৫. ব্লানশের মৃত্যুর পর

শৈশব থেকে জুলি যা পায়নি, ব্লানশের মৃত্যুর পর অবশেষে ও হাতে যথেষ্ট টাকা, একটা মিল্ক কোট, ওয়েস্ট এস্তে ফ্ল্যাট সব পেল। কিন্তু ওয়েসলি ওর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠলেন।

জুলির ধারণা সব পুরুষই এক চরিত্রের। শুধু এগোবার কায়দাতেই যা পার্থক্য। ওয়েসলিকেও ও নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর প্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হলো। কিন্তু ওয়েসলি যখন ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার কোনও লক্ষণই দেখালেন না, তখন জুলির অহঙ্কারে ঘা লাগলো। জুলির সব আশাই বিফল হলো। জুলির সন্দেহ হল ওয়েসলি হয়তো ভুলতে পারছেন না যে ও ওঁর স্ত্রীর চাকরানী ছিল। সেকারণেই উনি ওর বিষয়ে উদাসীন।

ওঁকে পরীক্ষা অথবা শাস্তি দেবার জন্যে জুলি দামী দামী উপহার চাইতে লাগল। উনি তাতে বিরক্ত না হয়ে খুশীই হলেন। জুলি ওঁর কাছ থেকে মীনা করা টয়লেট সেট, সোনার সিগারেট কেস আর লাইটার চাইল। উনি হাসিমুখে দিলেন। স্যাভয়ে খাওয়ালেন, বার্কলেতে ডিনার, সিরোতে নাচের আসরে, সিনেমা, থিয়েটার সব জায়গাতে নিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু সব সময় উদাসীনতার প্রাচীরটা ওদের মাঝে রয়ে গেল।

 সেই খুনের রাত থেকে ওয়েসলি ওকে চোখে চোখে রাখতে লাগলেন। ওর হ্যারির কথা মনেই এলো না। জুলির দিনরাত কাটতে লাগল নাইট ক্লাব, থিয়েটার, সিনেমা আর বেহিসেবী খরচ করে। বাইরের জগতের কোন খবর যাতে জুলি না পায়, তার জন্যে ওয়েসলি একমুহূর্তও ওকে কাছ ছাড়া করেন না। ওদের ফ্ল্যাটে রেডিও নেই, খবরের কাগজ বন্ধ, টেলিফোন কেউ করে না, কেউ চিঠিও লেখে না। জুলি বুঝল ওয়েসলি ওকে সবকিছু দিতে তৈরী।

কদিনের মধ্যে ও ব্লানশের পোষাকগুলোর জন্যে আদেখলাপনা শুরু করলো।

একদিন জুলি, ওয়েসলি ওকে যে লাল সাদা ফুটফুট ড্রেসিং গাউন আর পাজামা দিয়েছিলেন, সেটা পরে ওয়েসলির কাছে এলো। কিন্তু ওঁর মধ্যে কোন বিকারই দেখা গেল না। নিস্পৃহ, নিরাসক্ত চোখে জুলির দিকে তাকালো।

–কি শয়তানী মতলব মাথায় ঘুরছে?

একটু হেসে জুলি ওঁর কোলে বসতে গেলে উনি ওকে আস্তে সরিয়ে দিয়ে বললেন, আগুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াও, যাতে তোমায় দেখতে পাই।

জুলির তখন ওঁকে অসহ্য মনে হল।

ও রেগে বলতে শুরু করলো, আমার কয়েকটা পোষাক চাই। রঙীন ঠোঁটে সিগারেট ঝুলছে, পকেটে এমনভাবে হাত রেখেছে যাতে ওর নিটোল নিতম্বের ওপর পাতলা সিল্ক এঁটে বসেছে। জুলি তেরছা, সতর্ক চোখে ওয়েসলির দিকে চেয়ে রইল।

–কিন্তু এখনকার মত তোমার তো অনেক পোষাকই আছে। তোমাকে যেই একটা জিনিষ কিনে দি, অমনি আরেকটা চাও।

 তুমি যে পোষাকগুলো কিনে দিয়েছ, সেগুলো আমার পছন্দ নয়। আমি ভাবছিলাম, ও ফ্ল্যাটে কতকগুলো পোষাক শুধু শুধু পড়ে আছে। ওগুলো কেন আমি পরবো না?

ওয়েসলি ওকে বাধা দিয়ে বলল, ওগুলো ব্লানশের পোষাক।

–ওর তো আর দরকার হবে না। ওগুলো আমার হবে।

–ও ওগুলো পরেছে বলে আমি ভাবছিলাম একজন মৃত স্ত্রীলোকের পোষাক পরতে তোমার খারাপ লাগবে, তাই ও কথাটা বললাম।

জুলি সত্যিই অবাক হয়ে গেল।

কিন্তু আমি তো ওর খুন হবার সময় পরে থাকা পোষাকটা চাইছি না, অন্য পোষাকগুলো নষ্ট হবে কেন?

–তোমার কি মনে হয়না আমি আমার স্ত্রীর পোষাকে তোমাকে দেখা পছন্দ নাও করতে পারি?

তোমার কি সব কথার জবাব তৈরীই থাকে?

ওয়েসলি হঠাৎ হাসলেন। কি পাজি মেয়ে তুমি, ঠিক আছে জুলি ওগুলো তুমি নিও আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই।

জুলি এ সুযোগ ছাড়ল না।

–কেন?

–কেন চাইব না? বেশ, আমি কাউকে সুখী করতে চাইবনা কেন?

 –তাতে তোমার সুখ কোথায়?

–আমি একটি সুন্দরী সঙ্গিনী পেয়েছি। তাছাড়া তুমি প্রজাপতির মত গুটি কেটে বেরুচ্ছো দেখতে আমার ভাল লাগে। এত সন্দেহ কিসের? তুমি কি বিশ্বাস কর না যে মানুষ বিনা উদ্দেশ্যে, বিনা স্বার্থে কারো উপকার করতে পারে?

পুরুষরা আমাকে বিনা উদ্দেশ্যে সাহায্য করে না। তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে মেয়েমানুষ রাখতে চাও। মেয়েমানুষ রাখার বিষয়ে তোমার ধারণাটা খুব অদ্ভুত না?

–ওরকম কিছু বলেছি বলে মনে পড়ছে না। তুমি যে ভাষাটা ব্যবহার করলে, সেই মেয়েমানুষ হিসেবে তোমাকে রাখবার কোন উদ্দেশ্য ছিল না আমার। আমি তোমায় দিতে চেয়েছিলাম বাড়ি, নিরাপত্তা, বছরে হাজার পাউন্ড। আমি কোন শর্ত করিনি। তুমি সুখী হও, তাছাড়া আর কিছু চাই না তোমার কাছে।

সিগারেট ধরিয়ে বললেন, যাও পোষাক বদলে এসো। পোষাকগুলো তবে নিয়ে আসি চলল।

–তোমায় আসতে হবে না। তোমায় বিরক্ত না করেই আমি ওগুলো আনতে পারি।

–আমাকে তোমার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত কোর না জুলি। তাছাড়া দারোয়ান ভাবতে পারে তুমি ওগুলো চুরি করছে।

জুলি লাল হয়ে গেল।

 কথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি কারখানায় যাবে না? আমার সঙ্গে এতখানি সময় কাটানো তোমার ঠিক হবে বলেই যাবে।

ঘরে বসেই আমি কারখানার কাজকর্ম দেখতে পারি জুলি। তুমি কি ভয় পাচ্ছো আমার টাকাপয়সা ফুরিয়ে যাবে। আমার অনেক যোগ্য কর্মচারী আছে।

বেরোবার সময় জুলি দরজাটা ধড়াস করে বন্ধ করে দিয়ে গেল।

পার্কওয়ের ফ্ল্যাটে লিফটে ওঠার সময় ওয়েসলিকে কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল জুলি তা খেয়াল করল না। দামী দামী জিনিষ নিতে চলেছে বলে ও বেজায় উত্তেজিত।

ফ্ল্যাটে ঢুকতে কার্পেটের সেই বাদামী দাগ ওর মনে কোন দাগই কাটলো না। ওর মনে হল ব্লানশ যেন কোনদিনই ছিলনা। হ্যারি ওর মনের গভীরে একটা অস্বস্তি ভরা বিবেকের খোঁচা মাত্র।

জুলি একটা বিশেষ পোষাক বাছলো। ওয়েসলি বলল, না! ওটা না! ওটা রেখে দাও।

–কিন্তু এটা আমার ভাল লেগেছে। আমার গায়ের রঙের সঙ্গে এটা মানানসই হবে। কেন এটা নেব না?

রেখে দাও।

ওঁর মুখের যন্ত্রণার রেখা দেখে জুলি বুঝলো এ হচ্ছে বিপদ সঙ্কেত। ও ঐ পোষাকটা রেখে দিল। আরো অনেক পোষাক ছিল।

ওয়েসলি অস্থির হয়ে বললেন, তোমার এখনও হয়নি? অত পোষাক তুমি পরে উঠতেই পারবে না।

–কেন পারব না? নিশ্চয়ই পারবো। তুমি কি ভাবছো এমন সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো? সারা জীবন রাশি রাশি পোষাক চেয়েছি, এতদিনে তা পেলাম।

অবশেষে ও যাবার জন্যে তৈরী হলো। দুটো সুটকেশ বোঝাই পোষাক নিয়েও ওর আশ মিটল না। ও জানত ঘরে ফার আর গয়না আছে। ওসব কিছু না নিয়ে যেতে মন চাইল না।

মিষ্টি হেসে বলল, আমি কয়েকটা গয়না পেতে পারি? এ পোষাক পরলে গয়না ছাড়া বিশি দেখাবে।

এক দীর্ঘ, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, উনি চেয়ে রইলেন।

জুলি মনে হচ্ছে তুমি কিছুতেই খুশী হতে পারছে না। ঠিক আছে, আমি যা হয় বেছে দিচ্ছি।

অ্যালার্ম বন্ধ করে আলমারী খুলে দেরাজ হাতড়াতে লাগলেন। জুলি এগিয়ে গেল। উনি বাধা দিলেন।

–বলেছি আমিই বেছে যা হয় দেব? ওখানে গিয়ে বস দয়া করে। আমি দেখছি।

–আমি কেন দেখব না? আমার কি দরকার সেটা তো আমিই ভাল জানি।

–না, বললে, কিছু পাবে না।

জুলি রেগে গিয়ে জানলার কাছে চলে গেল। কিন্তু ওঁর শানিত চোখ দেখে ভয়ে গুটিয়ে গেল ও।

উনি বেছে যা গয়না দিলেন, তাতে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। একটা হীরের নেকলেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে টেবিলে ছুঁড়ে ফেললেন।

–কি সুন্দর। এগুলো সব আমার? আমায় দিয়ে দিচ্ছো?

ধার দিচ্ছি তোমায়। যা কিছু পরছে, সবই ধার দিয়েছি।

 অবাক হয়ে জুলি ওঁর দিকে তাকালো। কিন্তু ও এত উত্তেজিত ওসব শর্ত–টর্ত নিয়ে মাথাই ঘামাল না। গয়নাগুলো এখন তো পরতে পারবে, এটাই যথেষ্ট। পরে এগুলো রাখবে কি রাখবে না তা নিয়ে চিন্তা করবে। ও তখনি নেকলেশটা পরতে চাইছিল, উনি পরতে দিলেন না। যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

দুটো সুটকেশ ভর্তি পোশাক গয়না নিয়েও ফারগুলো নেবার জন্যে জুলি ছোঁকছোঁক করতে লাগল।

ব্যাগে গয়নাগুলো ভরতে ভরতে বলল, আমি একটা ফারকোট পেতে পারিনা? আর্কটিক শেয়ালের ফারটা আমার খুব পছন্দ। ওটা নেব।

উনি অলামারী বন্ধ করে দিলেন।

না। আমি যে মিল্ককোটটা কিনে দিয়েছি ওটা নিয়েই খুশী থাকো। এবার তোমার জিনিষ চাওয়া বন্ধ কর। তোমার কি কিছুতেই সুখ হচ্ছে না জুলি? দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, মুখ কালো করে লাভ নেই। চল। ছোটদের মত কোরনা।

জুলি ভেতরে ভেতরে জ্বলতে জ্বলতে লিফটের দিকে এগোতে লাগল। কিন্তু ওগুলোর জন্যে জোরাজুরি করাটা ঠিক হবেনা ভেবে তখনকার মত চুপ করে গেল জুলি। ওর মনে হলো, পরে ওটা যদি সমানে চাইতে থাকে তবে ওয়েসলি ওটা ওকে দেবেন।

সেদিন সন্ধ্যায় সেগেত্তির রেস্টুরেন্টে, লন্ডনের সবচেয়ে ফ্যাশানী রেস্টুরেন্টে ওর হীরের নেকলেশ দেখাতে চেয়েছিল।

কিন্তু বেনটন ওদের সুন্দর সন্ধ্যাটা মাটি করে দিল।

ট্যাক্সিতে আসতে আসতে ও রাগে ঘৃণায় জ্বলে উঠলো। ওর মনে হলো বেনটনের সঙ্গে পাল্টা রাগারাগি না করে উনি ওকে অপমান করেছেন। একথা ভেবে আর স্থির থাকতে না পেরে, ফেটে পড়ে বলল, কোন্ আস্পর্ধায় ও আমায় গালাগালি দেয়? জানোয়ার। ও তোমার বউয়ের প্রণয়ী ছিল। তুমি নিশ্চয় ওকে দিয়ে আমাকেও অপমান করতে দেবে না?

 ওর দিকে না তাকিয়ে ওয়েসলি হেসে বললেন, তোমার অসংযত মুখ বন্ধ কর।

জুলি এত ঘা খেল যে ফ্ল্যাটে না পৌঁছনো অবধি ওরা কেউ একটা কথাও বলল না। জুলি ট্যাক্সির নরম গদীতে নিথর হয়ে বসে রইল।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে জুলি ওকে আক্রমণ করলো। চোখ-মুখ লাল করে বলল, আমি তিতিবিরক্ত হয়ে গেছি। আমি আর একমুহূর্তও তোমার সঙ্গে থাকব না। জানি না, কেন তোমার সঙ্গে এসেছিলাম। তুমি আমার সঙ্গে জানোয়ারের মতো ব্যবহার করেছ।

ওয়েসলি ইলেকট্রিক ফায়ার প্লেসের সুইচ টিপে জ্বালালেন। ওর চেহারায় ক্লান্তি, কিন্তু চোখে মুখে রাগের আগুন জ্বলছে।

যদি যেতে চাও, তোমায় বাধা দেব না। কিন্তু সঙ্গে কিছু নিয়ে যেতে পারবে না। তোমার নিজের পোষাকে বেরিয়ে যাবে। বুঝলে? আমার ধার দেওয়া পোষাক একটাও পরে বেরুতে পারবেনা। যাও নিজের ঘরে। আজ রাতে তোমায় দেখে আমার বিরক্ত লাগছে।

রাগে সাদা হয়ে গেল জুলি। ও জানে উনি যত খারাপ কথাই বলুক না কেন, এই বিলাসবহুল সুখের জীবন ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।

কিন্তু সে সম্পর্কেও উনি বললেন জুলি এখন সব ফাস করে দিলেও ওঁর কিছু এসে যায় না। যদিনাই এসে যায়, তবে কেন এখনো অন্ধত্বের ভান করে চলেছেন? কেন? কার ভয়ে? কারখানার কেউ? বেনটন? পুলিশ?

পুলিশ! সহসা লাফিয়ে উঠলো জুলি। অতর্কিতে ওর মনে ঝলকে উঠল সত্য কথাটা। তাহলে ওয়েসলি ব্লানশকে খুন করেছেন। সেটা এতই স্পষ্ট আগে কেন বোঝেনি জুলি?

অভিনয়টা ওয়েসলির নিখুঁত ছিল। একজন অন্ধকে কেউ সন্দেহ করবেনা। ওয়েসলি ব্লানশকে ঘৃণা করতেন। গেরিজ বলেছিল ওঁদের ডিভোর্স হলে ব্লানশকে যে মোটা খেসারত দিতে হবে ওয়েসলির সে টাকা ছিল না।

ব্লানশ বেনটনের সঙ্গে প্রেম করছিল। খুনের কারণ ওটাই। চোখ অপারেশন সফল হলেও উনি ভান করে গেছেন, অপারেশনে ফল হয়নি।

যাইহোক, ব্লানশকে উনি ফিরে আসতে বাধ্য করেন। কিন্তু পুলিশের চোখ এড়ালেন কিভাবে? ওর মনে পড়ল লিফটে সেই ব্যান্ডেজটা কেন উনি লুকোনোর চেষ্টা করলেন। যখন মনে পড়ল ব্লানশকে কেউ বাইরে থেকেও গুলি করতে পারে তখন উনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। এখন বোঝা যাচ্ছে ওয়েসলি ব্লানশের সঙ্গেই উঠে এসেছিলেন। ব্লানশ যখন সদর দরজা খুলছিল, উনি কাছেই ছিলেন। ও হলঘরে ঢুকতেই উনি ওকে গুলি করে ওর গায়ের কাছে পিস্তলটা ছুঁড়ে ফেলে দেন। সব কিছু খুব সহজ হয়ে যায়। পুলিশ সেখানে ছিল না। উনি বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলেই লিফটের দরজা বন্ধ করে পুলিশ ফ্ল্যাটে ঢোকা অবধি অপেক্ষা করেন। ওরা যতক্ষণে হ্যারিকে গ্রেপ্তার করে, উনি ততক্ষণে মাটির তলায় চলে যান এবং সেখানে একটু সময় অপেক্ষা করে উনি সামনের গেট দিয়ে ঢোকেন। ওঁকে আর কে সন্দেহ করবে?

জুলি আতঙ্কে কাটা হয়ে গেল। ও জানত হ্যারি নির্দোষ ও খুন করতে পারেনা। কি করবে ভেবে না পেয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলোলা। বাইরে একটা পায়ের শব্দ হতেই জুলি লাফিয়ে পিছু হটল। ওয়েসলি ঢুকলেন। জুলির চোখে ভয়।

চেঁচিয়ে বলে উঠল, তুমি। তুমি ওকে খুন করেছে। সেইজন্যেই তোমার এই অন্ধত্বের ভান করে থাকা!

ওয়েসলি আস্তে দরজা বন্ধ করলেন।

শান্ত, অবিচল কণ্ঠে বললেন, জানতাম এক সময়ে তুমি সব বুঝতে পারবে। বেশ, এখন যখন সবই জেনেছো, এসো কথা বলা যাক। ভয় পেওনা। আমি তোমার গায়ে হাত দিতে চাইনা।

–আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। চলে যাও তুমি। আমি পুলিশকে সব বলতে যাচ্ছি।

উনি ইজিচেয়ারে বিছানার কাছে এসে বসলেন।

উত্তেজিত হয়ে কোন লাভ নেই জুলি। শান্ত হয়ে আমার কথা শোন। সিগারেট খাবে? জুলি ভয়ে শিউরে উঠে সরে গেল।

জুলি, তুমি একটা বাজে নাটকের চাকরানীর মতো আচরণ করো না। ওঁর শানিত গলায় জুলি ক্ষেপে উঠল। আর উনি চাইছিলেনও তাই।

–কি আস্পর্ধা তোমার। বেরিয়ে যাও, নইলে আমি চেঁচাবো।

সিগারেট খাও জুলি; বোকামি কোরনা। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

ওয়েসলি একটা সিগারেট ধরিয়ে কেস আর লাইটারটা বিছানার ওপর ফেললেন।

ওঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে জুলি বলল, যে কাজ তুমি করেছ তারপরে তুমি সুস্থির আছো কিভাবে? তোমার মন বলে কিছু নেই। তুমি সাপের মতই ঠাণ্ডা আর ভয়ানক।

–আমি কথা দিচ্ছি আমার মন আছে জুলি, কিন্তু সেকথা এখন অপ্রাসঙ্গিক। তুমি ঠিকই বলেছ, আমিই ব্লানশকে খুন করেছি।

জুলি আড়ষ্ট হয়ে গেল।

–আর তুমি হ্যারিকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছিলে? কাপুরুষ কোথাকার! কি করে পারলে? হ্যারির ব্যাপারে তোমার মত আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি নিজের দোষ স্বীকার করিনি বলে তুমি আমায় দোষ দিতে পারে না। পার কি? আমার অবস্থায় তুমি পড়লে তুমিও তাই করতে।

ওঁর ঠাণ্ডা, নির্লিপ্ত ভাব দেখে জুলি এমন ঘাবড়ে গেল, কি বলবে ওর মাথায় কিছু এলো না।

–হাজার হলেও জুলি, হ্যারি তোমার বন্ধু হতে পারে, কিন্তু সমাজের কাছে ও একটা ছিঁচকে চোর, তরুণী মেয়েদের কাছে ও একটা মূর্তিমান বিপদ। আমি তো দেখছি ওর স্বপক্ষে তোমার বলার মত কিছুই থাকতে পারে না। অপরপক্ষে, আমি এরোপ্লেন চালানোর ওপর গবেষণা করছি। যা সফল হতে চলেছে এবং এ যুগে আর আগামী যুগের মানুষের কাছে তার অশেষ মূল্য থাকবে। সুতরাং ওর চেয়ে আমার বাঁচবার দাবি বেশী জোরালো।

কি করে এমন কথা বলছ? ও নির্দোষ। ওকে দোষী বানিয়ে, তোমার জায়গায় ওকে তুমি ফাঁসিতে ঝোলাতে পারো না।

ওয়েসলি হেসে বললেন, আমি তো বলিনি ও আমার বদলে ফাঁসি যাক। উত্তেজিত হবার আগে চুপ করে বসো, একটা সিগারেট খাও, ঠাণ্ডা মাথায় শোন, কি হয়েছিল, বুঝিয়ে বলি।

ওঁর ব্যবহারে সম্মোহিত হয়ে জুলি বসল। সিগারেট নিল।

–বেশ। তাহলে গোড়া থেকে শুরু করা যাক। আমার সঙ্গে ব্লানশের বিয়ে হয় ছবছর আগে। ওর সুখ্যাতি, সৌন্দর্যকে আমি অন্ধের মত, মুখের মতও বলা যায় ভালবাসতাম। আমাকে ও কি জাতের মেয়ে সাবধান করে দেওয়া সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছে ও রূপকথার বই থেকে বেরিয়ে এসেছে।

সে সময়ে আমার হাতে প্রচুর টাকা। ওর নামে মোটা টাকা লিখে দিলাম। তখন ও প্রস্তাব করলো আমার লিখে দেওয়া উচিত যে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে ওকে দুক্ষ পাউন্ড দেব। যতক্ষণ না একটা পাকা দলিলে আমাকে সই করতে বলা হয় ততক্ষণ আমি ভেবেছিলাম ওটা ঠাট্টা। আমি সই করবো না বলায় ও আমাকে বিয়ে করবে না বলল। দুশো অতিথি আসার কথা। বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা। বুঝলাম সই আমাকে করতেই হবে নইলে ওকে পাবার আশা পরিত্যাগ করতে হবে। অন্যেরা আমায় বোকা বলবে।

এখন আমার মনে হচ্ছে আমার মুখতার জন্যে আজ আমি দাম দিচ্ছি। ওকে ভালবাসতাম। সল্প কথায় বলি, ওর ব্ল্যাকমেলের প্রস্তাবে আমি সই করলাম।

বিয়ের প্রথম বছরটা সুখেই কাটলো। ব্লানশের ব্যবহার ছিল মিষ্টি। আমরা সবসময়ে একসঙ্গে ঘুরতাম, কিন্তু আমার যেন মনে হতো, ও শুধু আমার নয়। ও তখন অন্ততঃ বাবোজন পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করছে। আমি তা জানতে পারি অনেক পরে।

কারখানা তখন বড় হচ্ছে। আমি জনসাধারণের টাকাকে মূলধন করতে চাইনি। আমি আমার কারখানাটা হাতের মুঠোয় রাখতে চেয়েছিলাম কারণ আমার কতকগুলো বৈপ্লবিক পরিকল্পনা ছিল। তা সফল করতে আমি তখন কারখানা নিয়ে জুয়া খেলছি। জুয়াটা নিজের টাকাতেই খেলতে চাইলাম।

ব্লানশ চেয়েছিল আমার সঙ্গে যথেচ্ছাচার করতে। আমার হাতের মোটা রোজগার ও হারাতে চায়নি। ও মদ খেয়ে ফুর্তি করতো। আমি ওকে ঘাড় থেকে নামাতে বেজায় ব্যস্ত! ততদিনে আমি অন্ধও হয়ে যাই। ঐ ভাবেই দুবছর কাটলো। তারপর বেনটন ওকে বিয়ে করবার জন্যে ব্লানশকে জোর করতে লাগল। ও আমাকে কারখানা বেচে দিতে চাপ দিতে লাগল, যাতে আমি ওর ঘাড় থেকে নেমে যেতে পারি। তাতে শর্তমত দুলক্ষ পাউন্ড পাবে। সে দলিল খুব পাকা। আদালত অবধি গড়ালে আমি কিছুই করতে পারবো না। আমি জানতে পারলাম ও আমাকে চাপ দিয়ে বাধ্য করবে। আমি উদ্ধার পাবার পথ খুঁজতে লাগলাম।

কাজ আমার শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর ছমাস গেলেই সম্পূর্ণ হবে। যদি সে ছমাস পর্যন্ত দেরী করে তাহলে আমি লাভ রেখে বেচতে পারি, কিন্তু ও দেরী করতে রাজি হলো না।

সিগারেটটা ঘষে নিভিয়ে উনি তখনি আরেকটা ধরালেন।

–তোমার কি ক্লান্ত লাগছে জুলি? কথাগুলো এজন্যই বলছি যে তোমার জানা দরকার, কি জন্যে আমি ব্লশকে খুন করতে বাধ্য হয়েছি। ব্লানশ মাতাল, বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। যেসব অল্প বয়সী ছেলেদের ওর ভাল লাগত, তারই বিপদ ঘটাত। এসব দেখে আমি তখন দিশেহারা। তারপর অপারেশনের সুযোগ এলো। অপারেশনের পরে ব্যান্ডেজ খোলার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমার মনে হলো যদি কখনো ব্লানশকে খুন করা যায়, তাহলে এই অন্ধত্বটা কি দারুণ অ্যালিবাই হয়ে সাহায্য করতে পারে। তখন সেটা একটা অলস চিন্তা হিসেবেই আমার মনে আসে। কিন্তু যত ভাবতে থাকি, ততই স্থির করি যে, কোনদিন চোখে দেখতে পেলে ওকে খুন করবো।

চোখের ডাক্তার সাবধান করে দেন, দৃষ্টি ফিরে পাবার সম্ভাবনা হাজারে এক। প্রথম যখন ব্যান্ডেজ খুলে দেই, কিছুই দেখতে পাইনি। সবাই অপারেশন বিফল হয়েছে বলেই ধরে নেয়। কিন্তু বেলার দিকে মনে হল ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি। সন্ধ্যের মধ্যে আমি ভাই দেখতে পেলাম। কিন্তু কাউকে কিছু বললাম না। আমি অন্ধের ভান করেই রইলাম।

ফ্ল্যাটে ফিরে এসে তোমাকে ব্লানশের পোষাকে আর গ্লেবকে দেখে আমি অবাক হই। আমি ধরে ফেলি তোমরা দুজন ফারগুলোর জন্যে এসেছে। তখন ভাবতে শুরু করি কি করে তোমাদের কাজে লাগিয়ে আমার অ্যালিবাই আরো জোরদার করতে পারি। ব্লানশকে মেরে ফেলবার প্রচুর কারণ আছে আমার। ওর প্রতি আমার কোন মমতাই ছিল না। সবরকমে ও আমার কাজের পথে বিশ্রি একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর কোন পথ আমার ছিল না। ওকে সরাতেই হবে।

বাকীটা তুমি সব জানো। আমি যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও ভালভাবে হয়ে গেল সব। পুলিশ অবশ্য, ব্লানশ কেন ফিরে এল তা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন। কিন্তু মনে হয়না কিছু দাঁড়াবে তা থেকে। আমি খুব সাবধানতা গ্রহণ করেছিলাম। এখন জুলি, ব্লানশের মৃত্যু নিয়ে ভাববার আগে আমি তিন মাস সময় পাচ্ছি। এই তিন মাসে আমার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

তুমি তুমি বলেছছ পুলিশকে সব জানাবে? হ্যারিকে ফাঁসি যেতে দেবে না।

কথা তো তাই না? কাজ শেষ হয়ে গেলে পুলিশের কাছে গিয়ে আমি আত্মসমর্পণ করবো। তিনমাসের আগে গ্লেব কোন বিপদে পড়বে না। কাজটা হয়ে গেলে আমার কি হবে, তা নিয়ে আমি ভাবি না। গ্লেবের মত একটা লোককে আমি আমার কৃতকার্যের জন্যে মরতে দেব না। এখন ওরকম করুণ মুখে আমার দিকে তাকাবার দরকার নেই জুলি। হয়তো গ্লেবের সময়টা খারাপ যাচ্ছে, কিন্তু আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি ও নিরাপদেই আছে। তবে ওর ভাগ্য এর চেয়ে ভালো হবার কথা নয়।

জুলি ওয়েসলিকে নিরীক্ষণ করে দেখল, ওর বুক ধড়াস্ ধড়া করছে।

শেষ অবধি ও ওয়েসলিকে বলল, আমি বিশ্বাস করি না তুমি ধরা দেবে। আমি পুলিশকে এখনি সব বলে দেব। তোমার দোষে হ্যারি কেন কষ্ট ভোগ করবে?

–তুমি এই কথা বলবে জেনেই আমি তোমায় সবকিছু খুলে বলার ঝুঁকি নিয়েছি। অতএব তোমার কথা একটু আলোচনা করা যাক। এটা তুমি বুঝতে পারছো, আমাকে ধরিয়ে দিলে তুমি কিছুই পাবে না। আর মনে হয় না, বেশী কামাতে পারবে বলে। যে বিলাসের স্বাদ তুমি পেয়েছে, যথেচ্ছ খরচ করার মজা তুমি পেয়েছে, বিশ্বাস হয়না এসব তুমি তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে পারবে। আর যদি আমার ধারণা ভুল হয় তবে তুমি পুলিশের কাছে যাও। সে স্বাধীনতা তোমার আছে। তবে তুমি যা বলছে তা যদি আমি অস্বীকার করি, তবে ওদের পক্ষে গ্লেবকে ছেড়ে আমাকে ধরার মত প্রমাণ যোগাড় করা কষ্টকর হবে।

হয়ত ওরা তা পারবে কিন্তু তা জুয়া খেলার মতই অনিশ্চিত। ইতিমধ্যে ঐ ফ্ল্যাটে তোমার আনন্দের, সুখের জিনিষ, পোষাক, গয়নাগাটি সব তুমি হারাবে। তবে তুমি যদি আমার ধরা না দেওয়া অবধি অপেক্ষা কর, তবে এ সব জিনিষ তো তুমি পাবেই, এছাড়া আমি তোমায় মোটা টাকা দিয়ে যাবো।

উঠে দাঁড়িয়ে উনি শরীর টানটান করে হাই তুলে বললেন, আজ আমি ক্লান্ত, এখন এ কথা থাক। যদি তুমি আগের জীবনে ফিরে যেতে চাও, তবে আমি বাধা দেব না। আমি ভরসা দিচ্ছি হ্যারি নিরাপদেই আছে।

উনি হেসে দরজার দিকে এগোলেন। গুড নাইট জুলি।

.

ওয়েসলি চলে যাবার পর জুলি ওর বিবেকের সঙ্গে নিদারুণ যুদ্ধ করলো। ও ব্লানশকে ঘৃণা করতো। তারজন্যে ওর কোন মমতাই নেই।

জুলি ভাবলো ব্লানশ একটা ভয়ঙ্কর মেয়েমানুষ। ওর কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। ওয়েসলির হ্যারির ঘাড়ে দোষ চাপানো ক্ষমা করা যায় না।

হ্যারিও অতীতে জুলিকে থিওকে দিয়ে মার খাইয়ে কষ্ট দিয়েছে। জুলি যদি এখন স্বার্থপর না হয় তাহলে ওয়েসলি ওকে আর্কটিক ফারটা দিচ্ছে না কেন? যদি দেবার কথা মাথায় না আসে তবে ও ওটা সরাসরি চাইবে।

কিন্তু ওয়েসলি যদি ধরা না দেন? যদি এটা সময় পাবার ফন্দী হয় ওঁর? উনি গোলমাল শুরু করলে ও শুধু একবার পুলিশের কাছে যাবে। যাতে ওয়েসলি তার কাজ শেষ করতে পারেন। জুলি জানতে পারবে যে হ্যারিকে জীবন দিয়ে দাম… জুলি ক্ষতবিক্ষত বিবেকের কাছে হার মেনে চুপ করলো।

পরদিন সকালে ওয়েসলি ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ও কি করতে চায়। ও ওঁকে সময় দিতে রাজী আছে বলার পর উনি এত শান্ত, অবিচল রইলেন দেখে জুলি ক্ষুব্ধ হলো।

ওয়েসলি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, এখন তো ঠিকই হয়ে গেল কথা। আমাকে এখন কারখানায় যেতে হবে। ওখানে আমার অনেক কাজ আছে, সময় সংক্ষিপ্ত।

জুলি ভাবলো, আমায় তো সৌজন্যবশতঃ একটা ধন্যবাদ দিতে পারতো। হাজার হলেও আমি ওঁর জন্যে যা করেছি, খুব কম লোকই করতো।

ও আড়ষ্টভাবে বলল, একটা কথা, আমার মনে হয় আমি..কথা থামিয়ে ও আবার শুরু করল, ওই ফারগুলো, আমি আর্কটিক ফারটা চাই। বুঝতে পারছি না কেন ওটা পাবনা। আমি তো তোমার জন্যে যথেষ্ট করছি।

ওয়েসলি হেসে বললেন, আমি তোমার জন্যে এ পর্যন্ত কিছুই করিনি, তাই না?

যখন জেলে থাকবো তখন ওটা পরছে জানলে সুখীই হবে। কিন্তু ওটা এখন তোমায় দিচ্ছিনা। জুলি আমাদের খোলাখুলি হওয়া দরকার। আমার কাজ, আমার জীবন এখন তোমার হাতে। তুমি যে জিনিষটা মনেপ্রাণে চাও সেটা আমার হাতে রাখতে আমি নিরাপদ বোধ করবো। তবে আমি কথা দিচ্ছি আমার কাজটা হয়ে গেলে শুধু আর্কটিকটানয়, সবগুলো ফারই তুমি পাবে। তোমাকে বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না, বড়জোর দুমাস।

জুলিকে এই কথাতেই খুশী হতে হল।

জুলির মনোভাব বুঝে ওয়েসলির ব্যবহারটাই বদলে গেল। উনি স্বীকার করলেন, ওকে এই ফ্ল্যাটে এনে তোলার উদ্দেশ্য ওর মুখবন্ধ রাখা। ওর সঙ্গে যে ওঁকে এখনো থাকতে হচ্ছে এটা ওঁর দুর্ভাগ্য। উনি অন্য কোথাও চলে যেতে চান। কিন্তু হঠাৎ ওকে ফেলে চলে গেলে পুলিশের কাছে সেটা গোলমেলে মনে হতে পারে, এখন উনি এমন কিছু করতে চান না, যাতে পুলিশ ওঁকে সন্দেহ করে।

উনি বুঝিয়ে দিলেন জুলিকে, ও ইচ্ছে হলে যা খুশী তাই করতে পারে। এখানে ওর বন্ধুদেরও ইচ্ছে হলেই ডাকতে পারে। উনি তাতে অসন্তুষ্ট হবেন না।

–এখন আমি তোমার সঙ্গে যখন ইচ্ছে বেরোতে পারবো না। যত খেটে কাজটা সারতে পারবো, তত তাড়াতাড়ি তোমার বন্ধু গ্লেব ছাড়া পাবে। ওয়েসলি জুলিকে বললেন।

জুলি এরকমটা আশা করেনি। ওয়েসলি কারখানায় চলে গেলে ও নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগল। ওর আগের জীবনের বন্ধুদের সঙ্গেও ওর কোন যোগাযোগ নেই। ওদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ, করতেও ওর ভয় হলো। সকালটা একঘেয়ে কাটলো, দুপুরে একলা সিনেমা দেখেও বিরক্তি ধরে গেল। সন্ধ্যে ছটার পর ওয়েসলিকে দেখে ও খুশীতে ভরে উঠল।

আশা করি দিনটা ভালই কেটেছে জুলি।

 জুলি তিক্ত গলায় বললো, বিশ্রি কেটেছে। মনে হয়না তাতে তোমার কিছু এসে যাবে।

 উনি বসার ঘরের দিকে এগোলে জুলিও ওঁর পেছন পেছন গেল।

ওয়েসলি বললেন, শুনে দুঃখিত হলাম। এখন আমার অনেক কাজ আছে, আমি নটার সময় খেতে চাই। তোমার যদি কিছু করার থাকে, আমি তাহলে একটা ট্রে আনিয়ে নেব।

না আমি রাতে বাইরে যেতে চাই।

জুলি দেখলো উনি ডিকটাফোনের পাশে বসছেন। জুলি জিজ্ঞেস করলো, বেনটনের খবর কি?

ওয়েসলি ডিকটাফোনে নতুন সিলিউ পরালেন।

এইকথায় ওয়েসলি পুরুষকাঠিন্য গলায় বললেন, ওর টাকা পয়সা আটকে ওকে বের করে দিয়েছি। ওর বাজারে প্রচুর দেনা ছিল। আমি শুধু যে গ্যারান্টি দিয়েছিলাম তা সরিয়ে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর টাকাকড়ির ব্যাপার সব অগাধ জলে তলিয়ে গেল। ও এখন আর আমাকে জ্বালাতে আসবে না।

মনে মনে জুলি খুশীই হলো, তুমি খুব কঠিন, তাই না?

–হয়তো। আজকাল মাঝেমধ্যে কঠিন হতেই হয়। তবে তুমি নিজেও ঠিক নরমসরম নও।

জুলি বুঝলো ও কথা বলে ওঁর কাজের ক্ষতি করছে হয়তো। তবুও ওর চলে যেতে খারাপ লাগলো। ও সঙ্গ চাইছিল।

জুলি বলল, তোমার কাজে আমি কোন সাহায্য করতে পারি না?

উনি মুখ ফেরালেন।

–আমায় সাহায্য করবে? জান জুলি, আমি তোমাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। তোমার কি আমাকে ভয় করছে না? আমি কি করেছি জেনেও তোমার মনে কোন ভয় নেই?

জুলি কাঁধ ঝাঁকাল।

–তাতে আমার কি? ব্লানশের যা প্রাপ্য ছিল ও তা পেয়েছে, ও বাঁচার যোগ্য ছিল না। আমি কেন তোমায় ভয় পেতে যাবো?

–তোমার দৃষ্টিভঙ্গি দেখলে ঈর্ষা হয়। না জুলি এখন তোমার সময় অপচয় না করে আনন্দ করা উচিত। মনে হয় না তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে। সত্যি বলতে কি আমি আশাই করিনি তুমি এসময় বাড়িতে থাকবে। ভেবেছিলাম তুমি বাইরে গিয়ে আমোদ করছে।

একা একা কি করে আমোদ করবো? সারাদিন বেজায় একঘেয়ে লেগেছে আমার।

ব্লানশের মত তুমিও তাড়াতাড়ি বলতে শুরু করলে একঘেয়ে লাগে। তবে তুমি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করনা কেন?

–তুমি জানো তোমারই জন্যে এখন আমার কোন বন্ধুবান্ধব নেই। এখন তুমি আমায় ব্যঙ্গ করছো?

বাজে কথা। ওয়েসলি কাজের তাগিদে অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন, এখন আমাকে কাজ করতে হবে, তুমি যাও। খাবার খেতে খেতে তোমার সমস্যার কথা শোনা যাবে।

–আমার থাকা যদি অবাঞ্ছিত হয়, তবে আমি নিশ্চয় থাকতে চাইনা। জুলি রেগে উঠে দাঁড়াল, রাগের চোটে ওর চোখে জল এসে গেল। ধড়াস করে দরজা টেনে দিয়ে ও বেরিয়ে গেল।

পরে সদর দরজায় ঘন্টা বাজতে শোচনীয় অবসাদ কাটিয়ে ও সচকিত হলো।

 দরজায় দাঁড়িয়ে ডিটেকটিভ ডসন। জুলি ওকে দেখে চমকে উঠলো।

মিঃ ওয়েসলি আছেন?

 মুখের আতঙ্ক লুকোবার চেষ্টা করল। ও বুঝল ডসন ওকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে।

–হ্যাঁ, কিন্তু উনি কাজ করছেন।

–আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। বল বেশী সময় নেবনা। বলবে?

 অনিচ্ছুক মুখে জুলি ওকে বসার ঘরে নিয়ে এলো।

 চারিদিকে তাকিয়ে ডসন শিস্ দিল আস্তে।

–কেমন লাগছে এখানে?

–ভালই।

–সুন্দর পোষাক পরেছো। উনি তোমায় ভালই দেখাশোনা করছেন। তাই না? কেন বল তো?

জুলি রেগে তাকাল কিন্তু ভয়ও পেল। মনে হল, ডসন কি বোঝাতে চাইছে। যখন ও ওয়েসলির কাছে গেল, তখন ওকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।

ওর চোখে ভয় দেখেই ওয়েসলি বললেন, ডসন?

–হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

ওয়েসলি হাসলেন।

–ঠিক আছে। কিছু বলেছে কি?

 –শুধু বলেছে, আমায় তুমি ভালই দেখাশোনা করছে, কিন্তু কেন সেটাই জানতে চাইলো।

 ওয়েসলি হাসলেন।

–ডসন বোকা নয়, দেখেছো? ঠিক আছে জুলি। ওকে আসতে বল। ভয় পাবার কিছু নেই। ইচ্ছে হলে সত্যি কথাটা বলে দিতে পারো।

বললে তুমি বোকা বনবে। জুলি বললো।

–অবশ্য, তুমি বলবে না কখনোই।

–অত নিশ্চিত হয়ো না।

 –ওকে অপেক্ষা করিয়ে নাটক কোর না। তোমায় মানায় না।

জুলি ক্ষেপে গিয়ে বলল, তোমায় আমি ঘেন্না করি। সব সময়ে তুমি আমায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কর।

–ছেলেমানুষি কোর না।

ঘর থেকে জুলি বেরিয়ে গেল। ওর টকটকে লাল মুখ দেখেই ডসন বুঝলো জুলি কিরকম চটেছে।

ডসনের দিকে না তাকিয়েই বলল, উনি দেখা করবেন। ওই শেষের ঘরটায় আছেন।

 ডসন খুব একটা ব্যস্ত হলো না।

–তোমার দোস্ত হ্যারি গ্লেবকে কাল দেখলাম। ও বেশ অসুস্থ। আমি ওকে বললাম তুমি ওয়েসলির সঙ্গে ভিড়েছে। হ্যারি খবরটা শুনে তেমন খুশী হলো না। দেখলাম ওর যেন ধারণা হয়েছে, সে তোমার দোষে ..।

ডসন করুণ মুখে মাথা নাড়লো। বলল, হ্যারির কথা ভাব কখনন? মনে তো হয়না, পুরোনো বন্ধুদের কথা ভাববার মত সময় আছে তোমার? দিব্যি মজায় ফুর্তি করে বেড়াচ্ছো। ভাল। তবে হ্যারি তোমার কথা ভেবে খুবই উদ্বিগ্ন। তোমায় বলছি, ওর অবস্থায় পড়লে আমিও উদ্বিগ্ন হতাম। বেসরকারী ভাবে বলছি, ছোকরা ফাঁসিতে ঝুলবে।

জুলি নির্বাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল।

–হয়তো তুমি তা ভাবছো না? হয়তো তোমার কাছে এমন খবর আছে, যার জোরে তুমি বেঁচে যাবে!

নেই।

–ঠিক বলছে নেই? খুনের মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণ গোপন করলে অসম্ভব বিপদে পড়তে হবে, জেনে রেখো। তুমি এখনো মনে কর হ্যারি একাজ করেনি?

ওয়েসলি দরজা থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান ইন্সপেক্টর?

ডসন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঘোরাল।

কালো চশমায় চোখ ঢাকা ওয়েসলির নিথর, নিশুপ দাঁড়িয়ে থাকা দেখেই বোঝা যায়, ওঁর ভেতরে টানটান উত্তেজনা একেবারে।

–হা চাইছিলাম। আমি মিস হল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আপনি এসে পড়েছেন যখন…

বসার ঘরে আসুন, ও ঘরটায় আরাম পাবেন। জুলি পোষাক বদল করে নাও, ইন্সপেক্টর চলে গেলে এক জায়গায় যেতে হবে, আশা করি মনে আছে।

ডসন আর ওয়েসলি চলে যেতেই জুলি ছুটে চলে গেল ওর শোবার ঘরে।

একা বসে বসে আশঙ্কায় অস্থির হতে লাগল ও। পুলিশকে যে ওয়েসলির কথা ও চেপে গেল, এতে ওর কোন বিপদের আশঙ্কা নেই তো? ডসন ধাপ্পা দিচ্ছিল না তো? জুলি শুনেছে খুনে সহযোগিতা করলে শাস্তি হয়। কিন্তু তাতে কি জেলে যেতে হয়? ডসনকে যদি ও সত্যি কথাটা বলে দেয়, তাহলে ও হয়তো জুলিকে বিপদে ফেলবার সুযোগ পেয়ে খুশীই হবে।

হ্যারির কথা মনে পড়ল ওর। ও ওয়েসলির সঙ্গে বসবাস করছে একথা ডসনের বলা অন্যায়। কি আনন্দই না করত ওরা দুজনে মিলে। ওকে পাবে না জেনেই ওকে মনে মনে চায় জুলি। জুলির মনে হল, ও বোধহয় আরেকবার হ্যারির প্রেমে পড়েছে। ও মনে মনে পরিকল্পনা করতে লাগল, ওয়েসলি যখন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, তখন সমস্ত টাকা-পয়সা জুলির হবে, তখন তো ও আর হ্যারি নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারে।

ওয়েসলি ওর নামে যে টাকা দেবেন বলেছেন, তা নিয়ে ও আর হ্যারি আমেরিকা চলে যেতে পারে। জুলি ভাবল, ব্লানশের ফ্ল্যাটে চুরি করতে ঢোকার জন্যে ওর হয়তো, কিছুদিনের জন্যে কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু সে তত বেশীদিন নয়। জুলির সহসা পুরোনো ভালবাসা নতুনভাবে ফিরে এলো। ও বুঝলো মনে মনে হ্যারিকে ও চিরদিনই চেয়ে এসেছে। হ্যারি তো ওকে অনেক অনুনয় করেছিল ওর সঙ্গে চলে যাবার জন্যে। জুলি মূর্খ তাই ওয়েসলির জন্যে ও হ্যারিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

বাইরে ডসনের ভারী গলার আওয়াজ পেয়ে ওর চিন্তার জাল কেটে গেল। শুনলো ডসন দরজা অবধি হেঁটে গেল। একটু বাদে ওয়েসলি ফ্যাকাশে, ক্লান্ত মুখে ভেতরে এসে দাঁড়ালেন

–ও চলে গেছে, কিন্তু খুব বাঁচান বেঁচেছি আমরা জুলি, খুব!

 জুলি লাফিয়ে উঠল।

–কেন? ও কি চাইছিল?

–প্রশ্ন করছিল। আমি নিজেকে যতটা চালাক মনে করি ততটা নই। তবে ও এখন খুশী হয়েছে।

–কি প্রশ্ন করছিল?

–আমার জবানবন্দীটা মিলিয়ে দেখছিল। আমি ফাঁদে পা দিইনি বটে তবে আমি যে অন্ধ এটা যদি ও নিশ্চিত না জানতো, তবে আমি অবশ্যই বিপদে পড়তাম।

চুলের ভেতর আঙুল চালালেন ওয়েসলি। খুবই উদ্বিগ্ন দেখালো ওকে। বললেন, আজ রাতে আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। একটু অস্থির অস্থির লাগছে। চলো কোথাও বেরিয়ে একটু আনন্দ করে আসি।

জুলি নিজের কথা ভাবছিল।

–ডসন বলেছে আমি কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ লুকিয়ে রাখলে বিপদে পড়তে পারি। আমি জানতে চাই এ কথার মানে কি? আমি অন্যের জন্যে বিপদে পড়তে চাই না।

–তুমি খালি নিজের কথাই ভাব না? যতক্ষণ না কথা বলছ, ততক্ষণ তোমার কোন ভয় নেই। তোমায় কেউ কিছু করতে পারবে না। ভয় পাবার কিছু নেই।

–তুমি তো বলেই খালাস, ওরা যদি ধরে ফেলে?

–কেমন করে ধরবে, তুমি যদি কিছু না বলো। দোহাই তোমার নিজেকে নিয়ে স্বার্থপরের। মতো চিন্তা করা বন্ধ করো। তোমার এই ছোট-খাটো সমস্যা ছাড়াও আমার অন্য যথেষ্ট সমস্যা আছে। যাও জামা বদলে এসো, আমরা বেরুব।

জুলি জ্বলে উঠলো।

–তুমি আমার কথা এক মুহূর্তও ভাব না। সব সময় চাকরানীর মতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ব্যবহার পেয়ে আমি ক্লান্ত।

ওয়েসলি বলল, এ শুধু তোমার দোষ জুলি। তোমার তো এখানে থাকার কোন বাধ্যবাধকতা নেই?

–হ্যা! আমি অত বোকা নই যে সব কিছু ছেড়ে দেবো এত সহজে।

–আমার মনে হয় তুমি লোভ দ্বারা পরিচালিত হও। লোভই তোমায় চালায়। যেই একটা জিনিষ পণ্ড, সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা চাও। কখনো কিছুতেই খুশী হওনা।

জুলি রেগে উঠেবললো, তুমি আমায় লোভী বলছ? আমি মোটেও কোনদিনই লোভী ছিলাম না।

ওয়েসলি হাসলেন।

–যাক রেগে যেও না। তোমায় নিয়ে আর পারবো না। তুমি একটা যা তা জুলি। যাও পোষাক বদলে এসো। চলো আমরা বেরোই।

–আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যাবো না। আমি তোমায় ঘেন্না করি। চলে যাও আমার সামনে থেকে। আমায় একা থাকতে দাও। আমি তোমায় ঘেন্না করি। ঘেন্না করি।

বিছানায় আছড়ে পড়ে জুলি কাঁদতে লাগলো।

.

জুলির জীবনে আর কোন সুখই রইলো না।

জুলির একবার মনে হল, গয়নাগাটি সব বেচে দিয়ে স্বাধীন জীবন কাটায়। কিন্তু ও দেখল সে টাকায় ওর বেশীদিন চলবে না। টাকা ফুরোলে ওর আবার যে কে সেই অবস্থা হবে। উনি কথা দিয়েছে ওর নামে মোটা টাকা লিখে দেবেন, ধনী হবার এ সুযোগ হারান তো বোকামিরই সামিল।

বিচারাধীন সময়টা কাটলে পরে হ্যারিকে যখন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হলো, জুলিকে সরকার পক্ষের সাক্ষী হতে হলো। পুলিশকে ও যে খবর দিয়েছে, একথা সর্বসমক্ষে স্বীকার করতে জুলি ভয়ানক বিপন্ন বোধ করল।

ওয়েসলির কাছে ও বিন্দুমাত্র সহানুভূতি পেল না।

–গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে, তা হয়না। ওয়েসলি বললেন, তবে কি বলবে সেটা তোমার খুশী। আমি এ কাজ করেছি সে কথা তোমার বলার ইচ্ছে হলে বলে দিতে পারো। আমি তোমায় কোন বাধা দেব না। বলে উনি জুলির মুখে ক্রুদ্ধ, নিরাশার ভাব দেখে হাসলেন।

জুলি ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগল। ওঁর কোন ভয়ই নেই ওঁকে ধরিয়ে দেবেবলে। বারবার ওঁর এই আত্মবিশ্বাস দেখে ক্ষেপে গিয়ে জুলি বারবার পুলিশকে ফোন করতে গিয়েও ফিরে এসেছে।

শত শত চোখের সামনে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ও লজ্জায় পুড়ে যেতে লাগল। হ্যারিকে দেখে ওর বুক ফেটে যেতে লাগল। ওকে চিনতে পারলো না জুলি। হ্যারির ওজন কমে গেছে, রোগা শীর্ণ মুখ-চোখে একটা ফাঁদে পড়া জন্তুর চাউনি। ওর দিকে কিছুতেই চোখ তুলল না হ্যারি। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রইল ও। ওর চকচকে স্যুট, এই নির্মম পরিবেশে বেমানান দেখালো। দুহাতে কাঠগড়ার রেলিং আঁকড়ে রইল ও। মাথাটা নিচু করেই রইল।

সরকার পক্ষের কৌসুলী বেশ সদয়ভাবেই ওর জীবনকাহিনী তুলে ধরলেন আদালতের সামনে। একটি সন্ত্রস্ত, অনভিজ্ঞ মেয়ে, যে অবস্থার ওপর ওর হাত নেই, তেমনি অবস্থায় পড়ে ঘটনার জালে জড়িয়ে পড়েছে, এমনি একটা জুলির ছবি তুলে ধরলেন।

জুলির মনে হল উনি একটু বেশীই নির্দোষিতার ওপর জোর দিচ্ছেন। হ্যারি ওর সম্বন্ধে কি ভাবছে কে জানে। আদালতের ভিড়ের মধ্যে জুলি হ্যারির দিকে তাকাল, ও চোখ তুলল না।

কিন্তু আসামীপক্ষের কৌসুলী যখন জেরা শুরু করলেন, তখন মনে হলো আদালতের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বদলে গিয়ে, আদালতের ভালো ধারণাটা ভেঙে দিয়ে উনি ওকে যতটা সম্ভব অপদস্ত করার চেষ্টা করলেন।

উনি তাতে সফলও হলেন। মুখের ওপর প্রশ্ন করলেন জুলির সঙ্গে হ্যারির ঘনিষ্ঠতা সত্য কিনা?

জুলি উত্তরটা পাশ কাটানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু যতক্ষণ না বিভ্রান্ত, আরক্ত মুখে সে কথা স্বীকার করলো, উনি জেরা করে যেতে লাগলেন। ওর নির্দোষিতা ভেসে গেল।

তারপর আদালতে উনি জানালেন, একটা চুরির পরিকল্পনা হচ্ছে জেনেও ও স্বেচ্ছায় ব্লানশের চাকরানীর কাজ নেয়, একথা সত্যি?

এ কথার প্রতিবাদ এত উত্তেজিতভাবে করলো জুলি, যে ও নিজেই বুঝলো কেউ বিশ্বাস করছে না।

কৌসুলী আরও জিজ্ঞেস করলেন, ও এখন কি করছে?

জুলি যখন বলল মিঃ ওয়েসলিকে দেখাশোনা করছে, তখন ওয়েসলি ভদ্রলোক ওঁর পাখীর ঠোঁটের মত বাঁকা নাকের ডগা দেখতে ব্যস্ত রইলেন।

কৌঁসুলী জিজ্ঞেস করলেন, চাকরানী হিসেবে দেখাশোনা করছে?

জুলি দুম করে বলে বসলো, ও ওঁর হাউসকিপার।

কাঠগড়া থেকে নামতে নামতে জুলি উপলব্ধি করলো ও হ্যারি বা নিজেকে কোন সাহায্য করতে পারেনি। আসামীপক্ষের কৌঁসুলী ওকে হেয় প্রতিপন্ন করে ছেড়েছেন। ওয়েসলি ওকে পরে জানালেন, হ্যারিকে ওল্ড বেইলিতে দায়রায় সোপর্দ করা হয়েছে।

কাগজে কেসের খবর বিশদ ভাবে বেরোল। বারবার কাগজ পড়ে জুলি, সাংবাদিকরা ওর এবং ওয়েসলির সম্পর্ক নিয়ে যে চোরা ইঙ্গিত করেছে, তা পড়ে লজ্জায় ওর মাথা কাটা গেল। ও এও বুঝল হ্যারির বাঁচবার কোন ভরসাই নেই। যদিও হ্যারিকে কেউ গুলি করতে দেখেনি, তবু পুলিশ ঢুকেই দেখেছে যে ও পালাবার চেষ্টা করছে। ওর ব্লানশকে গুলি করে মারার কোন সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না, কিন্তু হ্যারির তা থাকতে পারে। মনে হলো কেসের ফলাফল কি হবে তা জানা যাচ্ছে।

জুলি এখন দুশ্চিন্তায় পড়ল। ও নিজেকে ভরসা দিতে লাগল হ্যারির কিছু হবে না, ওয়েসলি আত্মসম্পণ করবেন। কিন্তু ওর যখন মাথায় এটা এল যে হ্যারি কি ভীষণভাবে ফাঁদে পড়েছে, এখন ওয়েসলির যদি কিছু বিপদ বা গাড়ি চাপা পড়ে মৃত্যু ঘটে, তবে তো হ্যারিকে বাঁচানোই যাবে না, তখন চিন্তায় দগ্ধ হয়ে ও ওয়েসলির কাছে গেল।

ওয়েসলি একতাড়া কাগজ দেখতে দেখতে নামিয়ে রেখে ওকে বললেন, তুমি কি ভাব আমার হৃদয় বলে কিছু নেই? ও কথা আমি কয়েক হপ্তা আগেই ভেবেছি। ব্যাঙ্কে আমি একটা সই করা জবানবন্দী রেখেছি, আমার মৃত্যুর পর সেটা খুলে দেখা হবে। আমার যদি কিছু হয়, ও কষ্ট পাকেনা।

–কেমন করে বুঝবো তুমি সত্যি কথা বলছো?

–তোমার চরিত্ৰজ্ঞান আরেকটু বেশী থাকা দরকার, জুলি। তুমি ভাবো আমি গ্লেবকে বাঁচাবো না। তাই না?

যখন বলছে বাঁচাবে, হয়তো বাঁচাবে। জুলি ক্ষুণ্ণ গলায় বলল।

তারপর দায়রার কেস ওঠার এক সপ্তাহ আগে ফ্ল্যাটে ঢুকেই ওয়েসলি জুলিকে ডাকলেন। জুলির সঙ্গে ওঁর দুদিন দেখা হয়নি। জুলি খুব সাবধানে ঘরে ঢুকল।

–কি হয়েছে? সন্দিগ্ধ চোখে জুলি জিজ্ঞেস করল।

ওয়েসলি প্যান্টের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে ভুরু কুঁচকে পায়চারি করছেন।

–ডসনের সঙ্গে দেখা করলাম। ও বলল, ডানা ফ্রেঞ্চ এসে আসামী পক্ষের সাক্ষী হয়েছে।

জুলির মুখের রং পাল্টে গেল। ও বলল, ও তো গ্রেপ্তার হবে?

–বোঝাই যাচ্ছে গ্লেবকে ও ভালবাসে।

–কি বলতে চাইছে? জুলি চেঁচিয়ে উঠল।

–ও নিজেকে বিপন্ন করে হ্যারিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে।

–কেমন করে?

ওয়েসলি কাঁধ ঝাঁকালেন।

বন্দুকটা থিওর, থিও ব্লানশকে গুলি করেছে ও হলপ করে বলবে। ও এটা বুঝছে না যে এ সাক্ষীতে গ্লেব বাঁচবে না। তবে মনে হলো খবরটা তোমার ভাল লাগতে পারে। দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে এখনও নিঃস্বার্থ মানুষ আছে।

জুলির হাত মুঠো হয়ে গেল। হিংসায়, রাগে ও জ্বলছে। সেই রং-মাখা মেয়েটা হ্যারির জন্যে এত করবে ভাবা গিয়েছিল কি?

–তুমি আমায় ঘেন্না কর, তাই না? জুলি ওঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো।

না জুলি। তোমায় আমি ঘেন্না করি না। সত্যি বলতে কি তুমি আমার মনকে খুবই আকর্ষণ কর। তুমি পুলিশের কাছে গিয়ে সব বলে দিলে আমার মত খুশী কেউ হতো না। তখন প্রমাণ হয়ে যাবে, আমি তোমায় ভুল বুঝিয়েছিলাম।

–তুমি কি বলতে চাইছে, আমি বুঝলাম না।

–ঠিকই বুঝেছে। এখন এই মেয়েটা যা করলো সেটা দেখেও তুমি টাকা হারাবার ঝুঁকি নিলে না?

–তুমি জানোয়ারের মতো বিশ্রি ব্যবহার করছে আমার সঙ্গে। হ্যারির ফাঁসি হবে না, তুমি কথা দিয়েছে। কয়েক হপ্তার কষ্টের জন্যে আমি কেন সব হারাতে যাবো? তুমিই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। তুমি ওকে ফাঁসি যেতে দেবে না তো?

না। তবে তা বিশ্বাস করতে তোমার কষ্ট হচ্ছে, তাই না? আমার এখন মনে হচ্ছে, আমি যদি ওকে ফাঁসি যেতেও দিই, তুমি তাও কিছু ছাড়তে প্রস্তুত নও।

নিশ্চয় পারবো। তুমি কোনরকম বদমায়েশি করবে না। আমি জানি আমি ওকে বাঁচাতে পারি, তাই আমি এরকম করছি। কেন আমি সুখ, বিলাস পাবো না। সারাজীবন আমি কিছুই পাইনি।

সুখ? তুমি কি সুখী জুলি? আমার তো মনে হয়না। যখন তুমি স্বাধীন হবে, তোমার নিজের টাকা হবে, তখনো তুমি সুখী হবেনা। তোমার মত মেয়ে কোনদিন সুখী হবেনা। তুমি অবাস্তবের পেছনে ছুটছে।

–সে দেখা যাবে। আর কথাটা যখন উঠলোই, এখন বলল কত টাকা দিচ্ছো তুমি আমায়?

–আমিও এ কথাটাই ভাবছিলাম। কখন তুমি জিজ্ঞেস করবে? ভাবছিলাম বছরে দু-হাজার পাউন্ড যথেষ্ট হওয়া উচিত।

জুলি ভাবল এই সুযোগ!

দু-হাজার? আমি তোমার জন্যে এত করলাম, তার জন্যে দু-হাজার? আমি আরো চাই। আরো চাই। অনেক টাকা চাই। কাকে দিয়ে যাবে তোমার টাকা? আমি সাহায্য না করলে তোমার মূল্যবান কাজটাই শেষ করতে পারতে না তুমি। তার দাম আরো বেশী হওয়া উচিত। জুলি চেঁচিয়ে বলল, আমার পাঁচ হাজার চাই।

–ছেলেমানুষি কোর না।

–আমি পেতে চাই। আমাকে পেতেই হবে।

ওর দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে চাইলেন উনি।

–তোমার একথা কখনো মনে হয়েছে জুলি আমি সহজেই তোমায় মেরে ফেলতে পারি?

দেশলাইয়ের নিভন্ত আগুনের মতো জুলির রাগ ফুস করে নিভে গেল।

–ভয় পেলে? একটা লোক যখন একটা খুন করে, দুটো খুন করলে তার শাস্তি বেড়ে যায় না। তোমার ঐ হতভাগা সরু গলা টিপে দেবার মতো সুবিধাজনক কাজ আর কি বা হতে পারে?

 জুলি পিছিয়ে গেল।

–এক এক সময় জুলি, আমার মনে হয় তা করতে পারলে আমার বেজায় আনন্দ হবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি স্বভাব খুনী নই। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, ব্লানশকে খুন করে আমি অনুতপ্ত। শেষের দিকে যখন বুঝলাম আমার কাছে ওর কোন মূল্যই নেই, তখন ওকে শেষ করে দেওয়াই ওর যোগ্য শাস্তি মনে হল। কিন্তু আমার হাতে মৃত্যু নয়। যতদিন বাঁচবো ওকে হত্যা করার জন্যে অনুশোচনা হবে আমার। জুলি জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিষ হলো মনের সুখ। সে আমার নেই। তোমারও নেই। ভয় পেও না। আমি তোমাকে মেরে আমার বিবেককে ব্যথা দিতে চাই না। তাছাড়া তোমাকে ছুঁতেও আমার ঘেন্না লাগে। এখন যতই তোমায় দেখছি, ততই মনে হচ্ছে তুমি কি বিরক্তিকর মেয়েছেলে!

জুলি জ্বলতে জ্বলতে বলল, সে দেখা যাবে। এরজন্যে তোমায় অনুতাপ করতে হবেই। দেখো অনুতাপ করতে হয় কিনা।

ওয়েসলি হাসলেন।

.

চেয়ারিং ক্রস স্টেশনের কাছে একটা মলিন শুড়িখানায় বসেছিল বেনটন। টেবিলের ওপর ছোট ছোট গোল গোল দাগের নকশার দিকে হতাশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে হইফিতে চুমুক দিচ্ছিল। রোগা শীর্ণ শরীরটা কাঁপছিল। চোখে একটা রিক্ত হতাশা।

ও নিজেকে বলল, আমি এখন শেষ হয়ে গেছি। গত দু-সপ্তাহ ধরে ও নিজেকে গুলি করে শেষ করে দেবার কথা ভাবছে। কিন্তু আত্মহত্যা করা আর পাওনাদারদের সামনে দাঁড়ানো, দুটোর একটা করারও সাহস ওর নেই। ওর অবস্থা এখন টানটান করে বাঁধা দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মত, বুঝতে পারছে এক পা নড়লেই মৃত্যু অনিবার্য।

বেনটন আগেই ঠিক করেছে এখন ও গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। যতক্ষণ না ঘটনাচক্ৰ কিছু করতে ওকে বাধ্য করে ততক্ষণ অবধি কোনরকম কাজ করবেনা। ওয়েস্ট এঙের ফ্ল্যাট ও ছেড়ে দিয়েছে। গত চার-পাঁচ দিন ধরে পথে ঘুরে, বিভিন্ন হোটেলে রাত কাটিয়েছে। ওর পকেটে পঁয়ত্রিশ পাউন্ড আছে, শেষ হয়ে গেলে আর কিছু থাকবে না। সঠিক মনে নেই বাজারে ওর ধার কত? তবে অনুমান বিশ হাজার পাউন্ড, তার বেশীও হতে পারে, কমও হতে পারে।

ওরা যদি ধরে ফেলে তো ওকে দেউলিয়া করে ছেড়ে দেবে। ক্লাব ছেড়ে দিতে হবে। যেদিন ওর বাবা ওকে প্রথম সম্ভ্রান্ত ক্লাবের সদস্য করে দেন, সেদিন সেই থাম বসানো বড় ফটকে ঢুকে বড় বড়, নিঃশব্দ ঘরগুলোতে প্রবেশের সময়ে ওর মনে যে গর্ব হয়েছিল, আজ তা শুধুই স্মৃতি।

ওর জীবনে গর্বের বিষয় চারটি–ওর স্কুল, ক্লাব, ফ্ল্যাট এবং ওর বাবা একজন জেনারেল ছিলেন, সেই কথাটা। এগুলোর সঙ্গে ওর জীবনে আর একজন মূল্যবান ছিল ব্লানশ। আজ ও সর্বহারা। আজ ওর রাগ ওয়েসলির ওপর।

বেনটন লোকটার মধ্যে কোন আদিমতার স্ফুলিঙ্গ নেই যা ওকে হত্যায় প্ররোচিত করতে পারে। ওর ঘৃণার মধ্যে ঈর্ষা আছে, প্রতিশোধ স্পৃহা আছে, কিন্তু হিংস্রতা নেই। কালো ওভারকোট থেকে এক কণা ধুলো ঝেড়ে ফেলে ও অজান্তে হাতটা নাড়াল, তাতে বোঝা গেল অবশেষে মনস্থির করে ফেলেছে। হুইস্কিটা শেষ করে, ঋলিত পায়ে আরেকটা হুইস্কির ফরমাস দিতে গেল ও। চোখে পড়লো একটা লম্বা, শুষ্ক নিতম্বিনী, ভরা যৌবন শরীরের মেয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। একমুহূর্তের জন্যে টেনের শরীরে কামনার তরঙ্গ খেলে গেলেও ওর ময়লা চটচটে হাত, গলায় জমে থাকা ময়লা, চুলের মৃদু টক গন্ধ পেয়ে ওর শরীর শিউরে উঠলো। টেবিলে ফিরে এসে ও অর্ধেক হুইস্কি খেলো, গ্লাসটা সযত্নে রেখে ও সিগারেট বের করলো।

লাল টুপি পড়া মেয়েটা ওর কাছে এসে বলল, যদি বেশি থাকে আমি একটা পেতে পারি?

বেনটন উঠে দাঁড়ালো। ওর বাবা বলতেন জাত ভদ্রলোক বেশ্যাকে দেখলেও জাত ভদ্রলোকের মতই আচরণ করে।

বেনটন বলল, আপনি বোধহয় সময় নষ্ট করছেন। দয়া করে আমায় মাপ করবেন।

–আমার তাড়া নেই। আমি তোমায় বেজায় মজা দেব। চাইলে একঘণ্টা থাকতে দেব।

আবার তরঙ্গের মত কামনা ওর শরীরে খেলে ব্লানশের কথা মনে পড়িয়ে দিল। এখন ও একা। মেয়েটির দিকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে চেয়ে ও বাজিয়ে দেখলো। আবার মেয়েটির সঙ্গে যাবার কথা ভেবে ভয় পেল।

ভদ্রতায় অবিচল থেকে ও বলল, না, আমায় মাপ করতে হবে।

–তোমায় দেখে মনে হচ্ছে, খুবই বিরক্ত। আমি তোমায় সব ভুলিয়ে দেবো।

না। হাসি ফুটিয়ে ভেংচির মত করে বলল বেনটন।

–একটু মদ তো কিনে দাও। তাতে আপত্তি আছে?

পকেটে হাত দিয়ে খুচরোগুলো দেখে ও ভাবল, এখন ওর প্রতি পয়সা দরকার। কিন্তু ও বুঝলো বারে দাঁড়িয়ে তিনটে লোক ওকে সব্যঙ্গ চোখে দেখছে। ভয় হলো মেয়েটা চেঁচামেচি না করে।

আমার তাড়া আছে, যেতে হবে। এই যে এই নিয়ে কিনে নিন।

বেনটনের প্রসারিত হাতে আধ ক্রাউনটা দেখে মেয়েটার ঠোঁট ঘেন্না আর তাচ্ছিল্যে কুঁচকে গেল।

যাও দেওয়ালে ওটা সেঁটে দাও গে। আমাকে যদি নাই চাও, তবে আমার দিকে চেয়ে মুখভঙ্গি করছিলে কেন? ভাগো কিপটে নেংটি ইঁদুর কোথাকার?

ও তাড়াতাড়ি বার ছেড়ে বেরিয়ে এলো। পুরুষ কণ্ঠের সব্যঙ্গ হাসি শুনতে পাচ্ছে বেনটন। রাতের টাটকা বাতাসে বেরিয়ে ও বুঝলো নেশা হয়েছে ওর, সাবধানে হাঁটতে হবে ওকে। একজন অত্যন্ত বৃদ্ধা, জীর্ণ পোষাক পরা স্ত্রীলোক চেয়ারিং ক্রস স্টেশনের দিকে হাঁটছিল। বেনটন টাল সামলাতে না পেরে তার ওপরে গিয়ে পড়ল। বেনটনের কাঁধের ধাক্কা খেয়ে বৃদ্ধাটি একটা দেওয়ালের গায়ে আছড়ে পড়ে গেল।

আতঙ্কে পাথর হয়ে ও স্ত্রীলোকটির দিকে চেয়ে মাথার টুপি খুলে ক্ষমা চাইল। জীবনে ও কোন মেয়েকে ধাক্কা মারেনি। জাত ভদ্রলোক যত মাতালই হোক না কেন, মেয়েদের গায়ে পড়ে যায় না। লজ্জায় লাল হয়ে গেল বেনটন।

বৃদ্ধাটি রেগে বলল, মাতাল হয়েছ! নেশা হয়েছে তোমার, তাই রাজার মত হাঁটছো?

বেনটন আধ ক্রাউনটা পকেট হাতড়িয়ে খুঁজতে লাগল। বৃদ্ধাটা পা ঘষটে ঘষটে চলে গেল। ও হাঁ করে তাকিয়ে রইল। মাথা নিচু করে স্যান্ডের দিকে যেতে যেতে আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগল।

ওয়েসলি! না আর দেরি করবে না বেনটন। আগে ও ওয়েসলিকে সিধে করবে। তারপর নিজের সমস্যা নিয়ে পড়বে।

ও জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। দূরে বিগবেনেনটা বাজলো। স্ট্যান্ডে তখনো ভিড়। টিভোলি থেকে জনস্রোতের পায়ের শব্দ, আনন্দের হাসি শুনতে পেল। ট্রাফালগার স্কোয়ার পেরিয়ে ও সহসা একটি ফোয়ারার সামনে থমকে দাঁড়ালো।

ও ভাবতে শুরু করল কারখানার তিনজন পাহারাদার রাত এগারোটায় মিলিত হয়ে একসঙ্গে খেতে বসে। বেনটন একবার ধরে ফেলেছিল, সতর্কও করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তবু ওরা এই সময়েই মিলিত হয়। আধঘণ্টা রিসার্চ ল্যাবরেটরি খালি পড়ে থাকে। ওর কাছে এখনো চাবি আছে খুব অসুবিধা হবার কথা নয়।

ফোয়ারার কালো জলে ওর ছায়া দেখে ফিরে এল অতীতের ব্লানশের স্মৃতি। সেদিন ওর বড় বড় নীল চোখের দিকে তাকিয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল, আজ তা আবার ফিরে এল। সে দুর্লভ মুহূর্তের আর পুনরাবৃত্তি হবে না। বেনটনের সামনে এখন শুধুই ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি। সামনে তাকাবার তো কিছুই নেই। স্মৃতি আর প্রতিশোধ স্পৃহা।

তাড়াতাড়ি পালমলের দিকে হেঁটে চলল ও। চমকিত চোখে ওর ক্লাবের আলোকিত জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে, ভেতরে ঢুকে ও একটু মদ খেয়ে নিল। শেষবারের মত চারিদিকে তাকিয়ে ওর ভালই লাগল। কিন্তু দারোয়ানটার দিকে চোখ পড়তেই ও মিইয়ে গেল। দারোয়ানটা জানে কার কত টাকা আছে। ধূমপানের ঘরটায় ও উঁকি মেরে দেখল বড় বড় ইজিচেয়ার জোড়ায় জোড়ায় পাতা, নরম আলো, দুটো ফায়ারপ্লেসে কাঠের গুঁড়ি জ্বলছে, বৃদ্ধ ওয়েটারটি ট্রে বোঝাই মদ নিয়ে সংযত পায়ে গোল হয়ে বসে থাকা সভ্যাদের দিকে চলেছে। ওর এই প্রিয় ছবিটা ও বুকে এঁকে নিল। মনে বিষাক্ত তীর বিধে গেল।

সপ্তাহখানেক আগে ঐ ঘরটাই ওর জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ওয়েসলি ওর সুখের জীবন কেড়ে নিয়েছে। বেনটনের চোখ জ্বরো রুগীর মত অস্থির হয়ে উঠলো। একটা ট্যাক্সি সওয়ারি নামিয়ে আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল, বেনটন ট্যাক্সিটাকে হাত দেখাতে দেখাতে ছুটলো।

প্রথমে ড্রাইভারটি নর্টহোলটে যেতে চায়নি কিন্তু বেনটন ওর হাতে একটা এক পাউন্ডের নোট গুঁজে দিল, তখন ও গজগজ করতে করতে রাজী হলো।

বেজওয়াটার রোড ধরে ট্যাক্সিটা ছুটলো। জানলা দিয়ে হালকা বাতাস বইছে, মুখ শুকনো। আরো মদ দরকার ওর। ট্যাক্সিটা যখন শেফার্ড বুশ আন্ডারগ্রাউন্ড পেরোচ্ছে, তখন ও ড্রাইভারকে সামনের শুড়িখানায় থামতে বললো।

নিজে লোভীর মত ডবল হুইস্কি নিল ও ড্রাইভারটিকে এক পাঁইট বিয়ার কিনে দিল। বয়স্ক বলিষ্ঠ দেহের ড্রাইভারটি অসন্তুষ্ট হয়েই বিয়ারটা খেলো। কোন কথাই বলল না ওরা, শুধু প্রথমত সুস্বাস্থ্য বলল।

এখন দশটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকী। প্রচুর সময় আছে হাতে। বেনটন মদের দাম মিটিয়ে ট্যাক্সিতে গিয়ে বসল।

উডগ্রীন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন পেরোবার সময়ে ওর হঠাৎ মনে পড়ল ব্লানশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় এই পথেই ও গ্রীন ক্রিমেটোরিয়ামে এসেছিল। ও ছোট উপাসনা মন্দিরে ঢোকেনি। ওয়েসলি একাই ছিলেন। ও কিছুতেই ওয়েসলির সঙ্গে শোক ভাগ করতে পারেনি। বেনটন পাশের উৎসুক কৌতূহলী জনতার মধ্যে মিশে গিয়েছিল। মর্মান্তিক শোক বুকে চেপে ও সবার অলক্ষে সমাধিতে গিয়ে একগুচ্ছ ভায়োলেট ফুল রেখেছিল। সেই ভেজামাটির জুপের ওপর ভায়োলেটই একমাত্র ফুল দেখে ও সামান্য সুখবোধ করেছিল।

কারখানার সিকি মাইল দূরে ট্যাক্সি থামালো ও। অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল। চওড়া রাস্তাটায় ঘরফিরতি গাড়ির ভিড়। গাড়িগুলোর জোরালো আলো থেকে মুখ বাঁচাতে ও মাথা গুঁজে চলতে লাগলো।

কারখানার গেটে তালা ঝুলছে। ও ওটাই আশা করেছিল। রাস্তা দিয়ে আরেকটু এগিয়ে বেড়ার গায়ে একটা তক্তা আলগা আছে। সেখান দিয়ে ঢুকল বেনটন।

কারখানাটা অন্ধকার। কন্ট্রোলরুম এমনকি হ্যাঁঙারগুলোও রাতে বন্ধ থাকে। বেনটনের বিবর্ণ চোখ এখন বেজায় সতর্ক, হাতগুলো ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল।

সদর ফটকের তিন চারশো গজ দূরে প্রধান অফিসবাড়ির পেছনে হঁট ও টালির তৈরী একতলা রিসার্চ ল্যাবরেটরিটা লুকোনো। ওখানে পৌঁছে হঠাৎ একটা জানলায় আলো জ্বলছে দেখে বেনটন চমকে উঠলো। বেনটনের মনে পড়ল কত সযত্নে ও এই বাড়িটাকে গড়ে তুলেছিল। কর্তৃপক্ষ বার সকরুণ প্রতিবাদ জানিয়েছে ল্যাবরেটরিটা যাতে অন্যভাবে গড়া যায়। কিন্তু বেনটন জোর করেছে, তর্ক করেছে, খোসামোদ করেছে। শেষ অবধি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ ওর কথা মেনে নিয়েছে। এই ল্যাবরেটরিটার জন্যে ওর অনেক গর্ব ছিল।

আর আজ, ও সেই জায়গাতেই আগুন জ্বালাতে চলেছে। ওয়েসলি ওকে শেষ করেছে, এখন ওর পালা ওয়েসলিকে খতম করা। এই বাড়ির যেসব জটিল যন্ত্রপাতি আছে তাতেই ওয়েসলির সব টাকা লগ্নী করা আছে। বাইরে ছাউনিতে একটা পেট্রোলের ড্রাম আছে, ওটা টেনে আনবে বেনটন। তারপর একটা কাঠি ঠুকবে দেশলাইয়ের। জ্বলবে নরকের আগুন।

আলোকিত জানালার দিকে চেয়ে বেনটন ভাবলো তবে কি ওয়েসলি ওখানে আছে?

ছায়ায় লুকিয়ে বেনটন অপেক্ষা করতে লাগল। কয়েক মিনিট বাদে একটা লোক বেরিয়ে আসতে ওঁর খুড়িয়ে হাঁটা দেখেই বুঝলো ও হচ্ছে প্রধান পাহারাদার। রাতের খানা খেতে যাচ্ছে।

.

ঘরে কেউ উঁকি দিলে ভুল করবে যে এ ঘরে শান্তি বিরাজ করছে। ওয়েসলি ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে কিছুক্ষণ বাদে বাদে পাশের টেবিল থেকে একটা একটা করে কাগজ নিচ্ছিলেন। দেখছিলেন, পাশে পরিষ্কার অক্ষরে নোট করছিলেন। ওঁর উল্টোদিকে নীল আর সাদা উল মিলিয়ে জুলি একটা গোলমেলে প্যাটার্ন বুনছিল। দুরঙা উলের বল কোলের ওপর নিয়ে দক্ষ হাতে দ্রুতগতিতে প্যাটার্নটা বুনছিল।

কাটার শব্দ আর কাগজের খসখসানি ছাড়া এ ঘরে অন্য কোন আওয়াজ নেই। জুলি বেরোতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একলা আর বেরোয় নি। তাই ওর বোনাটা এ ঘরে এনে আগুনের পাশে বসেছিল।

সারাদিন নিঃসঙ্গ ভাবে কেটেছে ওর। এখন সঙ্গ চাইছিল ও। এমনকি ওয়েসলির নীরব সঙ্গও যেন বহুদিন পরে এই প্রথম ওর মনে বিচ্ছিন্ন একটুকরো শান্তি এনে দিয়েছে।

সহসা ওর প্রশান্তি ছিন্নভিন্ন করে টেলিফোনটা তীক্ষ্ণ আওয়াজে বেজে উঠল। সেই ঘন্টার তীক্ষ্ণ আওয়াজ নিভৃত ঘরটিতে বিপদের সঙ্কেত বয়ে আনলো যেন।

এমনকি ওয়েসলিও চমকে উঠলেন।

কাগজে নামিয়ে রেখে ওয়েসলি বললেন, মাঝে মাঝে মনে হয় টেলিফোনটা আবিষ্কার না হলেই ভাল হতো। জুলি ফোনটা ধরবে? বলে দাও আমি ব্যস্ত আছি।

জুলি বোনা থামিয়ে অসন্তুষ্ট মনে টেলিফোন ধরল। একটি পুরুষ কণ্ঠ ওয়েসলিকে চাইছে। পুরুষটি বলল, খবরটা খুব জরুরী আমি কারখানা থেকে ফোন করছি। গলাটা উত্তেজিত, চেঁচিয়ে কথা বলছে।

কারখানার ফোন। ফোনটা ওয়েসলিকে এগিয়ে দিল।

 জুলি শুনতে পেল ফোনের ওপারের লোকটি চেঁচাচ্ছে। ওর অস্পষ্ট কথাগুলোর মধ্যে আগুনকথা জুলি বুঝতে পেরে ওয়েসলির দিকে তাকালো। ওয়েসলির মুখ পাংশুটে সাদা হয়ে গেল দেখে জুলি বুঝলো একটা বিপদ হয়েছে।

ওয়েসলি আড়ষ্ট হয়ে বললেন, আমি আসছি।

 লোকটি চেঁচাতেই থাকলো।

ওয়েসলি সংহত ধীর কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। হ্যাঁ ওকে রাখ, যতক্ষণ না আমি আসি। আমি এক্ষুনি আসছি। রিসিভার নামিয়ে এক মুহূর্ত জুলির দিকে চেয়ে রইলেন। জুলি ভয় পেল।

–কি হয়েছে?

–বেনটন ল্যাবরেটরিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

–বেনটন! কিন্তু কেন?

–তাতে আর কি এসে যায় বলো? হাতের চেটো দিয়ে মাথার রগের দুপাশ চেপে ধরলেন।

কিছু না ভেবেই জুলি বলল, তুমি কি চাও যে আমি আসি?

অনেক চেষ্টায় ওয়েসলি নিজেকে সামলালেন।

–হ্যাঁ। যতক্ষণ না ক্ষতির পরিমাণটা দেখি, ততক্ষণ এই ভান আমাকে করে যেতে হবে। আমাকে নিয়ে যাবার কেউ না থাকলে বেখাপ্পা দেখাবে। তাছাড়া আগুনটা দেখে তোমার বেজায় আনন্দ হবে। আগুনের দৃশ্যটা সাংঘাতিক হওয়া উচিত।

ওর ঠাণ্ডা নিপ্রাণ গলা শুনে জুলির শরীর কেঁপে উঠল।

–এমন হয়েছে না কি?

মনে হচ্ছে। চল কপালে থাকলে ট্যাক্সি পাবো।

পিকাডিলিতে ওরা ট্যাক্সি পেয়ে গেল।

সন্ধ্যার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ট্যাক্সি এঁকেবেঁকে চলতে লাগল। জানলার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ওয়েসলি বলল, দেখেছ জুলি, কি আশ্চর্যজনক ভাবে ঘটনাগুলো ঘটে যায়? আমি ভেবেছিলাম পাকা কাজ করেছি, কিছুতেই ভেস্তে যেতে পারে না আমার পরিকল্পনা। অবশ্য ল্যাবরেটরিটাই ছিল আমার চাবিকাঠি অথচ ওটার কথাই ভাবিনি। এখন মনে হয়না তোমার বন্ধু গ্লেবের কেসটা হবে।

জুলি ওর সাদা মুখের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখল।

–আমি বুঝলাম না।

ল্যাবরেটরি যদি পুড়ে যায় তাহলে আমার কোন কাজ হবে না। তাহলে সব কিছুই শেষ হয়ে গেল।

–তুমি বলতে চাও তুমি আর সময় পাবে না?

–অথবা টাকা।

 জুলি কুঁচকে সরে গেল।

-এর সঙ্গে টাকার যোগাযোগ কোথায়?

 ল্যাবরেটরির জিনিষপত্র যোগাবার জন্যে আমি টাকা ধার করি। টাকা ধার পাবার জন্যে আমি বন্ড দিই। যদি ল্যাবরেটরি গিয়ে থাকে তবে বণ্ডও গেছে।

জুলির অসুস্থতা বোধ হলো।

–তার মানে তোমার টাকা আর থাকবে না? তাহলে আমার কি হবে? তুমি তো আমাকে টাকা লিখে দেবে বলেছিলে?

জানি। আমি অনুতপ্ত, আমি তো জানতাম না এরকম ঘটনা ঘটবে। টাকা আমার কিছুই থাকবেনা। আমার যথাসর্বস্ব দিয়ে ল্যবরেটরি গড়া হয়। কিন্তু ফার আর গহনা মিলিয়ে তুমি অনেক দাম পাবে। সাবধানে চললে সব ঠিক হয়ে যাবে।

জুলি রাগে অস্থির হয়ে চেঁচিয়ে বলল, তুমি আমাকে ঠকিয়েছে। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে। আমি এত সব সহ্য করার পর! জাহান্নামে যাও তুমি। আমার আগে বোঝা উচিত ছিল এরকম হতে পারে। ঠিক আছে, এখন আমি পুলিশের কাছে যাবো। আমি তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব।

–আমি দুঃখিত জুলি। কথা দিলেও কোন কিছু পাওয়ার যোগ্য তুমি নও। সুযোগ পেলে কথা রাখতাম। বিশ্বাস করো।

–তোমার শুধু কথা! তোমার খালি বাকপটুত্ব। তুমি কথা বলে আমাকে রাজি করিয়েছিলে। তুমি আর তোমার মত বাজে প্রতিশ্রুতি। রাগের চোটে ওর চোখ ফেটে জল এল। ট্যাক্সির একপাশে চুপ করে বসে রইল।

–তুমি ফারগুলো পাবে। ওগুলো থেকে তোমার সুখ পাবার কথা কিন্তু কেন জানিনা তা তুমি পাবে না। কি করবে জুলি? তুমি গ্লেবকে ভালবাস না? গ্লেব জেল থেকে বেরোন অবধি অপেক্ষা করবে?

–হ্যাঁ। ও তোমার মত অপদার্থ নয়। আমি ওর জন্যে অপেক্ষা করবো। তুমি যখন ফাঁসিতে ঝুলবে, তখন আমাদের কথা ভাববে।

ট্যাক্সিটা হোয়াইট সিটি পেরিয়ে গেল। রেসের জন্যে ঝুলন্ত আলোয় ট্যাক্সির ভেতরটা মুহূর্তের জন্যে ঝলসে উঠলো। আলোয় দুজনে দুজনের দিকে তাকালো।

–এতটা তিক্ত হয়ে যেওনা জুলি। তোমার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হয়েছে আমার। তবে আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়, তাই আশাভঙ্গকে মেনে নিতে শিখেছি। আরো সময় পেলে গোড়া থেকে শুরু করতাম, কিন্তু এখন তা অসম্ভব। ব্লানশকে খুন করাই ভুল হয়েছিল। দেখলে তাতে আমার কিছু ভাল হলো না।

জুলি হতাশায়, ক্ষোভে চুপ করে রইল।

ওয়েসলির হাতে এত সইল জুলি, এখন কিনা টাকা নেই?

–আমি বিশ্বাস করতে পারছি না বেনটন এরকম কাণ্ড করতে পারে।

–শুনলাম ও ভীষণরকম পুড়ে গেছে। ওয়েসলি হতাশ হয়ে বলল।

–চুপ কর! আশা ভঙ্গে অস্থির হয়ে পড়েছে জুলি। বলল, ঐ তুমি পার কথা বলতে আর ধাপ্পা দিতে। ও ঘুরে তাকিয়ে বলল, কি করে জানবো এত কিছুর পরও তুমি আমাকে ফারগুলো দেবে? কেমন করে জানবো তুমি আমায় ঠকাবে না?

–সকালে আমার ব্যাঙ্কে গেলে ওরা তোমায় একটা চিঠি দেবে। পুলিশের জন্যে স্বীকারোক্তিও আছে। আমি সব গুছিয়ে রেখেছি।

–তুমি যাও। আমি আর তোমার হুকুম, ফরমাস শুনছি না। এখন সব বদলে গেছে।

–বেচারি জুলি। তোমার জন্যে আমি ভয়ানক দুঃখিত।

ওরা দূরের আকাশে একটা বিশাল লাল আভা দেখতে পেল। ট্যাক্সির গতি মন্থর হলো।

 ওয়েসলি বললেন, ঐ যে। বলেছিলাম না দৃশ্যটা দেখার মত হবে।

জুলি দেখল ওয়েসলির হাত কাঁপছে, তবুও ওর করুণা হলো না। ও ফার আর গয়নাগুলো বেচবে। যে টাকা পাবে, হ্যারির যে জমানো টাকা আছে সব মিলিয়ে ওদের চলে যাবে।

ট্যাক্সি কারখানার কাছে আসতে ওরা আকাশে লাল আর তৈলাক্ত কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে দেখলো। রাস্তার দুধারে সারবাঁধা গাড়ি। একটা বিশাল জনতা আগুন দেখতে চলেছে। চারিদিকে কোলাহলে পরিপূর্ণ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, হাসি, পায়ের শব্দ।

একটি পুলিশ ট্যাক্সি থামালো।

 ধীর কণ্ঠে বলল, যেতে পারবেন না। রাস্তায় জলের হোসপাইপ আছে।

ওয়েসলি বললেন, আমরা হাঁটবো। ওরা গাড়ি থেকে নামলেন।

ওয়েসলি গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন, তুমি অপেক্ষা করো, এই মহিলা ফিরবেন। ঘাসের ওপর দিয়ে জুলি পেছন পেছন চলল। ওয়েসলি ওর বাহু ধরে ভীড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। একজনের ধাক্কায় ওঁর কালো চশমাটা পড়ে গেল। জুলি পেছনেই ছিল। ওর পায়ের চাপে চশমাটা গুঁড়ো হয়ে গেল। ও যেন তৃপ্তি পেল। এবার ওয়েসলি শেষ। ওর মনে হল, এই কাঁচ ভেঙে যাওয়ার মতো ওদের পারস্পরিক সম্পর্কও শেষ হয়ে গেল।

জুলি বলল, চশমা ভেঙে গেছে।

–আর কি এসে যায়? তুমি দেখতে পাচ্ছেনা জুলি আমার কিছুতেই আর কিছু এসে যায়না?

ওরা কারখানার গেটে পৌঁছল। জল ছাড়বার হিস হিস শব্দ পেল ওরা। আগুমের গর্জন এখন কাছে। গেটের পুলিশদের সঙ্গে ওয়েসুলি কথা বলে একটা কার্ড দেখালেন, ওরা ওঁকে গেট ছেড়ে দিল।

ওঁকে দেখতে পেয়ে গেরিজ ছুটে এল। ওর চোখে তৈলাক্ত ঝুলের কালো ছোপ, চোখে শঙ্কিত দৃষ্টি।

–খুব খারাপ অবস্থা। ওয়েসলি ওর হাত চেপে ধরলেন।

গেরিজ একমুহূর্ত কথা বলতে পারল না। টোক গিলল। ওয়েসলির হাত ধরে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো।

তারপর ফেটে পড়ল, কিছু নেই। সাংঘাতিক ব্যাপার। ল্যাবরেটরি একটা জ্বলন্ত চুল্লী। ওরা ওটা বাঁচাতে পারবে না।

–আর বেনটন? ওয়েসলির নিচু, শান্ত গলা।

–খুব পুড়ে গেছে, তবে বেঁচে আছে।

গেরিজ ওয়েসলির দিকে তাকাল, কিন্তু আপনার চোখ স্যার? চোখ ঠিক হয়ে গেছে? আপনি দেখতে পাচ্ছেন?

–হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। আমাকে বেনটনের কাছে নিয়ে চলো।

–খুব ভাল কথা স্যার। গেরিজ যেন বিভ্রান্ত বোধ করছে। বলল, কখন হলো স্যার, সেই অপারেশনের পর?

আমাকে বেনটনের কাছে নিয়ে চলো। ওয়েসলির রুক্ষ গলা।

 গেরিজ আড়ষ্ট হয়ে উঠল।

উনি ওখানে স্যার। প্রধান অফিসের পাশের ছোট বাড়ির দিকে আঙুল দেখালো। বলল, আমাকে ফিরে যেতে হবে স্যার। আগুন ছড়িয়ে পড়বার আগে ফাইল-পত্র সরাচ্ছি।

ঠিক আছে, তুমি যাও। জুলি তুমি আমার সঙ্গে এসো।

অনেক হোসপাইপের লাইন পেরিয়ে গেল ওরা। বেনটন মেঝেতে শুয়ে আছে। মাথাটা ওভারকোটের ওপর, গায়ে কম্বল।

কাছেই একটা চেয়ারে একটা পুলিশ বসে আছে। ওয়েসলিকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

–আমি হাওয়ার্ড ওয়েসলি। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি?

–হ্যাঁ স্যার। ওঁর খুব খারাপ অবস্থা। অ্যাম্বুলেন্স এলেই ওঁকে নিয়ে যাবে।

ওয়েসলি বেনটনের অনড় শরীরটার দিকে এগোল। জুলিও গেল।

–হ্যালো হিউ! ওয়েসলি হাঁটু গেড়ে বসলো।

 বেনটন বিবর্ণ চোখ দুটো খুলল।

 ক্ষীণকণ্ঠে বলল, কে ওয়েসলি?

–হ্যাঁ। খুব বেশী পুড়ে গেছে?

বেনটন ভুরু কুঁচকে, নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অতিকষ্টে বলল, শুধু মনে হচ্ছে যদি একাজ না করতাম! তোমাকে জব্দ করতে চাইলাম। কিন্তু যেই আগুন ধরল তখন ভীষণ ভুল করে ফেলেছি ভেবে আগুন নেভাতে গেলাম। এতদিনের পরিশ্রম পুড়ে শেষ হয়ে যাবে! কিন্তু আগুনের সঙ্গে পারলাম না। মনে হলো আমি মরে যাচ্ছি। মরে গেলেই ভাল হতো। ও চোখ বন্ধ করলো।

সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন আমাদের যা করা উচিত তাই করি। সবচেয়ে খারাপ হলো অনুতাপ করা। আমিও অনুশোচনা করছি। আমি জানি তোমার মনের অবস্থা। যখন অন্যায়টা করি তখন আমাদের আত্মবিশ্বাস কোথায় থাকে? পরে বুঝি কি মূর্খতা করেছি।

–হ্যাঁ ঠিক তাই। আমি অনুতপ্ত। আমি সত্যিই অনুতপ্ত ওয়েসলি।

–আমরা এ জায়গা গড়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম, না? এতে কৃতিত্ব আমার যত, তোমারও

বেনটন ওঁর সাদা, ক্লান্ত মুখের দিকে তাকাল।

কখনো ভাবিনি তোমার মুখে একথা শুনবো। এ…তোমার মহৎ মনেরই পরিচয়। ওর রোগা শরীরটা কেঁপে উঠল, হাত মুঠো হলো, মনে হচ্ছে আমার পায়ে এখনও আগুন জ্বলছে।

–এই অ্যাম্বুলেন্স এখুনি আসবে। ওরা তোমায় ঠিক করে দেবে।

–যদি ব্লানশ মাঝখানে না থাকতো, তাহলে এঘটনা ঘটতো না। আমরা একসঙ্গে কাজ করে যেতাম। বেনটনের মুখে ক্লান্তি।

–হ্যা…ব্লানশ! ওয়েসলি উঠে দাঁড়ালেন। ল্যাবরেটরিটা শেষবারের মতো দেখে আসি। ভাবলাম তোমাকে আগে দেখে যাই।

বেনটন ক্ষীণকণ্ঠে বলল, কি যেন হয়েছে তোমার। বুঝতে পারছি না তোমার কি হয়েছে। …তোমার চোখ?

–ভেবনা ওসব কথা। কিছু ভেবনা। আচ্ছা হিউ! ওয়েসলি সামনে ঝুঁকে হাত বাড়ালেন, চলি, তুমি সেরে উঠবে।

টেন ওর হাত চেপে ধরল।

–আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে ঘেন্না করবে। আমি মুখ…অনুতপ্ত।

–আচ্ছা, বিদায়! হাত টেনে নিলেন। দরজা পর্যন্ত গেলেন উনি, জুলি…!

 জুলি ওঁর কাছে গেল।

–এস জুলি।

 ল্যাবরেটরির এদিকের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ার ভয়ঙ্কর শব্দ হলো। সেই ধোঁয়ায় প্রচণ্ড উত্তাপে ওরা দুজন এক মুহূর্ত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এ ওর দিকে চাইলেন।

ওয়েসলি বললেন, ফ্ল্যাটে যাও। ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে। কাল ডসনের সঙ্গে দেখা করে স্বীকারোক্তিটা দিও। ওর জোরে গ্লেব বেঁচে যাবে। ফারগুলো সাবধানে বিক্ৰী কোর, তোমার। ভাল থাকাই উচিত। আশা করি তুমি সুখী হবে জুলি।

জুলি বিমূঢ়ভাবে ওর দিকে চাইল। আগুনের হা–হা–হা গর্জনে ওঁর গলা শুনতে কষ্ট হচ্ছে।

–কি করবে তুমি? জুলি জিজ্ঞেস করল।

আমার কথা ভেবোনা। এই যে গেরিজ, তুমি মিস্ হল্যান্ডকে ট্যাক্সিতে পৌঁছে দাও।

 বলেই ওয়েসলি দ্রুত পায়ে সামনে যেতে থাকলেন।

–কোথায় যাচ্ছে ও? হঠাৎ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো জুলি। ওকে থামাও। ওকে যেতে দিও না।

ও ওয়েসলির পেছনে ছুটতে থাকলো। কিন্তু গেরিজ ওকে টেনে হিঁচড়ে থামালো।

–নিরাপদ নয়, ওদিকে যাবেন না। গেরিজ উত্তেজিত ভাবে বলল।

–আমায় যেতে দাও! চেঁচিয়ে হাত ছাড়িয়ে জুলি ছুটতে লাগলো।

 প্রধান অফিস বাড়িগুলোর কোণ দিয়ে পেছনে চলে গেলেন ওয়েসলি। জুলি যখন কোণে পৌঁছল প্রচণ্ড আগুনের হলকা ওকে যেন চড় মারলো। ধোয়া আর ফুলকির বন্যা বাতাসে ভেসে ওকে ধরতে এল, জুলি পিছিয়ে গেল।

কাছাকাছি একটা বাড়ির পেছনে দমকলকর্মীরা জল ছুঁড়ে চলেছে। তাদেরই একজন ওয়েসলিকে জ্বলন্ত ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল। দুজন দমকলকর্মী ওর পেছনে ছুটল। ওরা বেশী দূর এগোতে পারলোনা। আগুনের গনগনে আঁচের হল লেগে আরা পিছিয়ে এল।

ওয়েসলির যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে মাথা উঁচু করে, প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে থাকলেন। দূর থেকে জুলি মুখে হাত ঢাকা দিয়ে দেখতে থাকল। ওঁর পোষাকে ধোঁয়া। হঠাৎ হাতের কবজি আর গোড়ালি জড়িয়ে পাক দিয়ে উঠতে লাগল আগুনের লেলিহান শিখা। জুলি মুখে হাত চাপা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।

গেরিজ অগ্নিবেষ্টনীর মধ্যে একবার মাত্র ওয়েসলিকে দেখতে পেল। একটা বিশাল, ভয়াল শব্দের বিস্ফোরণ। কাঠ আর ধাতুর জ্বলন্ত ধস ওয়েসলিকে অদৃশ্য করে ফেলল। উনি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সে জায়গাটা লেহন করে একটা লম্বা লকলকে আগুনের জিভ আনন্দে আকাশপানে লাফিয়ে উঠলো।

.

ওয়েসলির চিঠি এখন জুলির হাতে। তাতে ফারগুলো নেবার নির্দেশ দেওয়া আছে। পুলিশের কাছে ওয়েসলির স্বীকারোক্তিও ওরই হাতে। এখন জুলি জানে ও কি করবে। পরদিন হ্যারির মামলা শুরু হবার কথা, অতএব একেবারে শেষমুহূর্তে উদ্ধার পাবে হ্যারি। ঠিক যেমনটি দেখা যায় সিনেমায়।

ওর মনে হল হ্যারি কোনদিন ভুলবে না যে আমিই ওকে বাঁচিয়েছি। কিন্তু জুলি অত বোকা নয়। হ্যারিকে উদ্ধারের আগে ও ফারগুলো চায়। তারপর ডসনের সঙ্গে দেখা করবে। প্রথম কাজ হল ফারগুলো হস্তগত করা। আর্কটিক ফারটা যদি পরে নিতে পারে, তাহলে ওর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। আর ডসনকেও চমকে দেওয়া যাবে।

একবার ওয়েসলির স্বীকারোক্তিটা পড়লে ডসন ওকে হ্যারির সঙ্গে দেখা করতে দেবে। ও হ্যারির জন্যে অপেক্ষা করবে একথা ও হ্যারিকে জানাবে। একথা জানবে যে, মুক্তির দিন জুলি জেলগেটে অপেক্ষা করবে, তবে হ্যারি বুকে ভরসা নিয়ে হাজতবাসের দিনগুলো কাটাতে পারবে। ভাবতে গিয়ে জুলি একটু কেঁদেও ফেলল। ও যেন মানসচোখে দেখতে পেল হ্যারি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জেলের বিশাল ফটক থেকে বেরোচ্ছে, শীতে কাঁপছে, বরফ পড়ছে, হা…বরফ পড়তেই হবে। বরফ হ্যারির ওভারকোটে পড়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে। জুলিও সারা গায়ে ফার জড়িয়ে একটা বিশাল বড় গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। কোমল–মমতায় হারিকে বুকে টেনে নেবে ও।

ওয়েসলির মৃত্যু জুলিকে নতুন জীবন দিয়ে গেল। ওঁকে আগুনে পুড়ে মরতে দেখে প্রথম ঘন্টাখানেক ওর খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এখন ওয়েসলি ওর মন থেকে একেবারে মুছে গেছে। এখন ও মনকে বোঝাল, উনি তো ওকে পছন্দ করতেন না। শুধু নিজের স্বার্থে জুলিকে কাজে লাগিয়েছিলেন। কোন করুণাই পায়নি জুলি ওঁর কাছ থেকে।

অবশ্য ওর হাতে টাকা থাকবে। মিসেস ফ্রেঞ্চের কথা মনে আছে ওর। বলেছিলেন ফারগুলোর দাম ত্রিশহাজার পাউন্ড। এ তো আইরিশ ডার্বি জেতার মতো টাকা। ত্রিশ হাজার পাউন্ড পেলে দুনিয়া তোমার হাতের মুঠোয়। তারপর গয়না তো আছেই। হীরের দাম এখন খুবই চড়া। জুলি ঠিক করেছে, গয়নার কথা হ্যারিকে কিছু বলবে না। গয়না ও ব্যাঙ্কে রেখে দেবে, অসময়ের কথা ভেবে। আর হ্যারিও যে ওর জীবনের শেষদিন অবধি টিকে যাবে, সে ভরসাও জুলির নেই। মেয়েদের নিজের কথা ভাবা উচিত। জুলি নিজেকে বোঝাল।

.

ওয়েসলির স্বীকারোক্তিতে হ্যারির নির্দোষিতা প্রমাণ হয়ে গেছে। ওয়েসলি লিখেছেন কেমন করে উনি ব্লানশকে বাড়ি ফিরে আসতে প্ররোচিত করলেন। উনি ট্যাক্সিতে টোপ ফেললেন। ওয়েসলি ব্লানশকে এমন ইঙ্গিত করলেন যে ওরা থিয়েটারে বেরোলেই বেনটন জুলির সঙ্গে দেখা করে প্রেম করবে। টোপটা ব্লানশ গেলে। ও জানতে বেনটনের প্রতি ব্লানশ-এর দুর্বলতা। , আর সেটাই ব্লানশকে খেপিয়ে তুলল। ও থিয়েটারে মদ গিলেই ওয়েসলির সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে ফিরে এসে গ্যারেজের গেট দিয়ে বাড়ি ঢোকে। ব্লানশ সদর খুলতেই ওয়েসলি ওকে লিফট থেকে গুলি করেন, পিস্তলটা হলঘরে ছুঁড়ে ফেলে দেন। পিস্তলটা যোগাড় করেছিলেন একজন আমেরিকান সৈনিকের কাছ থেকে। লোকটির নাম এবং সার্ভিস নম্বর উনি লিখে দিয়ে গেছেন। দু বছর আগে ওটা উনি কেনেন। উনি জানেন ওটার খোঁজ করতে কোন অসুবিধা হবে না। পরিকল্পনার পিছনে বিপদ থাকলেও সফল হওয়া যায়।

পিকাডিলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে জুলি স্বীকারোক্তিটা বুকে জড়িয়ে ধরলো। এটা এখন হ্যারির জীয়নকাঠি। তার চেয়েও বড় কথা ওর ভবিষ্যত সুখের চাবিকাঠি। এটা খোয়া গেলে হ্যারিকে বাঁচানো যাবে না। ও স্বীকারোক্তিটা আঁকড়ে ধরে একবার ভাবল ট্যাক্সি নিয়ে কেনসিংটন পুলিশ স্টেশনে যাওয়াই বোধহয় ঠিক কাজ হবে। কিন্তু পার্কওয়ের আর্কটিক ফারটা তো ওকে পড়তেই হবে। ওটা পড়লে জুলিকে চিত্রতারকার মতো দেখাবে আর ডসনকেও খুব চমক দেওয়া যাবে। জুলি ট্যাক্সির জন্যে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল।

পার্কলেন দিয়ে লাইটস ব্রিজে যেতে যেতে ও কল্পনার প্রাসাদ গড়তে লাগল। ফারগুলোর দাম ত্রিশহাজার হলেও বিশ হাজার পেলেও পেতে পারে। কিন্তু বিশ হাজারই বা কম কি? বিশ হাজার দিয়ে ও, হ্যারি যদি লন্ডনেই থাকতে রাজী হয় তবে ও জেল থেকে বেরোবার সময় একটা ফ্ল্যাট সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলে বেশ ভাল হয়। ও ভাবতে লাগল শোবার ঘরের রঙ কি হবে? আসবাব কি কি থাকবে? ভাবতে ভাবতে ইতিমধ্যে পার্কওয়ে পৌঁছে গেল ট্যাক্সি।

দারোয়ানের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে ওর একটু অস্বস্তি হলো। তবে তার দরকার হলো না। দারোয়ান দুপুরের খাবার খেতে গেছে, সহকারী তখনও আসেনি।

ওয়েসলির ফ্ল্যাটের সদর দরজা খুলে ও যখন ঢুকলো, তখন কেউ ওকে দেখতে পায়নি। এক মিনিট দাঁড়িয়ে ও কান পেতে রইল। এখানে একলা আসাতে ওর একটা অশরীরি অনুভূতি হচ্ছে। কার্পেটে সেই হালকা বাদামি দাগ, বাতাসে এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে ব্লানশের গায়ের সুগন্ধি।

ব্লানশের ঘরে ঢুকে জুলি দরজা বন্ধ করে অ্যালম বন্ধ করল। তারপর আলমারী খুলল। ফটো ইলেকট্রিক সেলের বাতিগুলো নেভালো। একমিনিট মন ভরে সপ্রশংস দৃষ্টিতে ফারগুলো দেখলে। এখন ওগুলো ওর। ওর যা ইচ্ছে করতে পারে এগুলো নিয়ে। এটা জুলির চূড়ান্ত আনন্দের মুহূর্ত। কিন্তু ও গয়নার কথা ভোলেনি। এখন অবধি ও ব্লানশের সব গয়না দেখেনি। গয়না থেকে মোটা টাকা পাওয়া যাবে। অনেক টাকা।

গয়নার কথা মনে পড়তেই ও ফারগুলো সরিয়ে আলমারীতে ঢুকলো। গয়নার আলমারীর ওপর ওর ব্যাগটা রাখলো। হঠাৎ খেয়াল হলো গয়নার আলমারী কি করে খোলে তা তো ওর জানা হয়নি। গয়নার আলমারী পালিশ করা দরজায় কোন চাবি ঢোকাবার ফুটো নেই কিন্তু দরজার মাঝামাঝি জায়গায় একটা ছোট্ট কালো বোতাম ওর চোখে পড়ল। ও সেটাছুঁলো, ভুরু কোচকালো, আঙুলে চেপে ধরুল বোতামটা, টান দিলো।

হঠাৎ বাতাস বেরিয়ে যাবার শব্দ হলো। হ..ই…স। আলমারীর দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

চারদিন বাদে ওর খোঁজ পেল পুলিশ। ডসনের হঠাৎ মনে হয়, হয়তো জিনিষের লোভে গিয়ে জুলি আলমারিতে আটকা পড়েছে। ওরা যখন দরজা খুলল, দেখলো যে আর্কটিক ফারের ওপর জুলির এত লোভ ছিল তারই নিচে, ওয়েসলির স্বীকারোক্তি হাতে চেপে ধরে পড়ে আছে জুলি।

ওর জন্যে কিছু করা গেল না বটে, কিন্তু হ্যারির কপাল জুলির চেয়ে ভালো ছিল। সেই কপালজোরেই ও মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়ে আঠারো মাসের কারাদণ্ড ভোগ করল। আশ্চর্য এই যে, ও যখন জেল থেকে বেরোল জুলির সেই কল্পনার ছবির মতো বরফ পড়ছে। কিন্তু কোন সুসজ্জিতা তরুণী ওকে নিয়ে যাবার জন্যে দাঁড়িয়ে নেই।

শুধু স্যালভেশন আর্মির একটি কর্মী হ্যারির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর নাকের কাছে চাঁদার বাক্স তুলে ঝন্‌ঝন্ করে বাজিয়ে চাঁদা চাইল।