০৫.
এডরিসের প্ল্যানে কোন গরমিল নেই, নিখুঁত বলেই প্রমানিত হল। ঠিকানা পাবার পর ফিল ডেরিস ক্লিয়বির ফ্ল্যাটে গিয়ে তাকেসিঁড়ি দিয়ে পা হড়কে গড়িয়ে পড়ার নিখুঁত ব্যবস্থা করে আসার পর, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ডেরিস পা ভাঙল আর মাস খানেকের জন্য শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রইল নিজের শোবার ঘরে।
ইরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তার পিতৃদেবের কাছে দরবার জানাতে তিনি প্রথমেই কুঁইকুঁই করতে করতে শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন ডেরিসের অনুপস্থিতিতে ব্যাঙ্কের কাজকর্ম বিঘ্নিত হবার ভয়ে।
প্ল্যান অনুযায়ী একদিনব্যাঙ্কের ছুটির পর এডরিসের অ্যাপার্টমেন্ট আর ফ্লোরিডা ব্যাঙ্ক থেকে কিছু দূরে অন্য এক জায়গায় একটা মাঝারি সাইজের রের্তোরাঁয় প্রবেশ করে ফিলের হাতে ছোট্ট একটা কার্ডবোর্ডেরবাসতুলে দিয়ে ইরা বলে উঠল, এতে গোটাকতক পাসকীর ছাপ রয়েছে। আপাততঃ এই দিলাম, তবে সময় আর সুযোগ বুঝে অন্য পাসকীর ছাপও এনে দেব, টিকিকে বলে দিও।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁয় থাকার পর বেরিয়ে এলো ইরা। পিতৃদেবের উপহার স্বরূপ দেওয়া ছোট কিন্তু শক্তিশালী টি, আর, চার মডেলের গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল বাড়ির অভিমুখে।
এত বিলাস বৈভবআরআরাম স্বাচ্ছন্দের মধ্যে থেকেও ইরারমনেকিন্তুসুখ ছিলনা। দারিদ্র্যের আর অভাবের জ্বালা বর্তমানে নেই কিন্তু যৌবনের জ্বালা? দৈহিক ক্ষুধা? অবশ্য মন চাইলেই গুপ্ত শয্যাসঙ্গীর অভাব তার হবে না সত্যি, কিন্তু তার সারা দেহ-মন জুড়ে সেই জেমস ফার অদৃশ্য ভাবে বিরাজ করছে। সেই সুখ আর তৃপ্তির স্মৃতি কি কখনও স্মরণে না রেখে পারা যায়? নিয়ম করে হপ্তায় চারদিন যৌনক্রীড়ায় মেতে উঠত সে আর ফার। দুইটা কী পৈশাচিকরূপেই তাকে গ্রহণ করত। তার লালসার কাছে হার মানতে হতো।ব্যথায় আর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ইরার চোখ ফেটে জল আসতে চাইত। তবু সেই নিষ্ঠুরতার শেষে যে স্বর্গসুখ, যে অনির্বচনীয় তৃপ্তির স্বাদ ইরা পেয়েছে, তার তুলনা কোথায়? পারবে কী এইসব গুঁড়ি গুডি ছেলেরা সেভাবে তাকে সুখের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে? মাস খানেক হলো ফারের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। ইরার মতো ফারও নিশ্চয়ই সতী সেজে বসে নেই।
কোন দুঃখেই বা সাজবে? তার মতন পুরুষের কাছে কী মেয়ের অভাব? লিয়াই হয়তো স্ব মহিমায় আবার তার সাম্রাজ্যে ফিরে এসেছে। নাঃ চিঠি লিখে, প্লেন ভাড়া পাঠিয়ে তাকে আনতেই হবে। সত্যি এই নিঃসঙ্গ একাকীত্ব আর সহ্য হয় না। কিন্তু মিঃ ডেভন যদি জানতে পারেন? তার ওপর রয়েছে টিকি আর ফিল। তাদের মনেও সন্দেহের সৃষ্টি করবে। তারা যদি এই ভাবে যে ইরা তার দেহের তাগিদে ফারকে কাছে ডাকেনি নিকটে পাওয়ার উদ্দেশ্য এই সম্পত্তির আরো একজন ভাগীদার রূপে, তখন? চিন্তায় ডুবে গেল ইরা। কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়? এদিকে ফারকে চা-ই চাই। না হলে চলবে না।
.
ছফুটের ওপর লম্বা, সেই অনুপাতে চওড়া বলশালী চেহারা হায়াম ওয়ানাসির। বয়স প্রায় তেষট্টি। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রঙ। টেক্সাস কোটিপতি, দেড় মাস প্যারাডাইস সিটিতে ছুটি কাটিয়ে আগামী কালই সস্ত্রীক ফিরে যাবেন স্বদেশে। তার এ ব্যাপার মোটেই ভালো লাগছিল না। কোথায় প্যারাডাইস সিটি আর কোথায় তার ডালাসের কাছে টেক্সস রেঞ্জ।
সেখানে শুধু কাজ, কাজ আর কাজ, মনকে ভোলাবার মতন কিছু নেই। মেয়েগুলো পর্যন্ত টেক্সাসের মত রুক্ষ, কঠিন আর রসকসহীন। তাদের সঙ্গে রোমান্সের কথা ভাবলেই অস্বস্তিতে সারা মন ঘিন ঘিন করে ওঠে।
কিন্তু এখানে? আহা! মধু! মধু!
বেলা তিনটের সময় ওয়ানাসির রোলস রয়েস কার এসে ফ্লোরিডা ব্যাঙ্কের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তিনি গণমান্য আর বিশেষ পরিচিত একজন ক্লায়েন্ট। তিনি গাড়ি থেকে নামতেই ব্যাঙ্কের গার্ডরা সসম্ভ্রমে আর সাবধানে অভিবাদন জানাল তাকে। লকার রুমের ক্ষেত্রেও তাই। সবাই তটস্থ।
চীফ গার্ড কুশল জিজ্ঞাসা করলে মুখ থেকে প্রকাণ্ড সিগারেট সরিয়ে বেদনার স্বরে বলে উঠলেন তিনি, মন ভালা নেই হে, তোমাদের এই শহর ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে। আবার আসব সামনের বছর।
নিয়ম-কানুনের ফর্মালিটি সেরে সিঁড়ি বেয়ে মাটির তলাকার ভল্টরুমে নামতেই ওয়ানাসির চোখ ছানা বড়া! আরে, এ মেয়েটা আবার কে। কোন স্ত্রী পরী নয়তো, আগের সেই বদখৎ, ভাবলেশহীন, ফ্ল্যাট চেস্টের গোমড়ামুখো ডেরিস মেয়েটা কোথায় গেল? হায়াম ওয়ানাসিকে দেখে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মধুর ভাসিনী হাসি হাসল ইরা!
ইরার রূপ, যৌবন চোখে ধা লাগিয়ে দিল ওয়ানাসির। তিনি অপলকনেত্রে খাণিকক্ষণ চেয়ে রইলেন ইরার দিকে।
গুড আফটার নুন, মিঃ ওয়ানাসি, ইরা তার কাছে এগিয়ে এসে অভিবাদন জানাল। আমি মিস ডেরিস ক্লিয়বির জায়গায় এসেছি–তবে সাময়িক ভাবে কারণ সে এখন সুস্থ নয়।
ওয়ানাসি ইরার সুঠাম গড়নের শরীরের উঁচু নীচু জায়গাগুলো, তার দেহের খাঁজ আর বাঁকগুলো জহুরীর দৃষ্টি দিয়ে বিচারপর্ব সারতে সারতে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে, হনি? কী নাম তোমার?
-নোরেনা ডেভন।
ডেভন মেল ডেভনের নামের সঙ্গে চমৎকার মিল আছে দেখছি।
–উনি আমার বাবা।
–সত্যি? তোমার বাবা?সত্যি আশ্চর্যের কথা!আমি দশবছর ধরে এই ব্যাঙ্কের ক্লায়েন্ট অথচ মেল ডেভনের যে তোমার মতন এক অপরূপা সুন্দরী বেবী ডল আছে তাই আমার অজানা ছিল!
-এতদিন পড়াশুনো নিয়ে ব্যত ছিলাম। ছোট থেকে বোর্ডিং, এখন পড়াশুনো শেষ করে ঘরে বসে থাকতে মন চাইল না তাই বাবাকে বলে এখানে জয়েন করেছি।
কথা বলতে বলতে ইরা এমন ভুবন ভোলানো হাসি হাসল, এমন করে তাকাল যে তাতেই বৃদ্ধ ওয়ানাসি অর্ধেক কাৎ।
ইরা তার বলা জারি রাখল, একটু আগে ফোনে বাবা আপনার কথা বলছিলেন। আপনার খাতির যত্নের যাতে কোন জটি না হয় সে ব্যাপারে বার বার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন। গোড়ার দিকে আমি খুব নার্ভাস বোধ করছিলাম। আপনাকে দেখে মনটা আগের চাইতে অনেক হাল্কা লাগছে। বলুন, কী করতে হবে?
আরো একবার মন কাড়া হাসি, সেইসঙ্গে বিলোল কটাক্ষ। যেটুকু অবশিষ্ট স্বরূপ পড়েছিল ওয়ানাসির তাও এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল। এরপর বৃদ্ধ ওয়ানাসি তার লকারের কাছে নিয়ে গিয়ে তার চাবি আদায় করা, হাতের তেলোয় লুকিয়ে রাখা পুটিতে তার ছাপ নেওয়া ইত্যাদি কিছুই কঠিনরূপে ধরা দিল না ইরার কাছে। কিন্তু বৃদ্ধর সে সব দিকে দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশ কোথায়?তখন তিনি ড্যাব ড্যাব করে ইরার নিতম্বদ্বয়ের ওঠানামা আর সুউন্নত সুগোল স্তনজোড়ার আন্দোলন দেখতেই মোহিত। অন্যদিকে তাকাবার ক্ষমতাই তার এখন নেই।
সে খুলে একপাশ হয়ে সরে দাঁড়াল ইরা। হায়াম ওয়ানাসিযখন টাকাবার করতে ব্যস্ত ছিলেন, ইরা আড়চোখে চেয়ে যা দেখল তাতে তার চক্ষু ছানা বড়া :সেটা কম করে একশো আর হাজার ডলারের নোটে ঠাসা। কোথাও একটু ফাঁক-ফোকর নেই। চোখ জোড়া মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল ইরার। বাপরে! এত টাকা!
বেশকিছু টাকা বের করে ওয়ানাসি ইরার দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বললেন, আপাততঃ যা নিয়েছি, তা যথেষ্ট। আমার হয়ে তুমি না হয় সেটা বন্ধ করে দাও, হনি। আশা করব তোমার হাতের পরশে আমার এই সেটা চিরদিনই ফুলেফেঁপে থাকবে।
ইরা হাসি মুখে ওর আর নিজের চাবি নিয়ে সেফ বন্ধ করার জন্য ঝুঁকে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কাণ্ড করে বসলেন ওয়ানসি। ইরা ঝুঁকে পড়ে সে বন্ধ করার কাজে যখন ব্যস্ত, বৃদ্ধ ওয়ানাসি নিজেকে আর সামলাতে না পেরে পেছন থেকে দুহাত বাড়িয়ে ইরার স্তনযুগল সবলে মুঠো করে ধরে বার কয়েক মর্দন করেই ছেড়ে দিলেন। অন্যসময় আর অন্য স্থান হলে তার মুখে সপাটে জুতোর ঘাবসাইরা। পুলিশ ডাকত, গালাগালির ফোয়ারা ছোটাতো।এত সহজে ছেড়ে দিত না। কিন্তু এক্ষেত্রে মুখ বুজেই সে সবকিছু সহ্য করল। সে বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে শান্তকণ্ঠে শুধু বললেন, আপনার মতো গণ্যমান্য আর বিত্তবান মানুষের কাছ থেকে ঠিক এ ধরণের ব্যবহার আমি প্রত্যাশা করিনি, মিঃ ওয়ানসি। আপনি আমার গুরুজন, আপনার নাভীর সমকক্ষ আমি, তার ওপর আপনার বন্ধুর মেয়ে। আমার সঙ্গে এই অশোভনীয় আচরণ আপনি কেন করলেন! যাক, ভবিষ্যতে এমন ভুল আর কখনো করবেন না, এইটুকু আশা আমি রাখতে পারি।
নিজের অজান্তে এই রকম ব্যবহার করার পর ওয়ানাসি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছেন। লজ্জা, ভয়, কুণ্ঠা তার মনকে আষ্টেপিষ্টে বিদ্ধ করছে। ঘামতেও শুরু করেছেন। তাই যত তাড়াতাড়ি হয় এখান থেকে সরে যেতে পারলে তিনি বেঁচে যান। ঝটকরে একটা একশো ডলারের নোট বার করে ইরার হাতে গুঁজে দিতে দিতে লজ্জিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, মনে কিছু করোনা হনি। ভুল করে সত্যি এক অনুচিত কাজ আমার দ্বারা হয়ে গেছে। এই টাকাটা রাখ, মন যা চায় তাই কিনো, আর দয়া করে মেলকে কিছু এ বিষয়ে বলোনা, কেমন, কেমন? আচ্ছা চলি, আবার আসব সেই সামনের বছর।
ওয়ানাসি চলে গেলে ইরা আপন মনেই হেসে উঠল। ভাবল, সামনের বছর এসে বৃদ্ধ যখন দেখবে তার হাতের ছোঁয়া বৃদ্ধর সে ভরপুর না হয়ে পরিবর্তে সব শূন্য হয়ে গেছে, ওর মুখের আর মনের অবস্থা তখন কেমন হবে!
পরের দিন সকাল নটা নাগাদ ইরা গিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় হাজির হলো। ফোনে আগেই কথা হয়ে গিয়েছিল এডরিসের সঙ্গে। এডরিস জানিয়েছিল, ফিল তার প্রতীক্ষায় সেখানে থাকবে। ইরা গেলে ওয়ানাসির চাবির ডুপ্লিকেট তার হাতে সেখানেই তুলে দেওয়া হবে। রেস্তোরাঁর এককোণে একটা টেবিল দখল করে তারই প্রতীক্ষায় বসেছিল ফিল। ইরাকে ঢুকতে দেখে হাত নেড়ে কাছে ডাকল। ইরা গিয়ে বসল টেবিলে। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে ফিল তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে, চারিদিকে একবার মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়ে কেউ তাদের লক্ষ্য করছে কিনা দেখে নিয়ে, টেবিলের তলা দিয়ে নকল চাবিটা ইরার হাতে চালান করে দিল।
-খুব যত্নের সঙ্গে তৈরী করেছি এই নকলটা, ফিসফিস কণ্ঠে বলল ফিল, আশাকরি কোন ঝামেলা হবেনা। এগারোটা নাগাদ আমি যাব। আমার সঙ্গে শুধু একটা ব্রিফকেস থাকবে। তুমি পারবে না ঐ সময়ের মধ্যে টাকাগুলো আমার সেফে চালান করে দিতে?
মনে হয় পারব যদিও কাজটা সহজ নয়, বুকি আছে যথেষ্ট। লকাররুমের এককোণে ওয়ানাসির সে, তার ঠিক উল্টো কোণে তোমার। মনে হচ্ছে ঐ সময় সেখানে কারো পদধূলি পড়বে না। জবাব দিল ইরা।
–তবে ঐ কথাই রইল : ঠিক এগারোটার সময় আমি গিয়ে হাজির হচ্ছি ব্যাঙ্কে। তুমি তার আগেভাগেই এক সেফ থেকে আর এক সেফে টাকাগুলো পাচার করে রাখবে।ফিল এরপর তার ব্রেকফাস্ট সেরে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এল। একটু পরে ইরাও।
দশটার একটু আগে ইরা এসে দাঁড়াল গ্রীল দেওয়া ভল্টরুমের দরজার সামনে। চীফগার্ড তাকে গুডমর্নিং জানিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর একে একে সইসবুদ, পাসকী দেওয়া ইত্যাদি প্রতিদিনকার নিয়মের বেড়াজাল পার হবার পর চীফগার্ড সহাস্যে জানাল: আজকে আপনার খুব পরিশ্রম হবে, মিস। একগাদা ক্লায়েন্টস শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দুপুর নাগাদ আসবেন মিঃ রস আর মিঃ লাজ্ঞা। দুজনেই কোটিপতি, ব্যাঙ্কের খয়ের খাঁ।ওদের একটু আদর-আপ্যায়ন করবেন।
–চিন্তা নেই, আন্ডুইক, সেদিকে আমার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। হাসি মুখে কথাগুলো বলে সিঁড়ি দিয়ে ইরা নেমে এল নীচে।
নিজের টেবিলে এসে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়াল ইরা। শুধু একবার চাইল নেমে আসা সিঁড়ির দিকে।না,গার্ডরা যেখানে পাহারা দিচ্ছে সেখান থেকে এই দিকের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব হবে না-যদি না ঝুঁকে বসে দেখবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে।ইরা আর সময় নষ্ট না করে চটপট ড্রয়ার খুলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্ৰবার করে নিজের টেবিলসাজাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।একটু সময়ও নষ্ট করা উচিত হবে না। দশ বাজতে তখনও তিন মিনিট দেরি।
উত্তেজনা আর নার্ভাসনেসেইরার বুক ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে। স্কার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফিলের দেওয়া চাবিটা একবার খুঁয়ে দেখল।
মুহূর্তের ইতস্ততা, আরও একবার সিঁড়ির দিকে চাইল, পরমুহর্তেইসব দুর্বলতার পাহাড় ঝেড়ে ফেলে সে দ্রুতপদক্ষেপে এগিয়ে গেল ওয়ানাসির সেফের দিকে।
সেফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন মনে হলো, সে যেন একটা আগ্নেয়গিরির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।তার অজান্তে যে কেউ এসে যেতে পারে এইভক্টরুমে এখান থেকে টেবিলনজর পড়ে না। সেও জানতে পারবেনাকারো উপস্থিতি। টেবিলে দেখতে পেয়ে, যেকেউযদিতারসন করতে করতে এখানে এসে পড়ে তবে তার অভাবনীয় কুকীর্তি অবশ্যই তার চোখে পড়বে।
একবার ঘড়ি দেখল ইরা। দশটা চার, আইকের কাছে সে শুনেছে লকার লেনেওয়ালা ক্লায়েন্টরা দুপুরের আগে আবার কখনো ব্যায়ে পা রাখেনা। কিন্তু দৈবাৎ কেউ এসে পড়ে, তবে? ক্ষণিকের জন্য ইরার শরীরের সারা স্নায়ুতন্ত্র যেন বিকল হয়ে পড়ল। ফিরে যাবার জন্য সে ঘুরে দাঁড়িয়ে পাও ফেলল, জেমের কথা ভেবে সেই বাড়ানো পা আবার টেনে নিল ইরা। সেফ না খুললে আনবার টাকা কোথায় পাবে সে? মিঃ ডেভন তাকে হাত খরচের মতোই যা টাকা দিয়ে থাকেন, তাতে জেমের প্লে-ফেয়ার…পোষাক পরিচ্ছদ…খাই খরচ…রাহা খরচ…এ সমস্ত কখনই কুলোবে না। অতএব সেফ তাকে যেকোন উপায়েই উন্মুক্ত করতে হবে।
একটু চেষ্টা করতেই সেফ খুলে গেল। নাঃ, ফিলের বাহাদুরীও আছে বটে। নকল হলেও চাবিটা কাজ করছে একেবারে আসলের মতোই। সেফ খুলেই কী মনে করে একবার ঘুরে এলো তার টেবিলের কাছ থেকে।না, কেউ আসেনি। কেউ প্রতীক্ষায় নেই তার। শুধু গার্ডদের পদধ্বনি কানে আসছে মৃদু মৃদু, যেমন আগেও এসেছে বহুবার।
হাতের তেলো ঘামে ঘর্মাক্ত বৈজায় ভিজে। স্কার্টের গায়ে ভাল করে হাতমুছে নিল সে। ফিরে এসে ক্ষণিকের জন্য কাজে মন দিল। থরে থরে সাজানো টাকার বাণ্ডিল। একটা বান্ডিল টেনে দ্রুত গুণে দেখল ৪২,৫০০ ডলারের নোট আছে তাতে।
উফ! জীবনে এতোটাকার মুখ দেখার সৌভাগ্য এর আগে কখনও হয়নি–ছোঁয়া তো দূরে থাক। কিন্তু এই টাকায় জেমের যাবতীয় খরচ কুলোন সম্ভব হবে কী? আপাত দৃষ্টিতে মনে তো হয় না। তাই আরো একটা বাণ্ডিল টেনে নিল ইরা। তারপর স্কার্ট তুলে টাকার বাণ্ডিল দুটো সে তার প্যান্টির গার্ডল টেনে প্যান্টি আর তলপেটের খাঁজে সযত্নে ঢুকিয়ে দিল। অনেক ভেবে সে গার্ডল দেওয়া, প্যান্টি আর ঢিলে কুচি দেওয়া স্কার্ট আজ চাপিয়ে এসেছে।
এবার ফিলের সেফের জন্য টাকা নেওয়ার পালা। যা টাকা আছে সেটাতে সব নিতে গেলে তাকে চার-পাঁচ বার ছোটাছুটি করতে হবে। দেখাই যাকনা হয় এর শেষ।এই ভেবে সে ওয়ানাসির সেফ খালি করে টাকার বান্ডিলগুলো মেঝেয় একে একে নামাতে লাগল। একগোছানামানোর পর পরবর্তী গোছায় হাত দিতে যাবে, ঠিক এই সময়ে তার কানে এল সিঁড়িতে জুতোর শব্দ।
মুহূর্তের মধ্যে চোখে অন্ধকার দেখল ইরা। বুকের মধ্যে দমাদম মুগুর পিটতে লাগল এক অজানা আতঙ্ক। ভয়ে-আতঙ্কে লজ্জায় সারা শরীর হিম আর কঠিন হয়ে গেল। কেউ যেন এদিকেই আসছে।
স্তূপাকৃতি নোটের তাড়া আর উন্মুক্ত সেফ ফেলেই ছুটল ইরা।
টেবিলের সামনে স্বয়ং তার পিতা মেল ডেভন দাঁড়িয়ে।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইরা। দেহের সমস্ত রক্ত আর শক্তি নিঃশেষে কে যেন চো চো করে। শুষে নিল। আত্মসংবরণ করে নিজেকে কোন রকমে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাল ইরা। তারপর যন্ত্রচালিতের মতো পিতার কাছে যেতেই স্বপ্নের ঘোরেই সে উচ্চারণ করল দুটি শব্দ, হ্যালো ড্যাডি…
মেল মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার চোখ মুখের অবস্থা শুকনো…ফ্যাকাসে…কী ব্যাপার? শরীর খারাপ?
কৈ নাতো! জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে ফিকে হাসি হেসে ইরা জবাব দিল, আমি তো ভালোই আছি।
টেবিলে তোমাকে দেখতে না পেয়ে আমি কম অবাক হইনি। তা, ভেতরে কী করছিলে?
–আজ মিঃ রস আর লাঞ্জা আসছেন এখানে শুনলাম। তাই আগে ভাগে এটাই দেখে আসতে ভেতরে গেছিলাম। তাদের সে দুটোর অবস্থান, যাতে না তাদের এখানে এসে অযথা প্রতীক্ষা করতে হয়।অম্লান বদনে এক ঝুড়ি মিথ্যে বুলি গড় গড় করে আওড়ে চলল ইরা। সময়োচিত কৈফিয়ৎ আবিষ্কারের বাহাদুরীর বহর দেখে সে নিজেই ভেতরে ভেতরে খুব অবাক। মেয়ের কাজের প্রতি অনুরাগ আর ঐকান্তিকতা দেখে মুগ্ধ হলেন ডেভন। তিনি এই জানার প্রয়াস করলেন-খুঁজে পেয়েছ?
হ্যাঁ। তার বলা শেষ করে চেয়ারে বসে পড়ল ইরা। এইভাবে খুব বেশীক্ষণ ধরে কথা চালাচালি করার ক্ষমতা তার ছিল না। ড্রয়ার খুলে একগাদা কাগজপত্র টেনে বার করে, আপন মনেই যেন বলছে এমনভাবে বলে উঠল: কাজের আর শেষ নেই। এখন আবার এগুলো নিয়ে বসতে হবে।
মিঃ ডেভন ব্যস্ত হয়ে বলে ফেললেন, ঠিক ঠিক, তোমার কাজে অযথা বিরক্ত করা বোধহয় আমার উচিত হবে না। যাইহোক, এলাম যখন, একবার না হয় নিজেই ঘুরে দেখে যাই লকার রুমটা। এই বলে তিনি পা বাড়ালেন লকার রুমের গলিপথের দিকে। ভয়ে প্রাণ উবে গেল ইরার। তীরে এসে তরী ডুবল এবার বুঝি। সত্যি তাহলে ঠেকানো গেল না অবশ্যম্ভাবী বিপদকে। কয়েক পা ঘুরলেই ওয়ানাসির খোলা সে আর মেঝের ওপর জড়ো করে রাখা নোটের তাড়া নজরে পড়বে তার। মুহূর্তের মধ্যে ভেবে নিয়ে পিছু থেকে ডাকল ইরা : ভ্যাডি!
ঘুরে দাঁড়িয়ে ডেভন জিজ্ঞাসা করে উঠলেন : কী, ডীয়ার?
–জয়ের সঙ্গে আলাপ করাতে আমায় কখন নিয়ে যাচ্ছ?
সেই চরম মুহূর্তে ইরার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তার কানে কানে ফিস ফিস করে বলে দিল-মেল ডেভনকে যদি থামাতে চাও তবে জয় অ্যানসনির প্রসঙ্গ তোলার এটাই ঠিক সময়। যা ভাবা, বর্তমানে ঘটলও তাই। ডেভন শুধু ঘুরেই দাঁড়ালেন না, উদ্ভাসিত মুখ নিয়ে আবার ফিরেও এলেন ইরার টেবিলের খুব কাছে।
–তুমি তার সঙ্গে আলাপ করতে সত্যি যাবে, ডীয়ার? আমার তো মনে হয়েছিল জয়ের অস্তিত্ব তুমি মেনে নিতে পারবে না।
ও ধারণা তোমার ভুল ড্যাডি।নানা কারণে আমার মন তখন বিক্ষিপ্তছিল বলেই আমি রাজী হইনি। কবে নিয়ে যাবে তাই বল না? আদুরে কণ্ঠে মধুর সুরে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করল ইরা।
–কবে কী? আজ রাতেই তোমাকে নিয়ে যাব আর আলাপও করিয়ে দেব। দেখবে, চমৎকার মানুষ সে। তোমার প্রসঙ্গ প্রায়ই উত্থাপন করে। তোমার প্রতি কী যত্ন নেব, সে বিষয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি উপদেশ আর নির্দেশবর্ষণ করে আমার ওপর।
ড্যাডি! টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে অদৃশ্য আঁকিবুকি কাটতে কাটতে ইরা বলল, জয়কে তুমি খুব ভালোবাস, তাই না?
ইরার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুব সাবধানে উত্তর দিলেন তিনিঃ আমাদের দুজনের মধ্যে-আলাপ বহুদিনের। স্বাভাবিক কারণেই একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছি।
জয়কে বিবাহ করতে চাও?
ডেভন অবাক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। ইরার মনোভাব বোঝার চেষ্টায় একটু সচেষ্ট হলেন। মুখে শুধু বললেন, তুমি কী বলে?
–আমার আর তোমার দুজনের জীবন যাত্রা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, আশা আকাঙ্ক্ষার চাহিদা যার যার কাছে তার নিজস্ব ধারায়। আমরা কী ভাবে চলতে চাই তার সম্পূর্ণ রূপেই নির্ভর করে আমাদের মন ও মর্জির ওপর। তাই এ ব্যাপারে আমার বলার-ই বা কী থাকতে পারে ড্যাডি?
-তুমি কেন এই সত্যটা বুঝতে চাইছ না নোরেনা, ইরার কাঁধে একটা হাত রেখে ডেভন প্রগাঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, তুমি আমার সন্তান। আমার ঘর সে তো তোমারও ঘর। আমি যদি জয়কে বিয়ে করে তাকে সসম্মানে ঘরে তুলিও, তোমার এ বিষয়ে বলবার অধিকার নিশ্চয়ই আছে–তা প্রিয়ই হোক আর অপ্রিয়ই হোক। তোমার ধারণাই ঠিক, জয়কে আমি বিয়ে করতে চাই। এক নয় দুই নয় ষোল বছর ধরে তোমার মায়ের জন্য দিন গুনেছি।
নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবার যা জ্বালা–এ বয়সে সেই জ্ঞান তোমার নেই। আজ ইহ জগতে সে নেই। তার পরিবর্তে তুমি এসেছ আমার নিভে যাওয়া ঘর আলো করতে। আর ভুল বুঝে ফিরে আসার প্রতীক্ষা করেও সে যখন আসেনি তখন তাকে ভুলে থাকার চেষ্টাই করেছি। এখনকার পরিস্থিতি একটু আলাদা। বর্তমানে তার প্রতিভু তুমি।
তোমার এ বিষয়ে মতামত প্রকাশের সম্পূর্ণ অধিকার আছে–আমার বিয়ে করা উচিত হবে না অনুচিত। আমি এবার নতুন করে ঘর বেঁধে সুখী হবার চেষ্টাই করব, না, করব না।
ড্যাডির মুখের দিকে তাকাল ইরা। তার মুখে সে কী দেখল, শুধু সেই জানে। সহানুভূতিভরা কণ্ঠে বলল, তুমি যাতে সুখী হবে তাই-ই করো ড্যাডি। তাকে তুমি হতাশ করো না। তোমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখী জীবন-যাপন কর।
এমন সময়ে ইরার টেবিলের ফোন সশব্দে বেজে উঠল। রিসিভার তুলে কানে লাগাল ইরা। ওপাশ থেকে অপারেটর জানাল : মিঃ ডেভন বোধহয় আপনার সঙ্গেই রয়েছেন, মিস ডেভন? থাকলে ওঁকে বলুন–মিঃ গোল্ডস্ট্যান্ড ওঁর জন্য ওঁর অফিসে বসেই অপেক্ষা করছেন।
ইরা সঙ্গে সঙ্গে সেই কথা ডেভনকে জানাতে তিনি ইরার কপালে ঠোঁট ঠেকিয়ে আদর জানিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন সেখান থেকে। ইরারও ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
মিঃ ডেভন চলে যেতেই ইরা ছুটল ওয়ানাসির সেফের দিকে। মেঝে থেকে টাকার বান্ডিলগুলো তুলে নিয়ে ওয়ানাসির সেফেই ভর্তি করে, সেফে চাবি লাগিয়ে ফিরে এসে বসে পড়ল আবার নিজের টেবিলে।
এগারোটার একটু পরেই ফিরে এল অ্যালগির। হাতে একটা বিরাট আকারের ব্রীফকেস। ইরার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।
ফ্যাকাসে, ঘামে সিক্ত ইরার মুখ দেখেই তার মনে সন্দেহের উদ্রেক করল, কোথাও কোন গণ্ডগোল বেঁধেছে নিশ্চয়ই। সে তাই কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? চাবিটা কাজে লাগেনি নাকি?
-না, না চাবি ঠিকই আছে। ধরা পড়তে পড়তে ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছি। শোন ফিল, একাজ আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়।
তার মানে? টাকা তুমি বার করতে পারনি?
সাবধান! চেঁচিওনা,গার্ডরা শুনে ফেলতে পারে।কতবার এক কথা বলব যে, একাজ আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমারই ভুল হয়েছিল তোমাদের প্রস্তাবে রাজী হওয়া। জান, মিঃ ডেভন একটু আগেই এখানে এসেছিলেন। হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন আমায়। সবে ওয়ানাসির সে খুলে টাকার বান্ডিলগুলো বের করে মেঝেতে রেখেছি, ঠিক সেই সময়ে তার পদধ্বনি কানে আসে সিঁড়িতে। এখন তুমি বিচার করো, কী সঙ্গীন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একাই প্রতিকূলতার সঙ্গে। সংগ্রাম চালিয়েছি।
ফিল বুঝতে পারল ইরার সাংঘাতিক সমস্যার কথা। একটু ভেবে সে বলল,, সত্যি একাজ তোমার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ওকে। আমি কাজে নামছি এবার, তুমি এদিকটার দিকে বরং একটু দৃষ্টি দাও। কেউ এলে পেতলের এই পেপার ওয়েটটা মেঝেতে ফেলে সংকেত দেবে আমায়। ঠিক আছে? এবার চাবিদুটো দাও আর বলে দাও সেটা কোথায়?
.
০৬.
চোখে ঘুম না থাকায় শুয়ে শুয়ে নিজের কথাই বিভোর হয়ে ভাবছিল ইরা। সত্যি কী বিরাট পরিবর্তনের মুখ গহ্বরে এসে সে পড়েছে। মাত্র দেড় মাস পূর্বেও সে ছিল বস্তিবাসিনী এক মেয়ে। জীবন ছিল নিত্য অভাব, অসম্মান আর পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ। সেইসঙ্গে কুৎসিত, কদর্য মানানসই পরিবেশ। চোখের সামনে ধরা দিতনা উজ্জ্বল আলোকময় ভবিষ্যতের মায়াবী কোন স্বপ্ন। স্বভাবে ছিল বেপরোয়া, দুর্দান্ত পরিশেষে বন্য। কিন্তু এখন?
বর্তমানে সে জীবন কাটাচ্ছে অগাধ প্রাচুর্যের মধ্যে। আপনা হতেই তার কাছে ধরা দিয়েছে নিরাপত্তার বেড়াজাল, সম্মান, বাড়ি-গাড়ি, সর্বোপরি মাথার ওপর অভিভাবকরূপে একজন আদর্শ পিতা।
যাঁর সংস্পর্শে এসে, স্নেহমমতা পেয়ে, তাদের আচরণে এসেছে ভদ্রতা, কোমলতা আর শালীনতার সুস্পষ্ট ছাপ।শুধু একটি মাত্র চিন্তা তাকে প্রবল ভাবে কুরে কুরে পীড়িত করতে লাগল বারংবার। আগে তার পরিচয় ছিল এক সামান্য ছিঁচকে চোররূপে কিন্তু আজ পরিস্থিতি একটু পৃথক। আজ সে সামান্য থেকে তার ক্ষমতার জোরে বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে পুরোপুরি এক পাকা চোর হয়ে। উঠেছে।একজনের সরলতা, বিশ্বাস আর ভালোমানুষীর সুযোগ নিয়ে সে তার পিঠেই ছুরি মারতে উদ্যত হয়ে নিজ মূর্তি ধারণ করেছে। মেল যদি বুঝতে পারেন তার কন্যা তার পিতৃস্নেহের এই প্রতিদান তাকে দিতে আগ্রহী, তবে সে আঘাত তিনি মনে মনে পাবেন তা এক কথায় অবর্ণনীয়। ইরারও লজ্জার সীমা-পরিসীমা থাকবেনা, এরপর কোন মুখে সে তার পিতার সামনাসামনি মাথা তুলে দাঁড়াবে।
বড় হওয়া অবধি মা বাবার স্নেহভালবাসা থেকে এতদিন সে বঞ্চিত ছিল। পিতৃ-মাতৃস্নেহ কী হয় তা ছিল একেবারে অজানা। কারণ মা ছিল খিটখিটে আর বদরাগী। বাবা ছিল পাঁড় মাতাল আর নরপশু। তার ভয়ে ইরা রাত্রে দরজা খুলে শুতে পারত না।
মদের নেশা চরমে উঠলে নিজের কন্যা আর স্ত্রীর মধ্যে কোন তফাৎ থাকত না তার কাছে।
ইতিমধ্যে জেমকে পত্রপাঠ বলেছে এখানে চলে আসবার জন্য। প্লেনভাড়া আর রাহা খরচের জন্য পাঁচশ ডলারও পাঠিয়ে দিয়েছে পৃথক পৃথক ভাবে। জেম এলে তার সঙ্গে পরামর্শ করে টিকি এডরিস আর ফিল অ্যালগিরের সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে নিতে হবে। আর মনের দিক থেকে কোন সাড়াও পাচ্ছেনা বিপদেরবুকি আর অসম্মানের বোঝা মাথায় নিয়ে ওদের পেটের ক্ষুধা মেটাতে। লাজ্ঞা তো স্বভাবে মিঃ ওয়ানাসির চেয়েও এককাঠি সরেস। তিনি শুধু একটি কাণ্ড ঘটিয়েই সন্তুষ্ট হননি, ইরার স্তনে হাত দেবার সঙ্গে সঙ্গে সবলে তাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে চুম্বন করতেও ভুল হয়নি। গার্ডদের ডাকার ভয় দেখাতে তবে তাকে নিরস্ত করা গেছে। অবশ্য পুরস্কার স্বরূপ দুশো ডলার তৎক্ষণাৎই ক্ষতিপূরণ পেয়ে গিয়েছিল ইরা। এমন ক্ষতিপূরণের আশা সে স্বপ্নেও করেনা।
মিঃ লাজ্ঞার চাবির ছাপ নিতে কোন অসুবিধায় পড়তে হয়নি। শুধু পারেনি মিঃ রসের চাবির ছাপ নিতে। মহা ধুরন্ধর লোক এই রস। ইরার রূপ যৌবন সত্ত্বেও তার কাছে ইরার হার স্বীকার করতে হয়েছে। উদ্ধত যৌবনের অধিকারিনী তার এই রূপে রসকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে ইরা। আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে, মিঃ রসের চাবির ছাপ নিতে পারেনি বলে তার মনে কোন অনুশোচনা নেই। এর কারণ কি হতে পারে?
এমন কি চাবির ছাপ নিতে ফিল অ্যালগির যখন চুপি চুপি তাকে জানাল : ওয়ানাসির সে লুট করে পঞ্চাশ হাজার সরিয়েছে, একটুর জন্য হলেও সে তখনও কোন উত্তেজনা অনুভব করেনি ইরা। অথচ দেড় মাস আগে হলে উত্তেজনা আর আহ্লাদে আটখানা হয়ে সে ফেটে পড়ত।
নিজের মনোভাব বিশ্লেষণ করতে বসে ইরা এখন সহজেই বুঝতে পারছে যে, আগের মতন টাকার মোহ আর তার মধ্যে নেই। এখন তার একটাই ইচ্ছা তা হল শান্ত ও স্থায়ী গৃহজীবনে সসম্মানে সমাহিত হওয়া।
এতোদিন পর্যন্ত সে যা যা করে এসেছে, তা কারো মনে সন্দেহের বিন্দুমাত্র উদ্রেক করতে পারেনি। সবাই তাকে জানে মেল ডেভনের মেয়ে নোরেনা ডেভন বলেই। প্রতি পদেই সে পেয়েছে প্রতিজনের স্নেহ ভালোবাসামর্যাদা আর বিশ্বাস। কিন্তু যেদিন সে জালে ধরা পড়বে নোরেনা ডেভন পরিচয়ে নয়, একজন জালিয়াৎ, ঘৃণ্যপ্রতারক রূপে, সেদিন কিন্তু তাকে সোনার সিংহাসন থেকে টেনে নামাবে পথের ধুলোয়। তার অবস্থান হবে তখন কোন জেলখানায়।
অস্থিরতায় আর আতঙ্কে বিধ্বস্ত হয়ে বিছানার ওপর উঠে বসল ইরা। মুহূর্তে সাদা হয়ে গেল সারা মুখ। মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল : না, না আর আমি পারব না এভাবে পরের হাতের পুতুল সেজে পিচ্ছিল পথ বেয়ে রসাতলের দিকে নেমে যেতে। মেল ডেভনের সঙ্গে আমি পারব না ছলনার কোন আশ্রয় নিতে। আমি সোজাসুজি স্পষ্ট ভাষায় বলে দেব টিকি আর ফিলকে : একাজ আমাকে দিয়ে আর হয়ে উঠবে না। তোমরা না হয় অন্য উপায় দেখে নাও।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল টিকির ভাবলেশহীন মুখ খানা। সাপের মতো জ্বর আর ভয়ঙ্কর সে দৃষ্টি। ওহ!সত্যি কী সাংঘাতিক বিপজ্জনক লোক ঐ টিকি। তার হয়তো সিংহের মতন থাবার জোর নেই, তবে পাইথনের মতন হিমশীতল মৃত্যুপ্যাঁচও উপস্থিত আছে। সেই মরণফাস থেকে রেহাই মেলা সুকঠিন।
আচ্ছা, মেলকে বলে আবার অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে বদলীহয়ে গেলে কেমন হয়? সেখানে যেতে পারলে টিকির আর কিছু বলবার বা কইবার কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তার আর কী দোষ? কর্তার ইচ্ছায় ক্রিয়া। ব্যাঙ্কে তাকে অন্যবিভাগে বদলী করে দিলে তারই বা করার কী থাকতে পারে?
কথাটা ভেবে নিয়ে মনে একটু শান্তি পেল। আগামী কালই সে কথাটা উত্থাপন করবে তার ড্যাডির কাছে। শান্তির ঘুম নেমে এল ইরার দুনয়নে।
পরদিন সকাল এগারোটায় যথারীতি ফিল এসে হাজির। তপ্ত চোখে বলল, লাজ্ঞার সেফে টাকাকড়ি কোথায়? শুধুইতো দলিল দস্তাবেজ।
সেজন্য আমার করণীয়ই বা কী আছে?
–তোমার চোখে পড়েনি তার সে শুধু কাগজে ঠাসা?
না। তিনি আমায় ঘরে যেতে বলেছিলেন সে খোলার ঠিক আগের মুহূর্তে।
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ইরার দিকে তাকিয়ে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গল্প করতে করতে বলে উঠল, লাঞ্চের আগে আর একটা চাবির ছাপ জোগাড় করে দিতে হবে, বুঝেছ? যেভাবেই হোক তোমাকে একাজ করতেই হবে। তোমার ওসব বিশ্রী অজুহাত আর চলবে না। চালাকির আশ্রয় নিতে হলে নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারবে। রাস্তার ওপাশে যে কাফে রয়েছে সেখানে আমি তোমার পথ চেয়ে বসে থাকব। এই বলে মুখ কালো করে চলে গেল হন্ হন্ করে।
নিজের টেবিলে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল বধিরইরা। মনে মনে সে ভীষণ বিচলিত। এই দেড়মাসে আজ তার কত পরিবর্তন ঘটে গেছে–এটাও তার একটা চিহ্ন। পূর্বের ইরা হলে ফিলের ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব দিয়ে বসত উপহার স্বরূপ গালে চড় কষিয়ে। একজন মেয়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা সম্বন্ধেও ইতরটা সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ।
ক্ষোভে ও রাগে অন্ধ হয়ে মুখ গোঁজ করে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল ইরা। এই চিন্তাই তার মনকে কুরে কুরে খেতে লাগল যে, এরপর তার করণীয় কী? ফিলতো ফতোয়া জারী করেই খালাস কিন্তু ওর ফতোয়া মতো কাজ করতে তার মনের দিক থেকে সাড়া পাচ্ছিল না। অবশেষে ভেবে চিন্তে একটা মতলব বার করল ইরা। চাবির ছাপ পেলেই তো ওরা খুশী, বেশ তা না হয় দেবেইরা। আপাততঃ ওদের ঠেকিয়ে রাখবার এই একটিমাত্র পথ খোলা আছে। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক।
এইভেবে ইরা ভাড়া না দেওয়া পড়ে থাকা দুটো খালি সেফের পাসকীর ছাপ তুলে নিল চটপট। সেফে কী আছে জানার কোন আগ্রহ নেই ইরার, তাই এদিক থেকে সে মুক্তবিহঙ্গ।
সময়মতো লাঞ্চের সময় চাবি দুটোর ছাপ হাত বদল হয়ে পৌঁছে গেল ফিলের হাতে। ক্লায়েন্টের নাম বলল–মিঃ কুইকশ্যাংক আর মিঃ বিনাশ্যাডার। তারই দেওয়া নাম।
চাবি দুটোর ছাপ নিয়ে পকেটে পুরে ফিল জিজ্ঞাসা করল: এদের সেফে টাকা কড়ির পরিমাণ কীরকম, দেখেছিলে নিশ্চয়ই?
–না।
–তবে চাবির ছাপ নিলে কোন কৌশলে?
ওরা আমার হাতে চাবির গোছ তুলে দিয়েছিল শুধু লকটা খোলার জন্য।
ফিল সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে ইরার মুখের দিকে খাণিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। ইরা এই দৃষ্টিকে আর ভয় পেলনা। ফিল আপন মনে কী ভাবল সেই জানে, শুধু মুখে বলল, সন্ধ্যে ছটা নাগাদ টিকি তোমায় দেখাকরতে বলেছে তার ওখানে। অবশ্যই যাবে বলে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল ফিল।
টিকির ওখানে যাওয়ার মনোগত কোন তাগিদ ছিল না আজকের ইরার মধ্যে। কিন্তু যা সাংঘাতিক লোক এই টিকি, না গেলে তার বিপক্ষে আবার কী ফন্দি আঁটবে কে জানে। ইরা শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে চিন্তে না যাওয়ার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করল।
ছটা বাজার কয়েক মিনিট পর, নিজের ডিউটি শেষ করে সেযখন ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসছে, লবীতে মেলের সামনা সামনি পড়ে গেল ইরা।
-কাজ শেষ হলো? হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
-হ্যাঁ আজকের মতন শেষ। আমার প্রস্তাবটার বিষয়ে কোন চিন্তা ভাবনা করলে নাকি, ড্যাডি?
-হ্যাঁ মাত্র দুসপ্তাহ অপেক্ষা কর। তারপরেই তোমার ছুটি। ডেরিস অবশ্য তার মধ্যে জয়েন করতে পারবে না, আমাদের নিউইয়র্ক ব্রাঞ্চে খবর পাঠিয়েছি। তারা জানিয়েছে : হপ্তা দুয়েকের আগে তারা কাউকে এখানকার জন্য স্পেয়ার করতে পারবে না।
দুহপ্তা, মনে মনে এক অজানা অদেখা আতঙ্কে শিউরে উঠল ইরা। সে কী এ দুহপ্তা ধরে টিকি আর ফিলের মতো ঝানু লোককে বোকা বানিয়ে রাখতে পারবে? এছাড়া আর কোন উপায়ও তো নেই। আগামীকাল ওরা খালি সেফদুটো খোলার পর তাদের নজরে যখন কিছুই আসবেনা, সূত্রপাত ঘটে যাবে মূল ঝামেলার। ওদের কেমন করে রুখবে ইরা? একটামাত্র ভরসা শুধু এই যে রাত্রেই জেম এসে পৌঁছচ্ছে প্যারাডাইস সিটিতে। সে এলে দুজনে একত্রে বসে শলা-পরামর্শ করে যা তোক একটা উপায় বার করা কিছু কঠিন হবে না। এই ভেবেই তখনকার মতন ইরা তার মনকে শান্ত করল।
এডরিসের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ইরা পৌঁছাল তখন সাড়ে ছটা বেজে গেছে। তাকে দরজা খুলে নিজের হাতঘড়ি দেখতে দেখতে গম্ভীর কণ্ঠে এডরিস বলে উঠল, অনেক দেরী করে ফেলেছ। ভেতরে এসো।
এক সেকেন্ড ইতস্ততঃ করে ভেতরে প্রবেশ করল সে। খোলা জানালার কাছে রাস্তার দিকে মুখ করে ফিল অ্যালগির দাঁড়িয়ে দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট।
ভেতরে এসে সোফায় বসতে বসতে ইরা স্পষ্ট শুনতে পেল, এডরিস দরজা লক্ করে দিল। বুকে ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গেল। সে একা আর প্রতিপক্ষ দুজন। তার এই শোচনীয় অবস্থা কোণঠাসা বেড়ালের মতোই করুণ। ইরার মধ্যে পূর্বের সেই বেপরোয়া ভাব আবার স্ব-মর্যাদায় ফিরে এল। সে প্রস্তুত হলো শক্ত হাতে গোটা ব্যাপারটা মোকাবিলা করতে।
প্রথমে এগিয়ে এল ফিল, রাগে আর বিদ্বেষে সারা মুখ বিকৃত হয়ে উঠেছে ইরার। সে নিজের বেল্ট খুলতে খুলতে কুৎসিত ভঙ্গিমায় বলে উঠল : ভাগ রে কুত্তীর বাচ্চি! আজ তোরই একদিন কীআমারই একদিন। আজ তোর গায়ের ছাল যদিনা ছাড়িয়ে নিই তবে আমার নামই ফিল অ্যালগির নয়। আমাদের সঙ্গে এরকম ধান্দাবাজি?
ফিল যখন তার প্যান্টের বেল্ট খুলতে সদাই ব্যস্ত, ইরা আত্মরক্ষার তাগিদে চট করে সামনের টেবিলে রাখা পেতলের ভারী অ্যাশট্রেটা হাতে তুলে নিয়েই এক ছুটে ঘরের এককোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সর্পিনীর মতো হি হি করে গর্জে উঠল, সাবধান, শয়তান! আমার দিকে আর একপাও এগিয়েছিস কী এই ভারী অ্যাশট্রেটা জানলা গলিয়ে নীচে ছুঁড়ে ফেলব। তারপর পুলিশ আর পথের নোকজন এখানে ছুটে আসবে এই হাস্যকর ব্যাপার জানতে। তখন তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করিস দুজনে।
থমকে গেল ফিল।
বেগতিক দেখে টিকি ধমকের সুরে ফিলকে বলে উঠল : আহা! কী হচ্ছে কী ফিল? মাথা ঠাণ্ডা রাখ। ইরার ব্যাপারটা না হয় আমার ওপরই ছেড়ে দাও।
ফিল ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকিয়ে বেল্টটা আবার পরতে পরতে চলে গেল ঘরের অন্যপ্রান্তে। এডরিস্ গিয়ে বসল নিজের আর্মচেয়ারে। অপেক্ষাকৃত কোমলকণ্ঠে ইরাকে একবার ডেকে বলল : এসো ইরা। ফিল তুমিও এসে বসো। ঠাণ্ডা মাথায় আলোচনা করা যাক আর একবার গোটা ব্যাপারটা।
ইরা পর্যায়ক্রমে এডরিস আর অ্যালগির-এর দিকে তাকিয়ে সোফাটা একটু দূরত্বে–প্রায় দেয়ালের কাছাকাছি টেনে নিয়ে গিয়ে বসল। অ্যাশট্রেটা কিন্তু হাত ছাড়া করলনা।এডরিস কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে অপলকনেত্রে তাকিয়ে রইলইরার দিকে, তারপরবুলিগুলো কেটে কেটে বলল, আমি তোমায় বুদ্ধিমতী বলেই জানতাম। কিন্তু তুমি যে সেই বুদ্ধি আমাদেরই বিপক্ষে কাজে লাগাবার সাহসিকতার পরিচয় দেবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। নিজের মন গড়া দুটো ভুয়ো নাম দিয়ে আমাদের প্রতারণা করার কী হেতু জানতে পারি?
ইরার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল, মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেল জবাব দিতে গিয়ে। আজ যবনিকা নেমে আসবে গোটা ব্যাপারটার। তবে ইরা মনে মনে চিন্তা ভাবনাও সেরে নিল খুব তাড়াতাড়ি–আপাততঃ ভাবভঙ্গিমা দেখে যা মনে হচ্ছে তার মারাত্মক কোন ক্ষতি করা ওদের সাহসে কুলোবে না। কেননা, খোলা জানালা দিয়ে এই বাড়িরই কোন ঘর থেকে টেলিভিসনের আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। তার মানে এ বাড়িতে জনপ্রাণী আছে। ওরা তাকে আক্রমণ করার পূর্বেই সে হাতের অ্যাশট্রেটা জানালা গলিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে পারে জন আর মন বহুল খোলা রাস্তায়, চিৎকার করতে পারে গলা ফটিয়ে। এই সব ভাবনা ভাবার পর থেকে একটু আশ্বস্ত হলো ইরা। গম্ভীর কণ্ঠে জবাবও দিল :আমি আর তোমাদের মধ্যে থাকতে চাইনা। তোমরা তোমাদের পকেট ভরার জন্য অন্য কোন কৌশল ঠাওরাও।
এডরিস ইরার কথার জবাবেশয়তানের হাসি হেসে বলল, এরকম যে কিছু একটা ঘটতে পারে এরূপ সম্ভাবনা অনেক আগে থাকতেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ছাড়ব বললেই তো আর ছাড়া যায় না সব জিনিস। বিশেষ করে তোমার পক্ষে।হাসি থামিয়ে চট করে গম্ভীর হয়ে গেল এডরিস। ভয়াল স্বরে বলল, তোমাকে কাজ চালিয়ে যেতে হবেই। আগামীকাল তুমি ব্যাঙ্কে গিয়ে ফিল-এর হাতে অন্ততঃ আরো দুটো জেনুইন চাবির ছাপ নিশ্চয়ই দিতে পারবে। এর অন্যথা যেন না হয়। বুঝেছ? আমার কথামতো যদি কাজ কর তবে তোমার এই অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেব।
-না, আমি পারবনা।দৃঢ় স্বরে জবাব দিল ইরা। সোফা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল ফিল। তারপর একটা কুৎসিত-খিস্তি বর্ষণ করল। কোমরের বেল্ট খুলতে খুলতে বলল, কুত্তীটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও টিকি। ওর কী অবস্থা করি একবার দেখ।
–চুপ করো, ফিল। এক ধমকে চুপ করিয়ে দিল এডরিস ফিলকে। তারপর ইরার দিকে চেয়ে বলল, তোমার যা যা বাসনা ছিল, তা খুব সহজেই তোমার কাছে ধরা দিয়েছে ইরা? বাড়ি গাড়ি-টাকা এমন কি মাথার ওপর ছাদ বলতে একজন অভিভাবক রূপে ধনবান পিতাও। তুমি বোধ হয় ভুলে গেছ নিজের ফেলে আসা অতীতটাকে। কিন্তু আমি যা যা চেয়েছিলাম, তা তো এখনও পাইনি ডার্লিং।
যাও, এগিয়ে যাও, মনোগত ইচ্ছাকে বাস্তবে পরিণতি দাও গে, কে তোমায় বাধা দিচ্ছে? দয়া করে আমায় মুক্তি দাও। দ্রুত কণ্ঠে ইরা তার কথা শেষ করল।
–কিন্তু তুমি সঙ্গে না থাকলে যে আমার কোন ইচ্ছাই স্বার্থক রূপ পেতে পারেনা, বেবী। মধুর হাসি হেসে জবাব দিল এডরিস।
বহুক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ইরা। মনে মনে সে তার চিন্তার জাল গুটিয়ে ফেলল। সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে বলল, আমি এখন যাচ্ছি। তোমরা যদি আমার পথের কোনরকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে উদ্যত হও, আমার হাতে ধরা জিনিসটা জানালা গলে সোজা গিয়ে আছড়ে পড়বে সামনের ঐ রাস্তায়। কথাটা মনে রেখ।
–এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই ইরা। যাবার আগে আমার কয়েকটা কথা শুনে যাও।ইরা যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
মিঃ ডেভনকে ভালোবাসতে শুরু করেছ, তাই না?
ইরা একটু ইতস্ততঃ করে পাল্টা প্রশ্ন করল : তোমার এ প্রশ্নের অর্থ?
–অর্থ তো খুবই পরিষ্কার। নিজের পিতৃদেবের তুলনায় এই নকল পিতা অনেক ভালো, চমৎকার মানুষ। তোমায় সুখী করার জন্য ভদ্রলোক তোমার জন্য কী না করেছেন। তাই তার মতো মানুষকে শ্রদ্ধা করা খুবই স্বাভাবিক।
এডরিসের বক্তব্য বুঝতে পেরে ইরা পাথরের মতো শক্ত কাঠ হয়ে গেল।
নিরীহ কণ্ঠে এডরিসইরার উদ্দেশ্যে বলছে:তোমার নিজের মাতাল পিতা একদিন যদি ব্যাঙ্কে হাজির হয়ে সকলের সামনে বিশেষ করে মিঃ ডেভনের সামনে তোমায় তার নিজের কন্যা বলে দাবী করে বসেন, সেদিন যেকাণ্ডটা ঘটবে তা ভাবতেই সারা শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে। সবার কাছে এই সত্য প্রকাশ পেয়ে যাবে যে তুমি ডেভনের কন্যা কোনদিনই ছিলেনা,তার শ্যালিকা আর তুমি এই দীর্ঘ ছ সপ্তাহ ধরে তোমরা একত্রে একই গৃহে অবস্থান করছ, সারা শহরে এই মুখোরাচক ব্যাপার আলোড়ন তুলবে তোমাদের দুজনকে নিয়ে। খবরের কাগজে ছবি ছাপা হবে বড় করে…ফলাও করে খবরও প্রকাশিত হবে…সেইসঙ্গে তোমার দিদিমুরিয়েলেরঅতীত জীবনও সব অন্ধকারের পর্দা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে স্বচ্ছ দিনের আলোয়। এত কাণ্ডের পরেও কী তুমি আশা কর তোমার এই স্নেহপ্রবণ উদার-মনের পিতা সসম্মানে আর সমর্যাদায় আসীন থাকবেন তার ব্যাঙ্কের এই উচ্চতম পদের আসনে? তাই পা ফেলার আগে একবার অন্তত চিন্তা করে নিয়ে তবেই পা ফেলো, বেবীডল আমার।
ইরা যেন নিষ্প্রাণ এক পাথরের প্রতিমূর্তি।
এডরিস বলল, যাক, যা হবার ছিল তা অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়ে গেছে। ও নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবার কোন কারণ নেই। যা বললাম সুবোধ বালিকার মতন আগামীকালই তার প্রমাণ দিও। কেমন? এবার তুমি আসতে পার।
ইরা চলে গেলে এডরিসফিলঅ্যালগিরের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ওহে আমার গোঁয়ার গোবিন্দ! বন্দুকের গুলির চেয়ে কলমের খোঁচা আর ভায়োলেন্সেরচাইতে সাইকোলজিক্যাল অ্যাপ্রোচই যে সব সময়ে শ্রেষ্ঠ তা মনে রেখ।
ইরা যখন জেমফারকে রিসিভ করতে মিয়ামি এয়ারপোর্টে পা রাখল তখন রাত সোয়া আটটা। এডরিসের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সর্বক্ষণ শুধু চিন্তাই করে গেছে কী ভাবে এই শয়তান দুটোর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ডেভনের সঙ্গে মেয়ের অভিনয়ে অভিনয় করতে করতে কবে যে নিজের অজান্তেই এই দেড় মাসে সত্যি সত্যি তার মেয়ে বলে নিজেকে ভাবতে শুরু করেছে, এতোদিনে এই সত্য তার অন্তরে উপলব্ধি করল। তার নিজের যা ক্ষতি হবার হোক কিন্তু দেবতাতুল্য অমন এক মানুষকে সে কখনোই পথের ধুলোয় টেনে আনতে পারবেনা এবং যতক্ষণ বেঁচে আছে এই অন্যায় সে হতে দেবে না। তার একমাত্র ভরসাজেম। জেম বুদ্ধিমান, চতুর এবং সাহসীও। সবচেয়ে বড় কথা সে ফন্দিবাজ। জেম নিশ্চয়ই পারবে পাল্টা কোন মতলব এঁটে এই দুই শয়তানের শয়তানী মতলব বানচাল করে দিতে এবং তাদের হাত থেকে তাকেও নিষ্কৃতি দেবে। মিঃ ডেভনের সম্মান আর মর্যাদা নিজস্থানে অক্ষয় এবং অটুট থাকবে।
জেমকে সঙ্গে নিয়ে সে যখন এয়ারপোর্টের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে নিজের টি আর ফোর গাড়ির সম্মুখে এসে দাঁড়াল, গাড়ির মডেল দেখে জেমের চক্ষু ছানা বড়া।
সে জিজ্ঞাসা করলগাড়িটা কী তোমার নিজস্ব?
–অফকোর্স।
–হায় আল্লা! জোটালে কী ভাবে?
–জানবে, সবই জানবে। আগে তো গাড়িতে ওঠ।ইরা তাড়া লাগাল তাকে। জেমহতবুদ্ধির মতন গাড়িতে উঠে ইরার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল ইরা। জেমের তখন কাহিল অবস্থা, এতো মূল্যবান গাড়ি…দামী পোশাক দামী মূল্যের প্রসাধনী সরঞ্জাম…এইসব কিছু এই দেড়-দু মাসের মধ্যে জোগাড় করল কী করে ঘুড়িটা।
শুধু কী তাই! আগে যার নুন আনতে পান্তা জোটানো ভার ছিল, সে এখন কিনা তাকে প্লেন ভাড়া…থাকার খরচ, পোশাক পরিচ্ছদ বাবদ নগদ পাঁচশ ডলার পাঠাচ্ছে। না, তার সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। একসময়ে সে জিজ্ঞাসা করল : আমায় নিয়ে কোথায় চলেছ বলো তো? তোমার বাসায়?
–স্বচক্ষেই দেখবে।
আর কোন প্রশ্ন করল না জেম।
ঘণ্টাখানেক পর ইরার গাড়ি এসে থামল সমুদ্রতীরের নিজস্ব অত্যাধুনিক কেবিনে। জনশূন্য আর অন্ধকারে ঢাকা এই সমুদ্রতীর।
দরজার তালা খুলে জেমকে নিয়ে কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করল ইরা, আলো জ্বালাল। পাইন কাঠের তৈরী চমৎকারভাবে সুসজ্জিত তিনকামরার সুন্দর কেবিন। পাশেই তিনটে পামগাছ। তার ছায়া এসে পড়েছে কেবিনে।
এখানে থাক? এটা তোমার? বিমূঢ়ের মতো প্রশ্ন করে বসল জেম।
–না, এখানে থাকিনা। দিন কাটাই অন্য জায়গায়। সেখানে অবশ্য তোমাকে নিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। আর কেবিনটা আমার নিজস্ব সম্পত্তি না হলেও একরকম নিজেরই বলতে পার। ক্ষিদে পেয়েছে? খাবে কিছু?
জেমের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ইরা তক্ষুনি রেফ্রিজারেটার খুলে কিছু ঠাণ্ডা খাদ্য বস্তু আর একবোতল বীয়ার বার করে জেম-এর সামনে রাখল।
জেম আর কোন কথা না বলে চটপট আহারে বসে গেল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আর ইরা তার সম্মুখপানে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে শুরুকরল তার ঘটে যাওয়া অকথিত কাহিনী। গোড়া থেকেই শুরু করল, তবে টাকার আসল অংশটা শুধু উহ্য রেখে যা তার কাছে এডরিস কবুল করেছিল।
ভোজন সারতে সারতে জেম একমনে শুনে গেল ইরার কাহিনীর আদ্যপান্ত। একবারও কোন প্রশ্ন করলনা। ইরাকাহিনী শেষকরে বলল, এই হলো আমার এখানকার বর্তমানইতিহাস। প্রথমে এই কাজটা করার জন্য এক কথায় পাগল হয়ে উঠেছিলাম কিন্তু এখন আমার এমন অবস্থা যে মন চাইলেও তাদের জাল ছিঁড়ে বেরতে পারছি না। এবার আমি কী করব অথবা এই পরিস্থিতিতে নিজেকে সামাল দেবার জন্য আমার কী করণীয় বলে দাও তুমি।
–এ কাজ থেকে কেন নিজেকে সরিয়ে আনতে চাইছ?
–ঐ টাকায় আমার আর কোন আসক্তি নেই। না চাইতেই অনেককিছু আমার ভাগ্যে জুটে গেছে। তাছাড়া আমার বিপদের কথাটাও একবার ভেবে দেখ। এভাবে চলতে থাকলে, একদিন না একদিন ধরা আমায় দিতেই হবে। তখন?
ওদের হয়ে কাজ করার জন্য কত টাকা ওরা তোমায় দিতে চেয়েছিল?
পাঁচহাজার ডলার। অম্লান বদনে মিথ্যে বলে গেল ইরা।
—এডরিস এতে কত কামাবে?
বিশ-ত্রিশ হাজার হবে, সঠিক বলতে পারছি না।
মাত্র? আমার তো মনে হয় ওরা তোমার কাছে আসল সত্য চেপে তোমায় বাজে কথা বলেছে।
বাজেই বলুক আরকাজেরই বলুক, তা আমি দেখতে চাইনা। আমি আর ঐচক্রে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চাই না। একটা না একটা উপায় তুমি বার করো, জেম। যা ভুল করেছি আমার আর টাকার প্রয়োজন নেই। বিপদের ঝুঁকি অযথা আমি মাথায় নিতে চাই না।
জেম এবার একটা সিগারেট ধরাল। কয়েক মিনিট ধরে তাতে টানও দিল।নীরবে কিছু চিন্তা ভাবনা করে নিল। তারপর বলল, তোমার পক্ষে এই কাজ হাত ছাড়া করা বোধহয় বোকামিই করা হবে।
-কিন্তু আমার বিপদ?
বিপদ? কীসের বিপদ? ওরা তোমায় বিপদে ফেলবে? সে তো ওদের হয়ে কাজ না করলে। কিন্তু তুমি এই পনেরোটা দিন যদি মুখ বুজে কাজ করে যাও ওদের কথামতো, কাজের শেষে তখন পুরোপুরি পাঁচ হাজার পেয়ে যাবে। সেটা ভাবছনা কেন একবার?গত দেড় মাসে যদি কারো। চোখে কোন রকম কোন সন্দেহের উদ্রেক করেনা থাক তবে এই পনেরো দিনেও কেউ তোমাকে। সন্দেহের বেড়াজালে জড়াতে পারবে না-যদি তুমি প্রতি পদক্ষেপ বুঝেশুনে সাবধানে ফেল।
ইরার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল প্রায়। একি শুনছে সে! নিজের কানকে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। যার ওপর নির্ভর করেছিল, অগাধ বিশ্বাসে অকপটে তার কাছে স্বীকার করেছে, শেষে সেই কিনা তাকে এই বিপদের মুখেই ঠেলে দিচ্ছে?
তার দেহমন জেমের ওপর ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় রাগে ক্ষোভে পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠল : না, আমি পারব না তোমাদের আদর্শের পথে চলতে। অসম্ভব।
জেমের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে চোয়াল কঠিন আকার ধারণ করল। এক পলকে নিষ্ঠুর জ্বর হয়ে গেল মুখের ভাব। সে দ্রুত বেগে ইরার সামনে এসে বিদ্যুৎগতিতে ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সজোরে তার গালে আঘাত হানল। আঘাতের ধাক্কা এতো প্রবল ছিল যে চেয়ার থেকে ছিটকে পড়ল ইরা।
কয়েক মিনিটের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল সে। সারা মাথা ঝিনঝিন্ করে উঠল। ইরা উঠে দাঁড়াবার বহু পূর্বেই জেম তার ওপরে কিল-চড়-লাথির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিল।
ইরা অতিকষ্টে বলে উঠল : এখান থেকে বেরিয়ে যা রাস্তার নোংরা কুকুর কোথাকার! আমি তোর মুখ পর্যন্ত দেখতে চাই না।
দাঁড়া ছুড়ি এর মধ্যেই যাব কি? আগে আমার পেটের ক্ষুধা মেটাই–মন ভরুকপকেট ভরে উঠুক, তবে তো৷কথা বলতে বলতে নিজের পোষাক ছাড়ল জেম। ইরাকেও নির্দেশ দিল তার এই পন্থা অবলম্বন করতে।
বেরিয়ে যা–বেরিয়ে যা বলছিআমি তোর কেনা বাঁদীনই যেকুম করলেই তা তামিল করতে হবে।
-বটে রে কুত্তা–এই বলেই সে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইরার ওপর। পূর্বের রণমূর্তি ধরে মারের ফোয়ারা ছুটিয়ে দিল। মারের চোটে অবসন্ন হয়ে এলিয়ে পড়ল ইরা। বাধা দেবার শক্তি পর্যন্ত সে হারিয়েছে। এই অবসরকে কাজে লাগিয়ে তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিল জেম। তারপর তাকে চিৎ করে ফেলে নিজেও শুয়ে পড়ল তার ওপর দেহের সব ভার চাপিয়ে। গোপনাঙ্গে তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রণা অনুভব করল ইরা। এমন যন্ত্রণার স্বাদ এর আগেও তার ভাগ্যে জুটেছে। তখন সেই যন্ত্রণাকে যন্ত্রণা বলেই মনে হয়নি। মনে হয়েছিল এর স্বাদ তীব্র মধুর। আজ সে যন্ত্রণায় ঝাঁকিয়ে উঠল। এই যন্ত্রণার ঢেউ তার সর্বশরীরে হলাহল বইয়ে দিল।
নিজের জৈবিক ক্ষুধা মিটিয়ে যখন জেম উঠে দাঁড়াল, ইরা তখন অঝোরে কেঁদে চলেছে। তার স্তনে, গালে, উরুতে জেমের পাশবিক অত্যাচারের নির্মম চিহ্ন অঙ্কিত।
পোশাক গায়ে চড়াতে চড়াতে অবশ হয়ে পড়ে থাকা ইরার শরীরে পা দিয়ে একটা মৃদু টোকা দিয়ে জেম বলে উঠল,তোর হাত ব্যাগে যা মালকড়ি আছে আমার হাত খরচের জন্য নিয়ে নিলাম। তুই আবারও পেয়ে যাবি, পরে কিন্তু আমায় দেবার কেউ থাকবে না। সোলং বেবী।
ইরা হতাশায় বেদনায়, অপমানে জর্জরিত হয়ে সেই শূন্য ঘরে একাকী চোখের জল ফেলতে লাগল।
জেম কোথাও যায়নি কাছাকাছির মধ্যেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল। আর সেই গোপনীয় স্থান থেকেই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখল ইরাকে। ইরার সমস্ত গতিবিধি সে লক্ষ্য করছিল। কেবিনের দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা কোথায় রাখল ইরা, তাও সে দেখে রাখল। ইরা চলে যাবার পর ধীরেসুস্থে সে তার পূর্বের আশ্রয় নেওয়া স্থান থেকে বেরিয়ে এসে, তালা খুলে কেবিনে প্রবেশ করল। রাত্রে থাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো!
জেম এবার গোটা কেবিনটা মনের সুখে ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করতে লাগল। দেখা শেষ হলে সে পা রাখল শয়নকক্ষে। সু-সজ্জিত আরামপ্রদ আর বিলাসবহুল নিজ শয্যা পাতা। জামাকাপড় ছেড়ে রাত্রিকালীন পোশাকের জন্য ক্লোজেট হাতড়াল। পোশাক আসাক যা আছে সবই বেশ মূল্যবান তবে তার খর্ব আকৃতির তুলনায় একটু বেশী বড়। জেম অতঃপর একটা চেস্ট অব ড্রয়ার্স খুলল।
ড্রয়ারে থরে থরে রাখা আছে সার্ট, রুমাল, টাই, মোজা এইসব। উল্টেপাল্টে একবার চোখ বুলিয়ে রেখে দিল। শেষ ড্রয়ারটা টানতেই তার সমস্ত শরীর টান টান হয়ে গেল। একগাদা তোয়ালের ওপরেই একটা পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের অটোমেটিক কোল্ট রিভলবার আছে। বহুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে জিনিসটার দিকে চেয়ে থাকার পর কিছুটা উত্তেজনা আর কৌতূহলের বশেই সে তুলে নিল নিজের মুষ্টিতে।
মোকাসিন গ্যাং-এর মুখ্য ভূমিকা পাবার পর থেকেই এমনই এক প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব বোধ করছিল জেম। নিজের করে একটা রিভলবার পাবার বাসনা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তার বহুদিনের কিন্তু অর্থ আর সুযোগের অভাবে এতকাল তা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। আজ সেটা পরিপূর্ণতা লাভের মুখে এসে পৌঁছেছে। রিভলবারটা সঙ্গে নিয়েই সে বিছানায় বসল। মুখে পূর্বের সেই কুটিল হাসি। আর কেইরার দয়ার দানের পরোয়া করে? এখন তার হাতে এমন এক হাতিয়ার এসে গেছে যার দ্বারা সে নিজেই কেড়ে নিতে পারবে বহুজনের কাঙ্ক্ষিত পার্থিব বহু কিছু।
নিজের বোনা স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিভলবারটা হাতে নিয়ে টান টান হয়ে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিল। আবেশে দুচোখে নেমে এল তৃপ্তির নিদ্রা।
চিন্তায় ভাবনায় জর্জরিত হয়ে বিনিদ্র ভাবে কেটে গেল ইরার গোটা রাত। একটা চিন্তাই তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল তা হল: জেমের মতলবটা কী?তার হাবভাব দেখে মনে হয় সে আর ব্রুকলিনে ফিরে যাচ্ছে না। কেন যে সব কথা জেমকে খুলে বলার মতো বোকামী করে বসল ইরা! এখন সে নিরুপায়, সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়েছে ঐ পশুটার কাছে। ঐ জঘন্য ইতর নর পশুটাকে সে যে কোনদিন মন দিয়েছিল, একথা মনে হতেই তার সারা মন ঘৃণায় ঘিনঘিন করে উঠল। জেমের চিন্তা মন থেকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে দিল। এডরিসের কথা ভাবতেই তার চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলল ইরা। এই লোকটা তার জীবনের সকল সমস্যার মূলে, তারও কোন সমাধান খুঁজে পেল না সে। কোথাও যে পালিয়ে গিয়ে একটু পরিত্রাণ পাবে, সে পথও আজ। রুদ্ধ। মেল নিরুপায় হয়েই পুলিশকে সজাগ করে দেবেন। ফলস্বরূপ পুলিশের জালে ধরা পড়ার পর তার যাবতীয় কীর্তি কাহিনী অচিরে ফাঁস হয়ে পড়বে জনমানসে। নিশ্চিত ভরাডুবি।
এভাবেই রাত পার হয়ে কখন যে দিনের আলো ফুটল ইরা টেরও পেল না। সকালে উঠে দেখা হলো মেলের সঙ্গে–ব্রেকফাস্ট টেবিলে।
মেল ইরার ক্লিষ্ট মুখপানে চেয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন : তোমার কী শরীর ভালো নেই, নোরেনা?
–না, না, তেমন কিছুনা, জোর করে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে জবাব দিল ইরা।
তারপর পাল্টা প্রশ্ন করল : কী বলল জয়? বিবাহে তার মত আছে?
মেল একগাল হেসে জবাব দিলেন : হ্যাঁ, এ মাসের শেষাশেষি। আমার হাতে কাজের চাপও অনেক কম থাকবে। নিশ্চিন্তে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে যেতে পারব। আশা রাখি, কিছুদিনের জন্য তোমায় একা থাকতে হবে বলে তুমি মনে কিছু করবে না।
বিদ্যুৎচমকের মতো একটা কথা ইরার মাথায় খেলে গেল। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে তার এখান থেকে পালিয়ে যাবার চমৎকার এক সুবর্ণ সুযোগ। মেল হনিমুনে চলে গেলে সেও এখানকার হাউসকীপার মিসেস স্টার্লিংকে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিঐ ধরণের একটা বাহানা দিয়ে নির্বিঘ্নে এই শহর ছেড়ে সরে পড়বে। অবশ্য কোথায় আর কতদূরে গিয়ে তার এই যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটবে, সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত তার কোন ধরণা নেই।
ইরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল : না না, মনে করব কেন? ঐ কটা দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তবে, আমার অগ্রিম বেস্ট উইসেস জানিয়ে দিলাম। কাপের তলানি কফিটুকু সমাপ্ত করে উঠে পড়ল ইরা।
আমি উঠছি ড্যাডি। কাজের একটু তাড়া আছে।বলে দ্রুত পদক্ষেপে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ঘড়িতে এগারোটা হবে, জনৈক দীর্ঘাঙ্গিনী, সুসজ্জিতা সুরূপা এক ভদ্রমহিলার প্রবেশ ঘটল লকাররুমে। নাম মিসেস মেরী গ্যারল্যান্ড। স্টীল ম্যাগনেট ধনকুবের মিঃ মার্ক গ্যারল্যান্ডের স্ত্রী। তিনি ও তার স্বামী ঐদিন সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের পথে যাত্রা করছেন। গতরাতে ক্যাসিনোয় জুয়ায় মোটা অঙ্কের বাজী জিতেছেন। সেই টাকাই বোধহয় সেফে রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এখানে হাজির। হয়েছেন। চীফগার্ড সেই রকমই একটা পূর্বাভাস দিল ইরাকে।
ভদ্রমহিলা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে ইরার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াতেই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে ইরা সস্মিত মুখে বলল, গুডমর্নিং মিসেস গ্যারল্যান্ড, আমি নোরেনা ডেভন। আশা করি, সব কুশল মঙ্গল।
–গুডমর্নিং? তুমি মেল-এর মেয়ে? তোমার অনেক কথা শুনেছি মেল-এর কাছে। তোমার মাকেও চিনতাম। অবিকল তারই মতো রূপের অধিকারিনী তুমি। তবে আমার মনে হয় তোমার মার থেকেও সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে তোমার পাল্লাই একটু ভারী–মুহূর্তের জন্য একটুথামলেন, তারপর গলার স্বর কমিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন : শুনলাম মেল নাকি আবার বিবাহ করছে? তুমি এ ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ জানাওনি?
–ঠিকই শুনেছেন। আমার আপত্তি জানাবার কী আছে? বাবার সুখেই আমি সুখী।
-বাঃ বাঃ, তোমার উপযুক্ত কথাই তুমি বলেছ। তা তুমি তোমার নতুন মা, জয় অ্যানলিকে দেখেছ কখনো? আলাপ হয়েছে?
-হ্যাঁ, সত্যি চমৎকার মানুষ।
–তোমার কথাই ঠিক। আমার সঙ্গেও আলাপ আছে। বড় ভালো মেয়ে।
তারপর মিসেস গ্যারল্যান্ড তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা পেটমোটা খাম আর নিজের চাবিটা বার করে ইরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, মনে যদি কিছু না করো, নোরেনা সেটা খুলে এটা রেখে দাও না লক্ষ্মীটি। আমি এখানেই বসে আছি।
ইরার বুকের রক্ত এই কথায় চলকে উঠল। সে দ্রুত অনেক কিছু তার মনে ছক করে নিল। তারপর এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করে নিজের টেবিলের ড্রয়ার খুলে পাস কী বার করার সঙ্গে একটুকরো পুটিও পুরে ফেলল তালুতে। এরপর ধীর পদব্রজে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলল মিসেস গ্যারল্যান্ডের সেফ যেখানে–অর্থাৎ সেইদিকে।
সেফ খুলতেই ইরার দৃষ্টি অপলক নেত্রে তাকিয়ে দেখল : টাকার মোটা মোটা বান্ডিল আর পেটমোটা খাম থরে থরে সজ্জিত আছে তাতে। সেই সঙ্গে রয়েছে বেশ কয়েকটি জুয়েল বক্স। গহনার বাক্সে যে দামী মূল্যের গহনা আছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তার একবার মনেও হল কী প্রয়োজন আর চাবির ছাপ নেওয়ার? একটা কী দুটো পেট মোটা খাম, কি টাকার বান্ডিল আলগোছে তুলে নিয়ে সযত্নে প্যান্টির মধ্যে চালান করে দিলেই কোন ঝাট নেই। পরক্ষণেই ভাবল : না, অতসহজে ওদের সুবিধে করে দেবে না। চাবির ছাপ দেবে…সেই ছাপ থেকে পরিশ্রম করে চাবি তৈরী করুক, তারপর সোমবার ব্যাঙ্ক খুললে ঐ চাবির সদ্ব্যবহার করে ফেলুক। তার আগে কখনোই নয়।
এই ভেবে সে খামটা রেখে সে বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, চোখে পড়ল, কিছুটা দূরে মিসেস গ্যারল্যান্ড তার কার্যবিধি লক্ষ্য করছেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে।
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল ইরার। বরাত জোরে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ভাগ্যিস সে খাম বা টাকা কোনটাই নেওয়ার সাহস করেনি সে থেকে। না হলে আজ যে তার ভাগ্যে কী ছিল…
লাঞ্চ হলে রাস্তার ওপারে কাফেতে গিয়ে অধীর প্রতীক্ষারত অ্যালগিরের হাতে চাবির ছাপটা তুলে দিল ইরা।
–মাত্র একটাই, গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল ফিল।
–হ্যাঁ, আজ একজনেরই পদধূলি পড়েছিল ভল্টে।
কে?
–মিসেস মেরী গ্যারল্যান্ড। নিউইয়র্কের কোটিপতি ব্যাবসাদার মিঃ পার্ক গ্যারল্যান্ডের স্ত্রী।
কোটিপতি যখন বলছ তখন সেফের মধ্যে যৎপরন্যাস্তি মালকড়ি আছে নিশ্চয়ই।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
-হুম। আশা করি আমায় দ্বিতীয়বার স্মরণ করিয়ে দিতে বাধ্য করবেনা যে, মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে আমাদের অযথা বোকা বানাবার শাস্তি কী হতে পারে? ঈশ্বরের তোমার প্রতি অনেক করুণা যে একবার বেঁচে গেছ বলে বার বার সে সুযোগের সম্মুখীন তুমি হবে না, বেবী।
ইরা কোন কথা না বলে শুধু ঘৃণা জনিত দৃষ্টিতে একবার ফিলের দিকে চেয়ে কাফে থেকে বেরিয়ে এল। একটু পরে ফিরে এল ফিল। নিজের নিজের ভাবনাচিন্তার বেড়াজালে বিচরণ করার দরুণ দুজনের একজনও লক্ষ্য করলনা যে রাস্তার একধারে একটা ভাড়াকরা পুরোন গাড়ির মধ্যে থেকে হেস সন্দিহান দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে। পুলিশের চাকুরিতে রহস্য-রোমাঞ্চ যতই অফুরন্ত থাক, ছুটি কিন্তু মোটে পাওয়া যায় না। নিয়মিত ডিউটি ছাড়া, ডাক এলেই সময় অসময় বিচার না করে ছুটতে হবে কর্মক্ষেত্রে। তাই আচমকা এই সপ্তাহে উইক এন্ডে ছুটি পেয়ে হেস মহাখুশী। ছেলে আর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পিকনিকের উদ্দেশ্যে প্যারাডাইসসিটি আর মিয়ামির মাঝে যে একটি মাত্র পিকনিক স্পট সমুদ্রের একেবারে ধারে, ঠিক সেই জায়গাতে।
সূর্যের তাপে মনোরম উষ্ণতা..মৃদুমন্দ হাওয়ায় অপরূপ আমেজ সমুদ্র কল্লোলে ঘুম পাড়ানীয়া গানের সুন্দর সুর। একপেট মুখোরোচক পিকনিক লাঞ্চ সেরে, একটা সুন্দর জায়গার সন্ধান পেয়ে হেস পরম নিশ্চিন্তে গা এলিয়ে দিলেন, কিছু দূরে বসে স্ত্রী মারিয়া তার সেলাই নিয়ে ব্যস্ত, আর একটু তফাতে ছেলে জুনিয়ার বালি নিয়ে খেলায় মত্ত।
চিত হয়ে কুপোকাত হয়ে দুহাত ভাঁজ করেমস্তকের নীচে দিয়ে, চোখ বুজে বিশ্রাম সুখ উপভোগ করছেন হেস। চোখে ঘুম নেমে এসেছে, ঠিক এই সময়ে তার ঘোর কেটে গেল আট বছরের ছেলে জুনিয়ারের তীব্র মন্তব্যে।
–মাম্মী! আমি পপকে কবর দেব।
এই বাণী কানে যাওয়া মাত্রই ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। মনে মনে বিরক্ত হলেন জুনিয়ারের ওপর। সত্যি বড় আবদার করে আজকাল। উচিত-অনুচিত যা জেদ ধরছে তা করা চাই-ই। ছেলেটাকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে মারিয়াই ওর মাথা খেয়েছে। আজকের এই অবস্থার জন্য মারিয়া সম্পূর্ণরূপে দায়ী।
হেস স্ত্রীকে ডেকে বললেন, জুনিয়ারকে তোমার কাছে ডেকে নাও, মারিয়া। আমায় একটা দিন অন্তত আরাম করতে দাও।
কথাটা শোনামাত্র যা দেরী ছিল, এক ঝংকার দিয়ে উঠল মারিয়া : তুমি আরাম করছ কর না। ও বড় জোর দু চার মুঠো বালি তোমার গায়ে ছড়িয়ে দেবে, তাতে কী তুমি ক্ষয়ে যাবে নাকি?
মহা সমস্যায় পড়ে গেলেন হেস। মায়ের আদর সোহাগের স্রোতে ভেসে গিয়ে ছেলে তখন তার বেলচাটা হাতে নিয়ে মহানন্দে লাফাচ্ছে। হঠাৎ একটা চমৎকার মতলব ঘুরপাক খেয়ে গেল হেসের মগজে। তিনি জানতেন তার ছেলেকে কোন কৌশলে বশীভূত করা যায়। ব্যাপারটা তেমন জটিল নয়, জুনিয়ারের মনকে অধিকতর আকর্ষক কোন কিছুর দিকে প্রভাবিত করতে পারলেই তখনকার মতো নিশ্চিন্ত। সেই উপায়ই তিনি কাজে লাগালেন। কোমল কণ্ঠে কাছে ডাকলেন জুনিয়ারকে। জুনিয়ার এলে, হেস রহস্য রোমাঞ্চ কোন কথা তার কাছে উত্থাপন করতে চলেছেন ঠিক এমনভাবে মুখের ভাব তৈরী করে বললেন, আমার একটা কথা শুনবে জুনিয়ার?
-কী?
অনতিদূরের একটা বড়গোছের বালিয়াড়ির দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে হেস বললেন, ঐ যে বড় বালিয়াড়ি দেখতে পাচ্ছ, ওখানে গতকাল রাতে অভিনব এক কাণ্ড ঘটে গেছে। তুমি যদি কাউকে না বল–এমনকি তোমার মাকেও, তবে আমি তোমায় বলতে পারি।
শিশু মাত্রই অজানা, অচেনা অজ্ঞাত বস্তুর প্রতি আকর্ষণ অপরিসীম। অপরিমেয় কৌতূহল। তার ওপর জুনিয়ারের পরিচয় সে একজন গোয়েন্দার ছেলে। স্বাভাবিক কারণেই বাবার প্রস্তাব উৎসাহিত হয়ে সে লুফে নিল। বলল, না, কাউকে বলবো না, প্রমিস।
ছেলেকে কোলে বসিয়ে তার কানের কাছে মুখ এনে,কণ্ঠস্বর কোমল করে হেস বলে উঠলেন, কাল রাতে এক বৃদ্ধ মাংসের বড়া ফেরি করে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিতে ওখানে এসেছিল। যখন সে গভীর নিদ্রায় ডুবে আছে তখন হঠাৎ ভীষণ ঝড় ওঠে সমুদ্রের দিক থেকে। তার ফলে ঐ বালিয়াড়ির বালি আর আশে-পাশের বালি উড়ে গিয়ে, বড়ার ঝুড়ি সমেত চাপা দিয়ে দেয় বৃদ্ধকে। তুমি যদি তোমার বুদ্ধির বলে ঐ বালিয়াড়িতে গিয়ে ওর ডালাটার কোন কিনারা করতে পার তবে লাভবান হবে তুমি। বৃদ্ধ জেগে উঠে খুশীতে ডগমগ হয়ে তোমার হাতে বেশ কয়েকটা বড়া উপহার স্বরূপ তুলে দেবে, তুমিও বড়া খেতে পারবে।
–সত্যি বলছ?
–অকাট্য সত্যি।
জুনিয়ার একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল বালিয়াড়ির দিকে তারপর ফিরে তাকাল তার বাবার মুখের দিকে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে এটাই বুঝতে চাইল যে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বাবা তাকে বোকা বানাচ্ছেন না তো?
তাই সে একটু ইতস্ততঃ করে বলল, তুমিও আমার সঙ্গে চলনা, পপ। আমার হাতে হাতে একটু সাহায্য করবে।
-বেশ তো চল, তবে তুমি তো জান, তোমার সঙ্গে বালি খুঁড়তে আমিও হাত লাগালে বৃদ্ধ খুশী হয়ে তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও কিছু বড়া খেতে দেবে–তাতে তোমার ভাগে কম হয়ে গেলে কোন আপত্তি নেই তো? তোমার যদি আমাকে নিয়ে যেতে কোন অসুবিধা না থেকে থাকে চল। আমি এক পায়ে খাড়া।
মাংসের বড়ার প্রতি জুনিয়ারের অস্বাভাবিক দুর্বলতার কথা তার অজানা নয়। তাই বালি খুঁড়ে বৃদ্ধ ফেরিওয়ালার সন্ধান করে পুরস্কার হিসেবে যে ভাগ্যে বড়া জুটবে–তার থেকে বাবাকে ভাগ দেবার ব্যাপার উঠতেই রীতিমত দমে গেল জুনিয়ার। তাই বাবার কথায় মাথা নেড়ে বলে উঠল, তবে থাক, আমি একাই বালি খুঁড়ে বৃদ্ধকে সামনে আনবার ক্ষমতা রাখি। এই বলে সে ক্ষুদে বেলচাখানা কাঁধে তুলে নিয়ে এক ছুটে এগিয়ে চলল সেই বালিয়াড়ির দিকে।
মারিয়া এতক্ষণ ধরে বাবা আর ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখছিল। কোন কথা না বলে সে চুপচাপই তার কাজ করে যাচ্ছিল। ছেলে তার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতেই স্বামীর দিকে তাকিয়ে স্থল মন্তব্য না করে পারল না। সে বলল : নিজের ছেলের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করতে তোমার একটুও লজ্জা করে না, হেস?
হেস কোন জবাব না দিয়ে সহাস্যে পুনরায় আড় হয়ে গেলেন বালির ওপর। দেখতে লাগলেন তাঁর ছেলে অনাবিল উৎসাহের সঙ্গে সেই বালিয়াড়ির তলায় বালি খুঁড়ে চলেছে প্রাণপণে। মিনিট কুড়ি পর–হঠাৎ জুনিয়ারের আর্তচীৎকারে স্বামী স্ত্রী উভয়েই চমকে ওঠেন।
তিনি দেখলেন তাদের ছেলে অস্থিরভাবে লাফালাফি করছে তার খোঁড়া জায়গাটা ঘেঁষে আর দুহাত নেড়ে ডাকছে তার বাবাকে।
–পপ। শীগগীর এসো। দেখে যাও, বৃদ্ধকে নয় তার জায়গায় অন্য এক আগন্তুককে এই বালি খুঁড়ে বার করেছি।