৬০. কর্ণ-ধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধ

৬০তম অধ্যায়

কর্ণ-ধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ পাণ্ডব ও সূতপুত্ৰপ্রমুখ কৌরবগণ নির্ভয়ে পুনরায় সংগ্রামার্থ পরস্পর সমাগত হইলেন। তখন পাণ্ডবগণের সহিত কর্ণের যমরাজ্যবিবর্দ্ধন অতি ভীষণ লোমহর্ষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। সেই তুমুল যুদ্ধে শোণিতস্রোত প্রবাহিত ও সংশপ্তকগণ অল্পমাত্র অবশিষ্ট হইলে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও মহারথ পাণ্ডবগণ অন্যান্য ভূপালবৰ্গসমভিব্যাহারে সূতপুত্রের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর কর্ণ সেই সমস্ত বিজয়াভিলাষী প্রহৃষ্টচিত্ত বীরগণকে আগমন করিতে দেখিয়া, পৰ্বত যেমন জলপ্রবাহকে অবরোধ করে, তদ্রূপ একাকীই তাঁহাদিগের গতিরোধ করিলেন। তখন জলস্রোত যেমন অচলে সংলগ্ন হইয়া ইতস্ততঃ প্রবাহিত হয়, তদ্রূপ সেই মহারথগণ সূতপুত্রকে প্রাপ্ত হইয়া চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইলেন। অনন্তর সেই বীরগণের ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন আনতপর্ব্ব শরদ্বারা কর্ণকে প্রহার করিয়া ‘থাক থাক’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন; মহারথ কর্ণও বিজয় নামক উৎকৃষ্ট কার্ম্মুক কম্পিত করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের আশীবিষোধম শর ও শরাসন ছেদনপূর্ব্বক নয়শরে তাঁহাকে তাড়িত করিলেন। সূতপুত্রনির্ম্মুক্ত শরনিকর ধৃষ্টদ্যুম্নের সুবর্ণমণ্ডিত বর্ম্ম ভেদপূর্ব্বক শোণিতলিপ্ত হইয়া ইন্দ্রগোপের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তখন মহারথ দ্রুপদতনয় সেই ছিন্ন কার্ম্মুক পরিত্যাগপূর্ব্বক অন্য এক শরাসন ও শরনিকর গ্রহণ করিয়া সন্নতপর্ব্ব সপ্ততি বাণে কর্ণকে বিদ্ধ করিলেন; সূতপুত্রও আশীবিষসদৃশ শরনিকরদ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন।

“অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন নিশিতশরজালে কর্ণকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে মহারথ সূতপুত্ৰ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দ্রুপদনন্দনের প্রতি এক যমদণ্ডসদৃশ ভীষণ শরনিক্ষেপ করিলেন। ঐ সময় মহাবীর সাত্যকি সেই কর্ণনিক্ষিপ্ত ঘোররূপ শর ধৃষ্টদ্যুম্নের অভিমুখে আগমন করিতে দেখিয়া ক্ষিপ্রহস্তে তৎক্ষণাৎ উহা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর কর্ণ তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া যুযুধানকে শরনিকরে নিবারণপূর্ব্বক সাতনারাচে বিদ্ধ করিলেন; মহাবীর সাত্যকিও হেমমণ্ডিত সুনিশিত শরজালে তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই বীরদ্বয়ের ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। ঐ আশ্চৰ্য্য যুদ্ধদর্শন বা শ্রবণ করিলেও, অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইয়া থাকে। ঐ সময় মহাবীর কর্ণ ও সাত্যকির সেই অদ্ভুত কাৰ্য্যদর্শনে সকলেরই কলেবর কণ্টকিত হইয়া উঠিল।

ধৃষ্টদ্যুম্নসহ অশ্বত্থামার যুদ্ধ

“এই অবসরে মহাবীর অশ্বত্থামা শত্রুদমনে ধৃষ্টদ্যুম্নের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া ক্রোধভরে কহিলেন, ‘রে ব্রহ্মঘাতক! তুই ক্ষণকাল এই স্থানে অবস্থান কর, আজ জীবিতাবস্থায় কদাচ আমার নিকট পরিত্রাণ পাইবি না। মহাবীর দ্রোণতনয় এই বলিয়া প্রাণপণে যুদ্ধে প্রবৃত্ত ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রযত্নসহকারে ক্ষিপ্রহস্তে সুনিশিত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। পূর্ব্বে মহাবীর দ্রোণাচার্য্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে সন্দর্শনপূর্ব্বক উহাকে যেমন আপনার মৃত্যুস্বরূপ জ্ঞান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ এক্ষণে মহাবলপরাক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামাকে স্বীয় মৃত্যু বলিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর কালান্তক যমসদৃশ মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন আপনাকে সংগ্রামে শস্ত্রের অবধ্য বিবেচনা করিয়া মহাবেগে অন্তকপ্রতিম অশ্বত্থামার অভিমুখে আগমন করিতে আরম্ভ করিলেন; অশ্বত্থামাও ক্রোধভরে ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন সেই বীরদ্বয় পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিয়া ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন। অনন্তর প্রবল প্রতাপশালী মহাবীর অশ্বত্থামা সন্নিহিত ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্বোধপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে পাঞ্চালাপসদ[পাঞ্চালকুলাঙ্গার]! আজ আমি তোমাকে নিশ্চয়ই যমালয়ে প্রেরণ করিব। পূর্ব্বে তুমি আমার পিতাকে সংহার করিয়া যে পাপসঞ্চয় করিয়াছ, অদ্য সেই পাপ তোমাকে সাতিশয় সন্তপ্ত করিবে। রে মূঢ়! যদি তুমি অর্জ্জুনকর্ত্তৃক রক্ষিত না হইয়া রণস্থলে অবস্থান কর, অথবা সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়নপরায়ণ না হও, তাহা হইলে অবশ্যই তোমাকে সংহার করিব।’ তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে দ্রোণাত্মজ! আমার যে অসিদণ্ড তোমার সমরলালস পিতার বাক্যে উত্তর প্রদান করিয়াছিল, এক্ষণে সেই খড়্গই তোমার এই বাক্যের প্রত্যুত্তর প্রদান করিবে। আমি যখন ব্রাহ্মণাধম দ্রোণকে বিনাশ করিয়াছি, তখন কি নিমিত্ত বিক্রমপ্রকাশপূর্ব্বক তোমাকে নিহত না করিব?’ পাণ্ডবসেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন এই বলিয়া অশ্বত্থামাকে সুনিশিতশরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শরজালে ধৃষ্টদ্যুম্নের চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন দিঙ্মণ্ডল, নভোমণ্ডল ও যোধগণ সেই দ্রোণপুত্রনির্ম্মুক্ত শরনিকরপ্রভাবে এককালে অদৃশ্য হইয়া গেল। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নও সূতপুত্রের সমক্ষে অশ্বত্থামাকে শরনিকরে তিরোহিত করিলেন। মহাবীর কর্ণ একাকীই পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ এবং দ্ৰৌপদীর পঞ্চপুত্র, যুধামন্যু ও সাত্যকিকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন শরদ্বারা অশ্বত্থামার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অশ্বত্থামা অবিলম্বে সেই ছিন্নকার্ম্মুক পরিত্যাগ ও অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক আশীবিষোপম শরনিকর বর্ষণ করিয়া নিমেষমধ্যে ধৃষ্টদ্যুম্নের শক্তি, শরাসন, গদা, ধ্বজ, অশ্ব, সারথি ও রথ ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপে ছিন্নকার্ম্মুক, বিরথ, হতাশ্ব ও হতসারথি হইয়া খড়গচর্ম্ম গ্রহণ করিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা, দ্রুপদতনয় সেই ভগ্নরথ হইতে অবতীর্ণ না হইতে হইতেই ভল্লদ্বারা তাঁহার অসিদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই বিস্মিত হইল।

যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম-অশ্বত্থামা—উভয়ের বিমুখতা

“হে মহারাজ! এইরূপে দ্রুপদনন্দনের রথ ভগ্ন, অশ্ব নিহত, শরাসন ও খড়ঙ্গ ছিন্ন এবং শরাঘাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হইলেও অশ্বত্থামা কোনক্রমেই সায়কদ্বারা তাহাকে নিহত করিতে সমর্থ হইলেন না। দ্রোণপুত্র যখন দেখলেন যে, অস্ত্রদ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করা নিতান্ত দুঃসাধ্য, তখন তিনি কার্ম্মুক পরিত্যাগপূর্ব্বক ভুজগগ্রহণলোপ গরুড়ের ন্যায় মহাবেগে দ্রুপদতনয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। তদ্দর্শনে বাসুদেব অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, সখে! ঐ দেখ, অশ্বত্থামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে সংহার করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিতেছেন। অতএব এক্ষণে তুমি সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় দ্রোণপুত্রের নিকট হইতে ধৃষ্টদ্যুম্নকে মমাচন কর। নচেৎ অশ্বত্থামা অবশ্যই উহাকে সংহার করিবেন। মহাত্মা বাসুদেব এই বলিয়া অশ্বত্থামার অভিমুখে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। চন্দ্ৰসন্নিভ অশ্বগণ গগনতল পান করিয়াই যেন দ্রোণপুত্রের প্রতি মহাবেগে ধাবমান হইল। তখন মহাবলপরাক্রান্ত দ্রোণনন্দন বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে আগমন করিতে দেখিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নবধে দৃঢ়তর যত্ন করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় অশ্বত্থামাকে ধৃষ্টদ্যুম্ন আকর্ষণে যত্নবান্ দেখিয়া তাহার প্রতি শনিকর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। ধনঞ্জয়ের গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত সেই সমুদয় শর বল্মীকান্তৰ্গামী পন্নগের ন্যায় অশ্বত্থামার দেহে প্রবেশ করিতে লাগিল। তখন প্রবল প্রতাপশালী দ্রোণাত্মজ সেই অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত, শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরিত্যাগ, রথে আরোহণ ও কার্ম্মুক গ্রহণ করিয়া ধনঞ্জয়কে সায়কসমূহে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ অবসরে মহাবীর সহদেব অরাতিতাপন ধৃষ্টদ্যুম্নকে রথে আরোপিত করিয়া রণস্থল হইতে অপসারিত করিলেন।

“অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় শরনিকরে অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করিলে অশ্বত্থামা নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার বাহুযুগল ও বক্ষঃস্থলে শরাঘাত করিতে লাগিলেন। তখন ধনঞ্জয় রোষপরবশ হইয়া দ্রোণপুত্রকে লক্ষ্য করিয়া দ্বিতীয় কালদণ্ডের ন্যায় এক নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। নারাচ অর্জ্জুনকর্ত্তৃক নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র অশ্বত্থামার আস্যদেশে নিপতিত হইল। মহারথ দ্রোণনন্দন সেই শরাঘাতে একান্ত বিহুল হইয়া রথোপস্থে নিষন্ন ও বিমোহিত হইলেন। তদ্দর্শনে তাহার সারথি তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ রথস্থল হইতে অপবাহিত করিল। তখন সূতপুত্ৰ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বিজয়-শরাসন আকর্ষণ ও ধনঞ্জয়কে বারংবার নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার সহিত দ্বৈরথযুদ্ধ করিবার বাসনা করিতে লাগিলেন। পাঞ্চালগণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিমোচিত ও দ্রোণাত্মজকে নিতান্ত নিপীড়িত দেখিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। দিব্য বিবিধ বাদিত্ৰসমুদয় বাদিত হইতে লাগিল। বীরগণ সেই অদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেবকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, সখে! এক্ষণে তুমি সংশপ্তকগণের অভিমুখে অশ্ব সঞ্চালন কর। উহাদিগকে বিনাশ করাই আমার প্রধান কাৰ্য। তখন বাসুদেব সেই মনোমারুতগামী পতাকাপরিশোভিত রথ সঞ্চালন করিতে লাগিলেন।”