৬১তম অধ্যায়
ভীষ্মসহ অর্জ্জুনের যুদ্ধ
কর্ণকে পরাজয় করিয়া উত্তরকে কহিলেন, “হে রাজকুমার! যে স্থানে হিরন্ময় তালবৃক্ষ বিরাজিত রহিয়াছে, যে স্থানে অমরদর্শন শান্তনুনন্দন ভীষ্ম সৈন্যগণ-সমভিব্যাহারে আমার সহিত যুদ্ধ করিবার মানসে রথারোহণপূর্ব্বক অবস্থিতি করিতেছেন, ঐ স্থানে রথ লইয়া যাও।” তখন বিরাট-তনয় উত্তর অনবরত শরজালে জর্জরিত কলেবর ও হস্তী, অশ্ব ও রথসঙ্কুল সৈন্যমণ্ডলী নিরীক্ষণে নিতান্ত ভীত হইয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে মহাভাগ! আমি আপনার অশ্বগণের রশ্মি সংযত করিয়া রাখিতে নিতান্ত অসমর্থ হইতেছি; আমার সর্ব্বাঙ্গ অবসন্ন ও মন একান্ত বিহ্বল হইয়া উঠিয়াছে। আপনি ও কৌরবগণ যে সমস্ত দিব্য শরজাল প্রয়োগ করিতেছেন, বোধ হয় যেন, তাহার প্রভাবে দশদিক দ্রবীভূত হইতেছে। আমি মেদ, রুধির ও বসাগন্ধে মূর্ছিতপ্রায় হইয়াছি; আজি এই সকল অলৌকিক ব্যাপার অবলোকন করিয়া আমার মন সাতিশয় অবসন্ন ও বিবেকাশূন্য হইতেছে।
আমি পূর্ব্বে এরূপ বীরসমাগম কদাচ নিরীক্ষণ করি নাই। এক্ষণে সুমৎ গদাঘাত, শঙ্খধ্বনি, সিংহনাদ, মাতঙ্গ বৃংহিত ও অশনিনির্ঘোষসদৃশ গাণ্ডীবরব দ্বারা আমার কর্ণকুহর বধির, স্মৃতিভ্রংশ ও চেতনা বিনষ্ট হইয়াছে। আপনাকে অলাতচক্রপ্রতিম গাণ্ডীব আকর্ষণ করিতে দেখিয়া আমার দৃষ্টি বিচলিত ও হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। ক্ৰোধোদ্ধত ভগবান ব্যোমকেশের ন্যায় আপনার এই উগ্ৰমূর্ত্তি ও অর্গলতুল্য ভুজযুগল অবলোকন করিয়া আমার অন্তঃকরণে অপরিসীম ভয়সঞ্চার হইতেছে। আপনি কখন বাণ গ্ৰহণ করিতেছেন ও কখনই বা প্রয়োগ করিতেছেন, আমি তাহা কিছুই অনুভব করিতে সমর্থ হইতেছি না। ফলতঃ রণক্ষেত্রে আপনার ক্ষিপ্রকারিতা সন্দর্শনপূর্ব্বক আমি নিতান্ত বিচেতন হইয়া উঠিয়াছি। বোধ হইতেছে যেন, ভূমণ্ডল নিরন্তর ঘূর্ণিত হইতেছে। এক্ষণে আমি আর কশাঘাত ও অশ্বরশ্মি গ্ৰহণ করিতে একান্ত অসমর্থ হইলাম।”
সমরভীত উত্তরকে আশ্বাসন
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে উত্তর! তুমি ভীত হইও না; সুবিখ্যাত মৎস্যরাজকুলে উৎপন্ন হইয়া রণস্থলে আশ্চৰ্য্য কাৰ্য্যসকল সংসাধন করিয়াছ; এক্ষণে কি নিমিত্ত অবসন্ন হইতেছ? ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক পুনরায় অশ্বসংযত কর, অবিলম্বে ভীষ্মদেবের সন্নিধানে যাইতে হইবে; আমি তাঁহার মৌর্বীচ্ছেদন করিব। যাদৃশ মেঘ হইতে সৌদামিনীদাম বিনির্গত হইয়া থাকে, তদ্রূপ আজি আমি রণস্থলে দিব্যাস্ত্ৰজাল বিস্তার করিব। তখন কৌরবগণ আমার এই সুবর্ণপৃষ্ঠ গাণ্ডীব নিরীক্ষণপূর্ব্বক উহার দক্ষিণ কি বাম পার্শ্ব হইতে শরনিকর নির্গত হইতেছে, ইহা নির্ণয় করিতে অসমর্থ হইয়া নানাপ্রকার তর্ক-বিতর্ক করিবে সন্দেহ নাই।
আজি আমি রথাবর্ত্তবতী [১] নাগনাক্ৰশালিনী [২] অরিনাশিনী শত্ৰুগণের শোণিততরঙ্গিণী [৩] [১-৩ আবৰ্ত্ত—ঘূণ্যমান জলমধ্যস্থ গৰ্ত্ত। হস্তী—কুম্ভীর জল—শত্ৰুশোণিত এবং বিধ নদীরূপ সমরস্রোত]
আলোড়িত করিব এবং কর, চরণ, শির, পৃষ্ঠ ও বাহুশাখাসঙ্কুল কুরু-কানন অবলীলাক্রমে ছেদন করিব। যেমন অর
ণ্যমধ্যে দহনোন্মুখ পাবকের গতি অপ্রতিহত হইয়া থাকে, তদ্রূপ যখন আমি একাকী কৌরবসেনা সকল সংহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইব, তখন কেহই আমার গতিরোধ করিতে পরিবে না। আমি বিচিত্র অস্ত্রশস্ত্ৰে সুশিক্ষিত হইয়াছি, আজি তুমি তাহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিবে। এক্ষণে বন্ধুর [নতোন্নত—উঁচুনীচু স্থান] প্রদেশে রথ উপস্থিত হইয়াছে, অতএব সাবধানে অবস্থান কর। আজি আমি নভোমণ্ডলগামী অতি বিপুল পর্ব্বত বিদীর্ণ করিব। পূর্ব্বে আমি দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশানুসারে শত সহস্ৰ পৌলোম ও কালঞ্জকদিগকে সংহার করিয়াছি; দেবরাজ হইতে দৃঢ়মুষ্টি ও ভগবান ব্ৰহ্মা হইতে ক্ষিপ্ৰহস্ততা শিক্ষা করিয়াছি; রুদ্রদেব হইতে রৌদ্রাস্ত্র, বরুণ হইতে বারুণাস্ত্ৰ, অগ্নি হইতে আগ্নেয়াস্ত্ৰ, বায়ু হইতে বায়ব্যাস্ত্র এবং দেবরাজ ইন্দ্ৰ হইতে ব্রজ প্রভৃতি সমস্ত অস্ত্ৰশস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছি। তুমি কদাচ ভীত হইও না; প্রবল বায়ু যেমন শীর্ণ কুলস্থ পাদপ-সমূহকে উন্মুলন করে, তদ্রূপ আজি তোমার সমক্ষে ষষ্টি সহস্ৰ পয়োনিধিপরবর্তী [সমুদ্রের পরপরবাসী] হিরণ্যপুরবাসিগণকে পরাজয় করিয়া কুরুকুল নির্মূল করিব এবং ধ্বক্ষবৃক্ষশালী, পত্তি [পদাতি] তৃণসম্পন্ন, রথিসিংহাসমাকীর্ণ কৌরববন অস্ত্রাগ্নি দ্বারা দগ্ধ করিব এবং অসহায় হইয়া আজি সমস্ত কৌরবসেনা সেই বাণসমূহ দ্বারা সংহার করিব।”
অনন্তর উত্তর মহাবীর অর্জ্জুন কর্ত্তৃক এইরূপে আশ্বাসিত হইয়া ভীষ্মরক্ষিত সেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। ক্রূরকর্ম্ম ভীষ্ম জিগীষাপরবশ অর্জ্জুনকে আগমন করিতে দেখিয়া তাঁহার পথরোধ করিলে তিনি প্রত্যাবৃত্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহার ধ্বজদণ্ড ছেদন করিলেন।
অনন্তর মহাবল-পরাক্রান্ত দুঃশাসন, বিকৰ্ণ, দুঃসহ ও বিবিংশতি, ইঁহারা আসিয়া অর্জ্জুনকে আক্রমণ করিলেন। দুঃশাসন ভল্লাস্ত্র দ্বারা উত্তরকে বিদ্ধ করিয়া অর্জ্জুনের বক্ষঃস্থলে প্রহার করিলেন। তখন অর্জ্জুন নিশিতধার শর দ্বারা কামুক ছেদন করিয়া পঞ্চ সায়কে তাঁহার অতি বিশাল বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। পরে দুঃশাসন পার্থশরনিপীড়িত ও তৎক্ষণাৎ সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া সত্বর সে স্থান হইতে অপসৃত হইলেন।
অনন্তর মহাবীর বিকর্ণ অর্জ্জুনের প্রতি আতি তীক্ষ্ন শরপ্রয়োগ করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন শাণিত সায়ক দ্বারা অবিলম্বে বিকর্ণের ললাটদেশ বিদ্ধ করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ রথ হইতে নিপতিত হইলেন। অনন্তর দুঃসহ ও বিবিংশতি বিকর্ণের প্রাণরক্ষা করিবার নিমিত্ত অর্জ্জুনের প্রতি অনবরত সুতীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন ধনঞ্জয় শরপ্রয়োগপূর্ব্বক তাহাদিগকে “একান্ত জর্জরিত করিয়া তাঁহাদিগের অশ্বসকল বিনাশ করিলেন। অধিকৃত লোকসকল তাঁহাদিগকে অন্য রথে আরোপিত করিয়া তথা হইতে অপসারিত করিল। তখন অর্জ্জুন অপ্ৰতিহত প্রভাবে রণস্থলে ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে লাগিলেন।