বেশ রাত হয়েছে।
মনোজদের বাড়ির অবস্থা বেশ থমথমে। হারানো ছবিটা পাওয়া যায়নি বলে রাখোবাবু প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সন্ধেবেলার পর যেসব খবর এসেছে তাতে তাঁর রাগ জল হয়ে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গেছে।
প্রথমেই থানা থেকে একদল সেপাই নিয়ে দারোগা নিশিকান্ত এসে হাজির। নিশিকান্ত ভারী কড়া দারোগা, একবার তাঁর দুই ছেলে মারপিট করে একজন অন্যজনের মাথা ফাটিয়েছিল বলে তাদের দুদিন করে হাজতবাস করিয়েছিলেন। আর একবার তাঁর স্ত্রী রাগ করে বাপের বাড়ি যাওয়ায় স্ত্রীর নামে ওয়ারেন্ট বের করেন। শুধু অন্যের বেলাতেই নয়, নিজের বেলাতেও তিনি সমান কড়া। যদি চোর ডাকাত ধরতে না পারেন, কোনও অপরাধের যদি কিনারা না হয় তবে তিনি নিজে নাকে খত দেন, উপপাস করেন, কখনও বা সেপাইকে ডেকে বলেন–আমাকে দশ ঘা বেত মার তো! ভারী কালীভক্ত লোক। যদি কেউ নিশি দারোগাকে কালীর গান শোনায় তবে তাঁর ভর হয়। চিতপাত হয়ে পড়ে গোঁ-গোঁ করে মুখে গাঁজলা তোলেন। নিশি দারোগাকে সবাই তাই সমঝে চলে।
সন্ধেবেলা এসেই তিনি বাইরে থেকে হাঁক ছাড়লেন, “ভজবাবু, আমরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছি, পালাবার চেষ্টা করবেন না বা গুলি ছুঁড়বেন না। যদি গুলি ছোঁড়েন তবে আমরাও ছুঁড়ব। যদি পালান তো আমরাও পালাব–থুড়ি আমরা আপনাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলব। কোন চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।”
এমনিতে নিশিকান্ত যতই কড়া হোন না কেন, লোকে বলে তিনি ভারী ভিতু লোক। ঘুষ নেন না বটে তবে ঘুষিও চালান না। গুলিটুলি চালাতেও তাঁর অনিচ্ছে ভীষণ। চোর-ডাকাতদের পিছু নেওয়া বা বিপজ্জনক লোককে গিয়ে ধরা-টরার কাজেও তিনি নেই।
তবু তাঁর হাঁক-ডাক শুনে বাড়ির লোক সব হন্তদন্ত হয়ে বেরোল।
দুঃখবাবু মনোজ, সরোজ আর পুতুলকে পড়াচ্ছিলেন। গণেশবাবু একমনে একটা তান ধরেছেন। পুলিশের বুটের আওয়াজ আর গলার দাপট শুনে দুঃখবাবু তাড়াতাড়ি উঠে সরোজ, মনোজ আর পুতুলকে বললেন, “চলো ভিতরবাড়িতে যাই। এখানটায় গরম হচ্ছে।”
গণেশবাবুরও সুরটা কেটে গেল। বাড়িতে পুলিশ এসেছে টের পেয়ে তিনি তানপুরাটা বগলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন। ইচ্ছে, পালিয়ে যান। কিন্তু বেরোতেই বাগানের ফটক থেকে একেবারে মুখের ওপর একটা টর্চের আলো এসে পড়ল। সেই আলোতে একটা রাইফেলের নল বা পুলিশের লাঠি যাহোক একটা বস্তুও দেখা গেল। নিশি দারোগা হুংকার ছাড়লেন, “বন্দুক ফেলে দিয়ে হাত তুলুন।”
গণেশবাবু চিচি করে বললেন, “বন্দুক নয়, তানপুরা।”
“তানপুরাই ফেলুন।”
এ সময়ে রাখোবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, “এসব কী। কী হয়েছে নিশিবাবু?”
নিশিকান্ত অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বললেন, “আপনার ভাই ভজহরিবাবুর নামে ওয়ারেন্ট আছে।”
“ওয়ারেন্ট মানে? কিসের ওয়ারেন্ট?”
এই শীতেও নিশিকান্ত কপালের ঘাম মুছে বললেন, “একজন মার্ডারারকে ঘরে লুকিয়ে রেখে আর ভান করবেন না রাখোবাবু। দয়া করে ওঁর পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে হাত দুটো ভাল করে বেঁধে আমাদের কাছে এনে দিন।”
“কার পিস্তল? কে মার্ডারার? কাকে বাঁধব?”
নিশিকান্ত খুব বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, “সবই তো জানেন রাখোবাবু, কেন অভিনয় করছেন? ভজবাবু যে এত বড় মার্ডারার তা যদি আগে জানতাম। ভদ্রবেশে এত বড় খুনি এতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেউ টেরই পায়নি। কত দারোগাই তো এ শহরে এর আগে এসেছে, কেউ ধরতেও পারেনি। কিন্তু এবার ভজবাবুর খেলা শেষ। আমার হাতেই আজ এত বড় রহস্যের কিনারা হয়ে যাবে। কই, নিয়ে আসুন তাকে! সাবধান, যখন আনবেন তখন যেন পিস্তলটা হাতে না থাকে।”
রাখোবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “ভজু মার্ডারার?”
পিছন থেকে আদ্যাসুন্দরী বলে উঠলেন, “এ দারোগাটাকে পেত্নীতে পেয়েছে।”
ঠাকুমা কেঁদে উঠে বললেন, “বন্দুক পিস্তল দূরে থাক বাবা, আমার ভজু দা দিয়ে বাঁশ পর্যন্ত কাটে না, পাছে বাঁশ ব্যথা পায়।”
কিরমিরিয়া দারোগা পুলিশ দেখে বিলাপ করে কাঁদছিল, “ওগো, আমাকে ধরে নিয়ে যেও না গো। আমি কালই মুলুকমে চলে যাব গো। ভজবাবু কেন পিস্তল দিয়ে খুন করল গো!”
“চুপ কর তো কিরমিরিয়া!” বলে রাখোবাবু ধমক দিলেন।
গণেশবাবু তানপুরাসুদু হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, “হাত দুটো কি নামাব দারোগাবাবু?”
দুঃখবাবু পড়ার ঘরের দরজায় খিল এঁটে জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখেছেন। তাঁর পাশে সরোজ, মনোজ, পুতুল।
সরোজ বলল, “পিস্তল?”
মনোজ বলল, “পিস্তল।”
পুতুল বলল, “পুতুলের বাক্সে ছিল।”
দুঃখবাবু ধমক দিয়ে বললেন, “আঃ, গোল কোরো না। ইম্পট্যান্ট কথা হচ্ছে সব, শুনতে দাও।”
গোলযোগ শুনে পাড়ার লোকও এসে জড়ো হয়েছে কম নয়। তবে তারা একটু দূরে দূরে।
নিশিকান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “শুনুন রাখোবাবু, আসল অপরাধীকে কোনওদিন বাইরে থেকে চেনা যায় না। আমাদের ক্রিমিনোলজিতে দেখবেন, বেশির ভাগ অপরাধীই দেখতে এবং আচরণে অতি নিরীহ। আর এদের অপরাধ প্রবণতা অনেক নিকট আত্মীয়স্বজনও টের পায় না। কাজেই ভজবাবুকে আপনারা যত নির্দোষ ভেবে এসেছেন ততটা মোটেই নয়। এ শহরের অন্তত দশ বারোজন লোক ভজবাবুর শিকার হয়েছেন। প্রত্যেকেই অল্পের জন্য বেঁচে যান। এমন কী, আমার একটা সেপাইকে পর্যন্ত তিনি দশবার ওঠবোস করিয়েছেন। আর কী করেননি শুনি। হরশঙ্কর গয়লাকে প্রায় মেরে ফেলেছিলেন, সে হাতে পায়ে ধরে বেঁচে যায়। ইউরোপিয়ান ক্লাবে গিয়ে গুলি ছুঁড়েছেন, গোবিন্দবাবু আর শার্দুলবাবুকে আধমরা করেছেন, বাজারে গিয়েছিলেন কাকে যেন তাক করতে। সবাই এসে থানায় রিপোর্ট করেছে। আমরা ইয়ার্কি করতে আসিনি রাখোবাবু। বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে, ভজবাবুকে বের করে দিন।”
রামু এতক্ষণ বারান্দায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। চেঁচামেচি শুনে উঠে এসে বলল, “ভজবাবু? ভজবাবু তো সেই সঝাবেলা পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বললেন কী, আজ সব গুণ্ডা বদমাশ আর খারাপ লোককে ঢিট করে আসবেন।”
রাখোবাবু ধমক দিয়ে বললেন, “তা সেটা এতক্ষণ বলিসনি কেন?”
রামু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হরশঙ্কর পাহলোয়ান আমাকে এমন ঘিসা দিল কি আমার তবিয়ত খারাপ হয়ে গেল।”
দারোগাবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাখোবাবু এ লোকটার নামই কি রামু?”
“হ্যাঁ।”
“তা হলে এর নামেও একটা মোষ চুরির নালিশ আছে। এ আজ হরশঙ্করের একটা দুধেল মোষ চুরি করে এনে আপনাদের গোয়ালে বেঁধে রেখেছিল।”
এই বলে দারোগাবাবু তাঁর সিপাইদের দিকে ফিরে বললেন, “লোকটাকে আগে সার্চ করে দেখ আর্মস আছে কিনা। তারপর অ্যারেস্ট করো।”
শুনে রামু সটান মাটিতে শুয়ে চেঁচাতে থাকে, “হনুমানজিকে কিরিয়া হো পুলিশ সাহেব, চোরি আমি কভি করি না।”
নিশিকান্ত সে কান্নায় কর্ণপাত করলেন না। রাখোবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “ভজবাবু বাড়িতে নেই বলছেন?”
রাখোহরিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথায় বিশ্বাস না হয় খুঁজে দেখতে পারেন।”
“সে তো দেখতেই হবে। তবে আমার ভয় হচ্ছে, এখনো যদি ফিরে থাকেন তবে এর মধ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও আরো কয়েকজনকে খুন করেছেন বা করছেন ভজবাবু।”
ঠাকুমা ডুকরে উঠে বলেন, “না না, সে যে মশা মারতে মায়া করে।”
ঠাকুরঝি পরিষ্কার গলায় বললেন, “দ্যাখো বাবা দারোগা, সার্চ করার সময় জুতো পরে ঘরে ঢুকতে পারবে না বলে দিচ্ছি। তোমার সেপাইদেরও জুতো খুলতে বলল। এই রাতে গোবরছড়া দিয়ে মরব নাকি, সে হবে না।”
.
এদিকে তখন ডাকাতে কালীবাড়িতে ভজবাবু হাড়িকাঠে পড়ে আছেন। একটা জোয়ান ডাকাত রামদা হাতে দাঁড়িয়ে। বাজনদাররা বলির বাজনা বাজাচ্ছে। দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছেন না ভজবাবু। কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইচ্ছে করে যে অজ্ঞান হওয়া যায় না সেটা বুঝে মা কালীকে ডাকতে লাগলেন। একমনে বলতে লাগলেন, “আমাকে অজ্ঞান করে দাও মা।”
একটা ঝাঁকড়া চুলওলা ডাকাত আর একটার কানে গোঁজা বিড়ি নিয়ে খেয়ে ফেলেছে বলে দুজনে খুব ঝগড়া হচ্ছিল। পা-পোড়া মোটা ডাকাতটা পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। ডাকাতের মেজ সর্দার সেই সুন্দরমতো ছেলেটা ভজবাবুর পিস্তল নিয়ে আমোদ করার জন্যই গোটা দুই দুমদাম গুলি ছুড়ল আকাশের দিকে।
ভজবাবুর বড় তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকটা চড়চড় করছে। প্রাণপণে বললেন, “জল!”
বিড়ি-চোর ডাকাতটা সবচেয়ে কাছে। সে ভজবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “চোপ! যার বলি হবে তার আবার অত কথা কী? আর ক মুহূর্ত পরেই সব খিদে তেষ্টা মিটে যাবে।”
ওপাশ থেকে কানাই জিজ্ঞেস করল, “কী বলছে রে বাজাড়টা?”
“জল চায়।”
কানাইয়ের মায়া হল, বলল, “দে না একটু।”
খাঁড়া হাতে লোকটা খাঁড়া নামিয়ে বলল, “ওরে, তোদর আর কতক্ষণ লাগবে। বলি দিবি বলে ফেলে রেখেছিস লোকটাকে তো দেরি করছিস কেন? লোকটার এ ভাবে পড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না?”
বিড়ি-চোর ডাকাতটি ঘটি করে জল আনছিল, সুন্দর মতো ছেলেটা চোখের ইঙ্গিতে তাকে নিষেধ করে এক গ্লাস শরবত নিয়ে গিয়ে কাছে বসে ভজবাবুকে বলল, “হাঁ করুন।”
ভজবাবু চোখ বুজে রেখে হাঁ করলেন। ডাকাতটা তাঁর মুখে খানিকটা শরবত ঢালতেই শিউরে উঠে বিষম খেলেন ভজবাবু, খানিকটা পেটে গেল, খানিকটা ফেলে দিয়ে বললেন, “এ কী রে বাবা, এ তো জল নয়।”
“জলের চেয়ে দামি জিনিস। আর একটু খান। আজকের দিনে খেতে হয়। আমরা সবাই খাচ্ছি তো।”
তেষ্টায় বুক কাঠ, না খেয়ে করেন কী ভজবাবু! আবার হাঁ করে আর একটু মুখে নিয়ে চুকচুক করে খেলেন। এবার অতটা খারাপ লাগল না। আবার খেলেন। আবার।
কিছুক্ষণ পরে চোখে ঘোর-ঘোর দেখতে লাগলেন। শরবতের মধ্যে কী ছিল কে জানে, ভজবাবুর মাথাটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যেতে লাগল। ভয়ডর কেটে গিয়ে ঠাণ্ডা শরীরটা গরম হয়ে উঠতে লাগল। খুব একটা তেজ এল মনের মধ্যে। হাড়িকাঠে গলা দিয়েও হঠাৎ হুংকার ছাড়লেন, “সব ব্যাটাকে দেখে নেব! সব ব্যাটাকে দেখে নেব!”
সেই হুংকার শুনে রোগা আর ভিতু ডাকাতরা একটু দূরে সরে বসল। মেজ সর্দার ভজবাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “এই তো চাই। এ না হলে বাপের ব্যাটা! তা ভজবাবু, আজ চলুন না আমাদের সঙ্গে ডাকাতি করতে, দেখি কেমন সাহস আপনার?”
ভজবাবু একটা ফুঃ করে বললেন, “এ আর কী কথা! এক্ষুনি চলো। কার বাড়ি লুট করবে?”
“রাজবাড়ি।”
“আরে দূর দূর। রাজবাড়িতে আছে কী? আছে একটা খুঁটের পাহাড় আর নটে শাকের জঙ্গল। রাজাদের কি আর সেই দিন আছে! লুটবে তো চলো একটা ব্যাঙ্ক লুট করি।”
“না। আমরা আজ রাজবাড়ি লুট করব ঠিক করেছি। সেখানে মাটির নীচে অনেক টাকা আছে। ভয় পাবেন না তো ভজবাবু?”
ভজবাবু হাড়িকাঠে শুয়ে থেকেই খুব হেঃ হোঃ করে হেসে বললেন, “ভজহরি কখনও ভয় কাকে বলে জানে না। হাড়িকাঠের খিলটা খুলে আমার হাতে একটা পিস্তল দাও, তোমাদের দেখিয়ে দিচ্ছি।”
মেজো সর্দার বলল, “আমরা পিস্তল বন্দুক রাখি না। বড় সদারের একটা বন্দুক আছে, কিন্তু তার আজ বড় আমাশা হয়েছে বলে সে যাচ্ছে না। আর আপনার এ পিস্তলেও আর গুলি নেই।”
“ছ্যাঃ ছ্যাঃ কেমন ডাকাত হে তোমরা যে পিস্তলবন্দুক রাখো। ঠিক আছে, দারোগাবাবুকে বলে আমি তোমাদের পিস্তলের বন্দোবস্ত করে দেব। আমাকে আজকের মতো একটা রাম দা-ই দাও, কী আর করা!”
মেজ সদর হাড়িকাঠের খিল খুলে দিতেই ভজবাবু লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চেঁচিয়ে বললেন, “অ্যাটেনশন।”
সেই চেঁচানিতে ডাকাতরা আবার ভয় খেয়ে চমকে উঠল। মেজ সর্দার হেসে বলল, “তোরা সব সোজা হয়ে দাঁড়া। আজ ভজবাবুই আমাদের সর্দার।”
ভজুবাবুও মাথা নেড়ে বললেন, “আলবাত আমি সর্দার। এই কানাই, রামদা দে একটা।”
কানাই ভয়ে ভয়ে একটানা রামদা এগিয়ে দিতেই ভজবাবু সেটা হাতে নিয়ে তিন চারটে লাফ মেরে বাঁই বাঁই করে ঘোরালেন চারদিকে। তারপর একগাল হেসে বললেন, “দেখলে তো সবাই।”
সবাই তারিখ করে বলল, “বাঃ। বহুত খুব!”
ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এক বাটি মাংস নিয়ে আয়।”
বিড়ি-চোর এক বাটি ভর্তি মাংস নিয়ে এল। ভজবাবু রামদা পাশে নিয়ে বসে বললেন, “তোরাও বসে যা। রাতে অনেক কাজ আছে।”
আদ্যাসুন্দরী দেবী এক হাতে লাঠি আর এক হাতে গুলতি নিয়ে উঠোনে ঢুকবার দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রক্ত-জলকরা গলায় হেঁকে বললেন, “দ্যাখো বাবা দারোগা, ভাল চাও তো বাড়িতে ঢুকবার আগে তোমার সেপাইদের জুতো খুলতে বলল, আর তুমিও খোলো। জুতো পরে যে ঢুকবে, তার আমি রক্ষে রাখব না।”
নিশি দারোগা গম্ভীর হয়ে বললেন, “ডিউটির সময়ে আমাদের জুতো খুলবার আইন নেই পিসিমা, আমাদের কাছে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না। মারাত্মক খুনিকে ধরতে এসেছি আমরা, ইয়ার্কির সময় নেই।”
আদ্যাসুন্দরীদেবী জীবনে কাউকে ভয় করেননি। গত বছরও গ্রীষ্মকালে একটা চোর জানালা দিয়ে গেঞ্জি চুরি করার চেষ্টা করেছিল বলে আদ্যাসুন্দরী হাত বাড়িয়ে তার কান মলে দেন। তা ছাড়া গুলতিতে তাঁর হাতের টিপের কথাও সবাই জানে। ব্রত-পার্বণে আম্রপল্লব বেলপাতা দরকার হলে তিনি নিজেই গাছে গুলতি মেরে-মেরে আমপাতা বেলপাতা পেড়ে আনেন। কাজেই আদ্যাসুন্দরী দেবীকে যারা জানে, তারা চট করে এ বাড়িতে ঢোকে না, একটু চিন্তা করে ঢোকে।
কিন্তু নিশি দারোগা করেন কী? চাকরি বাঁচাতে তাঁকে তো বাড়িতে ঢুকতেই হবে, তা ছাড়া এত লোকের চোখের সামনে যদি তাঁকে বা সেপাইদের জুতো খুলতে হয়, তবে সেটা পুলিশের পক্ষে বেইজ্জতির ব্যাপার।
কিন্তু আদ্যাসুন্দরীদেবীর এক কথা। “খুনি ধরতে বারণ করছে কে? কিন্তু জুতো পায়ে বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। রাজ্যের নোংরা আবর্জনা মাড়িয়ে এসেছ বাবা, রাত-বিরেতে কে গোবর গুলে ছড়া দেবে!”
দারোগাবাবু মিনমিন করে বললেন, “আইন নেই, পিসিমা। আমরা ছাপোষা মানুষ, কেন আমাদের লাঠিসোটা দেখাচ্ছেন?”
“দেখাচ্ছি কী! যে ঢুকবে জুতো নিয়ে, তার কপালে লাঠির ঘা আছে আজকে।”
কিন্তু সেপাইরা তো আর ঘাসজল খায় না। তারাও নানারকম লেক চরিয়েছে। মেলা ফন্দি-ফিকির জানে।
হঠাৎ হল কী, সেপাইরা সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। তারপর অন্ধকারে এধার সেধার দিয়ে টপাটপ সব লাফিয়ে লাফিয়ে দেওয়াল ডিঙোতে শুরু করে দিল। বুট-মেত সেপাইরা ঝুপঝাঁপ করে ভিতরের উঠোনে পড়ছে। আদ্যাসুন্দরীদেবী মহা খাপ্পা হয়ে ছোটাছুটি করে হাতের কাছে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ফটাফট লাঠি লাগাচ্ছেন। কিন্তু একা তিনি কতজনের সঙ্গে পেরে উঠবেন? ওদিকে দরজা ছাড়া পেয়ে আরও সেপাই ঢুকে পড়েছে উঠোনে। আদ্যাসুন্দরী দেবী চেঁচাচ্ছেন, “ডাকাত! ডাকাত! ওরা তোরা পুলিশে খবর দে!”
নিশি দারোগা কপালের ঘাম মুছে রাখোবাবুকে বললেন, “ওরে বাবা, জীবনে এরকম সিচুয়েশন ফেস করিনি। তা আপনাদেরও বোধহয় এ বাড়িতে একটু ভয়ে-ভয়েই থাকতে হয়, তাই না? ওরকম ডেঞ্জারাস পিসিমা আর মার্ডারার ভাই বাড়িতে থাকলে তো মহা বিপদের কথা মশাই।”
রাখোবাবু খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “কোথাও কিছু-একটা গণ্ডগোল হচ্ছে নিশিবাবু।”
“সে তো হচ্ছেই।” নিশি দারোগা গম্ভীর হয়ে বলেন, “খুব গণ্ডগোল হচ্ছে। আমি যতই শান্তি চাই, ততই অশান্তি এসে কপালে জোটে। আপনারা কিছুতেই আমাকে দু দণ্ড চুপচাপ বসে মায়ের নাম করতে দিচ্ছেন না।”
গণেশবাবু এখনও তানপুরা ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। এবার একটু সাহস পেয়ে বললেন, “দারোগাবাবু, তানপুরাটা কি নামাব?”
দারোগাবাবু অবাক হয়ে বলেন, “তানপুরা নামাবেন, তা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? তানপুরা নামাতে তো পুলিশের পারমিশন লাগে না! তবে এটা গান-বাজনার সময় নয় বটে। তা তানপুরা তুলল কে?”
গণেশবাবু বললেন, “আপনি আমাকে হাত তুলতে বললেন যে!”
“তানপুরা তুলতে বলিনি তো!”
“হাতে তানপুরা ছিল যে!” দারোগাবাবু একগাল হেসে বললেন, “তাই বলুন, হাতে তানপুরা ছিল। তা তানপুরা নিয়ে যাচ্ছিলেন কোথায়?”
গণেশবাবু যে পালাবার তালে ছিলেন, তা আর বললেন না, একটু অপ্রস্তুতভাবে বললেন, “কোথাও বিশেষ নয়। এই একটু বেড়াতে যাচ্ছিলাম আর কী।”
দারোগাবাবু ভারী অবাক হয়ে বলেন, “লোকে ছাতা বা লাঠি হাতে বেড়াতে বেরোয় বটে, কিন্তু তানপুরা নিয়ে কাউকে বেড়াতে শুনিনি তো!”
এইসব কথা যখন হচ্ছে তখন হঠাৎ ভিতরবাড়ি থেকে সেপাইদের আর্ত চিৎকার শোনা গেল। ঝপাঝপ দেয়াল ডিঙিয়ে সেপাইরা এ-পাশে পড়ে পালাচ্ছে।
দেখে নিশি দারোগাও বাবা রে বাবা বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাখোবাবু তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনারা কিছু হয়নি। ও নিশিবাবু, আপনি চেঁচাচ্ছেন কেন? আপনার কিছু
হয়নি।”
হয়েছে কী, বাইরে যখন এত সব কাণ্ড চলছে, তখন বৈজ্ঞানিক হারাধন তার গবেষণাগারে গবেষণার কাজে মগ্ন হয়ে ছিল।
চারদিকের এত হইচই তার কানেও যায়নি।
ওদিকে মনোজ সরোজ আর পুতুল যখন দেখল, ঠাকুরঝির সঙ্গে পুলিশদের মহা হাঙ্গামা বেধেছে, আর পুলিশ জোর করে ঘরে ঢুকছে তখন তিনজন আর থাকতে পারল না।
মনোজ বলল, “ছোটকাকা।”
সরোজ বলল, “ঠিক বলেছিস! ছোটকাকা ছাড়া উপায় নেই।”
পুতুল বলল, “ছোটকাকা ঠিক শিক্ষা দিয়ে দেবে।”
বলতে বলতে তিনজন দৌড়ে গিয়ে দরজার খিল খুলতে লাগল। দুঃখবাবু হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে বললেন, “করো কী, করো কী! ফাঁক পেলেই পুলিশ ঢুকে পড়বে।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! দরজা খুলে দুদ্দাড় তিন ভাই-বোনে বেরিয়ে পড়ল। অন্ধকারে বাগান পেরিয়ে তারা সোজা গিয়ে হাজির হল ছোটকাকার ল্যাবরেটরিতে।
হারাধনের ল্যাবরেটরি দেখলে তাক লেগে যায়। সেখানে কী নেই? বাগানের দিক থেকে ঢুকলে প্রথমেই পড়বে বিরাট একটা উদ্ভিদ-ঘর। কাঁচের শার্শি দেওয়া এই ঘরটায় নানান ধরনের টবে কিম্ভুত সব গাছপালা। তাতে চাগম (চাল+গম), লামড়ো (লাউ+কুমড়ো) ইত্যাদি গাছও আছে। এ ঘর পেরোলে একটা অন্ধকার-মতো ঘর। চামসে গন্ধে সেখানে টেকা দায়। এ-ঘরে অসংখ্য খাঁচায় রাজ্যের পাখি রাখা আছে। পাখিদের মধ্যে কাক, শালিখ, পায়রা থেকে শুরু করে ধনেশ, চিল, শকুনের মতো বিচিত্র সব নমুনা আছে। আর-একটা ঘরে বানর, গিনিপিগ, ব্যাং, খরগোশ, সাদা ইঁদুর। তার পাশের ঘরের নানান ঝাঁপিতে সাপ, বিছে, কীট-পতঙ্গ। এ ছাড়া একটা রসায়ানাগার, একটা পদার্থবিদ্যার ঘর আর একটা টেলিস্কোপ-ঘরও আছে।
মনোজ সরোজ পুতুল আলাদা হয়ে তিনজনে তিন ঘরে হারাধনকে খুঁজতে থাকে।
পুতুলই ছোটকাকাকে খুঁজে পেল পাখির ঘরে। সেখানে বৈজ্ঞানিক হারাধন একটা কাকের খাঁচার সামনে বসে একমনে একটা প্যাডে কী লিখছে।
পুতুল হাঁফাতে-হাঁফাতে ছুটে গিয়ে বলে, “ছোটকাকা, পুলিশ! মেজকাকাকে ধরতে এসেছে। কী ভীষণ কাণ্ড দেখবে চলো।”
বৈজ্ঞানিক হারাধন এত চিন্তাকুল যে, প্রথমটায় পুতুলকে চিনতেই পারেনি। অনেকক্ষণ বাদে চিনতে পেরে বলল, “কী বলছিস?”
পুতুল তখন খাঁচাটার মধ্যে রাখা কাকটাকে একমনে দেখছে। কাকটার গলায় এখনও পৈতে জড়ানো, পায়ে একটা ঝুমঝুমির মতো কী যেন বাঁধা। খুবই চেনা কাক।
পুতুল অবাক হয়ে বলল, “আরে! এই কাকটাই তো সকালে আমাদের বাড়িতে কুরুক্ষেত্র করেছে। এটার জন্যই কত সব কাণ্ড হয়ে গেল! তুমি কাকটাকে ধরলে ছোটকাকা?”
হারাধন বিরক্ত হয়ে বলে, “ধরব কেন? এটা তো আমারই কাক। সকালে ছেড়ে দিয়েছিলাম এক্সপেরিমেন্টের জন্য। তারপর বিকেল হতেই আবার নিজে থেকে এসে খাঁচায় ঢুকেছে।”
“তোমার কাক! তোমার কাক এত বদমাশ কেন বলো তো!” হারাধন একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে বলে, “বদমাশ হবে কেন? একটু তেজী আর কী! অন্য চার-পাঁচটা সাধারণ কাকের মতো নয়। তা সে ওর দোষ নয়, আমিই নানারকম ওষুধ আর ইলেকট্রিক চার্জ দিয়ে দিয়ে এটাকে ওরকম বানিয়েছি। এ আর কী দেখছিস! চারটে যা হনুমান বানিয়েছি না, তারা একেবারে ডাকাত। ছেড়ে দিলে লঙ্কাকাণ্ড করে আসবে।”
পুতুল হারাধনের হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “হনুমানের কথা পরে। আগে চলো। পুলিশের সঙ্গে ঠাকুরঝির মারামারি হচ্ছে যে!”
“বলিস কী!” বলে হারাধন লাফিয়ে ওঠে।
“শুধু তাই বুঝি! পুলিস আবার মেজকাকুকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। যা বিচ্ছিরি কাণ্ড না, আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।”
হারাধন দুই লাফে ল্যাবরেটরি পার হয়ে উঠোনের দিকে দরজা খুলে দেখে, বাস্তবিক সারা উঠোন জুড়ে তাণ্ডব শুরু হয়েছে। পাঁচিল টপকে টপকে সব সিপাইরা উঠোনে নামছে আর ঠাকুরঝি প্রকাণ্ড লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করছে। কিন্তু তারা কাবাডি খেলোয়াড়ের মতো ঠাকুরঝির লাঠির নাগাল এড়িয়ে দৌড়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। ঠাকুরঝি চেঁচাচ্ছেন, “ডাকাত! ডাকাত! ওরে তোরা কেন পুলিশকে খবর দিচ্ছিস না?”
ঠিক এই সময়ে অন্ধকারে সতীশ ভরদ্বাজ মশাইও উঠোনে ঢুকে পড়েছেন। তিনি বললেন, “উঁহু, এরা ডাকাত নয়, এরা হল পুলিশ। আপনি বরং ডাকাতদের ডাকুন, নইলে এ পুলিশদের ধরবে কে?”
আদ্যাসুন্দরীর তখন হুঁশ হল। তিনি একটা রোগা পুলিশের ঠ্যাঙে পটাং করে লাঠির ঘা বসিয়ে নতুন করে চেঁচাতে লাগলেন, “ওগো, তোমরা কে কোথায় আছ, শিগগির ডাকাতদের খবর দাও। আমাদের বাড়িতে পুলিশ পড়েছে।”
তখন চারদিকে আরও কয়েকজন চেঁচাল, “ওরে, শিগগির ডাকাতদের খবর দে, এবাড়িতে পুলিশ ঢুকেছে।”
হারাধন দৃশ্যটা দু মিনিট দাঁড়িয়ে দেখল। তার দুধারে পুতুল, সরোজ, মনোজ। তারপর ধীরে ধীরে ভাইপো-ভাইঝিদের হাত ধরে ঘরে টেনে এনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “শোন্, এখন আমি যে ব্যবস্থা করব তা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলবি না। আমার সন্দেহ হচ্ছে পুলিশের ছদ্মবেশে অন্য কোনও রাষ্ট্রের চর আমার ফরমুলা চুরি করতে এসেছে। এদের শিক্ষা দেওয়া দরকার।”
বলে হারাধন গটগট করে গিয়ে তার জীবজন্তুর ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সরোজ, মনোজ আর পুতুল। ঘরের একেবারে কোণের দিকে চারটে বিশাল খাঁচা। সেগুলোর চারদিকে চটের পর্দা ফেলা। হারাধন গিয়ে খাঁচার পা তুলে দিল। ভিতরের দৃশ্য দেখে সরোজ মোজ আর পুতুলের চোখ ছানাবড়া। তারা তাড়াতাড়ি ছোটকাকার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
খাঁচার ভিতরে চারটে বিশাল চেহারার হনুমান। এত বড় হনুমান যে থাকতে পারে, তা তিন ভাইবোনের জানাই ছিল না। সরোজ প্রথমটায় বলে উঠল, “গোরিলা।”
“বনমানুষ!” পুতুল বলে ওঠে।
মনোজ বলল, “না, হনুমান। তবে বড় বড়।”
হারাধন খাঁচার দরজার তালা খুলতে খুলতে বলল, “এ হচ্ছে গোরিমান।”
“তার মানে?” সরোজ জিজ্ঞেস করে।
মনোজ ছোটকাকার ব্যাপার-স্যাপার ভালই জানে, সে তাই বলে উঠল “খানিকটা গোরিলা, খানিকটা হনুমান, না ছোটকাকা?”
“হুঁ। তবে ওষুধ দেওয়া হনুমান, আর পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের কারসাজি। তোরা দৌড়ে গিয়ে বাড়ির লোকজনকে সব ঘরে ঢুকে যেতে বল। আমি হনুমান ছেড়ে দিচ্ছি। তারপর লঙ্কাকাণ্ড কাকে বলে তা সবাই টের পাবে।”
সরোজ, মনোজ আর পুতুল দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরঝি, ঠাকুমা, মা, কিরমিরিয়া সবাইকে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে লাগল। আর সেই সময়ে আধো অন্ধকারে অতিকায় চারটে বিভীষিকা বিভীষণ লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে এসে পিলে চমকানো ডাক ছাড়ল “গাপ! ধর! গাপ! ধর।”
সে-ডাক শুনলে রক্ত জল হয়ে যায়, সে-চেহারা দেখলে ভিরমি খেতে হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, তারা এক একটা পুলিশকে নেংটি ইঁদুরের মতো এক-এক হাতে তুলে যখন এ-ধার ওধার ছুঁড়ে ফেলছিল, তখন তাদের এলেম দেখে সবাই তাজ্জব।
প্রথমটায় পুলিশরা ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। একজন আবার একটা হনুমানকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়েও উঠেছিল, “এইবার খুনিকে ধরেছি।” তারপরই সে হঠাৎ তারস্বরে বলতে লাগল, “না না, এর যে লেজ রয়েছে! ও বড়বাবু, খুনির কি লেজ আছে নাকি?”
তারপরই দেখা গেল হনুমানকে জড়িয়ে ধরেছিল যে পুলিশটা, সে শুন্যপথে উড়ে পাঁচিলের ওধারে পড়ল। একজন পুলিশ গিয়ে পড়ল টিনের চালে। হনুমানদের একজন দুটো পুলিসকে দু বগলে নিয়ে মহানন্দে এক চক্কর নাচ নেচে নিল।
সতীশ ভরদ্বাজ ঘর থেকে জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে বললেন, “আদ্যাদিদির ডাকের গুণ আছে। এ যে দেখছি চার-চারটে পালোয়ান ডাকাত! না..না…ডাকাত তো নয়! সর্বনাশ! এ যে স্বয়ং রামচন্দ্রের ভক্ত। ও আদ্যাদিদি, কলিকালে দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে ম্লেচ্ছরা ধর্ম মানতে চায় না। কিন্তু নিজের চোখে সবাই এসে দেখুক ভক্তের বিপদের সময় ভগবান তাঁর অনুচর পাঠান কিনা। ওই দেখ সবাই, দু চোখ ভরে চেয়ে দেখ, স্বয়ং রামভক্ত হনুমানেরা এসেছেন!…আহা! কী করাল বিশাল চেহারা! কী সাংঘাতিক গায়ের জোর! …জয় বাবা হনুমানের জয়!”
বাইরে রামু আর রঘুও বিকট সুরে চেঁচাচ্ছিল, “জয় বজরঙ্গবলী! জয় মহাবীর হনুমানজিকি! জয় রামভগবানকি! জয় জানকী মায়জিকি!”
সেই বিশাল হনুমানের মারমূর্তি দেখে পুলিশরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দুদ্দাড় দৌড়ে পালাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে সব ফর্সা। খালি উঠোনে হনুমানগুলো লাফাচ্ছে। আদ্যাশক্তিদেবী তাড়াতাড়ি ঠাকুরঘর থেকে এককাঁদি কলা নিয়ে উঠোনে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “খাও, বাবারা খাও।”
হারাধন দরজার আড়াল থেকে সাঙ্কেতিক শিস দিতেই হনুমানগুলো কলার কাঁদি নিয়ে চোখের পলকে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেল।
বাইরে নিশি দারোগা, রাখোবাবু, দুঃখবাবু, গণেশবাবু বা পাড়ার লোকজন কেউ কিছু বুঝতে পারলেন না কাণ্ডটা কী! সবাই দেখলেন, সেপাইরা কার যেন তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে। একজন সেপাইও অবশ্য দাঁড়াল না, যাকে ধরে জিজ্ঞেস করা যায় যে ব্যাপারটা কী, সবাই পাঁই পাঁই করে ছুটে পালাল।
নিশি দারোগা দুহাতে রাখোবাবুকে জাপটে ধরে চেঁচাতে লাগলেন, “বাবা রে, বাবা রে! ভূত! ডাকাত! খুনি! রাখোবাবু, রক্ষে করুন।”
দুঃখবাবু তাঁর খিল-আঁটা ঘরের মধ্যে থেকেও ভয়ে পড়ার টেবিলের তলায় ঢুকে গেলেন। গণেশবাবু তানপুরাটা গদার মতো ঘঘারাতে ঘোরাতে চেঁচাতে লাগলেন, “আমার কাছে কেউ এলে খুন করে ফেলব বলে দিলাম।”
হনুমানরা চলে গেছে দেখে সতীশ ভরদ্বাজ বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “এখন ওই ঘোর নাস্তিক হারাধনটাকে ডেকে নিয়ে এসো। দেখে যাক ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কিনা! দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে সব পণ্ডিত হয়েছে। আমার হাঁদুর্ভুদুকে তুচ্ছজ্ঞান করে। একদিন বুঝবে ঠেলা, তখন এসে হাতে-পায়ে ধরে বলতে হবে, ঠাকুরমশাই, ধর্মে বিশ্বাস না করে বড় অন্যায় করেছি।
সেপাইরা সব পালিয়েছে। দারোগাবাবু একা বাড়ি ফিরতে সাহস করছে না। রাখোবাবু রঘুকে ডেকে টর্চ হাতে দিয়ে বললেন, “যা, দারোগাবাবুকে এগিয়ে দিয়ে আয়গে যা।”
বাড়ি আবার ঠাণ্ডা হলে রাখোবাবু সবাইকে ডেকে মিটিং বসালেন। বললেন, “ভজুটার কোনও খোঁজ নেই। বাড়ির মেয়েরা বাদে সবাই লাঠি, টর্চ বা হ্যারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। তাকে খুঁজে না আনা পর্যন্ত রহস্যটা পরিষ্কার হবে না। আর এও বোঝা যাচ্ছে না, পুলিশরা হঠাৎ সার্চ থামিয়ে পালাল কেন! সবাই তোমরা বলছ বটে হনুমানে তাড়া করেছিল। কিন্তু তাতে ঘটনাগুলো আরও জট পাকাচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে, হনুমানই বা এল কোত্থেকে! হনুমানগুলোকেও খুঁজে দেখ। এবাড়িতে তো তাদের উৎপাত ছিল না!”
এই কথা শুনে হারাধন খুব গম্ভীর হয়ে গেল। আর মনোজ, সরোজ, পুতুল নিজেদের মধ্যে গা-টেপাটেপি করতে লাগল।
সতীশ ভরদ্বাজ জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, “ভক্তের ডাকে স্বয়ং ভগবান তাদের পাঠিয়েছিলেন। তাদের আর কোথায় খুঁজবে?”
খোঁজাখুঁজির নামে দুঃখবাবু বলে উঠলেন, “আমার পায়ে বড় ব্যথা।”
গণেশবাবু বললেন, “আমারও। আমি বরং বাড়ি পাহারা দেব।”
রাখোবাবু তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছাত্রছাত্রীদের সামনে কোনও কাপুরুষতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন না। ভজুকে খুঁজে না-পেলে অনেক গোলমাল দেখা দেবে।”
তারপর রাখোবাবু সকলের দিকে চেয়ে বললেন, “আর দেরি নয়। সবাই বেরিয়ে পড়ো। বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য পিসিমা একাই যথেষ্ট। তিনি আজ পুলিশের বিরুদ্ধে যে পৌরুষ দেখিয়েছেন, তা কোনও পুরুষেও দেখাতে পারেনি। কাজেই আমি তাঁর ওপর বাড়ি দেখাশোনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত। পুরুষরা সবাই ভজুকে খুঁজতে যাবে।”
একথার পর সবাই উঠে পড়ল।
শরবতের গুণে ভজবাবুর ভারী ফুর্তি এসে গেছে। এত ভাল লাগছে তাঁর যে বলার নয়। মাঝে মাঝে গান গেয়ে উঠছেন।
রাত বারোটা বেজে গেল। ভরপেট মাংস আর ভাত খেয়ে ডাকাতরা খানিক গড়াগড়ি দিয়ে উঠে পড়েছে। পুরুতমশাই সকলের কপালে তেল সিঁদুর আর যজ্ঞের কালি লাগিয়ে দিয়েছেন। কানে জবা ফুল গোঁজা।
ভজবাবু মন্দিরের চাতালে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে হাতে খাঁড়া নিয়ে রক্তচোখে সব দেখছিলেন। একটা হাঁক দিয়ে বললেন–সব লাইন করে দাঁড়া।
ডাকাতরা চটপট দাঁড়িয়ে গেল। সুন্দরমতো মেজ-সদার ভজবাবুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে চেয়ে ভজবাবু এক গাল হেসে বললেন, “দেখলে! সবাই কেমন আমাকে মানে!”
“আপনার কথা আলাদা।”
“হে হে” বলে ভজবাবু নিজের হাতের খাঁড়াটা আবার বাঁই বাঁই করে চারদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ডাকাতদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “ভাইসব, আজ বড় আনন্দের দিন। আমি কথা বলতে পারছি না। আজ আমার কথাগুলি সব আনন্দের চোটে গান হয়ে যেতে চাইছে। তা ভালই। আমি গানে গানেই তোমাদের আদেশ করব। তোমরা সেইমতো চলবে। কেমন?”
ডাকাতরা একবাক্যে বলে ওঠে, “সদারের যেমন হুকুম।”
ভজবাবু গলাটা একটু সাফ করে নিয়ে গেয়ে উঠলেন, “হে দস্যবর্গ, হাতে নাও খঙ্গ, চলো যাই লুণ্ঠনকর্মে..”
ডাকাতরা সবাই ঝটপট খাঁড়া, তলোয়ার, লাঠি আর বল্লম যে যা পারল হাতে নিয়ে দাঁড়াল।
ভজবাবু এবার অন্য গান ধরলেন, “চল রে চল, বন্ধুদল, সামনে চল্ সবাই…”
ডাকাতরা চলতে থাকে। সবার সামনে ভজবাবু আর মেজ সদার। মেজ সদারের হাতে একটা মশাল জ্বলছে।
ভজবাবু খাঁড়া ঘুরিয়ে গাইতে লাগলেন, “বিঘ্ন বন্ধ, খানা ও খন্দ ডিঙিয়ে চল সবাই…”