৫. সায়েন্স দিয়ে সবকিছুকে ব্যাখ্যা

সায়েন্স দিয়ে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না গদাইবাবু। দিন-দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে লোডশেডিং-এ তাঁর বাড়িতে আলো জ্বলে এবং তাঁর সাদা কালো টিভি-তে এন বি সি বা বি বি সি’র রঙিন সম্প্রচার দেখা যায়–এসবের জন্য তাঁর বাড়িতে আজকাল সন্ধেবেলায় বেশ ভিড় হচ্ছে। অনেকেই দেখতে আসছে কাণ্ডটা।

সি ই এস সি’র লোকেরাও এসে তাঁর বাড়ির লাইন পরীক্ষা করে বলেছে, না কোনও হট লাইনের সঙ্গে তাঁর বাড়ির তার জড়িয়ে যায়নি। তবু কেন কারেন্ট না থাকলেও আলো জ্বলে তা তারা বুঝতে পারছে না।

গদাইবাবুর সম্বন্ধি গজেন এক দিন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “শোনো গদাই, আমাদের পাশের বাড়িতে একজন মস্ত ইলেকট্রনিক্সের এঞ্জিনিয়ার এসেছে। দেড় গজ লম্বা তার টাইটেল। আমেরিকায় একটা বড় ফার্মের চিফ ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার। বছরে দেড় লাখ ডলার মাইনে। তাকে কালই ধরে এনে তোমার বাড়ির লাইন দেখাব। সন্ধের পর থেকে। সে আসতে রাজি হয়েছে।”

গদাইবাবু উদাস গলায় বললেন, “যা ভাল হয় করুন।”

পরদিন সন্ধেবেলা যাকে নিয়ে এল গজেন তাকে দেখে গদাইবাবুর বড় চেনা-চেনা ঠেকতে লাগল। এ-মুখ যেন দেখেছেন কোথাও। নামটা শুনেই লাফিয়ে উঠলেন গদাইবাবু, “আপনিই বাবুরাম গাঙ্গুলি? বনির বাবা! আপনাকে এন বি সি’র নিউজ চ্যানেলে দেখেছি।”

বাবুরাম অবাক হয়ে বললেন, “এন বি সি! আপনি কি রিসেন্টলি আমেরিকায় গিয়েছিলেন?”

“না। কস্মিনকালেও যাইনি।”

“তা হলে কি এন বি সি’র ভিডিও ক্যাসেট দেখেছেন?”

“না। আমার ভি সি আর নেই।”

“তা হলে?”

গদাইবাব আমতা-আমতা করে বললেন, “ওই আর কি। আসলে কী জানেন, আমার বাড়িতে অদ্ভুত সব কাণ্ড হচ্ছে। তার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। এন বি সি চ্যানেল আমি এই টিভিতেই দেখেছি।”

“কিন্তু এ তো অর্ডিনারি টিভি! কলকাতার প্রোগ্রামই তো দেখাচ্ছে।”

“হ্যাঁ। কিন্তু মাঝে-মাঝে…”

বলতে বলতেই গদাইবাবুর টিভি রঙিন হয়ে গেল। স্পষ্ট চলে এল এন বি সি’র প্রাতঃকালীন সংবাদ। বাবুরাম স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলেন। এরকম হওয়ার কথা নয়। এ এক অসম্ভব কাণ্ড। মার্কিন টিভির প্রোগ্রাম কী করে কলকাতায় দেখা যাচ্ছে!

খবরে যে ঘটনাটি একটু বাদেই শুনলেন বাবুরাম তাতে আরও বিস্মিত এবং হিম হয়ে গেলেন। সংবাদ-পাঠক জানালেন, পোর্টল্যাণ্ডে একটি জঙ্গলের ধারে ডক্টর ওয়াং-কে সাঙ্ঘাতিক আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। ওয়াং বিশ্ববিখ্যাত চিনা বৈজ্ঞানিক সম্প্রতি তিনি দেশ থেকে পালিয়ে মার্কিন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু লণ্ডন থেকে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তারপরই তাঁকে এই অবস্থায় পাওয়া যায়। কয়েকজন ভবঘুরে তাঁকে উদ্ধার করে নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে নিয়ে আসে। ওদিকে চিন সরকার জানিয়েছেন যে, ইনি আসল ডক্টর ওয়াং নন। ডক্টর ওয়াং-এর উদ্ধারকারীদের একজনের জবানিতে শুনন। ইনি ফ্রেড মেইলার…. বলতে-বলতেই ফ্রেড-এর চেহারা ভেসে উঠল পরদায়। সেই পোশাক, সেই টুপি। ফ্রেড থেমে-থেমে বলল, “ডক্টর ওয়াং অত্যন্ত ভাল লোক। তাঁকে আমরা চিনতাম। পোর্টল্যাণ্ডে তিনি একটি বিশেষ অভিযানে গিয়েছিলেন। তাঁর অভিযান ছিল কিছু দুষ্ট লোকের বিরুদ্ধে। আমাদের বিশ্বাস, ডক্টর ওয়াং-কে ওই শয়তানেরা আবার মারবার চেষ্টা করবে।”… ফ্রেড-এর ছবি কেটে দিয়ে সংবাদ-পাঠক বললেন, “ডক্টর ওয়াং-এর জ্ঞান না থাকলেও তিনি মাঝে-মাঝে দু-চারটে শব্দ বারবার উচ্চারণ করছেন। তার মধ্যে একটা হল চি চেং। আর একটা বনি। বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে ডক্টর ওয়াং-এর বাঁচবার সম্ভাবনা সম্পর্কে ডাক্তাররা কিছুই বলতে পারবেন না। দুটি গুলি তাঁর ঊরুতে লেগেছে, একটি ঘাড়ে। তাঁর গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট থাকায় হৃৎপিণ্ডে বা ফুসফুসে কোনও গুলি লাগেনি। তবে দুঃখের বিষয় ডক্টর ওয়াং-এর সঙ্গী দু’জন ভবঘুরে এবং একজন চিনা নিহত হয়েছেন।”

সংবাদ শেষ হয়ে গেল।

বাবুরাম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মনটা ভরে গেল বিষণ্ণতায়। পোর্টল্যাণ্ডে কেন গিয়েছিলেন ওয়াং? তবে কি ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিকেই আছে মানুষকে যান্ত্রিক দাস বানানোর কারখানা? ওয়াং কি ভীমরুলের চাকে ঘা দিয়েছিলেন? চি চেং এবং বনির নামই বা তিনি করছেন কেন বিকারের ঘোরে? এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনও সম্পর্ক আছে? চি চেং হল ওয়াং-এর সেই আবিষ্কার যা চুরি হয়ে গেছে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল বাবুরামের। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে ওয়াং অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন।

গদাইবাবু শুকনো মুখে বললেন, “কিছু বুঝতে পারছেন বাবুরামবাবু?”

বাবুরান অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “না। ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। তবে আমি আগামীকাল আবার আসব। সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে হবে।”

.

পর দিন বাবুরাম সকালের ডাকে একটা চিঠি পেলেন। বারো দিন আগে নিউ ইয়র্ক থেকে পোস্ট করা ডক্টর ওয়াং-এর চিঠি। ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠিতে ওয়াং লিখেছেন, আপনি এত দিনে নিরাপদে দেশে পৌঁছে গেছেন আশা করছি। দয়া করে বনির কোনও চিকিৎসা করাতে যাবেন না, তাতে ওর ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। যে দুষ্টচক্র বিশ্বব্যাপী নিজেদের যান্ত্রিক দাস তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে তাদের সম্পর্কে আরও কিছু খোঁজখবর পেয়েছি। বনির মতো আরও কিছু শিশুকে মাতৃগর্ভেই এরা যান্ত্রিক আজ্ঞাবহ দাস বানানোর পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনও শতকরা একশো ভাগ সফল নয়। কিন্তু আমার ভয়, এরা অচিরেই সফল হবে। তার ফলে কী হবে জানেন? হাজার হাজার মানুষকে এরা রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চালাবে, যা খুশি করিয়ে নেবে। হয়তো নরহত্যা, চোরাই চালান, হাইজ্যাকিং, টেররিজম। আর এইসব যান্ত্রিক দাসেরা হবে খুব বুদ্ধিমান, সাঙ্ঘাতিক মেধাবী, অসম্ভব ক্ষিপ্র ও শক্তিশালী। এদের কোনও নৈতিক বোধ বা চরিত্র থাকবে না, থাকবে না নিজস্ব কোনও চিন্তাধারা বা আদর্শ, থাকবে না স্নেহ ভালবাসা প্রেম বা দুর্বলতা। এসব ভেবে ভয়ে আমি শিউরে শিউরে উঠছি। ভাবছি যদি আজ আমার হাতের কাছে চি চেং থাকত, হয়তো সে আমাকে উপায় বাতলে দিতে পারত। চি চেং এক আশ্চর্য জিনিস। সে না করতে পারে হেন কাজ নেই। হায়, সে আজ কোথায়?….

চিঠিটা পড়তে-পড়তে বাবুরামের চোখ ঝাঁপসা হয়ে এল চোখের জলে।

একটু বেলায় বাবুরাম গদাইবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। এই বাড়ির রহস্যটাও তাঁকে ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে। কোনও ব্যাখ্যাই তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।

গদাইবাবু আজ অফিস কামাই করে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিগলিত মুখে অভ্যর্থনা করে বললেন, “আসুন গাঙ্গুলি-সাহেব, আসুন। আপনিই এখন আমার শেষ ভরসা।”

বাবুরাম টিভি সেটটা খুলে তন্ন-তন্ন করে দেখলেন। অত্যন্ত সাধারণ সাদা কালো সেট। কোনও বৈশিষ্ট্য বা অসাধারণত্ব নেই। সারা বাড়ি ঘুরে-ঘুরে দেখতে-দেখতে তাঁরা ছাদে এলেন।

গদাইবাবু একজন বিজ্ঞানীকে কাছে পেয়ে নিজের ল্যাবরেটরিটা দেখানোর লোভ সামলাতে পারলেন না। চিলেকোঠার দরজাটা খুলে দিয়ে সগর্বে বললেন, “বাবুরামবাবু, আমি বিজ্ঞানী নই বটে, কিন্তু খুব বিজ্ঞান-মাইণ্ডেড। এই দেখুন, আমিও একটু চচা-টচা করে থাকি।”

বাবুরাম গদাইবাবুর ল্যাবরেটরি দেখে হাসলেন। তবে ভদ্রতাবশে সব-কিছুই খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওটা কী বস্তু গদাইবাবু?”

গদাইবাবু বললেন, “ব্যাটারা ঠকিয়ে দিয়েছে মশাই। মিস্টিরিয়াস মিস্টার পানচো নামের একটা সায়েন্স কিট নিয়ে এলুম। তার কোনও মাথামুণ্ডুই বুঝলুম না। এখন পড়ে আছে।”

বাবুরাম তাক থেকে পানচোকে নামিয়ে এনে ভাল করে দেখলেন। তাঁর ভ্রূ কুঁচকে গেল চিন্তায়। বললেন, “কোথায় পেলেন এটা?”

“আজ্ঞে চিনে-বাজারে।”

“জিনিসটা কোনও কাজেই লাগেনি?”

“না। আপনি নিয়ে গিয়ে দেখতে পারেন কোনও কাজ হয় কি।”

বাবুরাম পানচোকে ভাল করে পরীক্ষা করলেন ফের। একটা ব্যারেল আর কয়েকটা ধাতব হাত বা স্ট্যাণ্ড। তবে স্ট্যাণ্ডগুলোর গড়ন দেখে মনে হচ্ছে, সেগুলির ভিতর সম্মু যন্ত্রপাতি থাকতে পারে। বাবুরাম ব্যারেলের গায়ে কান পাতলেন। অনেকক্ষণ কান পেতে তাঁর মনে হল, ব্যারেলের ভিতরে একটা অতি ক্ষীণ স্পন্দন বা ভাইব্রেশন হয়ে চলেছে।

বাবুরাম জিনিসটা খবরের কাগজ দিয়ে ভাল করে মুড়ে নিলেন।

বাড়ি ফিরে তিনি সোজা দোতলার একটা অব্যবহৃত ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিলেন। তারপর পানচোকে কাগজের মোড়ক থেকে বের করে উলটে-পালটে দেখতে লাগলেন।

হঠাৎ আপন মনেই বাবুরাম ইংরেজিতে বলে উঠলেন, “টু নো দিস টয় আই নিড এ কমপিউটার।”

পানচোর ব্যারেলের মধ্যে একটা শিস টানার মতো শব্দ হল। বাবুরাম নীচে গিয়ে বাড়ির টিভি সেটটা নিয়ে এলেন। গদাইবাবুর বাড়িতে যা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, সাধারণ টিভি সেটকে কমপিউটর ডিসপ্লে স্ক্রিনে পরিণত করা পানচোর পক্ষে কঠিন হবে না। তবে কোনও কি-বোর্ড নেই বা ডাটা ফিডমেন্টের উপায় দেখছেন না।

বাবুরাম কী করবেন ভাবছেন। এমন সময় আচমকা টিভির পরদায় অক্ষর ফুটে উঠতে লাগল। প্রথমেই ফুটে উঠল, “আই অ্যাম অলসো এ কমপিউটার।”

বাবুরাম বুঝলেন, ডাটা ফিডমেন্টের প্রয়োজন নেই, তাঁর কথা পানচো বুঝতে পারছে।

তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, “তোমার নাম কী?”

“পানচো।”

“তুমি চি চেং-কে চেনো?”

“আমিই চি চেং।”

“তুমি ওয়াংকে চেনো?”

“ওয়াং আমার স্রষ্টা।” বাবুরামের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি হাসলেন। ঠাকুরের দয়ায় তিনি ওয়াং-এর সেই হারানো চি চেং-কে ফিরে পেলেন তা হলে! কী আশ্চর্য যোগায়োগ!

“গদাইবাবুর বাড়িতে যেসব অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছিল সেগুলো কে করত?”

“আমি করতাম।”

“কেন?”

“দুটো কারণে। ওসব করলে আমাকে নিয়ে হইচই হবে, পাবলিসিটি হবে এবং ডক্টর ওয়াং টের পাবেন আমি কোথায় আছি। দু’ নম্বর কারণ, ডক্টর ওয়াং সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে যদি ওরা তাঁকে খবর দেয় সেই জন্য হংকং টিভির প্রোগ্রাম ট্যাপ করেছিলাম। কিন্তু ও লোকগুলো বোকা। বুঝতে পারেনি।”

“তুমি এন বি সি’র প্রোগ্রামও ট্যাপ করেছ। কেন?”

“এন বি সি’তে বনির ছবি দেখানো হয়েছিল।”

বাবুরাম চমকে উঠে বলল, “তুমি বনির কথা জানো?”

“জানি। ডক্টর ওয়াং বনি সম্পর্কে আমার ভিতরে কিছু ইনফরমেশন রেকর্ড করে রেখেছিলেন।”

“এইসব প্রোগ্রাম তুমি কী উপায়ে ট্যাপ করো?”

“খুব সোজা। আমি উপগ্রহ থেকে প্রোগ্রাম চুরি করি। আমার ভিতরে অনেক শক্তি, অফুরন্ত শক্তি।”

“তুমি বনি সম্পর্কে কী জানো?”

“তুমি যতটুকু জানো তার বেশি নয়।”

“আমি যা জানি তা তুমি কী করে জানতে পারছ?”

“আমি তোমার মগজ থেকে সব তথ্য পেয়ে যাচ্ছি।”

“সর্বনাশ।”

“ভয়ের কিছু নেই। আমি ভালমানুষ।”

“ধন্যবাদ। বনি সম্পর্কে তোমার সিদ্ধান্ত কী?”

“ওর কোনও চিকিৎসা করা উচিত নয়।”

“ওকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখব?”

“বনির মগজের মধ্যে একটা মাইক্রোচিপ রয়েছে। খুব ছোট।”

“ঠিক কোথায় মাইক্রোচিপটা রয়েছে?”

“মেডুলা ওবলংগাটায়। খুব সেনসিটিভ জায়গা।”

“অপারেশন করা কি সম্ভব?”

“না।”

“তা হলে?”

“বনিকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”

বাবুরাম বনিকে নিয়ে এলেন। বাড়ির সবাইকে বললেন, “তিনি একটা জরুরি কাজ করছেন, কেউ যেন বিরক্ত না করে।

বনিকে চি চেং-এর সামনে একটা টেবিলে শুইয়ে দিলেন বাবুরাম। বনির চোখের মণি অত্যন্ত দ্রুত রং পালটাতে লাগল। কখনও লাল, কখনও নীল, কখনও সবুজ, কখনও গোলাপি।

চি চেং যেন দ্বিধায় পড়ে গেল। ডিসপ্লে স্ক্রিনে অনেকগুলো দুবোধ সংকেতবার্তা ফুটে উঠতে লাগল, যার অর্থ বাবুরাম জানেন না। তবে তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছিল, ডিসপ্লে স্ক্রিনে দুটো বিরোধী কমপিউটারে একটা লড়াই ঘটে যাচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টা এরকম চলল।

এর পর ডিসপ্লে বোর্ডে যে কথাটা ফুটে উঠল তা অবিশ্বাস্য। বাবুরাম সবিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে দেখলেন বোর্ডে একটা ছোট্ট বাক্য ফুটে উঠেছে, আমি বনি।

বাবুরাম বনির দিকে চেয়ে দেখলেন। বনি স্থির চোখে তাঁকে দেখছে। ঠোঁটে কি একটু হাসির ছোঁয়া?

বাবুরাম টিভি স্ক্রিনের দিকে চেয়ে দেখলেন, নতুন বাক্য এল, আমি চি চেং-কে দখল করেছি।

বাবুরাম অতি কষ্টে নিজেকে সামলালেন। মাত্র ছ’মাস বয়সের বনি কী করে এইসব কাণ্ড ঘটাচ্ছে? গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বাবুরাম বললেন, “বনি, আমি তোমার বাবা।”

“না। আমার বাবা নেই, মা নেই।”

“তবে তুমি কে?”

“আমি শুধু বনি।”

“তোমার স্রষ্টা কে?”

“ডক্টর লিভিংস্টোন।”

“সে তোমার কাছে কী চায়?”

“সে আমাকে চায়।”

“তুমি কি তার কাছে যাবে?”

“যাব। ভীষণ দরকার।”

“কী দরকার?”

“তার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার।”

“লিভিংস্টোন কীরকম লোক?”

“ছ’ ফুট লম্বা, ভাল স্বাস্থ্য, বয়স পঞ্চান্ন, দুরন্ত মাথা।”

“তুমি কি জানো বনি, লিভিংস্টোন একটা দাস সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছে?”

“হতে পারে। হয়তো তাই।”

“কীভাবে তোমার মাথায় মাইক্রোচিপ ঢোকানো হয়েছিল তুমি জানো?”

“জটিল পদ্ধতিতে। নাভির ভিতর দিয়ে সরু ক্যাথেডর ঢুকিয়ে। মাইক্রোসার্জারি। অন্তত দু’ দিন সময় লাগে।”

“বুঝেছি বনি। তোমার বয়স খুব কম, কিন্তু তবু তুমি চমৎকার বয়স্ক মানুষের মতো তথ্য দিচ্ছ, এটা কী করে সম্ভব হচ্ছে?”

“আমার মগজের সব কোষ জাগ্রত।”

“তোমার শরীর অসাড় কেন?”

“চিপটা ঠিকমতো বসেনি।”

“আমরা চিপটা বের করতে চাই বনি। আমরা তোমাকে সন্তান হিসেবে ফিরে পেতে চাই।”

“সম্ভব নয়। মাইক্রোচিপটা আমার জৈবী সংস্থানের সঙ্গে মিশে গেছে।”

“যদি ওটা অকেজো করতে চাই তা হলে কী করতে হবে?”

“মাদার কমপিউটারকে ধ্বংস করা ছাড়া সম্ভব নয়। আমার মগজের মাইক্রোচিপ মাদার কমপিউটারের সঙ্গে স্থায়ীভাবে টিউন করা।”

“সেটা কোথায় আছে?”

“ক্লিনিকে। বেসমেন্টে।”

“ক্লিনিক মানে কি লিভিংস্টোনের ক্লিনিক?”

“হ্যাঁ। পোর্টল্যাণ্ডে।”

“এ-ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই?”

“না।”

“মাইক্রোচিপটা যদি অকেজো করে দেওয়া যায় তা হলে কী হবে? তোমাকে কি আমরা ফিরে পাব বনি?”

“বলা কঠিন।”

“তুমি মরে যাবে না তো?”

“যেতে পারি।”

“তোমাকে আমরা ভীষণ ভালবাসি বনি। তুমি কি সেটা জানো?”

“ভালবাসা! হতে পারে।”

“তোমাকে বাঁচতেই হবে বনি। তুমি ভাল করে ভেবে দ্যাখো, মাদার কমপিউটারকে ধ্বংস করলে তোমার কোনও ক্ষতি হবে কি না।”

“আমি ঠিক জানি না। তবে কাজটা বিপজ্জনক।”

“কমপিউটারে কতজন শিশুকে টিউন করা হয়েছে?”

“বত্রিশজন। তিন শো তেত্রিশজন এখনও মাতৃগর্ভে আছে।”

“তুমি এ-তথ্য কী করে জানলে?”

“প্রথম লটের সব মাইক্রোচিপই একরকম। আমি সংখ্যাটা জানি।”

“আমি তোমার সাহায্য চাই বনি। মাদার কমপিউটার ধ্বংস করতে হলে কী করতে হবে, তা আমি জানি না।”

স্ক্রিনটা হঠাৎ সাদা হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে একটা বাক্য ফুটে উঠল, “খুব সাবধান।”

.

চি চেং ওরফে পানচোকে গদাইবাবুর হাতে ফেরত দেওয়া উচিত হবে কি না তা বাবুরাম বুঝতে পারছিলেন না। তবে সন্ধের দিকে তিনি গদাইবাবুর বাড়ি গেলেন। গিয়ে দেখলেন, ঘোর লোডশেডিং এবং গদাইবাবুর বাড়িও অন্ধকার।

তাঁকে দেখে গদাইবাবু আহ্লাদে একেবারে বিগলিত হয়ে বললেন, “ধন্য মশাই আপনি। কী একটু কলকাঠি নেড়ে গেলেন আর অমনি আমার বাড়িতে আবার আগের পরিস্থিতি ফিরে এসেছে।”

“আপনি কি তাতে খুশি?”

“খুব খুশি মশাই, খুব খুশি। যা ভুতুড়ে কাণ্ড শুরু হয়েছিল তাতে তো আমার হাত-পা সব পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যাওয়ার জোগাড়।”

“পানচোকে কি আপনি ফেরত চান গদাইবাবু?”

“দূর দূর। টাকাটাই গচ্চা গেছে। ও আর চাই না। জঙ্গল দূর হওয়াই ভাল।”