৫. যন্ত্রপাতি রাখার টেবিলে

০৫.

যন্ত্রপাতি রাখার টেবিলে মরগ্যান গিয়ে বসলো।

তাহলে এই যদি আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়, তবে অসম্পূর্ণ কাজগুলো এবারে সেরে ফেলা যাক। মরগ্যান সবার মুখের ওপর একে একে চোখ বুলিয়ে নিলো।

কারখানার এখানে সেখানে পড়ে থাকা প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে ওরা চারজন একমনে মরগ্যানের কথা শুনতে লাগলো।

মরগ্যান বললো, জিনির ব্যবহারের জন্য আমাদের আরও একটা গাড়ি দরকার। খোলামেলা টু–সীটার স্পোর্টস কার হলেই ভাল হয়। গাড়িটা জোগাড় করার ভার আমি কিটসন ও ব্লেকের ওপরেই দিলাম। গাড়িটা তোমরা কায়দা করামাত্রই সোজা এই কারখানায় নিয়ে আসবে। জিপো গাড়িটার রঙ, নম্বর সব পাল্টে দেবে–কেউ ধরতেই পারবেনা। এই গাড়িটাকে আমরা বিপজ্জনক বাঁকের মুখে উল্টে দেবো। ঐ বাঁকটার কাছাকাছি রাস্তার ধারে একটা বড়সড় গাজ্ঞা আছে। ফুট দশেক লম্বা দুটো শাবল দিয়ে আমরা গাড়িটাকে ওই গর্তে উল্টে দেবো। তোমার ওপরে শাবল দুটো জোগাড় করার ভার, জিপো।

ঠিক আছে। …আর ফ্র্যাঙ্ক, ঐ পথ নির্দেশ দুটো আমি তৈরি করে ফেলেছি।

দেখি, কোথায়?

কিছুক্ষণের মধ্যেই জিপো পথ নির্দেশ দুটো নিয়ে এলো। মরগ্যান দেখে খুশীই হলো ভালোই হয়েছে। এবার তাহলে পুরো পরিকল্পনাটা আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। তোমরা একজন কাগজ পেনসিল নিয়ে লিখতে শুরু করো। কারণ কাকে ঠিক কি কি করতে হবে, সে সম্বন্ধে পরে যেন কোনরকম সংশয় সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। জিনি তুমি লেখো। কেমন?

আমাকে একটা কাগজ আর পেনসিল দাও–আমি লিখে নিচ্ছি।

 জিপো কাগজ পেনসিল আনতে গেলে ব্লেক বললো, জিপো মনে হয় ভয় পেয়েছে, ফ্র্যাঙ্ক। আমার তো ওকে নিয়ে রীতিমতো চিন্তা হচ্ছে।

মরগ্যান কঠিন মুখে বললো, জিপোকে নিয়ে আমি চিন্তিত নই। ট্রাক দখলে আনা পর্যন্ত আমরা ওর সঙ্গে নরম ব্যবহার করবো, কিন্তু তারপরও যদি দেখি ও বেগড়বাই করছে, তাহলে ওকে চাপ দিয়ে কাজ আদায় করতে হবে–তাছাড়া উপায় নেই। সুতরাং জিপোকে নিয়ে ভয় পাওয়া নিরর্থক।

তুমি ঠিকই বলেছো–ওইভাবেই ওকে দিয়ে কাজ করাতে হবে। 

মরগ্যান এবার কিটসনের দিকে তাকিয়ে বললো এবারে বলল, আলেক্স–কিরকম লাগছে তোমার? কিভাবে টাকাটা খরচ করবে কিছু ভেবেছো?

কিটসন ধীরভাবে বললো, এখনও টাকাটা আমাদের হাতে আসেনি। ওটা হাতে আসার পর মতলব ভাজার ঢের সময় পাওয়া যাবে।

মরগ্যান তারপর জিনির দিকে ফিরলো–কেমন লাগছে, জিনি?

ভাবলেশহীন ভাবে জিনি বললো–কেন খারাপ কি?

জিপো একটা প্যাড আর পেনসিল এনে জিনিকে দিলো।

মরগ্যান বললো, পরিকল্পনাটা আগাপাস্তালা আমি আবার বলছি। কেউ যদি কোনো জায়গায় বুঝতে না পারো, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলবে, কারণ প্রত্যেকেরই নিখুঁতভাবে জানা দরকার তাকে কি করতে হবে। সুতরাং প্রশ্ন করতে দ্বিধা করবেনা। একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার বলতে লাগলো, শুক্রবার সকাল ঠিক আটটায় আমরা এখানে জমায়েত হচ্ছি। কিটসন ও জিনির পরনে থাকবে নতুন বর বউ যেন ছুটি কাটাতে যাচ্ছে এরকম পোশাক। কিটসন বুইকটা চালাবে, আর স্পোর্টস কারটা চালাবে জিনি। আমরা থাকবো বুইকের লাগোয়া এই ক্যারাভ্যানটার ভেতরে–সম্পূর্ণ অদৃশ্য। জিনি গাড়ি নিয়ে সোজা যাবে ওয়েলিং এজেন্সির কাছে। সেখানে ও ট্রাকটার জন্যে অপেক্ষা করবে। এদিকে কিটসন বুইক এবং ক্যারাভ্যান নিয়ে সোজা সেই কাঁচা সড়কের মুখে পড়বে। সেইখানে একটা পথ নির্দেশ সমেত জিপোকে আমরা নামিয়ে দেবো। এই খানে লিখে রাখো। পথ নির্দেশ দুটো জায়গামতো লাগানোর জন্য আমাদের দুটো ভারী হাতুড়ি দরকার। শোনো জিপো, কাঁচা সড়কের মুখে তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি। সেখানে লুকোবার জন্যে অনেক ঝোঁপঝাড় আছে। তোমার কাজ হচ্ছে ট্রাকটার জন্য অপেক্ষা করা। যেই ওটা কাঁচা সড়কে ঢুকবে, অমনি। তুমি পথনির্দেশটা রাস্তার মুখে লাগিয়ে দেবে–যাতে অন্যান্য গাড়ি আর সেই রাস্তায় না ঢোকে। বুঝতেই পারছো এইভাবে আমরা ট্রাকটা একলা পাচ্ছি। …আচ্ছা–এবার কাজ হয়ে গেলে তুমি কাঁচা সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করবে। যাতে আসল কাজের পর তোমাকে আমরা তুলে নিতে পারিবুঝেছো?

জিপো উত্তেজিতভাবে মাথা ঝাঁকালে, হ্যাঁ–

এরপর কিটসন গাড়ি থামাচ্ছে বিপজ্জনক বাঁকের কাছে। সেখানে এড এবং আমি ক্যারাভ্যান থেকে নেমে পড়বোবলাবাহুল্য আশপাশের ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে আমরা ট্রাকের আসার অপেক্ষায় থাকবে। কিটসন কিন্তু গাড়ি চালিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করবে। কিটসন, তুমি ক্যারাভ্যানটা কোনো জঙ্গলের ভেতরে লুকিয়ে রেখে শুধুবুইকটা নিয়ে কাঁচা সড়কের অন্য মুখটায় পৌঁছবে। সেখানে দ্বিতীয় পথনির্দেশটা লাগিয়ে দিয়ে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে। ক্যারাভ্যানটা আবার বুইকের পেছনে জুড়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে, যেদিক থেকে ট্রাকটা আসার কথা, অর্থাৎ আমাদের দিকে মুখ করে রাখবে। তারপর সংকেতের জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করবে। রাস্তা বেশ চওড়া আছে। ক্যারাভ্যান শুদ্ধ গাড়ি ঘোরাতে তোমার কোনো অসুবিধেই হবে না। তারপর সংকেত পেলে তুমি গাড়ি ছুটিয়ে আবার আমাদের কাছে এসে হাজির হবে। গাড়িটাকে আগের মতো ঘুরিয়ে ক্যারাভ্যানের পেছনটা ট্রাকের সামনের দিকে মুখ করে রাখবে। রাস্তার মাটি যথেষ্ট শক্ত। তবে একটা কথা–সংকেত শোনার পর তুমি একমুহূর্তও দেরী করবে না। বিদ্যুৎ গতিতে গাড়ি ছোটাবে। এ ব্যাপারে যেন কোনরকম ভুলচুক না হয়।

 কিটসন বললো, কিন্তু সংকেতটা কি, সেটা তোবললেনা। কি করে বুঝবো কখন গাড়ি ছোটাতে হবে?

চিন্তায় মরগ্যানের ভুরু ঈষৎ কুঞ্চিত হলো, আমার মনে হয় রাইফেল রা রিভলবারের শব্দ তুমি অতি সহজেই শুনতে পাবে। যদি সে ধরনের গুলি গোলার ব্যাপার না ঘটে। তবে আমি বাঁশীবাজিয়ে তোমাকে সংকেত পাঠাবো। বাঁশীর একটানা সংকেত শোনামাত্রই তুমি তোমার কাজ শুরু করবে। কেমন?

গভীরভাবে কিটসন বললো, তোমার কি ধারণা যে রিভলবার বা রাইফেল ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে?

মরগ্যান কাধ ঝাঁকালো। কি জানি! আগে থাকতে কিছুই বলা সম্ভব নয়। তবে আমার ধারণা, সেরকম ঘটনা ঘটতেও পারে।

মরগ্যান ব্লেকের দিকে একঝলক দেখে আবার বললো, সে যাই হোক, মোট কথা বাঁশীর শব্দ শুনলেই তুমি চলে আসবে। জিপো, তোমার কাজটা খুবই সহজ মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমার শেষের কাজটুকু হয়ে দাঁড়াবে সবচেয়ে কঠিন কথাটা মনে রেখো।

অস্বস্তিভরে জিপো ঘাড় নাড়লো। তবে কোনোরকম মারপিটের ঝামেলায় জড়াতে হবে না দেখে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আর তাছাড়া সে যখন মরগ্যানের প্রধান কারিগর, তখন যন্ত্রপাতির কাজ ছেড়ে সে কেন যাবে সাধারণ হাতাহাতির মধ্যে তার কাজ হচ্ছে ট্রাকের তালা খোলা, ব্যস।

মরগ্যান কিটসনকে বললো, তোমাকে কি করতে হবে–এখন বুঝতে পেরেছ?

কিটসন নিজেকে খুনের দায়ে জড়ানোর ভয় থেকে বাঁচাতে পেরে আশ্বস্ত হলো।

এবার তাহলে জিনির কথায় আসা যাক। ট্রাকটা বেরিয়ে আসা পর্যন্ত তুমি গাড়ি নিয়ে এজেন্সির দরজার কাছে অপেক্ষা করবে। ট্রাকটা রাস্তায় নেমে চলতে শুরু করলেই তুমি ওটাকে সাবধানে অনুসরণ করবে। ড্রাইভার যেন তোমাকে দেখতে না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। ট্রাকটা যখন মাঝারি রাস্তায় পড়বে, তখন তুমি ওটার ঠিক পেছনে গিয়ে হাজির হবে। ঘন ঘন হর্ন বাজাতে থাকবে। তোমাকে যাবার রাস্তা দিতে ট্রাকটা একপাশে সরে যাবে। এরপর তোমাকে ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে হবে। অর্থাৎ ট্রাক ড্রাইভার যেন তোমাকে মনে রাখে। অতএব যখন ট্রাকের পাশ কাটাবে, তখন খুব জোরে হর্ণ বাজাবে। চাই কি ড্রাইভারের দিকে মুখ ফিরিয়ে দু–চার বার হাতও নাড়বে। তারপর তীরবেগে গাড়ি ছুটিয়ে দেবে। আমি চাই, ঐ ড্রাইভার যেন মনে করে তোমার ভীষণ তাড়া আছে। তুমি যদি ঠিক সময়মতো ট্রাকের পাশ কাটাতে পারো, তবে সামনে তখনও মাইল খানেক রাস্তা পাবে। যে গাড়িটা তোমাকে এনে দেবো সেটা ঘন্টায়, কমকরে একশো মাইল দৌড়বে–সুতরাং তুমি যতো জোরে পারো গাড়ি ছুটিয়ে যাবে। যাতে টমাস আর ডাকসন বলাবলি করে যে, মেয়েটা একটা দুর্ঘটনা না করে বসে। আশা করি তুমি আমার মতলব বুঝতে পেরেছো?

জিনি সম্মতি জানালো।

কাঁচা সড়কের বাঁক ঘুরতেই ওরা আর তোমাকে দেখতে পাবেনা। কিন্তু তাই বলে তুমি গাড়ির গতি কমাবে না। দুর্ঘটনার কোনো ভয় নেই। কারণ মুখোমুখি আসা কোনো গাড়ির তুমি দেখা পাবেনা। অর্থাৎ কিটসন ততক্ষণে কাঁচা সড়কের অপর প্রান্তে প্রবেশ নিষেধপথ নির্দেশ লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তবুও তুমি সাবধানে থাকবে। যাতে কোনো বিপদ না হয়। আমরা শাবল নিয়ে তোমার জন্য বিপজ্জনক বাঁকের মুখেই অপেক্ষা করবো।

এড ও আমি গাড়িটাকে উলটে ফেলে দেবো রাস্তার ধারের গর্তে। ট্রাকটা এসে পৌঁছবার আগে দৃশ্যসজ্জার জন্য আমরা মোটামুটি পনেরো মিনিট সময় পাবো। অবশ্য সেটা নির্ভর করছে, কতত জোরে তুমি গাড়ি চালাতে পার তার ওপর। দুর্ঘটনার দৃশ্যটাকে বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তব করে তোলার জন্য তোমার গাড়িতে আমরা আগুন ধরিয়ে দেবো। পেট্রল–ট্র্যাঙ্কে ডোবানোর জন্য একটা লম্বা, ছেঁড়া কাপড় আমাদের দরকার পড়বে। কাগজে কাপড়ের টুকরোর কথা লিখেনাও। মরগ্যান কিটসনের দিকে ঘুরলো–তুমি যাবে ডুকাসের একটা মাংসের দোকানে। সেখান থেকে বোতল দুয়েক শুয়োরের রক্ত নিয়ে আসবে। রক্ত কেনার কারণ বলে দিও তোমার বাগানের কাজে লাগবে। জিনি, তুমি সঙ্গে করে আর এক প্রস্থ পোশাক নিও। কারণ তোমার পরনের পোশাক রক্তে একেবারে ভর্তি করে দেওয়া হবে। আমি চাই ট্রাক থামিয়ে টমাস ও ডার্কসন মনে করুক, তুমি অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। তোমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলে ওরা ট্রাক ছেড়ে নামতে আর দেরী করবে না। একটু হেসে মরগ্যান প্রশ্ন করলো, কোনো প্রশ্ন আছে?

জিনি বললো, না। এখন পর্যন্ত সবই ঠিক আছে।

আচ্ছা, তাহলে রক্ত সমুদ্রের মাঝে অচেতন হয়ে তুমি পড়ে রয়েছে। গাড়িটা রাস্তার ধারে দাউ দাউ করে জ্বলছে। এড ও আমি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে–এডের হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। ট্রাকটা এসে এই দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখে থামলো। এইখানে কিছুটা আমাদের আন্দাজের ওপর চলতে হবে। এবং এর পরবর্তী কাজগুলো অবস্থা বুঝে করতে হবে। কারণ জিনিকে পড়ে থাকতে দেখে টমাস এবং ডার্কসন ঠিক কি করবে বলা মুশকিল। তবে একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে জিনির ওপর দিয়ে তারা ট্রাক চালিয়ে যাবেনা। সুতরাং ওরা থামবে। হয়তো দুজনে নেমে অবস্থাটা ভালো করে বুঝতে চাইবে। আমার ধারণা প্রহরীটা এগিয়ে যাবে জিনির দিকে। আর ড্রাইভার ট্রাকেই বসে থাকবে। তাহলে ডার্কসন যেই জিনির ফুট খানেকের মধ্যে পৌঁছে যাবে। অমনি ট্রাকের পেছন দিক থেকে আমি এগিয়ে আসবো। এড তখন তার লুকোবার জায়গা থেকে ডার্কসনকে লক্ষ্য করে রাইফেল তাক করে রাখবে। ডাকসন যেই জিনির ওপর ঝুঁকে পড়বে। আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে হাজির হবো ট্রাকের জানলার কাছে ড্রাইভারের মুখে রিভলবার ঠেসে ধরবো। এবং একই সঙ্গে জিনি ডার্কসনের পেটে বন্দুক চেপে ধরবে।

মরগ্যানের দিকে ওরা চারজন একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

এরপর কি ঘটবে, সে সম্বন্ধে আমার ধারণাও তোমাদেরই মতো। হয় টমাস ও ডার্কসন আত্মসমর্পণ করবে, নয় তো গোলমাল বাধাতে চাইবে। সুতরাং আমাদের সবরকম পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। ডার্কসনের কোনোরকম বেচাল দেখলেই এড ওকে গুলি করবে। টমাসের ক্ষেত্রে আমাকেও ঐ একই পন্থা অবলম্বন করতে হবে। মানে, পুরো ব্যাপারটাই একটা সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করছে। তবে যাই ঘটুক না কেন, টমাসকে আমি বোতাম টিপৰার সময় দিচ্ছি না। তোমরা প্রত্যেকে যদি মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে পারো তবে বিপদের কোনো কারণ নেই। মরগ্যান ব্লেকের দিকে তাকালো।

যদি একান্তই তোমাকে রাইফেল ব্যবহার করতে হয়, তবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ ডার্কসন খুব বেশি হলে তোমার থেকে মাত্র বিশ ফুট দূরে থাকবে, আর তোমার হাতে থাকবে, স্বয়ংক্রিয় রাইফেলতা দিয়ে একশো গজ দূরের একটা মানুষকেও মেরে ফেলা যায়। তবে মনে রাখবে রাইফেল যেন একবারের বেশি ব্যবহার করতে না হয়। স্থির এবং নিশ্চিত গুলি করবে।

সে বিষয়ে আমার কোনো ভুল হবে না।

আচ্ছা, তাহলে টমাস, ডার্কসনকে কুপোকাত করে আমি বাঁশীতে ফুঁ দেব। তুমি আমাদের থেকে শপাঁচেক গজ দূরে থাকবে। কিটসন, বাঁশীর শব্দের জন্য একমনে কান পেতে অপেক্ষা করবে। সংকেত শোনামাত্রই ঝড়ের গতিতে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসবে।

কিটসন ঘাড় নাড়লো। এরপর আমাদের খুব.তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। কিটসন গাড়ি ঘুরিয়ে ক্যারাভানটাকে ট্রাকের সামনের দিকে মুখ করে রাখবে। আমি ট্রাকটা চালিয়ে ঢালু পাটাতন বেয়ে ক্যারাভানে ঢুকিয়ে দেবো। জিনি, তুমি ঐ সময়ের মধ্যে তোমার পোষাক চটপট পাল্টে নেবে। এড শাবল দুটো এবং রাইফেলটা নিয়ে ক্যারাভানে ঢুকিয়ে রাখবে। তারপর ট্রাকে আমার পাশে এসে বসবে। আর জিনি ও কিটসন বসবে বুইকে–পাশাপাশি। কিটসন আবার ঘুরিয়ে যেদিক থেকে ট্রাকটা এসেছে সেদিকে ছুটবে। ততক্ষণে জিপো রাস্তা ধরে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। অতএব অতি সহজেই আমরা ওকে ক্যারাভ্যান খুলে ট্রাকের ভেতর তুলে নেবো।

তাহলে কিটসন আর জিনিরইলোবুইকে। আর আমরা তিনজন রইলাম ক্যারাভ্যানের ভেতরে দাঁড়ানো ট্রাকের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্তরালে। এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা বড় রাস্তার দিকে ছুটবো। তা বলে কিটসনকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হবেনা। ভাগ্য সহায় থাকলে আমরা পনেরো মিনিটের মধ্যেই বড় রাস্তায় গিয়ে পড়বো। ঐ সময়ের মধ্যে এজেন্সিজানতে পারবে তাদের ট্রাক মাঝ রাস্তায় গায়েব হয়ে গেছে। প্রথমে হয়তো ওরা ভাববে ট্রাকের ট্রান্সমিটার কোনো অজ্ঞাত কারণে খারাপ হয়ে গেছে। তাই হয়তো রিসার্চ স্টেশনে খোঁজ করবে। আমার অনুমান, এই ট্রাক উধাও হওয়ার ব্যাপারে বিস্ফোরণ ঘটতে সময় লাগবে মোটামুটি আধঘণ্টা। বড় রাস্তায় পড়ে কিটসন তিরিশ মাইলের বেশি জোরে গাড়ি ছোটাবেনা। আর ঐ সময়ে রাস্তায় গাড়ি–টাড়ির ভিড়ও। থাকবে প্রচুর সুতরাং এই ক্যারাভ্যানটার কথা কারো মনেও আসবে না। বিশেষ করে লোকে যখন দেখবে নববিবাহিতা স্বামী–স্ত্রী ছুটি কাটাতে চলেছে। এ পর্যন্ত কারো কোনো প্রশ্ন আছে?

 কিটসন হাতে হাত ঘষে বললো, কিন্তু ড্রাইভার এবং রক্ষীর কি হবে? ওদের কী আমরা ঐ বাঁকের কাছেই রেখে আসবো?

মরগ্যান বিব্রতভাবে বললো, ও নিয়ে শুধু শুধু তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। এড এবং আমি ওদের উপযুক্ত ব্যবস্থা করবো।

কিটসন ঘামতে লাগলো। টমাস ও ডার্কসনকে যে নৃশংসভাবে খুন করা হবে, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ।

কিন্তু ওরা তো ক্যারাভ্যানটা দেখবে। এমন কি আমাদের চেহারার বর্ণনাও পুলিশের কাছে দেবে–বলবে ট্রাকটা আমরা ক্যারাভ্যানে লুকিয়ে রেখেছি। কিটসন টমাস ও ডার্কসনের ব্যবস্থার ব্যাপারটা খোলাখুলি ভাবে মরগ্যানের মুখ থেকে শুনতে চায়।

মরগ্যান বিরক্ত হয়ে বললো, সেটা যাতে না হয় সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে, তাই না? অতএব তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। আমি আর এড এদিকে খেয়াল রাখবো। ঠিক আছে?

কিটসন জিনির দিকে তাকিয়ে ওর নির্বিকার মুখভাব দেখে তার আতঙ্ককে আরো বাড়িয়ে তুললো। তার মনের ভেতরে চিৎকার করে কে যেন বললো, সাবধান আলেক্স, ভালো চাও তো এখনো এসব ছেড়ে সরে এসো। কিটসন বুঝল, এই ট্রাক লুঠের চূড়ান্ত পরিণতি মৃত্যু। এর শেষ অধ্যায় রক্তিম অধ্যায়। একজন অন্ধও এটা স্পষ্ট বুঝতে পারবে। কারণ টমাস ও ডার্কসনকে জীবিত অবস্থায় ছেড়ে আসার সাহস তাদের নেই। …হঠাৎমরগ্যানের কণ্ঠস্বরে, কিটসনের সম্বিত এলো—

তোমাদের যদি আর কারো কোনো প্রশ্ন না থাকে তাহলে আমি আবার শুরু করছি।

কাঁপা স্বরে জিপো বললো, দাঁড়াও ফ্র্যাঙ্ক। ব্যাপারটা যেন আমার কাছে কেমন কেমন ঠেকছে। আমি তোমার কাছে সোজাসুজি জানতে চাই : টমাস ও ডার্কসনের তোমরা কি ব্যবস্থা করবে? কি করে তোমরা নিশ্চিত হবে যে ওরা পুলিশের কাছে মুখ খুলবে না?

মরগ্যানের চোয়ালের রেখা কঠিন হলো দাঁত খিঁচিয়ে বললো, তোমাকে কি জিনিসটা ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে? কি করে লোকের মুখ বন্ধ করতে হয় তা তুমি জানোনা, ন্যাকা? শোনো জিপো, তুমি আর আলেক্স সম্পূর্ণ নিজেদের ইচ্ছেয় আমার স্বপক্ষে ভোট দিয়েছে। তবে আগে আমি তোমাদের বারবার সাবধান করে দিয়েছিলাম বলেছিলাম এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি আছে। চাই কি গরম চেয়ার পর্যন্তও ব্যাপার গড়াতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তেই তোমরা এ কাজে সম্মত হয়ে আমার পক্ষে ভোট দিয়েছিলে। অতএব কি পন্থায় টমাস ও ডাকসনের মুখ বন্ধ করবো সে নিয়ে এখন আর ন্যাকামী কোরো না। তুমিও যেমন জানো, তেমনি আমিও জানি কিভাবে মানুষের মুখ বন্ধ করতে হয়। কিন্তু তোমাকে তো আমি সে কাজের দায়িত্ব দিচ্ছি না। আমি আর এড যেচে সে ঝুঁকি নিচ্ছি। সুতরাং তুমি যদি এখন দলছুট হরার মতলবে থাকো, তো ভীষণ ভুল করবে। আমরা সবাই একসঙ্গে জলে নেমেছি। ডুবলে সবাই একসঙ্গেই ডুববো। তোমার আর কিটসনের হঠাৎ ধম্মোভাব জেগেছে বলে কাজ ভেস্তে দেবো, অতো বোকা আমি নই। বুঝেছো?

কয়েকবার ঢোক গিললো জিপো। মরগ্যানের নৃশংসতার ভাব দেখে তার মনে হলো, দ্বিতীয়বার যদি প্রতিবাদ করা হয় মরগ্যান তাকে কুকুরের মতো গুলি করে মেরে ফেলতে একটুও দ্বিধা করবে না।

জিপো মৃদুস্বরে বললো, ঠিক আছে, তুমি যা বলবে তাই হবে।

আলবাৎ তাই হবে। বলেই মরগ্যান এক ঝটকায় কিটসনের দিকে ঘুরে, তুমি কি বলল?

মরগ্যানের চেয়ে কিটসন জিনিকে বেশি ভয় করে। কারণ এই চরম মুহূর্তে পরাজয় স্বীকার করলে জিনির কাছেহবে উপহাস্যাস্পদ। তাছাড়া একটা মেয়ের কাছে সেহার স্বীকার করতে পারবে না।

কিটসন বললো, আমি এমনিই একটা প্রশ্ন করেছি। তার জন্যও কি আবার জবাবদিহি করতে হবে না কি?

আশা করি তোমার প্রশ্নে উত্তর তুমি পেয়ে গেছে? যদি আর সময় নষ্ট করতে না চাও, তাহলে আবার বলতে শুরু করি?

উত্তেজনায় কিটসনের মুখ লাল, বলল।

বড় রাস্তায় পড়ে আমরা সোজা ছুটবো ফন–হ্রদের দিকে। কারণ, সেখানে একটা ক্যারাভ্যানের ঘাঁটি আছে। আমরা সেখানেই আমাদের ক্যারাভ্যানটা রাখবো। দুশো ক্যারাভ্যানের মধ্যে ওটাকে খুঁজে বের করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়–সন্দেহ করা তো দূরের কথা দুপুরের মধ্যেই আমরা ফন হ্রদে পৌঁছে যাবো। সেখানেদের চারিদিকে অসংখ্য ছোট ছোট ঘর রয়েছে–কিটসন সেরকম একটা ঘর ভাড়া করবে। ভাড়া নেওয়া ঘরটার কাছেই তুমি ক্যারাভ্যানটা রাখবে। এবং তুমি আর জিনি নতুন বিয়ে করা বর বউয়ের অভিনয় করবে। সাঁতার কাটবে, মাছ ধরবে। ঘুরে বেড়াবে–অর্থাৎ চুটিয়ে আনন্দ করবে। অন্যান্য লোকেরা যেন বুঝতে পারে তুমি মধুচন্দ্রিমা কাটাতে এখানে এসেছে। এবং তোমরা নিজেদের মধ্যেই সর্বক্ষণ থাকতে চাও। তুমি যখন এই ধরণের পরিবেশ তৈরী করেছে, তখন আমি, জিপো ও এড ট্রাকটা নিয়ে পড়বো–

ব্লেক উত্তেজিত স্বরে, চেঁচিয়ে উঠলো, আশ্চর্য ফ্র্যাঙ্ক! কিটসন শালা দেখছি দিব্যি আরামের কাজ নিয়েছে! খালি ফুর্তি আর ফুর্তি!

উত্তেজিত রক্তিম মুখে কিটসন হাত মুঠো করে এগিয়ে এলোরাগে চোখ জোড়ায় যেন আগুন জ্বলছে।

মরগ্যান রুক্ষস্বরে, থামোমরগ্যানের রুষ্ট আদেশে কিটসন থামলো। –শোনো এড, তোমাকে আবারও বলছি। আমরা এই কাজটা দলগতভাবে করছি। কিটসনের কাজ গাড়ি চালানো এবং যৎসামান্য অভিনয় করাও দুটো কাজ ও আমাদের চেয়ে ভালোই পারে। অতএব তুমি কথায় কথায় ওকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করা ছাড়ো। নয়তো শেষে আমরাই বিপদে পড়বো। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে এই খেয়োখেয়ি দেখতে দেখতে আমার ঘেন্না ধরে গেলো। এক জিনিই যা চুপচাপ থাকে। এ কাজটা যদি আমাদের সত্যিই মতলব মাফিক হাসিল করতে হয়, তাহলে এই ছেলে মানুষিগুলো পকেটে পুরে রাখো। এ কথা আমি আর বলবো না–সেটা বুঝে চুপচাপ থাকো।

ব্লেক কাঁধ ঝাঁকালো–আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। ওঃ, একটা সামান্য মন্তব্য করলেও দেখছি বিপদ।

মরগ্যান আবার বলতে শুরু করলো, ক্যারাভ্যান ফন হ্রদে গিয়ে থামামাত্রই জিপো ওর কাজ শুরু করবে। অবশ্য ক্যারাভ্যানের ভেতর ঐ অল্প জায়গায় এবং ভ্যাপসা গরমে ট্রাকের তালা খোলা সহজ হবে না, কিন্তু আমরা নিরুপায় জিপো, ওটুকু কষ্ট তোমাকে করতেই হবে। আমি আর এড ট্রাকের ভেতরে থাকবোতোমারই সুবিধের জন্য। আমাদের তিনজনকেই একটু বেশি কষ্ট সহ্য করতে হবে, কারণ অন্ধকার নেমে আসার আগে আমরা ক্যারাভ্যান থেকে বেরোতে পারছি না। রাত হলেই আমরা ক্যারাভ্যান ছেড়ে ঘরে ঢুকবো, কিন্তু সকাল হওয়া মাত্রই সকলের অলক্ষ্যে আবার ক্যারাভ্যানে ফিরে আসবো। কেউ যাতে আমাদের দেখতে না পায়। জিপো যদি মনে করে তালা খোলার কাজ অল্প সময়ে হবে না তাহলে হয়তো আমাদের ফন হ্রদ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে সম্ভবতঃ পাহাড়ী অঞ্চলের দিকে। কিন্তু সেটা এড়াতে পারলেই খুশী হবো। কারণ পাহাড়ী রাস্তায় বুইকের পক্ষে বোধহয় ক্যারাভ্যানটিকে টেনে তোলা সম্ভব হবে না…তার ওপর গাড়ি যদি বিগড়ে যায় তাহলেই তো চিত্তির। জিপোর দিকে তাকিয়ে মরগ্যান, কোনো প্রশ্ন আছে?

জিপো বললো, তার মানে ট্রাকের ভেতরে বসেই আমাকে ক্যারাভ্যানের ওপর কাজ চালাতে হবে। তাহলে তো অ্যাসিটিলিন টর্চ ব্যবহার করা মুশকিল হবে। প্রথমতঃক্যারাভ্যানের পর্দার ভেতর দিয়ে সেই আগুন কেউ দেখে ফেলতে পারে। আর দ্বিতীয়তঃ, ক্যারাভ্যানে আগুন লেগে যাবার সম্ভাবনাও যথেষ্ট।

হয়তো তোমাকে ঐ অ্যাসিটিলিন টর্চ ব্যবহার করতে নাও হতে পারে। সময়–নির্ভর তালাটা যে ঐ সময়ের মধ্যে খুলে যাবেনা তাই বা কে বলতে পারে? অথবা কম্বিনেশন নম্বরটাও হয়তো অতি সহজেই তুমি বের করে ফেললে, তখন?

মরগ্যানের কথার সমর্থনে জিপো ঘাড় নাড়লো।

মরগ্যান টেবিল থেকে নেমে হাত পা ছাড়িয়ে অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সজীব করতে চাইলো, তাহলে এই হলো আমাদের মোটামুটি পরিকল্পনা। এতে কোনোরকম সম্ভাবনাকেই আমরা বাদ দিইনি, কিন্তু তবুও এটা নিখুঁত হয় নি। কোনদিন কোনো পরিকল্পনা নিখুঁত হয় না। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত–ট্রাকটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে আমরা অতি সহজেই দিনের পর দিন লুকিয়ে রাখতে পারবো। ক্যারাভ্যানের সমুদ্রে কোনো একটা বিশেষ ক্যারাভ্যানের ভেতর ট্রাকটার অবস্থিতির কথা কেউ ধারণাতেই আনতে পারবেনা। আমাদের প্ল্যানের এটাই হলো সবচেয়ে মার কাটারি অংশ। জিনি, এর জন্যে আমি তোমার কাছে ঋণী। তোমার এই মতলবটা এককথায় অপূর্ব।

যার যা কাজ সে তা ঠিকমতো করলেই আমাদের কাজ চোখ বুঝে হাসিল হবে–জিনির অকম্পিত কণ্ঠস্বরে নেই কোনো উচ্ছলতা।

মরগ্যান ঘড়ি দেখে বললো, আমার তাই মনে হয়। এড, তুমি আর কিটসন জিপোর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ো–গাড়ি রাখবার জায়গাগুলো একবার চক্কর মেরে এসো। একটা স্পোর্টসকার আমার আজ রাতেই চাই। গাড়িটা পেলেই জিপোর এখানে নিয়ে আসবে। জিপো ওটার রং পাল্টে নতুন রং করে দেবে। যাও, বেরিয়ে পড়ো।

কিটসন বিরক্তির সঙ্গেই রাজি হলো। বলাবাহুল্য ব্লেকের সঙ্গই তার যতো বিরক্তির কারণ। কিন্তু তবু সে রাজি হলো। মাথা নীচু করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

ব্লেক শিস দিতে দিতে ওকে অনুসরণ করলো। জিনিকে পাশ কাটাবার সময় অর্থবহ ভাবে সে চোখ টিপলো। জিনি শূন্যদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো।

লিংকনে স্টার্ট দেওয়ার শব্দ ওরা পেলো।

মরগ্যান জিনিকে বললো। জিনি, তোমাকে যা করতে হবে তা হলো খাবারের ব্যবস্থা। গোটা দুয়েক বাক্স কিনে তাতে টিনে ভরা খাবার কিনে নিও। কিছু টাকা ওর হাতে দিয়ে, যা যা দরকার মনেকরো, বুঝে শুনে কিনে রেখো–আর হ্যাঁ, দু বোতল স্কচ কিনতে ভুলোনা যেন। যাও, তোমার আর কোনো কাজ নেই। শুক্রবার সকাল আটটার সময় আবার দেখা হবে–কেমন?

ঠিক আটটার সময়। প্যাড থেকে লেখা দুটো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে মরগ্যানকে দিলো। সে কাগজ দুটো এক পলক দেখে পকেটে রাখলো।

বাইরে তো এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। বলো তো তোমাকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিই? মরগ্যান বললো।

জিনি প্লাস্টিকের বর্ষাতিটা গায়ে চাপিয়ে–না তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাসেই যেতে পারবো। হঠাৎই মরগ্যানের চোখে চোখ রেখে–তোমার ধারণা একাজে আমরা জিতবোই, তাই না?

হা, কিন্তু তোমারও তো ঐ একই বিশ্বাস?

ইতস্ততঃ করে জিনি মাথা নাড়লো, হুঁ। আচ্ছা, তাহলে চলি–দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছে জিপো। শুধু দু লক্ষ ডলারের লোভ এবং মরগ্যানের নীরব শাসানি তার মুখ বন্ধ করেছে। এখন তার ভয় হচ্ছে, যদি তাদের কোথাও ভুল হয়ে যায়? যদি সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে? ওঃ ভগবান। তার মা শুনলে কি ভাববে?

জিপোর কাঁধে মরগ্যান আশ্বাসের ভঙ্গিতে হাত রাখলো–ভয় পাওয়ার কিছু নেই, জিপো। আর মাত্র এক সপ্তাহ–তারপরই তোমার ভাগ্য ফিরে যাবে। দু লক্ষ ডলারের জন্য এর চেয়েও বিরাট ঝুঁকি নেওয়া যায়, তাই না? যাকগে, কাল সকালে আমি আবার আসবো। ক্যারাভ্যানের ওপর তোমার কাজ দেখে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। যাও, একটু গলা ভিজিয়ে নাও–এতো মুষড়ে পড়ার কি আছে? …আচ্ছা, তাহলে চলি–জিপোর পিঠে বার দুয়েক মৃদু চাপড় মেরে মরগ্যান চলে গেলো।

গমন্ট সিনেমার কাছাকাছি বিশাল গাড়ি রাখার জায়গা লক্ষ্য করে গাড়ি চালাতে চালাতে নিজের মনের ভেতর একসুপ্ত দ্বন্দ্বের আভাস পেলো কিটসন। এই বিপজ্জনক কাজে সাফল্য লাভের আশা সে করছে না। বরং সে খুনের দায়ে জড়িয়ে পড়তে চলেছে। এ কাজ থেকে সে পেছিয়ে আসতো, যদি না মরগ্যান তার ভূমিকা সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করতো। জিনি ও সে স্বামী–স্ত্রীর অভিনয় করবে। তাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। ঘুরতে হবে…তারা সাঁতার কাটবে, মাছ ধরবে কয়েকটা দিন আনন্দে কাটিয়ে দেবে। আর জিনি অভিনয়ের ব্যাপারে যেমন বাস্তবঘেঁষা, তাতে ঐকটা দিন ও এড়িয়ে চলবেনা কিটসনকে। তাছাড়া জিনি নিখুঁত অভিনয় করতে ভালবাসে।

সুতরাং জিনির সঙ্গলাভ তার মনের আশঙ্কাকে একেবারে মুছে দিলো। নাঃ, জিনির সঙ্গলাভের সুযোগ সে ছাড়তে পারবে না।

ব্লেক লিংকনে কিটসনের পাশাপাশি বসেছিল। হঠাৎবললো, শোনো আলেক্স, তোমাকে আগে থাকতেই জানিয়ে রাখা ভাল–জিনিকে নিয়ে যেন বেশি স্বপ্ন দেখোনা। ওর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ বোঝাপড়া হয়ে গেছে। এই কাজের ঝামেলা মিটে গেলে আমরা দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়বো–ঘুরে আসবো প্যারিস, লন্ডন–নানান দেশ। তাই তোমাকে আগেই বলে রাখলাম।

কিটসন আরেকটু হলেই একটা ট্রাকের গায়ে ধাক্কা মারছিলো। চৌমাথায় লাল আলোর সংকেত দেখে সে গাড়ি থামালো। সে আগুন ঝরা চোখে ব্লেকের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে গর্জে উঠলো–তুমি মিথ্যে কথা বলছো! তোমার মতো একটা গাড়োলের সঙ্গে জিনি কখনো কোথাও যাবে না। অতএব, ফালতু তাপ্পি দিয়ে লাভ নেই।

তার টোপ ফেলা সফল হয়েছে জেনে ব্লেক হেসে উঠলো–তাই নাকি? তাহলে ঐখানেই তুমি ভুলটা করেছে, জ্ঞানদা সুন্দরী। জ্ঞান দানের অভ্যেসটা তোমার সাধারণ বুদ্ধিকে ভোতা করে দিয়েছে। আমার সঙ্গে না যাওয়ার কোনো কারণ আছে কি? তবু আমি কিছু লেখাপড়া জানি, তোমার তোক অক্ষর গো মাংস। আর…তাছাড়া ঐ পেটেন্ট নাক নিয়ে তুমি জিনির সঙ্গে প্যারিসে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখোজঁ!

ব্লেকের তাচ্ছিল্যের হাসিতে কিটসন উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, নামো বলছি। নইলে এক

ব্লেকের জিভে হঠাৎ জেগে উঠলো ক্ষুরের ধার তোমার জায়গায় আমি হলে মোটেও সে চেষ্টা। করতাম না, সেদিন আচমকা ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় আমি ঠিক প্রস্তুত হতে পারি নি। কিন্তু আলেক্স, সে চেষ্টা এখন কোরো না–একটি ঘুষিতে তোমার দাঁত কটা উপড়ে ফেলে দেবো।

বিদ্যুৎগতিতে কিটসন পাশ ফিরলো…কিন্তু সেই মুহূর্তেই পেছন থেকে ভেসে এলো অধৈর্য হর্নের শব্দ। সামনে চেয়ে দেখে লাল আলো সবুজে পরিণত হয়েছে। কিটসন সম্বিত ফিরে পেলে লিংকন আবার চলতে লাগলো।

ব্লেক কিটসনকে রাগাতে পেরে খুশী হলো। হ্যাঁ–যা বলছিলাম…সেদিন জিনির সঙ্গে গল্প করছিলাম, তা কথায় কথায় প্যারিসের গল্প উঠলো। তুমি তো জানো আমি বছর দুয়েক আগে প্যারিসে গিয়েছিলাম। জিনি বললো, ওর প্যারিসে যাবার খুব শখ। তখন–

দয়া করে চুপ করো। নইলে গাড়ি থামিয়ে তোমাকে চুপ করাতে হবে দেখছি!

 ঠিক আছে, ঠিক আছে–তোমাকে শুধুমনে করিয়ে দিতে চাইছি, যে জিনির ওপর প্রথম দাবিটা আমার। তুমি তো আবার ওর স্বামীর অভিনয় করছে। সুতরাং তখন যদি এ কথাটা ভুলে যাও তাহলে গণ্ডগোলের আশঙ্কা আছে।

একটা বিরাট গাড়ি রাখবার জায়গার কাছে এসে হঠাৎই যেন কিটসন মুষড়ে পড়লো। জিনির মতো মেয়ের পক্ষে ব্লেকের মতো বদমাইশ লোকের ফাঁদে পা দেওয়া সহজ। তার ওপর ব্লেক হয়তো প্যারিসের ব্যাপারটা বানিয়ে বলছেনা। এই আকস্মিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়ে কিটসন যেন হোঁচট খেলো।

কিটসন ব্লেকের সঙ্গে মুখোমুখি দ্বৈরথে নিজের জয় সম্পর্কেও তেমন স্থির নিশ্চিত নয়। প্রথমতঃ ব্লেক তার চেয়ে ওজনে চোদ্দ পাউন্ড বেশি এবং তার স্বাস্থ্যও খারাপ নয়। একবার এক ঘরোয়া মারপিটের সময় ব্লেকের লড়াই কিটসন দেখেছিলো। ওর লড়াইয়ের স্বচ্ছন্দ ভঙ্গী কিটসনকে অবাক করেছিলো। প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানোর জন্য যে কোনো কুটিল উপায় অবলম্বন করতে সে দ্বিধা করে না। উপরন্তু তার নৃশংস, নিষ্ঠুর লড়াইয়ের পদ্ধতি তো আছেই।

গাড়ি রাখার জায়গায় কাছে ওরা থেমে দেখলো, গাড়ি পাহারা দেবার কোনো লোকই সেখানে নেই। লম্বা লম্বা দুটো সারিতে গাড়িগুলো পর পর দাঁড়িয়ে আছে।

ব্লেক গাড়ি থেকে নেমে তুমি ও পাশের সারিটা দেখতে থাকো, আমি এ পাশেরটা দেখছি। যদি পছন্দমত মালের সন্ধান পাও, শিস দিয়ে জানাবে।

গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে দুজনে আলাদাভাবে এগিয়ে চললো। কিটসনের চোখ গাড়ির ওপর নিবদ্ধ হলেও মনে বিক্ষুব্ধ ঝঞ্জাট।

ব্লেকের কথা মিথ্যে ভাবলেও কিটসনের মনে কোথায় যেন একটা অস্বস্তির কাটা খোঁচাতে লাগলো। সত্যিই কি জিনি ব্লেকের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে? বু ভালো, সে যে অন্ততঃ দু তিনটে দিন ওর সঙ্গে একান্তে কাটাতে পারবে–এবং তখনই সে একবার শেষ চেষ্টা করবে। জিনি যদিও বড় কঠিন, তবুও হাল ছাড়তে সে রাজি নয়। মাঝে মাঝে জিনির নির্বিকার, অচঞ্চল অভিব্যক্তি তাকে সন্দেহ গ্রত করে তুলেছে। জিনির মন জয় করা আদৌ কোনো পুরুষের পক্ষে কি সম্ভব?

কিটসন একটা এম. জি. স্পোর্টস কারের সামনে এসে থমকালো। একটা ক্যাডিলাক এবং জাগুয়ারের ফাঁকে ছোট্ট গাড়িটা দাঁড় করানো।

এইরকম একটা গাড়িই তাদের প্রয়োজন। কিটসন আড়চোখে এপাশ ওপাশ দেখে সতর্কভাবে গাড়িটার কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।

একটা ছোট টর্চ ছিলো কিটসনের। সেটা জ্বালিয়ে সে গাড়িটা ভালো করে পরীক্ষা করলো। একটু খুঁজতেই গাড়ির চাবিটা পেয়ে গেলো। সুতরাং শিস দিয়ে সে ইশারা করে ব্লেককে ডাকলো। কিটসনের ডাকে ব্লেক এলো।

কিটসন বললো, মনে হচ্ছে এই গাড়িটায় কাজ হবে। এই যে গাড়ির চাবি।

ব্লেক গাড়িটা দেখে ঘাড় নাড়লল, , চলবে। তা তুমি দেখছি দিনকে দিন সেয়ানা হচ্ছে, ব্যাপারটা কি? যাও–তাহলে গাড়িটা জিপোর কারখানায় পৌঁছে দাও। কারণ প্রথমতঃ তুমি গাড়ি চালানোয় দিগগজ, তার ওপর খুব একটা ভারী কাজের দায়িত্ব তোমার ওপর পড়েনি। সুতরাং এই যৎকিঞ্চিৎ ঝুঁকির কাজটুকু তোমাকে করতেই হবে। তারপরে না হয় জিনির সঙ্গে ঢলাঢলি কোরো।

কিটসনের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো। কোনোরকম ভাল মন্দ না ভেবেই ব্লেকের মুখে এক ঘুষি চালালো।

ব্লেক আগে থেকেই এর জন্য প্রস্তুত ছিলো। পলকের মধ্যে সে মাথা হেলালো বাঁ দিকে। কিটসনের ঘুষি লক্ষ্যহীন অবস্থায় তার কাধ ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো। কিটসন ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ব্লেকের ডানহাতি জোরালো ঘুষি আলেক্সের তলপেটে আছড়ে পড়লো। ব্লেক ইচ্ছে করেই সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘুষি মারলো কিছুটা প্রতিহিংসাবশতঃ কিছুটা আত্মরক্ষার প্রয়োজন। সংঘর্ষের আকস্মিকতায় কিটসন মুহূর্তের জন্যে পঙ্গু হয়ে পড়লো। সে প্রচণ্ড ব্যথায় হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো।

কিটসন বহুদিন যাবৎ মুষ্টিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় কিছুটা ধীরগতি হয়ে পড়েছে। শরীরের পেশী শ্লথ হয়ে পড়েছে। তাই ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগলো।

নৃশংস হাসিতে ব্লেক–এক মাঘে শীত যায় না চাঁদু। তাই আজ সুদে আসলে তোমার সেদিনকার বেইজ্জতি ওয়াপস করলাম। এরপর আর বেশি পায়তারা করলে নিজেই বিপদে পড়বে। যাও, চটপট গাড়িটা নিয়ে কেটে পড়ো। জিপো হয়তো অপেক্ষা করছে।

কথাটা শেষ করেই ব্লেক লিংকন চালালো। কিটসন তখনও একইভাবে বসে তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট ফুসফুসে হাওয়া টানার চেষ্টা করছে।

অবশেষে সে কোনরকমে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। টলায়মান পদক্ষেপে সে এম. জি স্পোর্টস কারে গিয়ে উঠলো। পরাজয়ের গ্লানি তার সারা শরীরে একটা বিজাতীয় রাগ ছড়িয়ে দিয়েছে। ইঞ্জিন চালু করে কিটসন বেরিয়ে পড়লো।

ব্লেকের চড় খেয়েছে বলতে গেলে গাল বাড়িয়ে–কিটসন নিজেকে ধিক্কার দিলো। তবে পরের বার আর সে সুযোগ দিচ্ছে না। লড়াই করার শখ চিরকালের জন্য মিটিয়ে দেবে।

কিটসন জিপোর কারখানা অভিমুখে গাড়ি ছুটিয়ে চলল।

দিনের পর দিন ব্লেক তাকে উপহাস করে এসেছে কিন্তু কিটসন জবাব দেয়নি।

কিটসন যখন এলোমেলোভাবে ভাবতে ভাবতে জিপোর কারখানার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন দলপতি ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যান তার বুইক নিয়ে নিজের ডেরায় ফিরে চলেছে।

আসল কাজের ভাবনায় মরগ্যান মগ্ন। এই কাজটাকে সে অন্য তিনজনের চেয়েও গভীরভাবে নিয়েছে–যেন এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তার জীবন–মরণের প্রশ্ন। অবশ্য কথাটা মিথ্যে নয়। তাই মরগ্যান তাদের পরিকল্পনাকে বারবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করে দেখেছে। বড় রাস্তায় গাড়ির সমুদ্রে গা ভাসিয়ে সে ভাবলো–এই আমাদের জীবনের শেষ কাজ।

অনেকক্ষণ বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু রাস্তায় এখনো জলের আস্তরণ। বুইকের হেডলাইটের আলো ভিজে রাস্তাকে যেন আয়না করে তুলেছে। সতর্ক হাতে গাড়ি ছুটিয়ে চললো মরগ্যান।

ঐ দশ লাখ ডলার হাতে পাওয়ামাত্রই তারা পাঁচজন যার যার ভাগের টাকা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরবে। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা মরগ্যান আগেই করে রেখেছে। এই মুহূর্তে তার পকেটে মেক্সিকো যাওয়ার টিকিট রয়েছে। এই টিকিটের বিশেষত্ব হলো যে কোনোদিন, যে কোনো সময়ে, যে কোনো প্লেনে মরগ্যান মেক্সিকো যেতে পারবে। সেজন্য কিছু বেশি টাকা লেগেছে। মেক্সিকোর এক আধা গ্রাম, আধা শহরে সে একটা ভল্ট ভাড়া করে রেখেছে। তাতেই সে লুঠের টাকা রাখবে, তারপর শুরু হবে প্রতীক্ষা। যখন মরগ্যান বুঝবে ট্রাক লুঠের চাঞ্চল্য কমে এসেছে তখন দু লক্ষ ডলার দিয়ে ধীরে ধীরে বন্ড কিনবে। সমস্ত টাকা যখন তমসুকে পরিণত হবে, তখন তাকে আর দেখে কে? এই পৃথিবীটাকে সে শুধু যে হাতের মুঠোয় পাবে তা নয়, পৃথিবী তখন থাকবে তার পায়ের তলায়।

মরগ্যান ভালোভাবেই জানে, এ কাজে সাফল্য ও অসাফল্যের সম্ভাবনা সমান–সমান–অর্থাৎ পঞ্চাশ–পঞ্চাশ।

মরগ্যানের চিন্তাধারা জিনির দিকে বাঁক নিলো। মেয়েটা তার সঙ্গে এক হয়ে মাথা খাটাচ্ছে ঠিক। কিন্তু একই সঙ্গে ও মরগ্যানের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জিনি ট্রাকটাকে ফাঁদে ফেলা থেকে শুরু করে লুঠ করা পর্যন্ত যে পরিকল্পনা দাখিল করেছে তা অপূর্ব। কিন্তু জিনিরই যে সে মতলবটা, সেটা মরগ্যান কিছুতেই মানতে রাজি নয়। তাহলে, জিনির পেছনে কেউ কি আছে? নাকি কাউকে বৈঠকী চাল দিচ্ছে মেয়েটা?

মরগ্যান অবান্তর ভাবনাকে সরিয়ে রাখলো। কারণ পরিপাটি করা মতলবটা জিনিই তার হাতে তুলে দিয়েছে। তাতে মরগ্যান য়ে লাভবান হয় নি তা নয়। তাছাড়া এই কাজের সবচেয়ে কঠিন অংশের দায়িত্ব জিনি নিজে নিয়েছে। সুতরাং ওকে সন্দেহ করে লাভ কি?

মরগ্যান জিনিকে মন থেকে সরিয়ে, চিন্তিত মুখে আরো একবার পরিকল্পনার ছকে মন দিলো…

.

০৬.

 জিপোর ঘুম ভাঙলো শুক্রবার ভোর ছটায়। গতরাতে সে ভালোভাবে ঘুমোতে পারে নি। সম্ভবতঃ অসহ্য মানসিক উৎকণ্ঠাই এই অনিদ্রার কারণ। সে বিছানা ছেড়ে ভোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। দূরে ধূসর পাহাড়ের অন্তরাল থেকে ক্রমশঃ ভোরের সূর্য আত্মপ্রকাশ করছে।

দু ঘণ্টার মধ্যেই সেই কাজ শুরু হবে–যা নিয়ে একদিন তারা সর্বক্ষণ মাথা ঘামিয়েছে, আলোচনা করেছে–আজ থেকেই শুরু হবে পৃথিবীর চতুরতম এবং কঠিনতম তালার সঙ্গে জিপোর বুদ্ধি ও দক্ষতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জিপে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলো। যদি সে পরাজিত হয়, তাহলে? মরগ্যানের ক্রোধোন্মত্ত রূপের কথা মনে পড়ায় সে শিউরে উঠলো।

উত্তেজিত স্নায়ুমণ্ডলীকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে একটা টিনের গামলার দিকে এগিয়ে গেলো। গামলা থেকে ঠাণ্ডা জল নিয়ে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো। তারপর দাড়ি কামাতে গিয়েই সে বুঝলো তার হাত বাঁশপাতার মতো থরথর করে কাঁপছে। গালে দু–এক জায়গায় রক্তও বেরিয়ে পড়লো। ট্রাকের সময়–নির্ভর তালা খোলার সময় তাকে ভীষণ সতর্ক হতে হবে।

কম্বিনেশন চক্রটাকে ঘোরাতে হবে এক চুল, এক চুল করে। কারণ কখন যে নম্বর মিলবে কেউ বলতে পারে না। সেই সময় যদি এভাবে তার হাত কাঁপে, তাহলে তো বিপদের কথা।

জিপো গভীর শ্বাস নিলো। নাঃ, এই উৎকণ্ঠা, উত্তেজনাকে যে করে হোক রুখতেই হবে। বরাবর সে তার অচঞ্চল, স্থির, দক্ষ হাতের জন্য গর্ব অনুভব করেছে। কিন্তু আজ তার শিল্পীসুলভ আঙুল, আস্থা এবং আশ্বসময় হাত–সব কি ম্যালেরিয়ার শিকার হয়েছে? আসল কাজের আগে থেকেই সে যদি সাহস হারিয়ে ফেলে তবে তো পরাজয় সুনিশ্চিত।

জিপো দেয়ালে ঝোলানো কাঠের ক্রশটার দিকে ফিরে তাকালো। এই সুন্দর কাজ করা জিনিসটা তাকে তার মা দেশ ছাড়ার সময়ে দিয়েছিলো। হঠাৎই তার মনে হলো, এই মুহূর্তে তার প্রার্থনা করা একান্ত প্রয়োজন।

কিন্তু হাঁটু গেড়ে ক্রশের নীচে বসে, বুকে ক্রশচিহ্ন এঁকে সে যখন প্রার্থনার জন্য প্রস্তুত হলো তখন সবিস্ময়ে দেখলো তার প্রার্থনার একটি শব্দও মনে নেই। জিপো উপলব্ধি করলো, এ কাজে ঈশ্বরের সাহায্য চাইবার ক্ষমতা তার নেই। জিপো অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে একই কথা বলল, ক্ষমা করো, আমাকে ক্ষমা করো।

কিটসন বিছানা ছেড়ে উঠে কফি গরম করছিলো। একটা শীতল আতঙ্কের নাগপাশ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

গতরাতে তার শুধু উসখুস করেই সময় কেটেছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, পিছিয়ে আসার আর সময় নেই। ঠিক আটটার সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী একের পর এক কাজ শুরু হবে। নিয়তির লিখন স্পষ্ট অক্ষরে তার ললাটে আঁকা হয়ে গেছে। শুধু যদি জিনি না থাকতো, তাহলে কিটসন কিছুতেই এ কাজে সায় দিতো না। এতক্ষণে সে দূরে বহুদূরে চলে যেতো–যেখানে মরগ্যান তার খোঁজ পাবে না। কিন্তু…

সে হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে, এ কাজে তারা বিফল হবেই হবে। কিন্তু জিনির আকর্ষণ অপরিণত ভালোবাসার নেশা তাকে রাজি করতে বাধ্য করেছে।

কফি চুমুক দিতে গিয়েই তার গা গুলিয়ে উঠলো। কাপটা সে বেসিনের ওপর উপুড় করে দিলো!

অন্য এক রাস্তার অন্য এক ঘরে জানালার কাছে মরগ্যান। ঠোঁটে একটা সিগারেট, চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ রক্তিম আকাশে। গত রাতের চরম প্রস্তুতির কথাই তার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যান যেন কোনো যুদ্ধে সেনাপতির ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে। তাই আক্রমণ পরিকল্পনার প্রতিটি অংশ সে কষ্টিপাথরে ঘষে যাচাই করছে, কোথাও গলদ আছে কিনা। এখন নিয়তিকে মেনে নিতে মরগ্যান প্রস্তুত–তাতে যদি পরাজয় আসে তবুও তার দুঃখ নেই। কারণ সে জানে তার তরফ থেকে কোন ভুল নেই, এর চেয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

এখন সাফল্য অসাফল্য পুরোপুরি নির্ভর করছে নিজেদের দক্ষতার ওপর। জিনি যদি হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়, ব্লেক যদি ঠিকমতো গুলি চালাতে না পারে। কিটসন তার গাড়ি ও ক্যারাভ্যান নিয়ে যদি বিপদে পড়ে অথবা যদি জিপো তালা খুলতে সক্ষম না হয়…কিছুই করার নেই। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে মরগ্যান স্থির নিশ্চিত। মাথা নীচু করে স্থির অনড় হাতের দিকে দেখলো। নিজের স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতায় সে সন্তুষ্ট হলো। না, কোনরকম ভুলকে সে অন্ততঃ প্রশ্রয় দেবে না :

ব্লেক শহরের অন্যপ্রান্তে নিজের ফ্ল্যাটে তখনও শুয়ে। চিত হয়ে শুয়ে সে দেওয়ালের একটুকরো রোদের দিকে তাকিয়ে। সে জানে, যখন ঐ আলোর টুকরোটা ঘরের ছাদ স্পর্শ করবে তখনই তার বিছানা ছাড়ার সময় হবে।

কাল রাতে গ্লোরিকে ডেকে পাঠাতে খুব ইচ্ছে করাছলো কিন্তু তাতে বিপদের সম্ভাবনা জেনে সে ইচ্ছে ত্যাগ করেছে। তার দরকারী জিনিসপত্র সব গোছানো হয়ে গেছে।

ব্লেক ভাবলো, আচ্ছা ডার্কসনকে খুন করার পর তার কি রকম লাগবে? কারণ অপরাধ জীবনে সেটাই হবে তার চরম পদক্ষেপ। এর আগে কোনদিন সে খুন করে নি। বরাবরই লুঠপাটের মতলবগুলো এমন ভাবে হয়েছে যাতে হতাহত না হয়। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।

না, ডার্কসনকে খুন করাটাকে ব্লেক তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেনা। কারণ যা বাস্তব, তা স্বীকার করতেই হবে। কাজেই সাফল্যের প্রয়োজনে ডাকসনের মৃত্যুর প্রয়োজন আছে। তাকে না মারলে গোটা পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে। কিন্তু তবুও ব্লেকের চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দৃশ্য–ডাকসনের কপালের লাল ফুটোটার দিকে। সে জানে তার হাত কাঁপবেনা খুন করতে, তবু শিউরে উঠলো। জেলে থাকতে অনেক খুনীর সঙ্গেই তার আলাপ হয়েছে। তারা গর্বসহকারে নিজেদের পাপের কাহিনী বললেও একটা অস্বস্তি আতঙ্কের ছায়া ব্লেক দেখতে পেয়েছে। কোথায় যেন ওদের ঘিরে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য কাঁচের দেওয়াল। তাদের চোখের যে অভিব্যক্তি, তা একবারেই আলাদা। এই কি তাহলে খুনীর চোখ? ডার্কসনকে খুন করার পর তার চোখেও কি ফুটে উঠবে একই দৃষ্টি? আমৃত্যু তাকে আতঙ্কের শিকার হয়ে কাটাতে হবে?

না, এ ঘটনার পর ব্লেক আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবেনা। দরজায় কড়া নাড়ার আকস্মিক শব্দেও তাকে চমকে উঠতে হবে। কোনো পুলিশি পোষাক তার মনে তুলবে শঙ্কার আলোড়ন। রাতের ঘুম হবে দুঃস্বপ্ন কণ্টকিত।

রোদের টুকরোটা ঘরের ছাদ স্পর্শ করতেই গায়ের চাদরটা ছুঁড়ে ব্লেক উঠে পড়লো।

খাট থেকে নেমে একটা স্কচের বোতলের দিকে এগিয়ে গেলোবোতলে তখনো কিছুটা তরল অবশিষ্ট। ব্লেক বোতলটা উপুড় করে গলায় ঢাললো।

তারপর সে কলঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ঝাঁঝরিটা খুলে ঝর্ণার নীচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

শহরের অপর প্রান্তে, ওপর তলায় একটা অপরিষ্কার ছোট ঘরে জিনি গর্ডন কাজে ব্যস্ত। নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করে স্যুটকেসের ঢাকনা বন্ধ করতে করতে হাত ঘড়িতে দেখলো–সাতটা বাজতে কুড়ি।

জিনি ভাবলো জিপোর কারখানায় রওনা হতে এখনও তার আধঘণ্টার ওপর সময় আছে–জানালার কাছে গিয়ে বসলো। দেখতে লাগলো বাইরের নোংরা, অপরিসর রাস্তা–তার দুধারের জঞ্জাল। এ সবই তার বাসস্থানের পারিপার্শ্বিক। সুতরাং নোংরা হলেও কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে।

ভাগ্য যদি সহায় থাকে তবে আর কয়েকদিনের মধ্যেই এই দুঃখকষ্টের জীবনের অবসান হবে। নতুন করে জীবনের পথে পা বাড়াতে পারবে। তখন ওর কাছে থাকবে অজস্র টাকা। ও যেতে পারবে ওর স্বপ্ন নগরী নু–ইয়র্কে। দামী দামী সব পোষাক কিনবে। প্রকাণ্ড বাড়ি কিনে সে রানীর হালে থাকবে। এতদিনের স্বপ্ন তার বাস্তবে রূপ নেবে।

যদি ভাগ্য সহায় থাকে… ।

কিন্তু মরগ্যানের ওপর জিনির যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। মরগ্যানের ধারণা অনেকটা তারই মতো। মরগ্যানের একটা কথা ওর ভীষণ ভালো লেগেছে। হাতের মুঠোয় পৃথিবী এই তিনটি শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জিনির স্বপ্নের আসল রূপ। ওর ইচ্ছেকে এর চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা আর কেউ করতে পারতো কিনা কে জানে। আর সে ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দিতে চাই প্রচুর টাকা।

নাঃ। ট্রাক লুঠ করা যদি কারো পক্ষে সম্ভব হয়, তবে নিঃসন্দেহে সে লোক মরগ্যান।

 কিন্তু ঐ তিনজন… ।

সংশয়ের ছায়া নেমে এলো জিনির মুখে।

কাজের মূল চাবিকাঠিই জিপোর ওপর নির্ভর করছে। আর সে যেভাবে অল্পেতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাতে জিনির ভয় হয়। জিপো পারবে তো ট্রাকের তালাটা খুলতে? কিন্তু এখন জিপোর জন্য মরগ্যানের ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই।

জিনির ভাবনা কিটসনকে নিয়েও। তার চোখের দৃষ্টি মোটই ভালো লাগে না। আর যেভাবে সর্বক্ষণ ছোঁক ছোঁক করে। নাঃ, ফন হ্রদে গিয়ে কে সতর্ক থাকতে হবে–কোনমতেই যেন ঐ লোকটার সঙ্গে তাকে একা থাকতে না হয়।

জিনির কপালে ভাঁজ পড়লো কিটসনের কথা মনে পড়তেই। ছেলেটা তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। জিনির যুক্তি নির্ভর, আঙ্কিক মনের শীতলতা বুঝি কিটসনের চিন্তার উষ্ণতায় কমে এলো। মার্লো যাওয়ার পথে তাকে খুশীকরার জন্য ছেলেটার আপ্রাণ প্রয়াসের কথা মনে পড়ে মুখে ফুটলো মিষ্টি হাসি।

জিনির হাতে টাকা আসামাত্রই নেকড়ের দল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। টাকাগুলো ছিনিয়ে নিতে চাইবে। তাই ও ভাবছে, কাজের শেষে কিটসনের সঙ্গে যোগ দিলে কেমন হয়? ওদের দুজনের মিলিয়ে মোট চার লাখ ডলার হবে। তাছাড়া কিটসনের স্বভাব ভালোই। অনায়াসে জিনি ওর ওপর নির্ভর করতে পারে। সবদিক থেকেই ও নিশ্চিন্ত হতে পারবে। নইলে লোকে সন্দেহ করবে। একটা বিশ বছরের ছুড়ি এতো টাকা পেলো কোত্থেকে।

নাঃ, এ ব্যাপারটা নিয়ে জিনিকে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে।

 সবার আগে মরগ্যানই এসে পৌঁছলো।

সে যখন জিপোর কারখানার সামনে বুইক থামালো তখন ড্যাশ বোর্ডের ঘড়িতে আটটা বাজতে দশ মিনিট।

গতরাতে সে, ব্লেক ও জিপো–তিনজনে বুইক গাড়িটার ওপর প্রচুর খেটেছে। বার বার দেখেছে কতোটা ধকল গাড়িটা সইতে পারে। মরগ্যান গাড়িটাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তার ফ্ল্যাটে–চালিয়ে দেখেছে গাড়িটার অবস্থা।

মরগ্যান কারখানায় ঢুকতেই দেখলো, জিপো ক্যারাভ্যানের কাবার্ডে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়াকরছে। জিপোর মুখমণ্ডল বিবর্ণ। শ্বাস–প্রশ্বাস হাঁপানী রুগীর মতো যন্ত্রণা ক্লিষ্ট। যন্ত্রপাতি ধরা হাতদুটো কাঁপছে।

মরগ্যান ভাবলো প্রথম প্রথম তো, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তা যদি না হয় তাহলে বিপদের সম্ভাবনা প্রচুর।

জিপো তো জিপো, এই মুহূর্তে মরগ্যান নিজেও কি সুস্থির থাকতে পারছে। পরিকল্পনার প্রথম পর্বে পৌঁছে সে নিজেও হয়েছে উৎকণ্ঠা কবলিত–জিভ শুকনো, বিস্বাদ। সুতরাং জিপো যে একটু বিচলিত হবে, তাতে আশ্চর্যের আর কি আছে!

কিন্তু জিপোর এই অনিশ্চিত ভাবটা কাটিয়ে ওঠা একান্ত প্রয়োজন। নইলে এই সামান্য দুর্বলতা থেকে রূপ নেবে বিরাট ফাটল–সেটা মরগ্যান কিছুতেই হতে দেবে না।

মরগ্যান এগিয়ে বললো, এই যে, জিপো, –ঠিক আছো তো?

মরগ্যানের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে জিপো বললো। হা, হা, ঠিক আছি। মনে হচ্ছে আজ আর বৃষ্টি হবে না। ইঃ, প্যাঁচপেচে বর্ষার চেয়ে রোদ্দুর অনেক ভালো।

এমন সময় একটা স্যুটকেস ও একটা পিকনিক বাস্কেট নিয়ে জিনি এলো। ওকে দেখে মনে হলো, গত রাতে ওর ভালো ঘুম হয় নি। ওর চোখের কোনে কালি, মুখে বিবর্ণতা।

মরগ্যান হালকা সুরে বললো। কি খবর, জিনি? ভয় করছে না কি?

ও মরগ্যানের দিকে তাকিয়ে, তোমার মতোই তার বেশি নয়।

 মরগ্যান হাসলো, তাহলে তো ভয় করছে বলতে হয়। কারণ আমিও যে একেবারে নিশ্চিন্ত তা নই।

এবার কিটসন কারখানায় উপস্থিত হলো–তার পেছনে ব্লেক।

মরগ্যান ব্লেককে দেখেই বুঝল, ও নেশা করেছে। ব্লেকের মুখে লালচে আভা, চলাফেরার মধ্যে কেমন যেন একটা আলস্য অবসাদ। মরগ্যানের মনে অস্বস্তি হলো।

কিটসনকে কিছুটা নার্ভাস মনে হলেও জিপো বা ব্লেকের তুলনায় আজ সে নিজের ওপর অনেক বেশি আস্থাশীল। মরগ্যানকে এই ব্যাপারটাই অবাক করলো।

আটটা বাজতে দু মিনিট বাকি। সুতরাং শুধু শুধু মরগ্যান আর সময় নষ্ট করতে চাইলো না। সে বললো, ঠিক আছে, তাহলে এবার বেরোবার জন্যে প্রস্তুত হও। তোমরা তিনজন ক্যারাভ্যানটাকে বাইরে বের করো। আর জিনি, তুমি এম. জি টা নিয়ে সোজা এজেন্সিতে চলে যাও।

মরগ্যান জিনিকে অনুসরণ করে ছোট এম. জি. গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো।

চালকের আসনে জিনি উঠে বসলো। মরগ্যান ওর ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালো। তুমি তো জানোই কি করতে হবে। দেখো, যেন কোনো ভুল না হয়। গুড লাক।

জিনির কাছে কিটসন গিয়ে বললো, গাড়ি চালাবার সময় সাবধানে থেকো। এম. জি. টা দারুণ জোরে ছোটে। গুড লাক।

জিনি কিটসনের চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়লো, ধন্যবাদ! তুমিও সাবধানে থেকো। ক্লাচ টিপে, গীয়ার দিয়ে এম. জি. টা ছুটলো।

মিনিট পাঁচেক পরে ক্যারাভ্যানটাকে সঙ্গী করে বুইকটা আস্তে আস্তে কারখানা ছেড়ে বেরোলো।

মরগ্যান ও ব্লেক ক্যারাভ্যানের মেঝেতে বসে–আর গাড়ির চালক কিটসন।

জিপো বাইরে এসে কারখানার দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর তালার ওপরে ঝুলিয়ে দিলে একটা কাঠের ফলক। তাতে লেখা : গরমের ছুটিতে কারখানা বন্ধ থাকবে।

জিপোর কেন জানিনা মনে হলো, তার এই সাধের জীর্ণ কারখানাকে সে কোনোদিনই দেখতে পাবে না। এই কারখানা থেকে তার খুব একটা লাভ হয় নি ঠিকই। কিন্তু পনেরো বছর এটাকে সুখদুঃখের সঙ্গী করার ফলে আজ কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। ক্যারাভ্যানে ওঠার সময়ে জিপোর দৃঢ়তার প্রতিরোধ ভেঙে তার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো। একজন ভাবপ্রবণ ইটালিয়ানের মতোই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

ন্যাকামো? আবার কি হলো? ব্লেক খেঁকিয়ে উঠলো।

কি হলো ছিচকাঁদুনির?

এড থামো। দাঁত খিঁচিয়ে উঠলো মরগ্যান। সরে জায়গা করে দিলো জিপো। তার বিপজ্জনক শীতল দৃষ্টি ব্লেকের মুখে যেন জ্বালা ধরিয়ে দিলো–সে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মরগ্যান জিপোর পাঁজরে খোঁচা মারলো, জিপো, কারখানার জন্য কাঁদছো? তোমার হাতে আসবে নিজের বাংলো জমিজমা গাড়ি কতো কি? ভেবে দেখো তো, মেয়েরা তোমার চারিদিকে কেমন ভিড় করবে! তোমার পকেট দু লাখ ডলারে ঠাসা।

ঘাড় নাড়লো জিপো, বিষণ্ণমুখে হাসির রেখা।

তাই যেন হয়। সত্যি সত্যিই পারবো তো, ফ্র্যাঙ্ক?

নিশ্চয়ই। সে ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও। প্রত্যেক কাজে আমার নির্দেশে চলেছে–তাতে বিপদ হয়েছে কি?

কিটসন জোরেই গাড়ি চালাচ্ছিলো, কিন্তু ক্যারাভ্যানের চাকায় প্রিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় এবড়ো–খেবড়ো রাস্তায় দোলানির পরিণাম হয়ে উঠলো সাংঘাতিক।

একটা পথ নির্দেশ ও একটা হাতুড়ি দিয়ে রাস্তার মুখেই জিপোকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ক্যারাভ্যানটাকে নিয়ে বুইকটা রাস্তায় ঢুকে পড়তেই চাপা স্বরে ব্লেক, শালা, একেবারে অপদার্থ। যদি ঐ ট্রাকের তালা হারামজাদাটা না ভাঙতে পারে, তবে আমিই ওকে ভেঙ্গে তক্তা বানিয়ে দেবো।

মরগ্যানের স্বর যেন বরফে ডোবানো। জিপোর চিন্তা ছেড়ে এবার এদিকে মন দাও। তোমার কাজটুকু ঠিকমতো করে তারপর বোতলের কথা ভাবা যাবে।

গাড়ির গতি আস্তে আস্তে কমে একসময়ে ক্যারাভ্যানটা থামলো। পেছনের দরজাটা কিটসন খুললো।

বিপজ্জনক বাঁকের কাছে ওরা এসে দাঁড়িয়েছে।

ব্লেক ও মরগ্যান রাস্তায় নেমে পড়লো। ব্লেকের হাতে রাইফেল। মরগ্যানের হাতে ৪৫। ওরা কয়েক সেকেন্ড থমকেরইলো। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যেরপঅনুভবকরলো ওরা।

কিটসনকে বললো মরগ্যান, তোমার কাজ তুমি জানো। অতএববাঁশীরসংকেতের জন্য প্রস্তুত থেকো। একমুহূর্তও যেন দেরী হয় না আসতে।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে কিটসন প্রথমে ব্লেকের দিকে তারপর মরগ্যানের দিকে, গুড লাক।

বিদ্রূপ মাখানো স্বরে ব্লেক বললো, শালা এমনভাবে বলছে যেন ভাগ্য টাগ্যর ব্যাপারটা ওর দরকারই নেই। তোমারও বেশ খানিকটা ভাগ্যের দরকার, আলেক্স! শুধু শুধু আমাদের জন্য তুমি দুঃখ করছো।

কিটসন কাঁধ ঝাঁকালো, গীয়ার দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চললো। হঠাৎ মরগ্যানের মনে পড়লো ক্যারাভ্যান থেকে শাবল দুটো নামাতে ওরা ভুলে গেছে।

মরগ্যান হেঁড়ে গলায় চিৎকার করলো। এই! এই! আলেক্স–থামো।

 গাড়ি থামিয়ে কিটসন জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো, কি ব্যাপার?

প্রত্যেকটা জিনিসই কি আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে, এড? ওঃ, গাধার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছো কি? যাও, শাবল দুটো গাড়ি থেকে নামাও।

গাড়ি থেকে নেমে কিটসন ক্যারাভ্যানের দরজাটা খুললো। শাবল দুটো ব্লেকের হাতে তুলে দিলো। মরগ্যানের চোখ জোড়া রাগে জ্বলছে। সে কিটসনকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। বুইক ও ক্যারাভ্যানটা চলতে শুরু করলেই মরগ্যান রাস্তার ধার রেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। ব্লেক তাকে অনুসরণ করলো।

মরগ্যান এই জায়গাটা এতোবার ঘুরে দেখেছে যে এর প্রতিটি ঝোঁপঝাড় তার নখদর্পণে। ব্লেকের হাত থেকে একটা শাবল নিয়ে মরগ্যান ওকে লুকোবার জায়গায় দেখিয়ে দিলো। ব্লেকের থেকে গজ ছয়েক দূরে সে তার লুকোবার জায়গা বেছে নিলো।

  ওরা দুজনেই রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে প্রতীক্ষায় রইলো।

নাঃ, লুকোবার জায়গাটা ভালই হয়েছে–ভাবলো ব্লেক। রাইফেলটা রাস্তার দিকে তাক করলো সে। না, রাইফেলের নিশানার বাধাই পড়ছে না; তাছাড়া কারো পক্ষে দেখে ফেলা সম্ভব নয়। ব্লেকের অস্বস্তি কমে এলো কিন্তু এক চুমুক স্কচের অভাবে ফুসফুসটা আনচান করতে লাগলো। ফ্ল্যাট ছাড়ার আগে স্কচ যেটুকু খেয়েছে তার আমেজটা এখন যাই–যাই করছে। বেলা বেশি না। হলেও সূর্যের তাপ প্রচণ্ড।

কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? মরগ্যান আড়াল থেকেই প্রশ্ন করলো।

নাঃ, দারুণ আছি! রাইফেল ঠিক করতে করতে বলে উঠলো ব্লেক।

মরগ্যান একবার তাকালো হাতঘড়ির দিকে। এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। টমাস ঠিক ঠিক চালালে, তবে এগারোটা নাগাদ বাঁকের কাছে পৌঁছে যাওয়া উচিত। তাহলে জিনি মিনিট পনেরোর মধ্যেই এসে পড়বে মরগ্যান ভাবলো,

হাতে সময় আছে দেখে মরগ্যান একটা সিগারেট ধরালো।

এই সুযোগে ব্লেকও একটা সিগারেট ধরালো! রাইফেলের ওপর রাখা তার বাঁ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল–তার হাত কাঁপছে। শত চেষ্টাতেও ব্লেক হাতটাকে স্থির রাখতে পারছে না। নিজের ওপর বিরক্ত হলো। উত্তাল হৃদপিণ্ডের উন্মত্ততা তার বুকে। এই দুঃসহ প্রতীক্ষা ব্লেকের স্নায়ুর ওপর জেঁকে বসলো।

পাঁচ মিনিট পর মরগ্যান আচমকা মাথা তুললো। যেন কিছু শোনবার চেষ্টা করছে।

মনে হচ্ছে একটা গাড়ি আসছে।

ব্লেক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে গেলো। সঙ্গে সঙ্গেই মরগ্যান চাপা স্বরে, বসে পড়ো, বোকা কোথাকার! এটা, জিনির গাড়ি নয়–শীগগির লুকিয়ে পড়ো।

ব্লেক বসে পড়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে দেখবার চেষ্টা করলো।

গাড়িটা কাছে আসতেই ওরা দেখলো গাড়িটা একটা সৈন্যবাহিনীর ট্রাক। ড্রাইভারের পাশে তিনজন সৈনিক বসে। ট্রাকটা ওদের সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো।

মরগ্যান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, ও–আজকের ডাক গেলো। আজ ওদের অন্যান্য দিনের তুলনায় কিছুটা দেরী হয়ে গেছে।

এগারোটা কুড়ির সময় মরগ্যান এই প্রথম দুশ্চিন্তায় চঞ্চল হয়ে উঠলো। তাহলে কি জিনি কেনা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে? না কি ভয় পেয়ে মেয়েটা তাদের দল ছেড়েই পালালো?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্লেক বললো, ও আর পারছি না। মেয়েটা এতোক্ষণ ধরে করছে কি?

মরগ্যান চিন্তান্বিত মুখে, বোধহয় গাড়ি টাড়ির ভিড়ে রাস্তায় আটকা পড়েছে।

ব্রেক উৎকণ্ঠায় বললো, টমাস যদি জিনিকে আগে যেতে না দেয়, তাহলে? ঐ শালারা যদি ট্রাক নিয়ে মেয়েটার আগেই চলে আসে। তখন আমরা কি করবো?

 কিছুই করব না। আগামীকাল আবার নতুন করে চেষ্টা করবো।

কিন্তু জিনিকে যদি ওরা কাল একই সময়ে আবার দেখতে পায়। তাহলে নির্ঘাৎ সন্দেহ করে বসবে। তখন পুরো কল্পনাটাই ভেস্তে যাবে।

মরগ্যান ধমকে উঠলল, থামো, যত সব আজগুবি চিন্তা। সে সব ভাববার জন্য যথেষ্ট সময়…। মরগ্যান গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে থেমে, এইবার ও আসছে।

বিদ্যুৎগতিতে ধেয়ে আসা এম. জি. গাড়িটাকে দেখতে পেলো এরা। তখনও তার দূরত্ব বাঁকের কাছ থেকে প্রায় এক মাইল।

ব্লেক তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বললোও দেখি পাগলের মতো ছুটে আসছে, দেখো, কি সাংঘাতিক জোরে ছুটছে।

মরগ্যানও ওঠে আগ্রহভরে। হয়তো ট্রাকটা ওর গাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নেই। শীগগির এসো, শাবল দুটো চটপট তুলে নাও।

পকেট থেকে এক ফালি বড় ন্যাকড়া বের করে রাস্তার ওপর মরগ্যান গিয়ে দাঁড়ালো। ন্যাকড়াটা পাকিয়ে দড়ির মত করে, বাঁ পকেট থেকে একটা বেনজিনের শিশি বের করলো।

বিপজ্জনক বাঁকের কাছে এসে গাড়ির গতিবেগ কমে এলো। গাড়িটা বাঁক ঘুরেই মরগ্যানের দৃষ্টির আওতায় হাজির হলো। হাত নেড়ে সে জিনিকে উপযুক্ত জায়গায় গাড়িটা থামাতে নির্দেশ দিলো।

জিনি গাড়ি থামিয়েই লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। মুখ আতঙ্কে বিবর্ণ, চোখের দৃষ্টিতে ক্রোধ ও উত্তেজনার ছোঁয়া।

ওঃ, ওরা কিছুতেই আমাকে আগে যেতে দিচ্ছিলো না। শেষে অতিকষ্টে পাশ কাটিয়ে এসেছি। আরেকটু হলেই রাস্তা থেকে ছিটকে নালার মধ্যে যাচ্ছিলাম আর কি। শীগগির করো ফ্র্যাঙ্ক। জিনির মুখ রক্তশূন্য, কাগজের মতো ফ্যাকাসে। স্বর উৎণ্ঠায় অস্থির। ওরা ঠিক আমার পেছন পেছনেই আছে।

জিনি গাড়ির যন্ত্রপাতি রাখার বাক্স থেকে একটা রিভলবার বের করে আনলো, তারপর গাড়ির মেঝে থেকে শুয়োরের রক্ত ভরা বোতলটা তুলে নিলো।

আমাকে কোন জায়গায় শুতে হবে?

মরগ্যান আঙুল উঁচিয়ে জায়গাটা দেখালো।

বোতলের ঢাকনা খুলে জিনি যখন রাস্তায় রক্ত ঢালছে, মরগ্যান ও ব্লেক তখন জিনির গাড়িটাকে শাবলের চাড় দিয়ে ওলটাতে ব্যস্ত।

ওদের দুজনের একত্রিত শক্তিতে গাড়িটা শূন্যে উঠে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দ করে নালার মধ্যে আছড়ে পড়লো।

যাও, শাবল দুটো নিয়ে লুকিয়ে পড়ো। বলেই মরগ্যান পেট্রোল ট্যাঙ্কের ঢাকনা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

ব্লেক শাবল দুটো নিয়ে নিজের জায়গায় লুকিয়ে পড়লো। ওদিকে জিনি রক্ত ঢেলে চলেছে। ওর হাতে, গায়ে, জামায়–ঘেন্নায় মুখ বিকৃত।

মরগ্যান ন্যাকড়ার দড়িটার ওপর বেনজিন ঢেলে শিশি ঝোঁপের আড়ালে ছুঁড়ে দিয়ে ভেজা দড়ির একমাথা ঢুকিয়ে দিলো পেট্রোল ট্যাঙ্কের ভেতরে। অন্য মাথাটা পড়ে রইলো রাস্তার দিকে।

ব্লেক চেঁচিয়ে উঠলো। ঐ যে ওরা আসছে। ওদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। জলদি, ফ্রাঙ্ক!

মরগ্যান ফিরে জিনিকে দেখলো। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ও মুখ তুলে ফ্রাঙ্কের দিকে তাকালো–বর্ণহীন মুখে উৎকণ্ঠায় ভরা বিস্ফারিত সবুজ চোখজোড়া কেমন বেমানান লাগছে।

মরগ্যান বললো। জিনি। রিভলবার নিয়েছো?

 হ্যাঁ।

ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা তো আছি।

মরগ্যান দেশলাই জ্বালতেই আচমকা দ্বিধায় পড়লো। ওলটানো গাড়িটা জিনির বড়ো বেশি কাছে রয়েছে না? যদি সে এখুনি গাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দেয় তাহলে জিনির গায়ে আঁচ লাগবে না তো। কিন্তু সে সব চিন্তা করার আর সময় নেই।

ব্লেক আতঙ্কিত স্বরে। জলদি করো ফ্র্যাঙ্ক!

জ্বলন্ত কাঠিটা ন্যাকড়ার একপ্রান্তে স্পর্শ করালো মরগ্যান। তারপরেই তার বেগে জিনিকে অতিক্রম করে ঝোঁপের আড়ালে ছুটলো।

আগুনের শিখা বেনজিন ভেজা নেকড়া বেয়ে পলকের মধ্যে পেট্রোল ট্যাঙ্কে প্রবেশ করলো। এক কান ফাটানো বিস্ফোরণ। গরম হাওয়ার হলকা এসে ঝাপটা মারলো মরগ্যানের মুখে–যেন তার শ্বাসরোধ হয়ে এলো।

ঘন কালো ধোঁয়া ও আগুনের লেলিহান শিখা আবহাওয়াকে আচ্ছন্ন করে তুললো। বাঁকের সামনের রাস্তাটা ধোঁয়ায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেলো।

ব্লেক মুখ আড়াল করে চেঁচিয়ে বললো, জিনি নির্ঘাত পুড়ে মরবে।

এখন আর কিছু করার নেই। জিনির কথা না ভেবে সামনে দেখলো, ওয়েলিং এজেন্সির ট্রাক সামনের বাঁক মোড় নিয়ে এগিয়ে আসছে।

ওরা এসে পড়েছে।

ব্লেক রাইফেল তুলে নিয়ে বাঁটটা কাঁধে চেপে ধরলো। নিশানা স্থির করতে আপ্রাণ চেষ্টা করলো, কিন্তু সামনের পটভূমি ওর চোখের সামনে স্তরে স্তরে কাঁপতে লাগলো।

এখন আগুনের শিখা অনেকটা কমে এসেছে–ধোঁয়াও অনেকটা কেটে গেছে। তখনও গাড়িটা ভীষণভাবে জ্বলছে–আবহাওয়ার উত্তাপে যেন চামড়া ঝলসে যাচ্ছে।

জিনি রাস্তার মাঝখানে স্থির পাথরের মতো পড়ে রয়েছে।

ব্লেকের মনে হলো, এর চেয়ে ভয়ংকর দুর্ঘটনার বাস্তব চিত্র কারো পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভবনয়।

নিশ্চলভাবে পড়ে থাকা মেয়েটা, ওর জামা কাপড়ের রক্ত, জ্বলন্ত গাড়িটা–সব মিলিয়ে যেন, চূড়ান্ত দুর্ঘটনার এক বিশ্বাসযোগ্য নিখুঁত ছবি রূপ নিয়েছে। জিনিকে দেখে বোঝা শক্ত, ও বেঁচে আছে কি মরে গেছে।

ইস, গাড়িটাকে আর একটু দূরে রাখলেই ভালো হতো। আফসোসের ধিক্কারে মরগ্যান মনে মনে ফেটে পড়লো।

সে যেখানে লুকিয়ে আছে সেখানেই তাপের প্রচণ্ডতা অসহ্য। তার ওপর জিনি রয়েছে। মরগ্যানের চেয়ে জ্বলন্ত গাড়িটার অন্ততঃকুড়ি ফুট কাছে। ওর জীবন্ত দগ্ধ হবার সম্ভাবনাকে মরগ্যান হেসে উড়িয়ে দিতে পারলো না। সত্যিই যদি? কিন্তু জিনির নিথর হয়ে পড়ে থাকার ভঙ্গী দেখে ওর যন্ত্রণার কোনোরকম আভাসই বাইরে থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

বিপজ্জনক বাঁকের মুখে ট্রাকটা এসে ঢুকলো।

মরগ্যানের সর্পিল আঙুল চেপে বসলো ৪৫–এর বাঁটের ওপর। সে এখান থেকে ড্রাইভার এবং রক্ষীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা জ্বলন্ত গাড়িটা ও রক্তাক্ত জিনিকে দেখেই ওদের মুখে ভাবান্তর ঘটলো। ট্রাক ড্রাইভার টমাস গাড়ি থামালো। জিনির থেকে প্রায় পনেরো ফুট দূরে ট্রাকটা থামলো।

মরগ্যানের মনে ঝড় বইলো। এরপর ওরা কি করবে? ওরা কি গাড়ি ছেড়ে নামবে? না কি…? মরগ্যানের মতলব, আশা ভরসা, সবকিছুই এখন তুলাদণ্ডে দুলছে।

সামনে ঝুঁকে ডার্কসন ব্যাপারটা ভালোভাবে দেখতে চেষ্টা করছে। আর টমাস ট্রাকের গীয়ারকে ঠেলে দিলো নিরপেক্ষ অবস্থানে।

মরগ্যান দেখলো, ট্রাকের দুধারের জানালাই খোলা। যাক, এখনো সবকিছু তার মতলব মাফিকই ঘটছে।

ট্রাকের ড্রাইভার এবং রক্ষী উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্বটা বুঝতে চাইলো। মরগ্যান যখন অধৈর্য হয়ে পড়েছে তখন ডাকসন টমাসকে কি যেন বললো। জবাবে টমাস ঘাড় নাড়লো।

মরগ্যান ভীষণ অস্বস্তি বোধ করলো। সামনের এই নৃশংস দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখেও ওরা বরফের মতো ঠাণ্ডা মাথায় বসে ওদের কর্তব্য ভাবছে।

মরগ্যান দেখলো, টমাস হাত বাড়িয়ে একটা ছোট কথা বলার যন্ত্র তুলে নিলো।

মরগ্যান ভাবলো, সর্বনাশ। ও কি নির্দেশ চেয়ে এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে?

মরগ্যানের ইচ্ছে হলো আড়াল ছেড়ে রিভলবার নিয়ে ওদের দিকে ছুটে যেতে। টমাসকে বাধা দিতে হলে এখুনি একটা কিছু করা দরকার। সে যদি আগে থেকে এটা ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতো, তাহলে ব্লেককে সে কখনোই রাস্তার এ পাশে রাখতো না। কারণ ব্লেক আর সে রাস্তার দুপাশে থাকলে এই মুহূর্তেই টমাস ও ডার্কসনকে আক্রমণ করতে পারতো। কিন্তু ওদের দুজনের সামনে একা একা ঝুঁকি নেওয়া নেহাতই অপরিণামদর্শিতা।

মরগ্যান এবার জিনির কথা ভাবলো। মেয়েটা ধীরে ধীরে আগুনের আঁচে পুড়ছে। ও কি বুঝতে পারছে না, ওর কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরেই ট্রাকটা দাঁড়িয়েছে। ও নিশ্চয়ই শুয়ে শুয়ে ডার্কসনের আগমনের প্রতীক্ষা করছে।

এই সংকটময় মুহূর্তে জিনির সাহসের প্রশংসা না করে পারলো না। ঐ অবস্থায় একরাশ উৎকণ্ঠিত অনুভূতি নিয়ে অন্ধ হয়ে পড়ে থাকা সাধারণ মানুষের কর্ম নয়।

মরগ্যান দেখলো, টমাসের হাত থেকে যন্ত্রটা নিয়ে ডার্কসন তাতে কথা বলছে। তার বক্তব্য অনুমান করা সম্ভব হলো না।

মরগ্যান ভাবলো তাহলে তাদের পালাবার সময় ধীরে ধীরে কমে আসছে। যেই ট্রাকটা রাস্তা থেকে হাপিস হবে, সঙ্গে সঙ্গেই এজেন্সি বেতার তরঙ্গে সতর্কবাণী ছড়িয়ে দেবে।

ডার্কসন কথা শেষ করে যন্ত্রটা নামিয়ে টমাসকে কি যেন বলে দরজা খুলে ট্রাকের বাইরে নামলো।

টমাস একইভাবে ট্রাকের ভেতর বসে উইন্ডস্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করতে লাগলো।

মরগ্যান যেখানে লুকিয়ে সেখান থেকে এখন ব্লেককে দেখা যাচ্ছে না। ব্লেক কি করছে ভেবে সে অবাক হলো।

ব্লেক জিনির দিকে এগিয়ে যাওয়া ডার্কসনকে নিশানা করে রাইফেল তুলে ধরলো। কিন্তু তার হাত থরথর করে কাঁপতে লাগলো। চাপা স্বরে সে একটা খিস্তি দিয়ে হাত স্থির করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো ফল হলো না। আতঙ্কের হিমেল হাওয়া ব্লেকের ফুসফুসে ঝাপটা মারলো।

রক্ষীটি ততক্ষণে জিনির দশ ফুটের মধ্যে পৌঁছে গেছে। ব্লেক জানে, এবার যে কোনো মুহূর্তে মরগ্যান রিভলবার নিয়ে ঝোঁপ ছাড়বে।

অনিশ্চিতভাবে ব্লেকের রাইফেলের নিশানা কাঁপতে লাগলো। একবার ডার্কসনের ওপর, পরে আবার তার বাইরে।

ঝোঁপঝাড়ের খসখস শব্দে চোখ ফেরাতেই সে দেখলো মরগ্যান রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েছে। এবং এইখানেই ব্লেক করলো চরম ভুল। ডাকসনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সে তাকালো মরগ্যানের দিকে।

ওদিকে ডার্কসন জিনির শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়েছে কিন্তু স্পর্শ করেনি। হয়তো তার মনের কোণায় সামান্যতম ক্ষীণ সন্দেহ ছিলো, যে এই দুর্ঘটনায় কোথাও একটা গোঁজা মিল আছে। হয়তো তার সন্দেহ হলে যে কেউ তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। ডার্কসন হঠাৎই মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো।

ইতিমধ্যে মরগ্যান ট্রাকের জানলায় উঠে পড়েছে। ওর হাতের রিভলবার বিচলিত, হতবুদ্ধি টমাসের মাথা লক্ষ্য করে স্থির।

জিনি আচমকা উঠে বসলো।

বিদ্যুতের মতো ডাকসন ঘুরে দাঁড়ালো। ওর ডান হাত কাটারির মতো আছড়ে পড়লো জিনির রিভলবারের হাতে, কিছু বোঝার আগেই জিনির হাত থেকে রিভলবার রাস্তায় ছিটকে পড়েছে। প্রায় একই সঙ্গে ডার্কসনের বাঁ হাতের প্রচণ্ড আঘাতে ও মুখ থুবড়ে পড়লো। ডার্কসন কোমরের খাপ থেকে ডান হাতে রিভলবার বের করলো। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রগতিতে ব্যাপারটা ঘটে গেল।

ব্লেক উত্তেজিত শ্বাস–প্রশ্বাসের সঙ্গে রাইফেলের ট্রিগার টিপলো। ব্লেক তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ট্রিগারে চাপ দেবার পরিবর্তে হ্যাঁচকা টান মারলোঝাঁকুনির ফলে রাইফেলেরনল হয়ে পড়লো ঈষৎ ঊর্ধ্বমুখী–সুতরাং কোনো ক্ষতি না করেই ডার্কসনের মাথার ওপর দিয়ে গুলিটা বেরিয়ে গেলো।

ব্লেকের গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকের মধ্যে হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকা টমাস পাশে ঝাঁপ দিলো। ওর হাত ছোবল মারলো ড্যাশবোর্ডের বোম তিনটের দিকে।

সরাসরি মরগ্যান ওর মুখ টিপ করে গুলি করলো।

একই সঙ্গে ডার্কসন মরগ্যানের দিকে তাক করে গুলি চালালো। সেই মুহূর্তে জিনি আঘাত করলো ডার্কসনের রিভলবার ধরা হাতে। ডার্কসনের হাত সামান্য বিচলিত হলেও বিফল হলো না। কারণ তার আঘাতে আচ্ছন্ন জিনির শক্তি তখন প্রায় নিঃশেষিত।

মরগ্যান তার পাঁজরে এক বিরাট ধাক্কা অনুভব করলো। সঙ্গে এক বুক–খাক করে দেওয়া জ্বলন্ত যন্ত্রণা গুলির আচমকা সংঘর্ষে সে রাস্তায় পড়ে গেলো। কিন্তু শীঘ্রই নিজেকে সামলে নিয়ে ডার্কসনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লো। জিনি তখন কোনোরকমে ডার্কসনের রিভলবার ধরা হাত আঁকড়ে ঝুলছে।

মরগ্যানের গুলি প্রহরীর কপালে গিয়ে আঘাত করলো। এবং মুহূর্তে মৃত ডার্কসনের নিপ্রাণ দেহটা জিনিকে নিয়ে রাস্তায় আছড়ে পড়লো।

যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে ট্রাকের গা ধরে আস্তে আস্তে মরগ্যান উঠে দাঁড়ালো। উঠে দেখলো, আহত, অবসন্ন টমাসের ডান হাত অতিকষ্টে এগিয়ে চলেছে একটা বোতামের দিকে। মরগ্যান কিছু করার আগেই টমাসের আঙ্গুল খুঁজে পেলো বোতামটা এবং বোতামে চাপ দিলো।

মুহূর্তে ইস্পাতের চাদরে গোটা ট্রাকটা ঢাকা পড়ে গেলো। কেউ কিছু বোঝার আগেই ট্রাকটা একটা নিচ্ছিদ্র ইস্পাতের বাক্সে পরিণত হলো।

মরগ্যান খিস্তি দিয়ে টলতে টলতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, আক্রোশ হতাশায় ৪৫ এর বাট দিয়ে সজোরে ইস্পাতের পর্দায় আঘাত করলো। ধাতব শব্দ মরগ্যানকে ব্যঙ্গ করে হেসে উঠলো। এমন সময় ট্রাকের ভেতরে, শোনা গেলো গুরুভার কিছু পতনের শব্দ–সেই সঙ্গে একটা চাপা, অস্ফুট আর্তনাদ। সম্ভবতঃ নিজের আসন থেকে ট্রাকের মেঝেতে টমাস গড়িয়ে পড়েছে।

ব্লেক ঝোঁপের আড়াল থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলো। দু হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটা ধরে আছে–মুখে একরাশ অন্ধকার।

পায়ের শব্দে মরগ্যান তার দিকে ঘুরে তাকালোমরগ্যানের চোখে চোখ পড়তেই ব্লেক আতঙ্কে থমকে দাঁড়ালো।

মরগ্যান হিংস্রস্বরে খেঁকিয়ে উঠলো, শালা কুত্তীর বাচ্চা! তোকে আমি খুন করে ফেলবো।

অনুনয়ের ভঙ্গীতে, প্রাণভয়ে ব্রেক চিৎকার করে উঠলো, ফ্র্যাঙ্ক বিশ্বাস করো। আমি ওকে মারতে চেয়েছি। কিন্তু মাছিটা গোলমাল করতে থাকায় ফস্কে গেছে। তারপর তোট্রিগারটাই বিগড়ে গেলো।

মরগ্যান হঠাৎ অনুভব করলো অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোটের বোম খুলতেই রক্তাক্ত জামাটা চোখে পড়লো।

জিনি বেতালা পা ফেলে দৌড়ে এলো। জ্বলন্ত গাড়ির আঁচে ওর মুখ টকটক করছে। বাদামী চুলের কয়েক গুচ্ছ পুড়ে জড়িয়ে গেছে।

জিনি চিন্তিতভাবে বললো। খুব বেশি লেগেছে?

 ও কিছু নয়, তাচ্ছিল্যভাবে উত্তর দিলেও মরগ্যানের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। একটা শীতার্ত অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরলো। পকেট থেকে বাঁশীটা বের করে জিনির হাতে দিয়ে, শীগগির কিটসনকে ডাকো।

জিনি বাঁশীতে ফুঁ দিলোঃ লম্বা, একটানা কর্কশ সুরে বাঁশীটা বাজালো।

 মরগ্যান ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই, জিনি বললো, টমাস? টমাসের কি হলো?

টমাসকে আমি শেষ করে দিয়েছি। একটা বোম ও টিপেছে বটে, কিন্তু অন্য দুটোর নাগাল পায়নি–তার আগেই ওর গড়িয়ে পড়ার শব্দ আমার কানে এসেছে। ইতিমধ্যে ব্লেক মরগ্যানের কাছে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু হতবুদ্ধি হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎই যেন সে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো, ফ্র্যাঙ্ক। তোমার বুক থেকে যে রক্ত ঝরছে।

মরগ্যান দাঁত খিঁচিয়ে, সরে যা আমার সামনে থেকে–শালা ভেড়ুয়া কোথাকার। তোর জন্যেই আমাদের সমস্ত মতলব ফেঁসে গেলো। এখন আমরা ডুবতে বসেছি।

জিনি তীক্ষ্ণস্বরে বলল না। এখনও একটা উপায় আছে। এদিকে এসো ফ্র্যাঙ্ক। বোসো। আগে তোমার রক্তটা বন্ধ করি।

মরগ্যান বসতেই জিনি টান মেরে তার শার্ট, কোট খুলে ফেললো।

প্রথমে জিনি ক্ষতটা পরীক্ষা করে দেখলো–প্রায় ইঞ্চি তিনেক লম্বা একটা চেরা দাগ! অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। চটপট স্কার্ট তুলে পেটিকোটের সেলাই বরাবর লম্বা একফালি কাপড় ছিঁড়ে নিলো জিনি। তারপর মরগ্যানের শার্টটা নিয়ে রক্ত ভেজা অংশটা বাদ দিলো ছিঁড়ে, বাকি কাপড়টা নিয়ে ভাজ করে একটা নরম প্যাডের মতো করে মরগ্যানের ক্ষতস্থানে চাপা দিয়ে। কাপড়ের ফালিটা দিয়ে শক্ত করে বাঁধলো।

যাক, এতেই এখন মোটামুটি কাজ হবে। তবে ফন হ্রদে পৌঁছানো মাত্রই উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে হবে। কেমন লাগছে এখন?

আস্তে আস্তে মরগ্যান দাঁড়ালো। কোটটা গায়ে দিতে গিয়ে, যন্ত্রণায় মুখটা বিকৃত করে, আমি ঠিক আছি। কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করা বন্ধ কর। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেলো। এখন আর ট্রাকটাকে ক্যারাভ্যানে ঢোকানো সম্ভব নয়–এদিকে সময়ও চলে যাচ্ছে। চলো, পালাতে হলে আর দেরী নয়–শীগগির।

কিটসন ঠিক সেই সময়ে ক্যারাভান ও বুইক নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে হাজির। বিবর্ণ, উৎকণ্ঠা ভরা মুখে সে বুইক থেকে নামলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার ট্রাকের দিকে তাকালো। তারপর মরগ্যানের দিকে।

ডার্কসনের মৃতদেহটা ব্লেক একটা ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে ফিরে এলো। কিটসন উত্তেজিত ভাবে, কি হয়েছে? যেন গুলির শব্দ শুনলাম।

মরগ্যান বললো, সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখুনি আমাদের পালাতে হবে।

জিনি ওদের বাধা দিয়ে বললো, দাঁড়াও। এখনও একটা উপায় আছে। বুইকটা চেষ্টা করলে ট্রাকটাকে ঠেলে ক্যারাভ্যানে তুলতে পারে। আমার মনে হয় তা অসম্ভবনয়। আমরা একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবো। বিনা চেষ্টায় দশ লাখ ডলারের ট্রাকটাকে হাতছাড়া করতে আমি রাজি নই।

মরগ্যান জিনির দিকে তাকিয়ে, হু, তাইতো? …শালা, আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই পারা যাবে। আলেক্স, চটপট ক্যারাভ্যানটাকে বুইকের ল্যাজ থেকে ছাড়িয়ে নাও।

মরগ্যানের স্বরের তীক্ষ্ণতা কিটসনের কান এড়ালো না। হতভম্ব হয়ে সে ক্যারাভ্যানের দিকে ছুটে গেলো। বুইক থেকে ওটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো।

মরগ্যান ব্লেককে বললো যাও, ওকে সাহায্য করো। চটপট, চটপট! আগে ক্যারাভ্যানটাকে ঘুরিয়ে নাও। জিনি, তুমি বুইকটাকে নিয়ে এসো ট্রাকের পেছনে।

কিটসন ও ব্লেক ক্যারাভ্যানকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন জিনি বুইকটাকে চালিয়ে ট্রাক ছাড়িয়ে নিয়ে গেলো। তারপর পেছন গীয়ার দিয়ে আস্তে আস্তে গাড়িটাকে পিছিয়ে এনে ট্রাকের গায়ে স্পর্শ করলো। অর্থাৎবুইকের পেছনের বাম্পার ও ট্রাকের পেছনের বাম্পার পরস্পরকে স্পর্শ করলো।

কিটসন ও ব্লেক ক্যারাভানটাকে টানতে টানতে ট্রাকের সামনের দিকে নিয়ে এলো।

এক কাজ করো এড, ক্যারাভ্যানের চাকার সামনে কয়েকটা আধলা ইট বসিয়ে দাও, যাতে এটা নড়তে না পারে। আর শাবল দুটো বের করে আনো। ও দুটো দিয়ে ক্যারাভ্যানের সামনেটা ঠেকা দাও যাতে ট্রাকটা ঠেলে তোলার সময় ওটা উলটে না যায়।

কিটসন ঝড়ের বেগেকাজ করে চলল। মুহূর্তের মধ্যে কতকগুলো বড় পাথরের টুকরো তুলে ক্যারাভ্যানের চাকা ও রাস্তার ফাঁকে গুঁজে দিলো। ওদিকে শাবল দুটো দিয়ে ব্লেক ক্যারাভ্যানের সামনেটায় জোরালো ঠেকা দিয়েছে–যাতে ওটা উলটে না যায়।

মরগ্যান, জিনিকে ইশারা করলো, ঠিক আছে।

কিটসন ট্রাকের সামনের দিকে এসে দাঁড়াতেই মরগ্যান ক্যারাভ্যানের পেছনের দরজা খুলে। দিলো।

সাবধান! ধীরে ধীরে জোর বাড়াবে, জিনিকে বললো মরগ্যান। বুইকের ইঞ্জিন চালু করে ট্রাকটাকে জিনি ঠেলতে শুরু করলো। ট্রাকের হাত–ব্রেক দেওয়া থাকলেও বুইকের ক্রমবর্ধমান চাপে ট্রাকটা নড়তে লাগলো।

কিটসন ও ব্লেক ট্রাকটাকে ক্যারাভ্যানের পাটাতন বেয়ে ভোলার জন্য ওটার সামনের চাকা জোড়ায় মুহুর্মুহু লাথি মেরে ট্রাকের গতিপথ ঠিক রাখলো। ধীরে ধীরে ট্রাকটা ক্যারাভ্যানে ঢুকে পড়লো।

মরগ্যান জিনিকে ডেকে বললো, থামো! কাজ হয়ে গেছে, এড, শীগগির শাবল দুটো আর রাইফেলটা গুছিয়ে নাও। কিটসন, চটপট বুইকের সঙ্গে ক্যারাভ্যানটাকে জুড়ে দাও! জলদি। আর সময় নেই।

জিনি বুইকটা চালিয়ে ক্যারাভ্যানের সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো। তারপর গাড়িটা পিছিয়ে ক্যারাভ্যানের কাছ ঘেঁষে থামতেই কিটসন দুটোকে আবার শেকল দিয়ে আগের মতো জুড়ে দিলো।

জিনি চালকের আসন থেকে সরে বসতেই কিটসন বুইকে উঠে বসলো। স্টিয়ারিং ধরলো। গাড়ি ও ক্যারাভ্যানকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে যেদিক থেকে জিপোর আসার কথা সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালো।

মরগ্যান ও ব্লেক লাফিয়ে ক্যারাভ্যানের ভেতরে ঢুকলো।

কিন্তু ট্রাকটা যে এতো জায়গা নেবে ওরা ভাবতেই পারে নি। কারণ ট্রাকও ক্যারাভ্যানের মাঝে দেড় ফুট এবং পেছনে ফুট দুয়েক জায়গা রয়েছে। এতে ওদের আচ্ছন্ন করে তুলতে চাইলো।

ঠিক ছিলো আগে থেকেই মরগ্যানও ব্লেক ড্রাইভারের কেবিনে বসবে। সুতরাং ওদের যেতে হবে ক্যারাভ্যানের দেওয়াল ও ট্রাকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। এতে বিপদ আর প্রচণ্ড ঝুঁকি। কিন্তু নিরুপায়। কিটসন যদি কোনো বাঁক নেয় তাহলে ট্রাকটা ছিটকে আসতে পারে ক্যারাভ্যানের দেওয়ালের দিকে, হয়তো থেঁতলে দেবে ওদের দেহকে।

কিটসন গাড়ি ছেড়ে ক্যারাভ্যানের দরজা বন্ধ করতে গেল ওমরগ্যানের কথায় ঘাড় নাড়লো, ঠিক আছে, লক্ষ্য রাখবো

এক কাজ করলে কেমন হয়? ব্লেক বলল চাকাগুলোকে পাথরের টুকরো দিয়ে আটকে দিলে কেমন হয়?

না, না, ওসব শুনে খেঁকিয়ে উঠলো মরগ্যান

 কিটসন ছুটে গিয়ে বসলো বুইকের চালকের আসনে।

ততোক্ষণে জিনি রক্তমাখা স্কার্ট, ব্লাউজ খুলে ফেলে একটা ধূসর পোষাক পরে নিয়েছে।

ওকে দেখলো কিটসন, জিনির মুখমণ্ডলে মৃতের ছায়া। গীয়ার দিয়ে গাড়ি ছোটালো কিটসন। অনুভব করলো, বুইকের ক্ষমতা কমে আসতে চাইছে।

ব্লাউজ পরে স্কার্টের চেনটা টেনে বন্ধ করতেই জিনিকে শুধালো কিটসন, কি হয়েছিলো?

শঙ্কিতস্বরে ব্যাপারটা কিটসনকে জানালো ও।

কিটসন ভীষণ ভয় পেলো, তার মানে ট্রাকের ভেতরে একটা লোক মরে পড়ে রয়েছে?

যদি সে মরে না থাকে, তাহলে এতক্ষণে বেতারে সংকেত পাঠিয়ে আমাদের বিপদে ফেলতো। মরগ্যান তো বলছে যে ও টমাসকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। কি জানি!

তাহলে একটা মড়াকে সঙ্গে বয়ে আমরা ঐ ক্যারাভ্যানের ঘাঁটিতে যাচ্ছি?

জিনি ভাঙা উত্তেজিত স্বরে ওকে বাধা দিলো, ও, তুমি থামবে? তারপর পাশ ফিরে দুহাতে মুখ ঢাকলো।

ওদিকে ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যান ক্যারাভ্যানের ভেতরে শ্রান্তভাবে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। সে নিরাপত্তার প্রয়োজনে পা দুটো ঠেসে ধরেছে ট্রাকের পেছনের চাকায়। তার মনের ভেতরে বয়ে চলেছে চিন্তার অশান্ত ঢেউ। …।

শেষ পর্যন্ত তাহলে কাজটা হলো। এখন বাকীটা ঠিকমতো সারতে পারলেই হয়। এর জন্য দু দুজন লোককে আমি খুন করেছি। অবশ্য সেটা তাদের নিয়তি। নাঃ, টমাস ডার্কসনের সাহস আছে। বিশেষ করে ড্রাইভারটার। কারণ সে জানতো যে আমার রিভলবারের সামনে সামান্যতম বেচাল মানেই মৃত্যু। তবুও সে বোতাম টেপার চেষ্টা করেছে। নাঃ, আমি হলে অন্ততঃ সে চেষ্টা করতাম না। অথচ টমাস তাই করেছে এবং আংশিকভাবে সফলও হয়েছে। এই ইস্পাতের চাদর নিয়ে আমাদের এখন প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাটে পড়তে হবে। তাছাড়া ট্রাকের ভেতরে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। বাইরের পাটাতন ভেঙ্গে ওর দেহটাকে উদ্ধার করতে হবে। মনে হয় টমাস মারাই গেছে! কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে? হয়তো জ্ঞান ফিরে এলে ও বেতারে সংকেত পাঠাতে চেষ্টা করবে এবং আমাদের বাড়া ভাতে ছাই দেবে!

মরগ্যান মজবুত ইস্পাতের ট্রাকটার দিকে চোখ রাখলো। ভাবলা, সামান্য ইস্পাত প্রাচীরের ও পিঠেই রয়েছে তার এতদিনকার স্বপ্ন দশ লক্ষ ডলার। তার হাতের এতো কাছে স্বর্ণমৃগের মাদকতাময় নেশা ধরানো উপস্থিতি মরগ্যানকে ভুলিয়ে দিলো তার বুকের ক্রম বর্ধমান অসহ্য যন্ত্রণার কথা।

ব্লেক মরগ্যানের চোখের আড়ালে, ট্রাকের অপর দিকে নীচু হয়ে বসে আছে। ওর চোখ রয়েছে। ট্রাকের গায়ে। অধীর সংশয়ে তার চোখেমুখে দুঃস্বপ্নের ছায়া–এই বুঝি ট্রাকটা তার দিকে ছিটকে এলো।

ব্লেক এখন তার সাহস ফিরে পেয়েছে কিন্তু দুবার ব্যর্থতার কথা কিছুতেই সে ভুলতে পারছে না।

ট্রাকটা ওরা হাতিয়েছে:অথচ পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্লেককে কোনো খুন করতে হয়নি। ব্লেক স্বস্তির শ্বাস নিলো। ওঃ, একটুর জন্য সে চরম অপরাধ থেকে রক্ষা পেয়েছে। এখন সে যে কোন পরিস্থিতির জন্যই সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এমনিতে সে ভীরু বা কাপুরুষ নয়। অথচ ব্লেক জানে এ ঘটনার পর মরগ্যান তাকে আর বিশ্বাস করবে না। সুতরাং ব্লেককে ফ্রাঙ্কের ওপর নজর রাখতে হবে। বলা যায় না, শেষ পর্যন্ত সে হয়তো তাকে আঁটি চোষাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু ব্লেক অতত সস্তায় নিজের দু লাখ ছাড়তে রাজি নয়।

গাড়ি মাইল ছয়েক যাবার পর কিটসন দেখলো জিপো দ্রুতপায়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

গাড়ি থামাতেই সে বুইকের কাছে ছুটে এসে, কি হলো? সব ঠিক আছে তো? কোনো গোলমাল হয়নি তো?

কিটসন বললো, না, সব ঠিক আছে। যাও, ক্যারাভ্যানে ঢুকে পড়ো।

কিটসন বুইক থেকে নেমে ক্যারাভ্যানের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। এসো জিপো, এদিকে এসো।

ক্যারাভ্যানের ভেতরে উঁকি মারতেই জিপো মরগ্যানকে দেখে বললো, সব ঠিক আছে তো ফ্র্যাঙ্ক? মরগ্যান যন্ত্রণায় কাতর–মুখে ধূসর, মৃত্যুর প্রলেপ। কোনোমতে অস্ফুটস্বরে বললো, হা…এখন চলল। এসো, চটপট ভেতরে, ঢুকে পড়ো।

জিপো হঠাৎ থমকে স্থির অবাক চোখে মরগ্যানকে দেখে। তুমি এখানে কি করছো, ফ্র্যাঙ্ক? তোমার তত ট্রাকের ভেতরে বসার কথা।

মরগ্যান গর্জে উঠলো, ভেতরে এসো। নষ্ট করার মত সময় আমাদের নেই।

জিপো আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো। কয়েক পা পিছিয়ে, না। ওভাবে আমি ক্যারাভ্যানে চড়তে পারবো না। ট্রাকটা যদি সামান্য নড়ে তাহলেই তোমরা মাছির মতো থেতলে মারা যাবে।

মরগ্যান তার কাঁধে ঝোলানো খাপ থেকে ৪৫টা বের করলো। রিভলবার বের করবার সময় তার কোট খানিকটা সরে যেতেই জিপো দেখলো মরগ্যানের বুকে বাঁধা রক্ত ভেজা পট্টিটা।

মরগ্যান রিভলবার উঁচিয়ে, এসো ভেতরে।

 কিটসন জিপোকে ধরে এক ধাক্কা মারলো। ক্যারাভ্যানের ভেতর জিপো ছিটকে গিয়ে পড়লো। ক্যারাভ্যানের দরজা কিটসন সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিলো।

কিটসন চালকের আসনে বসে গাড়ি ও ক্যারাভ্যান হাওয়ার বেগে ছুটিয়ে নিয়ে চলল প্রধান সড়কের দিকে।