ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৫. যাদুকরের কবলে টারজান

৫. যাদুকরের কবলে টারজান

দ্রিম! দ্রিম! দ্রিম!

অন্ধকার অরণ্যের বুকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে বাজছে নিগ্রোদের ঢাক, আর সেই স্বরলহরীর বন্য ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্দাম নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠেছে একদল অর্ধনগ্ন কৃষ্ণকায় মানুষ; একটু দূরে মস্ত বড় একটা হাঁড়িতে মস্ত বড়ো একটা হাতা দিয়ে ঠেলছে এক রাঁধুনি–

সর্দার মবংগোর পল্লীতে আজ রাতে মস্ত ভোজের আয়োজন। সেই দিনই দুপুরবেলায় মবংগোর যোদ্ধারা একটা প্রকান্ড হাতি শিকার করেছে। হাঁড়ির মধ্যে সেই মাংসই রান্না হচ্ছে। তরুণ যযাদ্ধারা শিকার নৃত্যে মত্ত, তাদের ঘিরে বসে রয়েছে নিগ্রোপল্লীর অন্যান্য নারীপুরুষ ও শিশুর দল আসন্ন ভোজের প্রত্যাশায় তারা আনন্দে মশগুল। আনন্দ তো হবেই, এমন শিকার বড়ো একটা জোটে না

সকলের অলক্ষ্যে একটা প্রকাণ্ড গাছের উপর থেকে নিগ্রোদের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছিল টারজান। দু-দিন ধরে তার শিকার জোটেনি। শুধু ফলাহারেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। নিগ্রোপল্লীতে হানা দিয়ে সংগৃহীত শিকারের মাংস চুরি করে বহুবারই টারজান তার ক্ষুধা নিবারণ করেছে, আজও সেই আশাতেই সে গাছের উপর থেকে নিগ্রোপল্লীতে উঁকি মারছিল। ভোজ শেষ হয়ে গেলে কিছু মাংস হয়তো হাঁড়ির মধ্যে থেকে যাবে, সেই আশাতেই গাছের উপর অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করছিল টারজান–

হাঁড়ির নীচে অগ্নিকুণ্ড প্রায় নিবে এসেছে। গাঁয়ের প্রায় সব মানুষই মাংসভোজনে তৃপ্ত হয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে শয্যা আশ্রয় করেছে, তবে যোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন এখনও হাঁড়ির ভিতর হাত চালাচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রায় সকলেই শুয়ে পড়ল।

যোদ্ধারা ঘরের ভিতর যায় নি, প্রকাণ্ড হাঁড়িটার চারপাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে, শুধু একটি লোক তখনও হাঁড়ির ভিতর হাত ঢুকিয়ে মাংস সংগ্রহ করছে!

টারজান আর ধৈর্য রাখতে পারল না। লোভী মানুষটা যথেষ্ট খেয়েছে, তার পেট ফুলে উঠেছে, তৃপ্তি নেই– এখনও সে হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছে হাঁড়ির ভিতর! শূন্য উদরে ক্ষুধার দংশন আর সহ্য করতে পারল না টারজান, প্যান্থারের মতো নিঃশব্দে গাছ থেকে নেমে সে নিগ্রোপল্লীর মধ্যে প্রবেশ করল

হাঁড়ির ভিতর থেকে মস্ত এক টুকরো মাংস তুলে নিল ওবুবু, কিন্তু তার হাত মুখ পর্যন্ত পৌঁছল না– লোহার মতো শক্ত দশটা আঙ্গুল ওবুবুর গলা চেপে ধরল! মাংসের টুকরো ফেলে দু-হাত দিয়ে আততায়ীর হাত চেপে ধরল ওবুবু। বৃথা চেষ্টা কণ্ঠনালীর উপর আঙ্গুলের চাপ আরও শক্ত হয়ে বসল—

অচেতন মানুষটার গলার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল টারজান। লোকটা সেখানেই পড়ে রইল।

তার দিকে দৃকপাত না করে হাঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল টারজান, দু-হাত দিয়ে বড়ো বড়ো কয়েক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করল। হাতির মাংস আগে কখনো খায়নি টারজান। হাতিরা তার বন্ধু। রান্না-করা মাংসের স্বাদও সে আগে কখনো পায়নি, কাঁচা মাংস খেতেই সে অভ্যস্ত। এখন ক্ষুধার জ্বালায় রান্না-করা হাতির মাংসই সে খেতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে ক্ষুধার উপশম হতেই কাঠের বেড়া ডিঙিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করল টারজান এবং একটা প্রকাণ্ড গাছের উপর উঠে ঘুমিয়ে পড়ল—

গভীর রাত্রে একটা অস্ফুট শব্দে টারজানের ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা ভেসে আসছে গাছের তলা থেকে। শব্দ অনুসরণ করে দৃষ্টিকে সঞ্চালন করতেই শব্দের উৎস আবিষ্কার করল টারজান গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পশুরাজ নামা এবং তার কণ্ঠ থেকে নির্গত হচ্ছে অবরুদ্ধ গর্জনধ্বনি।

ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত হয়েছিল টারজান, তবে চিন্তিত হয়নি। সে জানত এত উঁচু গাছে উঠে ন্যুমা তাকে ধরতে পারবে না। ন্যুমা যখন এক লাফ মেরে গাছের উপর বেশ কিছুদূর উঠে পড়ল, তখনও টারজান সাবধান হওয়ার দরকার মনে করল না। কারণ সিংহরা একটু-আধটু গাছে চড়তে পারলেও খুব উঁচু গাছে কখনোই উঠতে পারে না। কিন্তু এ কী কাণ্ড! এই সৃষ্টিছাড়া সিংহটা তর তর করে উঠে আসছে যে! টারজান তাড়াতাড়ি আরও খানিকটা উপরে উঠে পড়ল। মার গতি রুদ্ধ হল না, সে টারজানকে অনুসরণ করতে লাগল। অবশেষে টারজানের আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় রইল না, কোমরের ছুরিতে হাত দিল টারজান দ্যুমা তার ভয়ংকর থাবা বাড়িয়ে দিল টারজানের দিকে!

আচম্বিতে মাথার উপর থেকে একটা তীব্র শব্দের রেশ ভেসে এল, সচমকে মুখ তুলতেই টারজান দেখল আকাশ থেকে ছোঁ মেরে তার উপর নেমে আসছে একটা অতিকায় ঈগল! মুহূর্তের মধ্যে টারজানকে নখে চেপে ধরে আবার শুন্যে উঠে গেল ঈগল, আর শিকার হাতছাড়া হওয়ায় বন কাঁপিয়ে গর্জে উঠল কুদ্ধ ন্যুমা

আকাশের বুকে পাক খেতে লাগল ঈগল, তার নখে বন্দি হয়ে অসহায় ভাবে ঝুলতে লাগল টারজান। কিন্তু বেশিক্ষণ ওইভাবে শিকারকে ঝুলিয়ে রাখল না ঈগল, হঠাৎ এক ঝটকা মেরে সে টারজানকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। শূন্যপথে ঘুরপাক খেতে খেতে পড়তে লাগল। টারজান–

চোখ খুলে টারজান দেখল তার শরীরটা অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে গাছের ডাল থেকে বেরিয়ে শূন্যে ঝুলছে! আর একটু হলেই সে নীচে ছিটকে পড়ত। তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে বসে সে তলার দিকে দৃষ্টিপাত করল। নাঃ, সেখানে কোনো সিংহ তার জন্য ওঁৎ পেতে বসে নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে অতিকায় ঈগলের অস্তিত্বও সে আবিষ্কার করতে পারল না। টারজান বুঝল এতক্ষণ ধরে সে একটা অসম্ভব দুঃস্বপ্ন দেখছিল। পেটের ভিতর একটা অস্বস্তির ভাব তাকে পীড়িত করে তুলল, তাড়াতাড়ি খানিকটা বমি করে সে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। মনে মনে টারজান প্রতিজ্ঞা করল হাতির মাংস আর কখনো মুখে তুলবে না সে।

আচম্বিতে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে বিদ্যুৎ জ্বলে উঠল, পরক্ষণেই বজ্রের হুঙ্কার প্রতিধ্বনি জাগিয়ে ক্ষিপ্ত ঝটিকা ঝাঁপিয়ে পড়ল অরণ্যের বুকে। একটু পরেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। গাছের ডাল আঁকড়ে শুয়ে রইল টারজান। চারদিকে তখন ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব চলেছে। অকস্মাৎ ভীষণ শব্দে গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে ছিটকে পড়ল টারজান–

প্রখর সূর্যালোকে চোখ মেলে তাকাল টারজান। এ কী! একটা কাঠের খুঁটির সঙ্গে দাঁড়। করিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে! এদিক-ওদিক তাকাতেই পাহাড়ের উপর দরজা বসানো গুহাটা তার চোখে পড়ল। জায়গাটা তার অপরিচিত নয়– ওই গুহাতেই বাস করে যাদুকর বাকওয়াই। কিন্তু এখানে সে এল কী করে?

পিছন থেকে একটা কর্কশ হাসির আওয়াজ ভেসে এল। পরক্ষণেই টারজানের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল বাকওয়াই, খুব অবাক হয়েছ, তাই না? সকাল বেলায় শিকারের খোঁজে বেরিয়ে দেখলাম একটা ভাঙা গাছের ডালের তলায় চাপা পড়ে তুমি অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। তোমাকে আমি ওখান থেকে ঘাড়ে করে নিয়ে এলাম আমার এই আস্তানার সামনে। সন্ধ্যার পরে আমার হায়না দুটো এখানে আসবে। একটু একটু করে তোমাকে তারা ছিঁড়ে খাবে, বুঝেছে? আচ্ছা, আমি এখন চলি, দুপুরে ঘুমিয়ে নিয়ে বিকালের দিকে আসব। টিবোকে তুমি আমার আস্তানা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে, সেকথা আমি ভুলিনি। আজ আমি তোমায় শাস্তি দেব। আমার হায়নারা যখন তোমায় আদর করবে, আমি তখন নিশ্চয়ই এখানে থাকব।

গোমাঙ্গানিদের ভাষা কিছুটা বুঝতে পারলেও সেই ভাষায় কথা বলতে তখনও শেখেনি টারজান। বাকওয়াই-এর বক্তব্য সে বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দও বেরিয়ে এল না। টারজান জানত অনর্থক চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই, তাই সে চুপ করে রইল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল বাকওয়াই, তারপর গুহার দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল

হঠাৎ কাঁধের উপর একটা মৃদু স্পর্শ অনুভব করল টারজান তার কাঁধে উঠে বসেছে ছোট্ট ন-কিমা। এখানে ন-কিমার একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। ন-কিমা হচ্ছে একটি ছোটো বাঁদর- মাত্র এক ফুট লম্বা, উচ্চতায় এক ফুটেরও কম। টারজানের সঙ্গে তার ভারি বন্ধুত্ব। কিচ মিচ করে বাঁদুরে ভাষায় ন-কিমা বলল, দুষ্টু গোমাঙ্গানিটা যখন তোমায় ঘাড়ে করে নিয়ে আসছিল, আমি তখন তার পিছন পিছন এসেছি। এখন তুমি কী করবে টারজান?

টারজান বলল, তুমি আমার দড়ির বাঁধনটা যদি দাঁত দিয়ে কেটে দিতে পার, তাহলে তোমায় নিয়ে আমি এখনই এখান থেকে চলে যাব।

ন-কিমা মহা উৎসাহে দড়ির উপর আক্রমণ চালাল। কিছুক্ষণ পরে নিতান্ত বিষণ্ণ হয়ে সে বলল, টারজান। ন-কিমার দাঁত কাটতে পারছে না। দড়িটা বেজায় শক্ত।

-বেশ, তাহলে তাড়াতাড়ি জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে বনমানুষদের সঙ্গে দেখা কর। তাদের এখানে নিয়ে এস। তাদের দাঁতে জোর আছে। তারা দড়ি কেটে টারজানকে মুক্ত করতে পারবে। তাড়াতাড়ি যাও, ন-কিমা।

চোখের পলকে টারজানকে ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল ন-কিমা—

 অনেকক্ষণ পর ফিরে এল ন-কিমা, দুঃখিত স্বরে বলল, আমি বনমানুষদের খুঁজে পেলাম না। কী হবে টারজান?

টারজানের ওষ্ঠাধরে মৃদু হাসির রেখা ফুটল। সে একবার আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল- প্রখর মধ্যাহ্ন সূর্য মেঘের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়েছে, দূরে আকাশে আসন্ন ঝটিকার আভাস।

টারজান বলল, ন-কিমা, তুমি এখান থেকে চলে যাও। তোমার আর কিছু করার নেই।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝড় হানা দিল। কড়কড় শব্দে কোথায় বাজ পড়ল, ঝড়ের মাতনে সাড়া দিয়ে শুরু হল বৃষ্টি। সে কী বৃষ্টি! আকাশ যেন ভেঙে পড়তে চায়।

গুহার দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল যাদুকর বাকওয়াই, এসে দাঁড়াল টারজানের সামনে। ঝড় বৃষ্টি অনেক আগেই থেমে গেছে। প্রকৃতি এখন শান্ত। অস্তায়মান সূর্যের দিকে একবার তাকাল যাদুকর, টারজানকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বলতে গেল কিন্তু সে কিছু বলার আগেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টারজান। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হল বাকওয়াই, হাতের বর্শা আর কোমরের ছুরি ব্যবহার করার সুযোগই পেল না সে।

বাঁধনের দড়ি বৃষ্টির জলে ভিজে নরম হয়ে গিয়েছিল। সেই নরম দড়ি টারজানের টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে গিয়েছিল। ছেঁড়া দড়িগুলো হাতে পায়ে জড়িয়ে খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

.

টারজান, অপেক্ষা করছিল বাকওয়াই-এর জন্য। বাকওয়াই আসতেই সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাকে কাবু করে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলেছিল।

বাকওয়াই আর্তনাদ করতে লাগল। বাঁধন খুলে দেওয়ার জন্য সে মিনতি করতে লাগল বার বার! সে জানত তার পোষা হায়না দুটো তাকে যেমন ভয় করে, তেমনই ঘৃণা করে— সুযোগ পেলে জন্তু দুটো তাকে ছাড়বে না, জীবন্তু অবস্থাতেই তাকে তারা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।

বাকওয়াই-এর আর্তনাদে বিচলিত হল না টারজান, আকাশের দিকে মুখ তুলে নিজের মনেই বনমানুষের ভাষায় বলল, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ড্যাংগো (হায়না) দুটো এখনই আসবে।

 বাকওয়াইকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল টাজান। একটু পরেই অকুস্থলে এসে পড়ল হায়না দুটো–

.

০৬. বিপন্ন টারজান

দ্বিপ্রহর। মাথার উপর আগুন ছড়িয়ে হাসছে আফ্রিকার মধ্যাহ্ন- সূর্য। এমন সময়ে পশুরাজ ন্যুমা গভীর অরণ্যের ছায়াঘেরা কোনো ঝোপে বিশ্রাম গ্রহণ করে, সন্ধ্যার পর উত্তপ্ত অরণ্য যখন ঠান্ডা হয় তখন সে তৎপর হয়ে ওঠে। বন থেকে বনান্তরে হানা দিয়ে ফেরে শিকারের সন্ধানে।

কিন্তু মধ্যাহ্নসূর্যের প্রচন্ড উত্তাপকে অগ্রাহ্য করেই আজ নুমা বেরিয়ে পড়েছে শিকারের খোঁজে। দু-দিন ধরে তার উপবাস চলছে। একটু আগেই একটা জেব্রার বাচ্চাকে সে প্রায় ধরে ফেলেছিল, হঠাৎ উলটো দিক থেকে বাতাস ছুটে এসে বাচ্চাটারা নাকে তার গন্ধ পৌঁছে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে পা মিলিয়ে বাচ্চাটা ছুটল। শিকার পালায় দেখে মাও ছুটল তার পিছনে। দুরত্ব খুব বেশি ছিল না, হয়তো সে বাচ্চাটাকে পাকড়াও করতে পারত। কিন্তু কোথাও কিছু নেই হতভাগা বুটো (গন্ডার) এসে দাঁড়াল ন্যুমা আর তার শিকারের মাঝখানে। দারুণ ক্রোধে বন কাঁপিয়ে গর্জে উঠল মা? সরে যাওয়া তো দূরের কথা, উলটে খুঙ্গি উঁচিয়ে ছুটে এলে বুটো। ওই জন্তুটাকে ন্যমা সমীহ করে ওর শক্ত চামড়া ভেদ করে আঁচড়-কামড় বসানো মুশকিল, অখচ ধারালো খঙ্গ দুটো যে-কোনো সময়ে পশুরাজের দেহ ফুটো করে দিতে পারে। দল বেঁধে সিংহরা অনেক সময়ে বুটোকে ঘায়েল করে বটে, কিন্তু দ্বন্দ্বযুদ্ধে একক সিংহের পক্ষে বুটোকে সামলানো অসম্ভব। অতএব আক্রমণোদ্যত গন্ডারের সামনে থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করল নুমা।

তারপর থেকে আর শিকারের সন্ধান পায়নি সে। দূর থেকে কয়েকটা অ্যান্টিলোপ তার চোখে পড়েছে বটে, কিন্তু ন্যুমা তাদের কাছে আসার আগেই জন্তুগুলো তীরবেগে ছুটে অদৃশ্য হয়েছে। তাই মাথার উপর মধ্যাহ্ন সূর্যের উত্তপ্ত আক্রমণ অগ্রাহ্য করে এই অসময়ে বনে মনে টহল দিচ্ছে নামা শিকারের আশায়। সামনের ঘাস ঝোপ পেরিয়ে এসে ফাঁকা মাঠের কিনারায় হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ন্যমা। একটু দূরে মাঠের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল বনমানুষ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাটি থেকে গাছের মূল বা শিকড় খুঁড়ে মুখে তুলছে, আবার কেউ বা পাথরের তলা থেকে বিছে বা বুনো ইঁদুরের সন্ধানে ব্যস্ত। অন্য সময় হলে নুমা বনমানুষদের দিকে আকৃষ্ট হত না। এই অতিকায় বানরগুলো দস্তুরমতো বিপজ্জনক, সাধারণত সিংহরা তাদের ঘাটায় না। কিন্তু নামার পেটে তখন আগুন জ্বলছে, যে-কোনো জীবই এখন তার কাছে খাদ্য– সবচেয়ে কাছাকাছি যে প্রকাণ্ড বনমানুষটা পাথরের তলা থেকে পোকা-মাকড় ধরার চেষ্টা করছে তাকেই শিকার হিসাবে বেছে নিল ন্যুমা

কার্চাকের মৃত্যুর পর তার দলের বনমানুষরা দলপতি হিসাবে টারজানকে মেনে নিয়েছিল। অবশ্য খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যাপারটা ঘটে নি। কাৰ্চাককে হত্যা করার পর টারজান যখন নিজেকে দলপতি বলে ঘোষণা করল, তখন কয়েকটি বনমানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ফলে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। তাদের মধ্যে একাধিক বনমানুষ টারজানের ছুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে, আবার অনেকে মার খেয়ে পরাজয় স্বীকার করে টারজানের আধিপত্য মেনে নিয়েছে। বর্তমানে টারজানের দলটা নিশ্চিন্ত মনে আহার অন্বেষণে ব্যস্ত, দলপতি টারজান একটা গাছের তলায় বসে সংগৃহীত ফলগুলো মনের আনন্দে চর্বণ করছিল। কারো মনে বিপদের আশঙ্কা ছিল না। কারণ, মাংসাশী পশুদের মধ্যে শিটা ছাড়া অন্য কোনো পশু বনমানুষদের দলে হানা দিতে সাহস করে না। এখন দিন-দুপুরে এতগুলো বনমানুষের মধ্যে শিটা নামক প্যান্থারও হামলা করতে সাহস পাবে না, একথা বনমানুষরা জানত। সুতরাং বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো দ্যুমার চকিত আবির্ভাব তাদের স্তম্ভিত করে দিল!–নুমা একবারও গর্জন করেনি, জ্যা-মুক্ত তীরের মতো নিঃশব্দে সে ছুটে এল নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে শিকারকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সে দেবে না!

পাথরের তলা থেকে পলাতক পোকাটাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছিল গাঁজান, হঠাৎ অনেকগুলো বনমানুষের ভয়ার্ত চিৎকারে সে চমকে মুখ তুলল এবং সভয়ে দেখল তাকে লক্ষ্য করে তীরবেগে ছুটে আসছে মা। এক মুহূর্ত স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল গাঁজান, পরক্ষণেই আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে সে ছুটল একটু দূরে অবস্থিত মস্ত গাছটার কাছে পৌঁছানোর আগেই সিংহ এসে পড়ল তার উপর। প্রচণ্ড চপেটাঘাতে শিকারকে মাটিতে পেড়ে ফেলে ন্যুমা তার ঘাড়ে কামড় বসাল। চারদিক থেকে কলরব করে উঠল বনমানুষের দল। গাঁজান সাড়া দিল না, এক কামড়েই তার ঘাড় ভেঙে দিয়েছে মা। শিকারকে হত্যা করার পর সিংহ সাধারণত তাকে আড়াল-দেওয়া জায়গায় নিয়ে যায়, ফাঁকা মাঠের উপর নিহত পশুর মাংস ভক্ষণ করে না পশুরাজ। কিন্তু ক্ষুধার্ত ন্যুমা আর দেরি করতে পারল না, সেইখানেই গাজনের মৃতদেহ থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে সে খেতে শুরু করল।

বনমানুষরা উঁচু গাছের ডালে বসে নিরাপদ দূরত্ব থেকে মাকে তিরস্কার করতে লাগল তারস্বরে। ন্যুমা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না, ভোজন করতে লাগল নিবিষ্ট চিত্তে। বনমানুষরা যদি একসঙ্গে মিলিত হয়ে আক্রমণ করত, তাহলে তাদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে নামার জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু সেই লড়াইতে একাধিক বনমানুষের মৃত্যু অবধারিত, তাই টারজানের প্ররোচনা সত্ত্বেও বনমানুষরা মাকে আক্রমণ করতে চাইল না। তারা জানে নুমাকে হত্যা করলেও মৃত গাঁজানের দেহে প্রাণ-সঞ্চার হবে না, অনর্থক আরও কয়েকটি বনমানুষের জীবন বিপন্ন করার সার্থকতা কোথায়? জঙ্গলের জানোয়ার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে লড়াই করে না, জীবনধারণের অনিবার্য প্রয়োজনেই তারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বনমানুষরা জানত, গাঁজানের রক্তমাংসে উদরপূরণ করে দ্যুমা বিশ্রাম গ্রহণ করবে, অতএব তাকে দেখে বনমানুষদের এখন আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু টারজানের মাথায় ছিল মানুষের মগজ, তার চিন্তাধারাও তাই মানুষের মতন। সে বুঝেছিল ন্যুমা যদি আজ নির্বিঘ্নে ভোজ সমাপ্ত করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে খাদ্যাভাব ঘটলেই সে আবার দলের উপর হামলা করবে। সেই ভয়াবহ সম্ভাবনা থেকে মুক্তি পেতে হলে নুমাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। শিকারের সামনে থেকে তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে এখনই। তাহলে সে বুঝবে, বনমানুষদের হত্যা করা সম্ভব হলেও নির্বিঘ্নে তাদের মাংসে উদরপুরণ করা সম্ভব নয়। একটা শক্ত কাঁচা ফল তুলে সে ছুঁড়ে মারল দ্যুমার দিকে। ফলটা ঠকাস করে এসে লাগল নমার দুই চোখের মাঝখানে। খাওয়া ফেলে ঘোঁৎ করে লাফিয়ে উঠল ন্যুমা কয়েক মুহূর্তের জন্য সে চোখে অন্ধকার দেখল।

দৃশ্যটা দেখে মহা উল্লাসে চিৎকার করে উঠল বনমানুষের দল। তৎক্ষণাৎ কঁচা-পাকা ফল আর গাছের ডাল ভেঙে নিল কয়েকটা বনমানুষ পরক্ষণেই অনেকগুলো ফল আর গাছের ডাল এসে পড়ল নমার সর্বাঙ্গে! এমন অবস্থায় কোনো ভদ্র সিংহই আহার করতে পারে না, ভীষণ গর্জনে প্রতিবাদ জানিয়ে আস্ফালন করতে লাগল নমা। গাছের উপর উপবিষ্ট বনমানুষদের লক্ষ্য করে কয়েকবার লাফ মারল সে এবং লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে না পেরে আবার শূন্যপথে নেমে এল যথাস্থানে।

বনমানুষদের দলে হইচই পড়ে গেল। এটা একটা মজার খেলা! নিক্ষিপ্ত ফল আর গাছের ডাল বৃষ্টির মধ্যে পড়তে লাগল দ্যুমার গায়ের উপর। কয়েকটা দুঃসাহসী বনমানুষ টারজানের নির্দেশে মাটিতে নেমে বড়ো বড়ো পাথর ছুঁড়তে লাগল দ্যুমার দিকে।

রাশি রাশি ফল, গাছের ডাল আর পাথর যখন বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল, তখন খাওয়া তো দূরের কথা, নামার পক্ষে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব হয়ে উঠল। কয়েকবার দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিয়েছিল সে কিন্তু বনমানুষদের উৎসাহ তাতে আরও বেড়ে গেল। এর মধ্যে নমার ডান চোখের উপরে একটা মস্ত আলু গজিয়ে গেছে, কান করছে ভোঁ ভোঁ আর বাঁ। চোয়ালে একটা পাথর এমন জোরে লেগেছে (সেটা ছুঁড়েছিল টারজান) যে, বাঁদিকের তিনটে দাঁত দস্তুরমতো নড়ে গেছে।

কিন্তু যাই-হোক না কেন, দ্যুমা আজ কিছুতেই শিকার ছাড়তে রাজি নয়। গাঁজানের মৃতদেহ মুখে তুলে সে ছুটতে শুরু করল এবং বনমানুষদের বোমাবৃষ্টি অগ্রাহ্য করে একটা ফাঁকা মাঠের উপর উপস্থিত হল।

বনমানুষরা এবার মুশকিলে পড়ল। ফাঁকা মাঠটায় সেখানে শিকার নামিয়েছে মা, তার কাছাকাছি কোনো গাছ নেই; দূর থেকে নিক্ষিপ্ত হল, পাথর বা গাছের ডাল নুমার কাছে। পৌঁছাল না। যদি বা দুই একটা পাথর তার লাগল, আঘাত মোটেই জোরাল হল না। ন্যুমা শিকারের মাংস ভোজন করতে লাগল পরমানন্দে।

বনমানুষরা এবার নিশ্চয়ই সরে পড়ত, কিন্তু টারজান বাধা দিল। টারজান তাদের বুজিয়ে দিল নুমা যদি আজ নির্বিঘ্নে ভোজ করতে পারে, তাহলে বার বার সে হানা দেবে বনমানুষদের দলে। সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে যেমন করেই হোক মাকে শিকারের সামনে থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে অথবা শিকারকে ছিনিয়ে নিতে হবে তার মুখ থেকে।

জোয়ান বনমানুষরা পরস্পরের মুখের দিকে চাইল- ক্ষুধার্ত সিংহের মুখের গ্রাস ছিড়িয়ে আনার সাহস আছে কার?

দলের ভিতর থেকে বাৰ্চাক নামে সবচেয়ে বলিষ্ঠ বনমানুষটিকে বেছে নিল টারজান, তার নির্দেশে বাৰ্চাক পাথর হাতে এগিয়ে গেল আহারে ব্যস্ত পশুরাজের দিকে,

মাথায় ঠকাস করে একটা পাথর এসে লাগতেই ঘোঁৎ করে লাফিয়ে উঠল সিংহ। তারপর বাৰ্চাককে লক্ষ্য করে ছুটে এল সগর্জনে। বাৰ্চাক তৈরি ছিল চটপট ছুটে গিয়ে একটা উঁচু গাছে উঠে পড়ল। তাকে ধরার আশা ছেড়ে সিংহ পিছনে ফিরল, আবার মৃত শিকারের উপর ভোজে বসবে সে। কিন্তু ফেলে-আসা শিকারের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দারুণ ক্রোধে তার কেশর ফুলে উঠল আর লেজটা উঠে গেল আকাশের দিকে তার শিকার তুলে নিয়ে একটা সাদা বনমানুষ গুটিগুটি সরে পড়ছে যে! অপরাধীকে শাস্তি দিতে ছুটে গেল রুদ্রমূর্তি পশুরাজ।

টারজান তখন গাঁজানের মৃতদেহ তুলে নিয়ে একটা গাছের দিকে রওনা হয়েছে। সিংহকে ছুটে আসতে দেখে সে গতি বাড়িয়ে দিল। গাছের তলায় পৌঁছে অমানুষিক শক্তিতে গাঁজানের মৃতদেহটা উপর দিকে ছুঁড়ে দিল সে। দুই জোড়া পেশিবদ্ধ লোমশ হাত গাঁজানের শরীরটা লুফে নিল, নির্দেশ অনুসারে ওই গাছেই অপেক্ষা করছিল টীকা আর কার্কা।

সিংহ লাফ দিল। টারজানের পায়ের তলায় গাছের গুঁড়িতে তার সনখ থাবা সজোরে এসে পড়ল। পরক্ষণেই আরও কয়েকহাত উপরে উঠে গেল টারজান। আবার লাফাল নমা। কিন্তু টারজান তখন লাগালের বাইরে। তিন চারটে শুকনো ফল আর একটা মোটা গাছের ডাল এসে পড়ল মার উপর। সগর্জনে বিরক্তি প্রকাশ করে সরে এল ন্যুমা এবং লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল গাছের উপর গাঁজানের মৃতদেহের দিকে।

কিন্তু বনমানুষরা ন্যুমাকে সেখানে দাঁড়াতে দিল না। ক্রমাগত গাছের ডাল আর ফল তো পড়তেই লাগল, কয়েকটা বড়ো বড়ো পাথরও এসে আঘাত করল মার দেহে। কয়েকটা উৎসাহী বনমানুষ পাথর কুড়িয়ে নিয়ে গাছে উঠেছে এবং নিরাপদ দূরত্ব থেকে মাকে টিপ করে ছুঁড়ছে সেই পাথর।

ন্যুমার পক্ষে আর দাঁড়ানো সম্ভব হল না। বাঁ চোখের খুব কাছেই একটা পাথর যখন ঠকাস করে লাগল, তখনই ন্যুমা বুঝল এখানে বেশিক্ষণ থাকলে অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এরকম ক্ষেত্রে কোনো বুদ্ধিমান সিংহই দাঁড়ায় না, নুমাও দাঁড়াল না। শেষবারের মতো গর্জন করে বিরক্তি জানিয়ে সে রণক্ষেত্র ত্যাগ করল তীরবেগে! পিছনে কলরব করে উঠল বিজয়ী বনমানুষের দল

জানোয়ার রসিকতা করতে জানে না, মানুষ জানে। জঙ্গলে জানোয়ারদের মধ্যে বড়ো হলেও মানুষের রসবোধ ছিল টারজানের জন্মগত। তার রসিকতার ধরণ অবশ্য খুব উচ্চস্তরের ছিল না। তার সাথীদের পক্ষেও তার রসিকতা উপভোগ করা সম্ভব তো ছিলই না, বরং টারজানের রসবোধ তাদের মনে ক্রোধেরই উদ্রেক করত। দুই একটা উদাহরণ দিচ্ছি:

রাকা নামে বনমানুষটি অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর একটা পাকা ফল দেখতে পেয়ে হাত বাড়াল। কিন্তু ফলটা হাতে আসার আগেই মাথার উপর থেকে একটা দড়ির ফাঁস তার কবজিটাকে জড়িয়ে ধরল– পরক্ষণেই এক হ্যাঁচকা টানে রুজ্জবদ্ধ হল শূন্যপথে দোদুল্যমান! ক্রোধে আর আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল রাকা, টারজান তখন মাথার উপরের উঁচু ডালে দাঁড়িয়ে হাসছে– তার হাতের দড়িটারই অপর প্রান্তে ফাঁসে আটকে শূন্যে ঝুলছে রাখা! কিছুক্ষণ শূন্যে ঝুলিয়ে ভয় দেখিয়ে রাকাকে বন্ধনদশা থেকে মুক্তি দিল টারজান। মুক্তি পেয়েই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে রাকা তাড়া করল টারজানকে, ধরতে পারলে সে নির্ঘাত খুন করবে তাদের সাদা চামড়ার দলপতিকে। কখনো গাছের ডালে কখনো মাটির উপর টারজানকে তাড়া করে ছুটল রাকা, কিন্তু কিছুতেই তাকে ধরতে পারল না। নিষ্ফল আক্রোশে টারজানের দিকে তাকিয়ে রাকা গর্জন করতে লাগল আর নিজের রসিকতায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে হাসতে লাগল টারজান–

আর একদিন টীকা যখন লতার দোলনায় দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে এ-গাছ থেকে ও-গাছে, তখন হঠাৎ তার হাতের লতাটা ছিঁড়ে পড়ল মাটির উপর! আঘাত খুব গুরুতর হয়নি, কিন্তু অমন মজবুত লতা হঠাৎ ছিঁড়ল কেমন করে ভেবে হতভম্ব হয়ে গেল টীকা। কারণ অনুসন্ধানের জন্য ছিন্ন লতার অপরভাগের উদ্দেশ্যে উপরদিকে দৃষ্টিকে চালিত করতেই টীকা দেখতে পেল টারজানকে। একহাতে ছিন্ন লতার উপরের অংশটা চেপে ধরে অন্যহাতে ধারালো ছুরিটা তুলে হেসে উঠল টারজান। তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারল টিকা– লতাকে ছুরি দিয়ে কেটে দেওয়ার ফলেই সে যে ভূমিপৃষ্ঠে লম্বমান হয়েছে এবিষয়ে আর সন্দেহ রইল না তার। হিংস্র আক্রোশে চিৎকার করে সে ধেয়ে এল, লাফে লাফে উঠে পড়ল সেই গাছে, যেগাছের ডালে দাঁড়িয়ে হাসছে টারজান। কিন্তু টারজানের কাছে পৌঁছাতেই সে আর একটা আর একটা লতা ধরে টীকার নাগালের বাইরে চলে গেল।

টীকা সহজে ছাড়ার পাত্র নয়, কিন্তু অনেকক্ষণ ছোটাছুটি করেও যখন টারজানকে ধরা গেল না তখন বিষণ্ণ মনে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে সে বসে রইল। মনে হল এই পৃথিবীর কোনো কিছুতেই তার আসক্তি নেই। আত্মসম্মান বাঁচাতে অনেকসময় বনমানুষরা ওইরকম নিরাসক্ত ভাব অবলম্বন করে। টারজানের অট্টহাস্য আর সঙ্গীদের উল্লসিত কোলাহলে তার গা জ্বলে গেলেও নির্বিকার মুখে সে বসে রইল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। টারজানের রসিকতার শিকার যে হয়, সে ছাড়া অন্যান্য বনমানুষরা ব্যাপারটা উপভোগ করে আনন্দে

সেদিন সকালবেলা টারজান গাছের কোটরে তার গুপ্তস্থান থেকে একটা সিংহচর্ম টেনে বার করল। সিংহের কবলে গাঁজানের অপমৃত্যুর পর টারজান বনমানুষদের দলে একটি নিয়ম প্রচলিত করতে চেয়েছিল প্রতিদিন যখন দলের বনমানুষরা খাদ্যের সন্ধান করবে, সেইসময় পালা করে দুজন বনমানুষ সকলের উপর নজর রাখবে অর্থাৎ প্রহরীরা কর্তব্য করবে। বনমানুষদের স্মৃতিশক্তি খুব প্রবল নয়, এর মধ্যেই টারজান লক্ষ্য করেছে প্রহরীরা তাদের কর্তব্য করছে না। তাদের ভয় দেখিয়ে মজা করার জন্যই মাথাসমেত ওই সিংহচর্মটিকে বার করেছিল টারজান।

হঠাৎ টারজানের কাঁধের উপর একটা ছোট্ট বাঁদর লাফিয়ে উঠল, পরক্ষণেই শোনা গেল ন-কিমার কণ্ঠস্বর, টারজান, তুমি নামার চামড়া দিয়ে কী করছ?

টারজান হাসল, আমি আজ ন্যুমা সেজে মাঙ্গানিদের (বনমানুষদের) ভয় দেখাব।

ভারি খুশি হয়ে ন-কিমা বলল, সেটা খুব মজার ব্যাপার হবে। কখন ভয় দেখাবে টারজান? আমিও সেখানে থাকব তো?

-নিশ্চয়ই। তুমি আমার সঙ্গে এস। এখনই মজা দেখতে পাবে।

বনমানুষের দলটা ফাঁকা মাঠের উপর এদিক-ওদিক ঘুরে খাদ্যের সন্ধান করছিল। ঝোপের আড়াল থেকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করল টারজান। উপরের দিকে গাছে গাছে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল সে, তারপর খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত দলটার দিকে ভালো করে তাকাল না, কোথাও প্রহরীদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বোকা বনমানুষরা অতীতের শিক্ষা ভুলে গেছে। হিংহের মাথা সমেত চামড়াটায় আপাদমস্তক ঢেকে হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল টারজান এবং সিংহের মতো গর্জন করে উঠল! অবিকল সিংহনাদ! বহুদিন চেষ্টার পর সিংহের কণ্ঠস্বর নিখুঁতভাবে অনুকরণ করতে পারত টারজান।

ফল হল তৎক্ষণাৎ। কিন্তু টারজান যা ভেবেছিল, তা হল না। বনমানুষরা দৌড়াদৌড়ি করে গাছে ওঠার চেষ্টা করল না, সবাই ছুটে এসে একজায়গায় জড়ো হয়ে মার দিকে উদ্ধত ভঙ্গিতে রুখে দাঁড়াল।

আর ঠিক সেইসময়ে মাথার উপরে গাছগুলো থেকে রাশি রাশি পাথর আর গাছের শুকনো ডাল উড়ে এল সিংহচর্মাবৃত টারজানের দিকে! বনমানুষরা টারজানের শিক্ষা ভোলেনি, সকলের অলক্ষ্যে একাধিক গাছের উপর পাতার আড়াল থেকে নজর রাখছিল প্রহরীর দল! শুধু তাই নয়— তলা থেকে বড়ো বড়ো পাথরও সংগ্রহ করে তারা রেখে দিয়েছিল গাছের উপর!

বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল পাথর, সেই সঙ্গে মোটা মোটা গাছের ডাল! বিপদ বুঝে আবার ঝোপে প্রবেশ করার চেষ্টা করল টারজান, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না– হঠাৎ একটা মস্ত পাথর এসে লাগল তার মাথায় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল টারজান।

ন্যুমাকে পড়ে যেতে দেখে গর্জে উঠল বনমানুষের দল। চার পাঁচটা জোয়ান বনমানুষ তেড়ে এল ভূপতিত টারজানের দিকে তাদের মাথায় এখন খুন চেপেছে, এখনই দাঁতে-নখে নমার শরীরটা তারা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।

কিন্তু একী! ঝোপের ভিতর থেকে তীরবেগে ছুটে এসেছে ছোট্ট নকিমা, ন্যুমা আর আক্রমণোদ্যত বনমানুষদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে দু-হাত তুলে চিৎকার করছে সে, নিষেধ করছে বনমানুষদের আক্রমণ করতে!

বনমানুষরা হিংস্র নয়, কিন্তু ক্ষেপে গেলে তারা মাংসাশী শ্বাপদের চেয়েও ভয়ানক হয়ে ওঠে। একবার মাথায় খুন চাপলে তারা রক্তদর্শন না করে ক্ষান্ত হয় না। ছোট্ট ন-কিমার স্পর্ধা দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্যে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তারা তাকিয়ে রইল ন-কিমার দিকে, তারপরই মিলিত কণ্ঠে গর্জে উঠল তারা ন-কিমা যদি সরে না যায়, তাহলে তাকেও হত্যা করবে বনমানুষরা।

ন-কিমা একলাফে গিয়ে পড়ল ধরাশায়ী নমোর দেহের উপর, তারপর কেশর মুঠো করে ধরে প্রাণপণে টান মারল। বিস্মিত বনমানুষরা দেখল সিংহের মাথার তলা থেকে দেখা যাচ্ছে কিশোর টারজানের মুখ! ব্যাপারটা তাদের বোধগম্য হল না, রক্তের নেশায় তারা তখন উন্মত্ত-হয়তো, একটু পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ত তারা, টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলত টারাজন আর ন-কিমাকে, কিন্তু সেই সঙ্গীন মুহূর্তেই হঠাৎ টারজানের জ্ঞান ফিরে এল।

সভ্য মানুষের মতো টারজানের ইন্দ্রিয়গুলো অবশ হয়ে যায়নি, জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল– তৎক্ষণাৎ সিংহচর্ম সরিয়ে দিয়ে একলাফে উঠে দাঁড়াল সে।

কয়েকটা বনমানুষ গর্জন করে উঠল, মুখের ভিতর থেকে উঁকি দিল তীক্ষ্ণ শ্ব-দন্তের সারি!

একটানে কোমরের খাপ থেকে ছুরিটা খুলে নিয়ে রুখে দাঁড়াল টারজান

বনমানুষরা থমকে দাঁড়াল। তাদের মগজে ব্যাপারটা এখন কিছুটা ঢুকেছে। উত্তপ্ত মস্তিষ্ক। এবার টারজানকে চিনতে পারছ, চিনতে পারছে তার হাতের সাংঘাতিক ছুরিটাকে। একজন দু-জন করে টারজানের কাছে এল তারা, সিংস্রভাবে দন্তবিকাশ করল, তারপ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে সরে গেল, নিরাসক্তভাবে আহার্যের সন্ধান করতে লাগল আগের মতো

সিংহচর্ম গুটিয়ে নিয়ে টারজানও প্রস্থান করল অকুস্থল থেকে। তার কাঁধে চড়ে যেতে যেতে ছোট্ট ন-কিমা সমস্ত ঘটনার বিশদ বিবরণ পরিবেশন করল টারজানের কর্ণকুহরে। সব শুনে টারজান বুঝল নিজের জীবন বিপন্ন করে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে ন-কিমা। কিন্তু কে জানত রসিকতার পরিণাম এমন মারাত্মক হতে পারে।

.

০৭. দস্যুর বিরুদ্ধে টারজান

বহুদিন কেটে গেছে। কিশোর টারজান এখন পূর্ণবয়স্ক যুবক– বিরাট স্কন্ধ, কবাট বক্ষ, ক্ষীণ কটি, দীর্ঘ পেশিপুষ্ট বাহু। শক্তিচঞ্চল যৌবনের নিখুঁত প্রতিমূর্তি! দেহের সঙ্গে সঙ্গে তার মনও বেড়ে উঠেছে। আজও সে আফ্রিকার অরণ্যে অর্ধনগ্ন দেহে কটিবাস সম্বল করে ঘুরে বেড়ায় বটে, কিন্তু এর মধ্যে সভ্য জগতের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে। বিমানপোত দুর্ঘটনার ফলে কেমন করে ফরাসি সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন পল দ্য আরনৎ আফ্রিকার জঙ্গলে এসে পড়েছিল এবং শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে কেমন করে পূর্বোক্ত ফরাসি যুবককে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে টারজান উদ্ধার করেছিল, পরবর্তীকালে ওই যুবকের সঙ্গে বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ হয়ে টারাজন ইউরোপে গিয়ে তার সত্যিকার পরিচয়, অর্থাৎ সে যে ইংল্যান্ডের এক অভিজাত বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী সেকথা কেমন করে জানল, সেসব বৃত্তান্ত বিস্তারিত বলার জায়গা এখানে নেই

সংক্ষেপে বলছি, নিজের সত্যিকার নাম জন ক্লেটন এবং উপাধি লর্ড গ্রেস্টোক। উপাধি টারজান জানতে পেরেছিল, কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে সভ্য পৃথিবী সম্পর্কে তিক্ত ধারনা নিয়ে সে আবার ফিরে এল আফ্রিকার বনভূমির বুকে!

টারজানের মতে সভ্য জগতের মানুষের চাইতে বনের পশুরা ভালো। পশুজগতে লড়াই ঝগড়া আছে, কিন্তু মানুষের মতো তুচ্ছ কারণে তারা পরস্পরকে হত্যা করতে চায় না। তাদের জীবনধারণের পদ্ধতি সহজ সরল, নানারকম আইনকানুনের শৃঙ্খলে জড়িয়ে তারা জীবনকে জটিল করে তোলেনি। অতএব অরণ্যের সন্তান টারজান আবার ফিরে এল অরণ্যের বুকে তবে এখন আর সে অশিক্ষিত নয় ফরাসি ও ইংরেজি ভাষা এখন তার আয়ত্বে, আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতির ভাষাও সে ভালোভাবেই রপ্ত করেছে।

আফ্রিকার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীরা টারজানের আধিপত্য মেনে নিয়েছিল। ওই সীমিত স্থানের মধ্যে টারজান ছিল মুকুটবিহীন রাজা। অসৎ প্রকৃতির শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ী ও শিকারিদের হাত থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের রক্ষা করত টারাজন। কখনো কখনো সমাজবিরোধীদের উৎপাতও ঘটত, সেখানেও টারজান এগিয়ে যেত শান্তিরক্ষা করতে প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করতেও সে কুণ্ঠিত হত না। সকলের খবরাখবর রাখতে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গ্রামে যাতায়াত করত টারাজন। একদিন একটি ছোটো গ্রামে উপস্থিত হল সে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে যে-দৃশ্য তার চোখে পড়ল, তার জন্য সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। একদল অস্ত্রধারী দস্যু ঝুঁপিয়ে পড়েছে গ্রামবাসীদের উপর! ভয়ার্ত গ্রামবাসীরা ছুটোছুটি করছে, গ্রামের মধ্যে চলছে লুঠতরাজ, খুন-জখম!

টারজানকে দেখে কয়েকজন গ্রামবাসী ছুটে এল, আমাদের বাঁচাও টারজান! ক্ষ্যাপা মোষ আমাদের আক্রমণ করেছে।

যে-প্ৰকাণ্ড গাছটার তলায় গ্রামের বিচার-সভা বসত, তার তলাতেই এসে দাঁড়িয়েছে এক দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ নিগ্রো, তার মাথায় শিং সমেত বন্যমহিষের খুলি এবং একহাতে বন্দুক আর এক হাতে বর্শা!– মবোগো সানা অর্থাৎ ক্ষ্যাপা মোয!

ক্ষ্যাপা মোষের মতোই প্রচণ্ড কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল মবোগো, সৈন্যগণ! গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দাও। লুঠ কর! হত্যা কর! কাউকে ছাড়বে না! একটি মানুষও যেন প্রাণ নিয়ে পালাতে না পারে।

মবোগোর দুস্যরা মহা-উৎসাহে সর্দারের হুকুম তামিল করতে তৎপর হয়ে উঠল, কিন্তু হত্যাকাণ্ড শুরু হতে না হতেই বাধা এল

লোহার মতো শক্ত একটা হাত বন্দুক সমেত মবোগোর ডান হাত চেপে ধরল, আর একটা হাতের কঠিন আলিঙ্গনে বন্দি হল মবোগোর গলা!

মবোগোর শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হল, বাঁ হাত চেপে ধরে সে গলাটাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা! গলার উপর চাপ একটুও আলগা হল না, পিছন থেকে ভেসে এল আততায়ীর কণ্ঠস্বর, সর্দার মবোগো! তোমার লক্ষ্মীছাড়া চ্যালা-চামুন্ডাদের অস্ত্র ফেলে দিতে বল, না হলে তুমি মরবে।

মবোগো কিছু বলার আগেই দৃশ্যটা কয়েকজন দস্যুর দৃষ্টিগোচর হল, টারজান! কী সর্বনাশ! টারজান আমাদের সর্দারের গলা চেপে ধরেছে।

দস্যুরা ইতস্তত করতে লাগল। হঠাৎ মাথার উপর থেকে ভেসে এল উড়ন্ত বিমানের আওয়াজ। চমকে মুখ তুলে সকলে দেখল খুব নীচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি বিমানপোত। পরমুহূর্তেই বিমান থেকে দুটি বস্তু এসে পড়ল মাটির উপর। তৎক্ষণাৎ পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়ার আড়ালে আচ্ছন্ন হয়ে গেল দস্যুর দল!

খক! খক! খুক…

চারদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল কাশির আওয়াজ, সঙ্গেসঙ্গে ভীত কণ্ঠের আর্তস্বর, … পালাও! পালাও! চোখ জ্বলে গেল! লোহার পাখিটা ডিম পেড়েছে! বিষাক্ত ডিম!

টারজান ততক্ষণে মবোগোর গলা ছেড়ে অকুস্থল থেকে সরে পড়েছে। টিয়ার গ্যাস যখন ধম উদগিরণ করে, তখন বনের রাজা টারজানও নিস্তার পায় না। অতএব কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গ্রাম হল জনশূন্য, শমিত্র সকলেই স্থানত্যাগ করে বিষাক্ত ধোঁয়ার কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল– (একটা কথা মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার বহু বৎসর আগেকার আফ্রিকা আমাদের বর্তমান কাহিনির পটভূমি, টিয়ার গ্যাসের রহস্য তখনকার স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত)

ফাঁকা মাঠের মাঝখানে বিমান নামিয়ে একপাশে দাঁড়িয়েছিল ক্যাপ্টেন পল দ্য আরন। তার চোখের সামনে হঠাৎ অরণ্য ভেদ করে মাঠের উপর আত্মপ্রকাশ করল এক অর্ধনগ্ন বলিষ্ঠ পুরুষ টারজান!

দ্য আরনৎ সোৎসাহে বলে উঠল, বিমান থেকে দৃশ্যটা দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় আমি এসে পড়েছিলাম তাই না?  

টারজান হাসল, ঠিক কথা। তোমায় অজস্র ধন্যবাদ।

-না, না, ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। তবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, যথাসময়ে অমি এসে পড়েছিলাম।

–উঁহু, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাব না। তোমাকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি দুস্যসর্দার মবোগোর তরফ থেকে।

সে কী, বিস্মিত কণ্ঠে দ্য আরনৎ বলল, দস্যুর তরফ থেকে তুমি আমায় ধন্যবাদ জানাচ্ছ?

–নিশ্চয়ই, টারজান হেসে উঠল, দস্যু সর্দারকে আমি পাকড়াও করে ফেলেছিলাম, তোমার টিয়ার গ্যাসের কল্যাণে সে আমার হাত থেকে মক্তি পেয়ে গেল।

-ঈস! ভারি অন্যায় হয়ে গেছে সক্ষোভে বলে উঠল দ্য আরণৎ, ব্যাপারটা আমি বুঝতেই পারি ননি কিন্তু কে এই সর্দার মবোগো?

টারজান বলল, মবায়া এক দুর্ধর্ষ সর্দার, তার অধীনে রয়েছে এক বিশাল দুস্যবাহিনী। এই মবায়া এখন নাম নিয়ে-মবোগো সানা অর্থাৎ ক্ষ্যাপা মোষ। ক্ষ্যাপা মোষের মতোই ভয়ানক সর্দার ম-বায়া ওরফে মবোগো সানা। লোকটা এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে খাজনা আদায় করছে। খাজনা না দিলে গ্রাম জ্বালিয়ে গ্রামবাসীদের হত্যা করছে নিষ্ঠুরভাবে।

দ্য আরনৎ বলল, আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় এই ধরনের লুঠতরাজ হয় বলে শুনেছি।

-আমার এলাকায় এসব ব্যাপার চলে না, টারজান কঠিন স্বরে বলল, মবোগো ক্রমশ এগিয়ে আসছে, তার সীমানা ছাড়িয়ে আমার এলাকায় এসে পড়েছে। এবার তাকে বাধা দিতেই হবে- পল, তুমি পুবদিকে বিমান চালাও।

–বিমানচালকের আসন থেকে নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করল দ্য আরতৎ, টারজান, এই জঙ্গল-ঘেরা পাহাড়গুলোই কি মবোগোর আস্তানা?

উঁহু, এদিকে নয়। আর একটু এগিয়ে গেলেই দেখবে মরুভূমি। ওই দুস্তর বালির সমুদ্রই মবোগোর আস্তানার একদিক রক্ষা করছে।

কিছুক্ষণ বিমান চালিয়ে দ্য আরনৎ বলল দূরে ছোটো ছোটো পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তারপরই উঠে গেছে আকাশছোঁয়া পর্বতমালা।

টারজান বলল, হ্যাঁ, ওই উঁচু পাহাড়ের সারি পেরিয়ে গেলেই দেখবে সর্দার মবোগোর দুর্গ– ওই বিশাল আকাশছোঁয়া পাহাড়গুলো মবোগোর আস্তানার একটা দিক রক্ষা করছে; বিমানপোতের সাহায্য ছাড়া কোনো পদাতিক বা অশ্বারোহী শত্রু পাহাড়গুলো ডিঙিয়ে মবোগোর উপর হানা দিতে পারে না। আর একটু নীচু করে চালাও পল ওই দেখ, চাষের জমি আর ফলের বাগান অনাবৃষ্টির ফলে শুকিয়ে গেছে, আর সেইজন্যই গ্রামে গ্রামে দস্যুবাহিনী নিয়ে হানা দিচ্ছে মবোগো।

বিমান তখন মবোগোর গ্রাম পার হয়ে এসেছে, তলায় শুষ্ক জলাভূমির দিকে তাকিয়ে পল দ্য আরনৎ বলল, শুকনো জলার উপর দিয়ে অনায়াসেই শত্রু হানা দিতে পারে মবোগোর আস্তানায়।

অসম্ভব, টারজান বলল, ওই জলায় বাস করে বুনো মোষের দল। আফ্রিকার কেপ বাফেলো যে কী ভয়ংকর জীব, তা তুমি নিশ্চয়ই জানো। ওই মোষের পালকে এড়িয়ে কোনো মানুষই মোগোর গ্রামে আসতে পারে না।

তাহলে দেখছি মবোগোর দুর্গ একেবারেই দুর্ভেদ্য! কী বল টারজান?

-ওই জলাভূমির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা ফন্দি মাথায় এল। আকাশের বৃষ্টিহীন মেঘগুলো দেখে মনে হচ্ছে ফন্দিটা কাজে লাগবে। মবোগোর দুর্গ বোধ হয় আমি ধ্বংস করতে পারব। অবশ্য তোমার সাহায্যও আমার প্রয়োজন হবে।

আমি সর্বদাই তোমাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। বিশেষত খুনি ডাকতাদের আমি ঘৃণা করি। বল কী করতে হবে?

টারজান নতস্বরে কী যেন বলল– পল দ্য আরনৎ একটু চিন্তিভাবে বলল, হ্যাঁ, পল-আল-উন নামে হারিয়ে যাওয়া দেশের কথা আমার মনে আছে। আগে একবার আফ্রিকার সেই অজ্ঞাত জগতে তোমার সঙ্গেই এসেছিলাম। সময় সেখানে স্থির হয়ে আছে, আধুনিক পৃথিবীর পরিবর্তন সেই দেশকে স্পর্শ করতে পারে নি। সেখানে আমি তোমায় নামিয়ে দিতে পারব। বাড়তি একটা প্যারাশুট আমার সঙ্গে আছে। কিন্তু জায়গাটা ভারি বিপজ্জনক।

টারজানের মুখে মৃদ্যু হাসির রেখা ফুটল। দ্য আরনৎ একটু লজ্জিত হল, বিপদের ভয় যে টারজান করে না, সে-কথা কী সে জানে না?

একটা প্রকাণ্ড হ্রদের মাঝখানে পর্বত ও অরণ্য-আবৃত বিশাল দ্বীপ– পল-আল-ডন! অজ্ঞাত জগৎ। সেই দ্বীপের উপর উড়ন্ত বিমান থেকে ঝাঁপ দিল টারজান

ঘন ঘাসে আচ্ছন্ন বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বকে টারজান নামল। প্যারাশুট গুটিয়ে নিয়ে অদরে অবস্থিত ঘন জঙ্গলের দিকে তাকাল সে, গর্গো যদি কোথাও না গিয়ে থাকে, তাহলে এখানেই তার দেখা পাব।

বনমানুষের ভাষায় চিৎকার করে উঠল টারজান, গর্গো! টারজান ইয়ো গর্গো! টান্ড আগলা!

উত্তর এল, হারর-উফ!

পরক্ষণেই নিবিড় অরণ্য ভেদ করে যে অতিকায় জীবটি প্রান্তরের উপর আত্মপ্রকাশ করল, তাকে সামনে দেখলে অতিবড়ো দুঃসাহসীর বুকেও আতঙ্কের শিহরণ জাগবে।

আফ্রিকার বনভুমিতে কেপ বাফেলো নামে সচরাচর দৃশ্যমান মহিষের সঙ্গে দেহের গঠনে জীবটির কোনো তফাৎ নেই, তফাৎ আছে অয়তেন! গর্গো নামে অভিহিত অতিকায় মহিষটি আয়তনে প্রায় হাতির সমান!

গর্গোর সামনে গিয়ে আদর করে তার মুখে চাপড় মারল টারজান, গর্গো! তুমি আমাকে ভোলোনি তাহলে?

ম-ম-ম-ম! আনন্দ প্রকাশ করল গগো।

এই প্রকাণ্ড মহিষটিকে ছোটোবেলায় সিংহের মুখ থেকে রক্ষা করেছিল টারজান। তার ন্যুমা আগেই সিংহের কবলে প্রাণ হারিয়েছিল বাপ নিরুদ্দেশ। শ্বাপদ সংকুল আফ্রিকার অরণ্যে অরক্ষিত মহিষশাবকটির বেঁচে থাকা অসম্ভব জেনে টারজান তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। কিন্তু মহিষশাবকের আত্মরক্ষা করার মতো বয়স হওয়া পর্যন্ত সর্বদা তার দিকে নজর রাখা টারজানের পক্ষেও সম্ভব নয়। অতএব, টারজান এক অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করেছিল। আফ্রিকার জঙ্গলে এক ধরনের আশ্চর্য উদ্ভিদ পাওয়া যায়, তার রস পান করলে বা সেই উদ্ভিদ চিবিয়ে খেলে যে-কোনো সাধারণ জীব অতিকায় হয়ে ওঠে এবং তার দেহেও অসাধারণ শক্তির সঞ্চার হয়। একজন নিগ্রো ওঝা টারজানকে সেই উদ্ভিদের সন্ধান বলে দিয়েছিল। উক্ত উদ্ভিদের সাহায্যে এক মাসের মধ্যেই শিশু গর্গোকে পূর্ণবয়স্ক মহিষে পরিণত করল টারজান। কিন্তু সেই অতিকায় মহিষ শীঘ্রই শিকারিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে পল-আল-ডন নামক দ্বীপে মহিষটিকে নিয়ে আসে টারজান। এখানে বাস করে অতীতের মহাকায় ডাইনোসরের দল, তাদের মধ্যে গর্গোর প্রকাণ্ড শরীর কারা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। অবশ্য এই অঞ্চলে সভ্য মানুষের পদার্পণ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আজ প্রয়োজনের তাগিদে এই ভয়ানক জায়গাতে গর্গোর সন্ধানে এসেছে টারজান।

গর্গোর পিঠে চড়ে বিশাল জলা ও বনভূমি পার হয়ে টারজান এগিয়ে চলল। জলে-স্থলে বিশালকায় কয়েকটি ডাইনোসরের সঙ্গে তাদের সাক্ষাতকারও ঘটেছিল। কিন্তু কোনো মাংসাশী ডাইনোসর তাদের দিকে তেড়ে এল না। গর্গোর প্রকাণ্ড শিং দুটো যে অত্যন্ত মারাত্মক, তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে সে-কথা জেনে গেছে স্থানীয় ডাইনোসরের দল। মহিষমাংসের লোভে তারা জীবনকে বিপন্ন করতে চায় না।

এক সপ্তাহ পরের কথা। পূর্ব গগনে যখন সবে মাত্র আলোর আভাস দেখা দিয়েছে, সেই সময়ে সর্দার মবোগোর গ্রামে কাঠের বেড়ার মস্ত দরজার সামনে এসে দাঁড়াল নিঃসঙ্গ টারজান।

আফ্রিকার অন্যান্য গ্রামের মতোই মবোগোর গ্রামও ছিল কাঠের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মোটা মোটা শক্ত গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি সেই প্রাচীর।

প্রাচীরের গায়ে মস্ত দরজাটায় করাঘাত করল টারজানদরজা খুলল একাধিক সশস্ত্র প্রহরী, একী! টারজান!

-হ্যাঁ। আমি টারজানই বটে। তোমাদের সর্দারকে ডাকো। যদি সে ভয় না পায়, তাহলে যেন এখনই এসে আমার সঙ্গে দেখা করে।

প্রহরীরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল আশ্চর্য হয়ে, এক জডন প্রশ্ন করল, টারজান! তোমার ভয় নেই!

উত্তর এল, না। ভয় কাকে বলে আমি জানি না। তাছাড়া টারজানকে রক্ষা করছে অদৃশ্য শক্তি, তোমরা তাকে দেখতে পাচ্ছে না। যাও, দেরি কর না, সর্দার মবোগোকে খবর দাও।

যে প্রহরী টারজানের সঙ্গে কথা বলেছিল, সে বোকার মতো মাথা চুলকে তার সঙ্গীর দিকে ফিরল, অদৃশ্য শক্তি মানে কী? লোহার পাখিটার কথা বলছে নাকি?

সঙ্গী উত্তর দিল, না, টারজান যাদুর কথা বলছে। ও যাদু জানে। আজ পর্যন্ত কোনো বর্শা ওর শরীর ছুঁতে পারেনি, তা জানো?

অপর সঙ্গী বলল, ওকে ঘাটালে বিপদ আছে। তার চেয়ে বরং সর্দার মমবোগোকে খবর দেওয়াই ভালো। সর্দার যা ভালো বুঝবে, তাই করবে।

প্রহরী খবর দিতে গেল। মাটিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল টারজান

মহিষের শিংসমেত খুলি মাথায় চড়িয়ে কাষ্ঠপ্রাচীরের দরজায় এসে দাঁড়াল মবোগো, একী! টারজান! তুমি আমার সামনে বসে আছ? তোমার সাহস তো কম নয়! উঠে দাঁড়াও।

চারদিকে দেখছি জলের অভাবে শুকনো মাটি আর ধুলো, টারজান বলল, মবোগো! টারজান তোমাকে বৃষ্টি এনে দিতে পারে।

–ওয়া! ওয়া! আমাদের যাদুকর যা পারেনি, তুমি তা পারবে?

পারব। ওই যে মেঘগুলো মাথার উপর আকাশে ভেসে যাচ্ছে, ওদের বুক থেকে বৃষ্টির জল টেনে আনব আমি। কিন্তু তুমি যদি লুঠতরাজ না থামাও, তাহলে বৃষ্টি আসবে না। আমার নির্দেশে তোমার গ্রামের উপর শুরু হবে ধ্বংসের তান্ডব। কেউ রক্ষা পাবে না।

-কী! এত বড় স্পর্ধা। টারজান, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?

–দেখাচ্ছি।

কাঠের বেড়ার উপর এক জায়গায় অঙ্গুলি নির্দেশ করল মবোগো, সেখানে ঝুলছে সারি সারি অস্থিরময় নরমুন্ড!

একটা নরমুণ্ড তুলে নিয়ে মবোলগা বলল, টারজান। যারা একসময়ে আমায় বিরক্ত করেছে, এই মুণ্ডুগুলো হচ্ছে তাদের। এখন, লক্ষ্য কর

বলার সঙ্গেসঙ্গে উপরের দিকে কঙ্কাল-মুণ্ড ছুঁড়ে দিল মবোগো। করোটি যখন শূন্যে, তখনই একহাতে টিপ করে বন্দুক ছুঁড়ল সে সশব্দে মাটির উপর এসে পড়ল নরমমুণ্ড, তার মাথার একপাশে গুলির দাগ! একহাতে বন্দুক চালিয়ে শূন্যে ছিটকে-পড়া বস্তুতে গুলিবিদ্ধ করা সহজসাধ্য নয়।

মবোগো হাসল, টারজান! এটাকে ভালো করে দেখ। তোমার মাথার অবস্থাও এখনই এইরকম হবে।

তোমার হাতের টিপ চমৎকার, নীচু হয়ে নরমুণ্ডের কাছে বসে পড়ল টারজান, কিন্তু তুমি মোটেই চটপটে নও

বলার সঙ্গেসঙ্গে একমুঠো ধুলো নিয়ে টারজান ছুঁড়ে দিল মবোগোর মুখের উপর!

অস্ফুট চিৎকার করে বাঁ হাতে দুই চোখ ঢাকল মবোগো, ধুলোয় তার দৃষ্টি তখন অন্ধ হয়ে গেছে। তার শিথিল ডানহাত থেকে একটানে বন্দুক কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল টারজান, তারপর মবোগোর দুই বগলের তলা দিয়ে হাত গলিয়ে তার ঘাড় চেপে ধরল, মবোগো! তোমার সৈন্যদের সরে যেতে বল। নাহলে এখনই তোমার ঘাড় ভাঙব।

যৌবন টারজানের দেহে অমানুষিক শক্তির সঞ্চার করেছে, সভ্য পৃথিবী তাকে শিখিয়েছে হাতাহাতি লড়াই-এর বিভিন্ন কৌশল যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল মবগো!

–মবোগো! আত্মসমর্পণ করো, যদি বাঁচতে চাও। তোমার সৈন্যদের সরে যেতে বল।

আচম্বিতে একটা পাথরের মুগুর পিছন থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে সজোরে এসে পড়ল টারজানের মাথায়! জ্ঞান হারিয়ে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল টারজান

জ্ঞান ফিরে আসতেই টারজান দেখল একটা কাঠের খুঁটির সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সামনে দাঁড়িয়েছিল সর্দার মবোগোগা। টারজানকে চোখ মেলতে দেখে মবোগো বলল, টারজান! তুমি নাকি ভয় কাকে বলে জানো না? মরার আগে তুমি জানতে পারবে ভয় কাকে বলে!

টারজানের চোখে আচ্ছন্ন দৃষ্টি দেখে মবোগো বুঝল এখনও ভালোভাবে তার সংবিৎ ফিরে আসেনি, পার্শ্ববর্তী এক অনুচরকে ডেকে সে বলল, জল দিয়ে ভালো করে ওকে চাঙ্গা করে দাও। তারপর ওকে আমি বুঝিয়ে দেব ক্ষ্যাপা মোষের রোষ কেমন জিনিষ!

অনুচর টারজানের মুখে এক ভাঁড় জল ছিটিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্তে তার পূর্ণ চেতনা ফিরে এল, মুখ তুলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা ভালো করে বুঝে নিল সে, তারপরই চিৎকার, করে উঠল, গর্গো! গর্গো! ইয়াৎ! ইয়াৎ! আমার কাছে এস!

ব্যা-অ-অ- উনন! ভয়ংকর গর্জন ধ্বনিতে প্রায় বধির হয়ে গেল জনতা, পরক্ষণেই কাষ্ঠপ্রাচীরের উপর জেগে উঠল এক অতিকায় মহিষের শৃঙ্গ শোভিত বিশাল মস্তক!

সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্যের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল স্তম্ভিত দস্যুদল! একটানে বন্ধন রুক্ষ্ম ছিন্ন করে নিজেকে মুক্ত করে নিল টারজান, সঙ্গেসঙ্গে গর্গোর প্রচণ্ড শৃঙ্গাঘাতে সশব্দে ভেঙে পড়ল কাঠের প্রাচীর।

বিস্ময়ে আতঙ্কে এতক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল জনতা, এবার তারা আর্তনাদ করে পালাতে শুরু করল। মবোগো পালাতে পারল না, হাত ধরে তাকে আটকে রেখেছিল টারজান।

শিং দুলিয়ে টারজানের কাছে এগিয়ে এল গর্গো। সর্দার মবোগোকে গর্গোর সামনে ঠেলে ধরে টারজান বলল, দাঁড়াও মবোগো, এবার আমি তোমাকে বোঝাব ভয় কাকে বলে! তুমি নিজেকে ক্ষ্যাপা মোষ বলতে, তাই না, এবার দেখে নাও সত্যিকার ক্ষ্যাপা মোষ কেমন জিনিস!

মবোগো তখন ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। এমন অবিশ্বাস্য বিভীষিকার সঙ্গে তার কোনোদিন পরিচয় হয়নি!

টারজান কঠিন স্বরে বলল, মবোগো। তোমায় আমি আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, তোমার গাঁয়ের উপর ধ্বংসের তাণ্ডব শুরু হবে। তাকিয়ে দেখ মবোগো— জলাভূমির উপর যে বুনো মোষের দল বাস করে, যাদের জন্য কোনো শত্রু জলা পেরিয়ে তোমার আস্তানায় হামলা করতে পারে না সেই বুনো মোষের দল অতিকায় গর্গোর নেতৃত্বে আজ তোমার গ্রাম ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিচ্ছে! কাঠের গুঁড়িতে তৈরি কঠিন প্রাচীর গোর আগেই ভেঙে পড়েছে, সেই পথে ঢুকেছে বুনো মোষের পাল তোমার গ্রামে! দেখ মবোগো, একটার পর একটা কুঁড়ে ঘর মোষের শিং-এর আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে মাটির উপর! কিন্তু এই তো সবে শুরু, তারপর

-রক্ষা কর, রক্ষা কর, চিৎকার করে কেঁদে উঠল দুর্ধর্ষ দুস্যসর্দার মবোগো, আমি প্রতিজ্ঞা করছি কোনোদিন আমার যোদ্ধারা কোনো গ্রামে হানা দেবে না। তুমি দয়া করে তোমার মোষের পালকে এখান থেকে চলে যেতে বল।

টারজান গগোর দিকে তাকাল, গগো! তোমার দল নিয়ে জলাভুমিতে চলে যাও।

 ম-মমম, উত্তর দিল গর্গো, তারপর তাণ্ডবে মত্ত মহিষযুথকে উদ্দেশ্য করে তীব্রস্বরে হাঁক দিল, ম-মমম-উ-উ-উ-ঈ-ঈ-আন-হ!

ত্রাসে আতঙ্কে মুহ্যমান মবোগো টারজানের পায়ের কাছে পড়েছিল, হাত ধরে তাকে টেনে তুলল টারজান, ও মবোগ! চেয়ে দেখ, মোষের দল তোমার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে, এবার আমি আমার কথা রাখব। বৃষ্টি নামিয়ে দেব।

বিহ্বল স্বরে মবোগো বলল বৃষ্টি?

–হ্যাঁ বৃষ্টি, কটিবাসের ভিতর থেকে একটা আয়না বার করল টারজান, তোমার শুকনো জমি আমি বৃষ্টির জলে ভিজিয়ে দেব। এখন আমি মেঘের দেবতার সঙ্গে কথা কইব।

আকাশের দিকে চাইল টারজান। মেঘের তলায় চক্রাকারে পাক দিচ্ছে পল দ্য আরনৎ-এর বিমান। টারজানের আয়নায় প্রতিফলিত সূর্যরশ্মি চমকে উঠল বিমানের গায়ে।

দ্য আরনৎ নিজের মনেই মাথা নাড়ল, টারজান তাহলে তার কথামতো আলোর সংকেতে সংবাদ পাঠাল। নাইরোবি থেকে যে রাসায়নিক পদার্থ কিনেছি, এবার সেগুলোকে মেঘের উপর ছড়িয়ে দিতে হবে। এইভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর চেষ্টা সবসময় সফল হয় না, দেখা যাক কী হয়–

মেঘের উপর উঠে গেল পল দ্য আরনতের বিমানপোত

জলাভূমির প্রান্তে বিমান নামিয়ে অপেক্ষা করছিল দ্য আরন। এখানেই তার সঙ্গে টারজানের দেখা করার কথা। হঠাৎ গ্রামের দিক থেকে একটি চলমান বস্তু প্রান্তরের উপর দৃশ্যমান হল- কিছুক্ষণের মধ্যেই বস্তুটি এগিয়ে এল আরও সামনে, আরও কাছে কাছে, কাছে, আরও কাছে

হোল, মঁ আমি! বিস্ময়ে দুই চোখ বিস্ফারিত করে দ্য আরনৎ বলে উঠল, এই অসম্ভব দানবটিকে তুমি কোথা থেকে সংগ্রহ করলে, টারজান?

গর্গোর পিঠের উপর থেকে হাসিমুখে উত্তর দিল টারজান, আমি ওকে এক বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ খাইয়ে পালন করেছি শিশুকাল থেকে; তার ফলে এই মহিষশাবক আজকের অতিকায় দানবে পরিণত হয়েছে। ওর কথা যাক্, এখন বল, তোমার বৃষ্টি কখন শুরু হবে?

-বেশি দেরি হবে না, দ্য আরনৎ আকাশের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল, ওই দেখ।

টারজান নির্দিষ্ট দিকে দৃষ্টিপাত করল, কালো জলভরা মেঘ এগিয়ে আসছে বটে!

কিছুক্ষণ পরেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। দূর থেকে উৎফুল্ল জনতার উল্লাসধ্বনি ভেসে আসতে লাগল দুই বন্ধুর কানে।

টারজানের মুখে হাসি ফুটল, ধন্যবাদ পল। বৃষ্টি নেমেছে, সুতরাং দস্যুসর্দার মবোগো আর কারো উপর হামলা করবে না।

দ্য আরনৎ কিছু বলার আগেই বিকট হাঁক ছাড়ল গগো, মমম-ব্র-অ-অ! চমকে উঠে দ্য আরনৎ উদবিগ্ন স্বরে বলল, দানবটা অমন হাঁক-ডাক করছে কেন? পুঁতিয়ে দেবে না তো?

-না, না, টারজান হাসল, গর্গো এখন আমায় নিয়ে স্বস্থানে ফিরে যেতে চাইছে।

একলাফে গর্গোর কাঁধের উপর উঠে বসে টারজান বলল, পল, আমি এখন গর্গোকে নিয়ে পল-আল-ডন দ্বীপে যাচ্ছি।

ম আমি, বৈমানিক দ্য আরনৎ হাত নেড়ে বন্ধুকে বিদায় জানাল, আমি তোমায় যথাসময়ে ওই দ্বীপ থেকে তুলে নেব।

.

০৮. নিখোঁজের খোঁজে টারজান

আফ্রিকার বনভূমির উপর দিয়ে উড়ে চলেছে একটি বিমানপোত। বিমানে যাত্রী দু-জন। বিমান চালনা করছেন ডক্টর আলেকজান্ডার ম্যাকহোয়ার্টার সংক্ষেপে ম্যাক! ড. ম্যাক একজন বৈজ্ঞানিক, আফ্রিকার অরণ্যে বিভিন্ন পশুপক্ষী ও উদ্ভিদ নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন। তার সাময়িক আস্তানা এখন আফ্রিকারই এক অরণ্যে, সেখানে যাবতীয় গবেষণার উপযোগী জিনিসপত্র রয়েছে।

তার সঙ্গী টারজান আমাদের পরিচিত। ড. ম্যাক টারজানকে তাঁর বিমানে তুলে নিয়েছেন বিশেষ উদ্দেশ্যে। তাঁর ভাইঝি বারবার নাইরোবি থেকে বিমানপোতে রওনা হয়েছে তাঁর কাছে আসার জন্য, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পরেও বারো ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, এখনো সে এসে পৌঁছায়নি ড. ম্যাকের কাছে। তাই অত্যন্ত দুচিন্তাগ্রস্থ হয়ে ড. ম্যাক টারজানের আস্তানা ৫ থেকে তাকে তুলে নিয়েছেন এবং আকাশ থেকেই গন্তব্যপথ ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন–

হয়তো তলায় জঙ্গলের মধ্যে বিমানের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়তে পারে—

টারজান হঠাৎ বলে উঠল, ড. ম্যাক! নীচে ওই খাদের কিনারায় একটা ভাঙা বিমান পড়ে আছে।

দুই চোখের দৃষ্টিকে অরণ্যভূমির উপর সঞ্চালিত করে ড. ম্যাক বললেন, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তবে তোমার দৃষ্টিশক্তি সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক বেশি প্রখর তুমি বিমানের উপর থেকে দূর জঙ্গলের মধ্যে যা দেখতে পাচ্ছো, আমার পক্ষে তা দেখা সম্ভব নয়। তুমি যে-জায়গাটা দেখছ, তার কাছেই বিমান নামানোর উপযুক্ত অনেকটা ফাঁকা মাঠ রয়েছে, ওখানেই আমরা নামব।

বিমানপোত নামিয়ে টারজানের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে সত্যিই একটা ভগ্ন বিমান দেখা গেল। বিমানচালকের মৃতদেহ সেখানেই পড়েছিল, কিন্তু ড. ম্যাকের ভাইঝি বারবারা নামক মেয়েটিকে কোথাও দেখা গেল না।

ড. ম্যাক নীচু হয়ে মৃতদেহটা দেখলেন, মৃতের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। লোকটা বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়নি, কিন্তু আমার ভাইঝি বারবারা গেল কোথায়?

টারজান নীচু হয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করে বলল, মৃত মানুষটির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। কলকজা বিগড়ে গেলেও বিমানচালক বিমানটিকে কোনোরকমে নামিয়ে এনেছে, অসমান বনভূমিতে ধাক্কা লেগে বিমানটি ভেঙেছে বটে কিন্তু আরোহী দু-জন অক্ষত থেকে গেছে।

ড. ম্যাক বললেন, তাহলে লোকটি হঠাৎ মারা পড়ল কেমন করে? আমার ভাইঝি বারবারাই বা গেল কোথায়?

টারজান বলল, লোকটি মারা পড়েছে কাঁকড়া-বিছার কামড়ে। এখানকার বিছাগুলি ভীষণ বিষাক্ত। আপনার ভাইঝি কোথাও যায়নি, তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বিস্মিত কণ্ঠে ড. ম্যাক বললেন, জোর করে নিয়ে গেছে কারা?

— এখানকার কয়েকজন নিগ্রো অধিবাসী আপনার ভাইঝিকে নিয়ে গেছে, টারজান বলল, তবে বারবারার কোনো ক্ষতি হয়নি, সে ভালো আছে। কিন্তু মেয়েটি খুব ভয় পেয়েছে

-কী করে বুঝলে?

-এখানে নিগ্রোদের পায়ের চিহ্ন আর গায়ের গন্ধ আছে। মেয়েটি ভয় পেয়েছিল, সেই ভয়ের গন্ধও আমি পাচ্ছি। তার মানে বারবারা ওই লোকগুলোর হাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা আগে বন্দি হয়েছে। ভাবছেন, কী করে বুঝলাম? ড. ম্যাক, ভয় পেলে মানুষ বা জীবজন্তুর শরীর থেকে একধরনের গন্ধ বার হয়, আমি সেই গন্ধ পাচ্ছি। ছয় ঘণ্টার বেশি ওই গন্ধ থাকে না, তাই বঝতে পারছি বারবারা বন্দি হয়েছে স্থানীয় নিগ্রোদের হাতে ওই সময়ের মধ্যে। সাদা মানুষ, বিশেষত ইউরোপের মেয়ে আর নিগ্রোদের গায়ের গন্ধে তফাৎ আছে। এখানে কালো-চামড়ার নিগ্রোদের গায়ের গন্ধের সঙ্গে একটি ভয়-পাওয়া সদা-চামড়ার মেয়ের অর্থাৎ বারবারার গায়ের গন্ধ আমার নাকে ধরা পড়েছে।

-এখন আমরা কী করব?

–জঙ্গলের চলার পথে ওদের চলার চিহ্ন ধরে আমি এগিয়ে যাব। আশা করি তাহলেই একসময়ে বারবারার দেখা পাব, আর দেখা পেলে তাকে উদ্ধার করা বোধ হয় অসম্ভব হবে না।

-বেশ। তাহলে পথ দেখাও। আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

–না, ড. ম্যাক। আপনি আপনার বিমানে উঠে চলে যান। আমি বারবারাকে নিয়ে আপনার গবেষণাগারে পৌঁছে যাব। আপনি আমার জন্য অন্তত তিন দিন অপেক্ষা করবেন। ওই সময়ের মধ্যে যদি আমি আপনার ভাইঝিকে নিয়ে ফিরে আসতে না পারি, তাহলে অস্ত্রধারী লোকজন নিয়ে এই অঞ্চলটা খুঁজে দেখবেন। তবে আমার মনে হয় সেরকম প্রয়োজন হবে, আমিই বারবারাকে নিয়ে নির্দিষ্ট তিনদিনের মধ্যে আপনার কাছে পৌঁছে যাব।—-টারজান, আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই। বারবারার জন্য আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।

আপনি সঙ্গে গেলে বারবারাকে উদ্ধার করা কঠিন হবে। একা আমার পক্ষে কাজটা অনেক সহজ। অনর্থক চিন্তা করবেন না, ড. ম্যাক। আপনি চলে যান।

ড. ম্যাক বুঝলেন প্রতিবাদ করে লাভ নেই। তিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁর বিমানের দিকে পা চালালেন। টারজান মাটিতে পদচিহ্নের সন্ধান করতে করতে এগিয়ে চলল

হঠাৎ সামনের ঝোপের ভিতর থেকে একটা বুনো গন্ধ ভেসে এল টারজানের নাসারন্ধ্রে। কোমর থেকে ছুরি খুলে নিয়ে প্রস্তুত হল টারজান। পরক্ষণেই ঝোপের ভিতর থেকে প্রান্তরের উপর আত্মপ্রকাশ করল বন্য শুকর হোর্গ, তার প্রকাণ্ড দাঁত দুটো সূর্যের আলোয় ঝক ঝক করে উঠল।

টারজানের দিকে তেড়ে এল হোর্তা; তৎক্ষণাৎ শূন্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল নিক্ষিপ্ত ছুরি আমূল বিঁধে গেল হোর্তার মস্তকে! একটা আর্ত চিৎকার করে শুয়রটা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে নিকটবর্তী অরণ্যের ভিতর থেকে ভেসে এল সিংহের গম্ভীর গর্জন!

ছুরিটা শূয়রের মাথা থেকে খুলে নিয়ে শব্দ লক্ষ্য করে ঘুরে দাঁড়াল টারজান। আবার সিংহনাদ! টারজান বিস্মিত হল– গর্জনের ধরন শুনেই সে বুঝেছে ন্যুমা ক্ষুধার্ত, শূয়রের চিৎকার কানে যেতেই সে গর্জে উঠেছে কিন্তু পেটে খিদে থাকলেও ন্যুমা একজায়গায় দাঁড়িয়ে গর্জন করছে কেন? সে এগিয়ে আসছে না কেন? টারজানের কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠল–

শূয়রের মৃতদেহ কাঁধে ফেলে গর্জনধ্বনি অনুসরণ করে এগিয়ে চলল টারজান। আর একটু এগিয়ে যেতেই দৃশ্যটা টারজানের চোখে পড়ল একটা গর্তের ভিতর দাঁড়িয়ে গর্জন করছে মা। নিগ্রোদের ফঁদ-পাতা গর্তে পড়ে গিয়েছে প্রকাণ্ড এক সিংহ! কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে জন্তুটাকে পর্যবেক্ষণ করল টারজান, তারপর নিজের মনেই বলল, কী চমৎকার জন্তু। গায়ের রং এত গাঢ় যে প্রায় কালো বলেই মনে হয়। শরীরটাও প্রকাণ্ড। আফ্রিকার জঙ্গলে এতদিন আছি, এমন সুন্দর আর শক্তিশালী সিংহের দেখা কখনো পাইনি।

শূয়রের শরীর থেকে মস্তবড় এক টুকরো মাংস কেটে সেটা গর্তের ভিতর ছুঁড়ে দিল টারজান। ন্যুমা সেটাকে লুফে নিল, তারপর অতি দ্রুত মাংস ছিঁড়ে ভোজন করতে লাগল ক্ষুধিত আগ্রহে

টারজান একটু চিন্তা করল, নিগ্রোরা এসে উপর থেকে পাথর আর বল্লম ছুঁড়ে ওকে শেষ করবে। না, এমন সুন্দর জন্তুটাকে এমন অসহায় ভাবে মরতে দেওয়া যায় না। ওকে বাঁচাতে হবে।

গর্তের পাশ থেকে আলগা মাটি ছুরি দিয়ে খুঁড়ে ফেলতে লাগল টারজান। দ্যুমার পক্ষে খাড়া গর্তের গা বেয়ে ওঠা অসম্ভব হলেও মাটির ধস নামলেই সেই হেলানো মাটির দেয়াল বেয়ে সে উঠে আসতে পারবে। মাটিতে ছুরি চালাতে চালাতে টারজান হেসে উঠল, মুক্তি পেলেই তুমি হয়তো আমাকে আক্রমণ করবে। তাহলেও আমি বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছি

হঠাৎ হুড়মুড় করে আলগা মাটি গর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ল, সেই সঙ্গে টারজানও ছিটকে পড়ল গর্তের মধ্যে। কোনোরকমে সামলে নিয়ে উঠে বসল টারজন এবং সবিস্ময়ে দেখল ন্যুমা তার দিকেই তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু তার চোখে মুখে হিংস্র আক্রোশের চিহ্নমাত্র নেই।

ন্যুমার গলা থেকে চাপা আওয়াজ বেরিয়ে এল, মমম-অনন!

ওই শব্দ চেনে টারজান। সিংহরা ওইভাবেই বন্ধুকে প্রীতি জানায়। উঠে দাঁড়াল টারজান। সামনে মাটির ধস হেলে পড়ে উপরে ওঠার পথ করে দিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে টারজান বলল, ন্যুমা আমি তোমাকে খেতে দিয়েছি, সেকথা দেখছি ভুলে যাওনি। আচ্ছা বন্ধু, এবার উপরে উঠে যাও। আমি তোমার অনুসরণ করছি।

চটপট গর্তের ঢাল বেয়ে উপরে অদৃশ্য হল মা। টারজানও তাকে অনুসরণ করল। কিন্তু উপরে উঠে সে আশ্চর্য হয়ে গেল নমা স্থির হয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য!

বিস্মিত টারজন বলল, বন্ধু, তুমি স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছ। তোমার পেটও ভরেছে। আর কী চাই?

উত্তর এল, মম-অরর হঃ!

সিংহের ভাষা বোঝে টারজান। সে হাসল, তুমি আমার শিকারের সঙ্গী হতে চাও ভালো কথা। কিন্তু আমরা এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকারের সন্ধান করব অর্থাৎ মানুষের সন্ধানে যাত্রা করব। বুঝলে?

ন্যুমা কী বুঝল, সে-ই জানে, চাপা গর্জনে উত্তর দিল, অরর-হঃ!

বারবারা আর তার অপহারক নিগ্রোদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে টারজান একটা ঢালু জায়গার কিনারে এসে দাঁড়াল। পায়ের দাগগুলো ওই পথেই নেমে গেছে। টারজান সেই পথে নীচে নেমে এল।

মা এতক্ষণ তার সঙ্গে আসছিল কিন্তু ঢালু জায়গাটার কিনারে এসে থমকে পঁড়িয়ে পড়ল। টারজান বুঝল ওই উপত্যকা তার শিকারের জায়গা নয়, তাই ওখানে যেতে চাইছে না মা। অগত্যা নুমাকে সেখানেই রেখে নিঃসঙ্গ টারজান আবার পদচিহ্নের অনুসরণ করতে লাগল

চলার পথ থেকে একটু দূরে যে-জঙ্গলটা ছিল, সেখান থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল তিনটি হায়না। জন্তুগুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল টারজান। জঙ্গলের ভিতর থেকে আরও কয়েকটা হায়না ফাঁকা মাঠের উপর আত্মপ্রকাশ করল। তাদের দৃষ্টি টারজানের দিকে। টারজান বিচলিত হল না, সে জানে হায়না ভীরু জানোয়ার, যে-শত্রু ফিরে আঘাত করতে পারে তাকে হায়না আক্রমণ করে না। হঠাৎ একটা হায়না কর্কশ শব্দে অটহাস্য করে উঠল ইয়া-হা-হা-হা-! সঙ্গেসঙ্গে সমস্ত দলটা ছুটে এল টারজানের দিকে!

হুঁ, জন্তুগুলো খুব অসাধারণ, টারজান নিজের মনেই বলল, দলে ভারি হয়ে ড্যাংগোর (হায়না) সাহস বেড়েছে। কিন্তু ওরা চটপটে নয়। টারজানকে ধরার সাধ্য ওদের নেই।

টারজান পিছন ফিরে ছুটতে শুরু করল এবং কিছুদূর গিয়ে একটা গাছে উঠে পড়ল। তলায় দাঁড়িয়ে বিকট মুখভঙ্গি করে চিৎকার করতে লাগল হায়নার দল। কিছুক্ষণ নিফল আক্রোশে চেঁচিয়ে জন্তুগুলো আবার জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হল–

পৃথিবীর বুকে তখন ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে টারজান স্বগতোক্তি করল, মানুষের শিক্ষা না পেলে হায়নার এমন সাহস হয় না। প্রভুদের শিক্ষাতেই বহিরাগত মানুষকে আক্রমণ করে এই জন্তুগুলো।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল টারজান। সন্ধ্যার ধূসর অঞ্চলের পরিবর্তে বনভূমিকে গ্রাস করল রাত্রির কালো যবনিকা- হঠাৎ অন্ধকার অরণ্যের বুকে জাগল আলোর আভাস টরজান বুঝল কারা যেন অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়েছে–

টারজান মাটিতে নেমে পদচিহ্ন অনুসরণ করার চেষ্টা করল না, রাতের অন্ধকারে সেটা সম্ভবও ছিল না গাছ থেকে গাছে লতা ধরে ঝুলতে ঝুলতে আর দুলতে দুলতে সে এগিয়ে চলল অগ্নিকুণ্ড লক্ষ্য করে

স্থানীয় নিগ্রোরা বারবারাকে একটা কুঁড়েঘরের মধ্যে সারাদিন বন্দি করে রেখেছিল। রাত্রে তারা মেয়েটিকে ঘরেরবাইরে নিয়ে এল। এর মধ্যে তার উপর কোনো উৎপীড়ন ঘটেনি, খাদ্য পানীয় সরবরাহ করা হয়েছিল তার জন্য পোড়া মাংস, প্রচুর ফল আর জল।

বারবারাকে পাঁচিল-ঘেরা সমতল ভূমির উপর একটা খোলা জায়গার উপর নিয়ে এল কয়েকজন নিগ্রো রক্ষী। সমতলভূমির মাঝামাঝি জায়গায় একটা মস্ত টিপি এবং সেই ঢিপির একটু দূরে জ্বলছে অগ্নিকুণ্ড। ঢিপিটা খুব সরু, প্রায় তিন-মানুষ উঁচু। ঢিপির গায়ে একটা মই লাগিয়ে নিগ্রোরা বারবারাকে উপরে উঠে যেতে ইঙ্গিত করল। অবাধ্য হয়ে লাভ নেই– নিরুপায় বারবারা উপরে উঠে গেল। ঢিপির উপর যেটুকু সমতল অংশ আছে, তার উপর একটা লোক কোনোরকমে দাঁড়াতে পারে। বারবারা সেই জায়গাটায় উঠে দাঁড়াতেই নিগ্রোরা মইটা সরিয়ে নিল

কিছুক্ষণ পরে অগ্নিকুণ্ডের সামনে এসে দাঁড়াল নিগ্রোদের ওঝা, আঙুত পোশাক চড়িয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে সে নাচতে লাগল– সেই সঙ্গে তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুরু করল গান। নৃত্যগীত শুরু হওয়ার একটু পরে শিকল-বাঁধা একদল হায়নাকে নিয়ে এল কয়েকজন নিগ্রো। জন্তুগুলোর শিকল খুলে দেওয়া হল। তৎক্ষণাৎ ঢিপির নীচে ছুটে এসে দাঁড়াল হায়নার দল এবং ঊর্ধ্বে মুখ তুলে অর্থাৎ বারবারার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে লাগল সমবেত কণ্ঠে

বারবারার মাথা ঘুরতে লাগল। সে ওঝার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। সেই বিচিত্র নৃত্য বেশিক্ষণ তাকিয়ে দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে আর নীচে পড়ে গেলে হায়নারা যে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে সে বিষয়ে বারবারার কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। খুব বেশিক্ষণ ওই স্বল্প পরিসর জায়গায় ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকা যে সম্ভব হবে না, তা জানত বারবারা– তবু নিজেকে সামলে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিল। বারবারা বুঝল লোকগুলোর কাছে এটা একটা মজার খেলা সম্ভবত অপরিচিত মানুষের সাক্ষাৎ পেলে তাকে বন্দি করে এখানকার লোকগুলো, তারপর হায়নার টোপ করে ওই ঢিপির উপর তুলে দেয়। একসময় ভারসাম্য হারিয়ে মানুষটা নীচে পড়ে যায় আর তৎক্ষণাৎ অপেক্ষমান হায়নার দল তাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলে। সেই ভয়াবহ পরিণমাম থেকে বাঁচার কোনো উপায় খুঁজে পেল না বারবারা, তবুও ওঝার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সে যথাসাধ্য ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছিল

আচম্বিতে বহু মানুষের কোলাহল আর হায়নার উত্তেজিত তীব্র কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল বারবারা। আওয়াজ আসছিল নৃত্যরত ওঝার দিকে থেকে। সেদিকে ফিরে তাকাতেই বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বারবারা

ওঝাকে দু-হাতে মাথার উপর তুলে ধরেছে এক বিপুল বপু শ্বেতাঙ্গ দৈত্য। দৈত্য বারবারার অপরিচিত নয়, কাকার অন্তরঙ্গ বন্ধু টারজানকে আগেও দেখেছে বারবারা।

ওঝা তার ছুরি দিয়ে টারজানকে আঘাত করার চেষ্টা করতেই টারজান তাকে শূন্যে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলল হায়নাগুলো দিকে। দুটো হায়না আর্তনাদ করে উঠল, ওঝা এসে পড়েছে তাদের ঘাড়ের উপর।

হায়নার দল আর তাদের প্রভুরা বিস্ময়ের চমক সামলে প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় পেল না– অগ্নিকুণ্ড থেকে কয়েকটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে টারজান শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করল। জ্বলন্ত কাষ্ঠের ভয়াবহ স্পর্শ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য দৌড়ে পালিয়ে গেল হায়নার দল, তাদের প্রভুরাও পোষ্যদের অনুসরণ করতে দ্বিধাবোধ করল না। আর ঠিক সেইসময় হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল বারবারা। তীব্র আর্তনাদ করে সে চোখ মুধে ফেলল

কিন্তু কঠিন মাটির সংঘাতের পরিবর্তে বারবারা অনুভব করল তার দেহটা আশ্রয় পেয়েছে একজোড়া বলিষ্ঠ বাহুর মধ্যে! চোখ খুলতেই সে দেখল তাকে পাঁজাকোলা করে ধরে রেখেছে টারজান! তাকে নামিয়ে দিয়ে টারজান বলল, বারবারা, অগ্নিকুণ্ড থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নাও।

বারবারা তার নির্দেশ পালন করল। টারজানও একটা মস্ত বড়ো জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিল।

হায়নার দল আর তাদের প্রভুরা পালিয়ে যাওয়ার পর পাঁচিল ঘেরা জায়গাটার মধ্যে এতক্ষণ কেউ ছিল না। এবার দরজা দিয়ে প্রবেশ করল অনেকগুলো হায়না, তাদের পিছনে রয়েছে কয়েকজন বলিষ্ঠ নিগ্রো। লোকগুলো টারজান ও বারবারার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে কী যেন বলল- পরক্ষণেই কর্কশ অট্টহাস্যে চারদিক কাঁপিয়ে জন্তুগুলো ছুটে এল টারজান আর বারবারার দিকে।

এক অমানুষিক গর্জন ধ্বনি বেরিয়ে এল টারজানের গলা থেকে, জ্বলন্ত কাঠটা তুলে নিয়ে সে সগর্জনে ছুটে গেল হায়নাগুলোর সামনে।

জ্বলন্ত আগুন নিয়ে টারজানকে ছুটে আসতে দেখেই ভয় পেয়ে গেল হায়নার দল, তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে তারা ছুট দিল। পিছনের দরজাটা নিগ্রোরা বন্ধ করে দিয়েছিল, কিন্তু অতগুলো ধাবমান পশুর দেহের ধাক্কায় দরজা ভেঙে সঙ্গেসঙ্গে সেই ফাঁক দিয়ে তীব্র বেগে অন্তর্ধান করল হায়না বাহিনী। যে লোকগুলো হায়নাদের নিয়ে এসেছিল তারাও এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল। ভাঙা দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল টারজান আর বারবারা। বারবারার হাত ধরে অন্ধকারের মধ্যেই ছুটল টারজান–

পদে পদে হোঁচট খেয়ে প্রায় অন্ধের মতোই ছুটছিল বারবারা। দু-বার সে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে টারজানের হাত ধরে সে সামলে নিল।

পিছন থেকে আবার ভেসে এল অনেকগুলো হায়নার কর্কশ কণ্ঠস্বর, সেই সঙ্গে মানুষের কোলাহল। অন্ধকারে কান পেতে শুনল টারজান, তারপর বলল, ওরা আবার আসছে। বারবারা, তুমি ছুটতে পারছ না

বলার সঙ্গেসঙ্গে তাকে টপ করে তুলে নিল টারজান, তারপর আবার ছুটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ ছোটার পর আবার পিছন থেকে ভেসে এল পশু ও মানুষের সমবেত কণ্ঠস্বর।

বারবারা বলল, আমাকে নিয়ে ছুটলে তুমি ওদের ছাড়িয়ে যেতে পারবেনা। টারজান, আমাকে নামিয়ে দাও। আমি ছুটতে চেষ্টা করব।

টারজান উত্তর দিল না, বারবারাকে নামিয়েও দিল না শুধু গতিবেগ আরও বাড়িয়ে দিল, তার শ্বাসপ্রশ্বাস হল আরও দ্রুত

আচম্বিতে সামনের উঁচু জমির উপর থেকে ভেসে এল গুরুগম্ভীর সিংহ গর্জন!

 টারজান একমূহুর্ত থামল, বারবারা, হয়তো আশা আছে। ওই সিংহটাকে আমি চিনি।

উঁচু জমির উপর অস্পষ্ট কালো ছায়ার মতো একটা সিংহের শীর এখন বারবারার চোখে পড়েছে। হঠাৎ টারজানের কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল এক ভয়াবহ গর্জনধ্বনি। টারজানের দুই হাতের মধ্যে শুয়ে থেকেও আতঙ্কে চমকে উঠল বারবারা– টারজানের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে অবিকল সিংহের কণ্ঠস্বর।

উপরের ছায়া শরীরটা একলাফে নীচে নামল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এসে দাঁড়াল টারজানের সামনে প্রকাণ্ড সিংহ।

টারজান বারবারাকে নামিয়ে দিতেই সে সভয়ে টারজানকে আঁকড়ে ধরল। টারজান হাসল, ভয় নেই। ন্যুমা তোমাকে কিছু বলবে না।

তারপর সিংহের দিকে তাকিয়ে টারজান কতকগুলো অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করল। বারবারার মনে হল সে সিংহটাকে কিছু বলছে। উত্তরে সিংহের গলা থেকে বেরিয়ে এল চাপা গর গর আওয়াজ।

টারজান বারবারার দিকে ফিরল, তুমি এখানে দাঁড়িও না। একটু কষ্ট করে ঢাল বেয়ে ওই উঁচু জমিটার উপর উঠে যাও, তারপর ওইখানে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা কর।

টারজানের সাহায্যে উঁচু জমির উপর আশ্রয় গ্রহণ করল বারবারা। ওদিকে জঙ্গল ভেঙে বেরিয়ে এল একদল হায়না, তাদের পিছনে রয়েছে কয়েকজন বর্শাধারী নিগ্রোযযাদ্ধা।

যোদ্ধাদের পিছনে ফেলে ছুটে এগিয়ে এল হায়না-বাহিনী। ভয়ঙ্কর গর্জনে চারদিক কাঁপিয়ে প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল দ্যুমা, তার প্রচণ্ড থাবা মুহূর্তের মধ্যে দুটো হায়নাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল।

আরও দুটো হায়না লাফ দিল টারজানকে লক্ষ্য করে। দুটো লোহার মতো শক্ত হাত জন্তু দুটোর টুটি চেপে শূন্যে তুলে ধরল। সঙ্গেসঙ্গে একজোড়া বর্শা এসে বিধল জন্তু দুটোর শরীরে। টারজান হাসল, বৰ্শ দুটো আমার দিকেই ছোঁড়া হয়েছিল। হায়নারা ঝাঁপিয়ে না পড়লে অস্ত্র দুটো আমার গায়েই লাগত।

দুটো হায়নাই মারা পড়েছিল। একটার শরীর থেকে বর্শা তুলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল টারজান

হতাহত সঙ্গীদের পিছনে ফেলে হায়নারা পালাতে লাগল। তাদের প্রভুরাও প্রাণপণে পোষ্যদের অনুসরণ করতে দ্বিধা বোধ করল না। ক্রুদ্ধ নুমা সগর্জনে তাদের পিছনে ছুটে যাওয়ার উপক্রম করতেই টারজান বাধা দিল, না মা, ওদের যেতে দাও।

অসন্তোষের চাপা গর্জন বেরিয়ে এল নমার গলা থেকে, কিন্তু সে টারজানের আদেশ বা অনুরোধ রাখল। একলাফে উঁচু জমিটার উপর উঠে টারজানের দিকে তাকিয়ে সে মৃদুস্বরে গর্জন করল একবার, তারপর অন্ধকার অরণ্যের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল

বারবারা এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়েছে, টারজান, তুমি নিশ্চয় কাকার কাছে খবর পেয়ে এসেছ?

টারজান সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।

বারবারা বলল, এ-যাত্রা বোধ হয় আমরা বেঁচে গেলাম। সিংহটা যেন ঈশ্বর-প্রেরিত–যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনই হঠাৎ মিলিয়ে গেল।

–তা বটে, টারজান হাসল, কিন্তু একটু পরেই আবার আমরা ওর দেখা পাব।

–কেন?

আমি এখন ওকেই অনুসরণ করছি। তুমিও আমার সঙ্গে আসছ।

–কেন? ওকে আমরা অনুসরণ করব কেন?

–একটু আগেই ও শিকার করেছে। সেই শিকারের মাংসে ভাগ বাসাবার জন্য ও আমায় নিমন্ত্রণ করে গেল।

সিংহের নিমন্ত্রণ! তার শিকারে ভাগ বসানোর জন্য! সত্যি টারজান, সারা পৃথিবীতে তোমার তুলনা নেই।