৫. শস্যক্ষেত্র
রিহানের ধারণা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি সে এখন কাটাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে একটু নাস্তা করেই সে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে চলে আসে। স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা অকেজো যন্ত্রপাতি নিয়ে পুরো দিন কাটিয়ে দেয়। অচল মোটরবাইকের বেশিরভাগ সে সারিয়ে ফেলেছে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলোও সে খুলে আবার জুড়ে দিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ট্রাক এবং লরির। ইঞ্জিনগুলো নিয়ে একটা সমস্যা হলেও সে মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছে। কয়েকটা এক ধরনের অচল যন্ত্রপাতি দিয়ে সেএকটা যন্ত্রকে দাঁড়া করিয়ে ফেলতে পারে। শুধু যে। যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে অচল এবং অকেজো যন্ত্রপাতি সারিয়ে তুলেছে তা নয়– কমিউনের ট্রাক, লরি আর কন্টেইনার ঘিরে গড়ে ওঠা মানুষজনের দৈনন্দিন সংসার নিয়েও সে কাজ করতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ প্রবাহকে ঠিক রাখার জন্যে সে তারগুলো ঠিক করে টানিয়ে দিয়েছে, কীভাবে কোনটা ব্যবহার করতে হবে তার নিয়ম তৈরি করে দিয়েছে। আজকাল দুর্ঘটনা হচ্ছে অনেক কম।
শুধু যে সে একা কাজ শুরু করেছে তা নয়–তার সাথে বাচ্চাকাচ্চারাও এই ব্যাপারটিতে উৎসাহ পেতে শুরু করেছে। তাদের অনেকেই ছোটখাটো কাজ করতে শিখে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি উপকার হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মী মেয়েগুলোর। আগে অকেজো যন্ত্র সারানোর জন্যে ঈশ্বরী প্রিমাকে একটা দীর্ঘ রিপোর্ট পাঠাতে হত। ডায়াগনষ্টিক মেশিনের সেই রিপোর্টটি ঠিক করে তৈরি করা খুব কঠিন। সেই রিপোর্ট দেখে ঈশ্বরী প্রিমা সেটা সারানোর জন্যে যন্ত্রপাতির ইউনিট নম্বর লিখে দিতেন। তাদের সরবরাহ কেন্দ্রে সেই ইউনিট নম্বরের যন্ত্রপাতি থাকলে সেটি ঠিক জায়গায় লাগিয়ে সেটি ঠিক করতে হত। সঠিক ইউনিট নম্বরের যন্ত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন, যখনই রসদ সগ্রহের জন্যে তাদের বিশেষ বাহিনী বের হত। তাদেরকে প্রয়োজনীয় ইউনিট নম্বরসহ একটা তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হত। সেই তালিকার যন্ত্রপাতি কখনোই পুরোপুরি পাওয়া যেত না। তাই কখনোই যন্ত্রপাতি পুরোপুরি ঠিক হত না।
এই কমিউনে রিহান প্রথম যখন যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে শুরু করল তখন কমিউনের সবাই যে সেটাকে সহজভাবে নিয়েছিল তা নয়। অনেকেই তীব্র প্রতিবাদ করেছিল–যন্ত্রকে আর সম্মান প্রদর্শন করতে হবে না, এই ব্যাপারটিতে তাদের আপত্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। বড়দের পাশ কাটিয়ে ব্যাপারটি একেবারে শিশুদের ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছিল বলে কেউ কিছু করতে পারে নি। এখন মোটামুটিভাবে সবাই ব্যাপারটিকে মেনে নিয়েছে এবং তার চাইতে বড় কথা কমিউনের আরো নিয়মকানুন নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
কমিউনে শুধু যে যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হয়েছে তা নয়–হঠাৎ করে নূতন যন্ত্রপাতি তৈরি হতে শুরু করেছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় যন্ত্রগুলো অবশ্যই খেলনা–ঘোট ঘোট বাচ্চাদের খেলার জন্যে স্টিয়ারিং হইল লাগানো গাড়ি! সেই গাড়ি থেকে উল্টে পড়ে দুই চারজন বাচ্চার যে হাত পায়ের ছাল–চামড়া ওঠে নি তা নয়, কিন্তু তার পরেও বাচ্চাগুলোর মাঝে এগুলো অসম্ভব জনপ্রিয়। গান শোনার জন্যে যে ক্রিস্টাল ডিস্ক রিডার ছিল সেগুলো ব্যবহার করার সৌর ব্যাটারির খুব অভাব ছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র থেকে নূতন করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পর এখন প্রতি লরিতেই গান শোনার ব্যবস্থা হয়েছে। সন্ধেবেলাতেই যেভাবে গান বাজতে থাকে যে নীলনকে নূতন করে আদেশ দিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনতে হয়েছে!
রাত্রিবেলা ঠাণ্ডার কষ্ট থেকে বাচার জন্য আগুন জ্বালানোর একটা ব্যবস্থা করা হত– আজকাল আর সেটা করা হয় না। নিউক্লিয়ার রি–একটরের পাশে একটা গরম পানির ধারা থাকে, সেটাকে টিউব দিয়ে পুরো কমিউনে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাত্রিবেলা সব ট্রাক লরি এবং কন্টেইনারগুলোর ভেতরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
তবে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক আবিষ্কারটি হয়েছে অন্য জায়গায়। সেটি শুরু হয়েছে এভাবে : ঈশ্বরী প্রিমার কাছ থেকে বিশেষ নির্দেশ এসেছে বলে নীলন একদিন কমিউনের সবাইকে নিয়ে একটা সভা ডেকেছে। বেশি ছোট বাচ্চাগুলোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মায়েরা বসেছে, একটু বড় বাচ্চাগুলো হুটোপুটি করে খেলছে এবং যারা মোটামুটিভাবে বুঝতে শিখেছে তারা গম্ভীর হয়ে বাবা–মায়ের কাছে বসে আছে–কখন এই সভা শেষ হবে সেজন্যে অপেক্ষা করছে। অন্যেরা ট্রাকের চাকায় বা যন্ত্রপাতিতে হেলান দিয়ে বসে নীলনের ঘোষণার জন্যে অপেক্ষা করছে। শুধু যাদের সেন্ট্রি ডিউটি দেওয়া হয়েছে তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে বাইরে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
নীলন সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সভার কাজ শুরু করল, বলল, তোমরা সবাই জান আর কিছুদিনের ভেতরেই ঠাণ্ডা পড়ে যাবে এবং তার আগেই আমরা দক্ষিণে যাত্রা শুরু করব। এবং তোমরা এটাও জান যে যাত্রা শুরু করার আগে আমাদের শীতকালের শস্যভাণ্ডার পুরো করতে হবে।
এরকম সময়ে কমবয়সী তরুণ–তরুণীরা যন্ত্রণার একটি শব্দ করল! নীলন সেটা না শোনার ভান করে বলল, আমরা আমাদের স্কাউট বাহিনীকে আশপাশে এবং শস্যভূমিতে পাঠিয়েছি, তারা তাদের রিপোর্ট দিয়েছে। ঈশ্বরী প্রিয়া আমাদের শস্যক্ষেত্রে যাবার দিন ঠিক করে দিয়েছেন।
ঈশ্বরী প্রিমা নামটির জন্যে তরুণ–তরুণীরা এবারে যন্ত্রণার শব্দ করার সাহস পেল না। তবে শস্য কাটতে যাওয়ার এই দিনটি নিয়ে কারো মনে আনন্দের কোনো স্মৃতি নেই।
ঈশ্বরী প্রিমা বলেছেন এবার শস্যক্ষেত্রে শস্য একটু আগেই প্রস্তুত হয়েছে এবং আমাদের আগেই যেতে হবে। এলাকার অন্যান্য কমিউনের সদস্যরাও সেখানে শস্য সংগ্রহ করতে যাবে কাজেই আমাদের শস্য কাটতে হবে দ্রুত, সেজন্যে এবারে আরো অনেককে শস্য কাটতে যেতে হবে। সবাইকে সেজন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।
যন্ত্রণার মতো শব্দ করা হলে ঈশ্বরী প্রিমার প্রতি অসম্মান করা হয় বলে কমবয়সী তরুণ–তরুণীরা বেশ কষ্ট করে চুপ করে রইল। তখন পিছনে বসে থাকা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মী বাহিনীর একটি মেয়ে, নিহানা, দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য নীলন, আমি কি একটা প্রস্তাব করতে পারি?
কী প্রস্তাব?
শস্য কাটার জন্যে আমরা যে চাকু ব্যবহার করি সেটি খুব ভালো কাজ করে। আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয় এবং প্রত্যেকবারই আমাদের ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু আমার মনে হয় মেয়েটি কথা বন্ধ করে একটু সময়ের জন্যে অপেক্ষা করে।
কী মনে হয়?
আমার মনে হয় আমরা শস্য কাটার জন্যে একটা যন্ত্র তৈরি করতে পারি যেটা দিয়ে অনেক তাড়াতাড়ি শস্য কাটতে পারব।
যারা উপস্থিত ছিল তাদের মাঝে অনেকেই অবিশ্বাসের শব্দ করল। একজন বলল, অসম্ভব। এরকম যন্ত্র তৈরি করা যদি সম্ভব হত ঈশ্বরী প্রিমা আমাদের জন্যে সেটি খুঁজে বের করতেন।
মেয়েটি বলল, এটি অসম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কী আমি যন্ত্রটা তৈরি করেছি, তবে এখনো পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পাই নি।
এবারে সবাই বিস্ময়ের একটা শব্দ করল। মেয়েটা লাজুক মুখে বলল, একটা মোটরবাইকের পিছনে এটা লাগাতে হবে। মোটরবাইকটা যখন সামনে যাবে তখন আমার যন্ত্রটা ঘুরে ঘুরে শস্য কাটতে থাকবে।।
রিহান উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দের একটা ধ্বনি বের করে বলল, অভিনন্দন! তোমাকে একশ অভিনন্দন! এক হাজার অভিনন্দন!
অন্য অনেকে এবার হাত তালি দিতে থাকে। কাউকেই আর ভোঁতা চাকু দিয়ে শস্য কাটতে হবে না–একটা যন্ত্র সবার শস্য কেটে দেবে, দৃশ্যটি চিন্তা করেই সবাই খুশি হয়ে যায়। নীলন হাত তুলে সবার আনন্দোচ্ছাসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি নিজেই খুব অবাক হয়ে দেখছি কিছুদিন আগেও যে ব্যাপারটি আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না এখন কত সহজে আমরা সেটি করতে পারি। ঈশ্বরী প্রিমার প্রতি আমাদের শত সহস্র কৃতজ্ঞতা যে তিনি আমাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে এই পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং গবেষণা করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
একজন চিৎকার করে বলল, জয় হোক ঈশ্বরী প্রিমার।
সবাই সমস্বরে বলল, জয় হোক।
নীলন আগের কথার সূত্র ধরে বলল, আমাদের নিহানা শস্য কাটার একটা যন্ত্র তৈরি করেছে সেজন্যে তাকে সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। তবে সবাইকে একটা জিনিস লক্ষ রাখতে হবে–বছরের একটা সময় আমাদের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই শস্যক্ষেত্রগুলোতে প্রতি বছর নিজে শস্য জন্মায় এবং আমরা শস্য কেটে আনি। আমাদের শরীর ঠিক রাখার জন্যে কী কী খেতে হবে ঈশ্বরী প্রিমা সেটি ঠিক করে দেন–তার কাছ থেকে আমরা জেনেছি এই শস্য মজুত করে রাখতে হয়। কাজেই নিহানার যন্ত্রটি আমরা ব্যবহার করব কি না সেটি খুব ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে। যদি কোনো কারণে যন্ত্রটি ঠিকভাবে কাজ না করে এবং আমরা ঠিক সময়ে শস্য কেটে আনতে না পারি আমাদের পুরো কমিউনের ওপর ভয়ংকর দুর্যোগ নেমে আসবে।
নিহানা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ নীলন। সেজন্যে আমি আগে আমার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
কমবয়সী একজন দাঁড়িয়ে বলল, পাহাড়ের নিচে ঘাসের বন আছে। আমরা সেই ঘাসের বনে শস্য কাটার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
নীলন বলল, আমি যন্ত্রটা ব্যবহার করার পক্ষে কিন্তু যদি যন্ত্রটা কোনো কারণে কাজ করে তার জন্যেও প্রস্তুতি রাখতে চাই। তা ছাড়া নীলন একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, এই এলাকার মানুষের যেসব কমিউন আছে তারা অনেকেই এখানে শস্য কাটতে আসে। কিছু কিছু কমিউন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তাদের সাথে যুদ্ধ হতে পারে সেজন্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে।
কমিউনের বয়স্ক সদস্যরা তখন ঘুঁটিনাটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয়। অনেক আলোচনা করে মোটামুটি একটা পরিকল্পনা করে সেদিনকার সতা শেষ করা হল।
নিহানার যন্ত্রটা যেরকম কাজ করবে ভাবা হয়েছিল, দেখা গেল সেটি তার থেকে অনেক ভালো কাজ করছে। পাহাড়ের নিচে কাশবনের জঙ্গলটি সেটি কয়েক মিনিটে কেটে শেষ করে ফেলল, সেটি দেখে সবাই এত উৎসাহ পেল যে তখন তখনই তারা শস্য মাড়াই করার একটা যন্ত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা করা শুরু করল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে আগে যে কাজ করতে তাদের পুরো এক সপ্তাহ লেগে যাবার কথা ছিল সেটি চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে শেষ হয়ে যাবে বলে সবাই আশা করতে থাকে।
নির্দিষ্ট দিনে বড় কন্টেইনারসহ একটা ট্রাক এবং দশটা মোটরবাইকে করে বিশজন মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে শস্য কাটতে রওনা হৃল। কন্টেইনারের ভিতরে নিহানার শস্য কাটার এবাং শস্য মাড়াই করার যন্ত্র। শস্যক্ষেত্রটি অনেক দূর, ভোরবেলা রওনা দিয়ে পাথুরে রাস্তায় সারা দিন চালিয়ে ওরা গভীর রাতে সেখানে পৌঁছাল। সবাই ক্লান্ত, তার পরেও তারা শস্য কাটার যন্ত্রটি মোটরবাইকের সাথে লাগানোর কাজটুকু সেরে রাখল যেন খুব ভোর বেলাতেই কাজ শুরু করে দিতে পারে।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই শুতে গিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলে ভোরবেলা কাজ করা সহজ হবে। নিহানার যন্ত্রটা ঠিকভাবে কাজ করলে তাদের খুব বেশি পরিশ্রম হবার কথা নয়। জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা, কন্টেইনারের ভেতর স্লিপিং ব্যাগে অন্য সবার সাথে গুটিসুটি মেরে রিহান শুয়ে পড়ল। যন্ত্রপাতি ঠিক করার জন্যে কাছাকাছি কেউ নেই বলে তাকে আনা হয়েছে, যদি কোনো সমস্যা হয় তাকে ঠিক করে দিতে হবে।
রাত্রে হঠাৎ রিহানের ঘুম ভেঙে গেল। কেন ঘুম ভেঙেছে রিহান বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ ঘাপটি মেরে শুয়ে থেকে তার মনে হতে থাকে কিছু একটা অস্বাভাবিক জিনিস ঘটেছে কিন্তু সেটা কী সে বুঝতে পারছে না। রিহান মাথা উঁচু করে বোঝার চেষ্টা করে। তখন সে বহু দূরে কয়েকটা মোটরবাইকের শব্দ শুনতে পেল। এই শস্যক্ষেত্রের আশপাশে কোনো কমিউন নেই, বহু দূর থেকে মানুষেরা শস্য কাটার জন্যে এখানে আসে। তাদের মতো আরো কোনো দল হয়তো শস্য কাটতে আসছে।
রিহান উঠে বসল, যারা আসছে তারা কী ধরনের মানুষ কে জানে। এসে একটা গোলাগুলি শুরু করে দিলে কী হবে? সবাইকে ডেকে তুলবে কি না রিহান বুঝতে পারল না। সবাই ক্লান্ত হয়ে এমন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে যে রিহানের তাদের ডেকে তুলতে মায়া হল। মোটরবাইকগুলো এখনো অনেক দূরে, আরো একটু কাছে এলে ডেকে তোলা। যাবে। রিহান কন্টেইনারের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে মোটরবাইকের শব্দগুলো শুনতে থাকে। যদি কমিউনের লোকেরা শস্য কাটতে আসে তা হলে মোটরবাইকের সাথে বড় বড় ট্রাক এবং লরির শক্তিশালী ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাবে কিন্তু সেরকম কিছু নেই। দুই থেকে তিনটি মোটরবাইকের শব্দ শোনা যাচ্ছে–কখনো আস্তে, কখনো জোরে, কখনো সেটা পাহাড়ের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
রিহান চুপচাপ বসে থাকে, ধীরে ধীরে মোটরবাইকের শব্দ বাড়ছে, যারা আসছে তারা কাছাকাছি এসে পৌঁছে গেছে। সম্ভবত অন্য কোনো কমিউনের স্কাউট দল, শস্যক্ষেত্রটি দেখতে এসেছে, ভোরের আলোতে দেখে আবার ফিরে চলে যাবে।
রিহান তবু ঝুঁকি নিল না, কন্টেইনারে ঘুমিয়ে থাকা গ্রুস্তানকে ডেকে তুলে সাবধানে বের হয়ে আসে। বাইরে আরো দুজন সেন্ট্রি পাহারা দিচ্ছিল, মোটরবাইকের শব্দ তারাও শুনেছে, হাতে অস্ত্র নিয়ে তারাও অপেক্ষা করছে।
গ্রুস্তান বলল, ভয়ের কিছু নেই। মনে হয় স্কাউট দল। আমরা একটু সতর্ক থাকি।
রিহান বলল, ঠিক আছে।
মোটরবাইকগুলো কাছে এসে হঠাৎ করে হেডলাইট নিভিয়ে ফেলে, ইঞ্জিনগুলো চাপা গর্জন করে আরো কাছাকাছি এসে থেমে যায়। গ্রুস্তান নিচু গলায় বলল, আমাদের দেখেছে।
কিন্তু হেডলাইট নিভিয়েছে কেন?
বুঝতে পারছি না।
গ্রুস্তান চাপা গলায় সেন্ট্রি দুজনকে বলল, তোমরা দুই পাশে চলে যাও। সন্দেহজনক কিছু দেখলে গুলি করতে হতে পারে।
সেন্ট্রি দুজন মাথা নেড়ে দুই পাশে সরে গেল। গ্রুস্তান আর রিহান অন্ধকারে কন্টেইনারের পিছনে লুকিয়ে থাকে। তারা কিছুক্ষণের মাঝেই কয়েকটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল–ছায়ামূর্তিগুলো পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে। ট্রাকের সামনে এসে সেটা পরীক্ষা করল, খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে কথা বলল। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখা মোটরবাইকগুলো দেখল, নিজেরা নিজেরা কিছু একটা কথা বলল, তারপর তারা ফিরে যেতে শুরু করল।
গ্রুস্তান ফিসফিস করে বলল, লোকগুলো ফিরে যাচ্ছে।
হ্যাঁ।
কোনো কমিউনের স্কাউট দল মনে হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই।
রিহান মাথা নেড়ে সম্মতি দিতে গিয়ে থেমে গেল, লোকগুলো আবার ফিরে আসছে। তাদের হাতে বড় একটা পাত্র। রিহান ফিসফিস করে বলল, কিন্তু লোকগুলো ফিরে আসছে। কেন?
পরের দৃশ্য দেখে রিহান আর গ্রুস্তান আঁতকে উঠল, সর্বনাশ! কী একটা জানি ছিটাচ্ছে! আগুন ধরিয়ে দেবে।
কী ধরনের মানুষ অপরিচিত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করতে পারে? কিন্তু সেই কারণ খুঁজে বের করার অনেক সময় পাওয়া যাবে, এই মুহূর্তে তাদের থামাতে হবে।
রিহান হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁচু করে চিৎকার করে বলল, হাত তুলে দাঁড়াও–না হলে গুলি করব!
মানুষগুলো থমকে দাঁড়াল, মনে হল ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে কিন্তু তার আগেই সেন্ট্রি দুজনের ক্রিপটন ফ্লাশ লাইটের তীব্র আলো তাদের ওপর এসে পড়ল। তিনজন মানুষ, মধ্যবয়স্ক পুরুষ, শরীরে কালো বায়ু নিরোধক পোশাক, মাথায় হেলমেট এবং চোখে নাইট গগলস।
গ্রুস্তান অস্ত্র উদ্যত করে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, তোমরা এক পা নড়লে গুলি করে শেষ করে দেব। আমরা চারজন মানুষ তোমাদের টার্গেট করেছি। খবরদার ভুলেও হাতে অস্ত্র নেবার চেষ্টা করবে না।
মানুষগুলো চেষ্টা করল না। ক্রিপটন ল্যাম্পের তীব্র আলোতে হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গ্রুস্তান এবং রিহান আরো একটু এগিয়ে যায়। সেন্ট্রি দুজনও কাছাকাছি এগিয়ে আসে।
গ্রুস্তান জিজ্ঞেস করল, তোমাদের হাতে ওটা কী?
মানুষগুলো কোনো কথা বলল না।
গ্রুস্তান ধমক দিয়ে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমাদের হাতে কী?
বিস্ফোরক। প্লাস্টিক বিস্ফোরক।
তোমরা কেন ওটা এখানে ছড়াচ্ছ?
মানুষগুলো প্রশ্নের উত্তর দিল না।
গ্রুস্তান আবার ধমক দিল, কেন?
আমরা তোমাদের কন্টেইনারটা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
রিহান হঠাৎ করে চমকে উঠল, সে আগে এই কণ্ঠস্বরটি কোথাও শুনেছে। দুই পা এগিয়ে সে তীক্ষ্ণ চোখে মানুষগুলোর দিকে তাকাল। তাদের কণ্ঠস্বর পরিচিত কিন্তু চেহারা পরিচিত নয়।
গ্রুস্তান আবার জিজ্ঞেস করল, কেন তোমরা আমাদের কন্টেইনারটি উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে? তোমরা জান এই কন্টেইনারের ভেতর আমাদের মানুষেরা ঘুমাচ্ছে?
জানি।
তা হলে?
পৃথিবীতে শস্যের অভাব। আমরা আমাদের কমিউনের জন্যে শস্য নিতে চাই।
রিহান এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে, সে নিশ্চিত এই কণ্ঠস্বরটি আগে শুনেছে। মানুষগুলো অপরিচিত কিন্তু কণ্ঠস্বর পরিচিত সেটি কেমন করে হতে পারে? হঠাৎ রিহান বিদ্যৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, হ্যাঁ, তার মনে পড়েছে। এই মানুষ তিনজন প্রভু ক্লডের আদেশে তাকে হত্যা করার জন্যে নিয়েছিল। অন্ধকারে তাদের চেহারা দেখতে পায় নি শুধু গলার স্বর শুনেছে। রিহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কী আশ্চর্য কিছুদিন আগে যারা তাকে হত্যা করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল এখন তারাই তার উদ্যত অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে?
রিহান এক পা এগিয়ে এসে বলল, তোমরা তোমাদের কমিউনের জন্যে শস্য নিতে চাও?
হ্যাঁ।
প্রয়োজন হলে অন্যদের ধ্বংস করে?
একজন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ প্রয়োজন হলে অন্যদের ধ্বংস করে। পৃথিবীতে যারা যোগ্য তারা বেঁচে থাকবে।
তোমাদের সেটা কে শিখিয়েছে? তোমাদের ঈশ্বর? তোমাদের প্রভু?
হ্যাঁ। আমাদের প্রভু।
রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের প্রভু ভুল জিনিস শিখিয়েছে।
মোটা গলার একজন মানুষ বলল, আমাদের প্রভু কখনো ভুল জিনিস শেখান না। আমাদের প্রভূ কখনো ভুল করেন না।
করেন, তোমার প্রভু হচ্ছে প্রভু ক্লড। এবং প্রভু ক্লড অনেক বড় ভুল করেছেন! আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তা হলে আমার দিকে তাকাও
মানুষগুলো অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। ক্রিপটন ল্যাম্পের তীব্র আলোর কারণে প্রথমে তারা তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। রিহান সেন্ট্রির দিকে ইঙ্গিত করতেই সে আলোটা খানিকটা তার দিকে ঘুরিয়ে আনে। মানুষগুলো রিহানকে দেখে হতবাক হয়ে যায়, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।
রিহান উদ্যত অস্ত্র হাতে মানুষগুলোর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমার প্রভু আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল! সে যদি সত্যিকারের ঈশ্বর হত তার মৃত্যুদণ্ড থেকে আমি বেঁচে আসতে পারতাম না। তোমরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে, হত্যা করতে পার নি। আমি বেঁচে এসেছি। শুধু যে বেঁচে এসেছি তা নয়–এখন আমি তোমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছি। ট্রিগারে একটু টান দিলেই তোমাদের রক্তাক্ত শরীর এখানে পড়ে থাকবে।
গ্রুস্তান আর সেন্ট্রি দুজন অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান হিংস্র গলায় বলল, তোমরা বেঁচে থাকবে না মরে যাবে সেটা এখন নির্ভর করছে আমার ইচ্ছের ওপর। তোমার প্রভু ক্লড তোমার প্রাণ বাঁচাতে পারবে না–তোমার প্রাণ বাঁচাতে পারব আমি!
মানুষগুলো কোনো কথা না বলে হতচকিত হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিহান গ্রুস্তানের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রুস্তান, এদের কী করবে?
গ্রুস্তান হাত নেড়ে বলল, এরা হচ্ছে চতুর্থ শ্রেণীর ঘাতক। এদের বেঁচে থাকা মরে যাওয়ায় কিছু আসে যায় না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এদেরকে মেরে ফেললে পৃথিবীর উপকার হয়। কিন্তু আমরা মানুষ মেরে অভ্যস্ত নই।
মানুষগুলো হঠাৎ হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বলল, আমরা ক্ষমা চাই–আমাদের হত্যা করবেন না। ঈশ্বরের দোহাই।
রিহান জিজ্ঞেস করল, কোন ঈশ্বর? তোমাদের না আমাদের?
মানুষগুলো একমুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে তারপর বলে, আপনাদের ঈশ্বর।
রিহান হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, তোমাদের মেরে ফেললে পৃথিবীর উপকার হয়। কিন্তু তোমাদের আমরা মারব না তোমাদের ছেড়ে দেব। কেন ছেড়ে দেব জান?
মানুষগুলো মাথা নাড়ল, তারা জানে না।
তোমাদের ছেড়ে দেব যেন তোমরা তোমাদের প্রভু ক্লডের কাছে গিয়ে বলতে পার যে আপনি সত্যিকারের ঈশ্বর নন। আপনি মিথ্যা। আপনি যখন কোনো মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেন সেই মানুষের মৃত্যু হয় না। শুধু যে মৃত্যু হয় না তাই না, সেই মানুষ ফিরে এসে আমাদের প্রাণ ভিক্ষা দেয়।
মানুষগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রিহান বলল, কী বলেছি তোমাদের মনে থাকবে?
মানুষগুলো মাথা নেড়ে জানাল যে তাদের মনে থাকবে। রিহান বলল, বেশ, এবারে দেখা যাক তোমাদের সাথে কী আছে। তোমাদের যন্ত্রপাতি, বিস্ফোরকগুলো রেখে দিই যেন ফিরে যাবার সময় অন্য কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি করতে না পার।
রিহান কাছে গিয়ে বলল, দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও, দেখি তোমাদের শরীরে কী আছে।
.
মানুষগুলোর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গুলির বেল্ট, বিস্ফোরক সরিয়ে রেখে তাদেরকে যখন যেতে দিল তখন পূর্বের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। সূর্য ওঠার আগেই তারা বুঝতে পারল এই মানুষগুলোকে যেতে দিয়ে তারা বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। মানুষগুলো যাবার আগে শস্যক্ষেত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সেই আগুন ধীরে ধীরে শস্যক্ষেত্রকে গ্রাস করতে আসছে। প্রভু ক্লডের অনুসারীরা কোনো মানুষকে এই শস্যের অংশ দেবে না প্রয়োজনে নিজের সর্বনাশ করে হলেও।
সবাই এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে শস্যক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশাল এই শস্যক্ষেত্রটিতে প্রতি বছর শস্যের জন্ম হয়। তারা ভাসা ভাসা ভাবে জানে একসময় পৃথিবীতে অনেক মানুষ ছিল তখন নিশ্চয়ই এখানে তারা এগুলোকে শস্যভূমি তৈরি করেছিল। এখনো তার কিছু অবশেষ রয়ে গেছে মানুষের কোনো সাহায্য ছাড়াই এই বিশাল প্রান্তরে প্রতি বছর শস্য বেড়ে ওঠে। পৃথিবীতে এখন নানা কমিউনে যে মানুষেরা বেঁচে আছে তাদের অনেকে এখান থেকে শস্য কেটে নিয়ে যায়–যে পরিমাণ শস্য জন্মায় পৃথিবীর এই অঞ্চলে বেঁচে থাকা মানুষের জন্যে সেগুলো যথেষ্ট। কিন্তু আজ সেই শস্যক্ষেত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, দেখতে দেখতে পুরো শস্যক্ষেত্র আগুনে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
রিহান কাঁপা গলায় বলল, গ্রুস্তান, এই আগুনটা আসতে কতক্ষণ লাগবে বলে মনে হয়?
বাতাস নেই তাই দুই–তিন ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। বাতাস শুরু হলে দেখতে দেখতে চলে আসবে।
আমরা শুধু শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে আগুনটা না দেখে কিছু একটা কাজ করতে পারি না?
কী করতে চাও? এখানে তো ঈশ্বর প্রিমা নেই যে তাকে জিজ্ঞেস করব।
একজন বলল, ইশ! যদি কোনোভাবে ঈশ্বর প্রিমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম!
রিহান বলল, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা কি শস্য কাটা শুরু করতে পারি না?
গ্রুস্তান মাথা নেড়ে বলল, দুই–তিন ঘণ্টায় তুমি কতটুকু শস্য কাটবে?
রিহান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আগুনটা জ্বলছে শস্য গাছে। আমরা আগুনের পথে শস্যগুলো কেটে রাখতে পারি না যেন আগুন জ্বলার জন্যে কিছু না থাকে?
গ্রুস্তান বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকাল। রিহান বলল, নিহানার শস্য কাটার যন্ত্রটা শস্য গাছকে চমৎকারভাবে কাটতে পারে–আমরা সেটা ব্যবহার করে লম্বালম্বিভাবে শস্যক্ষেত্রে খানিকটা জায়গায় গাছগুলো একেবারে গোড়া পর্যন্ত কেটে সরিয়ে নেব। আগুনটা তখন এই পর্যন্ত এসে থেমে যাবে–আর এগুতে পারবে না কারণ আগুন জ্বলার জন্যে কিছু থাকবে না!
গ্রুস্তান খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমার কী মনে হয় জান?
কী?
আমরা যদি ঈশ্বরী প্রিমাকে এখন জিজ্ঞেস করতাম, তা হলে তিনিও এটাই বলতেন!
তা হলে দেরি করে লাভ কী? চল কাজ শুরু করে দিই।
চল।
নিহানার তৈরি শস্য কাটার যন্ত্রটা শস্যক্ষেত্রে নামিয়ে আনা হল। সেটা শস্য কেটে যেতে থাকল এবং দলের বিশজনের সবাই কাটা শস্যের গাছগুলো সরিয়ে নিতে লাগল। ঘণ্টাখানেকের মাঝেই প্রায় দুই মিটার চওড়া আগুনের জন্যে একটা বাধা তৈরি করা হল। ততক্ষণে আগুনটা আরো এগিয়ে এসেছে, বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, মাঝে মাঝে আগুনের ফুলকি ছুটে আসছে। সবাইকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল আগুনের ফুলকি থেকে যেন নূতন কোনো আগুন শুরু হয়ে না যায় তার দিকে লক্ষ রাখতে।
আগুনের জ্বলন্ত শিখা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ফাঁকা জায়গাটাতে দুর্বল হয়ে পড়ে সেখানে জ্বলার মতো কিছু নেই। কিছুক্ষণ ধিকিধিকি করে জ্বলে আগুনটা নিভে যায়। সবাই বিস্মিত হয়ে দেখে শস্যক্ষেত্রের এক অংশ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে, অন্য পাশে সোনালি শস্যক্ষেত্র বাতাসে নড়ছে!
গ্রুস্তান রিহানকে জড়িয়ে ধরে বলল, রিহান তুমি আজ এখানে না থাকলে আমরা কিছুতেই শস্যক্ষেত্রটা বাঁচাতে পারতাম না। তোমার বুদ্ধিটা অসাধারণ।
রিহান মাথা নেড়ে বলল, উঁহু, নিহানা যদি তার শস্য কাটার যন্ত্রটা আবিষ্কার না করত আমরা কিছুই করতে পারতাম না! যত বুদ্ধিই থাকুক কোনো কাজই হত না।
নিহানা হেসে বলল, আমার যন্ত্রটা শস্য গাছগুলো কেটেছে–কিন্তু সবাই যদি কাটা গাছগুলো সরিয়ে না নিত কোনো লাভই হত না। কাজেই কৃতজ্ঞতা জানাতে হলে সেটা জানানো উচিত তাদেরকে।
গ্ৰস্তান হেসে বলল, ঠিক আছে! বোঝা যাচ্ছে কারো একার বুদ্ধিতে এই অসাধ্য সাধন হয় নি! সবাই মিলে করা হয়েছে।
কালিঝুলি মাখা কমবয়সী একজন তরুণ বলল, ঈশ্বরী প্রিমার সাহায্য ছাড়াই আমরা কত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি দেখেছ?
সবাই মাথা নেড়ে কথাটা মেনে নিল, শুধু রিহান চমকে উঠে ভাবল, এই কথাটার কি অন্য কোনো অর্থ রয়েছে? যদি সবাই একসঙ্গে থাকে তা হলে কি ঈশ্বর ছাড়াও কমিউন বেঁচে থাকতে পারবে?
পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা ফসল কাটা, মাড়াই করা, বাক্স বোঝাই করে ট্রাকে তোলার অমানুষিক পরিশ্রমের মাঝে ঘুরেফিরে রিহানের শুধু এই কথাটা মনে হতে থাকল।