হলধরের উড়ুক্কু ঝাঁটা যে একদিন সত্যিই উড়ে বেড়াবে তাতে রুইতন আর হরতনের কোনও সন্দেহ নেই। রোজই গিয়ে তারা কিছুক্ষণ হলধরের ঘরে বসে খুব মন দিয়ে ঝাঁটা তৈরির কাজ দেখে।
হলধর দুঃখ করে বলে, “আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না, বুঝলে? সবাই ভাবে আমি একটা পাগল। কিন্তু যেদিন সত্যিই আমার ঝাঁটা উড়ে বেড়াবে সেদিন লোকে বুঝবে।”
রুইতন আর হরতনের হলধরকে অবিশ্বাস হয় না। তার কারণ, কিছুদিন আগে হলধর একটা ছোট্ট বিঘতখানেক লম্বা এরোপ্লেন তৈরি করেছিল। তাতে ছোট জেটও লাগিয়েছিল হলধর। সেটা উড়তে পারে বলে প্রথমটায় বিশ্বাস হয়নি তাদের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যেদিন হলধর সেটা পরীক্ষা করার জন্য বাড়ির পিছনে
আগাছায় ঘেরা পতিত জমিতে নিয়ে গিয়ে চালু করল, সেদিন সেটা কিছুক্ষণ গোঁ গোঁ শব্দ করার পর হঠাৎ খানিকটা ছুটে গিয়ে সাঁ করে আকাশে উড়ে গেল। উড়ে গেল তো গেলই। কোথায়, কতদূর পর্যন্ত গিয়েছিল তা আর জানা যায়নি। এবোপ্লেনটা অনেক খুঁজেও আর পাওয়া গেল না। হলধর মাথা চাপড়ে দুঃখ করে বলেছিল, “ইস, বড় ভুল হয়ে গেছে। একটা লম্বা শক্ত সুতোয় বেঁধে ছাড়লে জিনিসটাকে উদ্ধার করা যেত।”
সেই থেকে হলধরের লুকনো প্রতিভার ওপর রুইতন আর হরতনের অগাধ বিশ্বাস। কাজেই দুই ভাই উড়ুক্কু ঝাঁটার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল। কাজও প্রায় শেষ। দু’-একদিনের মধ্যেই পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ আজ সকালেই শোনা গেল হলধরকে তার ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না। ঝাঁটাগাছও নেই।
রুইতন বলল, “আমার মনে হয় এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে হলধরদা ঝাঁটায় চেপে কোথাও চলে গেছে। কিন্তু ফিরতে পারছে না। আমাদের চারদিকে খুঁজে দেখা উচিত।”
হরতন করুণ মুখে বলে, “ধর যদি আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়ে থাকে?”
“না না, অতদূর যাবে না। হলধরা তো বলেছে, ওটা কম পাল্লার রকেট।”
সব শুনে ভূতনাথ মাথা নেড়ে চুপি চুপি বলল, “ওসব নয় গো খোকাবাবুরা, আসল বৃত্তান্ত শুনলে তোমাদের পিলে চমকে যাবে।”
“কী বৃত্তান্ত ভূতনাথদাদা?”
“ওই নরখাদকটা হলধরকে খেয়ে ফেলেছে। একেবারে চেটেপুটে।”
রুইতন অবাক হয়ে বলে, “কোন নরখাদক?”
হরতন একটু ছেলেমানুষ। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “রান্না করে খেয়েছে? না কাঁচা?”
ভূতনাথ একটু হেসে বলল, “ওরা কাঁচাই ভালবাসে। কর্তামশাই বড্ড ভালমানুষ কিনা, ভাল করে পরখ না করেই ঠাঁই দিয়ে ফেললেন। কাল হলধরকে খেয়েছে, আজ হয়তো হাবুকে খাবে। তারপর একে একে সবাইকে। আমার পালা কবে পড়ে কে জানে?”
রুইতন বলল, “যাঃ, কী যে বলো, ও তো লেঠেল। আমাদের লাঠি খেলা শেখাতে এসেছে।”
“লাঠি খেলা? দূর দূর? লাঠিখেলার ও জানেটা কী? লাঠিখেলা শিখতে চাও বুঝি? তা বেশ তো, আমিই তোমাদের শেখাবো খন!
রুইতন বলল, “তুমি লাঠি-খেলা জানো বুঝি?”
ভূতনাথ মাথা নেড়ে বলে, “তা জানি না বটে, তবে টক করে শিখে নেবোখন।”
“কার কাছে শিখবে?”
“সে আছে। অত গুহ্য কথা শুনে তোমাদের কাজ নেই। তবে কাউকে যদি না বলো তা হলে চুপি চুপি বলতে পারি।”
“বলো না ভূতনাথদা।”
গলা নামিয়ে ভূতনাথ বলল, “খুড়োমশাই যে মস্ত লেঠেল ছিলেন! খুড়োমশাই কে তা বুঝতে পারলে তো?”
“তোমার সেই পোষা ভূতটা বুঝি?”
“আহা, ওভাবে বলতে নেই। খুড়োমশাইয়ের অপমান হয়। আমার পোষা হতে যাবেন কেন? বরং আমিই ওঁর পুষ্যি।”
“তুমি যে বলো এ বাড়িতে অনেক ভূত! আমরা তো একটাও দেখাতে পাইনি!”
ভূতনাথ চোখ বড় বড় করে বলে, “বলো কী? এ বাড়িতে তো গিজগিজ করছে ভূত! পীতাম্বরমশাই, আন্নাকালী দেবী।”
রুইতন হেসে বলল, “ওসব তো নবুদার বানানো গল্প। আমরা
নবুদাকে জিজ্ঞেস করায় বলল, দূর দূর! ভূতনাথটা কর্তাবাবুর কাছে গুল মারছিল বলে ওকে ভড়কে দেওয়ার জন্য বলেছি।”
ভূতনাথ অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু কর্তাবাবুও যে নবুদাদার কথায় সায় দিলেন!”
“নবুদার সব কথাতেই বাবা সায় দেয়। নবুদা হল বাবার মন্ত্রী।”
হরতন বলল, “মুখ্যমন্ত্রী, না রে দাদা?”
ভূতনাথ চিন্তিত হয়ে বলল “তা হলে তো মুশকিলেই পড়া গেল খোকাবাবুরা! ভূতের আশাতেই এতদূর আসা কিনা! কিন্তু এ বাড়িতে ভূত না থাকার তো কথা নয়! পুরনো বাড়ি, সাতপুরুষের বাস! আমার অঙ্কটা তো মিলছে না খোকাবাবুরা! ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে।”
সন্ধের পর দুই ভাই দোতলায় পড়ার ঘরে বসে লেখাপড়া করছিল। এমন সময় হঠাৎ হরতন চেঁচিয়ে উঠল, “জানালার বাইরে দিয়ে ওটা কী উড়ে গেল রে দাদা?”
রুইতন অবাক হয়ে বলল, “কী আবার উড়ে যাবে? প্যাঁচা বা বাদুড় হবে হয়তো।”
হরতন জানালার কাছে ছুটে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর উত্তেজিত হয়ে বলল, “দেখ দাদা দেখ, একটা লোক উড়ে বেড়াচ্ছে।”
“যাঃ,” বলে রুইতনও উঠে এল।
যা দেখল তা অবিশ্বাস্য। জ্যোৎস্না রাত্রিতে সত্যিই একটা বিরাট ফড়িঙের মতো জিনিস উড়ে বেড়াচ্ছে। তার পিঠে একটা মানুষ।
“এই দাদা, হলধরদা নয় তো?” বাগানে একটা চক্কর খেয়ে জিনিসটা সাঁ করে ফের জানালার কাছে চলে এল। ঘরের যেটুকু আলো বাইরে গিয়ে পড়েছে তাতে দেখা গেল, হলধরই বটে!হলধর একগাল হেসে তাদের দিকে চেয়ে হাত নেড়ে চেঁচাল, “মার দিয়া কেল্লা! মার দিয়া কেল্লা!”
“দেখলি দাদা!”
“সত্যিই তো!”
উড়ুক্কু ঝাঁটা ফের হুশ করে জানালার কাছে এসে ফের সাঁ করে বেরিয়ে গেল। হলধর শুধু চেঁচিয়ে বলল, “দারুণ মজা!”
দু’ভাই হাঁ করে দৃশ্যটা দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল ঝাঁটাটা আর একপাক ঘুরে আসতে গিয়ে হঠাৎ ফুস শব্দ করে গোত্তা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
দুই ভাই দৌড়ে নেমে ছুটে পিছনের পোড় জমিটায় গিয়ে দেখল, হলধর বসে বসে বিকৃত মুখে উঃ-আঃ করতে করতে মাজায় হাত বোলাচ্ছে।
“তোমার খুব লেগেছে হলধরদাদা?”
“তা লাগবে না? বেশ ভালই লেগেছে। তবে জিনিসটা সাকসেসফুল হওয়াতে ব্যথা তেমন টের পাচ্ছি না। কিন্তু মুশকিল কী জানো, একবার উড়ে চললে ব্যাটা বশে থাকতে চায় না। বাগ মানানো খুব মুশকিল। সেইজন্য দু-চারটে যন্ত্রপাতি লাগানো দরকার। আর একটা অসুবিধে হল সরু লাঠির ওপর বসে থাকা কিন্তু বেশ কঠিন ব্যাপার। ভাবছি একটা সাইকেলের সিট বা ঘোড়ার জিন লাগিয়ে নেব।”
হরতন বলল, “তা হলে দুটো লাগিও। একটায় তুমি বসবে, আর একটায় আমি আর দাদা।”
“হ্যাঁ, হবে হবে, সব হবে। একবার আবিষ্কারটা যখন হয়ে গেছে তখন বাদবাকি ব্যবস্থা করা শক্ত নয়। এখন কাজ হল, ওই নরদানবের হাত থেকে জিনিসটাকে রক্ষা করা।”
হরতন বলে উঠল, “আচ্ছা হলধরদাদা, ভূতনাথদা যে বলছিল তোমাকে একটা নরখাদক খেয়ে ফেলেছে! তুমি ভূত হয়ে আসোনি তো!”
মুখটা ব্যথায় বিকৃত করে হলধর বলল, “না রে ভাই, এখনও ভূত হইনি, তবে হওয়া বিচিত্র নয়। নরদানবটা তো আমাকে নিকেশ করতেই এসেছে। সারাদিন বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে ছিলুম। কী মশা রে ভাই সেখানে! পিঁপড়েও কামড়েছে অনেক। তবে কষ্ট সার্থক। চাট্টি মুড়িটুড়ি এনে দেবে খোকারা? বড্ড খিদে।”
দুই ভাই দৌড়ে গিয়ে মুড়ি নিয়ে এল। মুড়ি খেতে খেতে হলধর বলল, “আচ্ছা থোকারা, ঝাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়ানোর সময় ছাদে একজন বিধবা থান পরা মেয়েছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম। তার হাতে একটা খ্যাংরা ঝাঁটা। তিনি কে বলো তো! এই বাড়িতে বিধবা তো কেউ নেই!”
রুইতন মাথা নেড়ে বলল, “জানি না তো?”
“শুধু তাই নয়, আরও দেখলুম, পিছনের বারান্দায় একজন বুড়ো মানুষ খুব পায়চারি করছেন। হাতে মোটা লাঠি। তাঁর সাদা গোঁফ। ঠিক চিনতে পারলুম না। কে জানো?”
রুইতন বলল, “না তো!”
“তা হলে কি ভুল দেখলুম? তা তো হতে পারে না। আমার। চোখের দোষ নেই। আরও একটা কথা।”
“কী?”
“তোমাদের বাড়ির পিছনে ওই মস্ত আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে যে পুরনো দেউড়িটা রয়েছে, তার বন্ধ ফটকের বাইরে চারজন যামার্কা লোক দাঁড়িয়ে কী যেন গুজগুজ ফুসফুস করছিল। চোর ডাকাত হতে পারে। নবুদাদাকে একটু সাবধান করে দিও। আমি এখন আমার বাঁশঝাড়ে ফিরে যাচ্ছি।”
হরতন বলল, “কিন্তু বাঁশঝাড়ে তুমি শোবে কোথায়?”
“বাঁশপাতা পড়ে পড়ে সেখানে পুরু গদির মতো হয়ে আছে। শুয়ে ভারী আরাম।”
সন্ধের পর বাড়িটা একদম সুনসান হয়ে যায়। বাড়ির ঝি চাকররা বেশিরভাগই সন্ধের পর বাড়ি চলে গেছে। শুধু রান্নার ঠাকুর আর দু’জন জোগালি একতলার রান্নাঘরে কাজকর্ম করছে। গিন্নিমা শোয়ার ঘরে, কর্তামশাই বৈঠকখানায়, রুইতন আর হরতন পড়ার ঘরে। বিশাল দোতলাটা এ সময়ে হাঁ হাঁ করে।
ছাদে ওঠার সিঁড়ির নীচে ঘুপচি জায়গাটায় বসে নবকৃষ্ণ কর্তামশাইয়ের জন্য একমনে তামাক সাজছিল। টিকে ধরিয়ে ফুঁ দিয়ে সবে আগুনটাকে ধিইয়ে তুলেছে, ঠিক এমন সময় কে যেন বলল, “ওটা কিন্তু তোর খুব খারাপ ওভ্যেস।”
নবকৃষ্ণ যখন যে কাজ করে তাতেই অখণ্ড মনোযোগ, তাই আনমনে বলল, “কোন ওভ্যেসটা?”
“ওই যে ফুঁ দিয়ে কলকে ধরাস! ফুঁ দিলে যে জিনিসটা এঁটো হয় সে খেয়াল আছে? কবে যে তোদের আক্কেল হবে কে জানে! বাছাকে আমার এঁটোকাঁটা খাওয়াচ্ছিস, তাতে কি তোর ভাল হবে?”
নবকৃষ্ণ কলকেটা প্রায় ধরিয়ে ফেলেছে। অন্যমনস্ক না হয়ে বলল, “ওসব ছোটখাটো দোষ ধরবেন না। আগুনে দোষ নেই। অগ্নিশুদ্ধ হলে সব শুদ্ধ।”
“বলি কথা তো মেলাই শিখেছিস দেখছি। এত শাস্ত্রজ্ঞান কবে থেকে হল?”
কলকেটা ধরিয়ে ফেলে এবার নবকৃষ্ণ মুখ তুলে চেয়ে দেখল, ছাদের সিঁড়িতে এক বিধবা ঠাকরুন দাঁড়িয়ে। পরনে থান, মাথায় কদমছাঁট চুল, চোখ দুখানায় খুব তেজ। তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “পেন্নাম হই মা ঠাকরুন, তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”
“কোথা থেকে আবার আসব রে মুখপোড়া? আমার কি কোথাও যাওয়ার জো আছে? মায়ার বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি, আজও উদ্ধার পেলুম না।”
নবকৃষ্ণ গদগদ হয়ে বলল, “যা বলেছেন মা ঠাকরোন। মায়া হল কাঁঠালের আঠা, সহজে ছাড়তে চায় না। বড় চটচটে জিনিস। তা মা ঠাকরোন, কর্তাবাবুকে খবর দেব, না গিন্নিমাকে? আপনি কোন তরফের লোক তা তো ঠিক জানা নেই কিনা।”
“কেন রে হাঁদারাম, জানা নেই কেন? পাঁচ কুড়ি বছর ধরে ঘাঁটি গেড়ে বসে নিত্যি তোদের অনাছিষ্টি দেখছি, আমি কি উটকো লোক রে অলপ্পেয়ে? শুদ্ধাচার লোপাট হয়েছে, গোবর গঙ্গাজলের তো বালাই-ই নেই, তুলসীমঞ্চে কেউ একবার সাঁঝের পিদিমটা অবধি জ্বালে না। যত দেখছি তত গায়ে জ্বালা হচ্ছে। এর চেয়ে বরং ট্যাঁশদের খাতায় গিয়ে নাম লেখা, বালাই চুকে যাবে।”
লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে নবকৃষ্ণ বলে, “সেসব ছিল বটে সব ঠাকরোন, তবে কে করে বলুন! দোষঘাট নেবেন না, আপনি তো এসেই গেছেন, এখন থেকে সব আগের মতোই হবে’খন। তা রাত্তিরে কী খাবেন বলুন দেখি! দুধ আছে, মর্তমান কলা আছে, খান্দেসরি চিনি আছে, চারটি সাগুটা ভিজিয়ে রাখব কি?”
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিলা বললেন, “আর খাওয়া! সে তো কতকাল আগেই ঘুচে গেছে। আর খেলেও কি তোদের মতো অনাচারী ম্লেচ্ছদের হাতে খাব নাকি রে নচ্ছার? হেগোবাসী ছাড়ার বালাই অবধি ঘুচিয়ে দিয়ে বসে আছিস। নরকে যাবি যে!”
নবকৃষ্ণ ভারী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “সে তো বটেই মা ঠাকরোন। পাপের বোঝা নিত্যি ভারী হচ্ছে।”
মহিলা একটু নরম গলায় বললেন, “তা হ্যাঁ রে, আমাকে কি সত্যিই চিনতে পারলি না?”
মাথা চুলকে নবকৃষ্ণ লাজুক মুখে বলল, “চেনা চেনা ঠেকছে মা ঠাকরোন, তবে বুড়ো হচ্ছি তো, স্মৃতিভ্রংশ মতো হয়।”
“তবে যে ভূতনাথের কাছে আমার নামে গল্প ফাঁদলি! খুব যে বললি, আন্নাকালী দেবী এ বাড়ির আনাচেকানাচে ঘোরে।”
একগাল হেসে নবকৃষ্ণ বলে, “সে আর কবেন না মা ঠাকরোন, ভূতনাথটা বড্ড মিথ্যেবাদী। ভূতের গপ্পো ফেঁদে বসেছিল কর্তাবাবুর কাছে। উনি তো আবার ভালমানুষ লোক, যে বলে বিশ্বাস করে ফেলেন। তাই ভূতনাথকে ভড়কে দেওয়ার জন্য বানিয়ে ছানিয়ে বলেছিলাম আর কী। পীতাম্বরমশাই, হরুখুড়ো, পঞ্চা বিশ্বাস, আন্নাকালী দেব্যা…”
মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বানিয়ে বলেছিলি বটে, কিন্তু মিথ্যে বলিসনি রে।”
“তা মা ঠাকরোন, আপনি এসব জানলেন কী করে? ভুতোটা বলেছে বুঝি?”
“না, ভূতনাথ বলবে কেন? আমি তো সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই শুনেছি।”
ভারী অবাক হয়ে নবকৃষ্ণ বলল, “কিন্তু মা ঠাকরোন, সেখানে যে তৃতীয় ব্যক্তি কেউ ছিল না!”
“কে বলল ছিল না? না থাকলে শুনলুম কী করে রে হতভাগা? এখনও কি তোকে বলে দিতে হবে যে, আমিই আন্নাকালী দেব্যা?”
“অ্যাঁ।”
“হাঁ করে রইলি যে বড়! বলি আকাশ থেকে পড়লি নাকি?” নবকৃষ্ণের হাত থেকে কলকে পড়ে গেল। সে মেঝেয় পড়ে চোখ উলটে গোঁ গোঁ করতে লাগল।
আন্নাকালী ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “আ গেল যা! এ যে দাঁতকপাটি লেগে ভিরমি খেল। একটা কাজের কথা বলতে এলাম, দিল সব ভণ্ডুল করে। এখন যে কী করি!”
পিছনের ফটকে ডাকাত পড়ার খবরটা দিতে এসে রুইতন আর হরতনই নবকৃষ্ণকে ওই অবস্থায় দেখতে পেল।
কাছে গিয়ে হরতন নবকৃষ্ণের অবস্থা দেখে বলল, “দাদা, নবুদা শুয়ে শুয়ে গান গাইছে কেন রে?”
“ধ্যাৎ, নবুদা কখনও গানটান গায় না।”
“তা হলে কি নাক ডাকছে?” রুইতন একটু বড়। তার বুদ্ধি বিবেচনা হয়েছে। সে দেখেটেখে বলল, “না, নবুদা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। বাবাকে খবর দিতে হবে।”
খবর পেয়ে রাঘববাবু এলেন, অন্য লোকজনও এসে গেল। চোখে মুখে জল ছিটোবার পর নবকৃষ্ণ চোখ মেলেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমি দেশে যাব কর্তাবাবু, আমাকে ছুটি দিন।”
“কেন রে, কী হল হঠাৎ?”
এ ভূতের বাড়িতে আর থাকব না। রাঘববাবু অবাক হয়ে বললেন, “ভূতের বাড়ি! বলিস কী? এ বাড়িতে এক জন্ম কাটিয়ে দিলি, কখনও ভূতটুত দেখেছিস?”
“কিন্তু আজ যে স্বয়ং আন্নাকালী দেব্যা দেখা দিয়েছেন।”
“দূর বোকা! কী দেখতে কী দেখেছিস!”
উঠে বসে মাথা নেড়ে নবকৃষ্ণ বলল, “শুধু দেখা নয় কর্তাবাবু অনেকক্ষণ কথাবার্তাও হয়েছে। ভুল দেখা টেখা নয়।”
রাঘববাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তাই তো রে! তা আন্নাপিসি চায় কী? গয়ায় পিণ্ডি দিতে হবে নাকি?”
জড়ো-হওয়া লোকজনের ভিতর থেকে পরিপাটি ধুতি আর পাঞ্জাবি পরা সরুমতো একটা লোক এগিয়ে এল। লোকটার সবই সরু। শরীর সরু, মুখ সরু, নাক সরু, গোঁফ সরু এবং এমনকী চোখের ধূর্ত চাউনিটা অবধি সরু।
জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে লোকটা বিনয়ী গলায় বলল, “পেন্নাম হই কর্তামশাই। আপনার তো বেশ ঝাট যাচ্ছে দেখছি।”
রাঘব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তা যাচ্ছে বটে! তা তুমি কে?”
“অধমের নাম সুধীর বিশ্বাস। ধামের কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। যখন যেখানে তখন সেখানে। পেটের ধান্ধায় ভেসে ভেসে বেড়াই আর কী!”
“অ। তা কী চাও বাপু?”
“আজ্ঞে একটা কথা বলতে আসা। ফাঁক বুঝে বলব বলেই এসেছিলাম। তা এসে দেখি কী একটা হাঙ্গামা হচ্ছে। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জুত মতো বলার জন্য আরও একটু দাঁড়িয়ে থাকলে বোধ হয় ভালই হত। কিন্তু ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার মতো বরাত আর ক’জনের হয় বলুন! হাতে আর তেমন সময়ও নেই কি না।”
“তা তো ঠিকই হে। তা কথাটা কী নিয়ে বলো তো?”
লোকটা চারদিকে চেয়ে যেন একটু অবাক হয়েই বলল, “কর্তামশাই, খোকা দুটিকে দেখছি না তো!”
“খোকা! কোন খোকা হে?”
“আপনার খোকা দুটির কথাই বলছি। রুইতন আর হরতন। আহা, বড় ভাল দুটি ছেলে হয়েছে আপনার। যেন দেবশিশু। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।”
“তারা এখন পড়ার ঘরে।”
“ভাল, ভাল। লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়া খুব ভাল। পেটে বিদ্যে, ঘটে বুদ্ধি না থাকলে এই আমাদের মতো অকাজ-কুকাজ করে বেড়াতে হবে। সব ভাল যার শেষ ভাল। যা দিনকাল পড়েছে, খোকা দুটিকে একটু সামলে রাখবেন।”
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার আসল কথাটা কী?”
ভারী অপরাধী মুখ করে মাথা নুইয়ে, হাত কচলে সুধীর বিশ্বাস বলল, “আছে, সেটা পাঁচজনের সামনে বলার মতো নয়। একটু গুহ্য কথা। যদি একটু ফাঁকে আসেন তা হলে সাহস করে বলে ফেলি।”
“অ, তা এসো, ফাঁকেই এসো।”
বৈঠকখানায় ঢুকে চারদিকে চেয়ে সুধীর বিশ্বাস বলল, “বাঃ, বেশ বৈঠকখানাটি আপনার। এসব ঘরে বাস করলে মনটাও উঁচু থাকে। মেজাজও ভাল হয়।”
“সে তো বুঝলুম, কিন্তু কথাটা কী?”
“এই যে বলি। কোন মুখে বলব সেইটেই ভাবছি। বড় কথা ছোট মুখে কেমন মানাবে, সেটাও চিন্তার বিষয়।”
“অত সঙ্কোচ কীসের হে? বলে ফেললেই ল্যাটা চুকে যায়।”
ঘাড়টাড় চুলকে, লজ্জার হাসি হেসে, হাত-টাত কচলে সুধীর বিশ্বাস বলল, “কর্তামশাই, লাখপাঁচেক টাকা হবে?”
রাঘব হাঁ হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থেকে বললেন, “কী বললে হে? ঠিক শুনেছি তো!”
সুধীর বিশ্বাস মাথা নিচু করে বলল, “আজ্ঞে, একবার বলতেই মাথা কাটা গেছে। দু’বার পেরে উঠব না। ভারী লজ্জা করবে না আমার। তবে বলি, ঠিকই শুনেছেন।”
“পাঁচ লাখ টাকা! তার মানে কী?”
সুধীর বিশ্বাস ভারী সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে পাঁচ লাখ টাকার মানে পাঁচ লাখ টাকা বলেই তো মনে হচ্ছে। না হয় ডিকশনারিটা একটু দেখে নিন।”
“বলি পাঁচ লাখ টাকা আছে কিনা জেনে তোমার কাজ কী?”
সুধীর বিশ্বাস লজ্জার হাসি হেসে বলল, “আজ্ঞে, আমার আর কাজ কী? পাঁচ লাখ টাকা কেন, আমি পঞ্চাশ টাকারই হিসেব গোলমাল করে ফেলি। আর পাঁচ লাখ পেলেই বা রাখব কোথায়? চালচুলো নেই, চোরে ডাকাতে কেড়ে নেবে।”
“তা হলে পাঁচ লাখ টাকার কথা উঠছে কেন?” হাতজোড় করে সুধীর বিশ্বাস বলে, “সে আমার জন্য নয় কর্তামশাই।”
“তা হলে?”
“শ্রদ্ধাস্পদ ল্যাংড়া শীতলের জন্য। তিনি বলে পাঠিয়েছেন, গরিব দুঃখীদের তো আপনি কতই বিলিয়ে দেন। তাঁকেও না হয় দিলেন। দান-ধ্যান না করলেও চলবে। দীর্ঘমেয়াদী হাওলাত হিসেবে দিলেও ক্ষতি নেই। ধরুন বছর পঞ্চাশেক পর থেকে তিনি দু’-পাঁচ টাকা করে শোধ দিতে শুরু করবেন।”
“বলি তুমি পাগলটাগলনও তো!না কি ইয়ার্কি মারতে এসেছ?” জিভ কেটে, নিজের দু’খানা কান স্পর্শ করে সুধীর বিশ্বাস বলল, “আজ্ঞে, ইয়ার্কি মারব কী কর্তামশাই, আপনার সঙ্গে কথা কইতে যে আমার হাঁটুতে হাঁটুতে কত্তাল বাজছে! মান্যিগন্যি লোকেদের সঙ্গে কথা বলার কোন যোগ্যতাটা আছে আমার?”
“এই ল্যাংড়া শীতলটা কে?”
“আজ্ঞে, শ্রদ্ধেয় শীতলদাদাও একজন মান্যগণ্য লোক। তবে তাঁর এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। একটা কঠিন ফাঁড়া আছে সামনে। তাই বড় নেতিয়ে পড়েছেন। ব্যবসাবাণিজ্য লাটে উঠেছে।”
“পাঁচ লাখ টাকা চেয়ে পাঠায়, তার বেজায় বুকের পাটা দেখছি!”
“যে আজ্ঞে যথার্থই বলেছেন। আমাদের শীতলদাদা অবস্থার বিপাকে পড়লেও ওই একটা জিনিস এখনও আছে। তা হল বুকের পাটা।”
“এখন এসো গিয়ে। আমার অনেক কাজ আছে।”
“যে আজ্ঞে। তা হলে শীতলদাদাকে গিয়ে কী বলব?”
“বোলো, টাকা অত শস্তা নয়।”
“আজ্ঞে, তাই বলব। তা হলে আমি আসি গিয়ে।”
“এসো।”
“তা কামশাই, যাওয়ার আগে আপনার খোকা দুটিকে একবারটি একটু আদর-টাদর করে যেতে পারি কি?”
“না হে, তারা লেখাপড়া করছে।”
ঠিক এই সময়ে পাঁচু ধেয়ে এসে বলল, “কর্তাবাবু, ছেলে দুটোকে যে গুণ্ডারা তুলে নিয়ে গেল!”
রাঘব সটান হয়ে বললেন, “অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ কর্তাবাবু! পিছনের মাঠে তুবড়ি ফুটছে দেখে দুই ভাই নীচে নেমে দেখতে গিয়েছিল। রতন নিজের চোখে দেখেছে, তিন-চারটে মুশকো জোয়ান রুইতন আর হরতনকে ধরে কাঁধে ফেলে হাওয়া হয়ে গেছে।”
“সর্বনাশ! শিগগির লেঠেলদের খবর পাঠা। কোথায় নিয়ে গেল দেখ, কী সব্বোনেশে কাণ্ড!”
সুধীর বিশ্বাস যাই-যাই করেও যায়নি। ভারী জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো, তার দিকে চোখ পড়তেই রাঘব হুঙ্কার ছাড়লেন, “এ কি তোমার কাজ?”
মাথা নেড়ে সুধীর বিশ্বাস বলল, “আজ্ঞে না। কাজ সব ভাগ করা আছে কিনা।”
“তার মানে?”
“যার যে কাজ। আমার কাজ ছিল আপনার কাছে কয়েকটা কথা নিবেদন করার। তার বেশি নয়।”
“ওরা কারা?”
“আজ্ঞে, শিবেন, কাদু আর তাঁপা। ওগুলো ওদের আসল নাম নয় অবশ্য। তবে ওই নামেই ডাকে।”
রাঘববাবু হুঙ্কার ছাড়লেন, “ওরে কে আছিস, শিগগির আয়। এটাকে ধরে চোর কুঠুরিতে নিয়ে বেঁধে রাখ।”
সুধীর বিশ্বাস অতিশয় দুঃখের সঙ্গে বলল, “বিপদে পড়লে লোকের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না কর্তামশাই। সেটা দোষেরও নয়। তবে কিনা থাকলে ভাল হত।”
“তার মানে?”
“ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবুন কর্তামশাই। শীতলদাদা তো ধার হিসেবেই চাইছেন। শোধ দিতে একটু দেরি হবে এই যা।”