৫. বিজয়পুরের রায়বাহাদুর হেরম্ব রায়

বিজয়পুরের রায়বাহাদুর হেরম্ব রায় অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। অপদার্থ মাধব চৌধুরীর সঙ্গে ছোট মেয়ে ফুলির বিয়ে দেওয়ার পর থেকেই তাঁর মেজাজ খাট্টা হয়ে আছে। সত্য বটে হেতমগড়ের জমিদারদের একসময়ে খুব রবরবা ছিল, তাদের বংশও ভাল, বিজয়পুরের পাণ্টি ঘর। দশ-বিশ বছর আগেও হেতমগড়ের চৌধুরী-বাড়িতে মেয়ে বা ছেলের বিয়ে দিতে পারলে যে-কেউ ধন্য হয়ে যেত। হেরম্ব রায় অবশ্য ধন্য হওয়ার লোক নন, কিন্তু তিনিও এই বিয়েতে খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর শালীদের ঠাট্টায় জামাইটা যে এমন আহাম্মকির কাজ করবে তা জানবেন কী করে? শালীরা নাড়র মধ্যে সুপুরি দিয়েছিল। তা ওরকম তো শালীরা করেই থাকে। হেরম্ব রায়ের নিজের বিয়ের সময় তার শালীরা পানের মধ্যে ধানী লঙ্কা দিয়েছিল, লুচির মধ্যে ন্যাকড়ার টুকরো ভরে দিয়েছিল, মুনগোলা শরবত খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। তিনি কোনো ঈদে ধরা দেননি। কিন্তু তার আহাম্মক ঘোট জামাই বাহাদুরি দেখাতে আস্ত সুপুরি চিবিয়ে খেতে গিয়ে দাঁতগুলোর বারোটা বাজাল। খবর পেয়েছেন, জামাই এখন বাঁধানো দাঁত পরে থাকে। ছিঃ ছিঃ! একে তো ঐরকম গবেট, তার পর আবার আছে আঠারো আনা তেজ। বিয়ের পরদিনই শ্বশুরবাড়ির সংস্রব ছেড়ে চলে গেছে, আর ওমুখো হয় না।

হেরম্ব রায় ভেবেছিলেন, ওরকম জামাইয়ের মুখদর্শন আর করবেন। হেতমগড়ের সেই নামডাকও আর নেই। সরস্বতীর বানে বিষয় সম্পত্তি সবই জলে গেছে। জামাইটা তার জমিদার ভগ্নীপতির গলগ্রহ হয়ে আছে। এমন জামাইকে জামাই বলে স্বীকার করতেও লজ্জা হয়।

কিন্তু বাদ সেধেছে ফুলি। এতকাল সে চুপচাপ ছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ এক রাতে সে স্বপ্ন দেখেছে, জামাই হতচ্ছাড়া নাকি একটা গ্যাস-বেলুন ধরে ঝুলে-ঝুলে আকাশ দিয়ে যাচ্ছে। এ-বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নাকি সে বলে গেছে, “তিব্বতে সন্ন্যাসী হতে চললুম। আর ফিরব না।” সেই থেকে মেয়ে বেঁকে বসেছে, বাপের বাড়িতে আর থাকবে না। পাগল হোক, বোকা হোক, গলগ্রহ হোক, মাধবকে ফিরিয়ে আনতে হবে। দরকার হলে সে গাছতলাতেও থাকতে রাজি।

শুনে প্রথমটায় হেরম্ব ভীষণ চটে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফুলি হেরম্ব রায়েরই মেয়ে তো। তেজ তারও কিছু কম নয়। সে সোজা গোটা দশেক করবী ফুলের বিচি আর একটা নতুন দড়ি নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে দোর দিয়েছে। দুদিন ধরে দরজা ঠায় বন্ধ। বাইরে থেকে মা পিসি মাসি কাকা ভাই বোনের কাকুতি-মিনতিতেও দরজা এতটুকু ফাঁক হয়নি। ফুলি বলে দিয়েছে, তিনদিনের মধ্যে ছোট জামাইকে সসম্মানে হাজির করা না হলে সে হয় বিষ খাবে, নয়তো গলায় দড়ি দেবে, কিংবা দুটোই একসঙ্গে করবে। সেই থেকে হেরম্ব আর বেশি কিছু বলার সাহস পাননি।

জামাইয়ের খোঁজে গতকাল তার ভগ্নীপতির বাড়িতে লাঠিয়াল আর বরকন্দাজ পাঠিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসে খবর দিল, জামাই নাকি রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। অগত্যা মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে তিনি চতুর্দিকে লোক-লশকর পাঠালেন। অবশেষে লাতনপুর থেকে লোকে এসে খবর দিল, ফুটবল খেলার মাঠে বন্দুক নিয়ে হামলা করার জন্য ছোট জামাইকে পুলিসে গ্রেফতার করেছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! মাধরের অন্য যে-কোনো দোষ থাক সে যে এত বড় গুণ্ডা তা হেরম্বর জানা ছিল না। তবু খবরটা শুনে হেরম্ব তেমন দুঃখ পাননি। হাজতের ভাত খেয়ে আহাম্মকটার বুদ্ধিটা একটু খুলতে পারে। তাছাড়া থানায় আটক থাকলে আর যখন-তখন এদিক সেদিক পালাতেও পারবে না।

কিন্তু কাল রাতে নায়েব এসে খবর দিল, জামাই আরো কয়েক জন আসামীকে নিয়ে হাজত ভেঙে পালিয়েছে। এ-রকম বিপজ্জনক জামাই হেরম্বর আর একটিও নেই। কালে-কালে কত কী-ই যে হচ্ছে!

কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না। তাই তিনি জামাইকে ধরার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। কাল রাত বারোটার মধ্যে জামাইকে হাজির না করতে পারলে মেয়ে ফুলি আত্মঘাতী হবে কাজেই সময়ও আর হাতে নেই।

দশ হাজার টাকার লোভে পুলিস, গেরস্ত, চাষ, সবাই মাধবের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। সুতরাং জামাই ধরা পড়বেই।

হেরম্ব জামাইয়ের খবরের জন্য উদগ্রীব হয়ে দোতলার মস্ত বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। এই সময়ে তাঁর এক চর এসে খবর দিল, “রায়মশাই, আপনার জামাই হেতমগড়ের গভীর জঙ্গলে ঢুকেছেন। উদ্ধারের আশা খুবই কম। কারণ সেখানে চিতাবাঘ ভালুক নেকড়ে বুনো মোষ অজগর, কী নেই! দিনে দুপুরে সেখানে ঘোর অন্ধকার। বিশাল বিশাল গাছ, লতাপাতা, বিছুটিবন, চোর বালি, দহ সবই সেখানে আছে।”

হেরম্ব বললেন, “কী সর্বনাশ! হেতমগড়ের জঙ্গল যে সর্বনেশে জায়গা! আমি পুরস্কার ডবল করে দিলাম। তোমরা সব বেরিয়ে পড়ো।”

শুনেই চররা বাই-বাই করে ছুটল।

হেতমগড়ের জঙ্গলে নবতারণ দারোগাও খবরটা শুনলেন। শুনেই কোমরবন্ধটা আরো একটু কষে এটে নিয়ে পঞ্চাশটা বৈঠকি আর পঞ্চাশটা বুকডন দিয়ে ফেললেন। সেপাইরা জঙ্গল ঢুড়ে-চুড়ে হেদিয়ে পড়েছিল, খবর শুনে তারাও চাঙ্গা হয়ে উঠল।

ওদিকে প্রথম চোটে জঙ্গলে ঢুকেই মাধব জায়গাটার খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন, এমন বিচ্ছিরি গহন আর অন্ধকার জঙ্গল তিনি দেখেননি জীবনে।

সবার আগে বনমালী, তারপর রেলগাড়ির কামরার মতো এ ওর কোমর ধরে প্রথমে মাধব এবং বনমালীর স্যাঙাতরা। ঘটোৎ মাধবের কাঁধে উঠে বসে আছে।

বেশ যাচ্ছিল সবাই। এর মধ্যেই হঠাৎ পিছন থেকে খাই-খাউ করে কুকুরগুলো তেড়ে এল। প্রাণের ভয়ে রেলগাড়ি ভেঙে যে যার মতে দৌড়োতে লাগল।

একটু বাদেই মাধব দেখেন, তার সঙ্গীদের চিহ্নও নেই। ঘটোৎ কচকে কাঁধে নিয়ে তিনি একা বেকুবের মতো ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। এই জঙ্গলে পুলিস তাকে খুঁজে পাবে না ঠিকই, কিন্তু তিনি নিজেও যে নিজেকে খুঁজে পাবেন মনে হচ্ছে না।

এই সময়ে হুপ করে ঘটোৎকচ কঁধ থেকে নেমে মাধবের দিকে নিজের লেজটা বাড়িয়ে দিল। ইঙ্গিত বুঝে মাধব লেজটা দুহাতে চেপে ধরলেন।

ঘটোৎকচ শাল, শিশু, সেগুন, জিকা, বাবলা–হাজারো গাছ গাছালি আর ঘন ঝোঁপঝাড় এবং লতাপাতার ভিতর দিয়ে মাধবকে নিয়ে চলল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা মাধব বুঝতে পারলেন না, তবে ঘটোৎ যে বুদ্ধি করে ঠিক জায়গাতেই তাকে নিয়ে তুলবে এ বিষয়ে তাঁর সন্দেহ নেই। দু-একবার লতায় পা জড়িয়ে আছাড় খেলেন মাধব। তবে ঘন ঝোঁপঝাড়ে পড়ে যাওয়ায় চোট পেলেন না। কাঁটা-গাছে লেগে গা দু-চার জায়গায় চড়ে গেল। শুয়ে পোকার হুল লেগে ঘাড়টা জ্বালা করতে লাগল। তবে এরকম ছোটখাটো বিপদ ছাড়া বড় কোনো অঘটন ঘটল না। জঙ্গলের জীব ঘটোৎকচ খুব সাবধানেই নিয়ে যেতে লাগল তাঁকে।

ঘন জঙ্গলের মধ্যে কোথাও-কোথাও হঠাৎ গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত রোদের দেখা পাওয়া যায়। কোথাও ঝিঝি ডাকে, দু-একবার হরিণের বিচ্ছিরি কাসির শব্দও পেলেন। কাসি নয়, ওটাই হরিণের ডাক। আশেপাশে বনমোরগেরাও থেকে থেকে ডাক দিয়ে জানান দিচ্ছে যে, এ জঙ্গলটা মানুষের জন্য নয়। পায়ের তলায় মাঝে-মাঝে কাদা জমি টের পাচ্ছেন মাধব, কখনো ভেজা গাছের পাতা জমে গালিচার মতো নরম বস্তুর ওপর আরামে পা ফেলছেন। এক জায়গায় একটা ঝর্নার জল বয়ে যাচ্ছে দেখে দু কোষ ঠাণ্ডা জল খেয়ে নিলেন। কত করে একটা শ্বাস ফেলে ভাবলেন, এই জঙ্গলেরই কোথাও আমাদের বসতবাড়িটা ছিল।

আবার অন্ধকার জঙ্গলে ঢুকে চলেছেন তো চলেছেনই। পথ আর ফুরোয় না। ঘটোৎকচেরও কি ক্লান্তি নেই? মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে লেজটা ছেড়ে দুহাতে জামা তুলে মুখ মুছে নিচ্ছেন। আবার শেষ অবলম্বনের মতে, শিবরাত্রির সলতের মতো লেজটা চেপে ধরছেন।

একসময়ে মাধবের মনে হল, লেজটা যেন কিছু মোটা মনে হচ্ছে! মনের ভুলই হবে। তবু লেজটা একটু হাতিয়ে দেখে নিলেন। সন্দেহটা থেকেই যাচ্ছে। লেজটা কিছু মোটাই।

আস্তে করে ডাকলেন, “ঘটোৎ! এই ঘটোৎ।”

ঘটোৎকচ সাধারণত হুপ বলে জবাব করে। কিন্তু মাধব কোনো হুপ শুনতে পেলেন না।

ভয়ে-ভয়ে আবার ডাকলেন, “ঘটোৎ রে! বাবা ঘটোৎকচ!”

জবাব দিল না কেউ। কিন্তু দিব্যি সরসর করে টেনে নিয়ে চলল ঠিকই। নিকষ কালো একটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলেছেন মাধব। বাইরে বোধহয় সন্ধেও হয়ে এল। তাই সামনে কিছুই নজরে পড়ছে না। মাধব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কী খেয়ে হঠাৎ এত মোটা হয়ে গেলি বাপ ঘটোৎকচ!”

কেউ জবাব দিল না। তবে গতি অব্যাহত রইল।

হাঁটতে-হাঁটতে হয়রান হয়ে গেলেন মাধব। হঠাৎ টের পেলেন জঙ্গলটা যেন একটু পাতলা হয়ে আসছে। আকাশের দিকে তাকালে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দু-একটা তারার চিকিমিকি, একটু জ্যোৎস্নার মলম দেখা যায় যেন!

বড়-বড় গাছের সারি শেষ হয়ে হঠাৎই বেঁটে-বেঁটে ঝোঁপঝাড়ে পড়লেন মাধব। বেশ জোরেই যাচ্ছেন। তারপরই দেখেন, জ্যোৎস্নায় সামনে একটা জলা দেখা যাচ্ছে। জলার ধারে ধারে

মাঝে-মাঝে দপদপ করে মশালের মতো আলেয়ার আলো জ্বলে উঠছে। ঘটোৎকচও বেশ আন্তে চলছে এখন। একবার থেমেও পড়ল। হাঁফ ছেড়ে মাধব এতক্ষণে লেজটার দিকে তাকানোর ফুরসত পেলেন।

যা দেখলেন তাতে বেশ অবাকই হওয়ার কথা। ঘটোৎকচের সেজে কে বা কারা কালো আর হলুদ রঙ দিয়ে চিত্তির-বিচিত্তির করে দিয়েছে। ফলে লেজটা আর আগের মতো বিচ্ছিরি দেখতে নেই। বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে।

“বাঃ! বাঃ!” বলে মাধব লেজটায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর সারা গা’টা এরকম চিত্তির-বিচিত্তির হলে দেখতে বেশ সুন্দর হয়ে উঠবি রে ঘটোৎ!”

বলতে-বলতে তিনি ঠাহর করে দেখেন, শুধু লেজ নয়, ঘটোৎকচের শরীরেও কালো আর হলুদ ছোপছক্কর দেখা যাচ্ছে। তবে বেঁটে গাছের জঙ্গলে শরীরের বারো আনাই ডুবে আছে বলে শুধু পিঠটাই দেখতে পেলেন মাধব।

মাধব খুশি হয়ে বললেন, “বাঃ! বাঃ! তোকে যে আর চেনাই যায় না রে ঘটোৎ!”

বলতে না বলতেই বেঁটে ঝোঁপের আড়াল থেকে জলার ধারের ফাঁকা জমিতে পা দিলেন মাধব। জ্যোৎস্নায় ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে বিশাল জলাটাকে। চারধারে নিবিড় জঙ্গল। অল্প কুয়াশায় ভারী স্বপ্ন-স্বপ্ন দেখাচ্ছে। প্রচণ্ড শীত যেন পাথর হয়ে জমে আছে এখানে।

এই শীতের হাঁটাহাঁটির পরিশ্রমে মাধবের কপালে ঘাম জমেছে। ঘটোৎকচের লেজে একটা টান মেরে মাধব বললেন, “একটু থাম বাবা ঘটোৎ। জিরিয়ে নিই।”

লেজে টান পড়ায় ঘটোৎ ঘর-র-র শব্দ করল। মাধব অবাক হলেন। চেহারার সঙ্গে-সঙ্গে কি ঘটোৎকচের স্বভাবটাও পাল্টে গেল। ঘটোৎ এরকম গম্ভীর আওয়াজ কখনো করে না তো!

ঘটোৎকচ একটু রেগেই গেছে। ঘর-র-র শব্দের পর ধীরে-ধীরে মুখটা ফিরিয়ে মাধবের দিকে তাকাল সে।

মাধব হিম হয়ে গেলেন। স্ট্যাচু হয়ে গেলেন। একটা আঙুলও নাড়বার ক্ষমতা রইল না আর।

ঘটোৎকচ ভেবে যার লেজ কষে ধরে আছেন, সেটা এক মস্ত চিতাবাঘ।

লেজটা ছেড়ে দিয়ে যে দৌড় দেবেন তারও উপায় নেই। আঙুল গুলো লেজটাকে যেমন ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে ঠিক সেইভাবেই আড়ষ্ট হয়ে গেল। চেষ্টা করেও আঙুলের সেই বজ্র আঁটুনি খোলর উপায় নেই।

বাঘটা জুলজুল করে চেয়ে আছে। মাধবও চেয়ে আছেন। কেউ কারো চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না। বাঘের গায়ের বোঁটকা গন্ধটা এখন বেশ নাকে আসছে মাধবের। কোনো ভুল নেই, সামনের জন্তুটা বাঘই বটে। জঙ্গলের অন্ধকারে কোন সময়ে যে লেজ-বদল হয়েছে তা টেরও পাননি মাধব।

কয়েক মিনিট সম্মোহিতের মতো থাকার পর মাধব গলার স্বর ফিরে পেয়ে কাঁদো-কঁদো হয়ে অনেকদিনের পুরনো একটা ছড়ার লাইন বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “দোহাই দক্ষিণরায়, এই করে। বাপা। অন্তিমে না পাই যেন চরণের থাপা।”

ঠিক এই সময়ে মাধবের ডানদিকের কানটা ভারী সুড়সুড় করে উঠল। নন্দকিশোরের মুণ্ডুটা তার ডান কানের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে

চারদিক দেখে নিয়ে বলে উঠল, “যাক বাবা! বাঁদরটা ধারে-কাছে নেই দেখছি। বাঁচালে!”

মাধব কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, “বাঁদর না থাক, বাঘ তো আছে!”

নন্দকিশোর এক গাল হেসে বলল, “বাঘকে ভূতের কোনো পরোয়া নেই। বাঘের ব্যাপার তুমি বুঝবে।”

কাঁপতে-কাঁপতেই মাধব দাতে-দাতে ঠকাঠকের মধ্যে বললেন, “বাঁদরকেই কি আপনার সবচেয়ে ভয়?”

খিকখিক করে একপেট হেসে নন্দকিশোর বলে, “গুপ্ত ব্যাপারটা ধরে ফেলেছ দেখছি। কী জানো, ঠিক ভয় নয়। বাঁদরের গায়ের একটা ভুটভুটে গন্ধ আছে, সেইটে আমাদের একদম সহ্য হয় না। তা তুমি দেখছি বেশ বাঘা লোক হে, এমনিতে ভিতু হলেও দিব্যি একটা বড়সড় বাঘকে পাকড়াও করেছ! চিড়িয়াখানায় বেচবে নাকি?”

“আজ্ঞে, ঠিক পাকড়াও করিনি। জঙ্গলে লেজবদল হয়ে গেছে। এখন ছাড়তে পারছি না। আঙুলগুলো জট পাকিয়ে আছে।”

“অ, তাই বলো। ভয়ে তোমার আঙুলে খিল লেগেছে। আমি তো নিজের চোখে ভিতরে ঢুকে দেখে এসেছি, তোমার সাহসের থলি চুপসে আছে। তাই বাঘের লেজ ধরে তোমার দাঁড়ানোর পোজ দেখে ভারী খটকা লাগছিল।”

ঠিক এই সময়ে বাঘটা বলল, ঘর-র-র-ঘ্যাও!

মাধব আপাদমস্তক আর একবার কেঁপে উঠলেন। এত কাছ থেকে এত জোরে বাঘের ডাক তিনি কোনোদিন শোনেননি। নন্দ কিশোর তার অবস্থা দেখে একটু নরম করে বলল, “আচ্ছা দাঁড়াও, দেখি কী করা যায়।”

এই বলে নন্দকিশোর আবার কানের ফুটো দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। মাধবের কান সুড়সুড় করে উঠল আবার। কিন্তু আঙুল দিয়ে কানের ফুটো যে একটু চুলকোবেন তার উপায় নেই। হাত দুটো বাঘের লেজে সেঁটে আছে।

একটু বাদে হঠাৎ মাধব যেন একটু সাহস পেতে লাগলেন। আর যেন ততটা ভয় করছিল না। বাঘটা যদিও তাকে জলার দিকে ধীরে-ধীরে টেনে নিয়ে যেতে-যেতে মাঝে মাঝে পিছু ফিরে দেখছে আর লকলকে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে, তবু মাধবের যেন একটু বেপরোয়া ভাব এল। হাত দুটোও যেন ক্রমে বাঘের লেজ থেকে খসে আসছে।

নন্দকিশোর এবার নাকের ফুটো দিয়ে উঁকি দেওয়ায় মাধব বার দুই প্রকাণ্ড হ্যাঁচ্চো দিয়ে বললেন, “কী হল?”

নন্দকিশোর চোখ পাকিয়ে বলল, “আচ্ছা অভদ্র তো হে! আমার গায়ের ওপর হেঁচে দিলে?”

মাধব ক্ষমা চেয়ে বললেন, “নাকে সুড়সুড়ি লাগল কিনা।”

নন্দকিশোর ক্ষমা করে দিয়ে বলল, “কোনো রকমে তোমার সাহসের থলিটাকে ফুঁ দিয়ে বেলুনের মতো ফুলিয়ে একটা শিরা দিয়ে বেঁধে দিয়ে এসেছি। সেটাতে তেমন কোনো স্থায়ী কাজ হবে না বটে, তবে চোপসানো থলির চেয়ে তা অনেক ভাল। আপাতত এইতেই কাজ চালিয়ে নাও। আমি আবার ভিতরে চললুম, সেখানে আমার অনেক কাজ।”

মাধব আর আগের মতো ভিতু নন, তাই গম্ভীর গলায় বললেন, “কী কাজ?”

“তোমার শুকনো মগজটাকে জল ছিটিয়ে একটু সরস করে তুলতে হবে। রাগের ঝালগুড়োগুলো ঝেটিয়ে বিদেয় করতে হবে। মায়া দয়া স্নেহ মমতার কয়েকটা চারাগাছ পুতে দিতে হবে। তারপর যদি একটু মানুষের মতো মানুষ হও।”

এই বলে নন্দকিশোর আবার ভিতরে ঢুকে গেল।

জলার কাদামাটিতে মাধবের হাটু পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছিল ভুসভুস করে। আর একটু এগোলেই কোমর পর্যন্ত ডুববে। তাহলে আর কাদার কবর থেকে জীবনেও উঠে আসতে পারবেন না। বাঘের সে ভয় নেই, চারপায়ে দিব্যি হালকা-পলকা চালে চলে যাচ্ছে নরম মাটির ওপর দিয়ে।

মাধব দম বন্ধ করে প্রাণপণে এক ঝটকা মারলেন। হাত দুটো ঝড়াস করে খুলে দুটো লাঠির মতো শরীরের দুধারে ঝুলতে লাগল। একেবারে অবশ।

শিকার পালাচ্ছে বুঝে বাঘটাও থামল এবং আস্তে-আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ঘর-র-র…ঘ্যাও।

মাধবও চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন, “মামদোবাজি পেয়েছ? কাদায় ডুবিয়ে মারবে! এক চড়ে ঠাণ্ডা করে দেব!” বলে চড়ও তুললেন। কিন্তু বাঘটা মুখ সরিয়ে নেওয়ায় চড়টা লাগল না! কিন্তু একটা খুব উপকার হল মাধবের। হাতের অবশ ভাবটা কেটে গেল।

মাধব দেখলেন বাঘটা আর ঝামেলা না বাড়িয়ে জলার দিকে জল খেতে গেল। তিনিও হাঁচোড়-পাঁচোড় করে ঠাণ্ডা কাদা ভেঙে ডাঙা জমিতে উঠে এসে একটা শুকনো জায়গায় মস্ত একটা গাছ পড়ে আছে দেখে তার ওপর বসলেন। ক্লান্তিতে হাত-পা অবশ করে চোখ জড়িয়ে আসছে। এই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লে যে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটতে পারে তা মনে করেও কিছুতেই জেগে থাকতে পারছেন না। চোখের পাতা দুটো এত জুড়ে যাচ্ছে যে, আঙুল দিয়ে টেনে খুলে রাখতে হচ্ছে। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় দেখতে পেলেন, চিতাবাঘটা জলায় জল খাচ্ছে। তার আশে-পাশে জলার অন্য ধারগুলিতে তিনি আরও কয়েকটি প্রাণীকে দেখতে পেলেন। একজোড়া মোষ, একটা ভালুক, গোটা কয়েক মস্ত শম্বর হরিণ। কিন্তু ঠিক আগের মত আর ভয় পাচ্ছেন না। নন্দকিশোর সাহসের থলিটা ভালই ফুলিয়েছে বলতে হবে। এখন যদি লিক-টিক না বেরোয় তবেই বাঁচোয়া।

মাধব গাছের গুঁড়িটার পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকাল বেলায় সূর্য যখন উঠি-উঠি করছে তখন ঘুম ভাঙল মাধবের। এই শীতে সারা রাত বেশ ওমের মধ্যেই শুয়েছিলেন বলে মনে পড়ছে। গায়ে যেন একটা ভারী কম্বল ছিল! জেগে উঠে পাশ ফিরতে গিয়েই অবাক হয়ে দেখলেন, মস্ত চিতাবাঘটা তাকে আঁকড়ে ধরে গা ঘেষে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে।

অন্য সময়ে হলে এই দৃশ্য দেখে মাধবের হার্টফেল হত। এখন হল না। একটু অস্বস্তি বোধ করলেন মাত্র। কোমর আর গলা থেকে বাঘের দুটো থাবা আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলেন মাধব। তারপর রোজকার মতো হাই তুলে বললেন, “দুর্গা দুর্গা।”

দিনের আলোয় দেখলেন, জলার ধারে বিস্তর বড়-বড় পাথরের চাই পড়ে আছে। সাবধানে সেগুলোর ওপর পা ফেলে জলায় গিয়ে মুখ ধুলেন। ফিরে এসে আবার অকুতোভয়ে বাঘটার মাথার কাছে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসলেন।

বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, সামনের পাথরের চাঁইগুলো কেমন যেন চৌকো ধরনের। মনে হয় বহু পুরনো কোন বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ। তারপরেই মাধবের নজর পড়ল গাছের গুঁড়িটার দিকে। ওপরে শ্যাওলা জমে আছে। মাধবের সন্দেহ হওয়াতে নখ দিয়ে খুটলেন এবং দেখলেন, এটা মোটেই গাছের গুঁড়ি নয়। একটা প্রাচীন থাম। মাধব একটু চমকে উঠলেন। এসবের মানে কী? চারদিকে চেয়ে এ-জায়গাটা ভঁর চেনা-চেনা ঠেকছে। দৈবক্রমে হেতমগড়ের হারানো বাড়িতে ফিরে আসেননি তো?

এই কথা মাত্র ভেবেছেন, হঠাৎ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বাজ পড়ার মতো ‘ঘ্রাম’ করে গর্জন ছাড়ল বাঘটা। ঘুম থেকে উঠে কপিশ চোখে সোজা তাকিয়ে আছে মাধবের দিকে।

বুকটা কেঁপে ওঠায় মাধব প্রথমটায় ককিয়ে উঠেছিলেন। হয়তো অজ্ঞানও হয়ে যেতেন। কিন্তু হঠাৎ নাকের ফুটো দিয়ে নন্দকিশোর মুখ বার করে বলল, “বড় চেঁচামেচি হচ্ছে হে। একটু ঘুমোতেও দেবে না নাকি?”

“আমি চেঁচাইনি। চেঁচাল তো ঐ বাঘটা।” মাধব বললেন।

নন্দকিশোর বাঘটার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি হেনে বলল, “লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। পালাও।”

“কোথায় পালাব?”

“সে আমি কী জানি! আমাকে তো আর বাঘে খাবে না। খেলে তোমাকেই খাবে। ঐ যে আসছে!” বলে নন্দকিশোর আবার নাকের ফুটো বেয়ে সুট করে মাধবের ভিতরে ঢুকে যায়।

বাঘটা সত্যিই পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসছে। খুবই নিশ্চিন্ত ভাব ভঙ্গি। একবার প্রকাণ্ড একটা হাইও তুলল। মাধব ভয়ে সিটিয়ে আছেন। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, সারা রাত বাগে পেয়েও যখন বাঘে তাকে খায়নি, তখন এই সাত-সকালেও বোধহয় খাবে না। তাছাড়া চিতাবাঘ সাধারণত মানুষ খায়ও না, কিন্তু বেগরবাই দেখলে মারে। এই বাঘটার ব্রেকফাস্ট হয়েছে কিনা তা বুঝতে না-পারায় মাধব খুব নিশ্চিন্তও বোধ করতে পারছেন না।

বাঘটা এসে মাধবের সামনে থাবা গেড়ে বসল এবং খুব মন দিয়ে মাধবের মুখোনা দেখতে লাগল। তাতে খানিকটা ভয় কেটে গিয়ে মাধবের একটু লজ্জা-লজ্জা করছিল। কারণ, আজ দাড়ি কামানো হয়নি। কাল থেকে নানা ঘটনায় নাকাল হয়ে চেহারাটা হয়েছে ঝোড়ো কাকের মতো। তার ওপর দাঁত নেই। চুলটা ঠিক মতো পাট করা নেই। মাধব বাঘের দৃষ্টির সামনে লজ্জায় অপোবদন হয়ে বসে রইলেন।

বাঘটা এবার মোলায়েম গলায় বলল, ভ্রাম!

মোলায়েম হলেও এই আওয়াজেও পিলে চমকে যায়। মাধবেরও চমকাল।

বাঘটা একটু ঘুরে বসে আচমকাই লেজটা মাধবের কোলের ওপর বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ঘর-র।

মাধব আঁতকে উঠলেন। অমনি নন্দকিশোর কানে কানে বলল, “তোমাকে লেজটা ধরতে বলছে।”

“ধরব?” মাধব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

“না-ধরেই বা কী করবে?”

“তাই তো!” বলে মাধব খুব সংকোচের সঙ্গে লেজটা ধরলেন। বাঘটা তখন ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিয়ে চলল।

পুবধার দিয়ে জলাটা ঘুরে বাঘটা তাকে একটা ভারী সুন্দর সাজানো জঙ্গলে নিয়ে এল। মনে হয়, এখানে এককালে মস্ত কোনো বাগান ছিল। হাঁ করে চারদিকে চেয়ে দেখছেন মাধব। বাগানের চারধারে কোনো পাঁচিলের চিহ্নও নেই। তবে একটা জায়গায় একটা মস্ত গোল বাঁধানো চৌবাচ্চার আকৃতি মাটির মধ্যে দেখতে পেলেন। খুবই চেনা-চেনা ঠেকছে।

বাঘটা একটা হ্যাঁচকা টানে লেজ ছাড়িয়ে নিয়েছে। তারপর একটা বেঁটে জামগাছের দিকে এগোচ্ছে দুলকি চালে। মাধব বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে দেখছেন।

জামগাছের নিচু ডালে মস্ত বড় একটা মৌচাক। বিজবিজ করছে মৌমাছি। বাঘটা গিয়ে এক লাফে গাছের ডালে উঠে ধীরে ধীরে চাকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাধব দম বন্ধ করে আছেন। আচমকা নাড়া পড়লে মৌমাছিরা যে কী কাণ্ড ঘটাবে।

কিন্তু বাঘটার বুদ্ধির প্রশংসাই করতে হয়। হুট করে কোনো কাণ্ড ঘটাল না। বরং খুব ধীরে ধীরে সামনের পা দুটো দিয়ে ডালটাকে নাড়াতে লাগল। যেন বাতাসের দোলা। একটি দুটি করে মৌমাছি চাক থেকে উড়ে যেতে লাগল। বাঘটা আস্তে-আস্তে দুলুনি বাড়াতে থাকে। মাঝে মাঝে আচমকা একটু ঝাঁকুনি দেয়। মৌমাছিরা পালাচ্ছে। উড়ছে, ফিরে আসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় চাকটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। মাধব দূর থেকেও দেখতে পেলেন, টসটস করছে মধু।

বাঘটা বলল, ভ্রাও।

নন্দকিশোর সঙ্গে-সঙ্গে কানে-কানে কথাটা অনুবাদ করে বলল, “তোমাকে খেতে বলছে। শুনলে না, খাও!”

“খাব?”

“না খেয়েই বা করবে কী? বাঘকে চটানে কি ভাল? বাঘটাকে খুব ভাল বাগিয়েছ হে!”

বাঘটা চাকটাকে মৌমাছিশূন্য করে আর দাঁড়াল না। জঙ্গলের মধ্যে বোধহয় হরিণের গন্ধ পেয়েই এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাধব নিশ্চিন্তে এগিয়ে গিয়ে চাকটার নীচে দাঁড়ালেন। হাতের নাগালের মধ্যে একেবারে নাকের ডগায় জিনিসটা ঝুলে আছে। মাধব আর দেরি না করে চাকটার খানিকটা ভেঙে নিয়ে মুঠোয় চাপ দিয়ে সেরটাক রস বের করে খেয়ে ফেললেন। বহুকাল এরকম ভাল পদ্মমধু খাননি। প্রাণ বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। তারপর চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন।

যত দেখেন ততই ধারণা হতে থাকে, এ সেই হেতমগড়ের রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ না হয়ে যায় না। এক জায়গায় তিনি বেশ কয়েকটা বড় বড় শ্বেতপাথরের টুকরো দেখতে পেলেন। ঝোঁপ জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা পেতলের কলসির গায়ে দেখলেন নাম খোদাই করা–আর. সি.। সম্ভবত তার বাবার নামের আদ্যক্ষর। বাবার একটাই ছিল শখ। সব কিছুতে নিজের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করতেন। সুতরাং মাধবের আর সন্দেহ রইল না, দৈবক্রমে নিজেদের হারানো ভিটের সন্ধান তিনি পেয়েছেন।

অবশ্য সন্ধান পেয়েও কোনো লাভ নেই। এই ঘোর জঙ্গলের মধ্যে মাটিতে প্রায় মিশে-যাওয়া বাড়ি নিয়ে তিনি করবেনই বা কী? বাড়িতে কিছু গুপ্তধন আছে বলে শুনেছিলেন। কিন্তু তার বাপ ঠাকুরদা সেই গুপ্তধনের অনেক খোঁজ করেও সন্ধান পাননি। এখন সেই গুপ্তধনের সন্ধান করার কাজ বরং আরও কঠিন হয়েছে। কেননা, পুরো বাড়িটাই ডেবে গেছে মাটির নীচে।

মাধব তাই আরও সেরটাক মধু খেয়ে গাছতলায় ছায়ায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন। মধু খাওয়ার আমেজে ঘুমও এসে গেল। তাই ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর রাগী ঠাকুরদা গাছের ওপর বসে আছেন রাগের চোটে। রাগে গরগর করছেন। ঐ ভাবে গাছের ওপর বসে থাকতে-থাকতে হঠাৎ তার লেজ গজিয়ে গেল। রেগে গেলে মুখটা সবসময়ে কুঁচকে আছেন বলে ক্রমে-ক্রমে মুখটা বদলে যেতে লাগল। ক্রমে সেটা হুবহু বাঁদরের মুখের মতো দেখাতে লাগল। গায়ে লোম গজাল। মাধব দেখলেন, ঠাকুর্দার বদলে একটা মহাবানর গাছের ডালে বসে আছে। তারপরই দেখতে পেলেন বাবাকে। মাধবের বাবা রাগের চোটে কাকে যেন হুংকার দিয়ে ডেকে তর্জন-গর্জন করলেন। পারলে তাকে দাঁতে নখে ছিঁড়ে ফেলেন আর কী! চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, হা করে থাকায় দাঁতগুলো হিংস্র দেখাচ্ছে। জিবটাও লকলক করছে যেন। নিজের বীভৎস রাগকে বশে আনার জন্য কলকে পুড়িয়ে ছ্যাকা দিচ্ছেন নিজের গায়ে। এই করতে-করতে সারা শরীরে ছোপ-ছোপ দাগ হয়ে গেল। চোখ দুটো গোল গোল আর কপিশ রঙের হয়ে গেল। দাঁতগুলো বড় বড় আর ধারালো হয়ে উঠল। ক্রমে দেখা গেল, মাধবের বাবা রাগের চোটে আস্ত একটা বাঘ হয়ে বিকট গর্জন ছাড়লেন, ভ্রাম!

সে গর্জনে ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন মাধব। দেখলেন, বাঘটা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আবেগের চোটে মাধব ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “বাবা।”

বাঘ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে ছিল বটে, তবে চোখে তেমন হিংস্রতা নেই। ঘপাস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বাঘটা বলে উঠল, গিয়াও।

কানের কাছে নন্দকিশোর ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে উঠে পড়তে বলছে।”

মাধব হাতের পিঠে চোখের জল মুছতে-মুছতে উঠলেন। বাঘটা লেজ বাড়িয়ে ধরল। মাধব সেটা হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে লাগলেন পিছু-পিছু।

জলার উত্তরধারের দুর্ভেদ্য ভয়ংকর কাটাঝোঁপের জঙ্গল, আগাছা ভেদ করে ও পায়ের নীচে ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে বাঘটা তাকে একটা মজা পুরনো ইদারার ধারে নিয়ে এল। মাধবের মনে পড়ল, ছেলে বেলায় এই ইদারাটাকে তিনি দেখেছেন। এর জল পচা ছিল বলে কেউ ব্যবহার করত না। সবাই বলত, ওর মধ্যে ভূত আছে। মাঝে মাঝে নাকি ভুতুড়ে ইদারার ভেতর থেকে নানারকম আওয়াজ উঠে আসত। অনেক সময়ে মানুষের গলায় কান্নার শব্দ পাওয়া যেত। নিশুত রাতে ঘুম ভেঙে বাড়ির দাসী-চাকরেরা শুনতে পেত, ইদারার ভিতর থেকে শব্দ আসছে, আয়, আয়, আয় আয়।

বাঘটা ইদারার কাছে এসে মাধবের দিকে চেয়ে ডাকল, ঘর-র ঘ্রাও!

ঠিক এইসময়ে একপাল হরিণ পথ ভুলে সামনে এসে পড়েছিল। বাঘ দেখে হাওয়ার গতিতে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে মাধবের হাত থেকে লেজটা টেনে নিয়ে বাঘও হাওয়া। মাধব চোখের জল মুছে আপন মনে বললেন, “বাবার খিদে পেয়েছে।“

“খিদে পেয়েছে না হাতি! বাঘ হচ্ছে এক নম্বরের পেটুক। যখন তখন তাদের খাই-খাই। ও হচ্ছে চোখের খিদে।” বলতে-বলতে নন্দকিশোর মাধবের নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে বাতাসে সাঁতার কাটতে লাগল।

মাধব খেপে গিয়ে বললেন, “খবর্দার! আজে-বাজে কথা বলবেন বলে দিচ্ছি! ভাল হবে না।”

“এ! খুব যে তেজ দেখছি! কী করবে-টা শুনি! তোমার মতো অকৃতজ্ঞ লোক দুটো দেখিনি। সারা সকাল ধরে তোমার ফোকলা নাম ঘোচানোর জন্য কত মেহনত করলুম, এই তার প্রতিদান?”

মাধব রাগটা চেপে রেখে বললেন, “কী করেছেন শুনি।”

“তোমার মাড়ির গোড় সব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আলগা করে সঁতের বীজ বুনেছি। একটু সার আর জল পেলে দেখ-না-দেখ দাঁতের চারা গজিয়ে উঠবে। কিন্তু তুমি বাপু মহা অকৃতজ্ঞ।”

মাধব লজ্জিত হয়ে বললেন, “আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।”

“না করে আর উপায় কী? যাই, একটু বেরিয়ে আসি। বাঘটা তোমাকে কী বলে গেল বুঝেছ তো!”

“আজ্ঞে না।”

“বাঘটা তোমাকে ওই কুয়োটার মধ্যে নেমে পড়তে বলে গেছে। ভালমন্দ তুমি বোঝো গিয়ে, আমি শুধু অনুবাদটা করে দিলাম।”

এই বলে নন্দকিশোর ফড়ফড় করে বাতাসে ভেসে চলে গেল। মাধব ইদারার মধ্যে ঝুঁকে দেখলেন, একেবারে তলায় একটু জল এখনো চকচক করছে। ইদারায় নামবার কোনো সিঁড়ি বা মই নেই। তবে ভিতরে হরেক রকম ভাঙাচোরা থাকায় নানা ধরনের খাঁজের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শ্যাওলা জমে খাঁজগুলো ভীষণ পিছল। মাধব তাই নামতে সাহস পেলেন না। চুপ করে ইদারার ধারে গাছের ছায়ায় বসে রইলেন। বুঝতে পারছেন, ইদারার মধ্যে কোনো রহস্য আছে। স্বয়ং বাঘবেশী বাবা নাহলে এখানে তাকে টেনে আনতেন না।

ভাবতে-ভাবতে মাধবের ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। বেলা ঢলে আসছে। শীতকালে এই জঙ্গলে দুপুর না গড়াতেই রাত্রি এসে যাবে। কী করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না মাধব। ঝিমোতে-ঝিমোতে নানা কথা ভাবছিলেন। হঠাৎ মাথার ওপর ‘হপ হুপ’ করে দুটো শব্দ হল। তারপরই ডালপালা তছনছ করে বিকট উল্লাসের শব্দ করতে করতে ঘটোৎকচ নেমে এল মাধবের কোলের ওপর। আর অমনি জঙ্গলের ভিতর থেকে বনমালীর গলা পাওয়া গেল, “কর্তা ধারেকাছে আছেন নাকি?”

“আছি! আছি!” চেঁচিয়ে উঠলেন মাধব। তারপর ঘটোৎকচকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দাদু! দাদু গো! এ-জন্মেও আমাকে ভোলোনি তাহলে?”

জঙ্গল ফুড়ে খিদেয় চিমড়ে-মারা চারটে মূর্তি বেরিয়ে এসে ধপাস ধপাস করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। মাধবের ভারী মায়া হল। বললেন, “বোসো তোমরা, ব্যবস্থা আছে।

ভায়গাটা এখন চেনা হয়ে গেছে। মাধব গিয়ে জামগাছের ডাল থেকে মৌচাকটা পুরো ভেঙে আনলেন। মধুতে এখনো ভরা-ভর্তি। টপটপ করে মধুর ফোঁটা পড়ে চাকের নীচে মাটি ভিজে গেছে, পিঁপড়ে লেগেছে।

চাক নিয়ে এসে চারজনকে আকণ্ঠ মধু খাওয়ালেন মাধব। সকলের পেট ঠাণ্ডা হল, গায়ে জোর বল এল।

মুখে কথা ফোঁটার মতো অবস্থা হতেই বনমালী বলে উঠল, “কা! এ জায়গাটা যে বড় চেনা-চেনা ঠেকছে।”

মাধব তখন গোটা ব্যাপারটাই ভেঙে বললেন। সবাই শুনে তাজ্জব হয়ে গেল। বনমালী তার টিকটিকি-বিদ্যে-জানা স্যাঙাতকে হুকুম দিল, “ইদারায় নাম।”

লোকটা কালবিলম্ব না করে তরতর করে ইদারার ভিতরের খাঁজে পা আর হাতের ভর রেখে শা করে নেমে গেল। ওপর থেকে সবাই বুকে দেখছে, লোকটা জলের কাছ-বরাবর নেমে চারদিকে গুপ্ত দরজা বা গর্ত খুঁজছে। অনেকক্ষণ খুঁজল। তারপর কিছু না পেয়ে ওপর দিকে চেয়ে বনমালীর উদ্দেশে বলল, “ওস্তাদ, এখানে তো কিছু দেখছি না।”

ঘটোৎকচ কী বুঝল কে জানে। হঠাৎ সে হুপ করে হাঁক ছেড়ে ইদারার মধ্যে সাবধানে নামতে লাগল। আধাআধি নেমে একটা পাথরের চাই ধরে টানাটানি করতে করতে চেঁচাতে লাগল, হুপ! হুপ!

তখন টিকটিকি-ওস্তাদ নীচে থেকে ঘটোৎকচের কাছ-বরাবর উঠে এসে পাথরটা ভাল করে দেখে-টেখে বলল, “এ পাথরটা একটু অন্যরকম।”

বেলা ফুরিয়ে আসছে। জঙ্গলের প্রচণ্ড হাড়কাঁপানো শীতও মালুম দিচ্ছে। বনমালী আর দেরি না করে তার আর-দুই স্যাঙাতকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে লম্বা-লম্বা কয়েকটা লতানে গাছ ছিঁড়ে আনল। কাছেই একটা মস্ত গাছের গুঁড়িতে লতার এক মাথা বেঁধে অন্য মাথা ঝুলিয়ে দিল ইদারার মধ্যে। তারপর একে একে বনমালী আর তার এক স্যাঙাত নেমে গেল নীচে।

তিনজন মিলে পাথরটার ওপর কী ক্রিয়া-কৌশল করল, ওপর থেকে মাধব তা ভাল বুঝলেন না। তবে কিছুক্ষণ বাদে দেখতে পেলেন পাথরটা দরজার কপাটের মতো খুলে গেছে। বনমালী চেঁচিয়ে বলল, “কর্তা, ঝুল খেয়ে নেমে আসুন। এখানে একটা সুড়ঙ্গ পাওয়া গেছে।”

উৎসাহের চোটে মাধবের আর ভয়ডর রইল না। লতা বেয়ে নেমে গিয়ে দেখলেন, বাস্তবিকই একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ হাঁ করে আছে। স্যাঙাতদের একজনের কাছে দেশলাই ছিল। তাই দিয়ে মৌচাকটাতে আগুন দেওয়ায় দিব্যি আলো জ্বলে উঠল। একটা গাছের ডালের আগায় জ্বলন্ত মৌচাকটাকে গেঁথে নিয়ে মাধব সদলে সুড়ঙ্গে ঢুকলেন। এত নিচু আর সরু সুড়ঙ্গ যে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়। ভিতরে বদ্ধ ভ্যাপসা ভাব। চারদিকে নিরেট পাথরের দেয়াল। মশালের আগুন আর ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়।

খানিকদূর গিয়ে সুড়ঙ্গটা কিছু চওড়া হল। ছাদটাও একটু উঁচুতে। সামনে গলিটা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। সেইখানে সবাই দু’দণ্ড জিরিরে হাঁফ ছাড়ে। বনমালী বলল, “কর্তা, আমরা ছ্যাচড়া হলেও নিমকহারাম নই, চোর হলেও লোভী নই। যদি গুপ্তধন পাওয়া যায় তবে সবটাই আপনার। আপনি আবার হেতম গড় গা তৈরি করুন! আমাদের শুধু সেখানে থাকতে দেবেন। কথা দিচ্ছি, হেতমগড়ে কখনো চুরি-ডাকাতি হবে না!”

মাধব রাজি হলেন। সেখানেই ঠিক হল, মাধব বনমালী আর ঘটোৎকচকে নিয়ে যাবেন ডাইনে, তিন স্যাঙাত যাবে বাঁয়ে। ঘণ্টা দুই পর তারা আবার এখানে ফিরে আসবে। মৌচাক ভেঙে দুটো মশাল তৈরি করে তারা দুদিকে এগোলেন।

মাধব ডানদিকের রাস্তা ধরে এগোচ্ছেন। সামনে ঘটোৎকচ পিছনে বনমালী। চারদিকে পাথরের দেয়াল চলেছে তো চলেইছে। মাথা নিচু না করে যাওয়ার উপায় নেই। মাধবের ঘাড় টনটন করে ছিঁড়ে পড়ার জোগাড়। তার ওপর এই শীতকালেও সুড়ঙ্গের ভিতরটায় বেজায় ভ্যাপসা গরম। অনেকক্ষণ চলার পর মাধব হঠাৎ বুঝলেন, সুড়ঙ্গটা হচ্ছে আসলে একটা ভুলভুলাইয়া বা গোলকধাঁধা। কোনোখানেই পৌঁছচ্ছেন না, কেবলই যেন একই জায়গায় ঘুরে মরছেন।

খুবই ক্লান্ত হয়ে একসময়ে পাথরে ঠেস দিয়ে বসে পড়লেন মাধব। পাশে বনমালী আর ঘটোৎকচ।

মুখে কথা পর্যন্ত সরছে না কারো। ঠিক এই সময়ে মাধব শুনতে পেলেন, নন্দকিশোর কানে-কানে বলছে, “খুব কানামাছি খেললে বাপু! তা আমাকে যে ফেলে এলে, আমি কি তোমার গুপ্তধনে ভাগ বসাতুম?”

মাধব গম্ভীর মুখে বললেন, “আপনার মতো অপদার্থ ভূত জীবনে দেখিনি।”

“বেশি কচকচ কোরো না ছোঁকরা। তোমার ঐ বাঁদরটার গায়ের গন্ধ আমার যদি অসহ্য না হত তাহলে আজ তোমাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়ে বিস্তর নাকাল করতুম। যাক গে, এখন হাঁ করো তো, ভিতরে সেঁদিয়ে যাই।”

বনমালী হাঁ করে মাধবের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। বলল, “ও কার সঙ্গে কথা বলছেন আপনি? এখানে তো আমি ছাড়া আর কোনো মনিষি নেই।”

মাধব সেকথার জবাব না দিয়ে নন্দকিশোরকে বললেন, “অপকার সবাই করতে পারে। উপকারটাই করতে পারে না। এই যে গোলকধাঁধায় পড়ে খাবি খাচ্ছি, তার একটা উদ্ধারের পথ আগে বের করে দিন, তারপর বড়-বড় কথা বলবেন। প্রথম থেকেই তো ফাড়া কাটছেন, ভূত এটা পারে না, সেটা পারে না। ও কেমনধারা কথা!”

নন্দকিশোর চিড়বিড়িয়ে উঠে বলল, “কভি নেহি! কভি নেহি। মানুষের উপকার আর কক্ষনো নয়। তুমি নিতান্ত হাবা-গঙ্গারাম বলে আর মানুষের মতো মানুষ নও বলে তোমার খানিকটা উপকার করে ফেলেছি। এখন দেখছি তুমিও খুব সেয়ানা। আর উপকারের মধ্যে আমি নেই। বেঁচে থাকতে বিস্তর মানুষের উপকার করেছি। ফলে আমাকে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হয়েছিল। ফের উপকার করতে গিয়ে ফেঁসে যাব নাকি! তার ওপর এখন গলায় দড়ি দিয়ে মরবারও উপায় নেই।”

এই বলে নন্দকিশোর গোত্তা খেয়ে মাধবের মুখে ঢুকে পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে গেল।

বনমালী ভাবল, কর্তাকে ভূতে ধরেছে। এই সুড়ঙ্গের ঘোর অন্ধকার পাতালপুরীতে সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাছাড়া গুপ্ত ধনের কাছেপিঠে এরা থাকেই। বনমালী হঠাৎ ভয় খেয়ে শিউরে উঠে “ভূত! ভূত! বলে চেঁচিয়ে দৌড়তে লাগল।

কিন্তু এই পাতালপুরীতে দৌড়ে যাবে কোথায়? দশ কদম যেতে না-যেতেই একটা দেয়ালে মাথা ঠুকে যাওয়ায় ‘উঃ’ বলে বসে পড়ল। আর বসেই চেঁচিয়ে উঠল, “কর্তা, এধারে আসুন তো।”

মশাল নিবুনিবু হয়ে এসেছে। মৌচাকে আর মোম নেই। সাবধানে মাধব এগিয়ে গেলেন। বনমালী বলল, “এই পাথরটা যেন আমার ধাক্কায় একটু নড়ে উঠল। দেখুন তো।”

কথাটা সত্যি। পাথরটা একটু ঠেলতেই নড়ল। এবং টানতেই কপাটের মতো খুলে গেল।

মাধব মশালের শেষ আলোটুকুতে মুখ ঢুকিয়ে দেখলেন, ভিতরে একটা ঘর। ঘরে অনেক জিনিস রয়েছে। মাধব ঘরে ঢুকলেন।

সামনেই একটা পিলসুজে মস্ত প্রদীপ রয়েছে। মাধবের বুদ্ধি খেলছে। বুঝলেন, প্রদীপ আছে, তখন খুজলে তেলও পাওয়া যাবে।

বেশি খুজতে হল না। পুরনো একটা গাড়তে বিস্তর রেড়ির তেল পাওয়া গেল। নিবন্ত মশাল দিয়ে প্রদীপটা একেবারে শেষ মুহূর্তে জ্বালাতে পারলেন মাধব। সেই আলোয় চারদিকে চেয়ে একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেললেন। সেই হারানো মোহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর দুঃখের কিছু নেই।

মাধব আস্তে আস্তে গিয়ে প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুকটার গায়ে হাত বোলালেন। প্রদীপের আলোয় দেখলেন, সিন্দুকের গায়ে খোদাই করে লেখা : এই সম্পদ ভোগের জন্য নহে। ইহার দ্বারা প্রজাপালন, কূপ, পুষ্করিণী ইত্যাদি খনন, সড়ক প্রভৃতি নির্মাণ করিবে। বিদ্যা ও ধর্ম দান করিবে। সতত অপরের মঙ্গল চিন্তা না করিলে এই সম্পদে অধিকার জন্মায় না, ইহা জানিও। সর্বদাই চিন্তা করিবে। আমি অক্রোধী, আমি অনামী, আমি নিরলস, আমি ইষ্টপ্রাণ, সেবাপটু…