০৫.
ফার্স্ট গ্রেডের ডিটেকটিভ টম লেপস্কি মেজাজ খারাপ করে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে তার টেবিলে বসেছিল। মেজাজ খারাপের কারণ তার বউয়ের সাথে ঝগড়া।
টেলিফোনটা বাজতেই পাশে বসে থাকা জ্যাকবির হাত থেকে রিসিভারটা কেড়ে নিয়ে বলল, লেপস্কি বলছি বলুন।
ল্যারি বলল, যে শয়তান লোকটা দুজনকে গুলি করেছে, লোকটার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ডাক্তার বলছে, মিনিট তিনেকের মত সে কথা বলতে পারবে।
–আমি দশ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। লেপস্কি চীৎকার করে বলল।
হসপিটালের প্রধান ডাক্তার জেলাড স্কিনার লেপস্কি আর জ্যাকবিকে বললেন, লোকটা যে মারা যাবে তা ধরে নিতে পারেন। তবে জ্ঞান ফিরেছে, আশার কথা। প্রচণ্ডভাবে আমরা চেষ্টা করেছি
লোকটা দুটো খুন করেছে। ও মরলে কি আসে যায়?
আমাদের এসে যায়। এই হসপিটালের একটা নাম আছে। এখানে আমরা জীবন বাঁচনোর চেষ্টা করি–তা সে যেই হোক না কেন।
একটা নার্স এসে লেপস্কি আর জ্যাকবিকে পেড্রোর কাছে নিয়ে গেল। ল্যারি উঠে দাঁড়াতেই ফাঁকা চেয়ারটা লেপস্কি দখল করে বসল। দেখল পেড্রোর মুখে মৃত্যুর পাণ্ডর ছায়া। সে পেট্রোর হাতটা ধরে ঝাঁকাল। পেড্রো গুঙিয়ে উঠল। চোখ খুলে তাকাল।
-কেমন আছ, বন্ধু? লেপস্কির মধুর কণ্ঠস্বরে জ্যাকবি অবাক হয়ে তাকাল।
–পেড্রো আবার গুঙিয়ে চোখ বন্ধ করল।
বলতো তোমার নামটা কি?
–জাহান্নামে যাও। পেড্রো বিড়বিড় করে বলল।
–শোন বাছা, ডাক্তার বলছে তোমার বাঁচার আশা নেই। যদি তুমি তোমার নামটা না বল, একটু পরেই তুমি একটা বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যাবে। পেড্রো চোখ খুলে তাকাল।
-হ্যাঁ, বেওয়ারিশ মড়া। জান পুলিশ বেওয়ারিশ মড়া নিয়ে কি করে। লোকটাকে একটা রবারের চাদরে মুড়ে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়-হাঙর খাবে বলে? তুমি কি তাই চাও? তুমি যদি আমাদের নামটা বল, তাহলে তোমার বউ বা আত্মীয়স্বজনকে খবর দিতে পারি।
আমি হাঙ্গরের খাদ্য হব? পেড্রো ভীত স্বরে বলল।
–হ্যাঁ, বাছা। এবার তোমার নামটা বল। তোমার ভালর জন্যই বলছি।
লেপস্কি জানে কিউবানরা ধর্মভীরু হয়, আর কুসংস্কারাচ্ছন্নও।
আমার নাম পেড্রো সার্টেস। ক্ষীণ স্বরে পেড্রো বলল।
আবার সেই নরম দয়ালু গলায় লেপস্কি বলল, কোথায় থাক তুমি ভাই?
একটু ইতস্ততঃ করে পেড্রো বলল, সাতাশ নং ফিস রোড, সমুদ্রের ধারে।
–তমার কি বউ আছে? তাহলে আমরা তোমার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া করাতে পারি।
—অনিতা।
–সে কি করে, কোথাও কাজ করে?
–সে–পেড্রোর হেঁচকি উঠল, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এল। মুখটা নেতিয়ে পড়ল।
তাড়াতাড়ি একটা নার্সকে ডাক। মনে হচ্ছে লোকটা মারা গেছে।
–একটা নার্স এগিয়ে এসে পেট্রোকে দেখে নির্লিপ্তভাবে বলল, আর বড়জোর দুমিনিট। আপনারা যান। আমার অনেক কিছু করণীয় আছে। বাইরে বেরিয়ে জ্যাকবি বলল, হাঙরের, ব্যাপারটা বড় নিষ্ঠুর হয়ে গেল।
কাজটা তো হল।
মিনিট দশেক পরেই লেপস্কি আর জ্যাকবি পেড্রোর বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছেহানা দিল।
পেড্রো সার্টেস ওপরতলায় থাকে।
–তার বউ আছে এখানে?
না, কাজে গেছে।
–কোথায় কাজ করে। কেয়ারটেকারটা অনিতাকে পছন্দ করে। সে ঠিক করল অনিতাকে সে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে না। বলল, জানি না।
–তাকে আমাদের ভীষণ দরকার। তার স্বামী মারা যাচ্ছে। তাকে তার স্বামীর কাছে নিয়ে যেতে এসেছি। লেপস্কি চেঁচিয়ে বলল।
বললাম তো, জানি না।
কখন সে কাজ থেকে ফেরে।
–আমি কি করে জানব? কখনও কখনও বেশ দেরী হয়।
–কেমন দেখতে?
কেয়ারটেকার আশ্বস্ত হল, পুলিশ অনিতার চেহারার কোন বর্ণনা জানে না বলে।
–আর পাঁচজন কিউবান মহিলার মতন। বাদামী, খুব মোটা। মাথার চুল চূড়ো করে বাঁধা।
বয়স কত?
–আমি কি করে জানব। তিরিশ-চল্লিশ।
লেপস্কি বুঝল লোকটার থেকে সে কোন কথা আদায় করতে পারবে না। এই হতচ্ছাড়া কিউবানগুলো সব এককাট্টা। সে জ্যাকবিকে ইশারা করে রাস্তায় নামল।
আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। তুমি থাক। আমি কাউকে পাঠিয়ে দেব তোমাকে ডিউটি থেকে ছাড়াবার জন্য। মোটাই হোক বা রোগাই হোক–এই বাড়ির ভেতর ঢুকবে এমন প্রতিটা কিউবান মহিলার পরিচয়পত্র দেখবে।
.
তিক্তকণ্ঠে জ্যাকবি বলল, ভাল কাজ যা হোক। কয়েক মিনিট পরে আবর্জনা ফেলার অছিলায় কেয়ারটেকারটা বাইরে এসে জ্যাকবিকে দেখে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর সে ছেলেকে ডেকে বলল–ম্যানুয়েল টেরেসের নৌকোটা চিনিস?
-হ্যাঁ।
-দেখ, টেরেসের কাছে গিয়ে বলবি পুলিশ এসে পেড্রোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। আর বাড়িটার ওপর নজর রেখেছে।
অনিতা কাজ সেরে বাড়িতে ফিরছিল। পথে ম্যানুয়েলের ভাঙ্গাচোরা লিংকন গাড়িটা এসে থামল।
–উঠে এস।
–অনিতা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, পেড্রোর কোন খারাপ খবর—
না, সে ভালই আছে। তবে তুমি বাড়ি যেও না। পুলিশ খুঁজছে।
–পুলিশ।
–হ্যাঁ, চিন্তার কিছু নেই। তারা তোমার চেহারার বর্ণনা বা কোথায় কাজ কর, কিছুই জানে না। আমার নৌকোতে থাক।
পুলিশ জানল কি করে?
-কোন ইনফর্মার। আমাদের লোকের ভেতরেও তো ইনফর্মার আছে। তবে চিন্তা কোর না। চল, আমরা আমাদের প্ল্যান ঠিক করে নিই।
.
লেপস্কি সার্জেন্ট বেইগলারকে বলল, আমায় দুটো লোক দিন। লোকটার বউকে ধরতে হবে। কোথায় কাজ করে জানতে পারিনি। সুতরাং, ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে। সার্জেন্ট বেইগলার বলল–আমার লোক নেই। তবে তুমি সিটি হলে যাও। ওখানে কোন কিউবান কোথায় কাজ করে সব লেখা আছে।
ঠিক, লেপস্কি সঙ্গে সঙ্গে সিটি হলের উদ্দেশ্যে ছুটল। সিটি হলের ইমিগ্রেশন অফিসের কাছে গিয়ে দেখল কিউবানদের লম্বা লাইন পড়েছে।
লেপস্কি কাউনটারের গোড়ায় গিয়ে ব্যাজটা দেখিয়ে কাউন্টারের রিসেপশনিস্ট মিস হেপলওয়েটকে প্রশ্ন করল, শুনুন, মিস
–আমি ব্যস্ত দেখতেই পারছেন।
–আমি লেপস্কি, সিটি পুলিশ।
–তা আমি কি করব? আপনার কাছে হাঁটু গেড়ে বসব, রিসেপশনিস্ট বলল।
–আমি জানতে চাই, অনিতা সার্টেসা কোথায় কাজ করে।
–কেন?
–পুলিশের দরকার। কেন নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না, বেবি।
–আমাকে বেবি বলবে না। দুর্ব্যবহারের জন্য আমি তোমার নামে নালিশ করতে পারি।
লেপস্কি মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না, শোন বেবি, সরকারী কাজে বাধা দেবার জন্য আমি তোমায় গ্রেপ্তার করতে পারি? আমি একটা খুনের তদন্ত করছি। তুমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অসতে চাও?
মিস হেপলওয়েট লেপস্কির কঠিন মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, আর বাড়াবাড়ি করা উচিৎ হবে না। বলল, কি নাম?
পুলিশী হাসি হেসে লেপস্কি বলল, অনিতা সার্টেস। থাকে ফিস রোড, সমুদ্রের ধারে।
দাঁড়ান, দেখছি। মিস হেল্পলওয়েট চলে গেল। একটু পরে এসে বলল, মেয়েটি স্প্যানিশ বে হোটেলে পার্ট টাইম কাজ করে। সকাল দশটা থেকে বেলা একটা। আবার আটটা থেকে।
ধন্যবাদ। লেপস্কি চলে গেল।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কিউবান আরেকজনকে বলল, আমার লাইনটা রাখ। আমি আসছি।
–একটা টেলিফোন বুথে গিয়ে সে ডায়াল ঘোরাল, ম্যানুয়েল টেরেস?
.
স্প্যানিশ বে হোটেলের ডিটেকটিভ জোশ প্রেসকট নাইট ডিউটির জন্য আজ বিশেষ করে সাজগোজ করছে। কারণ, আজ রাতে ম্যাগীর সাথে তার অভিসারের তারিখ রয়েছে।
হঠাৎ ঝড়ের মত লেপস্কি ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল-এই যে জোশ।
-কি চাই তোমার, আমি ডিউটির জন্য তৈরী হচ্ছি।
–অনিতা সার্টেস নামে একজন কিউবান মহিলা এই হোটেলে কাজ করে–চেন?
–হ্যাঁ, এখানে ঝাড়ুদারনীর কাজ করে। কেন, কি করেছে?
–ফিস রোডের সেই ভাড়া আদায়কারী লোকটার হত্যার খবরটা তো শুনেছে। অনিতা সেই হত্যাকারীর স্ত্রী। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
একটু চিন্তা করে প্রেসকট বলল, দেখ লেপস্কি মেয়েটা পেন্ট হাউসে কাজ করে। ওখানে কাজ না হলে মালিকের মাথা গরম হয়ে যাবে। বরং তুমি দশটার সময় এস, ডিউটি শেষ হলে মেয়েটিকে আমি আমার ঘরে বসিয়ে রাখব।
লেপস্কির খিদে পেয়েছিল। ভাবল বাড়ি থেকে খেয়ে আসা যাক। দশটা বাজতে দেরী আছে।
অনিতা আর ফুয়েনটেস ম্যানুয়েলের জন্য ঝাড়া তিন ঘণ্টা অস্থির ভাবে অপেক্ষা করছিল।
ম্যানুয়েল ভেতরে ঢুকে বলল, শুভ সংবাদ। আমাকে এক পাত্র মদ দাও ফুয়েনটেস। আমার দেরী হয়ে গেল। কারণ, হসপিটালে আমার বন্ধু খুব ব্যস্ত ছিল।
পেড্রো, প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে অনিতা জিজ্ঞেস করল।
হা-পেড্রো। রামের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ম্যানুয়েল বলল, শেষ পর্যন্ত আমি কথা বলেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, পেড্রো সমুদ্রে যাত্রা করতে পারবে কি? সে বলল ঠিকঠাক ব্যবস্থা করলে। যেতে পারবে।
ফুয়েনটেস ভাবল ম্যানুয়েল কী সুন্দর অভিনয় করছে।
–কি ব্যবস্থা?
-পেড্রোকে হসপিটাল থেকে নৌকো পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসতে হবে। একবার নৌকোয় উঠতে পারলে তুমি তো আছই।
-কিন্তু পুলিশরা কি পেড্রোকে ছাড়বে?
–নিশ্চয়ই ছাড়বে। উইলবার আমাদের হেফাজতে থাকবে না? তাছাড়া দু-দুটো বোমা। ডুলাককে আমি বুঝিয়ে দেৰ,যদি পেড্রোকে নৌকায় আসতে দেওয়া হয়, আমি নৌকা থেকেই বোমা ফাটাতে পারি।
অনিতা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি কি তা পারবে?
–হ্যাঁ, রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে।
অনিতা আশ্বস্ত হয়ে একটু হাসল।
তবে একটা খারাপ খবর আছে। পুলিশ জানতে পেরেছে তুমি কোন হোটেলে কাজ কর।
অনিতা চিন্তা করতে লাগল। ম্যানুয়েল আর ফুয়েনটস ভাবল এই বুঝি সব ভেস্তে যায়।
— অনিতা সহজভাবে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, ভয় পাবার কিছু নেই। হোটেলে কাজের লোক কম। সুতরাং আজ রাতে কিছুই হবেনা। আমি কথা দিচ্ছি রাত বারোটার সময় আমি পেন্টহাউসের দরজা তোমাদের জন্য খুলে দেব।
ম্যানুয়েল প্রশংসার গলায় বলল, সত্যিই তুমি সৎ এবং সাহসী মহিলা। দুএক দিনের মধ্যেই আমরা সবাই হাভানায় পাড়ি দেব।
–আমি তোমায় বিশ্বাস করি, ম্যানুয়েল। তোমরা টাকাটা নিও। আমার শুধু পেড্রোকে চাই।
অনিতা চলে যাবার পর একটা অস্বস্তিকরনীরবতা ঘরের মধ্যে নেমে এল। ফুয়েনটেস বলল, বিপজ্জনক মহিলা। ওর হাতে পিস্তল দিও না যেন।
ম্যানুয়েল মাথা নাড়ল।
.
সামুদ্রিক খাবারের রেস্তোরাঁয় কোনার একটা টেবিলে এড হ্যাডন আর ব্রাডে বসেছিল।
কি খবর বল, তাড়াতাড়ি? হ্যাডন বলল।
আজ রাতেই কাজটা করছি। প্রথমে সিন্দুকের মালগুলো হাতাবো তারপর ওয়ারেনটনের হীরেগুলো। কিন্তু তারপর?
–তোমাদের পরিকল্পনা একদম নিখুঁত করেছে তো?
–হ্যাঁ।
–আমিও সব ঠিক করে রেখেছি। কেনড্রিক সব মালগুলিই সামলাবে বলেছে। সে সুবিধেমত জায়গায় মালগুলো লুকিয়ে রাখবে। তারপর হৈ-চৈ থেমে গেলে ও ওগুলোর ব্যবস্থা করবে, টাকা পেতে মাস কয়েক লাগবে।
-কিন্তু কেনড্রিক যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে?
চিন্তা করনা, লু। আমার কাছে ওর সম্বন্ধে এমন সব প্রমাণ আছে তাতে আমি ওকে জেলে পাঠাতে পারব। সুতরাং টাকাটা পাবেই।
–মাইককে আমি কথা দিয়েছি। ও টারমিনাল ক্যান্সারে ভুগছে। একটা জড়বুদ্ধি মেয়ে আছে ওর। মরার আগে মেয়েটার ব্যবস্থা করে যাবার জন্য টাকাটা ওর এক্ষুনি চাই।
বেশ, তুমি দিয়ে দিও, হ্যাডন বলল।
–আমার থাকলে দিতাম। তোমার কাছে পঞ্চাশ হাজার আর কি? একটু মানবিকতা সম্পন্ন হও, এড।
একটু চিন্তা করে হ্যাডন বলল, বেশ ও যদি ভালভাবে কাজটা শেষ করতে পারে, টাকাটা ওকে দিয়ে দেব।
.
মারিয়া আর উইলবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাইরে থেকে বেরিয়ে এসে হোটেলে ফিরল। হঠাৎ খেয়ালী মারিয়া বলল, আমার জুয়ো খেলতে ইচ্ছে করছে।
উইলবার বলল, কিন্তু আমাদের কথা ছিল, তুমি হীরেগুলো পরে হোটেলের বাইরে যাবে না।
বাজে কথা বোল না। আমি আমার হীরেগুলো পরবই আর সাড়ে আটটার সময় বেরুচ্ছি, মনে রেখ।
উইলবার অনেকক্ষণ চিন্তা করে দেওয়ালের গুপ্ত সিন্দুক নম্বর মিলিয়ে খুলে ফেলল। ভেতর থেকে একটা চামড়ার জহরতের বাক্স বার করল। তারপর সিন্দুক বন্ধ করে ডুলাককে ফোন করল।
ডুলাক জানাল সে তাদের সঙ্গে দুজন বডিগার্ড দেবে। প্রেসকট সবে রাতের খাওয়া শেষ করেছে সেই সময় ডুলাক এসে বলল, তোমাকে বডিগার্ড হয়ে মিঃ এবং মিসেস উইলবারকে ক্যাসিনো পৌঁছে দিতে হবে।
প্রেসকট ভাবল অনিতা সার্টেসকে ধরবার জন্য তার লবিতে বসে থাকার কথা।
-স্যার, পেন্টহাউসে যে মহিলাটি ঝাড়ুদারনীর কাজ করে তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
–ঐরকম কোন মেয়েছেলেকে আমরা এখানে রাখতে পারি না। ঠিক আছে, ব্যাপারটা আমি দেখছি। তুমি যাও।
প্রেসকট বেরিয়ে যেতে ডুলাক স্টাফ ম্যানেজারকে ফোন করল।
না, স্যার। আজ রাতে স্টাফ কম। পেন্টহাউসের কাজ ততবন্ধ রাখা যাবেনা।কাল সকালে নিশ্চয় ব্যবস্থা করব। ম্যানেজার বলল।
ঠিক ঐ সময়টাতেই অনিতা হোটেলে উপস্থিত হয়, সে সকাল সকাল এসেছিল এই ভেবে যে অত তাড়াতাড়ি পুলিশরা নিশ্চয়ই আসবে না। তাকে কেউ আসতে দেখেনি। সে চুপচাপ স্টাফরুমের দরজা খুলে একটা টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে রইল।
অনিতা ভবিষ্যতের নানা রঙীন চিত্র আঁকতে থাকল, তারপর একসময় পেড্রোর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বসল। সে যখন প্রার্থনা করছিল ঠিক সেই সময়ে পেড্রো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
ব্রাডে, ম্যাগী আর মাইক ব্যানিয়েল বসে আসন্ন অভিযানের খুঁটিনাটিগুলো আলোচনা করে নিচ্ছিল।
–আমরা মালগুলি হাতাতে পারলেই তুমি দিন দুয়েকের মধ্যে টাকাটা পেয়ে যাবে।
মাইক তার বিশাল কাঁধ ঝুঁকিয়ে বলল, বাঃ, খুবই খুশীর খবর।
মাইক যন্ত্রণা শুরু হবার আগেই তিনটে যন্ত্রণা নিরোধক বড়ি খেয়ে নিয়েছে। সারা শরীরটা যেন আড়ষ্ট প্রানহীন। সে বুঝতে পারছে মৃত্যু যে কোন মুহূর্তে আসতে পারে।
আমি তোমার এমন মেক-আপ করে দেব যে কেউ চিনতে পারবে না। দুটোর সময় আমরা হোটেলে যাব, কেউ আমাদের লক্ষ্য করবে না সেই সময়। যদি কেউ বাধা দেয়, তাহলে তুমি ভার্ট গান দিয়ে ব্যবস্থা করবে। ওয়ারেনটনরা সম্ভবতঃ তখন পেন্টহাউসে থাকবে। তুমি তাদের ব্যবস্থাও করবে। কাজগুলো শেষ করতে চল্লিশ মিনিটের বেশী লাগা উচিৎ নয়। আমরা আমাদের ঘরে ফিরে এসে বসের লোকদের হাতে মাল দিয়ে দেব। আরও দুটো দিন আমরা হোটেলে থাকব যাতে কারও সন্দেহ না হয়। তুমি তোমার টাকা পেয়ে যাবে।
–আপনি আমার উপর ভরসা করতে পারেন।
জানি, তোমার টাকাটা কত দরকার। ম্যাগী, যাও বলে এস আজ রাতে আমি কিছুই খাব না।
.
প্লাস্টিকের একটা থলে থেকে ম্যানুয়েল দুটো পয়েন্ট আটত্রিশ রিভলবার বার করে টেবিলের ওপর রাখল। একটা রিভলবার সে ফুয়েনটেসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, সাবধান গুলি ভরা আছে। মনে রেখ, সহজে গুলি চালাবে না। পুলিশ যাতে ব্যাপারটার মধ্যে না আসে।
ফোনটা বেজে উঠল। ম্যানুয়েল ফোনে কথা বলল, ধন্যবাদ যথাসময়ে তোমাকে পুরস্কৃত করব। ফোন নামিয়ে রেখে ম্যানুয়েল বলল, আমাদের অনিতা সম্পর্কে আর কোন সমস্যা রইল না। আধঘণ্টা আগে পেড্রো মারা গেছে।
ফুয়েনটেস শক্ত হয়ে উঠল–মারা গেছে। শুভ সংবাদ। কিন্তু অনিতা জানতে পারলে তো আমাদের পেন্টহাউসের ভেতর ঢোকাবে না।
–এতক্ষণে ও হোটেলে ঢুকে পড়েছে। পেন্টহাউসে ঢোকার পর আমরা অনিতাকে জানার যে পেড্রো ভাল হয়ে উঠছিল, কিন্তু অকস্মাৎ মারা গেছে। পুলিশ অনিতাকে খুঁজছে। অতএব তাকে আমাদের সাথে আসতেই হবে। আমি তাকে কিছু টাকাও দেব।
–সে ভাবতেও পারে তুমি মিথ্যে কথা বলেছ। তখন সে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
ম্যানুয়েল বলল, রেডিওর খবরেই ও জানতে পারবে তখন বিশ্বাস হবে পেড্রো মারা গেছে। আমরা অবাক হবার ভান করব।
.
রাত নটা চল্লিশ মিনিটে লেপস্কি জ্যাকবিকে নিয়ে হোটেলের পাশের দরজা দিয়ে ঢুকল।
রাত দশটা চল্লিশ বেজে গেল। লেপস্কি অধৈর্য হয়ে বলল, প্রেসকটের রাত দশটার সময় মেয়েটাকে নিয়ে আসার কথা ছিল। আমি গিয়ে দেখি, কি হল। তুমি এখানে অপেক্ষা কর।
রাত এগারোটা পনেরো মিনিটে প্রেসকট একটা নতুন সিগারেট প্যাকেট নেবার জন্য তাঁর অফিসে এল। লেপস্কি আর জ্যাকবির আগুন-ভরা চোখ দেখেই তার অনিতার কথা মনে পড়ল–এই যা। আমাকে ওয়ারেনটনদের বডিগার্ড হয়ে ক্যাসিনোয় যেতে হয়েছিল।
–কিউবান মেয়েটা কোথায়? লেপস্কি গর্জন করে উঠল।
–হয়তো বাড়ি চলে গেছে এতক্ষণ।
বাড়ি। কি বলছ তুমি? রাত দশটার সময় তোমার তাকে এখানে নিয়ে আসার কথা। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছি।
–আরে বললাম না আমাকে একটা কাজে যেতে হয়েছিল। সে নিশ্চয়ই বাড়ি চলে গেছে এতক্ষণে।
–তুমি কেমন করে জানলে সে বাড়ি গেছে। রাগে লেপস্কি চীৎকার করে উঠল।
কারণ রাত দশটায় তার ডিউটি শেষ হয়ে গেছে। আর শোন, চেঁচিয়ো না। বাড়ি গিয়ে বরং দেখ।
বাড়ি? কেন পেন্টহাউসে লুকিয়ে থাকতে পারে না।
-সে তো উঁদুরগুলোও থাকতে পারে। যাও যাও ওর বাড়ি গিয়ে দেখ।
–আমি যাচ্ছি। কিন্তু আবার ফিরে আসব। তখন তোমার ব্যবস্থা করব।
যাও যাও। আমার বস ডুলাক মেয়র আর তোমার বসকে বলে তোমাকে আবার। কনস্টেবল বানিয়ে দেবে। এখন দয়া করে কাট তো।
.
রাত সাড়ে বারোটায় অনিতা যখন দেখল রান্নাঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সে চুপিচুপি গিয়ে স্টাফ রুমের দরজাটা খুলে করিডোরটা দেখে নিল। কেউ কোথাও নেই। তখন সে পা টিপে টিপে কর্মচারীদের প্রবেশ পথের দরজা খুলে দিল। ম্যানুয়েল আর ফুয়েনটেস অপেক্ষা করছিল। তারা ভেতরে ঢুকল। তারপর তিনজন মিলে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। অনিতা সবচেয়ে ওপরতলার বোতামটা টিপে দিল। –পেড্রো?
কোন খবর নেই। আমার বন্ধুটি হসপিটালে নেই। চিন্তার কি আছে?
আমি প্রার্থনা করছিলাম। মন বলছে পেড্রো ভাল আছে।
–ঠিক তাই। নিজের ওপর একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে ম্যানুয়েল বলল ভগবান নিশ্চয়ই তোমার প্রার্থনা শুনবেন।
ওপরে উঠে তাঁরা বিরাট বড় বসবার ঘরটায় ঢুকল।
অনিতা দরজাটা বন্ধ করে চাবি দিয়ে দিল।
অনিতা একটু হাঁপাচ্ছিল, বলল–আলো জ্বালিয়ো না।
–না। আমরা টেরেস থেকে আসা আলোয় ভালই দেখতে পাচ্ছি। ম্যানুয়েল চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, বড়লোকেরা কি আরামেই না থাকে।
তার মনের মধ্যে একটা ভাবনা ঝিলিক দিল। সেও যখন ৫০ লক্ষ ডলারের মালিক হবে এরকম একটা পেন্টহাউস ভাড়া করে থাকতে পারবে।
সে হালকা গলায় বলল, চল আমরা অপেক্ষা করি। ম্যানুয়েল একটা বড় লাউঞ্জ চেয়ারে বসে পড়ল। ফুয়েনটেসের অস্থির অস্থির লাগছিল। সে টেরেসে গেল। টেরেসের আকার দেখে ফুয়েনটেস অবাক হচ্ছিল। বড় বড় ফুলের টব লাউঞ্জ চেয়ার, টেবিল, ককটেল বার। বাব্বাঃ
কটা বাজল। ম্যানুয়েল তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, খবরের সময় হয়ে এল। অনিতা আমি একটা ঘোড়র ওপর বাজি রেখেছি। মনে হচ্ছে খবরটা শুভই হবে। পকেট থেকে ক্ষুদে ট্রানজিস্টারটা বার করে ম্যানুয়েল শুধোল, অনিতা তুমি কখনও ঘোড়ার ওপর বাজী ধরেছ।
–অত বাজে টাকা আমার নেই। এখানে ট্রানজিস্টার চালিয়োনা। কেউ শুনতে পারবে হয়তো।
–আরেনানা, আমি আস্তে করে চালাব। সুইচটা চালু করে টিউন অ্যাডজাস্ট করল ম্যানুয়েল।
ফুটেনটেস দরজার কছে এল। তার পিঠে টেরেসের চাঁদের আলো পড়েছে। তার সারা মুখে ঘাম ঝরছিল। ঐ বোকা মেয়েমানুষটা কি ওর স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে চেঁচামেচি শুরু করে দেবে? তাহলেই তো হয়েছে। সে তার পিস্তলটা চেপে ধরল।
রেডিয়োতে স্থানীয় সংবাদ হচ্ছিল। অনিতা নিশ্চল হয়ে বসেরইল। অন্ধকারে তার মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছিলনা। অবশেষে সেই প্রতিক্ষিত সংবাদটা শোনা গেল। ঘোষণাটা খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে সারা হল। ম্যানুয়েল আর ফুয়েনটেস তৈরী হয়েই ছিল অনিতা চেঁচালে তাকে মুখ চেপে ধরবে।
সীকম্বের ভাড়া আদায়কারীর হত্যাকারী পেড্রোসার্টেস যাকে ডিটেকটিভ টম লেপস্কি তিন হাজার ডলার নিয়ে পালাবার সময় গুলি করে, আজ বিকেলে অল্প সময়ের জন্য তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল কিন্তু তারপরেই সে মারা যায়।
এরপর ঘোষক ঘোড়ার খবর দেওয়া শুরু করতেই ম্যানুয়েল রেডিওটা মেঝের ওপর শব্দ করে ফেলল আর অনিতার দিকে কঠিনভাবে তাকিয়ে রইল। কিন্তু হিস্টিরিয়ার কোন লক্ষণই অনিতার মধ্যে দেখা গেল না। সে একটা পাথরের মূর্তির মতন বসে রইল।
দূর থেকে আসা সমুদ্রের গর্জন আর দেরী করে স্নান করতে যাওয়া লোকজনের অস্পষ্ট চেঁচামেচি ছাড়া দুঃসহ এক নিস্তব্ধতা তিনটি প্রাণীকে যেন গ্রাস করে ফেলল।
ম্যানুয়েলই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙ্গল, বলল, হে ভগবান। একি দুঃসংবাদ। আমার কিছু বলবার ভাষা নেই, অনিতা।
অনিতা নিশ্চল হয়ে বসে রইল।
ম্যানুয়েল অনিতার দিকে এগিয়ে গেল।
–আমার কাছে এসো না, হিসহিস্ করে অনিতা বলল।
অনিতার গলার স্বরটা এতই ভয়ঙ্কর যে ম্যানুয়েল থমকে গেল। ফুয়েনটেসও পিছিয়ে গেল।
অনিতা সুইচ টিপতেই একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলে উঠল। সেই আলোয় অনিতার মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেল ম্যানুয়েল। ম্যানুয়েল দেখল অনিতার মুখ থেকে যেন সব রক্ত চলে গিয়েছে। চোখদুটো কোটরে বসে গেছে।
কিন্তু হিস্টিরিয়ার কোন লক্ষণ দেখা দিল না। তবুও ম্যানুয়েল ভাবল এ যেন একজন মৃত। স্ত্রীলোকের মুখ।
জোর করে মিথ্যে বলবার চেষ্টা করল ম্যানুয়েল, বিশ্বাস কর অনিতা খবরটা আমার কাছে তোমার মতনই মর্মান্তিক।
অনিতার চোখদুটো জ্বলে উঠল।
হে সত্যনিষ্ঠ মানুষ, তুমি তাহলে আমার কাছে মিথ্যে বলেছিলে। তুমি সবসময়েই জানতে পেড্রো মারা যাচ্ছে। তার কণ্ঠস্বর শুকনো পাতার মর্মরধ্বনির মতন শোনাল। শুধু নোংরা টাকাগুলো হাতাবার জন্য তোমরা আমাকে মিথ্যে বলেছিলে। ভগবান তোমাদের অভিশাপ দেবেন।
না, অনিতা না। ম্যানুয়েল অস্ফুট গলায় বলল, আমি দিব্যি গেলে বলেছি। তুমি জান আমি সত্যি কথার মানুষ। আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তোমার স্বামীকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব। আমি যখন কাউকে কথা দিই তা প্রাণপণে রাখার চেষ্টা করি। আসলে হসপিটালের লোকই আমায় মিথ্যে বলেছিল। কেন সে মিথ্যে কথা বলল? ম্যানুয়েল কপালে করাঘাত করে। বলল। আমি তাকে শাস্তি দেব। আমি প্রতিজ্ঞা করছি।
অনিতা চোখ বন্ধ করল। তার দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নামল-পেড্রো তোমাকে আমি হারিয়েছি।
ম্যানুয়েল চকিতে ফুয়েনটেসের দিকে তাকাল। ফুয়েনটেস ঘাড় নাড়াল। তার মতে, ম্যানুয়েলের অভিনয়টা দারুণ হয়েছে।
আমরা যখন হাভানায় ফিরে যাব তখন ঘটা করে পেড্রোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করব। এখন হে অভাগিনী কাঁদ, কেঁদে তোমার মন হাল্কা কর।
আবার ঘরে একটা ভৌতিক নিস্তব্ধতা নেমে এল। অনিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখন যাব।
ম্যানুয়েল এই ভয়টাই পাচ্ছিল। গর্জে উঠে বলল, কোথায়?
আর কোথায় গীর্জায়। আমার পেড্রোর জন্য মোমবাতি জ্বালাতে হবে। আমার প্রার্থনার প্রয়োজন।
খুব নরম গলায় ম্যানুয়েল বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কিন্তু এখন নয় অনিতা। যখন তুমি আর আমি হাভানায় ফিরে যাব, তখন পেড্রোর জন্য হাজার মোমবাতি জ্বালাব আর তার পারলৌকিক কাজও করব।
দরজার দিকে এগোল অনিতা।
ম্যানুয়েল গিয়ে তার হাত ধরে ফেলল। অনুভব করল, অনিতা কাঁপছে।
না,না শোন অনিতা পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। তারা জানতে পারবে তুমিই এখানকার দরজা খুলে দিয়েছিলে। তোমাকে গ্রেপ্তার করে ওরা গারদে পুরবে। ভেবে দেখ, তুমি পেড্রোর জন্য কতগুলি মোমবাতি জ্বালাতে পারবে তখন?
ম্যানুয়েল দেখল অনিতার মুখে একটা হতাশার ভাব খেলে গেল। সেঅনিতার হাত ছেড়ে দিল।
–চল, আমরা টেরেসে যাই। নরম গলায় ম্যানুয়েল বলল, চাঁদের আলোয় আমরা তোমার স্বামীর জন্য প্রার্থনা করব।
ঘড়ি দেখল ম্যানুয়েল। এখন রাত একটা পাঁচ। ওয়ারেনটনদের ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে। ততক্ষণ এই মেয়েছেলেটাকে ভুলিয়ে রাখতে হবে।
জ্যান্ত লাশের মতন অনিতা টেরেসের দিকে এগিয়ে গেল। ম্যানুয়েল তাকে একটা কোনায় নিয়ে গেল। টবে লাগানো একটা কমলালেবুর গাছের জন্য জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আছে। চাঁদের আলোয় সোনালী ফলগুলো ঝকমক করছে। পাশাপাশি তারা হাঁটু মুড়ে বসল। ফুয়েনটেস ম্যানুয়েলের ভণ্ডামি দেখছিল এতক্ষণ অবাক হয়ে। সে মুখ ফেরাল।
.
ব্যালেটের মধ্যে ব্রাডে মাইকের একটা কৃষ্ণকায় যুবকের মেকাপ দিচ্ছে। থুতনিতে দাড়ি, টুক্সেডো পোশাক।
যাও আমার কাজ শেষ। তোমার মাও তোমাকে চিনতে পারবেনা। ডার্ট ছোঁড়ার সময় তোমায় কেউ দেখে ফেললেও কোন সমস্যা হবে না। একটু স্থির হয়ে দাঁড়াও। তোমার গোঁফটা একটু ঠিক করে দিই।
টুক্সেডো পরা ব্যানিয়েন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে তার মেয়ে ক্রীসের কথা ভাবছিল। নিজের ভেতরটা তার একদম শূন্য মনে হচ্ছে। বেদনা নিরাময়ক পিলগুলো আরামদায়ক বটে। কিন্তু ক্যান্সারের হিংস্র দাঁতগুলো তার জীবনশক্তিকে কুরে কুরে খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলেছে ক্ৰমশঃ। একটা নেকড়ে বাঘের মতন তার শিকারের দেহটা ছিন্নভিন্ন করছে।
ব্রাডে বসে পড়ে বলল, এবার আয়নায় নিজেকে দেখ।
মাইক আয়নায় দেখল এক শক্তিমান অপরিচিত যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রবল ইচ্ছে হল সেরকম শক্তিমান মানুষ বলে নিজেকে ভাবতে–তাহলে জীবনটা সে আবার শুরু করতে পারত।
ব্রাডে হাসতে হাসতে বলল, কেমন ভাল নয়?
মাইক শান্তস্বরে বলল চমৎকার।
তার কণ্ঠস্বর শুনে ব্রাডে অবাক হয়ে মাইকের দিকে তাকাল–মাইক তুমি সুস্থবোধ করছ তো?
–আমাকে সুস্থ থাকতেই হবে এই কাজটার জন্য। তারপর সে ব্রাডের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, এই কাজটা শেষ করে সত্যিই যদি আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন তুমি আমার মেয়েকে দেখবে–এমন আস্থা কি তোমার ওপর রাখতে পারি?
–মাইক, এ নিয়ে আমাদের আগেই কথাবার্তা হয়েছে। তোমার কাজ শেষ হলেই তোমার ভাগের টাকাটা তুমি পেয়ে যাবে। এ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা কর না।
মাইক পকেট থেকে একটা কার্ড বার করল-লু, এই হচ্ছে আমার মেয়ের ডাক্তারের ঠিকানা। এই কাজটা করার পরে আমার যদি ভালমন্দ কিছু হয়ে যায়, তুমি টাকাটা মনিঅর্ডার করে এই ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিও। আমাকে কথা দাও–
একটা হিমশীতল স্রোত যেন ব্রাডের ওপর দিয়ে বয়ে গেল।
কিন্তু, মাইক
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এইটুকু তুমি আমার জন্য করবে?
নিশ্চয় করব, মাইক। কিন্তু তুমি কি মনে করছ এই দুদিনের মধ্যে তোমার কিছু হয়ে যাবে? মাইকের ঠাণ্ডা ভিজে হাতটা ধরল ব্রাডে।
না, ধরনা এটা একটা ইনসুর্যান্স।কাজটা শেষ হয়ে যাবার পর আমি এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারব না। আমার মেয়েটাকে গিয়ে একবার আমাকে দেখতেই হবে। তোমার টাকার জন্য আমি বসে থাকতে পারব না। কিছু মনে করলে না তো?
না, নিশ্চয় না মাইক। আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি।
ধন্যবাদ।
ব্রাডের গলায় কি যেন একটা দলা আটকিয়ে গেল। সে মনে মনে শপথ করল কাজটা যদি কেঁচেও যায় তাঁর, আর টাকা-পয়সা না পাওয়া যায়, সে তবুও দেখবে মাইকের জড়বুদ্ধি মেয়েটা যেন পঞ্চাশ হাজার ডলার পায়–যেখান থেকেই হোক না কেন।
ব্রাডে আর মাইক হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।
.
রাত দুটো নাগাদ প্রেসকট হন্তদন্ত হয়ে ম্যাগীর সন্ধানে সুইমিং পুলের দিকে এগোল। তারও একটু পরে সিকিউরিটি গার্ড দুজন এসে রাতের ডিউটিতে থাকা কর্মচারীটিকে একটা চাবি দিয়ে চলে গেল। এরও মিনিট দশেক পরে উইলবার আর মারিয়া এসে তাদের ঘরের চাবি নিয়ে গেল।
ব্রাডে বলল, সময় হয়েছে, ওঠ মাইক।
চেঁচালেই মরবে। ছোরা হাতে চাপা গলায় ম্যানুয়েল বলল। পিস্তল হাতে সামনে দাঁড়াল ফুয়েনটেস।
মারিয়া হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
–চুপ করে গিয়ে বসে পড়। চেঁচিয়েছো কি মরেছ। মারিয়া হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, টাকাপয়সা যা নেবার নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। ম্যানুয়েল পয়সার ব্যাগটা ফুয়েনটেসের দিকে ঠেলে দিল। তার চোখ মারিয়ার দিকে।
–মারিয়া ওরা হীরেগুলোর জন্য এসেছে। হীরেগুলো খুলে ওদের দিয়ে দাও, উইলবার শান্ত স্বরে বলল।
না,হীরেগুলোতে আমার কাজ নেই। আমরাটাকাঁচাই।আমরা পঞ্চাশ লক্ষ ডলার টাকাঁচাই।
অত টাকা আমাদের কাছে নেই।
–তোমার বাবাকে ফোন কর।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অনিতা সব শুনল।
সিন্দুক ঘরের দরজা খুলে ক্ষিপ্র হাতে মাইক এক একটা বাক্স খুলে ফেলছিল। বাক্স থেকে জিনিসগুলো সরিয়ে একটা ব্যাগে ভরছিল মাইক।
-দেখছ, এ যেন আপেল পাড়ার মতই সহজ ব্যাপার; ব্রাডে বলল। মাইক আস্তে আস্তে আবার জেগে ওঠা যন্ত্বনাটাকে টের পাচ্ছিল। তার কপালে ঘাম ফুটে উঠল। সে জোর করে হাসল।
তিরিশ মিনিটের মধ্যে বাক্সগুলো সব খালি হয়ে গেল। তারপর খালি বাক্সগুলো সিন্দুকের ভেতর ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল ব্রাডে।
এবার ওয়ারেনটনদের হীরেগুলো। ব্রাডে ঘড়ি দেখল, দুটো পঞ্চাশ। নিশ্চয় ওরা শুয়ে পড়েছে। চল যাই।
পেন্টহাউসের ছাদে এসে ওয়ারেনটনদের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে প্রমাদ গুনল ব্রাডে–সাবধান, ওরা এখনও ঘুমোয়নি।
অনিতা নিঃশব্দে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকোল।
–আমাদের সময় নষ্ট করা চলবে না, মাইক। দেখা যাক, কি হচ্ছে।
দরজার কাছ থেকে সে উঁকি মেরে দেখল নোংরা জামাকাপড় পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মধ্যে, তার সামনে মারিয়া আর উইলবারের মাথা দেখা যাচ্ছে। শক্তিমান টাক মাথা দাড়িওলা লোকটা একটা ছোরা উঁচিয়ে বলতে লাগল, তোমার বাবাকে বল, পঞ্চাশ লক্ষ ডলার নগদে চাই।
ব্রাডে সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পারলো। ঘরের ভেতরে একটা আয়নার মধ্যে দিয়ে সে হীরের গয়নাপরা মারিয়াকে দেখতে পেল। মাথা ঘুরিয়ে সে মাইককে ইশারায় ডাকল। মাইক নিঃশব্দে এগিয়ে এল।
প্রথম মোটা লোকটা, তারপরে টেকোটা। তারপর বাকি দুজন। তাড়াতাড়ি কাজ সার, মাইক।
উইলবার বলছিল–এত রাতে আমি বাবাকে ফোন করতে পারব না।
মাইক ব্যানিয়েন খাপ থেকে এয়ার পিস্তলটা বার করে দুহাতে ধরল। প্রথমে সে ফুয়েনটেসের ঘাড় লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল। উইলবারের কথায় বব আওয়াজটা চাপা পড়ে গেল। ফুয়েনটেস ঘাড় চুলকে বলল, হতচ্ছাড়া মশা।
বাবাকে ফোন কর এখনই–ম্যানুয়েল গর্জে উঠল। মাইক আবার ট্রিগার টিপল।
তৃতীয় ডার্টটা সে মারিয়ার ঘাড় লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। তারপর চতুর্থটা উইলবারকে লক্ষ্য করে।
ম্যানুয়েল রুদ্ধশ্বাস হয়ে দেখল ফুয়েনটেসের হাত থেকে পিস্তল খসে পড়ছে। সে একটা সোফার কোন ধরে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে করতে সোফার পেছনে এলিয়ে পড়ল।
ম্যানুয়েলের হাতও অবশ হয়ে গেল। তার মনে হল যে দ্রুত চেতনা হারাচ্ছে–কোনরকমে একটা টেবিল ধরে দাঁড়াতে গিয়ে সবশুদ্ধ নিয়ে সে মেঝেতে আছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে উইলবার আর মারিয়াও নিঃশব্দ হয়ে সেটির ওপর পড়ে রইল।
সাবাস, মাইক। চমৎকার লক্ষ্য। সাবাস।
তারপর ঘরে ঢুকে ব্রাডে চটপট মারিয়ার গা থেকে হীরের গয়নাগুলো খুলে নিল। সেগুলি একটা চামড়ার ব্যাগে ভরে সে পকেটে রেখে দিল।
তারপর দৌড়ে টেরেসে গিয়ে ব্রাডে বলল, মাইক চলে এস। আমি তোমাকে বলেছিলাম না কাজটা জলের মতন সোজা। এরপর ওরা ছাদের ওপর উঠে সিন্দুক ঘরে নেমে গেল, র মিনিট পনের বাদে সিকিউরিটি বাক্সের মালপত্র আর ওয়ারেনটনদের হীরেগুলো নিয়ে কেনড্রিকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।
ব্যানিয়েন তার মেকআপ তুলে সোফারের বেশ পরে নিল। ম্যাগী জেটির উপর শুয়ে ছিল। ব্রাডে এড হ্যাডনকে ফোন করল। হাড়ন অধীর আগ্রহে ফোনটার জন্য অপেক্ষা করছিল।
নিখুঁত ভাবে কাজ শেষ হয়েছে, এড।
দারুণ, সাবাস। হ্যাডন বলেই ফোন নামাল। ব্যানিয়েন হাতে একটা স্যুটকেশ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ভোরের দিকে লস এঞ্জেলসে যাবার একটা প্লেন আছে–আমি ওটা ধরতে চাই।
মাইকের মড়ার মতন সাদা চোখ আর বসে যাওয়া চোখ অব্যক্ত ভাবে সবই বলছিল, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না, বুঝলে?
নিশ্চয়। পোটারকে বলেছি, একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবে। চিন্তা কর না মাইক। ব্রাডে আবেগজড়িত গলায় বলল,তুমি কাজটা চমৎকার ভাবে করেছ। তোমায় আমি কথা দিচ্ছি, টাকাটা ডাক্তারের হাতে পৌঁছে যাবে।
দুজনে করমর্দন করল।
ম্যাগী উঠে পড়ে বলল, তুমি ক্ৰীসকে দেখতে যাচ্ছ মাইক।
হা।
–তোমার জন্য আমার মন কেমন করবে। যোগাযোগ রেখ।লু, আমাদের টেলিফোন নম্বরটা ওকে দাও না।
-না, যদি কিছু হয়ে যায় আর মাইকের কাছে টেলিফোননম্বর পাওয়া যায়,ঝাট হতে পারে।
ব্যানিয়েন ব্যাপারটা বুঝল। ঠিক আছে, চলি। বিদায় লু, তারপর ম্যাগীর কাঁধ চাপড়িয়ে দিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুব ভাল লাগল। মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যানিয়েন বাইরে বেরিয়ে গেল।
চলে যাওয়া ট্যাক্সির শব্দ শুনতে শুনতে ম্যাগী বলল, কোন গণ্ডগোল? ওকে অত মনমরা লাগছিল কেন?
–চলে এস, ম্যাগী। একটু ঘুমোন যাক।
-কিন্তু ও এভাবে চলে গেল কেন, লু?
ওর মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। চল শুয়ে পড়ি। খুব ক্লান্তি লাগছে।
.
অনিতা একটা ঘোরের মধ্যে টেরেস থেকে পেন্টহাউসের বসার ঘরে ঢুকল। সে চেতনাহীন ম্যানুয়েল, ফুয়েনটেস আর উইলবার ও মারিয়াকে দেখল।
অনিতা সবই লক্ষ্য করেছিল। ফুয়েনটেসের পাশে একটা রিভলবার পড়েছিল। অনিতা সেটা কুড়িয়ে নিল।
মিনিট পাঁচেক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অনিতা সিদ্ধান্তে এল এই লোকদুটো তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এদের জীবন এখন তার হাতের মুঠোর ভেতর। অনিতা রাগে ঘৃণায় ফুয়েনটেসের মুখে একটা সজোরে লাথি মারল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল একটা পাগলাটে হাসি নিষ্ঠুর, নির্দয়। এই দুটো লোককে সে খুন করবে। এরাই পেড্রোকে প্রলোভন দেখিয়েছিল। এরাই পেড্রোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কোমরে গুঁজে রাখা চবিটা বার করেও খাপে ভরে রাখল। তারপর ফুয়েটসের পায়ের গোড়ালি ধরে টানতে টানতে টেরেসে নিয়ে এল। তারপর আবার ঘরের মধ্যে গিয়ে ম্যানুয়েলের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে তাকিয়ে রইল। লোকটা তাকে মিথ্যে কথা বলেছে, নিশ্চয় বলেছে। তারপর বোমাদুটোর কথা মনে পড়ল তার। ম্যানুয়েলের পকেট হাতড়ে কোন যন্ত্রই খুঁজে পেলনা। তার মানে, সব ভাওতা। ম্যানুয়েলের বিশাল দেহটা অতিকষ্টে সে টেরেসের দিকে টেনে নিয়ে গেল। প্রতিশোধের দৃঢ় সংকল্প তাকে শক্তি যোগাল।
–পেড্রো, তুমি আমার কথা শুনতে পারছ। তোমার হয়ে আমি প্রতিশোধ নেব। তাহলে তুমি শান্তিতে ঘুমোত পারবে।
ছুরিটা বার করে ম্যানুয়েলের অচৈতন্য দেহটার পাশে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর অসীম ঘৃণাভরে ম্যানুয়েলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
–তুমি নিজেকে সত্যবদ্ধ মানুষবলে বড়াইকর।তুমিবলেছিলে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেবে। বোমাদুটোর সম্পর্কেও তুমি মিথ্যা কথা বলেছ। তুমি শুধু হৃদয়হীনের মতন টাকার কথাই ভেবেছ।
অন্ধকার কেটে আলোর রেখা ফুটছিল। সূর্য উঠতে আরম্ভ করেছে। একঘণ্টার মধ্যে সকাল হয়ে যাবে।
তাই আমি তোমাকে শাস্তি দেব, ভণ্ড মানুষ। অনিতা হিংস্র গলায় বলল, বলে নিস্কম্প হাতে ম্যানুয়েলের চোখের পাতা খুলে সোজা ছুরির ডগাটা দিয়ে তার চোখের মণিটা ঘুরিয়ে দিল। পরপর দুটো চোখেই সে একই কাজ করল। হ্যাঁ, অসত্য মানুষ। তোমার কাছে কেউ আর আসবে না। কারও সাথে তুমি আর বেইমানি করতে পারবে না।
ম্যানুয়েলের চোখ দিয়ে রক্ত গড়াতে লাগল। অনিতা এবার ফুয়েনটেসের পাশে গিয়ে বসল।
–তুমিও এর মধ্যে ছিলে, পেড্রোকে তুমিই মেরেছ। ছুরির বাঁটটা ধরে হিংস্র ভাবে অনিতা ফুয়েনটেসের দেহের ওপর বারবার আঘাত করতে লাগল।
দিনের আলো ছড়িয়ে গেল। অনিতা বাথরুমে গিয়ে হাতের রক্ত ধুয়ে ফেলল। ছুরিটাও ধুল।
নিজেকে একটু শান্ত লাগলেও অনিতা তৃপ্তি পাচ্ছিল না। যে ডিটেকটিভ পেড্রোকে মেরেছে সে বেঁচে থাকলে পেড্রো কবরে শুয়েও শান্তি পাবেনা। নামটা যেন কি? হঠাৎই তার মনে পড়ল, টম লেপস্কি। সে বসবার ঘরে টেলিফোন গাইডটা খুলল। লেপস্কির বাড়িটা ঠিকানা বার করতে তার কয়েক মিনিট গেল।
আবার সে চিন্তা করল ম্যানুয়েল আর ফুয়েনটেসের মতন এত সহজে সে লেপস্কিকে মারতে পারবে না। সে ফুয়েনটেসের রিভলবারটা তুলে নিল। পেন্টহাউস ছেড়ে এবার নিঃশব্দে অনিতা বেরিয়ে এল। নিঃশব্দে কর্মচারীদের ব্যবহৃত সিঁড়ি দিয়ে নেমে তাদের প্রবেশ পথের দিকে চলে গেল। তারপর বেরিয়ে গেল।
.
এখন সকাল সাড়ে সাতটা। লেপস্কি তিনটে ডিম ভাজা আর বেশ পুরু হ্যাম দিয়ে প্রাতঃরাশ সারছিল। স্ত্রী ক্যারোল তার দিকে হিংসেভরা চোখ দিয়ে দেখছিল।
ক্যারোল শরীরের ওজন কমানোর জন্য সকালে শুধু এক কাপ চিনি ছাড়া কফি পান করে। কিন্তু লেপস্কির খাওয়া দেখে তার যেন ক্ষিদে পেয়ে গেল। নিজেকে সম্বরণ করে, সে সমালোচনা শুরু করল।
–লেপস্কি তুমি বড় বেশী খাও।
–হ্যাঁ, হ্যামের টুকরোটা বেশ বড়ই।
–শোন তোমার এত ভারী প্রাতঃরাশ করা উচিৎ নয়। আমাকে দেখনা।
লেপস্কি তার কফিতে আরো চিনি মেশাল।
–ভুলে যাচ্ছ কেন, আমাকে সারাদিন পরিশ্রম করতে হয়। শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে না?
-হুঃ জানি তোমার কত কাজ। বেশীর ভাগ দিন তুমি টেবিলের ওপর পা তুলে কমিকস্ পড়। তুমি কাজ কথাটার কি মানে জান? কাজ করি আমি, রান্না করা, বাসন মাজা।
এসব কথা লেপস্কি দিবারাত্র শুনছে। তোষামোদের সুরে তাই বলল, তুমি না থাকলে আমার যে কি দশা হবে, বেবি।
ক্যারোল গজগজ করে বলল রাখ তোমার মিথ্যে তোষামোদ। শোন, সকালে একটা ডিম আর ছোট একটা হ্যাম খাবে। তাতে তোমার শরীর ঠিক থাকবে।
লেপস্কি হেসে বলল–বেবি, তুমি বরং তাই খাওয়া শুরু কর। আমি যা চালাচ্ছি, চালাব।
ক্যারোল প্রায় ফেটে পড়তে যাচ্ছে এমন সময় দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল।
যাও গিয়ে দেখ, লেপস্কি বলল।
–কেন তুমি যেতে পারনা? আমার কাজ নেই নাকি?
–আরে পোস্টম্যানও তো আসতে পারে। দেখ তোমার জন্য কোন উপহার এনেছে হয়তো।
ক্যারোল মুখ ঘুরিয়ে সরু প্যাসেজটা দিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলল। দেখল বেঁটে-চওড়া মতন একজন কিউবান মহিলা দাঁড়িয়ে। তার পরনেকালো স্ন্যাক্স আর কালো সোয়েটার কি ব্যাপার?
অনিতাবলল, আমি মিঃ লেপস্কির সঙ্গে দেখা করতে চাই। তার ডান হাত পেছন দিকে লুকোন। সেখানে রিভলবারটা ধরা আছে।
–আমার স্বামী প্রাতঃরাশ করছেন। এসময় বিরক্ত করাটা উনি পছন্দ করবেন না। আপনার কি নাম?
অনিতা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুশ্রী মহিলাটির দিকে তাকাল। স্বামীহারা হয়ে সে যে কষ্ট পাচ্ছে, এই মহিলাটিও তাই পাবে। তার বুক মুচড়িয়ে উঠল।
–আমার নাম অনিতা সার্টেজ। মিঃ লেপস্কি আমার স্বামীর সম্বন্ধে আমার সাথে কথা বলতে চান।
দাঁড়ান জিজ্ঞেস করছি।
ক্যারোল যখন খাওয়ার ঘরে ঢুকল লেপস্কি তার প্লেট সাফ করে ফেলেছে। সে এখন তার তৃতীয় কাপ কফি পান করছে।
–একজন কিউবান মহিলা অনিতা সার্টেজ নাম, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
লাথি মেরে চেয়ারটা সরিয়ে লেপস্কি উঠে পড়ল, হে ভগবান। ওই মেয়েটাকেই তো এত খুঁজছি।
লেপস্কি ঝড়ের বেগে দরজার দিকে ছুটল।
–আপনি কি মিঃ লেপস্কি?
অনিতার কাল পাথরের মতন চোখের দিকে তাকিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল লেপস্কির সারা শরীরে। অভিজ্ঞতা থেকে সে বলতে পারে, বিপদ আসছে। পিস্তলটা শোবার ঘরে রয়ে গেছে। সে নিরস্ত্র।
সে স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলো হ্যাঁ, আপনাকে আমি খুঁজছিলাম
আপনিই কি সেই লোক যে আমার স্বামীকে গুলি করেছিল।
ব্যাপারটার মানে–লেপস্কি আমতা আমতা করতে লাগল। আপনি ভেতরে আসুন।
লেপস্কি ভয়ার্ত চোখে দেখল অনিতা তার দিকে পিস্তল তাক করছে।
মর তাহলে–পাগলাটে দৃষ্টি নিয়ে অনিতা বলল।
লেপস্কি হৃদপিণ্ডে একটা ধাক্কা অনুভব করল। পিছু হটতে হটতে কার্পেটে পায়ের গোড়ালী বেঁধে সে পড়ে গেল। অনিতা আরও তিনটে গুলি ছুঁড়ল। তারপর সে পেছন ফিরে ছুটে রাস্তায় নেমে গেল।
সে জানত না ম্যানুয়েল ফুয়েনটেসকে যে রিভলবারটা দিয়েছিল তা ফাঁকা কার্তুজে ভর্তি।
লেপস্কিকে মাটিতে পড়তে দেখে আর গুলির শব্দ শুনে ক্যারোল চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। কিন্তু অজ্ঞান হবার মতন মেয়ে নয় সে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে লেপস্কির পাশে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
শয়তানটা ওকে খুন করেছে।
সে লেপস্কির মাথাটা ধরে দিশেহারার মতন এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
লেপস্কি নড়ে উঠল। এরকম করে আমায় ধরে থাক। কি যে ভাল লাগছে।
ক্যারোল তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ভেবেছিলাম মরে গেছ তুমি।
লেপস্কি উঠে বসল–আমিও তাই ভেবেছিলাম। সত্যিই বেঁচে আছি তাহলে। একটু ভয়ে ভয়ে লেপস্কি জামাটা খুলে ফেলে তার বুকটা পরীক্ষা করল। তারপর গর্জন করে বলল, কোন দিকে গেছে সে?
আমি কি করে জানব? ও টম আমি ভেবেছিলাম তুমি সত্যিই বুঝি মরে গেছ।
লেপস্কি ছুটে গিয়ে শোবার ঘর থেকে রিভলবারটা তুলে নিল।
ক্যারোল তার হাত চেপে বলল, যেয়ো না। মেয়েছেলেটা উন্মাদ।
লেপস্কি হেসে বলল, আরে এটা পুলিশের চাকরী। শোন বেইগলার আর অন্য সবাইকে খবর দাও।
ক্যারোলের চোখ জলে ভরে গেল।
রাস্তায় বেরিয়ে ডানেবায়ে তাকাল লেপস্কি। জনশূন্য রাস্তা। হঠাৎ দেখল লম্বা কাগজওয়ালা ছেলেটা, নাম টেড, বারান্দায় কাগজ ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছে।
লেপস্কি চেঁচিয়ে উঠল, এই টেড।
টেড জোরে সাইকেলে প্যাডেল করতে করতে এগিয়ে এল।
লেপস্কি জানত ছেলেটা একটু হাবাগোবা, কিন্তু লেপস্কিকে ভগবানের মতন পুজো করে।
টেড বলেছে তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হল লেপস্কির মতন একজন পুলিশ হওয়া।
টেড এসে লেপস্কির পাশদাঁড়াল, এই যে মিঃ লেপস্কি বদমাশগুলো সব কেমন আছে? লেপস্কি বলল– বদমাশেরা আসে আবার মিলিয়ে যায় টেড।
টেড বলল, যা বলেছেন। তারপর পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা দিয়ে কাউকে গুলি করেছেন?
শোন টেড, কাল পোশাক পরা কোন মেয়েকে তুমি এই পথে যেতে দেখেছ?
আমি জানি আপনি অনেক বদমাশদের এই রিভলবার দিয়ে শায়েস্তা করেছেন। আমিও একদিন পুলিশ হলে এই পিস্তল ব্যবহার করব।
লেপস্কি অধৈর্য হয়ে বলল,তড়াতাড়ি বল, কাল পোশাক পরা কোন মহিলাকে তুমি দেখেছছ?
–একজন মেয়েছেলে?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয় দেখেছি।
–কোন পথে গেছে?
মনে হয় গীর্জার দিকে গেছে। দৌড়ে গীর্জার দিকে গেল। অথচ আমার মা অসময়ে টানতে টানতে গীর্জায় নিয়ে যেত।
সে ছুটে গীর্জার দিকে যেতে যাবে এমন সময় একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল। আরও একটা গাড়ি চাকার তীব্র আর্তনাদ করে থামল। তার থেকে লাফিয়ে নামল জ্যাকবি আর সাদা পোশাক পরা দুজন পুলিশ।
প্রত্যেকের দৃষ্টি লেপস্কির দিকে। প্রতিবেশীরা বলে লেপস্কি সেরা পুলিশ ডিটেকটিভ। এই প্রসংশার মান রাখার সময় এসেছে।
-কি ব্যাপার কি? জ্যাকবি জিজ্ঞেস করল।
–অনিতা সার্টেজ। পাগল হয়ে গেছে। সে আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। চল সেন্টমেরী চার্চে ঢুকেছে।
পকেট থেকে রিভলবার বার করতে করতে জ্যাকবি বলল, বেশ চল ওকে ধরি।
পিস্তল হাতে তারা দল বেঁধে চার্চের দরজার কাছে জড় হল। দরজা খোলা।
লেপস্কি জ্যাকবির সঙ্গে সাবধানে ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল।
দূরে বেদীর কাছে সার সার মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির দপ দপে আলোয় বেদীটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
লেপস্কি কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল।
বেদীর সামনে পড়ে থাকা মেয়েটাকে সেই কিউবান মেয়েছেলে বলে চিনতে পারল। বেদীর সিঁড়ি বেয়ে টপ টপ করে রক্তের ধারা পড়ছে। একটা ছুরির হাতল অনিতা সার্টেজের হৃদপিণ্ডে আমূল বিধে রয়েছে।
.
উইলবার ওয়ারেনটন ধীরে ধীরে চোখ মেলল। তারপর পাশে পড়ে থাকা বউ-এর দিকে তাকাল। সেও জেগে উঠেছে। চোখ মেলে তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল।
মরিয়া বলল–ওরা কি চলে গেছে?
আমাদের ওপর ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করেছিল। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ ওরা চলে গেছে।
ঘুমের ওষুধ? কি বলছ মারিয়া বলল।
–তা ছাড়া আর কি? উইলবার বলল।
–কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে। মারিয়া উঠে তার গলায় হাত দিয়েই আর্তনাদ করে উঠল।
আমার হীরেগুলো ওরা নিয়ে পালিয়েছে। সে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, উইলবার তাকে ধরে ফেলল।
–মারিয়া, চুপ করে বোস। উইলবার বলল।
-ওঃ, আমার হীরে।বাবা কি বলবেন?ওগুলোর দাম এক কোটি ডলার।বদমাশগুলো আমার হীরে নিয়ে চলে গেল। মারিয়া আর্তনাদ করতে লাগল।
–ওগুলো তোমার হারায়নি। পাগলামিকরনা। মারিয়া একদৃষ্টে উইলবারের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর কাঁপা গলায় বলল, ওগুলো তাহলে কোথায়?
–কোথায় আবার সিন্দুকে।
আমি পাগল হয়ে গেছি না তুমি?
–আমি তোমার বাবাকে কথা দিয়েছিলাম যে তুমি যদি নিরাপত্তা ছাড়া ওগুলো পরে বাইরে যাবার জন্য জেদাজেদি কর তাহলে তোমাকে নকল সেটগুলো দেব।
নকল সেট?
–তোমার বাবা যখন হীরেগুলো তোমাকে দেন আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে নকল হীরেগুলো আমায় হাতে দেন। তিনি ওগুলো হংকং-এ তৈরী করিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন এক্সপার্টরাকাঁচকে এমন পরিবর্তন করতে পারেন যা দেখে মনে হবে আসল হীরে। তোমার দুল, হার, বালা যা গেছে তা সব কাঁচের তৈরী।
–হে ভগবান, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
উইলবার গোপনে সিন্দুক থেকে একটা ছোট্ট থলে বার করে মারিয়ার হাতে দিল। মারিয়া হাঁ করে হীরেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সুর্যের আলোয় ওগুলো ঝকমক করছিল।
থলেটা নামিয়ে মারিয়া উইলবারের দিকে ও ডার্লিং বলে ছুটে গেল-আমার অসভ্য ব্যবহারের জন্য আমাকে ক্ষমা কর।
উইলবার বলল–যাও, শুয়ে পড়। আমাকে এখন পুলিশ ডাকতে হবে।
শুয়ে পড়ব? আমার এখন শ্যাম্পেন আর স্যান্ডউইচ খেতে ইচ্ছে করছে। উৎসব পালন করবো না আমরা? মারিয়া আনন্দে চারপাশ ঘুরপাক খাচ্ছিল।
উইলবারকাঁধ ঝাঁকিয়ে পুলিশকে টেলিফোন করতে গেল। মারিয়াকে বাইরে টেরেসের দিকে যেতে দেখে হাসল। সে জানে না যে ঐ টেরেসেই দুদুটো বিকৃত মৃতদেহ পড়ে আছে। সে জানে না গত রাতে এই ঘরেই লোভ, বিশ্বাসঘাকতা, ভালবাসা, প্রতিশোধের এক বিরাট খেলা সংঘটিত হয়ে গেছে। ছোট ছোট মানুষের কত রকমের আবেগ যা উইলবার আর মারিয়া কোনদিন বুঝতে পারবে না।