কখন সন্ধে হয়ে অন্ধকার নেমেছে, তা নবীনের খেয়াল ছিল। ভাঙা ফোয়ারার ধারে বসে পূর্বপুরুষদের কথা ভাবতে ভাবতে সে একেবারে বিভোর হয়ে গিয়েছিল।
পূর্বপুরুষদের সঙ্গে তার কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি বটে, কিন্তু তাঁদের গল্প সে মেলাই শুনেছে। তাঁরা ডাকাতি করে বেড়াতেন বটে, কিন্তু গরিব-দুঃখীদের উপকারও করতেন খুব। যে গাঁয়ে জল নেই, সেখানে পুকুর কাটিয়ে দিতেন; যার ঘর পড়ে গেছে, তার ঘর তুলে দিতেন; বিপন্নকে রক্ষা করতেন; জমিদারের পাইকরা হামলা করলে উলটে তাদের শিক্ষা দিয়ে দিতেন। তাঁরা প্রায়ই বিশাল ভোজ দিয়ে পাঁচ-সাতটা গাঁয়ের লোককে ডেকে আকণ্ঠ খাওয়াতেন। তাঁদের যত দোষই থাক, গুণেরও অভাব ছিল না। তার এক পূর্বপুরুষ এক-ডুবে নদী পারাপার করতে পারতেন। আর একজন এমন লাঠি ঘোরাতেন যে, বন্দুকের গুলি অবধি গায়ে লাগত না। আর-একজন কুস্তিতে ভারত-বিখ্যাত ছিলেন।
ভাবতে-ভাবতে নবীন এমন বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে, মশার কামড় অবধি টের পাচ্ছিল না।
হঠাৎ বাতাসে একটা গুনগুন ধ্বনির মতো কী একটা শোনা গেল। নবীন চোখ বুজে ছিল।
কে যেন বলল, “তাকাও! তাকাও! ওপরে-নীচে, ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে।”
নবীন চমকে উঠল।
“কে?”
না, কেউ নেই।
মহাদেব এসে ডাকল, “কী গো দাদাবাবু, আজ কি বাগানেই রাতটা কাটাবে নাকি? ঠাণ্ডা পড়েছে না? এই শীতে এখানে বসে কোন্ খোয়াব দেখছ শুনি? পিসিঠাকরুণ যে ডেকে-ডেকে হয়রান!”
নবীন তাড়াতাড়ি মহাদেবের হাত চেপে ধরে বলল, মহাদেবদা, আমি এইমাত্র কার যেন কথা শুনলাম।”
“তোমার মাথাটাই গেছে। ওঠো তো, ঘরে চলো।”
নবীন উঠল। তার মনে হচ্ছিল, সে ভুল শোনেনি। পাতালঘরেও আজ সে কার যেন গলা শুনতে পেয়েছে। কে যেন বলছিল, “ওভাবে নয়।”
নবীন ঘরে এসে গরম চাঁদরটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এ-সময়টায় সে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে।
রাস্তায় পা দিতেই একটা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল নবীন। একেবারে পপাত ধরণীতলে। টের পেল, তার সঙ্গে-সঙ্গে আরও দুটি প্রাণী তারই মতো ছিটকে পড়ে গেছে মাটিতে।
নবীন তাড়াতাড়ি উঠে দু’জনকে ধরে তুলল। দেখল, সদাশিববাবুর নাতি আর নাতনি, বিলু আর অনু।
দু’জনেরই অবস্থা কাহিল। শীতে, ভয়ে দু’জনেই কাঁপছে থরথর করে।
“অনু! বিলু! তোমাদের কী হয়েছে? কোথা থেকে ছুটে আসছ?”
বিলু বলল, “বাঘ!”
“বাঘ! এখানে বাঘ কোথায়? কী হয়েছে বলো তো! তার আগে এসো, ঘরে বসবে। আগে একটু বিশ্রাম নাও। তার পর কথা।”
অনু মাথা নেড়ে বলল, “অত সময় নেই। সিদ্ধিনাথকে কে যেন জঙ্গলের মধ্যে মাথায় ডাণ্ডা মেরে ফেলে রেখে গেছে। তাকে এখনই হাসপাতালে দিতে হবে।”
একথায় নরীন ভারী চমকে উঠল। সিদ্ধিনাথকে কে মারবে? সাতে নেই, পাঁচে নেই!
নবীন বলল, “চলো, তোমাদের বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে আসি। লোকজন নিয়ে আমিই যাচ্ছি জঙ্গলে। কোথায় ঘটনাটা ঘটেছে বলো তো!”
“কালীবাড়িতে। ভুজঙ্গদা পাহারা দিচ্ছে।”
অনু আর বিলুকে তাদের বাড়ির ফটক অবধি এগিয়ে দিল নবীন। তার পর তোকজন নিয়ে রওনা হল।
কালীবাড়িতে সিদ্ধিনাথ কেন গেল, সেইটেই বুঝতে পারছিল
নবীন। ও দিকে সচরাচর কেটেরহাটের লোকেরা যায় না। বাঘের কথাটাতেও তার ধন্ধ লাগছে। এ-অঞ্চলে এক সময়ে বাঘ আসত ঠিকই, কিন্তু আজকাল আর বাঘের কথা শোনা যায় না।
কালীবাড়ির কাছ বরাবর পেীছে নবীন ডাকল, “ভুজঙ্গদা! ভুজঙ্গদা! কোথায় তুমি?”
কোনও জবাব পাওয়া গেল না।
তিন-চারটে টর্চের আলোয় চার দিকটা আলোকিত করে সবাই খুঁজছে।
অবশেষে কে একজন চেঁচিয়ে বলল, “এই তো সিদ্ধিনাথ! ইশ, এ তো প্রায় হয়ে গেছে।”
সবাই দৌড়ে গিয়ে সিদ্ধিনাথকে দেখল। মাথার পিছনে গভীর ক্ষত। চার দিকে রক্ত জমাট বেঁধেছে বটে, কিন্তু এখনও ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়ছে। শ্বাস ক্ষীণ।
নবীন নাড়ি দেখল। সে একটু-আধটু ডাক্তারি জানে। বহুকাল যতীন হোমিওপ্যাথের সাগরেদি করেছে। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয় বলে এবং বিদেশ বিভুয়ে অসুখ-বিসুখে বিপদে পড়তে হয় বলে, একটু সে শিখে রেখেছে।
পকেটে ওষুধ সে নিয়েই এসেছিল। সিদ্ধিনাথের মুখে চারটে বড়ি গুঁজে দিল সে। মাথাটা ব্যান্ডেজ করে দিল। তার পর বলল, “বাঁশ কেটে একটা মাচান তৈরি করে ফ্যালো চটপট।”
চার দিকে মেলা বাঁশগাছ। মাচান তৈরি হতে কয়েক মিনিট লাগবে।
নবীন নাড়ি ধরে বসে রইল। তার পর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু ভুজঙ্গ কোথায়? সে তো পাহারায় ছিল।”
পানু বলল, “না, তাকে দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় ভয় পেয়ে পালিয়েছে।”
ভয় পেয়ে পালানোর লোক ভুজঙ্গ নয়, নবীন জানে। ভুজঙ্গ সাকাসের দলে ছিল। ট্র্যাপিজের খেলা দেখাত। ভয় থাকলে ট্র্যাপিজের খেলা দেখাতে কেউ পারে?
নবীন মাথা নেড়ে বলল, “পালায়নি। হয় কাউকে তাড়া করেছে, নয়তো তারও সিদ্ধিনাথের মতো দশা হয়েছে। তোমরা কেউ এখানে বসো, আমি দেখছি। আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। ফিরতে দেরি হবে। তোমরা মাচান তৈরি হলে সিদ্ধিনাথকে নিয়ে চলে যেও। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এখানে ফিরে এসো।”
নবীনের ভয়-ডর বলে কিছু নেই। দেশভ্রমণ করতে গিয়ে সে বহু বার বহু রকম বিপদে পড়েছে।
টর্চ আর একটা লাঠি হাতে সে একা বেরিয়ে পড়ল ভুজঙ্গকে খুঁজতে!
চার দিকেই নিবিড় বাঁশবন। ঝোঁপঝাড়। খানাখন্দ। চার হাত দূরের জিনিসও কুয়াশার জন্য ভাল দেখা যাচ্ছে না। নবীন মাঝে-মাঝে ভুজঙ্গর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে খুঁজে বেড়াতে লাগল।
শিমুল গাছের পিছনে এক সময়ে কালীবাড়ির টলটলে দিঘি ছিল। মজে-মজে এখন আর দিঘির অস্তিত্ব নেই। শুকনো একটা খাদ মাত্র। তার ভিতরে মাথা-সমান আগাছার জঙ্গল।
নবীন একবার ভাবল, নামবে না। টর্চ জ্বেলে সে দেখছিল দিঘির ধারে ভেজা মাটিতে মানুষের পায়ের দাগ আছে কি না।
হঠাৎ নবীনকে আপাদমস্তক চমকে দিয়ে একটা বাঘ হুঙ্কার দিয়ে উঠল। এত কাছে যে, মনে হল, এক্ষুনি ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে।
নবীন প্রথমটায় কেমন বিহ্বল হয়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিল। যদি ডাকটা সত্যিই বাঘের হয়ে থাকে, তবে তা বিশাল বাঘ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আর না হলে কেউ বাঘের গলা নকল করে ডাকছে।
দ্বিতীয় সন্দেহটাই নবীনের দৃঢ়মূল হল। সিদ্ধিনাথকে যে বা যারা মেরেছে, তারাই নয় তো?
নবীন টর্চটা নিবিয়ে দিল। বাঘের ডাকটা শোনা গেছে পিছন থেকে। সুতরাং সামনে এগোতে বাধা নেই।
সামনে খাদ।
গুড়ি মেরে নবীন খাদের মধ্যে আগাছার জঙ্গলে নেমে গেল। সাবধানে হাত আড়াল করে টর্চ জ্বেলে সে দেখে নিচ্ছিল, জায়গাটা কতদূর বিপজ্জনক।
হঠাৎ নজরে পড়ল, এক-জোড়া পা একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে।
নবীন এগিয়ে গেল, টর্চ জ্বেলে দেখল, ভুজঙ্গদাই। নাকের কাছে হাত রাখল নবীন। শ্বাস চলছে। নাড়ি ধরে দেখল, আঘাত গুরুতর হলেও মারাত্মক নয়।
তার পর লক্ষ করল, ভুজঙ্গেরও মাথার পিছনে বেশ বড়সড় চোট। রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে।
ব্যাণ্ডেজ পকেটেই ছিল। ওষুধ দিয়ে জায়গাটা বেঁধে দিল সে। তার পর চারটে বড়ি খাওয়াল।
দশ মিনিটের মধ্যেই ভুজঙ্গ চোখ মেলে চাইল।
“ভুজঙ্গদা।”
“কে?”
“আমি নবীন। এখন কেমন লাগছে?”
ভুজঙ্গ যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করে বলল, “আমাকে ধরে তোলে। তো।”
“চলতে পারবে?”
“পারব।” নবীন তাকে ধরে বসাল। “কী হয়েছিল ভুজঙ্গদা?”
ভুজঙ্গ ঠোঁট উল্টে বলল, “কী করে বলব? সিদ্ধিনাথকে পাহারা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ কাছে-পিঠে একটা বাঘ ডেকে উঠল। প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সাকাসে মেলা বাঘ-সিংহ দেখেছি, দিন রাত তাদের ডাক শুনেছি। কেমন যেন মনে হল, এ সাচ্চা বাঘের ডাক নয়।”
“বটে! তোমারও তাই মনে হল?”
“তুমিও শুনেছ নাকি?”
“শুনেছি, আমারও মনে হয়েছে, ওটা আসল বাঘের ডাক নয়। তোমার ঘটনাটা আগে বলো।”
“বাঘের ডাকটা নকল বলে মনে হতেই আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। চার দিক সুনসান। হঠাৎ শুনলাম, ঝোঁপঝাড় ভেঙে কে যেন চলে যাচ্ছে। মনে হল, একটা বেশ লম্বা চেহারার লোক বাঁশবনের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পিছু নিলাম। লোকটাকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবছি, কোন দিকে যাব–হঠাৎ আবার সেই বাঘের ডাক। এই দিক থেকেই হল। দৌড়ে এলাম। তখন আচমকা কে যে পিছন থেকে মাথায় মারল, কিছু বুঝতে পারলাম না।”
নবীন চিন্তিতভাবে বলল, “তোমার কিছু সন্দেহ হয়?”
ভুজঙ্গ মাথা নেড়ে বলল, “শুধু মনে হচ্ছে কোনও পাজি লোক কেটেরহাটে এসে জুটেছে। সিদ্ধিনাথকে নইলে মারবে কে, বলো? তার টাকা-পয়সা নেই, সম্পত্তি নেই।”
নবীন একটু হেসে বলল, “তা না থাক, তবে সিদ্ধিনাথ হয়তো গুপ্ত কোনও খবর রাখে, যা আমি বা তুমি জানি না।”
“কী জানি বাপু!”
“তুমি হাঁটতে পারবে ভুজঙ্গদা?”
“পারব।”
“তা হলে আমার কাঁধে ভর দিয়ে চলো। অনেকটা পথ।”
“পারব হে নবীন। ভুজঙ্গ সাকাসে খেলা দেখাত। সে ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায় না।”
দু’জনে এগোতে লাগল।