রত্ব লাভ করিয়া শোকশূন্য হইল; মহাবীর ধনঞ্জয়ও সন্নতপর্ব্বশরনিকরে কৌরববল বিনাশ করিতে লাগিলেন।”