ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৫. যুদ্ধ

৫. যুদ্ধ

দ্বিরদরাজ্যের সীমান্তবর্তী যে গ্রামে বাস করত রাহুল, সেই গ্রামে সেইদিন মধ্যাহ্নে উপস্থিত হয়েছে একদল রাজসৈন্য। সেনানায়কের নির্দেশে গ্রামের মাঝখানে সমবেত হয়েছে তাবৎ গ্রামবাসী।

গ্রামের মোড়ল ও কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তিকে সমবেত জনতা থেকে পৃথক করে নিল সেনানায়ক, তারপর বলল, দুমাস আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম আমাদের রাজা গ্রীকসম্রাট আলেকজান্ডারের সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন এবং তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতএব, এই রাজ্যের অন্যান্য গ্রাম ও নগর যেমন সেই অর্থসংগ্রহ করে আমাদের হাতে দিয়েছে, তেমনি তোমাদেরও সাধ্যমত অর্থ সংগ্রহ করে রাজপ্রতিনিধি অর্থাৎ আমাদের হাতে সংগৃহীত সম্পদ তুলে দিয়ে প্রজার কর্তব্যপালন করা উচিত। আমি গ্রামপ্রধানদের কাছে জানতে চাই উক্ত সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ কত? আজই সেই কর জমা দেওয়ার শেষ তারিখ একথা নিশ্চয়ই মনে আছে? তোমাদের তরফ থেকে রাজভাণ্ডারের রাজকর জমা দেওয়া হয়নি বলেই আজ আমাদের আসতে হল।

জনতা স্তব্ধ। অতিবাহিত হল কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। তারপর গ্রামের মোড়ল ব এগিয়ে এসে কম্পিতস্বরে বলল, সেনানায়ক মহাশয়! আমাদের নির্দিষ্ট রাজকর আমরা মিটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এই অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমরা অত্যন্ত দরিদ্র। তার উপর এইবার অনাবৃষ্টির দরুন ভালো চাষ-আবাদ হয় নি। আমি শপথ করছি আগামী বৎসর যদি ভালো চাষ হয়, তাহলে নির্দিষ্ট রাজকরের দ্বিগুণ অর্থ আমরা রাজকোষে জমা দেব।

ওরে নির্বোধ! সেনানায়ক কর্কশস্বরে বলল, তোর জন্য আমরা কি এক বৎসর অপেক্ষা করব? রাজদরবারে একজন গ্রীক প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছে সম্রাটের জন্য দেয় অর্থ গ্রহণ করতে– এখন কি আমরা তাকে এক বৎসর অপেক্ষা করতে বলব?

কিন্তু প্রভু, মোড়ল নিবেদন করল, অন্যান্য শহর ও গ্রাম থেকে তো বেশ কিছু অর্থ সংগৃহীত হয়েছে। আপাততঃ কি সেই অর্থ দিয়ে গ্রীকসম্রাটের প্রতিনিধিকে সন্তুষ্ট করা যায় না?

শঠ! প্রতারক! তস্কর! ভীষণকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল সেনানায়ক, তোমাদের রোগ আরোগ্য করার উপযুক্ত ঔষধ আমি জানি… সৈন্যগণ! এই পাঁচজন গ্রামপ্রধানকে প্রহারে জর্জরিত করো। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অর্থ দিতে রাজি না হয়, ততক্ষণ প্রহার চালিয়ে যাও।

একজন বিপুলবপু বলিষ্ঠ সৈন্য সেনানায়ককে উদ্দেশ্য করে বলল, এরা সকলেই ক্ষীণজীবী দুর্বল ও বৃদ্ধ। অত্যাধিক প্রহার করলে এদের মৃত্যু ঘটতে পারে।

সেনানায়কের ওষ্ঠাধরে ফুটল নিষ্ঠুর হাস্য, সেজন্য আমি দায়ী নই। বিদ্রোহী প্রজার মৃত্যুতে রাজার ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। নাও শুরু করো।

শুরু হল নির্দয় প্রহার। কয়েকটি রমণী আর্তস্বরে কেঁদে উঠতেই সেনানায়ক বলল, যদি পুরুষদের বাঁচাতে চাও, তাহলে তোমাদের অলংকার বা গহনা তুলে দাও আমাদের হাতে।

একটি রমণী ক্ৰন্দনজড়িত স্বরে বলল, এই গ্রামের অধিকাংশ নারী এতই দরিদ্র যে, তারা অলঙ্কার ধারণে অসমর্থ। সামান্য কয়েকজনের কাছে যে গহনা রয়েছে, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই তা সংগ্রহ করে আনছি। অনুগ্রহ করে আমাদের কিছুক্ষণ সময় দিন।

বেশ, সেনানায়ক গম্ভীরস্বরে বলল, আমি কিয়ৎকাল অপেক্ষা করছি। যদি নগদ অর্থের পরিবর্তে যথেষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত অলংকার সংগৃহীত হয়, তাহলে আমি গ্রামপ্রধানদের মুক্তি দেব। নচেৎ এরা তো নির্যাতিত হবেই, গ্রামবাসী অন্যান্য পুরুষরাও নিস্তার পাবে না আমি সকলকেই বন্দিশিবিরে প্রেরণ করব।

-মহাশয়! আপনি অর্ধপ্রহর সময় দিন, আমি অলংকার সংগ্রহ করে আনছি।

রমণী গ্রামের মধ্যে অন্তর্ধান করল। সেনানায়ক সৈন্যদের প্রহার থেকে নিবৃত্ত হতে আদেশ দিল, তারপর অপেক্ষা করতে লাগল সাগ্রহে…।

অরণ্য ভেদ করে গ্রামের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল রাহুল, তার সামনে খোলা মাঠের উপর গ্রামবাসী জনতা ও সেনাদলের আবির্ভাব তাকে কৌতূহলী করে তুলল বনের আড়াল থেকে সে ঘটনার গতি লক্ষ্য করতে লাগল, এগিয়ে এসে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল না…।

জনতার ভিতর থেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল পূর্বে উল্লিখিত রমণী, বস্তাবৃত কয়েকটি অলংকার সমর্পণ করল সেনানায়কের হাতে। কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে অলংকারগুলিকে পর্যবেক্ষণ করল সেনানায়ক, তারপর বস্তুসমেত সমুদয় অলংকার ভূমিতে নিক্ষেপ করে সক্রোধে গর্জন করে উঠল, এই তোর অলংকার? অধিকাংশই তামা ও পিতলের জিনিস, মাত্র কয়েকটি রূপার তৈরি গহনা স্বর্ণ একেবারেই অনুপস্থিত। যদি মঙ্গল চাস তো স্বর্ণনির্মিত গহনা- যা লুক্কায়িত রয়েছে তা এনে দে। নচেৎ এই পাঁচজনের মৃত্যুশয্যা এখানেই রচিত হবে। অন্যান্য পুরুষরাও নিস্তার পাবে না।

রমণী কাতরকণ্ঠে বলল, মহাশয়! আমাদের কাছে লুক্কায়িত স্বর্ণ বা রৌপ্য নেই। আমরা আমাদের স্বামী, পিতা বা পুত্রের চাইতে অলংকারের মূল্য অধিক বলে মনে করি না। অনুগ্রহপূর্বক এইসকল অলঙ্কার গ্রহণ করে সকলকে মুক্তি দিন।

সেনানায়ক রমণীর আবেদনে কর্ণপাত করল না, তার আদেশে কয়েকটি সৈন্য নুতন উদ্যমে গ্রামপ্রধানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অট্টহাস্য করে সেনানায়ক জনতার দিকে ফিরল, কীরে শৃগালের দল! আমাদের বাধা দিতে কেউ তো এগিয়ে আসছে না দেখছি! ভীরু, কাপুরুষ! নিশ্চেষ্ট থাকলেই কি নিস্তার পাবি? অর্থ যদি সংগ্রহ করতে না পারি, তাহলে তোদের গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে রাজকোষে জমা দেব- হা! হা! হা!

গ্রামের মোড়ল বর পুত্র বিকর্ণ দাঁড়িয়ে ভীত দৃষ্টিতে বৃদ্ধ পিতার নির্যাতন দেখছিল, তার পাশে দাঁড়িয়েছিল আরও কয়েকজন কিশোর ও যুবক। তাদের মধ্যে একজন বিকর্ণকে উদ্দেশ করে বলল, বিকর্ণ! আমরা কি এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য নিরীক্ষণ করব? আমরা সমবেত হলে এই কটা সৈন্য কী করতে পারে? এস, গৃহ থেকে লাঠি, তলোয়ার নিয়ে আমরা ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।

বিকর্ণ মাথা নাড়ল, না। ওরা অস্ত্রচালনায় শিক্ষিত, রণনিপুণ সৈনিক। আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও ওদের সামনে দাঁড়াতে পারব না। আর যদি দৈবক্রমে সৈন্যদের পরাস্ত করতে পারি, তাহলেও শেষ রক্ষা হবে না, ক্রুদ্ধ দ্বিরদরাজ আমাদের বিরুদ্ধে সুবৃহৎ সেনাদল পাঠিয়ে এই গ্রামকে শ্মশানে পরিণত করবে। আমরা কিছুই করতে পারব না।

আর একটি কিশোর ক্রুদ্ধস্বরে বলল, তাহলেও আমরা মেরে মরতে পারব। এমনভাবে

আচম্বিতে ভেসে এল এক তীব্র কণ্ঠস্বর, ওরে কুকুরের দল! নিরস্ত্র বৃদ্ধের উপর বীরত্ব প্রকাশ না করে সশস্ত্র যোদ্ধার সম্মুখীন হয়ে ক্ষমতার পরিচয় দেয়।

চমকে উঠে কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে দৃষ্টি চালিত করতেই সমবেত জনতা ও সৈনিকদের চোখে পড়ল এক আশ্চর্য দৃশ্য বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে সেনাদলের দিকে ছুটে আসছে উদ্যত তরবারি হস্তে এক কিশোর।

জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হল, রাহুল। রাহুল!

 বিস্মিতকণ্ঠে বিকর্ণ বলল, আরে! এ যে রাহুল! কোথায় ছিল এ এতদিন? কিন্তু ও তো তলোয়ার চালাতেই জানে না! এখনই সৈন্যরা ওকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে।

ততক্ষণে সেনাদলের কাছে পৌঁছে গেছে রাহুল, যারা প্রহার করছিল, তার ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই রাহুলের অসির আঘাতে একটি সৈনিক ধরাশায়ী হল। বিস্ময়ের চমক সামলে গ্রামপ্রধানদের ছেড়ে মারমুখী সৈন্যরা আক্রমণ করল রাহুলকে। দুই হাত কোমরে রেখে সেনানায়ক হেসে উঠল, এই ছেলেটা দেখছি আত্মহত্যা করতে চায়! বেশ! বেশ! এতক্ষণে একটা মজার খেলা দেখার সুযোগ পেলাম। সৈন্যগণ! এই বালকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একটি একটি করে বিচ্ছিন্ন করো।

কিন্তু সেনানায়কের মুখের হাসি মুখেই শুকিয়ে গেল, আগন্তুক কিশোরের হাতের তলোয়ার ঘুরছে বিদ্যুৎবেগে, অব্যর্থ নিশানায় আঘাত হানছে প্রাণঘাতী সর্পের মতো দেখতে দেখতে রক্তাক্ত শরীরে ধরাশয্যা গ্রহণ করল আরও দুজন সৈনিক। এতক্ষণ যে কয়েকজন সৈন্য গ্রামপ্রধানদের নির্যাতন করছিল, তারাই অস্ত্রচালনা করছিল কিশোরটির বিরুদ্ধে;- কিন্তু এখন বেগতিক দেখে সমগ্র বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল কিশোর যোদ্ধার উপর।

মুক্ত প্রান্তরের মধ্যস্থলে একটি ক্রীড়ামঞ্চ নির্মাণ করেছিল গ্রাম্য বালকের দল একলাফে সেই মঞ্চে উঠে তরবারি তুলে চিৎকার করে উঠল রাহুল, আয়! আয়! আজ হয়তো এখানেই আমি মৃত্যুবরণ করব, কিন্তু মরার আগে তোদের কয়েকজনকে নির্ঘাত নরকে পৌঁছে দেব।

সৈন্যরা এগিয়ে এল। কিন্তু রাহুলের ঘুর্ণিত অসির প্রহরা ভেদ করে কেউ তার দেহস্পর্শ করতে পারল না। লড়াই ক্রমশঃ ঘোরতর হয়ে উঠল… অবশেষে রাহুলের অবসন্ন হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ার উপক্রম করছে.. বনের আড়াল থেকে ছুটে এল একঝাক বাণ! প্রত্যেকটি বাণ অব্যর্থ নিশানায় আঘাত হানল, হতাহত হয়ে শুয়ে পড়ল আরও কয়েকটি সৈনিক।

বিস্মিত ও বিপর্যস্ত সেনাদলকে চমকে দিয়ে বনের ভিতর থেকে ভেসে এল শিঙার ভীষণ শব্দ! সেই কর্ণভেদী শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই জাগ্রত হল এক প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর অরণ্যের অন্তরাল থেকে, রাহুল! লড়াই চালিয়ে যাও। এই কাপুরুষ সারমেয় বাহিনীকে এখনই আমরা তাদের আস্তানায় পাঠিয়ে দেব।

রাহুল সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ক্ষুদ্রক! ক্ষুদ্রক! আমরা দুজনেই যথেষ্ট। আর কারও সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। তবে শিঙার সংকেত যখন পৌঁছে গেছে, তখন অন্যান্য বন্ধুরা এখনই উপস্থিত হবে এখানে।

সেনানায়ক ও সেনাবাহিনীর পিলে গেল চমকে! একটিমাত্র কিশোর এতক্ষণ যা খেলা দেখাল, তাতেই তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এখন যদি উক্ত কিশোর যোদ্ধার বন্ধুবর্গ এসে তার সঙ্গে যোগ দেয়, তাহলে সেনাবাহিনীর একটি সৈন্যও যে জীবিত অবস্থায় ঘরে ফিরতে পারবে না, এ বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি! অতএব সেনানায়ক সৈনিকদের উদ্দেশ করে হাঁকল, সৈন্যগণ! শত্রু অতিশয় প্রবল। এখন আমরা অকুস্থল ত্যাগ করব। পরে ফিরে এসে রাজদ্রোহীদের সমুচিত দণ্ড

কয়েক মুহূর্তে মধ্যেই সেনাদল অন্তর্ধান করল। রণক্ষেত্রে পড়ে রইল কয়েকজন হতাহত সৈনিকের রক্তাক্ত দেহ।

সমবেত জনতার বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে বনের আড়াল থেকে ফাঁকা মাঠের উপর আত্মপ্রকাশ করল একটি ছোটোখাটো চেহারার মানুষ। মানুষটি আড়ে বহরে খুব বৃহৎ না হলেও তার পেশিবহুল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখলেই বোঝা যায় সে অসামান্য শক্তির অধিকারী। পূর্বোক্ত ব্যক্তি সশস্ত্র– তার পিঠে রয়েছে শরজাল-সজ্জিত তৃণীর ও ধনুক, কোমরে ঝুলছে ধনুক আর শিঙা। জনতা বুঝল একটু আগে ওই শিঙার তীব্রধ্বনি সকলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে এবং পৃষ্ঠদেশে লম্বমান ধনুক থেকেই মৃত্যু বর্ষিত হয়ে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে সমগ্ৰ সেনাবাহিনীকে!

এক লাফে মঞ্চ থেকে অবতরণ করে আগন্তুকের সামনে এসে দাঁড়াল রাহুল, ক্ষুদ্রক! তুমি কোথা থেকে এসে উপস্থিত হলে মূর্তিমান দেবদূতের মতন!

ক্ষুদ্রক হাসল, আমি শিকারের সন্ধানে ইতস্তত ভ্রমণ করছিলাম। হঠাৎ বহুকণ্ঠের চিৎকার ও অস্ত্রের ঝনকার-ধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে এখানে এসে পড়লাম। কুমার আর বজ্র নিশ্চয় শিঙার সংকেত শুনতে পেয়েছে, তারা এখনই এসে পড়বে। কিন্তু কাপুরুষ সৈন্যগুলি তীরবেগে পলায়ন করেছে– কুমার ও বজ্রের তরবারি আজ শত্রুর শোণিতপানে তৃপ্ত হবে না।

জনতার ভিতর এক জায়গায় ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন কিশোর ও যুবক, সেইদিকে তাকিয়ে হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠল রাহুলের দৃষ্টি, তারই সমবয়সী এক কিশোরকে লক্ষ্য করে গিয়ে গেল সে, এই যে বিকর্ণ! আশা করি আমায় চিনতে পারছ?

উদ্দিষ্ট কিশোর স্মিতমুখে বলল, রাহুল! তোমার অসাধারণ বীরত্ব আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে। তুমি তো কখনো লড়াই করো নি, লড়াই-এর নাম শুনলেই ভয় পেতে এমন আশ্চর্য অসিচালনার কৌশল তোমায় শিখিয়েছে কে?

অবান্তর প্রশ্ন, হিংস্র হাস্যে বিভক্ত হল রাহুলের ওষ্ঠাধর, অবান্তর ও অনাবশ্যক প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই। একসময় তুমি আমায় অপমান করেছ, খেলার ছলে দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্ররোচনা দিয়েছ- মনে আছে? আজ আমি প্রস্তুত- লাঠি, তলোয়ার অথবা বিনা অস্ত্রে মৃত্যুপণ মল্লযুদ্ধ কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই। বলল বিকর্ণ, বলল–তুমি যেভাবে চাইবে সেইভাবেই আমি তোমার যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দেব।

বিকর্ণের হাসি অম্লান, রাহুল! আমি তোমার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নই। তুমি অনায়াসে আমায় পরাস্ত করতে পারবে। কিন্তু তুমি আজ যেভাবে গ্রামপ্রধানদের বিশেষ করে আমার পিতার প্রাণরক্ষা করেছ, তাতে আমি আজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার পূর্বকৃত অপরাধের জন্য মার্জনাভিক্ষা করছি। যদি আমায় রণবিদ্যায় শিক্ষা দিতে সম্মত হও, তাহলে আমি তোমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি।

সমবেত কিশোর ও যুবকের দলে জাগল কোলাহল-ধ্বনি আমরাও তোমাকে গুরু বলে স্বীকার করছি। রাহুল! আমাদের সকলকেই তুমি রণবিদ্যায় শিক্ষিত করার ভার নাও।

রাহুল তার মতামত প্রকাশ করার আগেই ধ্বনিত হল এক সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, অবশ্যই তোমাদের এখন অস্ত্রচালনা শিক্ষা করতে হবে এবং রাহুল তোমাদের উপযুক্ত গুরু হবে এবিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অনতিবিলম্বে তোমাদের গ্রাম ছেড়ে গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিতে হবে। সেখানেই শুরু হবে তোমাদের অস্ত্রচালনার শিক্ষা।

রাহুল এবং সমবেত কিশোর ও যুবকবৃন্দ কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল নিঃশব্দে অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করেছে দুটি অস্ত্রধারী পুরুষ। একজন দৈর্ঘ্যপ্রস্থে দানবসদৃশ বিশালবপুর অধিকারী অপর ব্যক্তি সঙ্গীর ন্যায় লম্বা-চওড়া না হলেও তার পেশিমণ্ডিত দীর্ঘদেহ দেখলেই বোঝা যায় সে দস্তুরমতো শক্তিশালী পুরুষ। দুজনের অস্ত্রসজ্জাও একরকম নয়, দানবের কটিতে তরবারি ও শিঙা এবং হাতে রয়েছে একটি তৈলপক্ক সুদীর্ঘ বংশদণ্ড। তার সঙ্গীর কটিবন্ধে তরবারির সঙ্গে শিঙা ঝুলছে বটে, কিন্তু হাতে লাঠি নেই- পরিবর্তে তার পৃষ্ঠদেশে শোভা পাচ্ছে ধনুক ও শরসজ্জিত তুণীর। একটু আগে কিশোর ও যুবকদের উদ্দেশ করে কথা বলেছিল ধনুর্বাণধারী পুরুষ।

রাহুল পূর্বোক্ত আগন্তুকদের উদ্দেশ করে উল্লসিত স্বরে বলে উঠল, কুমার! বজ্র! তোমরা এসে পড়েছ! আর একটু আগে এলে একটি চমৎকার লড়াইতে অংশগ্রহণ করতে পারতে বিলম্বের ফলে সেই সৌভাগ্য থেকে তোমরা বঞ্চিত হলে। কিন্তু তুমি সবাইকে গ্রাম ছেড়ে অরণ্যে আশ্রয় নিতে বলছ কেন? এই গ্রামেই তো আমরা অস্ত্রচালনা অভ্যাস করতে পারি।

না, পারো না, অন্যতম গ্রামপ্রধান রল্লা বলল, আজ কিংবা কাল, দুদিনের মধ্যেই পরাজিত সেনানায়ক আবার এখানে হানা দেবে বিরাট সৈন্যদল নিয়ে রাহুল অতর অশিক্ষিত শিষ্যদের নিয়ে সেই রণনিপুণ সৈন্যদের বাধা দিতে পারবে না। অতএব, সব কিছু ফেলে গ্রাম ছেড়ে আমাদের অরণ্যগর্ভেই আশ্রয় নিতে হবে।

কিন্তু আমি যাদের কাছে শিক্ষালাভ করেছি, রাহুল বলল, তারা যদি সাহায্য করে তাহলে আমরা হানাদার বাহিনীকে সমুচিত শাস্তি দিতে পারব। বিকর্ণ, অর্বুদ, চিত্ররথ– তোমরা সবাই জেনে নাও আমি যাঁদের কাছে রণবিদ্যার শিক্ষাগ্রহণ করেছি, তারা সকলেই এখানে উপস্থিত রয়েছেন। ধনুর্বাণধারী এই গৌরবর্ণ পুরুষের নাম সুবন্ধু, তার পাশে দণ্ডায়মান দানবের নাম বজ্র আর ক্ষুদ্রকায় ওই বলিস্ট পুরুষ যে একটু আগে শরনিক্ষেপ করে অত্যাচারী সেনাদলকে বিধ্বস্ত করেছে তার নাম ক্ষুদ্রক। আমাদের এই দলটির অধিনায়কের স্থান গ্রহণ করেছেন সুবন্ধু তবে আমরা তাকে কুমার নামেই ডেকে থাকি।

কিছুক্ষণ সবাই নীরব রইল। তারপর স্তব্ধতা ভঙ্গ করল বিকর্ণ, আমরা অস্ত্রচালনায় একেবারে আনাড়ি নই। নিজেদের মধ্যে আমরা লাঠি, তলোয়ার ও মল্লযুদ্ধ অভ্যাস করে থাকি। যদি কুমার এবং তার দুই সঙ্গী আমাদের নেতৃত্ব দেন, তাহলে আমরা প্রাণবিপন্ন করেও দ্বিরাজের সেনাদলকে বাধা দেব।

সুবন্ধু হাসল, সাধু! সাধু! তোমাদের সাহস আছে বুঝলাম। কিন্তু এখনও তোমাদের রাজসৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময় হয়নি। তোমরা গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থেকে মাঝে মাঝে লোকালয়ে অবস্থিত দ্বিরদরাজের বিভিন্ন বিভাগে হানা দিয়ে অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ করো এবং বিদ্রোহী বাহিনী সংগঠন করতে মনোযোগী হও। এবিষয়ে রাহুল তোমাদের সাহায্য করবে।

রাহুল বলল, কুমার! তুমি, বজ্র আর ক্ষুদ্রক আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের সাহায্য করবে না?

সুবন্ধু কিছু বলার আগেই বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক ব্যক্তি। তার কঠিন মুখাবয়ব, চলার ভঙ্গি আর চোখের তীব্র প্রখর দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় মানুষটি রণনিপুণ যোদ্ধা। তার সঙ্গে ধনুর্বাণ নেই, কটিবন্ধে ঝুলছে দীর্ঘ তরবারি। সে নিকটবর্তী হয়ে বলল, আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। এখন স্মরণ করিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। এখনই যাত্রা শুরু করা উচিত।

রাহুলের ভ্রু কুঞ্চিত হল, ভানুর সঙ্গে তোমরা কোথায় যাত্রা করতে চাও

বজ্র বলে উঠল, রাহুল! তোমাকে আমি একদিন অনধিকার চর্চা করতে নিষেধ করেছিলাম, মনে আছে?

রাহুল দৃষ্টি নত করল। সুবন্ধু একবার চর্তুদিক পর্যবেক্ষণ করল, তারপর রাহুলের দিকে ফিরল, রাহুল! আমরা এখন স্থান ত্যাগ করব। তুমি এই কিশোর ও যুবকদের রণবিদ্যার তালিম দাও, সকলের অগোচরে এক দুর্ধর্ষ বাহিনীকে সংগঠিত করো। তারা দ্বিরদরাজ্যে কোনো অনাচার দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বে, উদ্ধত রাজকর্মচারীদের শাস্তি দেবে কিন্তু কখনো সম্মুখযুদ্ধ করবে না। এই অত্যাচারী দ্বিরদরাজকে একসময়ে তোমাদের সাহায্যেই আমি সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য করব।

কিন্তু সিংহাসন তো শূন্য থাকতে পারবে না, রাহুল বলল, তোমাকেই আমরা তাহলে দ্বিরদরাজ্যের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করব।

সুবন্ধু হাসল, দ্বিরদরাজ্যের সিংহাসনে কে প্রতিষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে আজ মস্তিষ্ককে ঘর্মাক্ত করার প্রয়োজন নেই। যথাসময়ে উক্ত ব্যাপারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হবে না।

একটু থেমে সুবব্ধু আবার বলল, বিদায় নেওয়ার আগে তোমায় একটা অনুরোধ করব, রাহুল। আশাকরি অনুরোধ রক্ষিত হবে।

অনুরোধ নয়, আদেশ, রাহুল বলল, তুমিই আমার অস্ত্রশিক্ষার প্রথম ও প্রধান আচার্য। তোমায় গুরুদক্ষিণা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু তোমার আদেশ আমি সর্বদাই নতমস্তকে পালন করতে প্রস্তুত থাকব।

-রাহুল! আজ আমি তোমাকে আমার প্রকৃত পরিচয় জানাব এবং সেই সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে তুমি যেভাবে আমায় গুরুদক্ষিণা দিতে পারবে, সে বিষয়ে তোমাকে অবহিত করব।

কুমার। তুমি নিজমুখে তোমার পরিচয় আমাকে না জানালেও বজ্রের কাছে শুনেছি তুমি ছদ্মবেশী রাজপুত্র। তবে তুমি কোন দেশের রাজকুমার সেকথা আমায় বজ্র জানায় নি।

–জেনে নাও; আমি মগধের রাজকুমার। অনুসরণকারী গুপ্তঘাতকদের কবল থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য আমি ছদ্মবেশে বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ করছি এবং বিশ্বস্ত সেনাদল সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি বন্ধুদের সাহায্যে। আজ সংগঠনের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ, আমার বন্ধুবর্গ অস্ত্রধারণ করতে প্রস্তুত। ভানু সেই বার্তাই বহন করে এনেছে। আমি এই অঞ্চল থেকে সরে গিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেব এবং খুব শীঘ্রই মগধ আক্রমণ করব। সেই যুদ্ধে হয়তো তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন হতে পারে। রাহুল! আজ থেকে ছয়মাসের মধ্যেই আশা করি তুমি একটি ক্ষুদ্র সেনাদল প্রস্তুত করতে পারবে।

–মাত্র ছয় মাস! খুবই অল্প সময়। তবে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আরও একটা কথা—

 রাহুলকে ইতস্তত করতে দেখে সুবন্ধু বলল, রাহুল। তুমি কিছু বলতে চাও, মনে হচ্ছে? ইতস্ততঃ করছ কেন? আমার কাছে অসংকোচে মনের কথা খুলে বলতে পারো।

–আমি যখন গ্রামে ছিলাম, সেইসময় নোকমুখে শুনেছিলাম নন্দরাজকে রাজ্যচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার জন্য চন্দ্রগুপ্ত নামক রাজবংশের এক ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ওই ব্যক্তি ঘাতককে ফাঁকি দিয়ে সকলের অগোচরে পলায়ন করে। কিন্তু সুবন্ধু নামে কোনো মগধ-রাজপুত্রের কথা আমি শুনি নি।

আমিই সেই চন্দ্রগুপ্ত, মগধ-সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। দুরাচার নন্দরাজ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাকে হত্যা করার জন্য গুপ্তচর ও গুপ্তঘাতকদের প্রেরণ করেছে। তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য আমি পেশাদার সৈনিকের ছদ্মবেশে সুবন্ধু নাম নিয়ে আর্যাবর্তের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছি। আজ আমার আত্মপ্রকাশ করার সময় হয়েছে। বন্ধুবর ভানুর কাছে খবর পেলাম আমার বন্ধুগণ সমবেতভাবে অপেক্ষা করছে মগধ-অভিযানের জন্য। এখনও আমার কিছু প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেই প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হলেই শুরু হবে মগধ-অভিযান। দুষ্ট নন্দরাজকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে শীঘ্রই আমি আমার পিতৃরাজ্য মগধ অধিকার করব।

–সেই অভিযানে আমিও সানন্দে যোগ দেব আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে। আশা করি অদুর ভবিষ্যতে কুমার চন্দ্রগুপ্ত মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত নামে অভিহিত হবেন।

রাহুল! তোমাদের সম্মিলিত শুভেচ্ছাই আমার বিজয়ের পথ সুগম করবে। আচ্ছা, এখন বিদায় গ্রহণ করছি।

সঙ্গীদের নিয়ে অরণ্যের অন্তরালে অন্তর্ধান করলেন রাজকুমার চন্দ্রগুপ্ত।