সকালবেলাটায় রাজা মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে ঘুমোচ্ছিলেন। বুড়ো বয়সের ওইটাই দোষ। যখন-তখন ঘুম পেয়ে যায়। সিংহাসনটার অবস্থা অবশ্য খুবই খারাপ। কাঠের ওপর পেতলের পাত লাগানো ছিল। সেগুলো পুরনো হয়ে উঠে যাচ্ছে, গদির ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে। ছারপোকার উপদ্রবও আছে খুব। বসলে মোটেই আরাম হয় না, বরং অসাবধান হলে ভাঙা পেতলের পাতে কিংবা উঠে-থাকা পেরেকে খোঁচা লাগে, গদির ছোবড়া কুটকুট। করে। তবু মহেন্দ্র বেশ আরাম করে গুটিসুটি হয়ে বসে রোজই ঘুমিয়ে পড়েন।
ঘুমের একটা সুবিধের দিকও আছে। অভাব-অভিযোগ শুনতে হয় না। একটু আগেই রানিমা এসে লম্বা ফিরিস্তি শুনিয়ে গেলেন, সরষের তেল বাড়ন্ত, গয়লার টাকা না মেটালে দুধ বন্ধ করে দেবে, মুদির দোকানে তিনশো টাকার ওপর ধার, ঠিকে-লোক কাজ করতে চাইছেনা, দক্ষিণের ঘরে দেওয়ালের চাপড়া খসে পড়েছে, ইত্যাদি।
আজ সবে ঘুমটা এসেছে, হঠাৎ-দু চারজন প্রজা এসে হাজির। ফটিক রায় এসে বলল, “মহারাজ, তামা-তুলসী ছুঁয়ে বলতে পারি, জীবনে কখনও রাজবাড়ির কুটোগাছটিতেও হাত দিইনি। কিন্তু রাজকুমার তার দলবল নিয়ে গিয়ে কী হেনস্থাটাই করল আমাকে পাঁচজনের সামনে। আমার বউয়ের গলার বিচেহারটা নাকি রানিমার বাপের বাড়ির দেওয়া জিনিস, আমার বউমার হাতের বালাজোড়া নাকি মহারাজ মহতাবের আমলে বড় রানিমা পরতেন। তা ছাড়া কাঁসার বাসন, রুপোর গোট এইসবই নাকি রাজবাড়ি থেকে আমিই সরিয়েছি! বলুন তো, গরিবের ওপর এ কী অত্যাচার!…”
নয়ন সামন্ত বুড়োমানুষ। এসে হাতজোড় করে বলল, “মহারাজ, বছরটাক আগে গোবিন্দপুরের গোহাটা থেকে দুধেল গাইটা কিনে এনেছিলুম। সবাই জানে। কোন সুবাদে সেটা রাজবাড়ির গোরু হল সেটা তো বুঝতে পারছি না। রাজকুমারের স্যাঙাতরা গিয়ে বলল, ‘এই তো রাজবাড়ির সেই কামধেনু গোরু। ওরে ব্যাটা, গোরু চুরি করেছিস সেজন্য কিছু বলছি না, কিন্তু রোজ সকালে দু সের করে দুধ দিয়ে আসবি। এর একটা বিহিত না করলে যে গঙ্গাধরপুরের বাস ওঠাতে হবে।’”
গণেশ হালদার হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “খালধারের জমিটা আপনার পিতাঠাকুরের কাছে আমার বাবা ন্যায্য দামে কিনে নিয়েছিলেন মহারাজ, মনে নেই? আমার দলিলও আছে। কিন্তু রাজকুমার সে দলিল স্বীকারই করতে চাইছেন না মোটে। খরচাপাতি করে ধান বুনলুম, তা শুনছি নাকি ফসল সব রাজবাড়িতে তুলে না দিয়ে গেলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। আপনার রাজত্বে কি শেষে সপরিবার বেগুনপোড়া হয়ে মরব মহারাজ?
সতীশ বিশ্বাস রোগাভোগা ভিতু মানুষ। ভারী কাহিল মুখ করে এসে বলল, ‘“রাজকুমার বহুকাল পরে ফিরে এয়েছেন, তাতে তো আমাদের আনন্দেরই কথা মহারাজ, তা আনন্দ আমাদের হচ্ছেও। খুবই হচ্ছে। কিন্তু উনি বলেছেন, মাসে মাসে দুশো টাকা করে খাজনা না দিলে ওঁর লেঠেলরা আমার বাড়িতে চড়াও হবে। মহারাজ, এত খাজনা তো সরকার বাহাদুরকেও দিতে হয় না। শেষে কি শুকিয়ে মরব?”
কিন্তু শিকদার বলল, “রাজকুমারের ভয়ে আমরা নালিশ জানাতে আসতেও ভয় পাই। তা আজ তিনি সকালবেলায় দলবল নিয়ে কোথায় যেন গেছেন বলে সাহস করে এসেছি। আপনি প্রজাপালক রাজা, আপনি না বাঁচালে আমাদের যে ধন প্রাণ দুটোই যাবে।”
কথাটা ঠিক নয়। রাজা মহেন্দ্রর রাজত্ব বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। প্রজারাও আর তাঁর প্রজা নয়। তবু এদের প্রতি তাঁর একটা দায়িত্ব তো আছে!
ঘটনাটা হল, দশ-বারো বছর আগে তাঁর ছেলে নবেন্দ্র কালীমাস্টারের কানমলা খেয়ে রাগে অভিমানে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। রানিমা কেঁদেকেটে শয্যা নিয়েছিলেন! ছেলেকে খুঁজতে জলের মতো টাকাও খরচ করেছিলেন মহেন্দ্র। কোনও লাভ হয়নি।
মাসখানেক আগে এরকমই এক সকালবেলায় রাজা মহেন্দ্র সিংহাসনে বসে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ পায়ে সুড়সুড়ি লাগায় আঁতকে উঠে দেখেন সামনে লম্বাচওড়া একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে আরও দশ-বারোজন।
ডাকাত পড়েছে ভেবে তিনি হাউমাউ করে উঠলেন, “ওরে বাপু, তোরা বড্ড ভুল জায়গায় এসে পড়েছিস। এ বাড়িতে ডাকাতি করার মতো কিছু আর নেই রে! সেই একান্ন বছর আগে শেষবার ডাকাতি হয়েছিল। এখন ছিচকে চোরও আসে না। তোরা বরং ওই ভল্লনাথ, গোবিন্দ সাউ ওদের বাড়িতে যা।”
লোকটা একগাল হেসে বলল, “বাবা, আমাকে চিনতে পারলে না? আমি যে তোমার নবেন্দ্র!”
নবেন্দ্র! মহেন্দ্র হাঁ হয়ে গেলেন! দশ বারো বছর আগে নবেন্দ্রর দশ-বারো বছর বয়স ছিল। এখন সে এত লম্বাচওড়া হয়েছে যে, চেনার উপায় নেই। তা ছাড়া মহেন্দ্র চোখেও কম দেখেন।
খবর পেয়ে রানিমা ধেয়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না, “কোথায় ছিলি বাপ, এতকাল মাকে ছেড়ে! এতদিনে বুড়ো মা বাবার কথা মনে পড়ল? ওরে তোরা শাঁখ বাজা, উলু দে…”
কিন্তু শাঁখ বাজানো বা উলু দেওয়ার মতো লোকই তো নেই রাজবাড়িতে! বুড়ি দাসী সুবালাই মস্ত শাঁখখানা নিয়ে বিস্তর ফুঁ দিল বটে, কিন্তু দম নেই বলে আওয়াজ বেরোল না।
রানিমা বাজারে তোক পাঠিয়ে রাজকীয় ভোজের আয়োজন করলেন। তারপর সোনার থালা, রুপোর বাটি বের করারও হুকুম হল। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, সেসব কিছুই আর রাজবাড়িতে নেই। বহুকাল আগেই বিক্রিটিক্রি হয়ে গেছে।
আয়োজনের খামতি হলেও আনন্দের তেমন খামতি হল না। পাড়াসুদ্ধ লোক ঝেটিয়ে এসে রাজকুমারকে দেখে গেল। বুড়ো পুরুত থুতনি নেড়ে রাজকুমার নবেন্দ্রকে আদর করে বললেন, “সেই মুখ! সেই চোখ! কতটুকু দেখেছি!”
নবেন্দ্র যে অভাবী মানুষ নয়, তা তাকে দেখেই বোঝা যায়। আঙুলে দামি আংটি, হাতে দামি ঘড়ি, গলায় সোনার চেন, পকেটে টাকা, জামাকাপড় রীতিমতো ভাল। মুখে মিষ্টি হাসি আর বিনয়ী ব্যবহার।
ছেলে কেষ্টবিষ্ট হয়ে ফিরেছে মনে করে রাজা মহেন্দ্র আশায় বুক বাঁধলেন। আজকাল ভাতের পাতে ডাল, ভাত আর ঘ্যাঁট ছাড়া বিশেষ কিছু জোটে না, দুধটুকু পর্যন্ত হিসেব করে খেতে হয়। বাজারে মেলা ধার বাকি। মহারানি ছেঁড়া শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেতন না পেয়ে নায়েব, গোমস্তা, চাকরবাকর সব বিদেয় নিয়েছে। রাজবাড়ির বড়ই দুর্দশা। ছেলে যদি এবার সুখের মুখ দেখায়!
তা পরের দিন সকালেই সুখের মুখ দেখে ফেললেন মহেন্দ্র। সিংহাসনে বসে সবে তন্দ্রাটি এসেছে, তাঁর ছেলের দুই ষণ্ডামার্কা স্যাঙাত এসে তাঁর দুই পা দাবাতে বসে গেল। মহেন্দ্ৰ আঁতকে “বাবা রে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
বিগলিত হাসি হেসে তারা বলল, “লাগল নাকি রাজামশাই?”
মহেন্দ্ৰ আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “বুড়ো বয়সের হাড়, ভেঙে যাবে যে!”
“তা বলে কি পদসেবা করব না রাজামশাই! আমাদের ওপর হুকুম আছে যে!”
“অ। তা হুকুম থাকলে কী আর করা! কিন্তু বাপু, অভ্যেস নেই যে, ওসব পদসেবাটেবা কি আমার সইবে?”
“উপায় নেই রাজামশাই, পদসেবা না করলে আমাদের গর্দান যাবে। কুমার বাহাদুর আপনার মতোই তেজি পুরুষ, বেয়াদবি একদম পছন্দ করেন না।”
“ওরে বাবা! তা হলে বরং হাতে একটু তেল মেখে নাও বাবারা, তোমাদের হাত যে শিরীষ কাগজের মতো খরখর করছে!”
“আজ্ঞে, সে চেষ্টা কি আর করিনি! রানিমার কাছে তেল চাইতে গিয়েছিলাম। তা তিনি তেল শুনে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।”
মহেন্দ্র হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইলেন। দুই ষণ্ডা তাঁর পদসেবা করেই ছাড়ল না, পা ছেড়ে হাতে উঠল, হাত ছেড়ে কাঁধে, তারপর মাথাতেও বিস্তর তবলাটবলা বাজিয়ে যখন ক্ষান্ত হল তখন মহেন্দ্র নেতিয়ে পড়েছেন। দুদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি।
তৃতীয় দিন সিংহাসনে গিয়ে বসতে না বসতেই আঁতকে উঠে দেখলেন, দুই ষণ্ডা আবার এসে হাজির। প্রাণের মায়া ছেড়েই দিয়েছেন মহেন্দ্র। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ষণ্ডারা পা দাবাতে দাবাতে বলল, “তা রাজামশাই, রাজবাড়ির পেছনের পুকুরটা কি আপনার নয়? সকালে জাল নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম, তা তিন-চারটে লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে তেড়ে এল। শুনলুম তারা নাকি পুকুর ইজারা নিয়েছে। সত্যি নাকি?”
“হ্যাঁ বাবারা, হলধর দাসের কাছে ইজারা দেওয়া আছে বটে।”
“তাই বলুন। তা আমরা অনেক কাকুতিমিনতি করলুম যে, একখানা পাঁচ-সাতসেরি রুইমাছ হলেই আমাদের চলবে। রাজবাড়িতে নজরানা দেওয়ারও তো একটা নিয়ম আছে, নাকি বলুন। তা কিছুতেই রাজি হয় না। তাই তখন মোলায়েম করে দু-চারটে রদ্দা মারতেই হল।”
“মারধর করেছ! সর্বনাশ! থানাপুলিশ হবে যে!”
“না, সে ভয় নেই। তারা লক্ষ্মী ছেলের মতো যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে-বসে আছে। কেউ থানামুখো হয়নি।”
শঙ্কিত হয়ে মহেন্দ্র বললেন, “মাছও ধরলে নাকি?”
“ওই একখানা দশসেরি রুই মোটে ধরা হয়েছে।”
পরের দিন ফের পা দাবাতে বসে ষণ্ডারা বলল, “আচ্ছা রাজামশাই, রাজবাড়িতে চোরা কুঠুরিটুরি নেই?”
“না হে বাপু। ছিল কিছু। সব ধসে গেছে।”
“দেওয়ালেটেওয়ালে কোথাও লুকোনো সিন্দুকটিক?”
“না বাবারা। সেসব কিছু নেই।”
“আর সোনা-রুপোর বাসনটাসনগুলো?”
মহেন্দ্ৰ হাত উলটে বললেন, “সেসব কবে বিক্রিবাটা হয়ে গেছে। তা বাবারা, এসব জানতে চাইছ কেন?”
“আজ্ঞে, সাবধান হওয়ার জন্যই জেনে নিচ্ছি। চারদিকে যা চোরছ্যাঁচড়ের উৎপাত! জিনিসপত্রের একটা হিসেব থাকা ভাল।”
মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গতিক তাঁর সুবিধের ঠেকছে না।
একদিন রাজা মহেন্দ্র দুপুরবেলা ছাদে বসে রোদ পোয়াচ্ছেন। এমন সময়ে ভারী জড়োসড়ো হয়ে একটা লোক তাঁর সামনে এসে পেন্নাম করে দাঁড়াল।
মহেন্দ্ৰ আঁতকে উঠে বললেন, “না, না বাবা! এখন আমার পা দাবানোর দরকার নেই। সকালেই হয়ে গেছে।”
“আমি পা দাবাতে আসিনি মহারাজ।”
মহেন্দ্র সন্দিহান হয়ে বললেন, “তবে কি গুপ্তধন?”
“আজ্ঞে না। আমি রাজকুমারের দলের লোক নই।” নিশ্চিন্তির খাস ছেড়ে মহেন্দ্র বললেন, “বাঁচালে বাবা। তা তুমি কে?”
“অধমের নাম শ্রীদাম খড়খড়ি।”
“কী চাও বাপু?”
“আজ্ঞে, একটু কথা ছিল। অনেকদিন ধরেই সুযোগ খুঁজছি। তা কুমার বাহাদুরের লেঠেলদের দাপটে রাজবাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারিনি। তা দেখলুম দুপুরের দিকে তেনারা খেয়েদেয়ে একটু ঘুমোন। ঘুমেরও দোষ নেই। আজই পদ্মলোচনবাবুর পুরুষ্টু পাঁঠাটা নিয়ে এসে কেটে খেয়েছেন তো! গুরুভোজনের পর ঘুম তো আসবেই।”
“পদ্মলোচনের পাঁঠা! বল কী হে? সে যে ভয়ংকর রাগী আর মারমুখো লোক!”
“তাই ছিলেন। তবে এখন তাঁর পাকানো গোঁফ ঝুলে পড়েছে। রক্ত জল করা চাউনি ঘোলাটে মেরে গেছে, উঁচু গলায় কথাটি কন না। আর তা হবে না-ই বা কেন বলুন! কুমার বাহাদুরের লোকেরা যে তাঁকে তাঁর ছেলেপুলে, নাতিপুতির সামনেই পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে!”
“বল কী?”
“আজ্ঞে, এইসব বৃত্তান্ত শোনাতেই আসা।”
সভয়ে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে মহেন্দ্র বললেন, “বৃত্তান্ত আরও আছে নাকি?”
“বিস্তর মহারাজ। বিস্তর। বলতে গেলে মহাভারত।”
মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “না, গতিক সুবিধের নয়।”
“মহারাজ, যদি আম্পদ্দা বলে না ধরেন তা হলে শ্রীচরণে দুটো কথা নিবেদন করি।”
“বলে ফেলো বাপু।”
“রাজকুমার নরেন্দ্রর বাঁ বগলের নীচে একটা লাল জডুল ছিল।” মহেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, “ছিল নাকি?”
“আজ্ঞে। এই অধমের আর কিছু না থাক, ভগবানদত্ত দু’খানা চোখ আছে। রাজকুমার যখন ছোটটি ছিলেন তখন কোলেপিঠেও করেছি কিনা।”
“অ। তা জডুলের কথাটা উঠছে কেন?” মাথা চুলকে ভারী লাজুক মুখে শ্রীদাম বলল, “আজ্ঞে, জডুলটা এখন আর নেই।”
মহেন্দ্র সটান হয়ে বসে বললেন, “নেই! তা হলে সেটা গেল কোথায়?”
“আজ্ঞে, জডুল যথাস্থানে আছে।”
“এ তো বড় গোলমেলে কথা বাপু। একবার বললে জডুল ছিল, একবার বললে নেই, ফের বললে জডুল যথাস্থানে আছে! তা হলে মানেটা কী দাঁড়াল?”
“ব্যাপারটা যেমন গোলমেলে, তেমনই আবার জলের মতো সোজা। জডুলটা যথাস্থানে আছে মানে হল, সেটা অস্থানে নেই।”
“তা বাপু, জডুলটা ওরকম লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে কেন? এক জায়গায় গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলেই তো হয়!”
“জডুলকে দোষ দেবেন না মহারাজ। জডুলরা লাফালাফি করতে মোটেই পছন্দ করে না। যে জায়গায় থাকার, জতুল সেখানেই গ্যাঁট হয়ে বসে আছে।”
“তা হলে যে বললে ‘নেই’?”
“শুধু ‘নেই’ বলিনি মহারাজ, সেইসঙ্গে ‘আছে’ও বলেছি।”
“ব্যাপারটা তো তা হলে আরও জটিল হয়ে উঠল হে!”
“যে আজ্ঞে জজুল ব্যাপারটা খুবই জটিল। তবু যদি মহারাজ অভয় দেন তো বলি, রাজকুমার যখন ছোটটি ছিলেন তখন তাঁর বাঁ বগলের নীচে লাল একটা জডুল ছিল। যখন দিব্যি লম্বাচওড়া হয়ে আপনার কোলে ফিরে এয়েছেন তখন তাঁর বাঁ বগলের নীচে জডুলটার চিহ্নমাত্র নেই। এটা কী করে হয় একটু ভেবে দেখেছেন?”
রাজা মহেন্দ্র খুবই ভাবিত হয়ে বললেন, “তাই তো হে! এ তো বেশ সমস্যাঁতেই পড়া গেল দেখছি! তুমি কি বলতে চাও জডুলটা বাঁ বগলের নীচে থেকে ডান বগলের নীচে সরে গেছে?”
“না মহারাজ, সেটা বাঁ বগলের নীচেই আছে।” রাজা মহেন্দ্র হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু, জডুলটার মতিগতি আমি ভাল বুঝছি না।”
“একটু তলিয়ে ভাবুন মহারাজ, তা হলেই বুঝবেন।”
“ওরে বাপু, অত ভাবাভাবির কী আছে! বুঝিয়ে বললেই তো হয়।”
“আজ্ঞে, ফাঁদালো করে বলতে ভরসা হয় না মহারাজ। ঘাড়ে তো একখানা বই মাথা নেই। তাই টাপেটোপে বলছি।”
“কেন বাপু, ভেঙে বলতে দোষ কী?”
“গর্দান যেতে পারে। আপনিও কুপিত হতে পারেন।”
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “ওরে বাপু, আমি গর্দান টর্দান নিতে মোটেই পছন্দ করি না। বুড়ো বয়সে ঘটিবাটি তুলতেই মাজায় ব্যথা হয় তায় খাঁড়া। নির্ভয়ে বলো বাপু শ্রীদাম। জডুলটা বাঁ বগলে ছিল, এখন সেটা সেখানে নেই– এই তো?”
“যে আজ্ঞে।”
“আবার দেখা যাচ্ছে, যেখানকার জডুল সেখানেই আছে এই
তো?”
একগাল হেসে শ্রীদাম বলল, “এইবার বুঝেছেন। চেপে একটু ভাবলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবার।”
“তা বাপু, তুমি জডুলটা সম্পর্কে এত জানলে কী করে? বলি তোমার কি জডুলেরই কারবার নাকি?”
“আজ্ঞে না মহারাজ, আমার অন্যদিকে একটু হাতযশ আছে।”
“তা বাপু, জডুলের কারবারও কিছু খারাপ ছিল না। ধাঁ করে উন্নতি করে ফেলতে পারতে। তা তোমার হাতযশটা তা হলে কোন দিকে।”
মাথা নিচু করে শ্রীদাম ঘাড়টাড় চুলকে লজ্জার হাসি হেসে বলল, “আপনি দেশের রাজা, একরকম বাপের মতোই, কী বলেন!”
“অবশ্য, অবশ্য।”
“আগে দেশে কোটাল ছিল, কনিষ্ঠবল ছিল। আজকাল সে জায়গায় দারোগা এয়েছে, কনেস্টবল এয়েছে, ঠিক কিনা?”
“খুব ঠিক।”
“তা তারা কীজন্য এয়েছে বলুন?”
“তারা চোর-ডাকাত ধরতেই এসেছে।”
“তবেই দেখুন, চোর-ডাকাত ছাড়া দারোগা-পুলিশের চলে না, ঠিক তো!”
“খুব ঠিক।”
“আজ্ঞে, আমার তো মনে হয়, চোর-ডাকাত না থাকলে দেশটা যেন কানা হয়ে যায়। ভগবানের রাজ্যে সবাইকেই তো দরকার নাকি? বেড়ালকেও দরকার, ইঁদুরকেও দরকার, বাঘকেও দরকার, ছাগলকেও দরকার, সাদাকেও দরকার, কালোকেও দরকার, একটা
হলে যে অন্যটা ফুটে ওঠে না।”
“সে তো ঠিক কথাই হে শ্রীদাম।”
“তাই বলছিলাম, আমার মতো মনিষ্যির কিছু দরকার আছে বলেই এই অধমের সৃষ্টি হয়েছিল।”
“তা তুমি পুলিশ না চোর?”
“চোর বললে কি আপনি রাগ করবেন?”
“না হে বাপু, না, রাগ করব কেন? পরিশ্রম করে উপায় করা কি খারাপ? তা বলে বাপু, এ বাড়িতে কিন্তু সুবিধে হবে না তোমার।”
হাত কচলে শ্রীদাম বলে, “তা আর বলতে! এ বাড়িতে চোরের একাদশী, একসময়ে কত ঘটিটা বাটিটা সরিয়েছি। সেসব কথা ভাবতেও চোখে জল আসতে চায়। আহা, কী দিনকালই ছিল, রাজপুত্তুররা মোহর দিয়ে ঢিল মেরে মেরে আম পাড়ত। রাজবাড়ির কুকুরের গলায় বকলসের বদলে থাকত নেকলেস। পোলাও কালিয়া ছাড়া কাঙালি ভোজন হত না।”
“উঁহু উঁহু, অতটা বলার দরকার নেই। আর একটু চেপেচুপে বললেই হবে। তা হলে জডুলের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বলছ?”
“যে আজ্ঞে। একটু তলিয়ে ভাবুন। কাল আমি আবার এসে হাজির হব’খন। রাজকুমারের স্যাঙাত বাবাসকলের ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।”
রাজামশাই খুবই চিন্তিতভাবে জডুলের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগলেন। রাতে খেতে বসে রানিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা ইয়ে, তা নবেন্দ্রর বাঁ বগলের নীচে নাকি একটা লাল জজুল ছিল? আমি অবশ্য বিশ্বাস করিনি কথাটা। তা ছিল নাকি?”
রানি বললেন, “ও মা! বিশ্বাস না করার কী? আমার নবেনের বাঁ বগলের নীচে লাল জঙুল তো ছিলই। কেমন বাপ গো তুমি যে, ছেলের জডুলের কথা মনে রাখতে পার না?”
“তা বটে! মনে রাখাটা উচিতই ছিল। তা সেই জডুল নিয়েই একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। জডুলটা কি যথাস্থানে নেই। না মানে
যথাস্থানেই আছে, তবে আবার নাকি নেইও। আবার নাকি আছেও। ভারী গোলমেলে ব্যাপার। শ্রীদাম বলছিল বটে।”
“শ্রীদামটা আবার কে?”
“তার কথা আর বোলা না, সে একটা চোর। তবে লোকটা ভালই।”
“চোরও বলছ, আবার ভাল লোকও মনে হচ্ছে তাকে?”
“আহা, চোরদের মধ্যে কি ভাল লোক নেই! খুঁজলে বিস্তর পাওয়া যাবে।”
রানিমা ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “তবে কথাটা খুব মিথ্যে নয়। নবেনের বাঁ বগলের নীচে জঙুল নেই।”
“নেই! যাক, বাঁচা গেল। আমিও ভাবনায় পড়েছিলাম। তা জডুলটা গেল কোথায় বলো তো! ডান বগলের নীচে নাকি?”
“জজুল কি জায়গা বদল করে?”
“তা হলে?”
রানিমা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “মনে হয় ঘামাচিটামাচি চুলকোতে গিয়ে জডুলটা উঠে গেছে।”
“তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল।”
রানিমা হঠাৎ চোখ পাকিয়ে বললেন, “তুমি কি ভাবছ জডুল নেই বলে এ আমার নবেন নয়?”
“তাই বললুম নাকি? রামোঃ, একথা আমার মাথাতেই আসেনি, নবেন নয় মানে? আলবত নবেন। ওর ঘাড়ে ক’টা মাথা যে নবেন না হবে?”
“তাই বলো! আমি কিন্তু দেখেই চিনেছি। সেই মুখ, সেই চোখ, সেই দুষ্টু দুষ্টু ভাব। আহা, এখনও সেই এটা খাব-ওটা খাব বলে বায়না।”
বলে রানি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
মহেন্দ্র বললেন, “জডুলটা তা হলে ওই ঘামাচির সঙ্গেই উঠে গেছে বলছ!”
“কেন, ওরকম কি হতে নেই?”
“তা হবে না কেন? হতেই পারে। জঙুল তো দেখছি নিতান্তই ফঙ্গবেনে জিনিস।”
“জল নিয়ে আর মাথা গরম কোরো না তো! এতবড় ছেলেটাকে আস্ত ফেরত পেলে, তাতে গাল উঠছে না নাকি? জডুলটা ফেরত আসেনি তো কী হয়েছে? ছেলে বেশি, না জডুল বেশি?
“আহা, ছেলের সঙ্গে জডুলের কি তুলনা হয়? ওসব নয় রানি, ভাবছি চোরটা এলে তাকে কী বলব! জডুলটা আছে, না নেই?”
“চোরছ্যাঁচড়ার সঙ্গে অত মেলামেশার তোমার দরকার কী?”
“চোর হলেও সে আমার প্রজা, সন্তানবৎ। বুঝলে না! থাকগে, জতুল নিয়ে তা হলে আর মাথা ঘামাচ্ছি না।”
“একদম না। নবেন ফিরে এসেছে, সেই আমার ঢের। জডুল চুলোয় যাক।”
পরদিন দুপুরবেলা একগাল হাসি নিয়ে শ্রীদাম এসে প্রণাম করে সামনে দাঁড়াল।
রাজা মহেন্দ্র তাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, “ওহে, বোসো, বোসো৷”
“তলিয়ে ভাবলেন নাকি মহারাজ?”
“তা আর ভাবিনি! যা একখানা সমস্যা ঢুকিয়ে দিয়ে গেলে মাথায় যে, আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। তোমাদের রানিমার সঙ্গে কথা হল। তা বুঝলে বাপু, জডুলটা নাকি ঘামাচি চুলকোতে গিয়ে উঠে গেছে।”
“যে আজ্ঞে।”
“সেরকম কি হয় না?”
“আজ্ঞে, রাজা-রাজড়াদের ঘরে কী না হয় বলুন! সবই হতে পারে। তবে রাজামশাই, আপনি আরও একটু তলিয়ে ভাবলে জড়ুলের একেবারে গোড়ায় যেতে পারবেন।”
“জডুলের গোড়ায়? সেখানে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?”
“আজ্ঞে, না গেলেই যে নয়!”
“কেন বলো তো?”
“ওখানেই সব রহস্য ঘাপটি মেরে আছে।”
“হুঁ, তা তোমার রানিমা অবশ্য বলেছিলেন ছেলে বেশি না জডুল বেশি। উনি দেখলুম জডুলের বিশেষ ভক্ত নন।”
“আজ্ঞে। তবে কিনা জডুল বাদ দিলে রাজকুমারের যে আর কিছুই থাকে না।”
“আচ্ছা, শ্রীদাম, তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে এ-ছেলেটা আমাদের নবেন নয়?”
শ্রীদাম জিভ কেটে বলল, “আরে ছিঃ ছিঃ! উনি যখন বলছেন উনিই নবেন, তখন নবেন ছাড়া আর কে হবেন?”
“আমারও সেই কথা। নবেন যখন বলছে সে নবেন, তখন আমাদের আপত্তি করার কী আছে? কী বল?”
ঘন ঘন দু’ধারে মাথা নেড়ে শ্রীদাম বলে, “আমারও আপত্তি হচ্ছে না মহারাজ। নবেন হতে বাধা কী? যে কেউ নবেন হতে পারে!”
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “পারেই তো। জডুলটা ফেরত আসেনি তো কী হয়েছে?নবেন তো ফিরেছে! আর শুধু জঙুলই বা কেন, নবেনের ডান হাঁটুতে একটা ফোড়া কাটার দাগ ছিল, সেটা ফেরত আসেনি। ডান হাতের কনুইয়ের কাছে একটা আঁচিল ছিল, সেটাও ফেরত আসেনি। একবার চিল ছোঁ মেরে হাত থেকে রসগোল্লা নিয়ে যাওয়ার সময় নবেনের কপালে আঁচড় দিয়ে গিয়েছিল, সেই দাগটাও ফেরত আসেনি। তা ওসব তুচ্ছ জিনিসের জন্য কি আমাদের দুঃখ করা উচিত! নবেন যে ফিরেছে এই ঢের।”
শ্রীদাম চোখ বড় বড় করে বলল, “তবে যে শুনেছিলুম মহারাজ, আপনি চোখে কম দেখেন!”
“দেখিই তো! চোখে কম দেখি, কানে কম শুনি। এই যে তুমি সামনে দাঁড়িয়ে আছ, এই তোমাকেই ঠিকমতো ঠাহর হচ্ছে না। একবার মনে হচ্ছে আছো, একবার মনে হচ্ছে নেই।”
গদগদ স্বরে শ্রীদাম বলে, “এরকম কম দেখলেই হবে মহারাজ। এখন থেকে এরকম কমই দেখতে থাকুন।”
মহেন্দ্র একটু তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, “তা বাপু শ্রীদাম।”
“যে আজ্ঞে।”
“তুমি যেন বলেছিলে জডুলটা যথাস্থানেই আছে। ঠিক শুনেছিলুম তো?”
“আজ্ঞে ঠিকই শুনেছেন।”
“তা হলে কি ধরে নেব যে, তুমি জডুলটার সন্ধান জান?”
“আমার যা কাজ তাতে সুলুকসন্ধান না রাখলে কি চলে মহারাজ?”
“তা তো বটেই, তা বলছিলুম কি, সুলুকসন্ধান দিতে কত মজুরি চাও?”
নিজের দুটো কান ধরে শ্রীদাম বলে, “ছিঃ ছিঃ মহারাজ, মজুরির কথা ওঠে কীসে? রাজবাড়ির নুন কি কম খেয়েছি?”
“ভাল, ভাল, মজুরি চাইলেও দিতে পারতুম না কিনা, তা হলে সুলুকসন্ধানটা কি বিনি মাগনাতেই দেবে?”
শ্রীদাম বুকটা চিতিয়ে বলে, “মহারাজ, রাজার জন্য প্রজা না পারে কী? প্রয়োজন হলে প্রাণটা পর্যন্ত পিরিচে করে এনে পায়ে নিবেদন করতে পারে।”
“বাঃ বাঃ, শুনে বড় খুশি হলুম।”
শ্রীদাম এবার একটু মাথা চুলকে বলে, “তবে মহারাজ, একটা কথা আছে।”
“কী কথা হে বাপু?”
“জানাজানি হলে জডুলের কিন্তু প্রাণসংশয় হবে। যার জডুল নেই সে জডুলওলাকে খুঁজে বেড়াবেই। পেলেই ধড় মুন্ডু আলাদা করবে। মুন্ডু না থাকলে জডুলের আর দাম কী বলুন।”
মহেন্দ্র চমকে উঠে বললেন, “থাক, থাক, আর বলতে হবে না। জডুল যথাস্থানে থাকলেই হল।”
বিগলিত হেসে হাতটাত কচলে শ্রীদাম বলল, “আজ্ঞে, যথাস্থানের জডুলের হুকুমেই আপনার শ্রীচরণ দর্শনে আসা আমার।”
রাজা মহেন্দ্র হঠাৎ বার্ধক্য ঝেড়ে পটাং করে সোজা হয়ে বড় বড় চোখে চেয়ে বললেন, “বল কী!”
“আজ্ঞে, আমি যেখান থেকে আসছি সেখানে যথাস্থানে জড়ল আছেই, সেইসঙ্গে ডান হাঁটুতে ফোড়া কাটার দাগ, ডান কনুইতে আঁচিল, চিলের আঁচড় সব পাবেন।”
“আমার যে বুক ধড়ফড় করছে শ্রীদাম!”
“তা করে একটু করুক মহারাজ, ধড়ফড়ানিটা কমলে বলবেন। বাকিটা বলব। আমি বসছি।”
“না, না, বলো।”
“যে আজ্ঞে, আমার ওপর হুকুম হয়েছে আপনাকে তিনটে কথা বলে যেতে।”
“বলে ফেলো শ্রীদাম, বলে ফেলল।”
“কথাগুলো হচ্ছে ম্যাজিশিয়ান, বারো ধাপ, ভূত ঘর, কিছু বুঝতে পারলেন মহারাজ?”
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু। আরবি, ফারসি নয়
তো?”
“আজ্ঞে, নিতান্ত বাংলা কথাই তো মনে হচ্ছে।”
“এর মানে কী?”
“তা তো জানি না মহারাজ। কথাগুলো আপনি মনে মনে একটু নাড়াচাড়া করুন। মনে হয় কিছু একটা বেরিয়ে পড়বে।”
ঠিক এই সময়ে হঠাৎ ছাদের দরজায় বিভীষণের মতো চেহারার একটা লোকের আবির্ভাব হল। বাজডাকা গলায় লোকটা পিলে চমকানো হুংকার ছাড়ল, “অ্যাই, তুই কে রে? এখানে কী মতলবে?”
দেখা গেল শ্রীদাম রোগাভোগা মানুষ হলেও খুব ঠান্ডা মাথার লোক। একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে তাড়াতাড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে একগাল হেসে বলল, “সনাতনদাদা যে! প্রাতঃ পেন্নাম! প্রাতঃ পেন্নাম!”
লোকটা যমদূতের মতো সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভাঁটার মতো চোখে শ্রীদামকে মাথা থেকে পা অবধি দেখে নিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “তোকে কে বলেছে যে আমার নাম সনাতন?”
ভারী অবাক হয়ে শ্রীদাম বলল, “সনাতন নয়! এঃ হেঃ!? তা হলে তো বড় ভুল হয়ে গেছে মশাই! আমি যেন কেমন সনাতন সনাতন গন্ধ পেলাম!”
“এ বাড়িতে কেন ঢুকেছিস?”
শ্রীদাম ভালমানুষটির মতো বলে, “ঢাকাটা কি ভুল হয়েছে মশাই? তা হলে না হয় বেরিয়ে যাচ্ছি।”
“বেরোনো অত সোজা নয়!” বলেই ভয়ংকর লোকটা হাত বাড়িয়ে শ্রীদামের ঘাড়টা ক্যাঁক করে ধরে ফেলল। রাজা মহেন্দ্র অবাক হয়ে দেখলেন, বিভীষণটা শ্রীদামের ঘাড়টা ধরল বটে, আবার যেন ধরলও না! শ্রীদাম ভারী বিনয়ের সঙ্গে ঘাড়সুষ্ঠু মাথাটা কেমন করে যেন লহমায় সরিয়ে নিল।
সনাতন খুব অবাক হয়ে শ্রীদামের দিকে চেয়ে “তবে রে” বলে থাবড়া তুলে এগিয়ে যেতেই শ্রীদাম বলে উঠল, “মারবেন না মশাই, মারবেন না। আমার বড্ড নরম শরীর। মারলে বড় লাগে।”
সনাতন নামক দৈত্যটা বিদ্যুৎগতিতে গিয়ে শ্রীদামের ওপর এমনভাবে পড়ল যে, শ্রীদামের পিষে যাওয়ার কথা। রাজা মহেন্দ্র ভয়ে চোখ বুজে ফেললেন। চোখ চেয়ে দেখেন, বিভীষণটা গদাম করে ছাদের ওপর পড়ে গেল। তারপর “বাবা রে, মা রে” বলে আছাড়িপিছাড়ি খেতে লাগল। শ্রীদাম ছাদের কার্নিশের ধার থেকে মহেন্দ্রকে একটা পেন্নাম করে বলল, “তা হলে আজ আসি রাজামশাই, মাঝে মাঝে শ্রীচরণ দর্শনে চলে আসব’খন, ভাববেন না,” বলেই রেলিং টপকে নেমে গেল।
মহেন্দ্র একটা ভারী আরামের শ্বাস ছাড়লেন। দুদ্দাড় করে বাড়ি কাঁপিয়ে দৈত্য দানোর মতো নবেন্দ্রর স্যাঙাতরা সব ছাদে এসে হাজির। তারপর তুমুল চেঁচামেচি, “কে মারল সনাতনকে! কার ঘাড়ে ক’টা মাথা, কার এত আম্পদ্ধা! আজ রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব। তার মুন্ডু নিয়ে পান্তুয়া খাব। বুকের পাটা থাকে তত বেরিয়ে আয় ব্যাটা!”
রাজপুত্র নবেন্দ্র গম্ভীর মুখে মহেন্দ্রর সামনে এসে দাঁড়াল, “এসব কী বাবা!”
মহেন্দ্র জুলজুল করে নবেন্দ্রর দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, কী একটা চেঁচামেচি হল যেন শুনলাম, কানে ভাল শুনতে পাই না তো! কী ব্যাপার বলো তো বাবা! এত হুলুস্থুলু কীসের?”
“তোমার কাছে কে এসেছিল?”
মহেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, “কেউ আসেনি তো! ওঃ হোঃ বোধ হয় একটা গোর ঢুকে পড়েছিল কোনও ফাঁকে।”
“গোরু! ছাদের ওপর গোরু কী করে আসবে?”
মহেন্দ্র ভারী অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে বললেন, “ছাদ! এটা ছাদ নাকি? এই দ্যাখো, বুড়ো বয়সের ভিমরতি আর কাকে বলে, উঠোনে গিয়ে রোদে বসব বলে বেরিয়ে ভুল করে ছাদে এসে পড়েছি বোধ হয়।”
রাজপুত্র নবেন্দ্র তার স্যাঙাতদের দিকে ফিরে বলল, “এখন থেকে তোমরা আরও সতর্ক থাকবে। ফের যদি গাফিলতি দেখি তা হলে কিন্তু চাবকে ঠান্ডা করে দেব।”
সনাতনকে ধরাধরি করে তোলা হল। সে এখনও কাতরাচ্ছে। নবেন্দ্র তার দিকে চেয়ে বলল, “তোমার বাহাদুরি দেখলাম। শরীরটাই বাগিয়েছ, যোগ্যতা বলে কিছু নেই। দূর হয়ে যাও আমার সুমুখ থেকে।”
মহেন্দ্রর দিকে ফিরে নবেন্দ্র গম্ভীর গলায় বলল, “এখন থেকে বাইরের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করার কোনও দরকার নেই বাবা। আমি যখন এসে গেছি তখন আমিই সবদিক সামলাব।”
মহেন্দ্ৰ খুশি হয়ে বললেন, “বেঁচে থাকো বাবা, বেঁচে থাকো, আমিও তো তাই চাই।” নবেন্দ্রকে খুবই চিন্তিত দেখাল, কী যেন বিড়বিড় করে বলতে বলতে নীচে নেমে গেল।