সকালের আলো ফুটতেই দু’জনে বেরিয়ে পড়ল, সোজা বেশ খানিকটা গিয়ে ডানধারে একটা কাঁচা রাস্তা। লোকবসতি বিশেষ নেই। বড় বড় গাছের ছায়ায় রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে আছে। প্রথমদিকে দু-চারখানা কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছিল বটে, কিন্তু আরও এগোতেই লোকবসতি শেষ হয়ে আগাছার জঙ্গল শুরু হয়ে গেল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর বাঁ ধারে ছাড়া-ছাড়া জঙ্গলের মধ্যে একখানা ছোট পাকা ঘর দেখতে পাওয়া গেল। দেওয়াল নোনা ধরেছে, দেওয়ালের ফাটলে অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে। দিনের বেলাতেও ঝিঁঝি ডাকছে। ভারী থমথমে জায়গা।
দু’জনে একটু থমকাল। এভাবে পরের বাড়িতে ঢোকার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। ফটিক ভয়ে ভয়ে বলল, “ঢোকাটা কি ঠিক হবে রে নিতাই? ভাল করে ভেবে দ্যাখ।”
নিতাই বলল, “আর উপায়ই বা কী বল। কপালে যা আছে হবে। আয় তো দেখি।”
ফটিক বলল, “জায়গাটার কেমন ভূত-ভূত চেহারা।” বাধোবাধো পায়ে দু’জনে হাঁটুভর চোরকাঁটার জঙ্গল পেরিয়ে গড়াইবুড়ির ঘরের দরজা খুলে ঢুকতে যাবে এমন সময়ে পেছনে হঠাৎ কে যেন ফিচ করে একটু হাসল। দু’জনে পেছন ফিরে দেখল একজন সুড়ঙ্গে রোগা বুড়োমতো লোক ফোকলা মুখে খুব হাসছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। চোখে চোখ পড়তেই বলে উঠল, “কী মতলব হে, কী মতলব? দেবেখন গড়াইবুড়ি পিণ্ডি চটকে। বলি গোবিন্দ সাউয়ের মতো ডাকসাইটে লোকই আজ অবধি দখল নিতে পারল না, আর তোমরা কোথাকার কে এসে ঢুকে পড়ছ যে বড়? এই আমি চললুম গোবিন্দ সাউকে খবর দিতে।”
বলে লোকটা হনহন করে হেঁটে ডানধারে কোথায় চলে গেল।
ফ্যাকাসে মুখে ফটিক বলল, “এই রে! কাকে যেন খবর দিতে গেল? এবার কী হবে রে নিতাই?”
নিতাইও একটু ঘাবড়ে গেছে। তবু সাহস করে বলল, “কী আর হবে! যদি বের করে দেয় তো দেবে। আমরা বলব নিরাশ্রয় হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম।”
“তোর বড় সাহস।” নিতাই দরজার দড়ি খুলে ভেতরে ঢুকল। পেছনে ফটিক।
ঘরদোরের অবস্থা যতটা খারাপ হবে বলে তারা ভেবেছিল, দেখা গেল ততটা নয়। মেঝেয় ধুলো জমে আছে ঠিকই, একটু ঝুলও পড়েছে চারধারে, তবে বসবাসের অযোগ্য নয়। ঘরে দু’খানা খাঁটিয়া আছে, গেরস্থালির জিনিসপত্রও কিছু পড়ে আছে। ভেতরদিকে উঠোনে পাতকুয়ো, দড়ি বালতি সবই পাওয়া গেল।
ফটিক বারবার বলতে লাগল, “কাজটা ঠিক হচ্ছে না রে নিতাই।”
নিতাই ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোর মতো কিন্তু আমার ভয় করছে। গনা ডাইনি যদি আমাকে ঘোড়া বানিয়ে ফেলত বা অষ্টভুজার মন্দিরে যদি সত্যিই বলি হয়ে যেতুম তার চেয়ে খারাপ আর কী হবে বল। আয় আগে চানটান করে একটু তাজা হই, তারপর যা হওয়ার হবে।”
দু’জনে সবে স্নান সেরে এসে জামাকাপড় পরেছে, এমন সময় বাইরে একটা চেঁচামেচি শোনা গেল। দু’জনে কানখাড়া করে শুনল কে যেন হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে বলছে, “কে রে, কার এত সাহস যে, এবাড়িতে বলা নেই, কওয়া নেই ঢুকে বসে আছে? কার এত বুকের পাটা? আঁ!”
দরজায় দমাদম শব্দ শুনে ফটিক ফের ফ্যাকাসে হয়ে বলল, “ওই যে! এসে গেছে।”
নিতাই গিয়ে দরজার খিলটা খুলে দেখল, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গায়ে নামাবলী জড়ানো একটা ষণ্ডামতো লোক দাঁড়িয়ে। তার দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বলল, “কে তুই? কার হুকুমে এ বাড়িতে ঢুকেছিস? জানিস এ বাড়ি এখন কার দখলে?”
নিতাই বিগলিত একটু হেসে বলল, “এবাড়ি কি আপনার?”
“আমার নয় তো কার? গড়াইবুড়িকে কড়কড়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে এবাড়ি কবে কিনেছি আমি। দলিল আমার সিন্দুকে। তোরা
কোন সাহসে এ-বাড়িতে ঢুকেছিস?”
বলে লোকটা লাফ দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল, তারপর পিছু ফিরে হাঁক মারল, “ওরে ও বিশু, লাঠিটা নিয়ে আয় তো দেখি–”
বেঁটেখাটো চেহারার একটা লোক মস্ত একটা লাঠি বাগিয়ে এগিয়ে এল।
ফটিক তাড়াতাড়ি বলল, “আহা, লাঠিসোঁটার দরকার কী মশাই? আমরা না হয় এমনিতেই যাচ্ছি।”
গোবিন্দ সাউ মুখ ভেঙিয়ে বলল, “এমনিতেই যাচ্ছি মানে? যাবে তো বটেই, তোমার ঘাড়ে যাবে। আগে বলো কার হুকুমে ঢুকেছ? এত সাহস হয় কোথা থেকে? আঁ!”
এইসব চেঁচামেচির মাঝখানে হঠাৎ খাঁটিয়ার তলা থেকে একটা
পেতলের ঘটি হঠাৎ লাফ মেরে শূন্যে উঠল, তারপর উড়ে গিয়ে ঠঙাত করে গোবিন্দ সাউয়ের কপালে লাগল।
“বাপ রে!” বলে গোবিন্দ সাউ কপাল চেপে বসে পড়ল মেঝেতে। তারপর চেঁচাতে লাগল, “মেরে ফেলেছে রে! খুন করে ফেললে রে!”
নিতাই আর ফটিক হতভম্ব হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তারা কেউ ঘটিটা ছুঁড়ে মারেনি! তা হলে কাণ্ডটা হল কী করে?
বাইরে থেকে বিশু বলল, “পালান বাবু, গড়াইবুড়ি ফের খেপেছে।”
গোবিন্দ সাউ কোনওক্রমে দরজার বাইরে গিয়ে ফের গলা সপ্তমে চড়িয়ে চেঁচাতে লাগল, “তোর এত সাহস গড়াইবুড়ি? মরেও তেজ যায়নি তোর?”
বিশু গোবিন্দর হাত ধরে টেনে বলল, “চলে আসুন বাবু, ভূতপ্রেতের সঙ্গে কি লড়াই করে পারবেন? বেঘোরে প্রাণটা যাবে।”
গোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠে বলল, “নিকুচি করেছে প্রাণের। প্রাণ যায় তো যাক। এই শুনে রাখ গড়াইবুড়ি, তোকে এই ভিটে থেকে উচ্ছেদ যদি না করি তো আমার নাম গোবিন্দ সাউ নয়। আমি এবাড়িতে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করাব, তারপর কীর্তনের দল এনে অষ্টপ্রহর এমন কীর্তন করাব যে, তুই পালানোর পথ পাবি না”।
কথার মাঝখানেই হঠাৎ উঠোনের নারকেল গাছ থেকে একটা ঝুনো নারকেল বোঁটা ছিঁড়ে সাঁ করে ছুটে এসে গোবিন্দ সাউয়ের মাথায় পটাত করে লাগল। গোবিন্দ চিতপাত হয়ে পড়ে চেঁচাতে লাগল, “গেছি রে! ওরে, আমি যে চোখে অন্ধকার দেখছি–”
নারকেল দেখে বিশু দুই লাফে রাস্তায় পড়ে ছুটে উধাও হয়ে গেল।
নিতাই আর ফটিক কিছুক্ষণ বিস্ময়ে হাঁ করে কাণ্ডটা দেখল। তারপর ফটিক বলল, “এসব কী হচ্ছে রে নিতাই! ভূতুড়ে কাণ্ড যে!”
নিতাই বলল, “তাই দেখছি।”
কিছুক্ষণ মূছার মতো পড়ে থেকে গোবিন্দ হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে বসল। তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে চেয়ে বলল, “তোমাদের কিছু করেনি গড়াইবুড়ি?”
নিতাই বলল, “না তো!”
বাঁ হাতে কপাল আর ডান হাতে মাথা চেপে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাস্তায় উঠে গোবিন্দ তাদের দিকে চেয়ে বলল, “আর এক ঘণ্টার মধ্যে যদি এ বাড়ি ছেড়ে চলে না যাও তা হলে কিন্তু আমি থানা থেকে পেয়াদা আনিয়ে–”।
কথাটা ভাল করে শেষ হয়নি, কোথা থেকে একটা ডাঁশা পেয়ারা ছুটে এসে গোবিন্দর ডান গালে খচাত করে লাগল।
“বাপ রে!” বলে গোবিন্দ ঘোড়ার বেগে দৌড়ে পালাল।
নিতাই ফটিকের দিকে চেয়ে বলল, “কিছু বুঝলি ফটিক?”
“হুঁ। গড়াইবুড়ি গোবিন্দ সাউকে পছন্দ করে না।”
“কিন্তু আমাদের করে।”
ফটিক চোখ বড় বড় করে বলল, “তা বলে কি ভূতের বাড়িতে থাকা ভাল?”
“ভূত যদি ভাল হয় তবে অসুবিধে কী?”
ঠিক এই সময়ে সেই সুডুঙ্গে লোকটা ফিরে এসে রাস্তা থেকে হাঁ করে তাদের দিকে চেয়ে বলল, “এ কী! তোমাদের ঘাড় এখনও মটকায়নি!”
নিতাই বলল, “আজ্ঞে না।”
“বলো কী হে! এই যে দেখলুম গোবিন্দ সাউ ছুটে পালাচ্ছে!”
তার মাথায় আলু, গালে ঢিবি, কপাল থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, আর তোমাদের গায়ে যে বড় আঁচড়টিও পড়েনি! না না, এ গড়াইবুড়ির ভারী অন্যায়। এটা ভারী একচোখোমি। আজ অবধি কেউ এ বাড়িতে ঢুকতে পারেনি, তা জানো? চোরাচড় অবধি নয়। গড়াইবুড়ির তাড়া খেয়ে সবাইকেই সটকাতে হয়েছে। তা হলে তোমাদের বেলায় অন্যরকম নিয়ম হবে কেন? এটা একটা বিচার হল? এতে কি গড়াইবুড়ির ভাল হবে?”
ঠিক এই সময়ে ভেতরের উঠোন থেকে একটা চেলাকাঠ উড়ে এসে ধাঁই করে লোকটার পায়ের গোছে লাগতেই নোকটা “রাম রাম রাম রাম” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে জিরাফের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে উধাও হয়ে গেল।
নিতাই দরজাটা বন্ধ করে খিল তুলে দিল। তারপর চোখ বুজে হাতজোড় করে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “পেন্নাম হই গড়াইঠাকুমা। এ পর্যন্ত তো আমাদের দিকটা ভালই দেখলে, বাকি কয়েকটা দিনও একটু দেখো। আতান্তরে পড়ে তোমার ঘরে ঢুকে পড়েছি ঠাকুমা, কিছু মনে কোরো না।”
নিতাইয়ের দেখাদেখি ফটিকও একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে গড়াইবুড়িকে পেন্নাম করে বলল, “আমি একটু ভিতু মানুষ গড়াইঠাকুমা। ফস করে আবার রাতবিরেতে দেখাটেখা দিয়ে বোসো না। তাতে পিলে চমকে হার্টফেল হয়ে যেতে পারে। এ যা খেল দেখালে তাতে কালী-দুর্গা কোথায় লাগে। শ্রীচরণে পড়ে রইলুম ঠাকুমা, একটু খেয়াল রেখো।”
তারা গাঁয়ের ছেলে, খিদে একটু বেশিই। তার ওপর দোগেছের জলবায়ুর গুণ আর কালকের ধকলে দু’জনেরই খিদে চাগাড় দেওয়ায় মুখোমুখি দুটো খাঁটিয়ায় বসে তারা নিজেদের পয়সাকড়ি গুনেগেঁথে দেখল। মোট ত্রিশ টাকা আছে। এ থেকে ফেরার ট্রেনভাড়া রেখে যা থাকবে তা কহতব্য নয়।
নিতাই বলল, “দ্যাখ যদি কচুরি-জিলিপি বা মণ্ডা-মিঠাই জলখাবার খাই তা হলে এ টাকা ফুস করে ফুরিয়ে যাবে। আর যদি চিড়েগুড় খাই তা হলে কষ্টেসৃষ্টে কয়েকদিন চলতে পারে।”
ফটিক গম্ভীর মুখে বলল, “হুঁ।”
এ সময়ে হঠাৎ ঘরের পাটাতনের ওপর থেকে দুম করে একটা বড়সড় মাটির ঘট মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল। আর রাশিরাশি খুচরো টাকাপয়সা ঝনঝন করে মেঝেময় ছড়িয়ে পড়ল।
ফটিক চমকে উঠে বলল, “এ কী রে বাবা?”
নিতাই অবাক হয়ে মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফের চোখ বুজে হাতজোড় করে বিড়বিড় করে বলল, “গড়াইঠাকুমা, এ যে বড় বাড়াবাড়ি করে ফেললে! আর জন্মে কি আমরা তোমার সত্যিকারের নাতি ছিলুম?”
ফটিক বলল, “পরের পয়সা নেওয়া কি ঠিক হবে রে নিতাই?”
“পর! পর কোথায়? ঠাকুমা বলে ডেকেছি না! গড়াইঠাকুমার টাকা তো আর স্বর্গে যাবে না। নিজের গরজে দিচ্ছেন, না নিলে কুপিত হবেন যে!”
“ও বাবা! তা হলে আয় কুড়োই।”
গুনেগেঁথে দেখা গেল, মোট তিনশো বাইশ টাকা। নিতাই বলল, “ওঃ, গড়াইঠাকুমার দেখছি দরাজ হাত।”
ফটিক ভয়ে ভয়ে বলল, “বড্ড দরাজ, এতটা কি ভাল? বিশ পঁচিশ টাকা হলেও না হয় কথা ছিল। তা বলে এত?”