ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৫. রাজরক্তের দাবি

৫. রাজরক্তের দাবি

পর্বতবেষ্ঠিত বন্ধুর বনপথ কোথাও কোমল তৃণদলের আবৃত শ্যামল-সবুজ, কোথাও বা প্রস্তর সজ্জায় রুক্ষ, কঠিন। সেই পথ মাড়িয়ে অশ্বের বলগা ধরে দ্রুত পদচালনা করে এগিয়ে চলেছে সুবন্ধু এবং নীরবে অনুসরণ করছে রাজকুমারী ছায়া আর বণিক আর্সাসেস….

অবশেষে সেই সুদীর্ঘ বনপথ অতিক্রম করে সঙ্গীদের নিয়ে সুবন্ধু উপস্থিত হল জঙ্গল ঘেরা একটি ফাঁকা জমির একপ্রান্তে। সম্মুখে দৃষ্টিপাত করেই তার ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, এই হতভাগা জন্তুগুলো দেখছি মাটির তলায় লুকিয়ে রাখা মৃতদেহেরও সন্ধান পায়!

সুবন্ধুর বিরক্তির কারণ একটি নেকড়ে ও তিনটি শেয়াল। ফাঁকা জমির একপাশে যেখানে একটি তলোয়ারের হাতল মাটির উপর উঁচু হয়ে মাথা তুলেছে, সেইখানে পুঁতে রাখা অস্ত্রের কাছেই সামনের দুই থাবা দিয়ে সজোরে ও সবেগে মাটি খুঁড়ে চলেছে একটি বিপুলবপু নেকড়ে এবং নিরাপদ ব্যবধানে দাঁড়িয়ে নেকড়ের কার্যকলাপ লুব্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে তিনটি শেয়াল। মাঝে মাঝে কোনো কোনো দুঃসাহসী শেয়াল ধৈর্য হারিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু নেকড়ে দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিতেই আবার পিছিয়ে যাচ্ছে সভয়ে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বন্য নাটকের দৃশ্যটি উপভোগ করল সুবন্ধু, তারপর পিঠ থেকে ধনুক নামিয়ে তীর ছোঁড়ার উপক্রম করল। উদ্যোগ ব্যর্থ হল, তাকে বাধা দিয়ে বণিক বলে উঠল, অনর্থক জীবহত্যার প্রয়োজন কী? ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দাও। তোমার স্বীকারোক্তি যদি সত্য হয়, তাহলে ভূগর্ভে প্রোথিত আজাক্সের মৃতদেহের নিশানা দিচ্ছে ওই তরবারি– তাই নয় কি?

শুধু আজাক্স নয়, সুবন্ধু বলল, কবর খুঁড়লে দেখতে পাবে আজাক্সের সঙ্গে আলিঙ্গনে বন্ধ হয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে এক সিংহী।

তাহলে, সম্মুখে পদচালনা করে বণিক বলল, আজাক্সের তলোয়ার দিয়েই আমি কবর খুঁড়ে দেখব। তোমরা এইখানে দাঁড়াও…

খননকার্য থামিয়ে নেকড়ে দেখল একটি মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে। মাটির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা যে বস্তুটির তলা থেকে গোপন আহার্যের গন্ধ তাকে আকৃষ্ট করেছে, সেই বস্তুটি তার অপরিচিত নয়। বহুদিন আগে দল বেঁধে তারা একটি নিঃসঙ্গ মানুষকে আক্রমণ করেছিল মানুষটি ওই ধরণের একটি জিনিস হাতে নিয়ে আঘাত করতেই দলপতির মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং দলের আর সকলের সঙ্গে সে নিজেও স্থানত্যাগ করে সরে পড়েছিল বিদ্যুৎ বেগে।

নেকড়ে একনজর তাকিয়ে দেখে নিলে মানুষটির হাতে কোনো মারাত্মক জিনিস নেই, তার দুই হাতই শূন্য তবে তার কোমরে একটা সন্দেহজনক বস্তু ঝুলছে বটে!

মানুষটি আর একটু এগিয়ে আসতেই নেকড়ে দাঁত খিঁচিয়ে এক ধমক দিল। নেকড়ে বরাবরই দেখেছে দ্বিপদ মানুষগুলো তাকে সমীহ করে চলে কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া মানুষটা তার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না, তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নির্বিকারভাবে এসে দাঁড়াল মাটিতে পুঁতে রাখা জিনিসটার সামনে! উদ্বিগ্নাক্ষে মানুষটার কোমরে বাঁধা বস্তুটির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল নেকড়ে নাঃ, ভয়ের কারণ নেই আগন্তুক ওই মারাত্মক বস্তুকে ব্যবহার করতে চাইছে না, সেটা তার কোমরেই ঝুলছে। আশ্বস্ত হয়ে নেকড়ে আর একবার গর্জন করল, অর্থাৎ- তফাৎ যাও, নইলে মরবে।

শ্বাপদের আস্ফালনে কর্ণপাত না করে আগন্তুক মাটিতে পুঁতে রাখা বস্তুটির হাতল ধরে সজোরে আকর্ষণ করল পরক্ষণেই মাটির তলা থেকে তার হাতে উঠে এল একটি তলোয়ার!

নেকড়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে আবার গর্জন করল, তার গাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল, লাঙুল হল আড়ষ্ট সে এইবার ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে! দ্বিপদ এইবার আক্রমণে উদ্যত শ্বাপদের দিকে ফিরল, হাতের মাটি মাখা অস্ত্র তুলে ভীষণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। মানবকণ্ঠের সেই ভয়ংঙ্কর রণনিনাদ শ্বাপদের সর্বাঙ্গে জাগিয়ে তুলল আতঙ্কের শিহরণ- নেকড়ে বুঝল এইখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত সে পিছন ফিরে ছুটতে শুরু করল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল নিবিড় অরণ্যের অন্তরালে! শেয়ালরা তার চাইতে বুদ্ধিমান, তারা অনেক আগেই ভোজের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে স্থানত্যাগ করেছিল.. অদুরে দন্ডায়মান সুবন্ধুর দিকে তাকিয়ে গভীম স্বরে বণিক বলল, আর্যযোদ্ধা! তোমাকে সন্দেহ করেছিলাম, তোমার কথা বিশ্বাস করি নি- সেইজন্য আমি অনুতপ্ত। আমাকে ক্ষমা করো।

অসির আঘাতে ছিন্নভিন্ন মৃত্তিকাস্তূপের তলা থেকে বণিকের পদপ্রান্তে আত্মপ্রকাশ করেছে মৃত্যু আলিঙ্গনে বদ্ধ গ্রীকসৈনকি আজাক্স এবং এক সিংহীর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ!

মৃতদেহ দুটির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল সুবন্ধু, তারপর বণিকের চোখের দিকে তাকিয়ে নীরসকণ্ঠে বলল, এখন তুমি সন্তুষ্ট হয়েছ তো?… ভালো। আশা করি এবার আমাদের নিষ্কৃতি দেবে?

–আমি তো অনুতাপ প্রকাশ করেছি। অপমান যদি করে থাকি, তার জন্য ক্ষমাও চেয়েছি। শত্রুও যদি অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তাহলে বীরপুরুষ মনের মধ্যে ক্ষোভ পুষে রাখে না। আর আমি তো তোমার শত্রু নই।

শত্রু না হয়েও তুমি চরম শত্রুতা করেছ। তুমি আমদের এখানে আসতে বাধ্য করেছ। অশ্বারোহণে অগ্রসর হলে এতক্ষণে আমরা বাহিক রাজ্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। আমার অশ্ব দুটি মানুষের দেহভার বহন করতে সমর্থ। বাকি রাজ্যে পৌঁছে আমরা কিয়ৎকাল বিশ্রামের সুযোগ পেতাম। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে দেখা দেওয়ার আগে যুদ্ধ শুরু করার নিয়ম নেই। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে যাত্রা করলে আমরা সন্ধ্যার আগেই অকুস্থলে পৌঁছালাম, অতএব চন্দ্রোদয় পর্যন্ত বিশ্রাম করে পরিশ্রান্ত শরীরকে কিছুটা সুস্থ করে নেওয়ার সুযোগও পেতাম। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি। তাতে যুদ্ধের আগে বিশ্রামলাভের আশা নেই। পথভ্রমণে শ্রান্ত দেহ নিয়ে আমাদের দুজনকে তিনটি দুর্ধর্ষ প্রতিদ্বন্দীর বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে নামতে হবে। বণিক! এই অঘটনের জন্য দায়ী কে?

দায়ী আমি। কিন্তু আমি তো বলেছি আমি অনুতপ্ত। শুধু মুখের কথায় অনুতাপ প্রকাশ করে আমি ক্ষান্ত হব না, শুধু মার্জনাভিক্ষা করে আমি সরে যাব না– শানিত তরবারির ফলকে আমি অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে প্রস্তুত।

–শানিত তরবারির ফলকে তুমি অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবে?… বণিক আর্সাসেস! তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।

বুঝতে পারছ না? তাহলে বুঝিয়ে বলছি, শোনো। বাহ্রিক রাজকন্যার সব কথাই তোমার কাছে শুনেছি। আসন্ন যুদ্ধে তিনজনের পরিবর্তে তোমরা দুজনেই অংশ গ্রহণ করতে চলেছ। কারণ, উপযুক্ত তৃতীয় ব্যক্তির সন্ধান তোমরা পাওনি। বেশ, আমি তোমাদের তৃতীয় ব্যক্তির সন্ধান দিয়ে প্রমাণ করে দেব আমার পূর্বাকৃত অন্যায়ের জন্য আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে উৎসুক।

বণিক আর্সাসেস! তুমি কী বলছ! সুবন্ধু বিস্মিতকণ্ঠে বলে উঠল, এখন মধ্যাহ্ন। রাত্রির প্রথম প্রহরের আগে আমরা বাকি রাজ্যে পৌঁছাতে পারব বলে মনে হয় না। এইটুকু সময়ের মধ্যে রণনিপুণ তৃতীয় ব্যক্তির সন্ধান কোথায় পাব জনহীন পর্বতমালা ও অরণ্যের গর্ভে?

এখানেই পাবে, বণিকের ওষ্ঠধরে ফুটল মৃদু হাস্য, আমিই হব সেই তৃতীয় ব্যক্তি। তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমিও ফাল্গুনী-পূর্ণিমা রাত্রের মরণ খেলায় যোগ দিতে প্রস্তুত… নীরব কেন? তুমি পেশাদার যোদ্ধা-পুরস্কারের লোভে জীবন পণ করে যুদ্ধে নামতে সম্মত হয়েছ তোমার সাহায্যে যুদ্ধে জয়ী হলে এই রাজকন্যা পিতৃরাজ্যের সিংহাসন অধিকার করতে সমর্থ হবে, বিনিময়ে তোমাকে নিশ্চয়ই প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে পুরস্কৃত করবে।

আমি যদি রাজকন্যার পক্ষে অসিধারণ করে জয়লক্ষ্মীর বরমাল্য ছিনিয়ে আনতে পারি, তাহলে আমিও আমার পছন্দমতো পুরস্কার চেয়ে নেব আশা করি এখনকার রাজকন্যা আর তখনকার মহারানী আমার প্রাপ্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করবেন না।

ছায়া এতক্ষণ নীরব ছিল, এইবার সে মৌনভঙ্গ করল, আর্সাসেস! তুমি ভুলে গেছ এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার একটি শর্ত আছে- ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে সিংহাসনের দাবিতে যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়, দেহে রাজরক্ত না থাকলে কোনো যোদ্ধা সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে না। বণিক! ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অধিকার তোমার নেই। তবে তুমি যে আমাদের জন্য প্রাণবিপন্ন করতেও কুণ্ঠিত নও, একথা জেনে আমি খুশি হলাম। তোমার আন্তরিক সদিচ্ছায় সন্দেহ করার কারণ আর রইল না। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেছে– দুধর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হব সম্ভবতঃ এই যুদ্ধে আমরা মৃত্য বরণ করব, কিন্তু এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সুবন্ধুর অসামান্য রণকৌশলের যেটুক পরিচয় পেয়েছি, তার উপর ভরসা করেই আজ রাত্রে ভাগ্যের সঙ্গে জুয়া খেলব। তারপর?- যা হওয়ার তা হবে।

নিশ্চয়, ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই, বণিকের মুখের হাসি অম্লান, তবে রাজকন্যা, ভাগ্য বোধহয় তোমার প্রতি খুব নির্দয় নয়। তোমাদের সঙ্গে তলোয়ার হাতে আমিও আজ রাত্রে ভাগ্যপরীক্ষা করব। রাজরক্তের কথা আমি ভুলি নি। তুমি আশ্বস্ত হও, আমার দেহেও রাজরক্ত প্রবাহিত।

সুবন্ধু ও ছায়া চমকে উঠল। এ যে অভাবনীয়! বণিকের দেহে রাজরক্তের অস্তিত্ব যে অবিশ্বাস্য!

বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করল রাজকন্যা, আর্সাসেস! শুধু মুখের কথায় বাহিকরাজ্যের পুরোহিত বিশ্বাস করতে চাইবেন না। যুদ্ধের আগেই যোদ্ধাদের প্রমাণ করতে হবে তারা রাজরক্তের অধিকারী।

যথাসময়ে আমি প্রমাণ করব আমার শরীরে রাজরক্ত প্রবাহিত, বণিকের গম্ভীরকণ্ঠে এখন আর হাসির রেশ নেই, কিন্তু তার আগেই যুদ্ধে জয়লাভ করলে আমার প্রাপ্য পুরস্কার সম্বন্ধে রাজকন্যার প্রতিশ্রুতি চাই।

রাজকন্যা কিছু বলার আগেই সুবন্ধু সবিস্ময়ে বলে উঠল, যুদ্ধে জয়-পরাজয় যখন অনিশ্চিত, তখন জীবনকে বাজি রেখে মৃত্যুর সঙ্গে জুয়া খেলতে পারে পেশাদার যোদ্ধা কিন্তু বাণিজ্যজীবী বণিক হয়ে পেশাদার যোদ্ধার ন্যায় তুমি বাণিজ্য করতে চাইছ তরবারির শাণিত ফলকে! তোমার প্রস্তাব আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিয়েছে!

আমিও বিস্মিত হয়েছি, কিন্তু সেইসঙ্গে যথেষ্ট আশ্বাসও পেয়েছি, রাজকন্যা বলল, এই দুঃসময়ে একজন দক্ষ যোদ্ধার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমার অন্তরে নূতন আশার সঞ্চার করছে। বণিক আর্সাসেস! তোমার পোশাক পারসীক বণিকের মতন হলেও তোমার চালচলনে অস্ত্র চালনায় অভিজ্ঞ রাজপুরুষের স্বাতন্ত্র অতিশয় স্পষ্ট। আমি এই তরবারি স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করচ্ছি যুদ্ধে জয়ী হয়ে, যদি আমি পিতৃরাজ্য উদ্ধার করতে পারি তবে তোমার কোনো প্রার্থনাই আমি অপূর্ণ রাখব না। বলো, তুমি কী চাও? আমার তরফ থেকে বলতে পারি রাজকোষে সঞ্চিত অর্থের অর্ধাংশ তোমাকে দিতেও আমি আপত্তি করব না।

–ধনরত্ন চাই না। তোমার বন্ধুত্ব পেলেই আমি খুশি।

-বলো কী! তুমি বলেছিলে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে তুমি প্রাণবিপন্ন করতেও কুণ্ঠিত হবে না। তাই কি এই প্রস্তাব?

-হয়তো তাই। তবে আমার একটি অনুরোধ আছে।

–কী অনুরোধ? বলো। সম্ভব হলে অবশ্যই তোমার অনুরোধ রক্ষা করব।

বণিক কিছুক্ষণ নতমস্তকে চিন্তা করল, তারপর মুখ তুলে রাজকন্যার চোখে চোখ রাখল, যদি জয়ী হয়ে পিতৃরাজ্যের সিংহাসন অধিকার করতে পারো, তাহলে প্রতিজ্ঞা করো তুমি গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের আনুগত্য স্বীকার করবে– কখনো কোনো কারণেই তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না।

রাজকুমারী বিস্মিতকণ্ঠে বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমার সহায়তায় যদি পিতৃরাজ্য উদ্ধার করতে পারি, তাহলে গ্রীক সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করব। কিন্তু পারসীক, আমি সম্রাট আলেকজান্ডারের অনুগত হলে তোমার কী লাভ?

সুবন্ধু বলল, হ্যাঁ, আমারও সেই প্রশ্ন বাহিকরাজ্যের রানী যদি গ্রীকসম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে, তাহলে পারসীক বাণিজ্যজীবী আর্সাসেস কেমন করে লাভবান হয়? বিশেষতঃ গ্রীকদের সঙ্গে পারস্যবাসীর তো অহি– নকুল সম্পর্ক বলেই জানি।

-হে আর্যযোদ্ধা! তোমার কথা সত্য। তবে গ্রীকসম্রাট আলেকজান্ডার আমার অন্তরঙ্গ বান্ধব। গ্রীস ও পারস্যের অধিবাসীরা পরস্পর সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ করলেও আমরা দুজনে অভিন্নহৃদয় সুহৃদ দুই দেশের জাতিগত শত্রুতা আমাদের স্পর্শ করতে পারে না; বাল্যকাল থেকেই আমরা পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের বন্ধনে বদ্ধ।

ব্যাপারটা সত্যই আশ্চর্য, সুবন্ধু বলল, গ্রীকসম্রাটের স্বার্থরক্ষার জন্য এক পারসীক বণিক তার প্রাণবিপন্ন করছে, একথা ভাবাই যায় না।

–কেন সুবন্ধু? মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কি জাতির বিচার করে? বন্ধুত্বের বন্ধন কি দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ?… উত্তর দাও সুবন্ধু! নীরব কেন?

তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাধ্য বোধহয় আর্যযোদ্ধার নেই, রাজকন্যা স্মিতহাস্যে বলল, আমিও এই মুহূর্তে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব না। তবে এইটুকু বলতে পারি বিদেশি বণিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলে বাহ্লিকরাজ্যের অনার্য রাজকন্যা যৎপরোনাস্তি সুখী হবে।

আর্সাসেস! গভীরস্বরে সুবন্ধু বলল, পারসীক বণিকের সঙ্গে সখ্যতার সূত্রে আবদ্ধ হলে আর্যযোদ্ধা সুবন্ধু নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে… কিন্তু আর সময় নষ্ট করা অনুচিত। আমার ঘোড়ার পিঠে দুজনের উপযোগী খাদ্য রয়েছে, সেটাকে তিনভাগে ভাগ করা কঠিন নয়। মধ্যাহ্নভোজনের পরেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, অতএব বাক্যালাপে সময় নষ্ট করা উচিত হবে না।

.. মধ্যাহ্নের আহার সমাপ্ত হতেই শুরু হল পথচলার পালা। কয়েকঘন্টা আগে যখন তিন পথিক আজাক্সের সমাধিস্থলের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল তখন ঘোড়ার লাগাম ধরে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলছিল সুবন্ধু এবং তাকে অনুসরণ করছিল রাজকুমারী ছায়া এবং বণিক আর্সাসেস। এখন আবার পূর্বোক্ত তিন পথিক চলেছে বাকিরাজ্য অভিমুখে, কিন্তু পরিবর্তিত হয়েছে। দৃশ্যপট। সুবন্ধু পরিবর্তে এখন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে ছায়া, কিন্তু পদব্রজে নয় অশ্বপৃষ্ঠে! পায়ে হেঁটে তাকে অনুসরণ করছে তার দুই সঙ্গী।

ছায়া অবশ্য সহজে পদাতিক সঙ্গীদের সাহচর্য ত্যাগ করে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করতে রাজি হয় নি। কিন্তু আর্সাসেস যখন বলল রাজকুমারী যদি পথশ্রমের ক্লান্তি থেকে কিছুটা অব্যাহতি পায়, তাহলে যুদ্ধের সময়ে সতেজ দেহ নিয়ে সে অধিকতর রণনৈপুণ্য প্রকাশ করতে সমর্থ হবে এবং তার ফলে আসন্ন দ্বৈরথে জয়লাভের সম্ভাবনাও সমধিক তখন আর সে অশ্বারোহণে আপত্তি করতে পারল না।

বণিকের যুক্তি অকাট্য– মৃত্যুপণ যুদ্ধে ছায়ার দিক থেকে যদি তৎপরতার অভাব ঘটে, তাহলে তার সহযোগী যোদ্ধাদের জীবনও হবে বিপন্ন। অতএব ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঘোড়ার পিঠে আসন পেতে রাজকুমারী পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব গ্রহণ করল- কারণ, বাহ্লীকরাজ্যের পথ একমাত্র তারই জানা আছে, তার দুই সঙ্গী পূর্বোক্ত পথের অনভিজ্ঞ পথিক…

যাত্রীদের মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্যের রশ্মি ক্রমে ক্রমে স্তিমিত হল, অপরাহ্নের আগমনে আকাশের নীলিমায় পড়ল মলিন প্রলেপ… ধীরে ধীরে সেই ম্লান নীলিমার বুকে জাগল সন্ধ্যার রক্তরাগ এবং এক সময়ে রক্তিম আকাশকে কালিমায় আচ্ছন্ন করে দুলে উঠল কৃষ্ণা রাত্রির কালো আঁচল… দুর্গম পাহাড়ী পথের উপর দিয়ে তখনও এগিয়ে চলেছে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্টা সশস্ত্র রমণী আর দৃঢ় পদক্ষেপে অক্লান্ত চরণে তাকে অনুসরণ করছে দুই দুর্দান্ত পুরুষ…

পাহাড়ের তলায় নিচু জমির উপর পদ্মাসনে স্থির হয়ে বসেছিলেন বাহ্লিকরাজ্যের রাজ পুরোহিত। তাঁর স্কন্ধবেষ্টন করে চর্মবন্ধনীর সঙ্গে সংযুক্ত একটি বিশাল রণভেরী ঝুলছিল বুকের উপর। ওই ভেরীটি ছাড়া তাঁর কাছে অস্ত্রশস্ত্র কিছু নেই। পুরোহিত নিরস্ত্র। নিকটবর্তী অরণ্য ও পর্বতমালা বিভিন্ন শ্বাপদের প্রিয় বাসভূমি। কিন্তু অস্ত্রহীন হলেও রাজপুরোহিত জীবন বন্যপশুর কবলে বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না কিছুমাত্র কারণ, তাকে ঘিরে অবস্থান করছিল চারজন বলিষ্ঠ প্রহরী, তাদের কোমরে তলোয়ার আর হাতে ভল্ল। অতি দুঃসাহসী নরখাদক শ্বাপদও ফাঁকা জায়গায় চারটি অস্ত্রধারী মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস করবে না। অতএব, গভীর রাত্রে শ্বাপদ সংকুল স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় উপস্থিত থাকলেও পুরোহিত মহাশয়ের জীবন ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ।

 প্রহরীরা নিজেদের মধ্যে নতস্বরে কথা বলছিল। একজন বলল, প্রতি বৎসর ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে এখানে এসে আমাদের অনর্থক নিশিযাপন করতে হয়। কেউ কোনোদিন সিংহাসনের দাবি নিয়ে যুদ্ধঘোষণা করতে আসে না।

মৃদুস্বরে বললেও প্রহরীর কথা শুনতে পেলেন পুরোহিত, মৌন ভঙ্গ করে তিনি বলে উঠলেন, কেউ না আসলেও রাজপুরোহিতকে প্রতি বৎসর ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাত্রে এখানে উপস্থিত থাকতে হবে এবং তাকে বন্যপশুর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য চারজন দেহরক্ষীকেও এখানে আসতেই হবে। অর্থহীন এই প্রথা বিগত দুই যুগের মধ্যে কেউ সিংহাসনের দাবি নিয়ে এখানে উপস্থিত হয় নি।

আচম্বিতে পুরোহিত ও প্রহরীদের চমকিত করে জাগল বামাকণ্ঠে তীব্র স্বর, কিন্তু আমি আজ উপস্থিত হয়েছি। আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে আমি বাহিক রাজ্যের সিংহাসনে আমার দাবি জানাতে এসেছি। অন্তত আজকের রাতে বৃথা নিশিজাগরণের জন্য আপনাদের ক্ষোভ প্রকাশের হেতু রইল না।

সেদিকে তাকিয়ে সকলে দেখল অদুরে অবস্থিত উচ্চভূমির উপর এসে দাঁড়িয়েছে একটি মুর্তি! অন্ধকারের মধ্যে নিরেট কালো দিয়ে গড়া সেই মূৰ্ত্তির অঙ্গপ্রতঙ্গ বা মুখাবয়ব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান না হলেও সকলেই বুঝল আগন্তুক পুরুষ নয়- নারী।

স্তম্ভিত ও বিস্মিত রাজপুরোহিত এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় এমনই অভিভূত হয়ে পড়লেন যে, তাঁর বাগযন্ত্রে স্বর ফুটল না। আগন্তুক রমনী আবার চিৎকার করে বলল, পুরোহিত! আমি এসেছি। আপনি রণভেরীতে ফুকার দিন!

এতক্ষণে পুরোহিতের সংবিৎ ফিরে এল, তিনি বলে উঠলেন, রাজকুমারী! ছায়া! আমি জানি তুমি অস্ত্রচালনায় সিদ্ধহস্ত, রমনী হলেও যে কোনো পুরুষের তুমি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু একাকী তিনটি রণনিপুণ যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তোমার মৃত্যু অনিবার্য। এমন দুঃসাহসের প্রকাশ আত্মহত্যা নামান্তর। বৎসে! তুমি ফিরে যাও।

তীক্ষ্ণ হাসির শব্দে রাতেও স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে আবার জাগল রাজকুমারীর কণ্ঠস্বর, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। পুরোহিত! আমি আত্মহত্যা করার জন্য উদগ্রীব নই। আমার সঙ্গে রয়েছে আরও দুই সঙ্গী… সুবন্ধু! আর্সাসেস! তোমরা এগিয়ে এস রাজপুরোহিত তোমাদের দেখতে চাইছেন।

আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চভূমির উপর দাঁড়াল দুটি পুরুষ। একজনের পাশাপাশি হেঁটে এল একটি ঘোড়া। ঘোড়ার মালিক লাগাম ধরে অশ্বকে পরিচালনা করছে, যে কোনো কারণেই হোক, মানুষটি অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে নি।

ওদের আমার সামনে নিয়ে এস, পুরোহিত বললেন, আমি তোমার সহযোগী যোদ্ধাদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চাই।

রাজকুমারী তার সঙ্গীদের নিয়ে উচ্চভূমি থেকে নেমে এল। অশ্বটি স্থানত্যাগ করল না, সে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল প্রস্তর মূৰ্ত্তির মতো।

রাজকুমারীর সঙ্গীদের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন রাজপুরোহিত, তারপর তার দৃষ্টি নিবন্ধ হল রাজকুমারী ছায়ার মুখের উপর। বৎসে! তোমার এক সহকারী পেশাদার যোদ্ধা, জাতিতে আর্য অপর সহকারীর বেশভূষা ও চেহারা দেখে মনে হয় সে পারসীক বণিক… এমন আশ্চর্য সমন্বয়ের ঘটনা আগে কোনোদিন বাহ্রিক রাজ্যে ঘটেনি। বৎসে ছায়া! তুমি এই রাজ্যের ইতিহাসে এক চমকপ্রদ অধ্যায় রচনা করতে চলেছ। কিন্তু যুদ্ধে নামার আগে তোমাকে সতর্ক করে বলছি- এখনও নিরস্ত হওয়ার সময় রয়েছে। পেশাদার আর্যযোদ্ধা কখনও কোনো অনার্য পুরুষ বা রমনীর হাতে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে, এমন ঘটনা আমার জানা নেই— তবে আর্য পুরুষের বীরত্ব ও রণদক্ষতা প্রশ্নের অতীত, অতএব তোমার সহযোগী আর্যযোদ্ধা যে মৃত্যুপণ যুদ্ধের উপযুক্ত সঙ্গী সেবিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু।

হঠাৎ নীরব হলেন কেন পুরোহিত? ছায়া বলল, মনে হচ্ছে আমার অপর সঙ্গী বণিক আর্সাসেস আপনার মনে কিছু দ্বিধার সৃষ্টি করেছে। তাই নয় কি?

–তুমি আমার মনোভাব বুঝতে ভুল করোনি। হ্যাঁ, তোমার অপর সঙ্গী পারসীক বণিক সম্পর্কে আমি দ্বিধাগ্রস্ত। পারসীকের কটিদেশে তরবারি রয়েছে বটে, কিন্তু অস্ত্রের অস্তিত্ব অস্ত্রধারীর দক্ষতার প্রমাণ নয়। পেশায় বাণিজ্যজীবী এই বণিক হয়তো অস্ত্রচালনায় অভ্যস্ত, হয়তো ইতিপূর্বে দস্যু তস্করের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু মনে রেখো এখানে তার প্রতিদ্বন্দী হবে এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, অস্ত্রচালনায় অনভিজ্ঞ অশিক্ষিত দুবৃত্ত নয়। অর্থলোভে বণিক তোমার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত হয়েছে সে জানে না কোন ধরণের মানুষের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। রাজকুমারী! সে বিধ্বস্ত হলে তুমিও বিপদে পড়বে। তোমরা তিনজন রাজপক্ষের তিন যোদ্ধার বিরুদ্ধে দ্বৈরথে প্রবৃত্ত হলেও প্রকৃত দ্বন্দ্বযুদ্ধের নিয়ম অনুসারে এই যুদ্ধ চলে না। যোদ্ধাদের মধ্যে কেউ আহত বা নিহত হলে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বন্দ্ব যুদ্ধে ব্যাপৃত তার পক্ষের যে কোনো যোদ্ধাকে সাহায্য করতে পারে। ভেবে দেখ বৎসে! এই বণিক যুদ্ধে ধরাশায়ী হলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যদি তোমার পিতৃব্য ঋক্ষরাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমায় আক্রমণ করে, তাহলে দুজন পরাক্রান্ত যোদ্ধার কবলে তোমার মৃত্যু অবধারিত। বাকি রাজ্যের সর্বপেক্ষা কৌশলী ও বলিষ্ঠ দুই যোদ্ধা তোমার পিতৃব্যের সহকারী হবে, একথা ভুলে যেওনা। বণিককে হত্যা করার পর বিজয়ী যোদ্ধা আর্যযোদ্ধার পরিবের্ত তোমাকেই আক্রমণ করবে– কারণ, তোমাকে কেন্দ্র করেই এই যুদ্ধের অনুষ্ঠান, তোমার মৃত্যুতেই হবে সব দ্বন্দ্বের অবসান। আর্যজাতি রণদক্ষ সম্ভবত এই পেশাদার আর্যযোদ্ধা বাহিক রাজের নির্বাচিত দ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সমর্থ হবে, কিন্তু পেশায় বাণিজ্যজীবী এই বণিকের উপর ভরসা কতটুকু? আমার মনে হয় এই বণিকের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নেই, শুধু তার কথার উপর নির্ভর করে তুমি জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে চাইছ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তাই বলছি এখনও সময় আছে, তুমি ফিরে যাও এক বৎসর পরে আগামী ফাল্গুনী পূর্ণিমায় উপযুক্ত সঙ্গী নিয়ে আবার প্রত্যাবর্তন করো।

পুরোহিত! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, রাজকুমারী হাসল, পরাজয় নিশ্চিত জানলে আমি কখনই বাকি রাজ্যের অধিপতিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে এখানে উপস্থিত হতাম না। যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত, সেবিষয়ে আগে থেকে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে এইটুকু বলতে পারি বাহ্লিকরাজ্যের বর্তমান নৃপতি যদি জয়লাভ করে, সেই জয় খুব সহজে হবে না। বাহ্লিক রাজ্যের অর্থাৎ আমার পিতৃব্যের পক্ষে যে-দুজন যোদ্ধা লড়াই করবে, তাদের মধ্যে একজন আর কাল প্রভাতের সূর্যোদয় দেখতে জীবিত থাকবে না। স্বয়ং বাকিরাজ ও তার অন্য বন্ধুটি বেঁচে থাকলেও সর্বশরীরে এই যুদ্ধের ক্ষতবিক্ষত স্মৃতিচিহ্ন আজীবন ধারণ করবে– আমার এ কথা আপনি বিশ্বাস করুন।

-তুমি তাহলে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ?

–হ্যাঁ। পুরোহিত! আপনি আপনার কর্তব্য পালন করুন।

অগত্যা, পুরোহিত সুবন্ধুর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, তুমি নিশ্চয়ই জানো রাজরক্তের অধিকারী না হলে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যায় না।

জানি, সুবন্ধু উত্তর দিল, রাজকুমারী আমাকে যুদ্ধের ওই শর্ত প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন।

বেশ। তাহলে প্রমাণ দাও যে, তোমার দেহে রাজরক্ত প্রবাহিত। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া আমি কোনো ব্যক্তিকে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেব না।

সুবন্ধু পুরোহিতের সামনে এসে মৃদুস্বরে কিছু বলল। সেই কণ্ঠস্বর উপস্থিত কোনো ব্যক্তির কর্ণগোচর হল না। তারপর সে বামহস্তের অনামিকায় অবস্থিত অঙ্গুরীয়টি পুরোহিতের চোখের সামনে প্রসারিত করল।

ম্লান চালোকে সেই বৃহৎ অঙ্গুরীয়টির বৈশিষ্ট্য পুরোহিতের চোখে ধরা পড়ল। তিনি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, মগধের রাজচিহ্ন অঙ্কিত অঙ্গুরীয়! বুঝতে পারছি মগধের রাজকুলে তোমার জন্ম। কিন্তু তোমার নাম তো আমায় বলো নি? ওটাও বলতে হবে।

সুবন্ধু হাসল, আমাকে আপনি সুবন্ধু নামে সম্বোধন করতে পারেন। আর কিছু জানার আছে?

–না। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ; এবার বণিকের পালা… বণিক! তুমি পেশায় বাণিজ্যজীবী হলেও আশা করি তোমার দেহে রাজরক্ত আছে?

আছে।

–শুধু মুখের কথায় নয়, উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে আমায় বুজিয়ে দাও তোমার দেহে রাজরক্ত অবস্থান করছে।

আমি যে রাজবংশের মানুষ সেবিষয়ে অবহিত আছেন স্বয়ং গ্রীকসম্রাট আলেকজান্ডার। নগরে অবস্থিত গ্ৰীকশিবিরে সংবাদ দিলেই আমার কথার সত্যাসত্য নির্ধারিত হয়ে যাবে।

সেটা সম্ভব নয়। রাজকুমারী! এই বণিককে আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে রাজি নই। তুমি এবং সুবন্ধু যদি মহারাজ ও তার দুই সহকারী যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে সাহসী হও, তাহলে রণভেরীতে ফুৎকার করে জানিয়ে দেব ফাল্গুনী-পূর্ণিমার রাতে সিংহাসনের দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে বর্তমান নরপতির প্রতিদ্বন্দ্বী। ভেরীর বার্তা শ্রবণ করলেই তার দুই সহকারী নিয়ে এইস্থানে আবিভূত হবেন বাহ্লিকরাজ্যের অধিপতি। মনে রেখো, আসন্ন মৃত্যুপণ যুদ্ধে তোমাদের দুজনের বিরুদ্ধে অসিধারণ করবেন তিন মহারথী– বলল, বসে! বল– কী তোমার সিদ্ধান্ত?

রাজকুমারী আর মতামত প্রকাশ করার আগেই ধ্বনিত হল বণিক আর্সাসেসের সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, এক প্রতারক নৃপতির পুরোহিতের কাছে আত্মপরিচয় দিতে আমি ঘৃণাবোধ করি। আগেই বলেছি আমার ধমনীতে রাজরক্তের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত আছেন স্বয়ং সম্রাট আলেকজান্ডার। গ্রীকশিবিরে লোক পাঠিয়ে খবর নিলেই জানতে পারবেন আমার কথা মিথ্যা নয়। অনর্থক বিলম্ব না করে ভেরীতে ফুৎকার দিন।

-তুমি যে রাজবংশের মানুষ এই মুহূর্তে তার অকাট্য প্রমাণ না দিতে পারলে তোমকে আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেব না।

রে বর্বর! সিংহের মতন গর্জন করে উঠল আর্সাসেস, এখানে আসার আগে গ্রীকশিবিরে আমার গন্তব্যস্থল জানিয়ে এসেছি। আমার বাহিক রাজ্যে আগমনের কারণও সম্রাটের অজানা নয়। এই রাজকন্যা ছায়া ও আর্যযোদ্ধা সুবন্ধু সম্রাটের বিশেষ স্নেহভাজন। ইচ্ছা করলে গ্রীকবাহিনীর সাহায্যে তিনি অনায়াসে বর্তমান বাহিক রাজ্যের অধিপতিকে সিংহাসনচ্যুত করে রাজকন্যা ছায়াকে পিতৃরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। কিন্তু স্নেহের বশেও সম্রাট অন্যায় করতে অনিচ্ছুক তাই রাজ্যের প্রথা মেনে আমাকে এই রাজকন্যার সহকারী যোদ্ধা হতে আদেশ দিয়েছেন। আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে সম্রাট অপমানিত বোধ করবেন এবং এই রাজ্যের পক্ষে তার ফল হবে অতিশয় শোচনীয়-গ্রীকবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাবে বাকিরাজ্য। রাজা কিংবা রাজপুরোহিত কেউ নিস্তার পাবে না।

বণিকের ক্রুদ্ধ কণ্ঠের দর্পিত ঘোষণা শুধু পুরোহিতকে নয়, সকলকেই করে দিল নির্বাক, স্তব্ধ। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে কয়েকটি মুহূর্ত অতিবাহিত হল, তারপরই বুকের উপর দোদুল্যমান ভেরী তুলে পুরোহিত সজোরে ফুঁ দিলেন- তীব্র ভেরীর রব দিকে দিকে প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল দূর-দূরান্তে…।

রাজকুমারী ও তার দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে পুরোহিত বললেন, মহারাজ ঋক্ষ এখনই আসবেন। ভেরীর শব্দ নিশ্চয়ই প্রসাদের প্রহরীরা শুনতে পেয়েছে। যদি ভেরীর আওয়াজ নিদ্রিত মহারাজের কর্ণকুহরে প্রবেশ না করে তাহলেও প্রহরীরা ভেরীর বার্তা মহারাজের গোচরে আনবে। অতএব বৎসে ছায়া! তোমার সঙ্গীদের নিয়ে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।

..অপেক্ষমান তিনযোদ্ধা, পুরোহিত ও তাঁর দেহরক্ষী প্রহরীরা দেখতে পেল অনেকগুলো জ্বলন্ত মশাল তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মশালগুলো নিকটবর্তী হতেই দেখা গেল মশালধারীদের অনুসরণ করছে এবং বৃহৎ জনতা! বাহ্লিকরাজ্যের প্রজাবর্গ ভেরীধ্বনি শুনে শয্যাত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছে এবং মশালধারী রাজপ্রহরীদের অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে সম্ভাব্য রণভূমির দিকে। সেই বৃহৎ মিছিলের পুরোভাগে যে দানব-সদৃশ পুরুষটি সগর্বে পদচালনা করছে, তার সুদীর্ঘ পেশীবদ্ধ দেহ বহু মানুষের ভিড়ের মধ্যেও আর্সাসেস ও সুবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার দুইপাশে স্থান নিয়ে আরও যে দুই ব্যক্তি এগিয়ে আসছে, একনজর দেখেই বণিক ও আর্যযোদ্ধা বুঝতে পারল তারাও শক্তিমান যোদ্ধা-মধ্যস্থলে ভ্রাম্যমান পুরুষের যোগ্য সহচর। কেউ পরিচয় করিয়ে না দিলেও রাজকুমারীর দুই সহযোদ্ধা অনুমানেই বুঝে নিয়েছিল অকুস্থলে উপস্থিত হয়েছে স্বয়ং বাকিরাজ বন্ধুদের নিয়ে…

রাজকুমারী ছায়া ও তার দুই সঙ্গীর কয়েক হাত দূরে এসে থামল বাহ্রিকরাজ ঋক্ষ এবং কর্বুর ও শলভ নামক তার দুই দুর্ধর্ষ সহকারী। জনতা ও সমবেত দুই পক্ষের যযাদ্ধাদের মধ্যে ব্যবধান রচনা করে দাঁড়াল সশস্ত্র প্রহরীর দল। নির্বাক জনতা রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করতে লাগল পরবর্তী ঘটনার জন্য…

প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে স্থির হয়ে দাঁড়াল কর্বুর ও শলভ। বন্ধুদের সান্নিধ্য ত্যাগ করে ঋক্ষরাজ এগিয়ে এসে দাঁড়াল রাজকুমারীর সম্মুখে। রাজকুমারীর দুই পাশে দন্ডায়মান আর্সাসেস ও সুবন্ধুর আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে সে যেন তাদের ক্ষমতা জরিপ করে নিল, তার দৃষ্টিতে নিষ্ঠুর হাসির রেখা, রাজকুমারী! এত অল্পবয়সে আত্মহত্যা করতে চাইছ কেন?

গ্রীবা উন্নত করে সদর্পে উত্তর দিল ছায়া, গুপ্ত ঘাতকের অসি এবং বিষ যখন আমি ব্যর্থ করতে পেরেছি, তখন প্রতারকের তরবারির মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে চাইব কেন?

জনতার মধ্যে শুরু হল অস্ফুট গুঞ্জন। ঋক্ষরাজ ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধচক্ষে জনতার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই সভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল জনমণ্ডলী। আবার ঘুরে ভ্রাতুস্পুত্রী ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়াল ঋক্ষরাজ, তোমার এক সহযোদ্ধা দেখছি পেশাদার যুদ্ধব্যবসায়ী এক আর্যযুবক। অপরজন পারস্য দেশের অধিবাসী, পেশায় বাণিজ্যজীবী বণিক। এরা কি রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছে?

আর্যযোদ্ধার ধমনীতে মগধের রাজরক্ত প্রবাহিত, বলে উঠলেন রাজপুরোহিত, যুবকের বামহস্তের অঙ্গুরীয়তে রযেছে মগধের রাজচিহ্ন। ওই প্রমাণ অকাট্য অতএব উক্ত যুবককে আমি যুদ্ধে যোগদানের অনুমতি দিয়েছি।

ঋক্ষরাজ্যের উগ্রদৃষ্টি ফিরল পুরোহিতের মুখে, আর এই পারসীক বণিকের দেহে রাজরক্তের কোনো অকাট্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন রাজপুরোহিত?

ক্ষণেক ইতস্ততঃ করে পুরোহিত বললেন, এই বণিক বলছে সম্রাট আলেকজান্ডার জানেন তার দেহে রাজরক্ত বর্তমান। তাই

তাই আপনি বণিককে রণক্ষেত্রে অংশ নিতে অনুমতি দিয়েছেন? কঠোর স্বরে ঋক্ষরাজ বলল, এই বণিকের হয়ে যতক্ষণ সম্রাট সাক্ষ্য না দিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বণিকের কথায় বিশ্বাস করা উচিত নয়।

-কিন্তু গ্রীকশিবিরে দূত পাঠিয়ে সম্রাটের নিকট থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার সময় নেই। দূত ফিরে আসার আগেই রাত্রি শেষ হয়ে দিনের অলো ফুটবে।

সেজন্য আমি দায়ী নয়। রাজরক্তের উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া ফাল্গুনী-পূর্ণিমার রাতে সংঘটিত যুদ্ধে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে না।

জনতা স্তব্ধ। পুরোহিতের মুখেও কথা নেই। হঠাৎ সামনে এগিয়ে এল রাজকুমারী ছায়া, এই বণিক যদি আমার সহযোদ্ধা হিসাবে রাজপুরোহিতের অনুমোদন না পায়, তাহলে আমি এবং এই আর্যযোদ্ধা ঋক্ষরাজ ও তার দুই সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত। আশা করি এই ব্যবস্থায় কারও আপত্তি হবে না।

জনতার মৃদু গুঞ্জনধ্বনি কিছুক্ষণের মধ্যেই কোলাহলে পরিণত হল– বাহিক রাজ্যের প্রজাবৃন্দ রাজকন্যাকে যুদ্ধে নামতে নিষেধ করছে, তারা রাজকন্যাকে ভালোবাসে, তার অপঘাত মৃত্যুর সম্ভবনায় তারা বিচলিত।

নিঃশব্দ হাস্যে বিভক্ত হল রাজার ওষ্ঠাধর, উত্তম প্রস্তাব। রাজকন্যা যদি একটি মাত্র সহচর নিয়েই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে চায়, তাহলে আমি কি করতে পারি? পুরোহিত! তাহলে আর বিলম্ব কেন? যুদ্ধ শুরু করার আদেশ দিন।

পুরোহিত কিছু বলার আগেই বেজে উঠল বণিকের সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, ওহে অনার্যরাজ। একটা কথা মনে রেখো এই যুবক ও রাজকন্যা সম্রাট আলেকজান্ডারের বিশেষ স্নেহভাজন। সম্রাটের অনুমতি নিয়েই আমি রাজকন্যার পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে এসেছি। যদি আমাকে যুদ্ধে নিবৃত্ত করা হয়–কয়েকমুহূর্ত নীরব রইল বণিক, তারপর ভীষণকণ্ঠে অসমাপ্ত বাক্য শেষ করল, এবং যদি তিন এর বিরুদ্ধে দুই এর অসম যুদ্ধে রাজকন্যার জীবনহানি হয়, তাহলে গ্রীকবাহিনীর আক্রমণে ধরাপৃষ্ঠ থেকে মুছে যাবে বাকিরাজ্য; আর প্রতারক বাকিরাজও রাজ্যসুখ ভোগ করার জন্য জীবিত থাকবে না।

ঋক্ষরাজ তার মতামত প্রকাশ করার আগেই জাগল রাজপুরোহিতের তীব্র কণ্ঠ, আমি এই বণিকের কথা বিশ্বাস করি, এমন উদ্ধত গ্রীবাভঙ্গি, এমন বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর কখনও মিথ্যার বাহন হতে পারে না। বাহ্লিকরাজ্যের প্রধান পুরোহিত হয়ে এই রাজ্যকে আমি সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিতে পারি না। সুতরাং এই বণিককে অমি রাজকন্যা ছায়ার পক্ষে অস্ত্রধারণের অনুমতি দিচ্ছি। রাজ্যের প্রথা অনুসারে ফাঙ্গুনী-পূর্ণিমার রাত্রে যুদ্ধ অভিলাষী দুই পক্ষের যোদ্ধাবর্গ সম্পর্কে চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন একমাত্র রাজপুরোহিত– আমি যুদ্ধ শুরু করার অনুমতি দিচ্ছি। মহারাজ ঋক্ষ! রাজকুমারী ছায়া! তোমরা সঙ্গীদের নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াও। আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গণনা করব। দশ বলার সঙ্গেসঙ্গে শুরু হবে এই যুদ্ধ। এক… দুই.তিন…।

দুই পক্ষ পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াল। জনতা প্রতীক্ষায় অধীর-ঋক্ষরাজ এবং শলভ ও কর্বুর নামে তার দুই সহযোদ্ধা অসিচালনার জন্য বিখ্যাত; বিরোধীপক্ষে রাজকুমারী স্বয়ং যাদের নির্বাচন করেছে, তারাও যে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা সেবিষয়ে প্রজাদের সন্দেহ নেই কিছুমাত্র।

দশ বলার সঙ্গেসঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল। জনতা একটি দীর্ঘস্থায়ী রক্তাক্ত যুদ্ধ দেখতে পাবে বলে আশা করেছিল, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কেউ সহজে পরাজয় স্বীকার করবে বলে মনে হয় নি। কিন্তু তাদের আশা পূর্ণ হল না

তিন জোড়া অসি সশব্দে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আবার বিছিন্ন হল পুনরায় আঘাত করার জন্য, আর ঠিক সেই মুহূর্তে বণিক আর্সাসেস আশ্চর্য কৌশলে শত্রুর আঘাত এড়িয়ে আক্রমণ করল– তার প্রতিদ্বন্দ্বী আত্মরক্ষার সুযোগই পেল না, বিদীর্ণ ও রক্তাক্ত বক্ষ নিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।

রক্তাক্ত অসি তুলে বণিক যুদ্ধের দৃশ্য নিরীক্ষণ করতে লাগল। ঋক্ষরাজ তখন ছায়ার আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত, তার প্রকান্ড তরবারি নিষ্ফল আক্রোশে রাজকুমারীর চতুর্দিকে গুঞ্জন করে ফিরছে, কিন্তু শত্রুর অঙ্গস্পর্শ করতে পারছে না। পক্ষান্তরে ঋক্ষরাজের বামবাহু ও দক্ষিণ জানুর উপরি ভাগ রক্তাক্ত করে দিয়েছে রাজকুমারীর অসি! আঘাত তেমন মারাত্মক না হলেও ক্রমাগত রক্তপাতের ফলে দেহ একসময়ে দুর্বল হয়ে পড়বে তাই যুদ্ধটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে ঋক্ষরাজ… প্রচন্ডবেগে সে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বারংবার কিন্তু শত্রুর বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্র সঞ্চালন ব্যর্থ করে দিচ্ছে সেই আক্রমণ…

জনতার ভিতর থেকে উঠল তুমুল কোলাহল, বণিক! কী দেখছ? আক্রমণ করো! আক্রমণ করো! সাহায্য করো রাজকন্যাকে!

বণিক আর্সাসেস বুঝল বাহ্রিকরাজ্যের প্রজাবৃন্দ ঋক্ষরাজকে চায় না, তারা চায় রাজকুমারী ছায়াকে। আর্সাসেস পুরোহিতকে উদ্দেশ করে বলল, দ্বন্দ্বযুদ্ধের নিয়ম অনুসারে আমার সঙ্গীদের আমি সাহায্য করতে পারি না। জনতার দাবি আমি বুঝতে পারছি, তারা বর্তমান রাজার অত্যাচার উৎপীড়নে অতিষ্ঠ। কিন্তু আমি নিরুপায়।

এই যুদ্ধে সঠিক ভাবে দ্বন্দ্বযুদ্ধের নিয়ম পালিত হয় না, পুরোহিতের উত্তর এল, তিনের বিরুদ্ধে তিন এই নিয়মে দ্বন্দ্ব শুরু হয় বটে, কিন্তু পরবর্তী কালে যোদ্ধাদের কেউ নিহত হলে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী তার সঙ্গীদের সাহায্য করতে পারে। অতএব যদি ইচ্ছা হয়, তাহলে প্রজাদের দাবি মেনে নিয়ে তুমি রাজকুমারীকে সাহায্য করতে পারো তাতে এই যুদ্ধের নিয়মভঙ্গ হবে না।

আর্সাসেস কিছু বলার আগেই জনতার ভিতর থেকে উঠল তীব্র উল্লাসধ্বনি। আর্সাসেসের দৃষ্টি ছিল পুরোহিতের উপর, জনতার কোলাহলে চমকে উঠে সে রণভূমির দিকে ফিরে চাইতেই দেখল বাঁ হাত দিয়ে রক্তাক্ত দক্ষিণবাহু চেপে ধরেছে সুবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী তার হাতের তলোয়ার খসে পড়েছে মাটির উপর।

জনতা গর্জন করে উঠল, হে আর্যযোদ্ধা! হত্যা করো। হত্যা করা দুরাচার কর্বুরকে! তারপর দুজনে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঋক্ষরাজের উপর, তিন-তিনটি তরবারির আঘাতে লুপ্ত হয়ে যাক বাহ্লিকরাজ্যে বিভীষিকার রাজত্ব!

নতমস্তকে আহত বাহুর শুশ্রূষা করছিল কর্বুর, জনতার রায় শুনে সে সভয়ে মুখ তুলে সুবন্ধুর দিকে তাকাল।

নিরস্ত্র শত্রুর দেহে আমি আঘাত করি না, সুবন্ধু বলল, তুমি অসি তুলে নিয়ে পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ করতে পারো। আমি তোমায় আরও একবার সুযোগ দিচ্ছি।

ধন্যবাদ, কর্বুর বলল, কিন্তু আমার পক্ষে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করা সম্ভব নয়। তোমার অসি আমার দক্ষিণ বাহুর মাংস ভেদ করে অস্থি পর্যন্ত কেটে বসে গেছে ইহজীবনে ওই হাতে আর আমি অস্ত্রচালনা করতে পারব না।

তুমি তাহলে বাঁ হাতেই তলোয়ার তুলে নাও, সুবন্ধু বলল, আমিও তলোয়ার ধরব বা হাতে। এস। যুদ্ধ করো।

কবুরের মুখে ফুটল করুণ হাসি, বাঁ হাতে তলোয়ার ধরার অভ্যাস আমার নেই। অতএব তোমার উদারতার সুযোগ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে তুমি দুহাতেই সমান ভাবে অস্ত্রচালনায় অভ্যস্ত ইচ্ছা করলে আমায় তুমি হত্যা করতে পারো। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।

তুমি এখনই রণভূমি পরিত্যাগ করো, আমি নিরস্ত্র শত্রুকে বধ করি না, সুবন্ধু বলল, আর্সাসেস! রাজকুমারী ও ঋক্ষরাজ্যের লড়াই বোধহয় আরও বেশ কিছুক্ষণ চলতে পারে। কিন্তু আমরা দুজন মিলিত ভাবে রাজকন্যার সাহায্যে অগ্রসর হলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে দ্বৈরথ

সুবন্ধুর বাক্য শেষ হওয়ার আগেই ধ্বনিত হল রাজকন্যার তীব্র কণ্ঠস্বর, না, না। আমি কারও সাহায্য চাই না। পিতৃব্য রক্তপাতে অবসন্ন, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হবে। দ্বৈরথ রণে আমি কারও সাহায্য নিয়ে জয়লাভ করতে ইচ্ছুক নই। আমি একাকী পিতৃব্যকে পরাস্ত করতে সমর্থ।

হয়তো রাজকুমারীর কথা সত্য কারণ বাহ্রিকরাজের সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরছে তপ্ত রক্তের ধারা, কিন্তু রাজকুমারী ছায়া এখনও অক্ষত; এখনও তার অঙ্গ স্পর্শ করতে পারে নি শত্রুর শোণিতপিপাসু তরবারি। অন্য কোনো যোদ্ধা হলে এতক্ষণে রক্তপাতে অবসন্ন দেহ নিয়ে শুয়ে পড়ত, কিন্তু অমানুষিক শক্তির অধিকারী বাহ্রিক রাজ অবিরত রক্তক্ষরণ তুচ্ছ করে অসিচালনা করছে প্রচণ্ড বেগে!

আর্সাসেস হাঁক দিয়ে বলল, কুমারী! অসিচালনায় তোমার দক্ষতা আমায় বিস্মিত করেছে। তোমার বিদ্যুৎ গৃতি ও রণকৌশল যে কোনো পুরুষের অন্তরে ঈর্ষার সঞ্চার করবে। যুদ্ধের গতি দেখে মনে হয় চরম আঘাতে এই দুরাত্মার প্রাণবধ করতে পারলেও তুমি তা চাও না।

বোধ হয় পিতৃব্যকে হত্যা করতে তুমি সংকুচিত- তাই তাকে রক্তপাতে অবসন্ন করে পরাজয় স্বীকার বাধ্য করতে চাও।

সাবধানে পাঁয়তারা করতে করতে ছায়া বলল, বণিক! তোমার অনুমানে ভুল হয় নি। আমি ইচ্ছা করলেই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বধ করতে পারি এই মুহূর্তে। কিন্তু আমি তা চাই না। পিতৃব্য ক্রমাগত রক্তপাতে দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অবসন্ন হয়ে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হবে।

রাজকমারী। পরাক্রান্ত শত্রুকে যেন-তেন প্রকারে বিধ্বস্ত করাই উচিত, বণিক গম্ভীরস্বরে বলল, আহত বাঘকে নিয়ে ব্যাধ যদি খেলা করে, তাহলে বাঘের কবলে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে প্রতি মূহুর্তে। তুমি যদি ঋক্ষরাজকে বধ করতে সংকোচ বোধ করো, তাহলে আমাকে দায়িত্ব দাও– আমি এই নরাধমকে অবিলম্বে যমালয়ে প্রেরণ করব।

রাজকুমারীর বক্তব্য জানার জন্য অধীর হয়ে উঠল জনতা। ভূমিপৃষ্ঠে কর্বর এবং অসিহস্তে দন্ডায়মান আর্সাসেস ও সুবন্ধু উৎকণ্ঠ আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল রাজকুমারী ছায়ার উত্তরের আশায়–

কিন্তু আচম্বিতে এক প্রচন্ড শব্দ ঝটিকা উপস্থিত সকলকেই চমকে দিয়ে তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করল অন্যদিকে!

যেদিক থেকে ভেসে আসছে শব্দের তরঙ্গ, সেইদিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত জনমণ্ডলী ও সমাগত যোদ্ধাবর্গ দেখল ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝড়ের বেগে রণক্ষেত্রে দিকে এগিয়ে আসছে দলে দলে অশ্বারোহী সৈনিক! তাদের শিরস্ত্রাণ, বর্ম ও ভল্লফলকের উপর জ্বলে জ্বলে উঠেছে চাঁদের আলো এবং তাদের বাহনদের পায়ে পায়ে খুরের আঘাতে কাঁপছে উপত্যকার ভূমি! দূর থেকে দেখলেও আগন্তুকদের স্বরূপ নির্ণয় করতে দর্শকদের অসুবিধা হল না তাদের পোশাক, শিরস্ত্রান ও বর্ম বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা গ্রীকবাহিনীর অন্তর্গত একদল অশ্বারোহী সৈনিক!

এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সকলেই চমকে উঠেছিল, যুদ্ধের কথা ভুলে তারা তাকিয়ে রইল ঘোড়সওয়ারদের দিকে। আর সকলের মতোই রাজকুমারী ছায়াও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল মুহূর্তের জন্য আর সেই মুহূর্তের সুযোগ নিল ঋক্ষরাজ, একলাফে ছায়ার সামনে এগিয়ে এসে সে মাথার উপর তুলল তার প্রচণ্ড তরবারি।