০৫. শিয়রে শমন
-মা তোমারে এক সায়েব ডাকতিছে।
–সায়েব! সে কী রে!
-হ্যাঁ গো, মা। যাও না দেখে এস। কী সব কইছে, আমি বুঝতে নারি।
মালতির মায়ের মুখে হঠাৎ এক সাহেবের আগমন-সংবাদ শুনে শ্রীময়ী অবাক হয়ে গেলেন।
এখানে মালতির মা নামক আধবয়সী দাসীটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। মালতির মা ঠিকা কাজ করে বিভিন্ন গৃহস্থের বাড়িতে। শ্রীময়ীর বাড়িতেও কাজ করে সে। সকাল-সন্ধ্যা এসে শ্রীময়ীর সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম করে দেয়, দুপুরে বা রাত্রে থাকে না। মালতি নামে কন্যাটির কথা আরও অনেকের মতো শ্রীময়ীও শুনেছেন, কিন্তু স্বচক্ষে তাকে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। শুধু তিনি নন, কোনোদিন কেউ মালতির মায়ের মেয়েটিকে চাক্ষুষ করেছে বলে শোনা যায় না। মেয়েটি নাকি তার মাসির বাড়িতে থাকে। তবে মেয়েটিকে না দেখলেও কন্যার নামেই বিখ্যাত হয়ে গেছে মালতির মা। অনেকের ধারণা মালতি নামে কোনো মেয়ের অস্তিত্ব নেই— মেয়ের অসুখের নাম করে সময়-অসময়ে টাকা চাওয়ার জন্য আর কাজ কামাই করার ছুতো হিসাবেই ওই মেয়েটিকে সৃষ্টি করেছে মালতির মা। শ্রীময়ীর সঙ্গে সেদিন সন্ধ্যার পর সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে মালতির মা ভাবছিল মেয়ের অসুখের নাম করে এ সময়ে দশটা টাকা চাইবে। মেয়ের অসুখের কথা শুনেও দশটা টাকা দেবেন না এমন কঠিন-হৃদয় মহিলা নন শ্রীময়ী, কিন্তু সম্প্রতি তিনি মালতির অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উ লে মনে হয় পর পর কামাই করার জন্য বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন বহুদিন– অতএব টাকাটা পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে মালতির মায়ের সন্দেহ ছিল যথেষ্ট। তবু কথা বলতে বলতে মনিবের মন বুঝে দশটা টাকার কথা পাড়বে বলে স্থির করেছিল মালতির মা, হঠাৎ দরজার কড়া সশব্দে নড়ে উঠতেই সে দরজা খুলতে ছুটল। ফিরে এসে সে যা বলল, তা আগেই বলা হয়েছে, পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।
শ্রীময়ী এবার নিজেই অগ্রসর হলেন। শার্টপ্যান্ট আজকাল সবাই পরে, তাদের সায়েব বলে ঘোষণা করে না মালতির মা। বলে, একজন বাবু ডাকতিছে। নয়তো বলে, প্যাণ্টেলুন পরা বাবু বা ছেলে। হঠাৎ তার মুখে সায়েব শুনে একটু অবাকই হয়েছিলেন শ্রীময়ী।
অপরিচিত আগন্তুককে ভিতরে বসতে বলেনি মালতির মা, সে বাইরে অপেক্ষা করছিল।
দরজা খুলে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে লোকটিকে দেখলেন শ্রীময়ী। লম্বা চেহারা, পরনে নিখুঁত ইউরোপীয় পরিচ্ছদ, টুপির তলায় মুখের উপরিভাগ ছায়ার অন্ধকারে প্রায় অদৃশ্য শুধু ধারালো নাক আর সরু গোঁফের নিচে একটা ক্ষীণ হাসির আভাস চোখে পড়ে।
শ্রীময়ী কোনো প্রশ্ন করার আগেই নত হয়ে অভিবাদন জানাল আগন্তুক, আমি নিশ্চয়ই মিসেস চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছি?
লোকটির গায়ের রং আর চেহারা দেখে তাকে বাঙালি বলে মনে হয় না, কিন্তু তার বাংলা উচ্চারণে বিন্দুমাত্র জড়তা নেই।
বিস্ময় চাপা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, হ্যাঁ, আমি মিসেস চৌধুরী। আমার কাছে আপনার কী দরকার? আপনাকে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
আগন্তুকের ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা বিস্তৃত হল, না, আমরা কেউ কাউকে আগে দেখিনি।
একটু ইতস্তত করে শ্রীময়ী বললেন, আপনি ভিতরে আসুন।
প্রয়োজন নেই, আগন্তুক বলল, আমার বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত। কথাটা বলেই চলে যাব।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন শ্রীময়ী।
একটা অনুরোধ করছি, আগন্তুক একটু থামল, বোধহয় বক্তব্য বিষয় মনে মনে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, আপনি কাজল চৌধুরীর সঙ্গে কোনোদিন দেখা করার চেষ্টা করবেন না সে এখানে এলেও তাকে এড়িয়ে যাবেন। তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে আপনার ক্ষতি হতে পারে।
শ্রীময়ী চমকে উঠলেন। তাঁর কান এবং মাথার ভিতর দিয়ে রক্ত চলাচল করতে লাগল দ্রুতবেগে। অপরিসীম বিস্ময় ও ক্রোধ সংবরণ করতে একটু সময় নিলেন তিনি, তারপর অনুচ্চ কঠিন স্বরে বললেন, আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আপনি কথা বলছেন কেন? দেখুন, মিঃ–
জোসেফ। আপনি আমায় জোসেফ নামেই সম্বোধন করতে পারেন।
–মিঃ জোসেফ, আপনার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মহিলার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আপনি কথা বলছেন কোন অধিকারে? আমি কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব, আর কার সঙ্গে রাখব না, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
–আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার যদি আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত করে, তখন বাধ্য হয়েই আমাকে আপনার ব্যাপারেও নাক গলাতে হবে। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি- কাজল চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না।
কারণটা কী? একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল জোসেফের পিছন থেকে, কাজল চৌধুরী মানুষটা কী খুব খারাপ? খুনে-গুণ্ডা বা ডাকাত গোছের কিছু?
সচমকে পিছন ফিরেই দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল আগন্তুক, বিনীত হাস্যে অভিবাদন জানিয়ে নবাগতাকে বলল, আসুন, সীমা দেবী। ভালোই হল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিস্মিত কণ্ঠে সীমা বলল, আপনি দেখছি আমায় চেনেন। আমি কিন্তু আপনাকে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
–ঠিকই বলেছেন সীমা দেবী। আমাকে আপনি কখনো দেখেননি।
—আপনি আমায় চিনলেন কেমন করে? কে আপনি? মায়ের মতো আপনিও অঞ্জনকেই কাজল বলছিলেন বোধহয়। উপরন্তু তার ঘোষ পদবিটাও বদলে চৌধুরী বানিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা কি বলুন তো।
ব্যাপারটা বেশ জটিল, মেয়ের কথার উত্তর দিলেন শ্রীময়ী, উনি মানে মিঃ জোসেফ আমাদের শুভার্থী, আমাদের মঙ্গলের জন্যই উনি কাজলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করছেন।
স্পর্ধারও একটা সীমা থাকা উচিত, সীমার মুখচোখ লাল হয়ে উঠল, মিঃ জোসেফ আপনার অযাচিত উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমাদের পক্ষে আপনার মূল্যবান উপদেশ শিরোধার্য করা সম্ভব নয়।
বলার সঙ্গেসঙ্গে মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে চেয়েছিল সীমা। পারল না। জোসেফের একটা হাত দরজা চেপে ধরেছে, আমি চলে যাচ্ছি। আমার কথাটা শুনলে ভালো করতেন। কাজল চৌধুরী মানুষটা ভালো কি মন্দ সেটা প্রশ্ন নয়। তার সাহচর্য আপনাদের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, এই কথাটা মনে রাখবেন।
দরজা ছেড়ে রাস্তায় নামল জোসেফ, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করল…
দরজা বন্ধ করে উত্তেজিত স্বরে সীমা বলল, মা, এই লোকটা কে বলো তো?
জানি না, শ্রীময়ী চিন্তিতভাবে বললেন, লোকটা যে ভালো নয়, তা তো বুঝতে পারছি। নাম শুনে মনে হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তাও পুরো নামটা বলল না। কাজলের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক জানি না। তবে আমাদের সঙ্গে কাজল মেলামেশা করে, এটা ওর পছন্দ নয়। আমাদের তো একরকম শাসিয়েই গেল।
তাই তো দেখছি, সীমার মুখেও চিন্তার ছায়া, পাড়ার ছেলেরা আমায় চেনে। কারও সঙ্গে আমাদের অসদ্ভাব নেই। চট করে এই বাড়িতে কেউ হামলা করতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু কাজলের অর্থাৎ অঞ্জনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকলে এই লোকটার কী ক্ষতি? সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন অদ্ভুত আর জটিল মনে হচ্ছে।
একটু থেমে সীমা আবার বলল, এই জোসেফ লোকটিও অঞ্জনকে কাজল বলে উল্লেখ করছিল। তুমিও ওকে কাজল নামে ডাকছ। কারণ হিসাবে বলেছিলে অঞ্জন মানেই কাজল–অর্থাৎ এটা ঠাট্টা। তা ওই লোকটাও কি তোমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ঠাট্টা করছিল?
শ্রীময়ী মেয়ের কথার জবাব দিলেন না; নিরুত্তরে বাইরের ঘর ছেড়ে ভিতরের দিকে চলে গেলেন…
মালতির মা দরকারি কথাটা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না। সাহেব আর মায়ের সাক্ষাৎকারের ফল যে খুব সন্তোষজনক হয়নি, সেটা সে বুঝেছিল। দিদিমিণির আবির্ভাব এবং দুপক্ষের কথোপকথন শুনে ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও পরিবেশের উত্তপ্ত আবহাওয়া সে অনুভব করতে পেরেছিল। শ্রীময়ীকে ভিতরের ঘরে এসে বসতে দেখে সে এগিয়ে এল। কিন্তু কপাল ঠুকে টাকার কথাটা বলার আগেই ঘরে ঢুকল সীমা। ওই লোকটা অঞ্জন ঘোষকে শুধু কাজল বলে উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়নি, পদবিটাও বদলে দিয়ে বলছিল কাজল চৌধুরী। এটা কেমন ব্যাপার হল মা? তুমিও তো প্রতিবাদ করলে না?
তুই আসার আগেই লোকটাকে অনধিকার চর্চা করতে বারণ করেছিলাম,শ্রীময়ীর কণ্ঠস্বর শান্ত, পদবি-টবি বা নাম নিয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।
মালতির মা প্রমাদ গুনল। সে বুঝতে পেরেছিল এখন টাকার কথা বলে লাভ হবে না। এমন সময়ে আবার কড়া নড়ে উঠতেই সে ছুটে গেল সেইদিকে। একটু পরে ফিরে এসে বলল, মা, তোমায় একটি ছেলে ডাকতিছে।
শ্রীময়ী আর সীমা পরস্পরের মুখের দিকে চাইলেন। সীমা বলে উঠল, আজ দেখছি ঘনঘন অতিথির আবির্ভাব ঘটছে।
শ্রীময়ী হেসে বললেন, আগের বারে সায়েব এসেছিল। এবার বাবু নয়, লোক নয় ছেলে! দেখে আসি ছেলেটা কেমন।
ছেলেটা খুব খারাপ, বলতে বলতে যে ব্যক্তি ঘরের মধ্যে পা বাড়াল, তাকে দেখে চমকে উঠল মা আর মেয়ে।
আপনি! অস্ফুট উক্তি বেরিয়ে এল সীমার গলা থেকে।
হ্যাঁ, আমি, অঞ্জন হাসল, তোমরা বেশ চমকে গেছ দেখছি।
চমকাবে না?শ্রীময়ী হাসলেন, বলা নেই, কওয়া নেই, বাইরের উটকো লোক অন্দরমহলে ঢুকে গেল। মেয়ে বোধ হয় খেপে গেছে।
ভ্রূ কুঁচকে মায়ের দিকে তাকাল সীমা। নাবলে অন্দরমহলে অঞ্জনের পদক্ষেপ সে পছন্দ করেনি, কিন্তু মুখের উপর সেকথা শুনিয়ে দেওয়া তো দস্তুরমত অপমানকর! এইভাবে অন্দরমহলে আসা যে অন্যায়, সে কথা অন্যভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার ভদ্র উপায়টাও কি শ্রীময়ীর মতো শিক্ষিত মহিলাকে বলে দিতে হবে?… সীমা অবাক হয়ে দেখল মায়ের মুখে একটা হাসির রেখা উঁকি দিচ্ছে। অঞ্জনের মুখের দিকে তাকাল সে– নাঃ, সেখানেও তো অপমানিত মানুষের ক্রোধ বা বিরক্তির আভাস দেখা যাচ্ছে না! বরং তার ওষ্ঠাধরের উপর খেলা করছে একটা তরল হাসির রেখা!
সীমাটা বেশ চটে গেছে, বুঝতে পারছি, হেসে হেসেই বলল অঞ্জন, ওকে দোষ দেওয়া যায় না। বাইরের উটকো লোক না বলে কয়ে অন্দরমহলে এলে একজন ভদ্রমহিলার নিশ্চয়ই রাগ করার অধিকার আছে।
আছেই তো, শ্রীময়ী সহাস্যে বললেন, তারপর ভদ্রমহিলাটি আবার দস্তুরমতো বিদষী। নিজে উপার্জন করেন, আবার মাকেও ভরণ-পোষণ করছেন।
-মা!
মেয়ের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ আর জ্বলন্ত দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শ্রীময়ী আবার বললেন, সে-মহিলাটি সংসারের যাবতীয় দুর্বহ ভার স্কন্ধে বহন করছেন এবং যিনি দস্তুরমতো বিদুষী বলে পরিগণিত, তার শয়নকক্ষে অনুমতি না নিয়ে প্রবেশ করা গর্হিত অপরাধ। অপরাধী শুধু এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, উক্ত মহিলাকে তুমি বলে সম্বোধন করার জন্য অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। এখন বলো কাজল, এই অপমানের প্রতিকার করা কি উচিত নয়?
অবশ্যই উচিত, অঞ্জন এখন দস্তুরমতো গম্ভীর, প্রতিশোধ হিসাবে সীমার উচিত আমাকে তুমি বলা। তাই নয় মা?
নিশ্চয়ই, সীমার দিকে তাকালেন না শ্রীময়ী, তবে অঞ্জন না বলে দাদা বলে সম্বোধন করলেই মেয়েকে আমি তুমি বলার অধিকার দিতে পারি।
–সেকি! সীমা কি আমার নাম ধরে উল্লেখ করে নাকি? সামনে তো অঞ্জনবাবু বলে।
আড়ালে সোজাসুজি অঞ্জন বলে। আমি অবশ্য নিষেধ করেছি। এসব অসভ্যতা আমার সহ্য হয় না। কী আর বলব কাজল- আজকালকার মেয়েগুলো যেমন অসভ্য, তেমনি উদ্ধত।
ঠিক কথা, অঞ্জন তৎক্ষণাৎ শ্রীময়ীর সঙ্গে একমত, তবে হাল ছাড়লে চলবে না। অন্তত এই মেয়েটাকে মানুষ করতে হবে।
আমি তো পারলাম না, শ্রীময়ী হাসলেন, এখন দ্যাখ তুই যদি পারিস।
তুই! সীমার ললাটে কয়েকটা রেখা পড়ল- না মা বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছে। এতটা গায়ে-পড়া ভাব ভালো লাগল না সীমার।
তার ভালো না লাগলে কী হবে, অপর দুজন পরমানন্দে আলাপ চালাতে লাগল, আমিও কি পারব? তবে চেষ্টা করতে হবে। একটাই যখন মেয়ে তোমার।
–আর তোর কেউ নয়?
–হুঁ। আমার সঙ্গেও একটা সম্পর্ক আছে বৈকি। কিন্তু তোমার বিদুষী কন্যা তো আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় বলে মনে হচ্ছে না।
ওর ইচ্ছায় কিছু আসে যায় না। যা-খুশি-তাই আর করতে দেওয়া হবে না ওকে।
–আপাতত চাকরিটা ওকে ছাড়তে হবে। নিজে উপার্জন করলেই মেয়েরা অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা হয়ে পড়ে। তুমি কি বলো মা?
–আমি আবার কী বলব? তুই যদি ভালো মনে করিস, ও চাকরি ছাড়বে।
অসহ্য! সীমা প্রায় চেঁচিয়েই বলে উঠল, চাকরি ছাড়লে আমরা খাব কী? আপনার ওই বারোশো টাকা দিয়েই সারা জীবন চলবে নাকি?
পাগল! তা কখনো চলে! অঞ্জন হাসল, যা দরকার হয়, আমিই দেব। কি বলো মা?
তুই যদি চালাতে পারিস, তাহলে ও চাকরি করবে কেন? শ্রীময়ী বললেন।
মা! এটা বড় বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? সীমা ক্রোধ গোপন করার চেষ্টা করল না, অঞ্জনবাবু আমায় গুণ্ডার খপ্পর থেকে বাঁচিয়েছেন সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। মেয়েকে বাঁচিয়েছে, মা হিসাবে তোমারও তাকে নিশ্চয়ই ভালো লাগতে পারে, কিন্তু তার টাকায় আমাদের খাওয়া-পরা চলবে একথা ভাবছ কী করে? আমাদের কি মর্যাদাবোধ বলে কিছু নেই? তোমার কাছে এমন অদ্ভুত ব্যবহার আমি আশা করিনি।
শ্রীময়ী মুখ টিপে হাসলেন, এতদিন আমার সঙ্গে রয়েছিস, আমাকে চিনলি না? আমার মর্যাদাবোধ নেই একথা তুই ভাবতে পারলি সীমা?
–সেইটাই তো অদ্ভুত লাগছে। কিছু মনে করবেন না অঞ্জনবাবু। আমি আবার—
অঞ্জনবাবু কেন? ধমকে উঠল অঞ্জন, দাদা বলতে বুঝি মুখে আটকায়?
হ্যাঁ, আটকায়, সীমা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমি দুদিনের পরিচয়ে দাদা, কাকা এসব বলতে পারি না। এমন গায়ে-পড়া ভাবও আমি পছন্দ করি না।
কথাটা বলেই থেমে গেল সীমা। তার ব্যবহার বড়ো বেশি রূঢ় হয়ে গেছে, এমনকী ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে বললেও ভুল হয় না। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে কিছু বলার জন্য অঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সীমা– কী আশ্চর্য! অঞ্জন হাসছে। লোকটার কি মান-অপমান বোধ নেই!
সত্যিই হাসছিল অঞ্জন, তোমার মেয়েটা খুব অসভ্য হয়ে গেছে মা। ওকে শক্ত হাতে শাসন করা দরকার।
শ্রীময়ীকে হাসতে দেখে আবার সীমার মাথা গরম হয়ে উঠল, মা, আমাকে নিয়ে এভাবে কথা বললে আমি সহ্য করব না। অঞ্জনবাবুকে যদি এভাবে প্রশ্রয় দাও, তাহলে জোসেফ কী অপরাধ করল?
অঞ্জনের বিস্মিত চমক লক্ষ করল না সীমা, ক্রোধ উদগিরণ করল মায়ের দিকে তাকিয়ে, জোসেফ কেন অঞ্জনবাবুর সঙ্গে তোমায় সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করেছে জানি না; কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে রাজি নই।
-সীমা!
মায়ের কঠিন স্বরে সীমার চেতনা ফিরে এল। তার পক্ষেও দারুণ অভদ্রতা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নিজেকে সংশোধন করে সে বলে উঠল, মানে, আমি কোনো সম্পর্কের বাঁধনে আসতে চাই না একথাই বলেছি। অর্থাৎ দাদা-টাদা বলতে পারব না। একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে মহিলা হিসাবে একটা ভদ্র সম্পর্ক নিশ্চয়ই
সীমার বক্তব্য শেষ হল না, অসহিষ্ণুভাবে বাধা দিল অঞ্জন, জোসেফ এখানে এসেছিল নাকি? কেন এসেছিল?
অঞ্জনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে কী ছিল বলা যায় না, সীমার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের শিহরন!
সীমার কথার উত্তরে প্রশ্ন করলেও অঞ্জনের দৃষ্টি রয়েছে শ্রীময়ীর দিকে, কেন এসেছিল জোসেফ?
শ্রীময়ী স্থিরদৃষ্টিতে তাকালে অঞ্জনের দিকে, তোমার সঙ্গে আমাদের সংস্রব রাখতে নিষেধ করেছে জোসেফ। সেইজন্যই এসেছিল সে। বলেছে–
-মা!
সকলেই চমকে উঠল। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে মালতির মা, আমি এবার যাব মা।
হ্যাঁ, অনেক রাত হয়ে গেছে, শ্রীময়ী ব্যস্ত হয়ে বললেন, চলো, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।
মা, মালতির মা এখন মরিয়া, কপাল ঠুকে বলে ফেলল, দশটা টাকার খুব দরকার ছিল। আমার মালতি
বাধা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, তোমার মেয়ে মালতির অসুখ তো? সে তত বারোমাস লেগেই আছে। আমি এখন কিছু
ঠিক আছে অসহিষ্ণু স্বরে অঞ্জন বলে উঠল, দশটা টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। এই নাও।
পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট মালতির মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল সে।
মালতির মা কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে শ্রীময়ীর দিকে তাকাতেই তাড়া দিয়ে উঠল অঞ্জন, মায়ের দিকে তাকাতে হবে না। আমি দিচ্ছি। নিয়ে যাও। চলো, দরজাটা বন্ধ করতে হবে। হাঁ করে তাকিয়ে থেকো না, অনেক কাজ আছে আমার।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দুজনেই। খিল তোলার আওয়াজ শোনা গেল। ফিরে এল অঞ্জন। সঙ্গেসঙ্গে রুষ্টকণ্ঠে বলে উঠল সীমা, আমার এসব ব্যাপার ভালো লাগছে না। দশটা টাকা আমিও দিতে পারতাম। মালতির মাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয় বলেই দিইনি। আপনি রাগ করবেন না অঞ্জনবাবু, শুধু মায়ের মত নিলেই চলবে না– এই সংসারে আমারও একটা মতামত আছে জানবেন।
জানি, ভদ্র সমাজের রীতিনীতি আমারও জানা আছে, অঞ্জনের কণ্ঠে পরিহাসের লেশমাত্র নেই, দরকারি কথার মধ্যে তোমাদের কি বাধার সৃষ্টি করছিল, তাই ওকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে
দিলাম। এতে রাগ করার কিছু নেই। তুমি না জানলেও তোমার মা জানেন আমার কাছ থেকে কিছু নিলে তোমাদের অমর্যাদা হয় না। কারণটা জানলে তোমারও আমার কাছ থেকে কিছু নিতে বাধবে না।
সীমা দৃঢ়স্বরে বলল, সেই কারণটাই তাহলে আগে জানতে চাই। নিশ্চয়ই জানবে। তবে একটা কথা সর্বাগ্রে জেনে রাখা দরকার অঞ্জনের কণ্ঠস্বর ভয়ানক গম্ভীর, তোমাদের শিয়রে শমন এসে দাঁড়িয়েছে।