৫. ম্যাঙ্গেল ক্বাস

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার দলবলকে সংগ্রহ করার জন্যে যে গ্রহটিকে ঘিরে ফোবিয়ানের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করল, সেই গ্রহটিকে আমার খুব অপছন্দ হলো। এই কুৎসিত বিশাল গ্রহটির যে উপগ্রহ থেকে সে তার সঙ্গীসাথির সংকেত পেয়েছে বলে দাবি করল সেই উপগ্রহটিকে আমার অপছন্দ হলো আরো বেশি। একটি নির্দিষ্ট গ্রহ বা উপগ্রহ সম্পর্কে ব্যক্তিগত ভালো লাগা না-লাগার কোনো গুরত্ব নেই, কিন্তু শুরু থেকেই এই গ্রহ এবং উপগ্রহ সম্পর্কে আমার ভিতরে একধরনের অশুভ অনুভূতির জন্ম হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটি গোপন করার কোনো চেষ্টা না করে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে বললাম, তুমি তোমার দলের লোকজনের অবস্থান ঠিক করে কো-অর্ডিনেট জানিয়ে দাও, আমি স্কাউটশিপ পাঠিয়ে তাদেরকে আনার ব্যবস্থা করে দিই।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস সর চোখে আমার দিক তাকাল, বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে নির্বোধ বিবেচনা কর নি।

আমি মাথা নাড়লাম এবং বললাম, না করি না। কিন্তু এই উপগ্রহটিকে আমার খুব অপছন্দ হয়েছে, গ্যালাক্টিক তালিকায় এর কোনো নাম নেই, বিদঘুটে সংখ্যা দিয়ে পরিচয় দেয়া হয়েছে। এটি অস্থিতিশীল এবং বিস্ফোরণমুখ। আমি এখানে যেতে চাই না।

তুমি যেতে চাও কি না-চাও সেটি বিবেচনার মাঝে আনার প্রয়োজন নেই। আমি চাই কি না-চাই সেটাই গুর ত্বপূর্ণ।

তুমি কী চাও?

আমার নিরাপত্তার খাতিরে আমি কখনোই তোমাকে আলাদা হতে দেব না। কাজেই আমরা যে স্কাউটশিপ নিয়ে এই উপগ্রহে নামব সেখানে তুমি থাকবে। মিত্তিকা নামের সেই মেয়েটিও থাকবে।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, আমি যদি একজন দস্যু হতাম আমিও ঠিক এধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে কোথাও এক পা আগ্রসর হতাম না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে তার দলের লোকজনের সাথে যোগাযোগ নিশ্চিত করতে করতে আমাকে বলল, তুমি স্কাউটশিপটা প্রস্তুত কর, আমরা কিছুক্ষণের মাঝেই রওনা দিতে চাই।

স্কাউটশিপে যাবার আগে আমি মিত্তিকাকে ডেকে পাঠালাম, সে একধরনের ভয়ার্ত চোখে হাজির হলো, ফ্যাকাশে মুখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ইবান?।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কিছুক্ষণের মাঝে এই উপগ্রহটাতে নামছে।

মিত্তিকা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, এই তথ্যটি তাকে জানানোর কারণটি সে বুঝতে পারছে না। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, সে এই উপগ্রহটাতে একা যাবে না, তোমাকে আর আমাকে নিয়ে যাবে।

কথাটি শুনে মিত্তিকা যেরকম ভয় পেয়ে যাবে বলে ভেবেছিলাম দেখা গেল সে সেরকম ভয় পেল না, বরং তার মাঝে বিচিত্র একধরনের কৌতূহলের জন্ম হলো। চোখ বড়-বড় করে বলল, এই উপগ্রহে সত্যি-সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী আছে?

আমি ভুর কুঁচকে বললাম, আমি আশা করছি নেই।

কেন? তুমি বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণী পছন্দ কর না?

সত্যি কথা যদি বলতে বল তাহলে বলব যে, না যে বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে আমার যোগাযোগ হয় নি তাকে আমি পছন্দ করি না।

কেন?

প্রথমত বুদ্ধিমান প্রাণী কৌতুহলী হয়। কাজেই তারা আমাদের নিয়ে কৌতুহলী হবে।

কৌতুহলী হলে সমস্যা কিসের? মিত্তিকা ঠিক বুঝতে পারল না আমি কী নিয়ে কথা বলছি। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যদি এরা মোটামুটি আমাদের মতো বুদ্ধিমান হয় তাহলে আমাদের কেটেকুটে দেখবে। আমাদের ধরে তাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে রাখবে। যদি অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয় তাহলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরণগুলি বিশ্লেষণ করবে, আমাদের নতুন করে তৈরি করবে।

মিত্তিকাকে এবারে একটু আতংকিত হতে দেখা গেল। আমি সাহস দিয়ে বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলবল যেহেতু এই উপগ্রহে বেঁচে আছে এখানে নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নেই। যদি থেকেও থাকে তাহলে সেটা নিশ্চয়ই বন্ধুভাবাপন্ন–

দেখতে কী রকম হবে বলে তোমার মনে হয়? অনেকগুলো চোখ, এঁড়ের মতো হাত-পা–

আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই বিনোদন চ্যানেলে নানা ধরনের ছায়াছবি দেখ। প্রকৃত বুদ্ধিমান প্রাণী হলে সেটি যে আমাদের মতো হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়ত তারা এত ক্ষুদ্র যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে। দেখতে হয়, কিংবা এত বড় যে পুরোটা নিয়েই তারা একটা গ্রহ! কিংবা তারা বাতাসের মতো দেখা যায় না কিংবা তরল সমুদ্রের মতো–

মিত্তিকার এবারে খুব আশাভঙ্গ হলো বলে মনে হলো। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তোমার এত মন খারাপ করার কিছু নেই, হয়ত সত্যিই দেখবে ছোট ছোট পুতুলের মতো হাসিখুশি মহাজাগতিক প্রাণী, তোমাকে দেখে আনন্দে নাচানাচি করছে!

স্কাউটশিপটি কিছুক্ষণের মাঝেই আমি প্রস্তুত করে নিলাম, মূল মহাকাশ্যানের মতো এর এত বড় ইঞ্জিন নেই কিন্তু কাজ চালানোর মতো দুটি শক্তিশালী প্লাজমা ইঞ্জিন রয়েছে। মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে বলে এর মাঝে কয়েকদিন থাকার মতো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, খাবার পানীয় বা জ্বালানি রয়েছে, শক্তিশালী যোগাযোগব্যবস্থা এমনকি ভয়ঙ্কর ধরনের অস্ত্রও রয়েছে।

আমি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে সেটার ইঞ্জিন চালু করতে করতে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে বললাম, তোমার কাছে আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই।

কী ব্যাপার?

উপগ্রহটিতে নামার পর যদি তুমি আমাকে কিংবা মিত্তিকাকে তোমার সাথে নিতে চাও তাহলে আমাদের অস্ত্র নিতে দিতে হবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েক মুহূর্ত কিছু-একটা ভাবল তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।

স্কাউটশিপটি ফোবিয়ান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই প্রচণ্ড গর্জন করে উপগ্রহের দিকে ছুটে চলল। উপগ্রহটি বিশাল, নিজের একটা বায়ুমণ্ডলও রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে স্কাউটশিপটি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে, তাপ নিরোধক আস্তরণ থাকার পরও আমরা সেটা অনুভব করতে শুরু করেছি। স্কাউটশিপের সংবেদনশীল মনিটর উপগ্রহের বায়ুমণ্ডল, তার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, প্রাণের চিহ্ন বা বিদ্যুৎ চৌস্বকীয় তরঙ্গের অবশিষ্ট খুঁজতে থাকে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলবলের দুর্বল সংকেত ছাড়া এই উপগ্রহটিতে অবশ্যি অন্য কোনো ধরনের প্রাণের চিহ্ন পাওয়া গেল না।

ধীরে ধীরে স্কাউটশিপটি আরো নিচে নেমে আসে, বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, স্কাউটশিপের গতিবেগ অনেক কমিয়ে আনতে হলো, উপগ্রহটির ভেতরে একধরনের আবছা সবুজ আলো। বায়ুমণ্ডলে শক্তিশালী আয়নের২৭ আঘাতে এই আলো বের হয়ে আসছে। আমি স্কাউটশিপটিকে উপগ্রহের মাটির কাছাকাছি নামিয়ে এনে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর কাছে এসে ঘুরপাক খেতে থাকি। ম্যঙ্গেল ক্বাস তার দলের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে কিছুক্ষণ নিচু গলায় কথা বলল, তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি স্কাউটশিপটাকে নিচে নামিয়ে নাও।

আমি মনিটরে একটি সমতল জায়গা দেখে স্কাউটশিপকে নিচে নামিয়ে আনলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় বলল, কী সর্বনাশ! এটা তো দেখি নরকের মতো।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার দলের সবচেয়ে চৌকস মানুষগুলো এই নরকে আটকা পড়ে আছে।

এখানে কেমন করে আটকা পড়ল?

মহাজাগতিক নিরাপত্তারক্ষীর সাথে সংঘর্ষ হয়ে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল।

তারা নিশ্চয়ই খুব সৌভাগ্যবান যে মহাকাশযান বিধ্বস্ত হওয়ার পরও প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস বলল, শুধু সৌভাগ্য নয়, এ ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কিছু কৃতিত্ব রয়েছে। আমি বলেছি তারা চৌকস।

নিরাপত্তারক্ষী বা সৈনিক কিংবা কলকারখানার চৌকস হলে সেটি আমি বুঝতে পারি কিন্তু একটা দস্যুদলকে যখন চৌকস বলা হয় তার অর্থ ঠিক কী আমি সেটা ঠিক বুঝতে পারি না কিন্তু সেটা নিয়ে আমি আর কোনো প্রশ্ন না করাই বুদ্ধিমান কাজ বলে মনে করলাম। আমি স্কাউটশিপের ভল্ট খুলে সেখান থেকে পোশাক বের করে পরে নিতে শুরু করি। এই উপগ্রহের বায়ুমণ্ডলে শুধু যে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই তা নয় এটা রীতিমতো বিষাক্ত। স্কাউটশিপের সামনে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে সেখান থেকে একটি বেছে নিয়ে আমি আমার হাতে তুলে নিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস চোখের কোনা দিয়ে আমাকে লক্ষ করল কিন্তু কিছু বলল না। আমি মোটামুটি একটা হালকা অস্ত্র তুলে নিয়ে মিত্তিকার হাতে তুলে দিলাম, সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কী?

একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।

এটা দিয়ে কী করব?

হাতে রাখ, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ব্যবহার করবে।

আমি অস্ত্র ব্যবহার করতে জানি না।

আমি হেসে বললাম, শুনে খুব খুশি হলাম। আশা করছি এই বিদ্যেটা কখনো যেন তোমার শিখতে না হয়। কিন্তু যেটা ব্যবহার করতে জানি না সেটা হাতে নিয়ে কী করব?

এটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র— তোমাকে কিছু করতে হবে না।

মিত্তিকা কী বুঝল কে জানে, শেষপর্যন্ত অস্ত্রটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে পিঠে ঝুলিয়ে নিল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস অস্ত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখে ভারী একটা অস্ত্র হাতে তুলে নিল, তার হাতে অস্ত্র নেয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল সে জীবনের একটা দীর্ঘ সময় এই অস্ত্র হাতে কাটিয়েছে।

স্কাউটশিপের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে আমরা জরুরি সরবরাহের ব্যাক পেকটি পিঠে নিয়ে গোলাকার দরজার কছে এসে দাঁড়ালাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাকে আগে বের হওয়ার জন্যে ইঙ্গিত করল— সেটাই স্বাভাবিক। আমার পিছু পিছু মিত্তিকা এবং সবার শেষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস নেমে এল।

বাইরে একধরনের অস্থিতিশীল আবহাওয়া, হুহু করে সবুজ রংয়ের একধরনের বাতাস বইছে। আকাশে সবসময়ে। একধরনের আলো, কখনো বাড়ছে কখনো কমছে বলে চোখের রেটিনা কিছুতেই অভ্যস্ত হতে পারছে না। চারিদিকে ধূসর উঁচুনিচু প্রান্তর, নানা আকারের পাথর, কিছু কিছু একধরনের তরলে ডুবে আছে, তরলের ভিতর থেকে বড় বড় বুদবুদ বের হয়ে আসছে মিত্তিকা ঠিকই বলেছে, নরক বলা হলে চোখের সামনে যে ছবিটি ফুটে ওঠে সেটি অনেকটা এরকম।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলের মানুষদের সংকেত এখন অনেক শক্তিশালী, ইচ্ছে করলে তাদের চেহারাও দেখা যাবে। কিন্তু আমরা আর সে চেষ্টা না করে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের চোখের সামনে লাগানো গ্যালাক্টিক অবস্থান নির্ধারণ মডিউলে ২৮ দেখতে পাচ্ছি কমপক্ষে তিরিশ মিনিটের মতো হাঁটতে হবে। আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কেমন লাগছে মিত্তিকা?

মিত্তিকা বড়-বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই পোশাক পরে অভ্যাস নেই তো তাই খুব সুবিধে করতে পারছি না।

আমি উৎসাহ দিয়ে বললাম, কে বলছে পারছ না? এই তো চমৎকার হাঁটছ।

কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে।

কমবয়সী এই মেয়েটির জন্যে আমার মায়া হলো, শুধুমাত্র ভাগ্যের দোষে মহাজাগতিক একজন দস্যুর হাতে ধরা পড়ে তার এক অজানা উপগ্রহের অস্থিতিশীল আবহাওয়ার মাঝে হেঁটে হেঁটে আরো কিছু ঘাঘু অপরাধীদের উদ্ধার করতে যেতে হচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের সাথে তার সঙ্গীসাথিরা একত্র হলে পুরো পরিবেশটা কেমন হবে চিন্তা করে আমি নিজের ভিতরে একধরনের অশান্তি বোধ করতে শুরু করেছি।

আমি মিত্তিকার পিঠে হাত দিয়ে বললাম, এই তো আমরা এসে গেছি।

কথাটি পুরোপুটি সত্যি নয় কারণ তার পরেও আমাদের প্রায় আরো একঘণ্টা হাঁটতে হলো এবং উপগ্রহের বৈরী আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন হঠাৎ করে চোখের সামনে বিধ্বস্ত একটা মহাকাশযান দেখতে পেলাম।

মহাকাশযানটি নিশ্চয়ই অনেকদিন আগে এখানে বিধ্বস্ত হয়েছে, কারণ পুরো মহাকাশযানটি ধূসর এবং সবুজাভ ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। আমি একটু অবাক হয়ে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে রইলাম কারণ এটি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে তাতে এর ভিতরে কোনো মানুষের বেঁচে থাকার কথা নয়। মহাকাশযানের মূল অক্ষটি ভেঙে গিয়েছে, বিস্ফোরণের ফলে যে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে তার ভিতর দিয়ে মহাকাশযানের পুরো বাতাস বের হয়ে যাবার কথা। এরকমভাবে বিধ্বস্ত হওয়া মহাকাশযান কিছুতেই বায়ুনিরোধক থাকতে পারে না। আমি মহাকাশযানের দেয়ালের দিকে তাকালাম, প্রচণ্ড উত্তাপে এটি দুমড়ে মুচড়ে গলে গিয়েছে, একটি মহাকাশযানের এই ধরনের উত্তাপ সহ্য করার কথা নয়, এর নিরাপত্তার পুরো ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। এই প্রলয়কাণ্ডে কোনোভাবেই মহাকাশযানের কোনো অভিযাত্রীর বেঁচে থাকার কথা নয়। আমি সবিস্ময়ে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বললাম, কী আশ্চর্য!

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল, কোনটি কী আশ্চর্য?

এই মহাকাশযানটি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এর মাঝে কোনো মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়।

কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ মানুষ বেঁচে আছে।

হ্যাঁ, কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব হলো? আমি বুঝতে পারছি না।

এটা নিয়ে এখন মাথা না ঘামিয়ে চলো ভিতরে যাওয়া যাক।

চল।

আমরা ঘুরে ঘুরে ভেতরে ঢোকার দরজা খুঁজে বের করলাম, সেই দরজা ধাক্কা দিতেই সেটা কঁাচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে সবুজ রংয়ের ধুলোর আস্তরণ এবং ঘােলাটে একধরনের অন্ধকার। মাথায় লাগানো উজ্জ্বল। আলোতে দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে থাকি, প্রথমে আমি, আমার পিছনে মিত্তিকা এবং সবার শেষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু আমাদের সবার হাত অস্ত্রের ট্রিগারে চলে এসেছে, এই বিধ্বস্ত মহাকাশযানটিতে একধরনের অশুভ আতংকের চিহ্ন রয়েছে।

সর করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে আমরা আরো বড় একটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, শক্ত দরজা এমনিতে খোলা যাচ্ছিল না, পা দিয়ে কয়েকবার লাথি দেবার পর সেটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকালাম, এখানেও কেউ নেই। আমরা মোটামুটি একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে এটি বাঁকা হয়ে আছে, একসময় এখানে আলো এবং বাতাস ছিল এখন কোথাও কিছু নেই, একটি থমথমে নীরবতা।

মিত্তিকা আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, আমার ভয় করছে।

আমি তার পিঠে হাত দিয়ে বললাম, ভয়ের কিছু নেই মিত্তিকা। আমরা আছি না?

জানি, তবু কেমন জানি ভয় লাগছে।

ভয় লাগার ব্যাপারটি হাস্যকর বোঝানোর জন্যে আমি শব্দ করে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পদ্ধতিটা খুব ভালো কাজ করল না।

ঢাল বেয়ে সাবধানে নিচে নেমে এসে আমরা আধা গোলাকার আরেকটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, এই দরজার ফাক দিয়ে হলদে রংয়ের ঘােলাটে একধরনের আলো বের হচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস খুশি-খুশি গলায় বলল, এই যে, সবাই নিশ্চয়ই এখানে আছে।

আমি দরজাটিতে হাত দিয়ে শব্দ করলাম, এবং ভেতর থেকে একধরনের শব্দ হলো, মনে হলো কেউ একজন প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি সাবধানে দরজাটি ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকলাম, মাঝারী অসমতল একটি ঘর, সম্ভবত ইঞ্জিন কক্ষ। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজন মানুষ ছিন্নভিন্ন পোশাকে, ধুলো এবং কালি মাখা অবস্থায়। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। মানুষগুলোর বসে থাকার মাঝে একধরনের অস্বাভাবিকতা রয়েছে যেটি দেখে আমার বুকের মাঝে ধক করে উঠল।

আমার পিছু পিছু মিত্তিকা এবং সবার পরে ম্যাঙ্গেল কাস ঘরটিতে এসে ঢুকল, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে খুব বিচলিত মনে হলো না, কিন্তু মিত্তিকা ছোট একটা আর্তচিৎকার করে আমাকে পিছন থেকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আমি নিচু গলায় বললাম, কী হয়েছে মিত্তিকা?

মিত্তিকা কাঁপা গলায় বলল, এরা কারা? আমার ভয় করছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল, বাড়াবাড়ি ভয় পাবার কিছু নেই, এরা আমার লোকজন। ম্যাঙ্গেল ক্বাস দুই হাত ওপরে তুলে অভিবাদন করার ভঙ্গি করে বলল, কী খবর, কেমন আছ তোমরা?

মানুষগুলো যারা সংখ্যায় ছয়জন, যাদের মাঝে পুরষ, মহিলা এবং পুর ষও নয় মহিলাও নয় এরকম মানুষ রয়েছে, ম্যাঙ্গেল কৃাসের অভিবাদনে খুব বেশি অনুপ্রাণীত হলো না। কাছাকাছি যে বসেছিল শুধুমাত্র সে যান্ত্রিকভাবে একটা হাত উপরে তুলল।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস গলার স্বরে আরো আন্তরিকতা ফুটিয়ে বলল, তোমরা এই ভয়ংকর দুর্ঘটনায় বেঁচে যাবে সেটা আমি আশা করি নি, বলা যেতে পারে এটি একটি ম্যাজিকের মতো।

মানুষগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না, পিছনে বসে থাকা একজন মানুষ, যার শারীরিক গঠন দেখে মহিলা বলে অনুমান করলাম— ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিজে থেকে আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, খিলা অনেকদিন পর তোমাদের দেখা পেলাম। তোমাদের আর দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি।

খিলা নামের মেয়েটি খসখসে গলায় বলল, আমাদের নিয়ে যাবে?

মেয়েটির গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠলাম, গলার স্বরটি আশ্চর্য রকমের প্রাণহীন এবং যান্ত্রিক।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ নিয়ে যাব। অবশ্যি নিয়ে যাব। কোথায় নিয়ে যাবে?

আমার সাথে। আমাদের দল আবার নতুন করে তৈরি করব। সবাই মিলে নতুন অভিযান হবে। নতুন অস্ত্র, নতুন। প্রযুক্তি অনেক পরিকল্পনা আছে।

সামনে বসে থাকা ভয়ঙ্করদর্শন মানুষটি মুখ উঁচু করে মোটা গলায় বলল, মানুষ থাকবে সেখানে?

মানুষ? ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে বলল, মানুষ থাকবে না কেন ইরি। অবশ্যই থাকবে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা শুনে ইরি নামের ভয়ংকরদর্শন মানুষটি হঠাৎ কেমন জানি খুশি হয়ে উঠল, সে তার শরীর দুলিয়ে বিচিত্র একটি আনন্দহীন হাসি হাসতে শুরু করে। ইরি নামের মানুষটির হাসি দেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা আরো কয়েকজন মানুষ হাসতে শুরু করে, আনন্দহীন ভয়ংকর একধরনের হাসি, শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তাদের হাসি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তোমরা এতদিন এখানে কেমন ছিলে বল?

প্রথমে কেউ কোনো কথা বলল না, এবং হঠাৎ করে পিছন থেকে না-পুরষ না-মহিলা এই ধরনের সবুজ রংয়ের চুলের একটি মানুষ বলল, জানি না।

জান না? ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে বলল, কেমন ছিলে জান না? কী বলছ উলন?

উলন স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর শীতল গলায় বলল, কেমন করে জানব। ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ হলো, তারপর আর কিছু মনে নাই।

মনে নাই?

না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস অন্যদের দিকে তাকাল, অন্যেরাও তখন মাথা নাড়ল, বলল, নাই, মনে নাই।

কিছু মনে নাই?

মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর বলল, না, মনে নাই।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না হঠাৎ করে ম্যাঙ্গেল ক্বাস রেগে উঠল কেন, গলার স্বর উঁচু করে বলল, আসলে মনে আছে, তোমরা মিথ্যা কথা বলছ।

মাঝামাঝি বসে থাকা একজন মানুষ তখন ধীরে ধীরে উঠে এল, তার শরীরের একটা বড় অংশ বিকটভাবে পুড়ে গেছে, একটা হাত ভেঙে অসহায়ভাবে ঝুলছে, মানুষটির চেহারায় জগৎসংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা— ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছাকাছি এসে বলল, আমরা মিথ্যা কথা বলছি?

হ্যাঁ। আমার ধারণা তোমরা মিথ্যা কথা বলছ।

কেন?

কারণ, তোমরা আমাকে বলবে না গ্লকোনাইটগুলো কোথায় আছে।

মানুষগুলো চুপ করে বসে এবং দাঁড়িয়ে রইল, তাদের দেখে মনে হলো তারা ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা বুঝতে পারছে না।

বল, কেথায় রেখেছ গ্লকোনাইটগুলো।

খিলা নামের মহিলাটি প্রথমে হেসে উঠল, প্রাণহীন আনন্দহীন ভয়ংকর একধরনের হাসি। তার হাসি শুনে অন্য আরো কয়েকজন হেসে উঠল এবং ম্যাঙ্গেল ক্বাস আরো রেগে উঠে, চিৎকার করে বলল, তোমরা বলবে না কোথায় আছে গ্লুকোনাইটগুলো?

মুখে নোংরা দাড়িগোঁফ একজন মানুষ উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা বেঁচে আছি না মারা গেছি সেটাই মনে নাই— আর গ্লকোনাইট!

উলন জিজ্ঞেস করল, থ্রকোনাইট কী?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবারে তার হাতে অস্ত্রটা তুলে নিয়ে সেটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তোমরা এখন বলতে চাও গ্লকোনাইট চেনো না?

ইরি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, হতে পারে চিনি কিংবা চিনি না। মনে নাই। আসলে কিছু মনে নাই।

আমাকে মনে আছে?

ইরি উত্তর না দিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে রইল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস হাতের অস্ত্র উদ্যত করে দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমরা কি ভেবেছ আমি শুধু তোমাদের উদ্ধার করা জন্যে এসেছি?

পুরষ, মহিলা এবং না-পুরষ না-মহিলা কেউই কোনো কথা বলল না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস পা দাপিয়ে বলল, না, আমি শুধু তোমাদের উদ্ধার করার জন্যে এখানে আসি নাই। একটা মহাকাশযান দখল করে এই উদ্ভট উপগ্রহে কেউ শুধু মানুষকে উদ্ধার করার জন্যে আসে না। আমিও আসি নাই। আমি গ্লকোনাইটের জন্যেও এসেছি। বল কোথায় আছে। গ্লকোনাইট।

ইরি চিন্তিত মুখে বলল, দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে দেখি।

কাকে জিজ্ঞেস করবে?

ইরি কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে গেল। মনে হলো কিছু একটা নিয়ে সে হঠাৎ যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল কাকে জিজ্ঞেস করবে?

এ তো–ঐ যে, যারা–মানে– এই যে—  ইরিকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখায়।

ম্যাঙ্গেল জ্বাস ভুর কুঁচকে তাকিয়ে রইল, তারপর হিংস্র গলায় বলল, বুঝেছি। তোমরা সহজ কথায় নড়বে না। আবার আমাকে একটা উদাহরণ তৈরি করতে হবে, যেন তোমাদের সব কথা মনে পড়ে।

আমি একধরনের আতংক নিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্লাসের দিকে তাকালাম, সে এখন কী করতে যাচ্ছে?

ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতে দাত ঘঁষে বলল, আমি ঠিক দশ সেকেন্ড সময় দিলাম, তার মাঝে তোমরা যদি না বলো গ্লুকোমাইটগুলো কোথায় আছে তাহলে আমি তোমাদের একজনকে গুলি করে মারব।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার অস্ত্র উঁচু করে ধরল এবং আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, সে সত্যিই দশ সেকেন্ড পর গুলি করবে। আমি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে এগিয়ে গেলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস— ।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস ধমক দিয়ে বলল, তুমি চুপ করো এখন। আমি এখানে ধর্ম প্রচারে আসি নি। এদের একজন দুই জনকে গুলি করে মেরে না ফেলা পর্যন্ত—

আমি বাধা দিয়ে বললাম, তুমি কাকে মারতে চাইছ?

কেন? এদেরকে।

যারা মরে গেছে, তাদেরকে মারা যায় না।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী বললে?

আমি চাপা গলায় বললাম, এরা সবাই মরে গেছে।

মরে গেছে?

হ্যাঁ। এই গ্রহে অক্সিজেন নেই, শুধু বিষাক্ত বাতাস। এই মানুষগুলো কেউ কোনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। দেখেছ?

নিঃশ্বাস নিচ্ছে না?

না।

তাহলে এরা কথা বলছে কেমন করে?

জানি না। আমার ধারণা–

তোমার ধারণা–

আমার ধারণা, এই মৃতদেহগুলোকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর মাথা ঝাকিয়ে বলল, বাজে কথা বল না।

আমি বুঝতে পারলাম সে আমার কথা বিশ্বাস করল না, আমি বুঝতে পারলাম সে এখন এদের একজন-দুজনকে গুলি করবে। আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম খিলা নামের মেয়েটা খুব ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একমাত্র এই দরজা দিয়ে বের হওয়া যায়, দরজাটি বন্ধ করে দিলে আর কেউ বের হতে পারবে না। সমস্ত শরীরের বেশিরভাগ পুড়ে যাওয়া মানুষটাও আমাদের অন্যপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। উলন এবং ইরিও উঠে দাঁড়িয়েছে— সবাই খুব ধীরে ধীরে আমাদেরকে ঘিরে ফেলছে। আমি মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম, সেগুলো কাচের চোখের মতো প্রাণহীন, নিষ্প্রভ। মানুষগুলোর চোখেমুখে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।

আমি সাবধানে এক পা পিছিয়ে এসে মিত্তিকার কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম, মিত্তিকা।

কী?

তুমি আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াও।

কেন?

এখন বলতে পারব না প্রস্তুত হয়ে থাকো।

কীসের জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকব?

জানি না।

আমি সাবধানে অস্ত্রটা হাতে নিয়ে চোখের কোনা দিয়ে চারপাশে তাকালাম, মানুষগুলো খুব নিঃশব্দ আমাদের ঘিরে ফেলে চারপাশ থেকে এগিয়ে আসছে এবং হঠাৎ আমার মনে হলো, এই প্রথম ম্যঙ্গেল ক্বাস একটু ভয় পেয়েছে। ভয়টা লুকানোর জন্যে সে চিল্কার করে বলল, দাঁড়াও সাবাই যে যেখানে আছ দাঁড়াও।

কেউ দাঁড়াল না, বরং আরো এক পা এগিয়ে এল, ম্যাঙ্গেল ক্বাস হিংস্র স্বরে চিৎকার করে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ট্রিগার টেনে ধরল। প্রচণ্ড শব্দে একঝাঁক গুলি বের হয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে ঝাঝরা করে ফেলল, কিন্তু একজন মানুষও থমকে দাঁড়াল না, কারো মুখে যন্ত্রণার একটু চিহ্নও ফুটে উঠল না। ইরি হঠাৎ করে অপ্রকৃতস্থের মতো হেসে উঠল।

ম্যাঙ্গেল ক্বাস এই প্রথম আতঙ্কিত হয়ে উঠল, সে ফ্যাকাসে মুখে একবার আমার দিকে তাকাল তারপর আবার ঘুরে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার হিংস্রভাবে গুলি করতে লাগল।

আমি দেখতে পেলাম মানুষগুলোর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেখান থেকে কোনো রক্ত বের হচ্ছে না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখতে পেলাম শরীরের ভেতর থেকে কিলবিলে কালচে রংয়ের কোনো একটা জীবন্ত প্রাণী বের হয়ে আসছে। বিভিন্ন ক্ষতস্থান থেকে অক্টোপাসের পায়ের মতো আঠালো কিলবিলে কিছু একটা বের হয়ে আসছে, আবার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ঘরের ভেতরে জান্তব চাপা একধরনের হিসহিস শব্দ শোনা যেতে থাকে।

মিত্তিকা আতংকে চিৎকার করে আমাকে আঁকড়ে ধরল, আমি একহাত দিয়ে তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, আমাকে ধরে রেখ।

আমি অন্য হাত দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা উপরের দিকে তাক করলাম, এটিকে এটমিক ব্লাস্টার হিসেবে ব্যবহার করলে মহাকাশযানের ছাদটুকু উড়িয়ে দিয়ে যাবার কথা। আমি নিঃশ্বাস আটকে রেখে ট্রিগার টেনে ধরতেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ এবং আগুনের হলকায় ঘরটি কেঁপে উঠল, মহাকাশযানের ছাদের একটা বড় অংশ উড়ে ফাঁকা হয়ে গেছে সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে বিচিত্র উপগ্রহের কুৎসিত আকাশ দেখা যাচ্ছে।

আমি একহাতে অস্ত্রটাকে ধরে রেখে অন্য হাতে জেট প্যাকটার সুইচ স্পর্শ করলাম সাথে সাথে জেট প্যাকের ক্ষুদ্র ইঞ্জিন দুটো গর্জন করে উঠল। জেট প্যাক একজন মানুষকে নিয়ে উড়ে যেতে পারে, দুজনকে নিয়ে উড়তে পারবে। কি না আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ নই কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করায় সময় নেই। মিত্তিকা নিজে থেকে তার জেট প্যাক চালাতে পারবে না— সে আগে কখনো ব্যবহার করে নি, আমি জেট প্যাকের ইঞ্জিনের উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে সেটাকে একটা শক্তিশালী ধাক্কা দেবার জন্যে প্রাণপণে লাফিয়ে উঠলাম। ঠিক সময়ে জেট প্যাকের ইঞ্জিন কান ফাটানো শব্দে গর্জন করে উঠল এবং আমরা দুজন মুহুর্তের মাঝে বিধ্বস্ত মহাকাশযানের বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া ছাদ। দিয়ে বের হয়ে এলাম। আমার মনে হলো শেষ মুহূর্তে নিচের মানুষগুলো ছুটে এসে আমাদের ধরার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমরা ততক্ষণে তাদের নাগালের বাইরে চলে এসেছি। আমি নিচে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম, একধরনের হুটোপুটি হচ্ছে বলে মনে হলো। কিন্তু ততক্ষণে আমরা অনেক দূর চলে এসেছি।

আমি মিত্তিকাকে এক হাতে কোনোভাবে ধরে রেখে বললাম, আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো মিত্তিকা।

মিত্তিকা আমাকে ধরে রেখে কাপা গলায় বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছি।

এখনই এত নিশ্চিত হয়ো না মিত্তিকা–

কেন নয়?

এই প্রাণীগুলি এত সহজে আমাদের ছেড়ে দেবে না।

মিত্তিকা ভয়-পাওয়া-গলায় বলল, কেন? একথা বলছ কেন?

প্রাণীগুলি এতদিন শুধু মৃত মানুষদের দেখেছে এই প্রথমবার তারা জীবিত মানুষ দেখছে। বুদ্ধিমান প্রাণী হলে কৌতূহল হবার কথা।

সর্বনাশ!

হ্যাঁ, প্রস্তুত থেকো। অস্ত্রটা হাতে রেখো–

কিন্তু আমি বলেছি আমি গুলি করতে পারি না। কীভাবে করতে হয় আমি জানি না—

তোমার জানতে হবে না। যখন সময় হবে তুমি জানবে।

কেমন করে জানব?

বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তি থেকে।

আমি আর মিত্তিকা মাটি থেকে শ-খানেক মিটার উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগলাম, চারপাশে সবুজাভ একধরনের কুয়াশা এবং ধুলো, আমি টের পেলাম আমার শরীরে বৈদ্যুতিক চার্জ জমা হতে শুরু করেছে। আমরা তার মাঝে উড়ে যেতে লাগলাম। মিত্তিকা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, আমি টের পাচ্ছি সে এখনো থরথর করে কাঁপছে।

কিছুক্ষণের মাঝে আমি স্কাউটশিপটা দেখতে পেলাম— অস্থিতিশীল গ্রহটির আবছা আলোতে সেটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো লাগছিল। আমি স্কাউটশিপের সাথে যোগাযোগ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমরা কাছাকাছি এসে গেছি মিত্তিকা। নামার জন্যে প্রস্তুত হও।

আমি প্রস্তুত আছি।

আমি জেট প্যাকের সুইচ স্পর্শ করে ইঞ্জিন দুটো নিয়ন্ত্রণ করে সাবধানে নিচে নেমে এলাম। হাতে অস্ত্রটি ধরে রেখে আমি দ্রত চারপাশে একবার তাকিয়ে নিই, কোথাও কিছু নেই। মিত্তিকা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে আমি শুনতে পেলাম তার স্পেস স্যুটের ভিতরে সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

আমরা স্কাউটশিপের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। আমি মিত্তিকাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম, যাও ভেতরে ঢোকো।

প্রথমে মিত্তিকা এবং তার পিছু পিছু আমি ভিতরে ঢুকলাম এবং প্রায় সাথে সাথে ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। মিত্তিকা স্কাউটশিপের দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, আমরা বেঁচে গেছি? বেঁচে গেছি ইবান?

সেটা এখনো জানি না, তবে মনে হচ্ছে বিপদের ঝুঁকি অনেকটা কমেছে। আমি নরম গলায় বললাম, নিরাপদে মহাকাশযান ফোবিয়ানে ফিরে যাবার সম্ভাবনা এখন শতকরা নব্বই ভাগ।

আমরা স্কাউটশিপের কোয়ারেন্টাইন কক্ষে দাঁড়িয়ে রইলাম, স্কাউটশিপের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি আমাদের স্পেসস্যুট থেকে সকল রকম জৈব-অজৈব পদার্থ পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। আমাদের ঘিরে নানারকম রাসায়নিক তরল ঘুরতে থাকে, শক্তিশালী আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি এসে আঘাত করে সকল বাতাস শুষে নেয়া হয়। মিত্তিকা অধৈর্য হয়ে বলল, এটা কখন শেষ হবে? কখন আমরা স্কাউটশিপ চালু করব?

এই তো এক্ষুনি।

এত দেরি হচ্ছে কেন?

কিছু করার নেই মিত্তিকা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পুরোপুরি পরিস্কার করা না হচ্ছে আমাদের এখান থেকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে না। অজানা কোনো জীবনের চিহ্ন, কোনো ভাইরাস কোনো জীবাণু নিয়ে আমরা ফোবিয়ানে। ফিরে যেতে পারব না।

কেন?

আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই।

মিত্তিকা অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগল। আমিও ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে গেছি কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না, মহাকাশযানের অধিনায়কদের নিজেদের অনুভূতি এত সহজে প্রকাশ করার কথা নয়।

একসময় কোয়ারেন্টাইন ঘরে নিরাপত্তার সবুজ আলো জ্বলে উঠল। আমি আর মিত্তিকা বায়ু নিরোধক দরজা দিয়ে স্কাউটশিপের ভিতরে ঢুকলাম। আমরা দ্রত আমাদের স্পেস স্যুট খুলে নিতে শুরু করি, যদিও নতুন এই পোশাকগুলি পুরোপুরি বায়ু নিরোধক হয়েও আশ্চর্য রকম পেলব কিন্তু তারপরেও দীর্ঘ সময় একটি বায়ু নিরোধক পরিবেশের ভেতরে থেকে যন্ত্রপাতি দিয়ে কথা বলার ব্যাপারটি স্নায়ুর উপরে একধরনের চাপের সৃষ্টি করে। স্পেস স্যুট ভল্টের মাঝে ঢুকিয়ে, অস্ত্রগুলো খুলে নিরাপদ জায়গায় রেখে আমরা স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের কাছে এসে দাঁড়ালাম। মিত্তিকা আমার কাছে এসে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, ইবান–

কী হলো?

আমার প্রাণ রক্ষা করার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমার প্রাণ তো আলাদাভাবে রক্ষা করি নি। আমি আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছি।

কিন্তু তুমি তো আমাকে নিয়ে বের হয়ে এসেছ, তুমি তো ইচ্ছে করলে জেট প্যাক ব্যবহার করে একা বের হয়ে আসতে পারতে।

আমি অবাক হয়ে মিত্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলাম, বললাম, আমি একা কেন বের হয়ে আসব?

মিত্তিকা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটাই নিয়ম। সবাই নিজের জন্যে বেঁচে থাকে। আমি সেটাই শিখেছি। সেটাই শেখানো হয়েছে।

সেটা নিয়ম না, মিত্তিকা। আমি সেটা শিখি নি।

মিত্তিকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি অন্যরকম। তোমার জিনেটিক প্রোফাইল অন্যরকম। আমি লক্ষ করছি।

আমি কিছু না বলে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে স্কাউটশিপের ইঞ্জিনের অবস্থা লক্ষ করে সেটা চালু করার প্রাথমিক ব্যবস্থাগুলো শেষ করতে থাকি। মিত্তিকা আমার পাশে দাঁড়িয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এর মাঝে সবচেয়ে ভালো

কী হয়েছে জানো?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি। ম্যাঙ্গেল ক্বাস দূর হয়েছে।

হ্যাঁ। আমি জানি না তাকে আর কোনোভাবে দূর করা যেত কি না–

মনে হয় এত সহজে যেত না। একজন খুব খারাপ মানুষকে শুধুমাত্র অন্য একজন খুব খারাপ মানুষ শায়েস্তা করতে পারে।

মিত্তিকা খুব সুন্দর করে হেসে বলল, তুমি খারাপ মানুষ নও। তুমি খুব চমৎকার একজন মানুষ। কাজেই তুমি ওর কিছু করতে পারতে না।

আমি হেসে বললাম, তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানো না, তুমি আমাকে দেখেছ মাত্র অল্প কয়েকদিন।

সেটাই যথেষ্ট। আমি অনেক মানুষকে দেখেছি, তুমি অন্যরকম। তোমার ভিতরে কিছু একটা আছে যেটা অন্যের ভেতরে নেই।

আমি সুইচ স্পর্শ করে মূল ইঞ্জিনে জ্বালানির প্রবাহ সৃষ্টি করে তাকিয়ে রইলাম, আর কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা এই অশুভ গ্রহটাকে ছেড়ে চলে যেতে পারব। মিত্তিকা আরো একটু এগিয়ে এসে বলল, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে ওরা কী করছে বলে তোমার মনে হয়?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বলা কঠিন। তবে আমাদের চাইতে সে অনেক বেশি বিচিত্র। ভয়ঙ্কর মানুষ ছিল। ম্যাঙ্গেল ক্বাস। মস্তিষ্কে আরো একটা কপোট্রন বসিয়ে রেখেছে হাইব্রিড মানুষ। যখন তার মানুষের অংশটাকে কাবু। করে ফেলা হয়— তার যন্ত্রের অংশটা দায়িত্ব নিয়ে নেয়।

কী ভয়ানক!

আর চিন্তা নেই। যন্ত্রণা দূর হয়েছে। আমি কন্ট্রোল প্যানেল দেখে মিত্তিকাকে বললাম, ইঞ্জিন চালু করার সময় হয়েছে। মিত্তিকা তুমি নিরাপত্তা বেল্ট লাগিয়ে গিয়ে বসো।

মিত্তিকা তার বসার আসনের দিকে রওনা দিয়ে হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার করে উঠল। আমি চমকে উঠে ঘুরে। তাকালাম এবং হঠাৎ করে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। স্কাউটশিপের জানালায় ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁড়িয়ে আছে সে ফিরে এসেছে!

মিত্তিকা চিৎকার করে বলল, ইবান! ইঞ্জিন চালু কর— এক্ষুনি।

আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর ঝুঁকে পড়লাম— ম্যাঙ্গেল ক্বাস স্কাউটশিপের ভিতরে ঢুকতে পারবে না তার হাতের অস্ত্র দিয়েও সহজে আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি সুইচ স্পর্শ করতে গিয়ে থেমে গেলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে কুৎসিত সাপের মতো কিছু একটা জড়িয়ে ধরেছে, সে প্রাণপণে সেই কিলবিলে জিনিসটি থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। তার মুখে আতঙ্ক, সে চিৎকার করছে।

মিত্তিকা হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো আবার চিল্কার করতে থাকে, তাড়াতাড়ি ইবান, তাড়াতাড়ি—

ইঞ্জিন চালু করতে গিয়ে আমি আবার থেমে গেলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের চোখে মুখে অনুনয়, তার জীবন ভিক্ষা চাইছে অস্ত্র দিয়ে গুলি করেও প্রাণীটির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। একজন মানুষ একটি মহাজাগতিক প্রাণী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে আমি মানুষ হয়ে সেখানে কি আরেকজন মানুষকে ধ্বংস হতে দিতে পারি?

আমি সুইচ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মিত্তিকা চিকার করে বলল, কী হলো?

ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে সাহায্য করতে হবে।

কী বললে? মিত্তিকা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, তুমি কী বললে?

বলেছি ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে এই মহাজাগতিক প্রাণীর হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

কেন? মিত্তিকা চিকার করে বলল, কেন?

কারণ, ম্যাঙ্গেলা জ্বাস একজন মানুষ। একজন মানুষ সবসময় অন্য মানুষকে রক্ষা করে।

করে না। কক্ষনো করে না— ম্যাঙ্গেল ক্বাস মানুষ নয়। দানব। আমাদের শেষ করে দেবে।

সম্ভবত। আমি শান্ত গলায় বললাম, কিন্তু আমি একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারব না।

কী বলছ তুমি? কী বলছ? মিত্তিকা চিৎকার করে উঠল, তুমি কীরকম মানুষ?

আমি মাথা নেড়ে স্কাউটশিপের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, নিচু গলায় বললাম, আমি দুঃখিত মিত্তিকা। তুমি একটু আগেই বলেছ আমি অন্যরকম মানুষ আমি একটু থেমে যোগ করলাম, মনে হয় আসলেই অন্যরকম। অন্যরকম নির্বোধ।

আমি হঠাৎ করে আমার মায়ের উপর একধরনের অভিমান অনুভব করলাম। বিচিত্র একধরনের অভিমান কেন আমার মা আমাকে এরকম একজন অর্থহীন ভালোমানুষ হিসেবে জন্ম দিয়েছিল?