৫. সন্ধের পর বগলাপতি

সন্ধের পর বগলাপতি সাধনপীঠে থাকেন না, বাড়ি ফিরে যান। একদিন কালীভক্ত গোবিন্দ ঘোষাল জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাপু হে, একখানা সাধনপীঠ তো বোকা লোকদের মাথায় হাত বুলিয়ে বানিয়ে নিয়েছ। তা নিশুত রাতে সাধন-ভজন না করে গুটিগুটি বাড়ি গিয়ে সেখোও কেন? কীরকম সাধক হে তুমি?”

বগলাপতি বললেন, “না দাদা, আমার বড় সর্দির ধাত। নদীর ধারের ভেজা বাতাস আমার সহ্য হয় না। ঠান্ডা লেগে যায়।”

“হাসালে ভায়া! যারা সাধন-ভজন করে তাদের গা এত গরম হয়ে ওঠে যে, হলকা বেরোয়। ওই হা কুঁড়ে জোলো বাতাসের সাধ্যি কী শরীরের ভিতরে ঢুকবে!”

বগলাপতি অতি বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, “তা তো বটেই। আমার শরীরে তো একশো দশ ডিগ্রি অবধি তাপ উঠে যায়। সেই অবস্থায় আমাদের মেনি বিড়ালটা একবার কোলে এসে বসেছিল। পরদিন তার গায়ে দেখি, বড়বড় ফোস্কা। কিন্তু কথা কী জানেন, ওই ধ্যান যেই শেষ হয় অমনই হু-হুঁ করে তাপটা নেমে যায়, আর তখনই ঠান্ডাটা লাগে।”

গোবিন্দ ঘোষাল বিছুটি হাসি হেসে বললেন, “লোকে কিন্তু অন্য কথাও বলে!”

বগলাপতি উদাস মুখে বললেন, “লোকে যা বলে তাও মিথ্যে নয় দাদা। লোকে বলে, আমি নাকি আসলে ভূতের ভয়ে পালিয়ে যাই। তা সেটা অস্বীকার করি কী করে? ঠিক ভূতের না হলেও ভূতের গানবাজনার ভয়ও তো আছে!”

গোবিন্দ ঘোষাল অবাক হয়ে বললেন, “ভূতের গানবাজনা! সে আবার কী জিনিস হে?”

“আর কবেন না দাদা! আমার তো দু’টি বই ভূত নেই। দুটিই অতি নচ্ছার দেহাতি ভূত। রাতবিরেতে তাদের একজন বেতালে ঢোল বাজায় আর অন্যজন বেসুরো গলায় গান গায়। ওই জন্যই তো দু’জনের নাম দিয়েছি গানাবাজানা। তাদের গানবাজনার ঠেলায় সাধনপীঠে কি শান্তিতে থাকবার যযা আছে মশাই? রাত ভোর হওয়ার আগে তা ক্ষান্ত হয় না।”

গোবিন্দ ঘোষাল আর কথা বাড়াননি। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “তুমি খুব উঁচুদরের সাধক হে, চালিয়ে যাও!”

বগলাপতি নির্বিকারভাবে বললেন, “কথাটা লিখে দেবেন দাদা, বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখব।”

তা কাল রাতেও বগলাপতি যখন বাড়িমুখো রওনা দিচ্ছেন তখন কামাখ্যা আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, “আমাকে এখানে একা ফেলে যাচ্ছেন, ভালমন্দ একটা কিছু হয়ে গেলে কী হবে?” বগলাপতি অবাক হয়ে বললেন, “একা! একা কেন রে? দুনিয়ায় কি একা হওয়ার যো আছে? এই তো ক্ষিতিবাবু আছেন, অপরেশবাবু আছেন, তেজেন্দ্রবাবুও হাজির! মরুবাবুও জেঁকে বসে আছেন, ব্যোমকেশবাবুকে তো নড়ানোই যায় না। পাঁচজনে গলাগলি ভাব। পঞ্চভূত বলে কথা!”

কামাখ্যা সন্দিহান হয়ে বলল, “এরা সব কারা মশাই? লোক ভাল তো?”

“বিশিষ্ট লোক রে, সব বিশিষ্ট লোক! ওই যে আমগাছটা দেখছিস, ওটা আবার কথাটথা কয়। রাতবিরেতে কান পাতলে শুনবি এদিককার এই কদম গাছটার সঙ্গে চাপানউতোর চলছে।”

“বলেন কী মশাই! গাছে-গাছে ঝগড়া! জন্মে শুনিনি!”

“তবে আর সাধনপীঠের মহিমা কী? তারপর ধর বাতাসে গিজগিজ করছে অশরীরীদের ভিড়, তাদেরও কত সুখ-দুঃখের কথা আছে। সারা রাত গুজগুজ ফিসফাস, কোনও বউ হয়তো শাশুড়ির গঞ্জনার কথা কয়, কোনও কেরানি হয়তো উপরওলার অত্যাচারের কথা কইতে গিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদে, কত রাজাগজা এখনও তম্বি করে বেড়ায়। হ্যাঁ রে কামাখ্যা, তুই কি ইঁদুরের বা বাদুড়ের ভাষা বুঝতে পারিস?”

কামাখ্যা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আজ্ঞে না, ওটা শেখা হয়ে ওঠেনি।”

“শিখে রাখলে পারতি রে! এখানে বলিয়েকইয়ে ইঁদুর আর গল্পবাজ বাদুড়ের অভাব নেই কিনা! একটা ইঁদুর হয়তো ঘরে ঢুকে তোকে দেখেই থতমত খেয়ে বলে উঠল, ‘এই যে কামাখ্যাবাবু, নমস্কার! কী সৌভাগ্য আমাদের! তা আপনি এখানে যে! কোনও বিষয়কৰ্ম আছে নাকি?’ ভাষাটা বুঝলে তুইও তখন গল্প ফেঁদে বসে যেতে পারতিস। কিংবা ধর, ছোট বাইরে করতে বেরিয়েছিস, হঠাৎ একটা বাদুড় এসে তোকে দেখে ভারী খুশি হয়ে বলল, ও মা! কামাখ্যাবাবু না? এঃ, বড্ড রোগা হয়ে গেছেন দেখছি! তা বন্ধকি কারবারটা কেমন চলছে?’ ভাষাটা ধরতে পারলে তুইও তখন দিব্যি গল্পগাছা করে খানিকটা সময় কাটিয়ে দিতে পারতিস।”

কামাখ্যা মাথা নেড়ে বলল, “না মশাই, ইঁদুর বাদুড়ের সঙ্গে কথা কয়ে রাতের ঘুম নষ্ট করতে পারব না।”

“আহা, তা তো বটেই। তবে কিনা, কথাটা হল, একা হওয়ার কি যো আছে রে? মিলেমিশে থাকলে দেখবি মোটেই একা লাগবে না।”

কামাখ্যা হতাশ হয়ে বলল, “ভূত-প্রেত, কথাকওয়া ইঁদুর, আড্ডাবাজ বাদুড়, মশাই, আর বাকি রইল কী? এ তো মুশকিলেই পড়া গেল দেখছি!”

মুশকিলটা হল রাত্রে।

বগলাপতি আর লালমোহন বিদায় হওয়ার পর কামাখ্যা ঘরে ঢুকে হ্যারিকেনের আলোয় যা ব্যবস্থাদি দেখতে পেল, তাতে খুশি হওয়ার কথা নয়। কেরাসিন কাঠের নড়বড়ে চৌকির উপর একটা কালো কুটকুটে কম্বল পাতা। বালিশটালিশ নেই। ঘরের দরজায় বাটাম আছে বটে কিন্তু কপাটের এমনই অবস্থা যে, বিড়ালে গা ঘষলেও দরজা ভেঙে পড়বে। অশরীরী পাহারাদারদের উপর তেমন ভরসা নেই কামাখ্যার। কপাটটা মজবুত হলেও না হয় কথা ছিল! বাটু পরিহার যে রাতবিরেতে এসে হাজির হবে না এমন কোনও কথা নেই। বাটুকে হাড়ে হাড়ে চেনে কামাখ্যা। সেবার গোসাঁইপাড়ায় নপু গোসাঁইয়ের বাড়ি মালসাভোগের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে বাটু পরিহারের চকচকে পাম্পশু মাড়িয়ে ফেলেছিল সে। তা নেমন্তন্ন বাড়িতে ওরকম তো হয়েই থাকে। জুতোজোড়া যে বাটুর তা তো আর সে জানত না। আর এও জানা ছিল না যে, বাটুর জুতোজোড়ার উপর নজর রাখার জন্য একজন পাহারাদার মোতায়েন আছে।

“বাটুবাবুর জুতোয় পা দিস, কে রে তুই? ঘাড়ে ক’টা মাথা?” বলে মুশকো চেহারার পাহারাদারটা তেড়ে এল। চারদিকে ভয়ে আতঙ্কে তুমুল চেঁচামেচি আর ছোটাছুটি পড়ে গেল। সবাই জানে, বাটুর কাছে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনও দণ্ড নেই। আর মৃত্যুদণ্ডটাও খুবই সরল ও সংক্ষেপ। ঘাড় থেকে মাথাটা নামিয়ে দেওয়া। কামাখ্যার সেদিনই হয়ে গিয়েছিল। তবে বরাতজোরে অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে যায়। নন্দবাবুই এসে বাটুকে ধরে বললেন, “ও বাবা বাটু, আজ পুজোকাটালি দিন, গোসাইবাড়িতে রক্তপাতটা কোরো না বাবা?”

তা বাটুরও সেদিন মেজাজটা ভাল ছিল। তাই মোটে দশবার সকলের সামনে কান ধরে ওঠবোস করিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল বাটু। বরাতজোরে ঘাড়টা সেদিন বেঁচে যায় বটে, তবে ঘটনাটা মনে পড়লে ঘাড় আজও সুড়সুড় করে।

কুটকুটে কম্বলের বিছানায় শুয়ে কি ঘুম আসতে চায়! অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে বোধ হয় একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। কিন্তু নিশ্চিন্তে ঘুমোবে তার উপায় কী? একে তো পেটে দানাপানি নেই, ভয়ের তাড়ায় খাওয়ার কথাই ভুলে মেরে দিয়েছে। তার উপর ঘুমোলেই নানারকম ভয়ের স্বপ্ন এসে হাজির হয়। আর কামাখ্যা চমকে জেগে ওঠে। তার উপর ইঁদুর দৌড়োয়, বিড়াল ডাকে। একপাল শিয়াল এসে উঠোনে বসে তারস্বরে হুক্কাহুয়া করে গেল। আর সত্যিই বাতাসে নানারকম ফিসফাস শব্দ শুনতে লাগল সে। ছোট-বাইরে সারতে দরজা খুলে ঘরের পিছন দিকটায় একটু গিয়েছিল সে। মাঝরাতে খুব ফিনকি দিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে। ফিরে আসবার সময় হঠাৎ দেখতে পেল দুটো পেল্লায় চেহারার লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে। বুকটা এমন ধক করে উঠেছিল যে, আর-একটু হলেই কেঁপে-ঝেপে মূৰ্ছা যেত। তাড়াতাড়ি আড়ালে সরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল, একজনের হাতে টর্চ, অন্যজনের হাতে একটা পিস্তলের মতো কিছু রয়েছে। টর্চ হাতে লোকটা খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে চারদিকে আলো ফেলে কী যেন দেখল। তারপর বেরিয়ে এসে চারদিকটা ভাল করে নিরীক্ষণ করে মাথা নেড়ে বলল, “এখানে কেউ নেই।”

এরা যে বাটু পরিহারের লোক এবং তাকেই খুঁজতে এসেছে, এ বিষয়ে কামাখ্যার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না। অতি সন্তর্পণে সে পিছু হটে ঝোঁপজঙ্গলের ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।

বগলাঠাকুর যে ক্ষিতিবাবু, অপরেশবাবু, তেজেনবাবুর কথা বলেছিল, এই দু’জন কি তাদেরই কেউ নাকি রে বাবা! গানাবাজানা ভূতের কথাও হয়েছিল বটে, কিন্তু এদের মধ্যে ভূত-ভূত ভাবটাই তো নেই! আড়াল থেকে খুব নিবিষ্ট হয়ে দু’জনের গতিবিধি নজর করছিল কামাখ্যা। টর্চের আলো তার দিকেও বারকয়েক ধেয়ে এল, কিন্তু ঝোঁপের আড়ালে সেঁটে থাকায় তাকে নজরে পড়ার কথা নয়। তবু কামাখ্যা আরও একটু গুটিসুটি মেরে উবু হয়ে বসে বিড়বিড় করে বলল, “গতিক বড় সুবিধের নয়।”

খুব মিহিন গলায় পিছন থেকে একটি প্রতিধ্বনি এল, না, গতিক মোটেই সুবিধের নয়।

কামাখ্যা ব্যাপারটা প্রথমে খেয়াল না করে ফের বলল, “বাটুর লোক বলেই তো মনে হচ্ছে।”

মিহিন গলাটা ফের বলল, “হতেই পারে।”

কামাখ্যা এবার খেয়াল করল এবং তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ভয়ে। কে বলল কথাটা! অ্যাঁ! কে তার পিছনে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে! ভয়ে ঘাড়টা এমন শক্ত হয়ে গিয়েছে যে, মুখ ঘুরিয়ে তাকানোর অবধি জো নেই। কাঁপা কাঁপা কাহিল গলায় সে বলল, “কে আজ্ঞে? কে আপনি?”

কানের কাছে মুখ এনে মিহিন গলা বলল, “নামধাম বলার উপায় নেই মশাই। ছদ্মবেশে আছি কিনা! বিপজ্জনক কাজে বেরোলে ছদ্মবেশ ছাড়া চলে না। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, নকল দাড়িগোঁফগুলো বড্ড কুটকুট করে।”

কামাখ্যার এবার একটু সাহস হল। ঘাড়টাও ঘোরাতে পারছে এখন। একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখল, বেঁটেমতো রোগা গোছের একটা লোক। দাড়িগোঁফ আছে, পরনে শার্ট আর প্যান্ট, হাতে একখানা মজবুত লাঠি।

লোকটা উঠোনের দুটো ষন্ডার গতিবিধি লক্ষ করতে করতে অতি চাপা স্বরে বলল, “জ্যোৎস্না রাত আপনার কেমন লাগে মশাই?”

কামাখ্যা এখনও ঘাবড়েই আছে। হঠাৎ জ্যোৎস্নার কথা উঠছে কেন তা বুঝতে না পেরে বার দুই গলাখাঁকারি দিয়ে নিল। কোন কথার মধ্যে কোন প্যাঁচ আছে কে জানে বাবা! আমতা-আমতা করে বলল, “জ্যোৎস্না তো আর খারাপ জিনিস নয়। বেশ একটা দুধ-ভাত দুধ-ভাত ভাব আছে। লোকে তো জ্যোৎস্না রাতকে ভালই বলে।”

দুর-দুর! জ্যোৎস্না অতি নচ্ছার জিনিস। গা-ঢাকা দিয়ে কাজ করার জো আছে? অন্ধকারের অনেক সুবিধে। রাতবিরেতে যাদের কাজেকর্মে বেরোতে হয়, জ্যোৎস্নায় তাদের ভারী মুশকিল। এই যে আপনি বিষয়কর্মে বেরিয়েছেন, আপনারই কি কিছু সুবিধে হচ্ছে? গেরস্তবাড়িতে সিঁদ দেবেন, কি জানালা ফাঁক করবেন, কিংবা গ্রিল কাটবেন, বাড়ির কর্তা উঁকি মেরে দেখে চিনে ফেলল আপনাকে। কী কেলেঙ্কারি বলুন তো!”

কামাখ্যা তটস্থ হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমি চোর নই।” লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলল, “নন? কী আশ্চর্য! ননই বা কেন? চুরির অনেক সুবিধে আছে মশাই। বুদ্ধিতে শান পড়ে, শরীরটা বেশ টগবগে থাকে, চারদিকে নজর রাখার অভ্যেস হয়, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বলেও কী যেন একটা কথা আছে, সেটাও নাকি খুব বেড়ে যায়। কথাটার মানে জানেন?”

কামাখ্যা দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না।”

“আমিও জানি না। ভাল কথাই হবে। তা হলে আপনি চোর নন?”

“আজ্ঞে না। ছোটখাটো একটু ব্যাবসামতো আছে।”

“চোর হলে বড় ভাল হত মশাই। চোরেরা গাঁয়ের হালহদিশ সব জানে কিনা! তাদের কাছে অনেক গুহ্য খবর পাওয়া যায়।”

কামাখ্যা ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে বলল, “যে আজ্ঞে! চোরডাকাতও কিছু খারাপ নয়। অনেক কাজে লাগে। তা কোন গুহ্য খবর জানতে চাইছেন আজ্ঞে?”

“সেটা কি ফস করে বলে ফেলা ঠিক হবে? পাঁচকান হয়ে গেলে গুহ্য কথা কি আর গুহ্য কথা থাকে?”

“তা অবিশ্যি ঠিক। তবে গাঁ-গঞ্জ জায়গা তো, কোনও কথাই তেমন ঢাকা-চাপা থাকে না। চাউর হয়ে পড়ে।”

চাপা গলাতেই কথা হচ্ছে, তবু লোকটা গলা আরও এক পরদা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “আচ্ছা, এই অঞ্চলে কি কোনও লাশের খবর আছে?”

কামাখ্যা চাপা গলায় বলল, “তা আর নেই! তা খবরের জন্য লাশপ্রতি কত করে দিচ্ছেন?”

“আপনাদের এখানে রেট কত?”

“তা ধরুন, একশো টাকা তো হবেই।”

“দুর মশাই! আমাদের ওদিকে একশো টাকায় দশটা লাশের খবর পাওয়া যায়। দরাদরি করলে বারোটা তেরোটা অবধি।”

“আচ্ছা, না হয় পাঁচ-দশ টাকা কমই দেবেন।” বেঁটে লোকটা মাথা নেড়ে ভারী দুঃখের গলায় বলল, “না, এখানে দেখছি দর বড্ড চড়া! তার উপর লাশ যদি বাবু বিশ্বাসের না হয়, তা হলে তো টাকাটাই জলে!”

কামাখ্যা আর-একটু গলা নামিয়ে বলল, “বাবু বিশ্বাসটা কে মশাই?”

“আছে মশাই, আছে। বাবু বিশ্বাসের জন্য দুনিয়া তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, সোজা ব্যাপার নয়। বাবু বিশ্বাসের লাশের খবর জায়গামতো পৌঁছে দিলে লাখ টাকা নগদ। হাতে-হাতে।”

কথাটা শুনে কামাখ্যার মুখ রসস্থ হয়ে পড়ল। টাকাপয়সার কথায় তার ওরকমধারা হয়। হেঃ হেঃ করে বলল, “তা খবরটা কাকে পৌঁছে দিতে হবে মশাই?”

“সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন। নইলে রাতবিরেতে বিছানার আরাম ছেড়ে এই আঁদাড়পাঁদাড়ে আমিই বা ঘুরে মরছি কেন, আর ওই ষন্ডা দুটোই বা কেন ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে? পাকা খবরের জন্য আমাদের মতো আরও কতজনা মাঠে নেমে পড়েছে কে জানে!”

“ওই ষদুটো কি তবে বাটু পরিহারের লোক নয়?”

“বাটু পরিহার! সে আবার কে মশাই?”

“আজ্ঞে, বাটু পরিহারের লোকেরাই তো খুনটা করল!”

“কোন খুনটা?”

কামাখ্যা মুখে হাত চাপা দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে, ও কিছু নয়। কী বলতে কী বলে ফেলেছি!”

“ওটাই তো ভুল করেন। গুহ্য কথা বেভুলে যাকে তাকে বলে ফেলতে নেই মশাই। আর-একটু হলেই তো পেটের কথাটা বের করে ফেলতেন! যাকগে, শেষ অবধি যে সামলে নিতে পেরেছেন, সেটাই বাঁচোয়া। তবে এ কথাও বলে রাখছি, খুনটা যদি নিজের চোখে দেখে থাকেন, আর লাশটা যদি বাবু বিশ্বাসেরই হয়, তা হলে তো কেল্লা মেরেই দিয়েছেন!”

“তা তো বুঝলুম। কিন্তু আপনি তো কেবল সাঁটে বলে যাচ্ছেন। ও থেকে জট ছাড়িয়ে আসল কথাটা বের করার কি উপায় আছে? লাখ টাকা যদি হাওয়ার নাড়ু হয়েই থেকে যায় তবে আর লাভ’কী?”

লোকটা মোলায়েম গলাতেই বলল, “দেখুন মশাই, দুনিয়ার একটা চলতি নিয়ম আছে। দোকানে গিয়ে পাঁচটা টাকা ফেলুন, এক পলা তেল পাবেন, কালীর থানে গিয়ে একটা টাকা প্রণামী খয়রাত করুন, পুরুত দু’খানা বাতাসা দেবে। গোরুকে ঠিকমতো জাবনা দিন, দেখবেন হুড়হুড় করে দুধ নামবে। নিয়মটা হল, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। লাখ টাকার ঠিকানা আদায় করতে হলে খুনের গুহ্য কথাটা আগে উগরে দিন।”

কামাখ্যা আমতা-আমতা করে বলল, “পাঁচকান হলে যে আমার বড় বিপদ হবে মশাই!”

“আহা, বিপদ কি আপনার এখনই কম যাচ্ছে মশাই! ওই যে ষভাদুটোকে দেখছেন, ওরা কার লোক জানেন?”

“আজ্ঞে না। কার?”

“থাক, সে আপনার জেনে কাজ নেই। শুনে যদি এক্ষুনি আপনার দাঁতকপাটি লেগে চোখ উলটে যায়, তা হলে বিপদ আরও বাড়বে। তার চেয়ে, উদগার তুললে যেমন পেটের বায়ু বেরিয়ে গিয়ে আরাম হয়, তেমনই গুহ্য কথাটা উগরে দিন, দেখবেন ভয়টা একটু কমে যাবে।”

“আজ্ঞে, খুনটা হল আজ দুপুরে, পাশের চৈতন্যপুর গাঁয়ে, বিদ্যাধরীর ধারে। তবে যে খুন হল সে বাবু বিশ্বাস কিনা তা জানি না! বেশ ফরসাপানা বাবুগোছের চেহারা, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স, দাড়িগোঁফ আছে।”

লোকটা চাপা উত্তেজিত গলায় বলল, “শাবাশ! লাখ টাকা এখন আপনার ট্যাকে, ওই হল বাবু বিশ্বাস।”

“বলেন কী মশাই?”

“ঠিকই বলছি।”

“তা মশাই, টাকাটা কী করে পাব?”

“শ্রীরাধিকা যখন শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতেন, তখনকার কথা মনে আছে? সরু, ছুরির ধারের মতো পথ, তাতে জলকাদায় পিছল, তার উপর বিষধর সাপ কিলবিল করছে, তায় দুর্যোগ, তার উপর কাটাঝোঁপ, আরও কত কী! টাকাটা পেতে হলে এরকমই সব বিপদআপদ অগ্রাহ্য করে একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে হবে। প্রাণ হাতে করে যাওয়া।”

“কেন মশাই, প্রাণ হাতে করে যেতে হবে কেন?”

“সে আপনার জেনে কাজ নেই। হার্ট ফেল হয়ে যেতে পারে। তবে লাখ টাকার জন্য ওটুকু বিপদ যদি গায়ে না মাখেন, তা হলে আর ভাবনা কীসের?”

কামাখ্যা ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “কথাটা আদায় করে নিয়ে এখন ছোলাগাছি দেখাচ্ছেন?”

“আরে, না! কথা আর আদায় হল কোথায়? শোনা কথার উপর লাখ টাকা ফেলার মতো আহাম্মক কি কেউ আছে? লাশই যদি না পাওয়া যায় তা হলে আর ও খবরের দামই বা কী বলুন! যে টাকা দেবে সে কি খবরের সত্যাসত্য যাচাই করতে ছাড়বে? বাবু বিশ্বাসের লাশ খুঁজতেই তো আমরা ঘুরে মরছি। তা লাশটা এখন কোথায়?”

“খুনের পর যদি লাশ বিদ্যাধরীতে ভাসিয়ে দিয়ে থাকে?”

“তা হলে লাখ টাকাও যে ভেসে গেছে মশাই! বড় ভুল করে ফেলেছেন। লাশটা আঁকড়ে ধরে সেঁটে বসে থাকতে পারতেন। তা হলে লাখ টাকা লাট খেয়ে আপনার পায়ের গোড়ায় এসে পড়ত। যান, এবার গিয়ে শুয়ে পড়ুনগে, ষন্ডা দুটো চলে যাচ্ছে। আমাকে এক্ষুনি ওদের পিছু নিতে হবে।” বলেই লোকটা টপ করে উঠে গুঁড়ি মেরে উঠোনটা পার হয়ে গেল।

জঙ্গলের মধ্যে মশা আর ভঁশের কামড়ে জেরবার কামাখ্যা তিতকুটে মুখ নিয়ে উঠল। ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে জানালা দিয়ে লোকগুলোর গতিবিধি নজর করতে গিয়ে তার একগাল মাছি। উঠোনের পশ্চিমের শুড়ি পথটায় জ্যোৎস্নার আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল, ষন্ডা দুটো হেলেদুলে যাচ্ছে। পিছন থেকে বেঁটে লোকটা দৌড়ে গিয়ে তাদের সঙ্গ ধরে ফেলল। তারপর তিনজনে নিচু গলায় কথা কইতে কইতে পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ব্যাপারটা বড়ই গোলমেলে। কামাখ্যা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না বটে, কিন্তু মাথাটা বড্ড গরম হয়ে গেল। নড়বড়ে চৌকিটায় শুয়ে এ পাশ ওপাশ করতে করতে রাত প্রায় কাবার। ভোরের দিকে একটু তন্দ্ৰামতো এসে গিয়েছিল।

হঠাৎ বাইরে হাঁকডাক শোনা গেল, “বগলাঠাকুর আছে নাকি! ও বগলাঠাকুর!”

কামাখ্যা উঠে দরজাটা খুলেই বাজপড়া গাছের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

শঙ্কাহরণ একগাল হেসে বলল, “কামাখ্যাবাবু যে!”

পাশ থেকে বিপদভঞ্জন বলে উঠল, “বৃন্দাবনবাবুও হতে পারেন।”

“তা বটে!”

“কামাখ্যাবাবু কি আমাদের চিনতে পারছেন না নাকি রে শঙ্কু?”

“মানুষ চেনা কি অত সোজা রে! তবে মনে হয় চিনেও চিনতে চাইছেন না।”

দু’জনের এইসব কথাবার্তা কামাখ্যাকে স্পর্শ করা দূরে থাক, কানেও ঢুকছিল না। সে দূরাগত একটা দুন্দুভির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। নরকের বাদ্যিবাজনা কেমন হয় তা সে জানে না বটে, কিন্তু এই দুন্দুভির শব্দটা যে সেখান থেকেই আসছে, তাতে তার কোনও সন্দেহ নেই। যে বিশাল হাঁড়িতে পাপীদের সেদ্ধ করা হয়, তার আঁচও শরীরে আগাম টের পাচ্ছিল সে। এই সকালের আলোতেও সে চারদিকে আবছা-আবছা প্রেতের নৃত্য দেখতে পাচ্ছে। নদীর দিকটা ডুমুর গাছটার তলায় বিশাল চেহারার যমদূতকেও যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। বিশাল হোঁতকা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ চেহারা, গায়ে লাল জামা, মাথায় লাল পাগড়ির মতো কিছু হাতে মুগুরটুগুর আছে বলেই মনে হল। তার শমন সুতরাং এসেই গেছে। আর এটা বুঝতে পেরেই হঠাৎ কামাখ্যার সব ভয়ডর উবে গেল।

সে বেশ বুক চিতিয়ে অকম্পিত গলাতেই বলল, “এসে গেছ বাবারা! তা তোমাদের যন্ত্রপাতি সব কোথায়?”

শঙ্কা আর বিপদ অবাক হয়ে একটু মুখ তাকাতাকি করে নিল। তারপর শঙ্কাহরণ বলল, “যন্ত্রপাতি! কীসের যন্ত্রপাতি মশাই? আমরা কি মিস্তিরি নাকি?”

কামাখ্যা বলল, “আহা, মানুষ মারতে তো ছুরিছোরা, বন্দুক পিস্তল গোছের কিছু লাগে নাকি? গলা টিপেও মারা যায় বটে! কাল যেমন মারলে! আমার অবশ্য কোনওটাতেই আপত্তি নেই।”

শঙ্কা আর বিপদ নিজেদের মধ্যে আরও একবার তাকাতাকি করে নিল। তারা অবাক হয়েছে বটে, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝে গিয়ে শঙ্কাহরণ বলল, “তা আপনার পছন্দ কোনটা? ছুরিহোরা, নাকি পিস্তলবন্দুক, নাকি…?”

‘সব চলবে বাবারা, সব চলবে। তবে কিনা গুলিটুলি হলে মন্দ হত না। ব্যাপারটা চট করে হয়ে যেত। আগেই বলে রাখছি বাপু, বাবু বিশ্বাসের লাশের কিন্তু এখন লাখ টাকা দাম। সেই লাশের সন্ধানে বিস্তর লোক এসে গেছে। একটা বেঁটে লোক, দু-দুটো মুশকো জোয়ান। লাশ হাতছাড়া করলে কিন্তু পস্তাবে, এই বলে রাখলাম। এইবার চটপট কাজ সেরে ফ্যালো।”

শঙ্কাহরণ মাথা চুলকে বলল, “আহা, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? এই বাবু বিশ্বাসটা কে বলুন তো?”

“কে জানে বাপু, তবে তার লাশের দাম লাখ টাকা। কাজটা সেরে বরং তোমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবু বিশ্বাসের লাশ পাহারা দাও গে। আর বাটু পরিহারকে গিয়ে বোলো, এই যে সে এবেলা-ওবেলা মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে এটা তার ভারী অন্যায়। এখন আর আমার ভয় কীসের, তাই উচিত কথাটাই বলছি। বাটু অতি খারাপ লোক। কথাটা বেশ চোটপাট করে পরিহারের পো’কে বলে দিয়ে তো! এবার চালাও গুলি, বসিয়ে দাও ছোরা…”

‘হচ্ছে, হচ্ছে! অত হুড়ো দিচ্ছেন কেন বলুন তো! আপনি মরার আগে যে কয়েকটি কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আপনি তো গিয়ে দিব্যি নরক গুলজার করে বসে যাবেন, কিন্তু ইদিকে যে কিছু ফ্যাকড়া থেকে গেল, তার কী হবে?”

“কীসের ফ্যাকড়া?”

“বেঁটে লোকটা কে?”

কামাখ্যা ধরা গলায় বলল, “আগে বেঁটে লোকদের আমি খুব শ্রদ্ধাভক্তি করতাম হে। শুনেছিলাম, বেঁটে মানুষরা নাকি বেজায় বুদ্ধিমান হয়! কথাটা মিথ্যেও নয়। লাখ টাকার প্যাঁচে ফেলে পেটের কথা বের করে নিল, একটা পয়সাও ঠেকাল না। না বাপু, কোনও বেঁটে লোককে আমি আর চিনতে চাই না। ঢের হয়েছে। তা বাপু, আর দেরি কেন? যে কাজে এসেছ, সেটি তাড়াতাড়ি সেরে সরে পড়ো। আমি মন তৈরি করে নিয়েছি। এই চোখ বুজলাম!”

শঙ্কাহরণ মোলায়েম গলায় বলল, “আপনাকে মারলে যে বদনাম হয়ে যাবে কামাখ্যাবাবু! বাটু পরিহারের বড় উঁচু নজর। মারলে হয়তো বলবেন, একটা শুটকো লোককে মেরে নাম খারাপ করলি কুলাঙ্গার! ছুঁচো মেরে যখন হাত গন্ধই করেছিস তখন বিদেয় হয়ে যা।”

কামাখ্যা চটে উঠে বলল, “এঃ, বাটু পরিহার কোথাকার খাঞ্জা খাঁ হে, যে আমাকে মারলে তার ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ হবে? খুব তো বোয়াব দেখছি তার! দু-চারটে লাশ নামিয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? তাকে বলে দিয়ো যে, কামাখ্যাচরণ তাকে মোটেই রেয়াত করে না। ঢের-ঢের বাটু পরিহার আমার দেখা আছে!”

“আজ্ঞে। তা সেই কথাটাই গিয়ে তা হলে বাটু পরিহারমশাইয়ের শ্রীচরণে নিবেদন করি। আজ্ঞা করুন, বিদেয় হই।”

কামাখ্যা বলল, “তা হলে তোমরা চললে!”

“যে আজ্ঞে।”

মওকাটা ফসকালে হে! এমন মওকা আর পাবে না। সাক্ষীসাবুদ নেই, বাধাবিপত্তি নেই, নিরিবিলিতে দিব্যি আমার লাশটা নামিয়ে যেতে পারতে। তা কী আর করা!