০৫.
যুক্তি, সম্ভাবনা ও জয়সোয়ালজী
শ্ৰীমতী মালহোত্রাকে নিয়ে ওরা ভেতরে শোবার ঘরে চলে গেলে আমি বেরোলুম। ঘরের এই পরিবেশে এবার দম আটকে আসছিল। বাইরে লনে কিছুক্ষণ পায়চারি করলুম। কিন্তু জয়ন্তী বা কর্নেলরা কেউ বেরোচ্ছেন না। ব্যাপার কী? জয়ন্তীকে অতক্ষণ ধরে প্রশ্ন করা কেন? মুহূর্তে আমার মাথায় একটা আবছা সন্দেহ ভেসে এল। জয়ন্তী বা শ্যামলীর পিছনের কথা তো কিছুই জানি না। এমনও তো হতে পারে যে মোহন পারেখের সঙ্গে প্রণয়ঘটিত কোন ঘটনার জের এই বাণেশ্বর অবধি ধেয়ে এসেছিল এবং পরিণামে পারেখ আর শ্যামলীর মৃত্যু ঘটল!
সন্দেহটা মাথায় দিব্যি ভেসে বেড়াতে থাকল। কলকাতার সাউথ পার্ক লেনের সেই দুবোন মিতারিতার কেসটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওরা একজনকেই ভালবাসত। তারপর ছোটবোন রিতা পরিণামে নিজের সহোদর দিদি মিতাকে হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয়নি। বিহারে এমনি এক পাহাড়ী অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। কথামতো আগে গেল দুবোন, তারপর ওদের প্রণয়ী। রিতা এক সন্ধ্যায় পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিল সেই যুবকটিকে। ফিরে এসে সেই রাতেই পটাশিয়াম সাইনায়েড দিয়ে দিদিকে হত্যা করল। এবং আত্মহত্যার ঘটনা বলে রটাল। একটা চিঠিও পাওয়া গেল মিতার বিছানার তলায়। আত্মহত্যার কারণ খুবই স্বাভাবিক। প্রণয়ীর মৃত্যুর পর তার বেঁচে থাকার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না, তাই বিষ খেল। ওদিকে প্রণয়ীর মৃত্যুটা আকস্মিক দুর্ঘটনা বলে সবাই মেনে নিয়েছে। কাজেই রিতা সবদিক থেকে নিরাপদ হল। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তার কোন অসুবিধেই হল না।
কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধুর চোখ এড়িয়ে যাওয়া অনেকের পক্ষেই অসম্ভব। ঘটনাচক্রে তিনি এখন সেই পাহাড়ী স্বাস্থ্যনিবাসে এক বন্ধুকে দেখতে গেছেন। কোথাও কোন আকস্মিক মৃত্যুর গন্ধ পেলেই উনি তো একেবারে চঞ্চল হয়ে ওঠেন।
যাইহোক, সে কেসের কথা খবরের কাগজে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ হয়েছিল। ধুরন্ধর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার হত্যাকারীকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। রিতার বয়স বিবেচনা করে তার যাবজ্জীবন জেল হয়ে যায়। জেলে মাঝে মাঝে দেখা করে আসতেন কর্নেল। ফিরে এসে বলতেন, মেয়েটি অনুতপ্ত হয়েছে এতদিনে!…
বাণেশ্বরের ঘটনার সঙ্গে সেই ঘটনার একটা মোটামুটি মিল আছে, তা এতক্ষণে হঠাৎ আবিষ্কার করে আমি ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠলুম। কর্নেল কি মিতারিতার কেসটা ভুলে গিয়েছিলেন?
জয়ন্তীকে এখনও জেরা করা হচ্ছে দেখে আমার মনে হল, কর্নেল নিশ্চয় কেসটা ভোলেননি। অমনি গা শিউরে উঠল। তারপর ক্রমশ মন খারাপ হতে থাকল। জয়ন্তী কি রিতা? জয়ন্তী অত ভাল মেয়ে–অমন সরল, নিরহঙ্কার, আর দয়ালু! মনে মনে তার মুখের দিকে তাকালুম। কোথাও একবিন্দু পাপের ছায়া দেখতে পেলুম না। না, না–আমি ভুল করছি। তাছাড়া মোহনকে না হয় ভূতের পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা সহজ হল, শ্যামলীকে কীভাবে মারল সে? অতগুলো লোকের মধ্যে, অন্ধকার হলেও, চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে হত্যা করার মতো দক্ষতা, চাতুর্য আর নার্ভ তার যে নেই, আমি এতে নিঃসন্দেহ। কর্নেল বলেছেন, এ কাজ কোন প্রচণ্ড শক্তিধর ক্ষুরধারবুদ্ধি সম্পন্ন অভিজ্ঞ হত্যাকারীর। সে প্রেত হোক, আর মানুষ হোক, তার শক্তি অতি সাংঘাতিক। তাছাড়া, প্যাথোজেন বা নাতেমা নামক আদিম জিরো ইন্ডিয়ানদের ব্যবহৃত বিষ কোথায় পাবে জয়ন্তী? যদি পায়, সে তো অন্য কোথাও অন্য কোন সুযোগ তা ব্যবহার করতে পারত। এমনকি তা বাদেও কোন পর্বতাভিযানে গিয়ে শ্যামলীকে খুব সহজেই সে ধাক্কা দিয়েই তুষারখাদে ফেলে মারতে পারত! ধরা যাক, যেভাবে মোহনকে মেরেছে সেভাবে তাকেও মারতে পারত ভূতের পাহাড়ে গিয়ে। কেউ কোন সন্দেহ করত না। কারণ দুজনেরই পাহাড়ে চড়ার সার্টিফিকেট আছে। জয়ন্তী কৈফিয়ত দিত, পশ্চিমের খাড়াই বেড়ে ওঠার চেষ্টা করছিল তারা–হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটেছে। খুবই স্বাভারিক কৈফিয়ত হত।
কিন্তু আরেকটা যুক্তি মনে ভেসে এল। সেটাও কর্নেলের। হত্যাকারী যেই হোক, শ্যামলীকে হত্যা করেছে সে আকস্মিক সিদ্ধান্তে।
কথাটা বার বার নাড়াচাড়া করে দেখলুম। হ্যাঁ, ঠিক তাই-ই বটে। কারণ, ওই পরিবেশে শ্যামলীকে হত্যা করার ঝুঁকি ছিল। অন্ধকার থাকলেও ঝুঁকিটা খুব সামান্য নয়। হত্যাকারী মরিয়া হয়ে, ঝুঁকিটা নিয়েছিল, তা বোঝা যায়। মার্ডার-উইপন বা হত্যার অস্ত্র যাই হোক, হত্যা করার মতলব যদি আগেই পরিকল্পিত হয়ে থাকে, তাহলে এতগুলো লোকের মধ্যে তা ব্যবহার না করে অন্যখানে শ্যামলীকে একা পেয়ে দিব্যি কাজে লাগানো যেত না কি? বিশেষ করে জয়ন্তীই যদি হত্যাকারী হয়, তাহলে তো তার সুযোগের জন্যে প্ল্যানচেটের আসরে আসতে হবে কেন?
ধরা যাক, জয়ন্তী মোহনকে খাদে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে এবং শ্যামলী আড়াল থেকে দেখেছে, তারপর হঠাৎ প্ল্যানচেট আসরের সুযোগ পেয়ে প্রিয় বান্দবীর কীর্তি ফাস করতে চেয়েছে–এতে জয়ন্তী বিপদ বুঝেই শ্যামলীকে কোন অজ্ঞাত অস্ত্রে হত্যা করেছে।
আবার দেখলুম, জয়ন্তীর দিকে সন্দেহের পাল্লাটা ভারী হয়ে যাচ্ছে।
তখন হাল ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ সিগারেটে দেখলুম এবং পায়চারি করলুম। হ্যাঁ এবং নার দোলায় অস্থির হতে থাকলুম। খানিকটা আগে হলুদ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জয়ন্তী প্রেতশক্তিকে হত্যাকারী প্রমাণের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল কেন? সে সুশিক্ষিত আধুনিকা। আবার অবাক লাগছিল তার মতামত। অবশ্য শ্যামলী গতকালের বিকেলে ভূতের পাহাড়ে ওকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে বিদ্রূপ করছিল বটে! তাহলেও আজ জয়ন্তী যেন ভূতপ্রেত দিয়ে তার আত্মরক্ষার জন্যে নিছক একটা সাফাই গড়ে তুলছিল আমার কাছে। নাঃ ভূতে আমার এখন এই উজ্জ্বল দিনের বেলায় একটুও বিশ্বাস নেই। চমৎকার ঝিরঝিরে বাতাস দিচ্ছে। চারদিকে স্পষ্টতার মধ্যে কোন অশুভ শক্তির কোন চিহ্ন নেই।
সিগারেট শেষ হলে একটা সিদ্ধান্ত নিলুম। জয়ন্তীর সঙ্গে যতটা পারি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা শুরু করব। দরকার হলে ফ্লার্টিং করব–এমনকি ওকে চুমু খেতে চেষ্টা করব, বুকে টানব। দেখা যাক, এতে কতখানি ফল পাওয়া যায় নিপুণ প্রেমের অভিনয় দিয়ে অবশ্য জানি না ও যদি সত্যিকার হত্যাকারী হয়, কতখানি সিদ্ধিলাভ সম্ভব হবে। অন্তত এটুকু বলতে পারি, বহুদিন ধরে ধুরন্ধর এক গোয়েন্দার শিষ্যত্ব নিয়ে যা কিছু শিখেছি, তা ঠিক ঠিক প্রয়োগ করতে পারলে কিছুটা কাজ হবেই।
হাসি পেল। প্রেমের অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি-সত্যি প্রেমে পড়ে যাব না তো? তাহলে আবার উল্টো বিপদ হবে। জয়ন্তীর মধ্যে একটা মারাত্মক টান আছে–এমনিতেই তার খপ্পরে পড়েছি আজ সকাল থেকে। ওকে না দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলুম না এতক্ষণ? মনকে বললুম–শক্ত হবি ব্যাটা। খবদার, বেশিদূর এগিয়েছ কী মরেছ!
তখনও কর্নেলদের কোন পাত্তা নেই। ব্যস্ত হয়ে ডাইনিং হলে উঁকি মেরে, চলে এলুম। তারপর একেবারে গেট পেরিয়ে রাস্তায় উঠলুম। অন্যমনস্কভাবে হোটেলের দিকে চলেছি, হঠাৎ দেখি রাস্তার ধারে বেমক্কা গজিয়ে ওঠা পিরামিডের মতো তিনকোনা প্রচণ্ড ন্যাড়া পাথরের কাছে দাঁড়িয়ে জয়সোয়ালজি পাইপ টানছেন। সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপর তাই পাথরটার উত্তরধারে ছায়া সেঁটে গেছে। ওই একফালি ছায়ায় ভদ্রলোক আপনমনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পিঠটা পাথরে ঠেকিয়ে একটু বাঁকাও হয়েছেন। আমি এই বদমেজাজী প্রাক্তন পুলিশ ডিক্টেটরের পাল্লায় পড়া বাঞ্ছনীয় মনে করলুম না। কিছুক্ষণ আগে যেভাবে রেগেমেগে বেরিয়ে এসেছেন, বলা যায় না–এখন সেই রাগটা আমার ওপর ঝেড়ে বসতে পারেন পুরোপুরি।
এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাই উনি হাত তুলে ডাকলেন–চাউড্রিজি! প্লিজ কাম হিয়ার!
গলার স্বর একেবারে অন্যরকম এখন। তবু ভয়েভয়ে কাছে গেলুম। এখনও হোটেলে ফেরেননি স্যার?
নাঃ। জাস্ট থিংকিং–ভাবছি। আসুন চাউড্রিজি!
এখানে ওইভাবে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন পুলিস সুপার কী ভাবছেন, জানতে কৌতূহল হচ্ছিল। আমি কাছে গেলে পা বাড়ালেন। তারপর আমার একটা হাত নিয়ে বললেন–আমার মেজাজ সময়ে সময়ে লোকে বড্ড বিগড়ে দেয়। তখন সামনে যাকে পাই কড়া কথা বলে বসি। আপনি আমার ছেলের বয়সী চাউড্রিজি, দয়া করে কিছু মনে করবেন না।
ব্যস্তভাবে বললুমনা, না। কী যে বলেন, স্যার!
–দেখুন, আমি সেই বাইশ বছর বয়সে ব্রিটিশ আমলে পুলিসের চাকরি নিয়েছিলুম। নিজের যোগ্যতায় সামান্য সার্জেন্ট থেকে অবশেষে পুলিস সুপার হয়েছিলুম। অজস্র মেডেল আর পুরস্কার পেয়েছি জীবনে। কত মারাত্মক সব কেসের অপরাধীদের খুঁজে বের করেছি–সে এক দীর্ঘ রোমাঞ্চকর অধ্যায় ছিল জীবনের। আমার চোখে চোখে পড়লেই গলগল করে অপরাধীরা সব কবুল করে যেত। আপনি রাজস্থানে যান। তামাম স্টেট আমার নাম শুনলে এখনও বলে উঠবে–হ্যাঁ, পুলস সুপার একজনই ছিল–সে জয়সোয়ালজি। এখন আমার অবসরজীবন। আজ দশ বছর অবসর নিয়েছি। বয়স হয়েছে। ছোটাছুটি বা কোন ঝামেলা বিলকুল পছন্দ হয় না, পরিও না। কিন্তু বড় কষ্ট হয় চাউড্রিজি, বুঝলেন? কোন জমানা ছিল–আর আজ কোন্ জমানা এল! শাসন চালাবার যোগ্যতা নেই, বুদ্ধিসুদ্ধি সেই, সব আলুর কারবারী ঢুকেছে প্রশাসনে। আর পুলিস প্রশাসন? ছ্যা ছ্যা! অযোগ্য নির্বোধ কতকগুলো তোক ঘুরে বেড়াচ্ছে! পুলিশ শুনলেই একসময় লোকের পিলে চমকে উঠত। আর আজ? পুলিশের প্যান্ট খুলে লোকেরা লেজ খুঁজে দেখে!
হো-হো করে হেসে উঠলুম।
জয়সোয়ালজি বললেন–হাসবেন না। হাসির কথা নয়। খুবই দুর্ভাবনার কথা চাউড্রিজি। পুলিসকে যদি ভয় না করলে, তো প্রশাসন চলবে কেমন করে? তাই তো এই অরাজক অবস্থা সারা দেশে। দুর্নীতি আর খুনজখম হু-হুঁ করে বেড়ে গেছে। এত ক্রিমিনাল বেড়ে যাওয়ার কারণ কী জানেন? লোকে পুলিসকে আর ভয় করে না। দেখছে, এরা আসলে কাকতাড়ুয়া-খড়ের মূর্তি। তালপাতার সেপাই সব। হাতে খেলনার বন্দুকপিস্তল। যান–পরীক্ষা করে দেখুন, গুলি বেরোয় না–বেরোয় গুলতির গুল!
আবার হাসি এল, কিন্তু সামলে নিলুম। কড়া ধমক খাওয়া বিচিত্র নয়। বললুম–ঠিক বলছেন, স্যার! আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তো তাই ঘটছে! বাচ্চা ছেলেরা পুলিশের হাত থেকে বন্দুক-পিস্তল কেড়ে নিয়ে কেটে পড়ছে।
জয়সোয়ালজি জোর নড়ে উঠলেন। –বিলকুল তাই ঘটছে। আরে! তুমি হচ্ছ কিনা পুলিস। ব্রিটিশ ট্রাডিশনের বীরত্ব তেজ শক্তি সাহস তোমার রক্তে থাকবে গাঁথা। তা কিনা, হাতে এমন সাংঘাতিক অস্ত্র থাকতে তুমি ভ্যাবলার মতো মার খাচ্ছ? পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপার দেখতে দেখতে আমি পাগল হয়ে যাই চাউড্রিজি! ছ্যা ছ্যা ছ্যা! যার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, তাকে কিনা সামান্য ছুরি দিয়েই কাহিল করে মারছে? আমি হাসব না কাদব ভেবে পাই না, যখন দেখি, বন্দুক পিস্তলের সঙ্গে শেকল লটকানো রয়েছে। সব বাঘ এখন গিদ্ধড় হয়ে গেছে। চাউড়ি। আমার হাত নিশপিশ করে। দিক না একদিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের পুলিস কর্তার দায়িত্ব আমার কাঁধে মাত্ৰ-একদিন, বুঝলেন? দেখবেন–সব শালা শায়েস্তা হয়ে গেছে!
সায় দিলুম–যা বলছেন স্যার!
–এই খান্নাটাকে কী ভাবছেন? ও তো একটু বুদ্বুর বুদ্বু। পুলিস ইন্সপেক্টার হয়েছে নেহাত খুঁটির জোরে। ও একজন কনস্টেবল হওয়ারও যোগ্য নয়। তাছাড়া, কিছু মনে করবেন না। চাউড্রি, আপনার কর্নেল ভদ্রলোকের ব্যাকগ্রাউন্ড আমি জানি না–না উনি চোখের সামনে যা দেখছেন, তা ছেড়ে দিয়ে তফাতে ঘুরতে যাচ্ছেন। কোন কোন মানুষের স্বভাব অবশ্য এমনিই হয়। আপনার কর্নেল কি ডিটেকটিভ ডিপার্টে ছিলেন?
জবাব দিলুমনা না। উনি মিলিটারির লোক।
জয়সোলাজি পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে ঘোঁতঘোঁত করে পুলিসি হাসি হাসলেন। শখের গোয়েন্দা?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ওঁর অনেক হবি মধ্যে এটাও একটা। জয়সোয়ালজি আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে বললেন–আপনার ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে বলে দেবেন, খুনোখুনি হবির মধ্যে পড়ে না। আগুন নিয়ে খেলার শামিল। আরে বাবা, ডিটেকশান বিদ্যা যদি এতই সহজ আর অশিক্ষিত-পটুত্বের ব্যাপার হত, তাহলে আর ট্রেনিং এবং অভিজ্ঞতার দরকার হত না!..
হোটেলের গেটে এসে পড়েছিলুম। তাই বাঁদিকে ঘুরছি, জয়সোয়ালজি আমার হাতে ধরে টানলেন। লাঞ্চের এখনও ঢের দেরি আছে। চলুন না, একবার নেপাল বর্ডার অবধি ঘুরে দেখে আসি, কী অবস্থা। আমি তখন বললুম, সারদা নদী পেরিয়ে নেপাল হয়ে বেরোনো যায়, খান্না কী জবাব দিল শুনলেন। তো? আমি বাজি রেখে বলছি ব্যাটা ওদিকে কখনও পা বাড়ায়নি। ওদিকটা আমার চেনা।
প্রস্তাবটা ভাল মনে হল। রাস্তা কবে মেরামত হবে ঠিক নেই। কালই যদি দরকার বুঝি, ঘুরপথে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগে পেলে ছাড়া উচিত হবে না। খুব বেশিদিন থাকাও যাবে না। ছুটি ফুরিয়ে যাবে। তাই ওঁর সঙ্গে পা বাড়ালুম। বললুম–কত দূর জায়গাটা?
জয়সোয়ালজি জবাব দিলেন–বেশি না, এক কিলোমিটার মাত্র। খান্নার কথা। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সারদা নদীতে এই বেমরশুমে বন্যা হয়ে গেল-মাত্র এক রাতের ঝড়-বৃষ্টিতে? ব্যাটা বড় ফাঁকিবাজি। আসলে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।
টনকপুর রোড ঘুরে বাঁদিকে চলে গেল। আমরা সে রাস্তা ছেড়ে সরু একটা পায়ে-চলা রাস্তায় নামলুম। দুধারে ঘন জঙ্গল। রাস্তাটা একটা পাহাড়ের গায়ে উঠে গেছে। চড়াইয়ে ওঠার পর লক্ষ্য করলুম, আশেপাশের পাহাড়গুলোতে অজস্র ধসের চিহ্ন রয়েছে। নীচের উপত্যকার ওপর ধস ছেড়ে সেখানেও অনেক গাছপালাকে মিশমার করে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, যেন কোন মহাকায় দানব হঠাৎ খেপে গিয়ে প্রকৃতির সাজানো ঘরসংসার লণ্ডভণ্ড করে আবার কোন গুহায় অন্ধকারে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে।
লক্ষ্য করলুম, কড়া ধাতের মানুষ হলে কী হবে, জয়সোয়ালজিরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার চোখ আছে। কারণ মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছেন এবং আগুনফুলের উজ্জ্বলতায় ভরা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে তারিফ করছেন। একস্থানে পাথরের ওপর ঝরনাধারার মতো অজস্র হলুদ অর্কিডের গুচ্ছ ডগায় আশ্চর্য সুন্দর লাল ফুল ফুটে রয়েছে। উনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তরপর সস্নেহে ঝুঁকে অর্কিডগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর বললেন–চাউড্রিজি কি বিবাহিত?
সলজ্জ হেসে জবাব দিলুমনা স্যার!
জয়বোয়ালজি বললেন–করবেন না। খামোকা প্রবৃত্তির বশে ঘরে দুশমন ডেকে এনে কী ফল?
–আপনি কি বিবাহিত, স্যার?
জয়সোয়ালজি ঘাড় নেড়ে বললেন–নো-ও-ও! আপনি পাগল হয়েছেন চাউড্রি? জীবনে সবকিছুকে আমি বিশ্বাস করতে রাজি–ওই একটি বাদে। স্ত্রীলোক! বলবেন, কেন একথা বলছি? বলছি স্রেফ আমার অভিজ্ঞতা থেকে। পৃথিবীতে যতরকম অপরাধ ঘটে থাকে, তার শতকরা নিরানব্বইটির পিছনে কোন-না-কোন-ভাবে স্ত্রীলোকের প্রভাব আছেই। স্ত্রীলোক সম্পর্কে খ্রিস্টানধর্মের ঈশারা আপনার মালুম হচ্ছে না? অ্যাডামকে স্ত্রীলোকেই তো জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে প্ররোচিত করেছিল! শয়তান প্রথম চেষ্টাতেই কৃতকার্য হয়েছিল ইভের ওপর। অ্যাডাম পুরুষ মানুষ। তাকে শয়তান নোয়াতে পারেনি। আর, আমাদের হিন্দুশাস্ত্র দেখুন। সেখানেও বলছেনারী নরকের দ্বার। তাই ঈশ্বরসাধনার প্রতিবন্ধক সে। ব্রহ্মচর্য ছাড়া ইশ্বর পাওয়া যায় না। তবে দেখুন, চাউড্রিজি, ঈশ্বর-টিশ্বর অনেক বড় কথা। আমি সামান্য মানুষ। আমি জানি, স্ত্রীলোক নিয়েই সাতকাণ্ড রামায়ণ আর অষ্টাদশপর্ব মহাভারত!
ওঁকে সায় দিয়ে বললুম ট্রয়ের যুদ্ধ, ওদিকে আরবের মুসলমানদের কারবালার যুদ্ধ-সবই স্যার, স্ত্রীলোকের কারণে ঘটেছিল নাকি। এমনকি কোন কোন পণ্ডিত বলেছেন, মোহেনজোদাড়ো সভ্যতার পতনের মূলেও স্ত্রীলোক। আর স্যার, আমাদের বাঙালিমতে বলা হয়, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী!
জয়সোয়ালজি আমার কাঁধে অন্তরঙ্গভাবে হাত রেখে বললেন বাঙালি খুব বুদ্ধিমান জাত। টেগোরকে- তাই নোবেল প্রাইজ দিয়েছিল বিলিতি পণ্ডিতরা।
–টেগোরও স্যার স্ত্রীলোকের ব্যাপারটা এক বিয়েতেই বুঝে ফেলেছিলেন। তাই স্ত্রীর অকালমৃত্যুর পর বাকি জীবন আর বিয়েই করলেন না। বুড়িয়ে খটখটে হয়ে একা একা মারা গেলেন। তবু কোন স্ত্রীলোককে পাত্তাই দিলেন না!
জয়সোয়ালজির চোখ পিটপিট করছিল উত্তেজনায়। এবার চাপাগলায় বললেন–মোহন পারেখটা বোকার মতো ওই স্ত্রীলোকের প্যাঁচে পড়েই মারা গেছে, বুঝলেন চাউড্রি? আমি জানি।
চমকে উঠে বললুম–আপনি জানেন?
নিশ্চয় জানি। মানে প্রত্যক্ষদর্শী নই। কিন্তু এ আমার একরকম জানাই বলতে পারেন। খান্নাটা বড় ভুল করছে।
ব্যাপারটা জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছে স্যার।
জয়সোয়ালজি হাঁটতে হাঁটতে বললেন-দেখুন, বরাবর, আমার মেথড অফ ডিটেকশান হচ্ছে, প্রথম মুহূর্তেই ইনটুইশান বা সহজাত বোধ যা বলে, তার দিকে মনোযোগ দাও। শ্যামলী মেয়েটি মারা গেছে শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার ইনটুইসান বলে দি-মিসেস মালহোত্রার দিকে লক্ষ্য রাখো!
–কিন্তু স্যার–
–ওয়েট, ওয়েট। মোটিভ পরে খুঁজবেন। প্রথমে দেখনু হত্যার চান্সটা কার বেশি ছিল? শ্যামলীর কাছাকাছি ছিল যে, তারই এখন, ওর ডাইনে ছিলুম আমি, বাঁয়ে মিসেস মালহোত্রা। কেমন?
-হ্যাঁ স্যার!
–এখন দেখুন, আমি জানি যে আমি হত্যা করিনি। তাছাড়া, যুক্তিশাস্ত্রের বিচারে আমিই যখন ডিটেকশন করছি অর্থাৎ হত্যাকারীকে খুঁজছি, তখন আমি নিজে হত্যাকারী নই। তাহলে দেখলুম, বাকি রইলেন মিসেস মালহোত্রা। কিন্তু তিনি কেন খুন করবেন? হ্যাঁ–এ একটা প্রশ্ন। অনেক ভাবলুম। ভেবে দেখলুম, ভদ্রমহিলা প্রেততত্ত্ব চর্চা করেন। ওঁর বদ্ধমূল ধারণা, প্রেতকে মিডিয়ামের দেহে আনা যায়। তাই শ্যামলীর মধ্যে প্রেতাত্মা আসুক, এই জেদ ওঁর ছিল। বলুন, এমন অবস্থায় ভদ্রমহিলার এই জেদ থাকা উচিত কি না?
–ঠিক বলেছেন স্যার। গোঁড়া বিশ্বাসী মানুষ তার বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণের জন্য সবসময় জেদ ধরে বসে থাকে।
–আপনি বুদ্ধিমান, চাউড্রি। তার ওপর আমরা এতগুলো হোমরাচোমরা সব মানুষ বসে আছি আসরে। আমাদের তাক লাগতে পারলে মিসেস মালহোত্রার মস্তো জয় হয় যায়। এদিকে আমরা সবাই প্রায় অবিশ্বাসী। কাজেই ভদ্রমহিলা প্রায় বাজি ধরে বসেছিলেন। সাইকলজিকাল পয়েন্ট থেকে ভেবে দেখুন চাউড্রিজি, এ ছিল মিসেস মালহোত্রার জীবনের এক চরম সঙ্কটময় মুহূর্ত। হেরে গেলে সে এক বড় অসম্মানের কথা, বড় লজ্জার কথা ওঁর জীবনে!
–ঠিক স্যার, আপনার যুক্তি অসাধারণ।
জয়সোয়ালজি এবার গোঁফে তা দিয়ে বললেন–এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে, এমন একটা মানসিক উদ্বেগের সময়ে, মিসেস মালহোত্রা দেখলেন যে শ্যামলী অভিনয় করছে। অর্থাৎ তামাশা করছে!
–অভিনয় করছে?
–বিলকুল! আপনি কি বিশ্বাস করেন, শ্যামলীর মুখ দিয়ে ভূতে কথা– বলছিল? এই বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের যুগে, যখন মানুষ গ্রহান্তরে পাড়ি দিচ্ছে, তখন আপনি ওইসব আদিম কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকবেন?
–মোটেও না, স্যার, ভূতটুত ছেলেভোলানো গল্প ছাড়া কী?
–হ্যাঁ, মিসেস মালহোত্রা টের পেলেন যে শ্যামলী তাঁর বিশ্বাস নিয়ে তামাশা করছে। বলবেন–কেমন করে টের পেলেন? পেলেন–যখন দেখলেন, জলজ্যান্ত মোহন পারেখকে ভূত বানাচ্ছে শ্যামলী।
–কিন্তু মোহন সত্যি তো তখন মৃত!
–মৃত হলেও তখন সে সবার কাছে জীবিত। কারণ কেউ জানত না যে সে পাহাড়ের খাদে পড়ে মারা গেছে। মোহন মালহোত্রা ফ্যামিলির নাকি খুব ন্যাওটা ছিল শুনুলুম। মিসেস মালহোত্রা নিঃসন্তান। এক্ষেত্রে মোহনের মৃত্যু জেনেও উনি চুপচাপ বসে থাকবেন, এটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় আপনার?
না স্যার।
মোহনের মৃত্যু কীভাবে হল, পরে আসছি সেকথায়। এখন দেখুন, যেই মিসেস মালহোত্রা টের পেল যে বাঙালির মেয়েটি তাঁকে নিয়ে তামাশা করছে, অমনি তাঁর মাথায় বিস্ফোরণ ঘটল। চাউড্রি, এ হচ্ছে মিসেস মালহোত্রার আকস্মিক সিদ্ধান্ত!
মুহূর্তে কর্নেলের ওই একই কথা মনে পড়ে গেল। আকস্মিক সিদ্ধান্তেই হত্যাকারী শ্যামলীকে খুন করেছে। আমি জয়সোয়ালজির মুখে কর্নেলের উক্তি এবং যুক্তির প্রতিধ্বনি শুনে শুধু অবাক নই, অভিভূত হলুম। জয়সোয়ালজি সত্যি ঝানু পুলিস অফিসার। ওঁর যুক্তি, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, পটভূমির খুঁটিনাটি অবস্থা বিচার এবং সম্ভাবনাতত্ত্বের সার্থক প্রয়োগ দেখে চমৎকৃত হয়ে বললুম– তাপূর্ব ডিডাকশান আপনরা! এদিকটা কেউ ভাবছেন না!
এবার প্রশ্ন ওঠে, মার্ডার-উইপনটা তাহলে কী ছিল? চাউড্রিজি, মিসেস মালহোত্রা কেন, পৃথিবীর যেখানে যারাই প্রেততত্ত্ব, ব্ল্যাকআর্ট ব্ল্যাকম্যাজিক, ডাইনিতত্ত্ব বা উইচক্র্যাফ্ট এক্সরসিজম বা ঝাড়ফুক তুকতাক ইত্যাদি আদিম সংস্কার নিয়ে চর্চা করে, তাদের অদ্ভুত-অদ্ভুত সব জিনিস সংগ্রহ করে রাখতে হয়। কেন রাখতে হয় জানেন? মানুষকে তাক লাগাবার জন্যে। কারণ, বাস্তবিক তো পৃথিবীতে অলৌকিক ব্যাপার মাথা খুঁড়লেও ঘটতে দেখা যায় না। যা আপাতদৃষ্টিতে অলৌকিক মনে হয়, পিছনে বাস্তব কারণ ও যুক্তি থাকেই। তাই অসহায় ও মরিয়া হয়ে তারা বিচিত্র জিনিস যোগাড় করে রাখে। উদ্দেশ্য– অগত্যা ম্যাজিক দেখিয়ে বিশ্বাস উৎপাদন। এর জন্যে দরকার হলে তারা হত্যাতেও কুণ্ঠিত হয় না। রাজস্থানের এক গ্রামে এক তথাকথিত ডাইনি নিজের শক্তি দেখাতে কী করেছিল শুনুন। বশীকরণ, তাড়ন, মারণ, উচাটন ইত্যাদি প্রাচীন ভারতীয় ডাকিনিবিদ্যার কথা আশা করি আপনার জানা আছে। একটা লোক তার শত্রু নিপাতের জন্যে সেই ডাইনিকে ধরল। তখন ডাইনি করল কী, মারণমন্ত্রের অনেকরকম তুকতাকের ভড়ং করল। কিন্তু কার্যত সে সেই ভিকটিমের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে গিয়ে চুপিচুপি তার ছাতুর মধ্যে বিষ মাখিয়ে এল। ছাতুখোর লোকটার ভোরে ছাতু খেয়ে কাজে যাওয়া অভ্যাস ছিল। যাই হোক, সে এক অদ্ভুত বিষ। লোকটা ক্রমশ পেটের অসুখে মারা পড়ল। চাউড্রি আদিম যুগের লোকেরা অদ্ভুত সব বিষের সন্ধান রাখে। আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান তা কল্পনাও করতে পারে না। আপনি যান আফ্রিকার জঙ্গলে, কিংবা অস্ট্রেলিয়া, কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের জঙ্গলে, দেখবেন, আদিম অধিবাসীরা কতরকম আশ্চর্য বিষের সন্ধান রাখে। তা মডার্ন চিকিৎসাবিজ্ঞানে হেঁয়ালির সৃষ্টি করবে।
মনে পড়ে গেল কর্নেলের মুখে শোনা প্যাথোজেন এবং নাতেমার কথা। প্যাথোজেন তো একালের আবিষ্কার, কিন্তু নাতেমা দক্ষিণ আমেরিকার জংলি জিরো জাতির আবিষ্কৃত বিষ এত তথ্য জয়সোয়ালজির জানা! আবার ওঁর বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়লুম। বললুম, খুব ইন্টারেস্টিং স্যার! বলুন।
জয়সোয়ালজি দম নিয়ে বললেন–মিসেস মালহোত্রাও আসলে সেই প্রিমিটিভ উইচ-ক্রাফটের চর্চা করেন। নানা দেশ ঘুরেছেন শুনেছি। ওঁর পক্ষে তেমন কোন আদিম এবং আমাদের অজ্ঞাত মারণাস্ত্র যোগাড় করা মোটেই অসম্ভব নয়। রাজস্থানে ডাকিনিবিদ্যার প্রভুত চর্চা আছে গ্রামাঞ্চলে। কত কেস যে আমি ধরেছি, ইয়ত্তা নেই। একবার একটাকে, ধরলুম। একের পর এক এলাকার বাচ্চারা অদ্ভুত একটা রোগে মারা পড়ছে। ডাক্তারেরা ব্যতিব্যস্ত। রোগটা ধরতেই পারছেন না ……।
বলেই উনি থেমে গেলেন। কেন থামলেন খুঁজছি, দেখি উনি বাঁদিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কিছু লক্ষ্য করছেন যেন। বাঁদিক নীচে জঙ্গলেভরা একটা উপত্যকা। আমার চোখে কিছু পড়ল না। তাই বললুম, আর কদুর স্যার?
জয়সোয়ালজি বললেন এসে গেছি। সামনের বাঁক ছাড়ালেই দেখতে পাব।
হাঁটতে হাঁটতে উনি বার বার পিছু ফিরে সেদিকে তাকাচ্ছেন দেখে আর চুপ করে থাকা গেল না। বললুম–কী স্যার?
জয়সোয়ালজি ভুরু কুঁচকে গম্ভীর হয়ে বললেন চাউড্রি, ওই অধ্যাপক ভদ্রলোককে আপনার কেমন মনে হয়?
ভালই। কেন বলুন তো?
–তখন মোহন পারেখের মৃত্যুর ব্যাপারটা বলতে গিয়ে বলা হয়নি। এবার শুনুন। মোহনকে ভূতের পাহাড় থেকে সম্ভবত ওই অধ্যাপকই ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল।
চমকে উঠে বললুম–সে কী!
–একথা কেন মাথায় এসেছে, জানেন? আমার সঙ্গে যতটুকু আলাপ হয়েছে, অধ্যাপক দ্বিবেদী ভীষণ সেকেলে রুচির মানুষ। বিশেষ করে নীতিবাগীশ। ফিল্মের লোকেদের প্রতি ওর প্রচণ্ড রাগ। মোহন পারেখের সম্পর্কে ভীষণ নিন্দে করছিল গতকাল। বলছিল, এরাই দেশটাকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে!
বলেন কী!
–হ্যাঁ। বলছিল, মোহন নাকি মেয়েছেলে দেখলেই বাঘের মতো হালুম করে ঝাঁপ দেয়! –ঘোঁতঘোঁত করে হাসলেন জয়সোয়ালজি। ফের বললেন– অধ্যাপক বলছিল, ওই মোহন নাকি কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে সংখ্যা নেই। ওর ফাঁসি হওয়া দরকার। মোহনের নিন্দে করার সময় অধ্যাপকের মুখে আমি একটা ক্রুর অভিসন্ধি লক্ষ্য করেছিলুম। দেখার পর, ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল।
–কিন্তু দেখে তো মনে হয় বড় নিরীহ ভীতু মানুষ।
–কারপেটে কী আছে, বলা কঠিন। চেহারা দেখে কি খুনী চেনা যায় চাউড্রি? …বলে উনি চুপ করে গেলেন হঠাৎ। ফের নীচের উপত্যকায় কী দেখলেন।
বাঁকের কাছে এসে মুখ খুললেন–দেখুন চাউড্রি, নীচের ওই জঙ্গল মনে হচ্ছে, অধ্যাপককে দেখছিলুম।
হৃৎপিণ্ডে খিল ধরে গেল আজানা ভয়ে বললুম-আঁ! অধ্যাপক?
–সেইরকম মনে হল। ব্যাটা গতিক বুঝে সারদা পেরিয়ে নেপালের দিকে কেটে পড়ার মতলব করেনি তো?
কিন্তু পুলিস যে সবাইকে চোখে চোখে রেখেছে?
জয়সোয়ালজী রেগে গিয়ে বললেন–খান্নার পুলিসকে আর পুলিস বলবেন না চাউড্রি! ওতে একটা বিরাট গৌরবোজ্জ্বল ট্রাডিশনকে আপমান করা হয়। এই যে আমি বা আমরা দুজনে চলে এলুম, এখন দিব্যি পালাতে পারি। কে দেখছে?
ঘাবড়ে গিয়ে বললুম–আমাদের পালাবার কোন কারণ নেই স্যার!
নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু ডিসিপ্লিন ইজ ডিসিপ্লিন!
–সত্যি, পুলিস আজকাল বড্ড নিষ্ক্রিয়।
কথাটা বলার পরই লক্ষ্য করলুম, সামনে পূর্বে বিশাল খোলামেলা আকাশ। নীচে বিরাট একটা নদী। প্রচণ্ড বেগে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ওপারে নেপালের পাহাড় রোদে ঝলমল করছে। কিন্তু খান্না ঠিকই বলেছিলেন, দুরন্ত খাড়া ওই সব পাহাড়। নদীর গা ঘেঁষে সোজা দেয়ালের মতো উঠে গেছে হাজার-হাজার ফুট উঁচুতে। নদীর স্রোতেও অজস্র গাছ ভেসে যাচ্ছে দেখলুম। ডাইনে দূরে প্রচণ্ড জলকল্লোল শোনা যাচ্ছিল। জয়সোয়ালজি বললেন–জলপ্রপাত আছে। ওখানটা। ওই দেখুন, কেমন ধোঁয়া হয়ে রয়েছে! ওগুলো আসলে মেঘ।
আমাদের পায়ের কয়েক গজ তফাতে ধস ছেড়েছে। নদীগর্ভ পর্যন্ত খাড়া দেয়ালের মতো নেমে গেছে এই পাহাড়াটা। বাঁদিকের উপত্যকা থেকেও একটা পাহাড় উঠেছে নদীর ধার অবধি। এই পাহাড় দুটোর মধ্যে এক গভীর খাদ। তলার দিকে তাকানো যায় না।
মিনিট দশেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর ঘড়ি দেখলেন জয়সোয়ালজি। তারপর বললেন–চলুন, ফেরা যাক। নেপাল হয়ে যাওয়া দেখছি সত্যি অসম্ভব। তবে খান্নাটা পরের মুখে ঝাল খেয়েই বলছিল, তা আমি হলফ করে বলতে পারি।
আবার ফেরা শুরু হল। এবার উনি বেশ খানিকটা গম্ভীর। কিছুদূর আসার পর ডাইনে সেই উপত্যকার দিকে জীবজন্তুদের একটা চলার পথ নেমে গেছে যেখানে, সেখানে এসেই আচমকা জয়সোয়ালজি বললেন–চাউড্রি, চলে আসুন তো!
তারপর ওই ঢালু পথ বেয়ে পাহাড়ী বাঘের মতো দৌড়ে নামতে শুরু করলেন জয়সোয়ালজি। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওঁকে অনুসরণ করার চেষ্টা করলুম। ঘুরে ঘুরে নীচে নেমেছে। দুধারে ঝোপঝাড় আর বড় বড় গাছ। পাথরও ছড়িয়ে রয়েছে সবখানে। একটা বাঁকে গিয়ে ওঁকে হারিয়ে ফেললুম। তখন চাপাগলায় ডেকে উঠলুম–জয়সোয়ালজি! জয়সোয়ালজি!
সামনে কোথাও ঝোপের ওপাশ থেকে আওয়াজ এল–শাট আপ! ধমক খেয়ে ঢোক গিললুম। তারপর এগিয়ে গিয়ে দেখি, উনি একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে নীচে কী লক্ষ্য করছেন। কাছে গেলে ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করলেন।
কাছে গিয়ে সেদিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে থাকলুম। অধ্যাপক অরিন্দম দ্বিবেদী!
তাহলে সত্যিই এই জাঁদরেল পুলিসকর্তার ধুরন্ধর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেননি ভদ্রলোক। কিন্তু এখানে কী করতে এসেছেন। সারদা পেরিয়ে নেপালের দিকে পালানোর মতলবে নয় তো?
নিশ্চয়। তাছাড়া আর কোন কারণ থাকতে পারে না।
কিন্তু উনি স্রেফ খালি হাতে এসেছেন। পরনে যথারীতি ঢোলা পাতলুন, জগঝম্প গলাবন্ধ শেরোয়ানিজাতীয় কোট। ওই বেশে কি সাঁতার দিতে পারবেন ভদ্রলোক?
দেখলুম অধ্যাপক একটা প্রকাণ্ড ওক গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তাহলে দেখতে পেয়েছেন নির্ঘাত! কিন্তু উনি যেভাবে দাঁড়িয়েছেন, আমরা ওঁকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছি।
জয়সোয়ালজি এবার শিকারী বাঘের মতো গুঁড়ি মেরে বসে পড়লেন। দেখাদেখি আমিও বসলুম। তখন উনি ফিসফিস করে বললেন–আপনি বাঁদিক ঘুরে ব্যাটাকে ঘিরে ফেলুন, আমি ডানদিক ঘুরে যাচ্ছি। সাবধান, যেন ও দেখতে না পায়।
কথামতো আমি গুঁড়ি মেরে, কখনও বুকে হেঁটে, পাথর আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে এগোতে শুরু করলুম। জয়সোয়ালজিও ডানদিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর যেই ওঁকে ফের দেখতে গেছি, অমনি পা হড়কে সড়সড় করে একেবারে গড়াতে গড়াতে গিয়ে অনেকটা নীচে পড়লুম। তারপর পোশাক থেকে ধুলোমাটি খড়কুড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে তাকিয়ে দেখি ওক গাছটা ফাঁকা। জয়সোয়ালজি গুম হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। কাছে গেলে বললেন। পালিয়েছে। ব্যাটা অসম্ভব ধূর্ত।