৫. মগনলাল আন্দাজ করছে

॥ ৫ ॥

ফোন না করে দুপুর বারোটা নাগাত জয়চাঁদবাবু নিজেই এসে হাজির। মগনলালের সঙ্গে তাঁর কী ঘটল না ঘটল বর্ণনা দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি মুক্তোর ব্যাপারটা কী করবেন?’

ফেলুদা বলল, ‘যদ্দূর বুঝতে পারছি, মগনলাল আন্দাজ করছে যে মুক্তোটা আমার কাছে রয়েছে। লোকটা অত্যন্ত তুখোড়। সোজাসুজি যদি আমার কাছে এসে পড়ে তা হলেও আশ্চর্য হব না। যে জিনিসটা এতকাল আপনাদের ফ্যামিলিতে ছিল, সেটা এখন হাতছাড়া হয়ে যাওয়াতে আপনার মন খারাপ লাগবে সেটাও আমি বুঝি। কিন্তু তাও আমি বলব যে মুক্তোটা আমার কাছেই থাক। আপনার কাছে থাকলে ও যেন-তেন-প্রকারেণ ওটা আদায় করে নেবে। সেটা ভালো হবে না।’

জয়চাঁদ রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি বিক্রি না করলে ত ও মুক্তোটা এমনিতেই পাবে না। আপদ বিদেয় হোক, তারপর ওটা আমার কাছে ফিরে যেতে পারে।’

‘ঠিক কথা,’ বলল ফেলুদা। ‘আপনি আজই ফিরছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সন্ধ্যের গাড়িতে।’

‘কোনো খবর থাকলে জানাতে ভুলবেন না।’

পরদিন সকালে সাড়ে সাতটার সময় ফোন এল। সোনাহাটি থেকে। সোমেশ্বর সাহা। ফেলুদা কথা বলা শেষ করে ফোনটা রেখে গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘কাল রাত্তিরে ট্রেনে জয়চাঁদ বড়ালের মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে কে বা কারা যেন তার বাক্স সার্চ করে। জিনিসপত্র সব ছত্রাকার হয়ে পড়ে ছিল। অবিশ্যি সোনাহাটি আসবার আগেই ভদ্রলোক জ্ঞান ফিরে পান।’

আমি বললাম, ‘এ-ও ত মগনলালেরই ব্যাপার।’

‘নিশ্চয়ই,’ বলল ফেলুদা। ‘লোকটা কোনরকম সুযোগ ছাড়ে না। ভাগ্যিস মুক্তোটা আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম।’

একটা নতুন কেসের গন্ধ পেলে জটায়ু মাঝে মাঝে বিকেলেও এসে হাজির হন। আজও তাই হল। বললেন, ‘মনটা পড়ে রয়েছে এখানে তাই বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না।’

ফেলুদা লেটেস্ট খবরগুলো লালমোহনবাবুকে দিয়ে দিল।

‘তা হলে ত মনে হচ্ছে ওঁর পায়ের ধুলো এবার এখানে পড়বে। ও ত নির্ঘাত বুঝে গেছে যে মুক্তোটা আপনার কাছে রয়েছে।’

লালমোহনবাবু কথাটা বলার পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাইরে একটা গাড়ি এসে যাবার শব্দ পেলাম। তারপর দরজার বেল বেজে উঠল। খুলে দেখি আসল লোক এসে হাজির।

‘মে আই কাম ইন, মিস্টার মিটার?’ বললেন মগনলাল।

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’

ভদ্রলোক ঢুকে এলেন। সেই কালো শেরওয়ানি আর ধুতি, পায়ে মোজা আর পাম্প শু।

‘অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল কি আপনার বাড়িতে একবার আসি। আমাদের এতদিনের দোস্তি—হে হে হে! আঙ্কল কেমন আছেন?’

লালমোহনবাবুকে মগনলাল যা নাস্তানাবুদ করেছে, ভদ্রলোক আর কোনোদিন মগনলালের সামনে স্বাভাবিক হতে পারবেন বলে মনে হয় না। শুক্‌নো গলায় জটায়ু উত্তর দিলেন, ‘ভালো আছি।’

‘চা খাবেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘না স্যার। নো টী। আমি আপনার বেশি সময় নেব না। আমি কেন এসেছি তা বোধহয় আপনি বুঝতে পারছেন।’

‘তা বোধহয় পারছি।’

‘তা হলে আর টাইম ওয়েইস্ট করার দরকার নেই। হোয়ার ইজ দ্যাট পার্ল?’

‘মিস্টার বড়ালের কাছে যে নেই তা ত আপনি জানেন। আপনার লোক ত ট্রেনে তাঁকে ঘায়েল করে তাঁর বাক্স সার্চ করে মোতি খুঁজে পায়নি।’

‘আমার লোক?’

‘তা ছাড়া আর কার লোক হবে বলুন।’

‘আপনি এভাবে বলবেন না, মিস্টার মিটার। আপনার কোনো প্রমাণ নেই যে আমার লোক কাজটা করেছে।’

‘আপনার ক্ষেত্রে প্রমাণের দরকার হয় না, মগনলালজী। আপনার কাজ মার্কামারা কাজ। সে কাজ আমি দেখলেই বুঝতে পারি।’

‘আমি আবার জিজ্ঞাসা করছি—সে পার্ল কোথায় আছে?’

‘আমার কাছে।’

‘ওটা আমার দরকার।’

‘যা দরকার তা কি সব সময়ে পাওয়া যায়?’

‘মগনলাল মেঘরাজ ক্যান অলওয়েজ গেট ইট। কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, মিস্টার মিটার। আমার ওই পিংক পার্ল চাই। না হলে, আপনি ত জানেন, আমি যেমন করে হোক ওটা আদায় করে নেবো।’

‘তা হলে সেটাই করুন, কারণ মুক্তো আমি আপনাকে দিচ্ছি না।’

‘দেবেন না?’

‘ভদ্রলোকের এক কথা।’

‘তা হলে আমি আসি।’ মগনলাল উঠে পড়লেন। ‘গুড বাই, আঙ্কল।’

‘গুড বাই,’ ক্ষীণস্বরে বললেন জটায়ু।

দরজার কাছে গিয়ে মগনলাল নেমে ফেলুদার দিকে ঘুরলেন। তারপর বললেন, ‘আমি তিন দিন সময় দিচ্ছি আপনাকে। আজ সোমবার। সোম, মঙ্গল, বুধ। বুঝেছেন?’

‘বুঝেছি।’

মগনলাল বেরিয়ে গেলেন।

লালমোহনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না মোটেই। দিয়ে দিন মশাই, দিয়ে দিন। আর আপনি কাছেই বা আর কত দিন রাখতে পারবেন। বড়ালকে ত তাঁর জিনিস ফেরত দিতে হবে—তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এত সাধের জিনিস।’

‘যদ্দিন মুক্তো বেহাত হবার আশঙ্কা আছে ততদিন এটা বড়ালকে ফেরত দেওয়া যাবে না। সব সংশয় কাটিয়ে উঠলে পর যেখানের মুক্তো সেখানে যাবে।’

‘কিন্তু বড়াল যে এক মহারাজার কথা বলছিল তার সম্বন্ধেও ত একটু খোঁজ নেওয়া দরকার।’

‘সে খোঁজ দিতে পারেন সিধু জ্যাঠা। বহুদিন জ্যাঠার সঙ্গে দেখা হয়নি। চলুন একবার ঘুরে আসি।’

‘জায়গার নামটা মনে আছে?’

‘ধরমপুর।’

‘আর মহারাজার নাম?’

‘সূরয সিং।’

আমরা লালমোহনবাবুর গাড়িতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিধু জ্যাঠার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। জ্যাঠা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে একটা পুরনো পুঁথি পরীক্ষা করছিলেন, আমাদের দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

‘তোমরা কে? তোমাদের ত আমি চিনি না।’

ফেলুদা হেসে বলল, ‘অপরাধ নেবেন না জ্যাঠা। পসারটা একটু বেড়েছে বলে আর লোকজনের বাড়িতে বিশেষ যাওয়া হয় না। আমি যে কাজে উন্নতি করছি তাতে আপনি নিশ্চয়ই খুশি।’

এবার সিধু জ্যাঠার মুখে হাসি ফুটল।

‘ফেলু মিত্তির—তোমাকে কি আমি আজ থেকে চিনি? আট বছর বয়সে এয়ার গান দিয়ে শালিক মেরে এনে আমায় দেখিয়েছিলে। আমি বলেছিলাম নিরীহ জীবকে আর কক্ষনো মারবে না—কথা দাও। তুমি সেদিন থেকে পাখি মারা বন্ধ করেছিলে। গোয়েন্দাগিরিতে পসার হচ্ছে বলে আমার কাছে বড়াই কোর না। গোয়েন্দা আমিও হতে পারতাম। তার সব গুণই আমার ছিল। এখনও আছে। তবে কোনোরকম কাজে বাঁধা পড়া আমার ধাতে সয় না। আমার সময় যদি আমি নিজে ইচ্ছামতো ব্যয় না করতে পারি তা হলে লাভটা কী? শার্লক হোম্‌সের এক দাদা ছিল জানতে? মাইক্রফ্‌ট হোম্‌স। জাত কুঁড়ে, কিন্তু বুদ্ধিতে সত্যিই শার্লকের দাদা। সেই দাদার কাছে শার্লক মাঝে মাঝে যেতো পরামর্শ নিতে। আমি হচ্ছি সেই মাইক্রফ্‌ট। যাক্ গে, এখন বল কি জন্যে আগমন?’

‘একজন লোক সম্বন্ধে আপনার কাছে কোনো ইনফরমেশন আছে কিনা জানতে এসেছিলাম।’

‘কে সেই ব্যক্তি?’

‘আপনি ধরমপুরের নাম শুনেছেন?’

‘শুনব না কেন? উত্তরপ্রদেশের একটা করদ রাজ্য ছিল। আলিগড় থেকে সাতাত্তর মাইল দক্ষিণে। ট্রেন নেই, গাড়িতে যেতে হয়।’

‘তা হলে সূরয সিং-এর সম্বন্ধেও নিশ্চয়ই জানেন?’

‘ওরে বাবা!—সে কি এখনো বেঁচে আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘সে যে একটি আস্ত বাঘ। মালটি মিলিওনেয়ার। হোটেলের ব্যবসার টাকা। হীরে জহরতের অত ভালো কালেকশন ভারতবর্ষে আর কারুর নেই।’

‘লোক কেমন জানেন?’

‘তা কী করে জানব? সে কি আমার এই কুটিরে পদার্পণ করেছে, না আমি তার বাড়ি গেছি? এসব লোককে ভালো-খারাপ বলে বর্ণনা করা যায় না। তুমি হয়ত গিয়ে দেখলে তার মতো অতিথিবৎসল লোক আর হয় না—তোমাকে রাজার হালে রেখে দিল। আবার পরদিন হয়ত সেই লোকই তার কালেকশনের জন্য পাথর আদায় করতে একজনকে খুনই করে ফেলল। অবশ্য নিজে হাতে নয়; এরা সব সময় আইন বাঁচিয়ে চলে, যদিও তার জন্য ট্যাঁক খরচা হয় অনেক।’

এই খবরই যথেষ্ট বলে আমরা সিধু জ্যাঠাকে আর বিরক্ত করলাম না, যদিও সূরয সিং-এর সঙ্গে আমাদের কারবার হচ্ছে কীভাবে সেটা এখনো বুঝতে পারলাম না। ফেলুদাকে বলতে ও বলল, ‘তাও এ খবরগুলো জেনে রাখা ভালো। সে লোক যখন বড়ালকে চিঠি লিখেছে তখনই বোঝা যাচ্ছে তার মুক্তোটার বিশেষ দরকার। সেটা পাবার জন্য সে কতদূর যেতে পারে সেইটে দেখার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছে।’