সে এক ম্যাজিকওলার ছেলে, যে ম্যাজিকওলা মাঝে মাঝেই অদৃশ্য হয়ে যেত, দিনের পর দিন তার দেখা পাওয়া যেত না। হিরুর মা ছিলেন না, এক বুড়ি দিদিমার কাছে মানুষ। বড্ড অনাদর ছিল তার, তাই সে হাপিত্যেশ করে বাবা কবে ফিরে আসবেন, তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকত।
অনেক-অনেক দিন পরে পরে বাবা হয়তো ফিরে আসতেন, কিন্তু বড্ড রোগা চেহারা নিয়ে, ধুকতে ধুকতে। তবু বাবা এসে তাকে পয়সা দিতেন। খাবার কিনে আনতেন, খেলনাও দিতেন একটা-দুটো। বাবা যে তার জন্যই রোজগার করতে গিয়ে গাঁয়ে গ্রামান্তরে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ান, তা হিরু জানত। বড় কষ্ট হয় বাবার জন্য। বাবার সঙ্গে চলে যেতেও ইচ্ছে হত তার। কিন্তু বাবা রাজি হতেন না। বলতেন, “তুমি পড়াশোনা করো, আমার মতো জীবন তোমার জন্য নয় বাবা।”
সে এক বর্ষার রাত। হিরুর স্পষ্ট মনে আছে। বাবা সেদিনই বাড়ি ফিরেছেন, তাই হিরুর মনে ভারী আনন্দ। রাতে বাবার বুক ঘেঁষে শুয়ে সে মহা আরামে ঘুমিয়েছিল। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখতে পেল, বাবা একটু দুরে মেঝের উপর বসে একটা হাত আয়নার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। আয়নার সঙ্গে কি কেউ কথা বলে?
চুপ করে শুয়ে চোখ সামান্য ফাঁক করে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃশ্যটা দেখছিল। হঠাৎ বুঝতে পারল, বাবা নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে প্রলাপ বকছেন না। আয়নায় দাড়ি-গোঁফওলা একটা অচেনা মুখ। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল হিরু।
ওটা কি ভুতুড়ে আয়না? বাবা কি ভূত-প্রেতের খেলা দেখান? হিরু কিছুই বুঝতে পারল না। তবে সেই ছোট বয়সেও সে বাবার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পেরেছিল, বাবা আয়নার ভূতটার সঙ্গে ভাব করতে চাইছেন।
পরপর দু’রাত একই ব্যাপার ঘটবার পর একদিন হিরু ঠিক করল, ব্যাপারটা দেখতে হবে। আয়নায় কথা বলার সময় বাবা যে গলায় ধুকধুকিটা ঝুলিয়ে নেন, এটা তার নজর এড়ায়নি।
সেদিন তার বাবা মদন তপাদার গাঁয়ের যাত্রা দেখতে গিয়েছেন। নিরালা ঘরে হিরু বাক্স খুলে আয়নাটা বের করল। এমনিতে আয়নাটা সাধারণ আয়নার মতোই। কিন্তু যেই গলায় লকেটটা ঝুলিয়ে নিল, সঙ্গে সঙ্গে আয়নায় একটা ভয়ংকর মুখ ভেসে উঠল। মাথায় লোহার টুপি, গালে দাড়ি-গোঁফ, চোখদুটো যেন জ্বলছে। সে পরিষ্কার শুনতে পেল, লোকটা উত্তেজিত গলায় অদ্ভুত এক ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। ‘হুররা… হুরো … বুরুচ… পিরো…’ এই ধরনের কথা। প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও হিরু বুদ্ধিমান ছেলে। সে খুব নরম করে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
লোকটা ভ্রু বেঁকাল। তারপর মুখের কাছে একটা হাত তুলে বলল, “রবিয়াল… রবিয়াল…।”
কথাটার মানে বুঝল না হিরু। কিন্তু তার কচি মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। গলার লকেটটার মধ্যে কোনও ব্যাপার নেই তো! সে তাড়াতাড়ি লকেটটা তুলে ভাল করে দেখল। মনে হল পালোয়ানের খোদাই করা ছবির বুকে একটা সূক্ষ্ম ফুটো আছে। সে ফুটোটার কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
লোকটা এবার বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে একটু হাসল।
লোকটার কথা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল হিরু। লোকটা বলল, “তোমার খুব বুদ্ধি। আমার নাম বুরুচ। আমি অনেক অনেক দূরে থাকি।”
“আমার নাম হিরু। হিরু তপাদার। আমি জাদুকর মদন তপাদারের ছেলে।”
“তুমি বেশ ভাল একটি ছেলে। যদিও তুমি খুব ছোট্ট একটা ছেলে, তবু তোমাকে বলে রাখি, এই আয়নাটা একটা ভীষণ দামি আর জরুরি জিনিস। আমাদের জগৎ থেকে একজন তোমাদের পৃথিবীতে গিয়েছিল। ওই আয়না আর লকেট সে চুরি করে পালিয়ে যায়। তারপর সে হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই দুটো মূল্যবান জিনিস তোমাদের গ্রহে পড়ে আছে। আমরা যে-কোনও মূল্যে ও দুটো ফেরত চাই।”
হিরু বলল, “বেশ তো, তুমি এসে এক্ষুনি নিয়ে যাও।”
লোকটা বলল, “শোনো বুদ্ধিমান ছেলে, আমাদের জগৎ থেকে তোমাদের জগতে যাওয়া সহজ নয়। অনেক সময় লাগবে। হয়তো তোমাদের হিসেবে আট-দশ বছর। কিন্তু আমাদের সৈন্যসামন্তরা ও দুটো জিনিস উদ্ধার করবেই। তখন যদি তারা বাধা পায়, তা হলে তারা ভয়ংকর সব অস্ত্র দিয়ে তোমাদের সব কিছু ধ্বংস করে ফেলতে পারে। আমাদের সৈন্যদের কোনও মায়াদয়া নেই, তার কারণ, তারা কলের তৈরি।”
“কিন্তু আমি তো ফেরত দিতেই চাইছি।”
“হ্যাঁ। তাই বলছি ও দুটো জিনিস খুব সাবধানে রেখো। খারাপ লোকের হাতে পড়লে সে এই দুটি জিনিস এমনভাবে ব্যবহার করবে, যাতে তোমাদেরই ক্ষতি হবে। ওই আয়না থেকে নানা সময়ে নানা বিচ্ছুরণ ঘটে। তার কোনওটা ভাল, কোনওটা মন্দ। সব সময়ে ঢাকনাটা দিয়ে রেখো। আশা করি আমার কথা তুমি বুঝতে পেরেছ।”
“পেরেছি বুরুচ। কিন্তু আয়নাটা যদি ভেঙে-টেঙে যায়?”
“সেই ভয় নেই। পৃথিবীর কোনও শক্তি দিয়েই ওকে ভাঙা যাবে না।”
“ঠিক আছে বুরুচ।”
“আমার অভিবাদন নাও হিরু তপাদার।”
মদন তপাদার যখন যাত্রা দেখে ফিরেছিল, তখন হিরু গভীর ঘুমে। আর পরদিন খুব ভোরবেলায় মদন তপাদার তার বাক্সপ্যাটরা নিয়ে সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিল আর তার সঙ্গে দেখাই হল না হিরুর। জরুরি কথাগুলো তাই মদন তপাদারকে বলাও হয়নি তার।
বছরখানেক পরে সে মদন তপাদারের একটা চিঠি পায়। তাতে লেখা–
বাবা হিরু,
আশা করি ঠাকুরের কৃপায় ভাল আছ। আমার শরীর খুব খারাপ, হয়তো বেশিদিন বাঁচব না। তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে কি না কে জানে। কিন্তু একটা জরুরি কথা তোমাকে জানানো দরকার। আমার কাছে একটা অদ্ভুত আয়না আর একটা ধুকধুকি ছিল। আয়নাটা চৈতন্যপুরের রাজবাড়ির দরবার ঘরের পিছনে চোরাকুঠুরির উপরের কুলুঙ্গিতে লুকানো আছে। ধুকধুকিটা আমার জাদুর বাক্সে রয়েছে। আর সেটা আছে চৈতন্যপুরের মন্টুরাম সিংহের বাড়িতে। বড় হয়ে যদি পারো, এ দুটো উদ্ধার করার চেষ্টা কোরো। এই গ্রামে আমার এক চেলা আছে। তার নাম সুধীর গায়েন। সে চোর। চোরেদের অনেক অন্ধিসন্ধি জানা থাকে।
বাবা হিরু, এই আয়নার মহিমা কী, তা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আশা আছে, তুমি হয়তো বুঝতে পারবে।
ইতি
তোমার বাবা মদন তপাদার
.
দরবার ঘরের পিছনে চোরাকুঠুরিতে ঢোকার সহজ পথ নেই। কয়েকদিন নিরীক্ষণের পর হিরু আবিষ্কার করল, ভাঁড়ার ঘরে বেদির মতো উঁচু যে উনুন আছে, তার নীচের ছিদ্রপথে হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায়। একখানা টর্চ নিয়ে হেঁচড়ে মেচড়ে ঢুকে প্রায় তেরো-চোদ্দো ফুট উঁচু কুলুঙ্গিতে উঠে খুঁজেও দেখল। কিন্তু আয়না সেখানে নেই। তবু ছোট ঘরখানার আনাচ কানাচ তন্নতন্ন করে খুঁজল হিরু। নেই।
হিসেবমতো বুরুচের সৈন্যসামন্তদের এসে পড়ার সময় হয়ে গিয়েছে। যদি আয়নাটা না পাওয়া যায়, তা হলে তারা যে কী ভীষণ কাণ্ড করবে কে জানে। হিরু ভারী চিন্তিত হয়ে মেঝের ধুলোবালির উপর কিছুক্ষণ বসে রইল। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার ঘর। নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল হিরুর। হয়তো অক্সিজেনের অভাব ঘটছে। আর মনে হচ্ছে, চারদিকে আবহের মধ্যে একটা যেন ফিসফাস, গুজগুজ হচ্ছে। কারা যেন হাঁটছে চলছে বা বাতাসে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। হিরু তটস্থ হল। এখন যদি সে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যায়, তা হলে ওই ঘরেই মরে পড়ে থাকতে হবে। সে ফের হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল।
বিকেলে হরিশ্চন্দ্র বারান্দায় তাঁর কেঠো চেয়ারটায় বসে ছিলেন। দেখা হতেই একগাল হেসে বললেন, “কী হল? পেলে না তো?”
হিরু ভারী অবাক হয়ে রাজামশাইয়ের পায়ের কাছটিতে বসে বলল, “কী পেলাম না রাজামশাই?”
হরিশ্চন্দ্র বললেন, “কেন, সেই আয়নাটা?”
হিরু আরও এক ডিগ্রি অবাক হয়ে বলে, “আয়নার কথা আপনি জানলেন কী করে?”
হরিশ্চন্দ্র বললেন, “সে আর জানা শক্ত কী! এ বাড়িতে বাতাসে কান পাতলে মেলা গুজগুজ, ফিসফাস শোনা যায়, বুঝলে!”
হিরু একটু চিন্তিত হয়ে বলে, “তা বটে রাজামশাই। কিন্তু ওই গুজগুজ আর ফিসফাস থেকে আয়নার একটা হদিশ কি পাওয়া যায় না মহারাজ?”
হরিশ্চন্দ্র ভ্রু কুঁচকে একটু ভেবে বললেন, “বাপু হে, গুজগুজ যে আমাকে খুব একটা মান্যিগণ্যি করে, তা তো নয়। আর ফিসফাসের কথা যদি বলল, তা হলে বলতে হয় তার নাগাল পাওয়া বেশ শক্ত। হাওয়া-বাতাসের মতো আসে আর চলে যায়, বুঝলে!”
“আজ্ঞে, বেশ বুঝেছি।”
“তা বাপু, বুড়ো বয়সের দোষে আজকাল লোকের নামধাম বড্ড ভুলে যাই। তোমার নামটা যেন কী বলেছিলে! হিরু তপাদার না কী যেন!”
হিরু অধোবদন হল। তারপর একটু অনুতাপ মেশানো গলায় বলল, “আজ্ঞে মহারাজ, ও নামটা আমি আপনাকে বলিনি। আমি বলেছি হিরু গণপতি। ওটা অবশ্য মিছে কথা। আমি জাদুকর মদন তপাদারের ছেলে হিরু তপাদারই বটে।”
“হ্যাঁ, ফিসফাস যেন তাই বলে গেল।”
হিরু তাড়াতাড়ি হরিশ্চন্দ্রের পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, “মহারাজ, সবই আপনাকে খুলে বলছি। দয়া করে আপনার গুজগুজ আর ফিসফাস ধরে করে আমার কাজটা উদ্ধার করে দিন।”