৬০তম অধ্যায়
বসুদেসমীপে কৃষ্ণের কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধ বর্ণন
এইরূপে মহাত্মা কেশব আসনে উপবিষ্ট হইয়া কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিলে, বসুদেব তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! আমি অনেকানেক ব্যক্তির মুখে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধসংবাদ শ্রবণ করিয়াছি; কিন্তু তুমি ঐ অদ্ভুত যুদ্ধ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছ; এই নিমিত্ত মহাত্মা পাণ্ডবগণ এবং নানাদেশনিবাসী বহুসংখ্যক ক্ষত্রিয়ের সহিত ভীষ্ম, কর্ণ, কৃপ, দ্রোণ ও শল্যাদির কিরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা তোমার মুখে শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে; অতএব তুমি উহা আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন কর।”
পদ্মপলাশলোচন হৃষীকেশ পিতা বসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া জননী দেবকীর সমক্ষে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক, কহিলেন, “পিতঃ! কুরুপাণ্ডবযুদ্ধে নিযুক্ত ক্ষত্রিয়গণের কাৰ্য্য অতি অদ্ভুত ও বহুল। শত বৎসর কীৰ্ত্তন করিলেও উহা সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ করা যায় না। অতএব আমি উহা অতি সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। প্রথমতঃ, মহাবীর ভীষ্ম কৌরবগণের একাদশ অক্ষৌহিণী ও মহাবীর শিখণ্ডী ধনুর্দ্বরাগ্রগণ্য অর্জ্জুনকর্ত্তৃক সুরক্ষিত হইয়া পাণ্ডবগণের সাত অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি হইয়াছিলেন। ঐ যুদ্ধ দশ দিবস হইয়াছিল। ঐ দশ দিবসের মধ্যে। উভয়পক্ষীয় অসংখ্য বীর কালকবলে নিপতিত হয়েন। পরিশেষে মহাবীর শিখণ্ডী অৰ্জ্জুনের সহিত সমবেত হইয়া অনবরত শরনিকরবর্ষী মহাত্মা ভীষ্মকে সমরাঙ্গনে নিপাতিত করিলেন। ভীষ্মদেব সূর্য্যের উত্তরায়ণকাল পৰ্য্যন্ত শরশয্যায় শয়ান ছিলেন; পরে উত্তরায়ণ উপস্থিত হইলে কলেবর পরিত্যাগ করেন।
“শান্তনুনন্দন শরশয্যায় শয়ান হইলে পর অস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য মহাবীর দ্রোণাচার্য্য কৌরবগণের সেনাপতি হইয়া কৃপ ও কর্ণ প্রভৃতি বীরগণের সাহায্যে হতাবশিষ্ট নয় অক্ষৌহিণী সৈন্যগণকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। এদিকে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন মিত্রপ্রতিপালিত বরুণের ন্যায় ভীমসেনকর্ত্তৃক সুরক্ষিত হইয়া পাণ্ডবগণের সেনাসমুদয়ের রক্ষায় নিযুক্ত হইলেন। ঐ মহাবীর পিতৃপরাভববৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া দ্রোণসংহারাভিলাষে রণস্থলে অতি ভীষণ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। দ্রোণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নের যুদ্ধকালে দিগ্বিদিক্ হইতে আগত বীরগণ প্রায় সকলেই বিনষ্ট হয়েন। এই উভয় বীরের পাঁচ দিবস ঘোরতর যুদ্ধ হয়। পরিশেষে, মহাবীর দ্রোণ সমরশ্রমে একান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ করিলেন।
“দ্রোণের মৃত্যুর পর মহাবীর কর্ণ পাঁচ অক্ষৌহিণী কৌরবসেনা ও ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য অৰ্জ্জুন তিন অক্ষৌহিণী পাণ্ডবসেনা লইয়া ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। দুই দিবস ঐ মহাবীরদ্বয়ের ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল। পরিশেষে মহাবীর কর্ণ বহ্নিমুখে পতঙ্গের ন্যায় অর্জ্জুনের হস্তে নিপতিত হইলেন। মহাবীর কর্ণ সমরে নিপতিত হইলে, কৌরবগণ নিতান্ত উৎসাহশূন্য ও নিব্বীৰ্য্য হইয়া মদ্ররাজ শল্যকে হতাবশিষ্ট তিন অক্ষৌহিণী সেনার আধিপত্যে স্থাপন করিলেন। পাণ্ডবেরাও স্বপক্ষীয় বহুসংখ্যক বীর নিহত হওয়াতে নিতান্ত ভগ্নোৎসাহ হইয়া যুধিষ্ঠিরকে হতাবশিষ্ট এক অক্ষৌহিণী সেনার আধিপত্য প্রদানপূর্ব্বক সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। যুধিষ্ঠিরের সহিত মদ্ররাজের অর্ধ দিবসমাত্র সংগ্রাম হইয়াছিল। পরিশেষে ধৰ্ম্মরাজ সংগ্রামস্থলে ভীষণ শরনিক্ষেপপূৰ্ব্বক মদ্ররাজকে নিহত করিলেন। মদ্ররাজের নিধনের পর মহাবীর সহদেব জ্ঞাতিবিচ্ছেদের অদ্বিতীয় কারণ দুষ্ট শকুনিকে বিনষ্ট করেন।
“শকুনি রণশয্যায় শয়ন করিলে মহারাজ দুৰ্য্যোধন নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া গদাগ্রহণপূৰ্ব্বক রণস্থল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া দ্বৈপায়নহ্রদে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন ক্রোধাবিষ্ট চিত্তে কুরুরাজকে অনুসন্ধান করিতে করিতে সেই হ্রদমধ্যে নিরীক্ষণ করিলেন এবং পাণ্ডবেরা হতাবশিষ্ট সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সেই হ্রদ পরিবেষ্টন করিয়া রহিলেন। পরিশেষে রাজা দুৰ্য্যোধন ভীমের বাক্যবাণে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া গদাহস্তে সেই হ্রদমধ্য হইতে যুদ্ধার্থ উত্থিত হইলেন। তখন মহাবীর ভীম অন্যান্য ভূপালগণের সমক্ষে বিক্ৰম প্ৰকাশপূৰ্ব্বক গদাযুদ্ধে তাঁহাকে সংহার করিলেন। ঐ দিন রজনীযোগে হতাবশিষ্ট পাণ্ডবসৈন্যগণ শিবির মধ্যে নিদ্রিত হইয়াছিল। মহাবীর অশ্বত্থামা পিতৃবধ সহ্য করিতে না পারিয়া তাহাদিগকে সেই অবস্থায় বিনাশ করেন।
“এক্ষণে পাণ্ডবগণের পুত্র, মিত্র ও সৈন্যসমুদয় নিহত হইয়াছে, কেবল তাহারা পাঁচজন, যুযুধান ও আমি আমরা এই কয়েক ব্যক্তিমাত্র অবশিষ্ট আছি। আর কৌরবপক্ষে অশ্বত্থামা, কৃপ ও কৃতবর্ম্মা এই তিনজন জীবিত আছেন। ধৃতরাষ্ট্রতনয় যুযুৎসুও পাণ্ডবগণের আশ্রয়লাভ করিয়াছিল বলিয়া সমর হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে। বিদুর ও সঞ্জয় দুর্য্যোধনের নিধনানন্তর ধৰ্ম্মরাজের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। হে তাত! এইরূপে কৌরব ও পাণ্ডবগণের অষ্টাদশ দিবস ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল। ঐ যুদ্ধে যেসমুদয় ভূপতি নিহত হইয়াছেন, তাঁহারা এক্ষণে স্বর্গলাভ করিয়া সুখে অবস্থান করিতেছেন।