৫. প্লুটোনিকের জীবনযাত্রা ভারি বিচিত্র

প্লুটোনিকের জীবনযাত্রা ভারি বিচিত্র। যাদেরকে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে ধরে আনা হয়েছে, তারা প্রথম কয়দিন খুব ছটফট করে, বিদ্রোহ-বিক্ষোভ করতে চায়, হৈচৈ চেঁচামেচি করে। কিন্তু ফ্রিপসির অদৃশ্য চোখ-কান আর অলৌকিক ক্ষমতার সামনে কয়দিনেই সবাই শিশুর মতো অসহায় হয়ে পড়ে। কয়দিন পরেই তাদের সবরকম বিদ্রোহ-বিক্ষোভের ঝোঁক কেটে যায় তখন জেলখানায় আটক বন্দিদের মতো মাথা গুজে কাজ করে যায় আর দিন গুনতে থাকে কবে বন্দিজীবন শেষ করে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে।

হাকশী বাইরে কোথায় কি করছে না-করছে সে সম্পর্কে প্লুটোনিকের কাউকেই একটি কথাও বলে না। প্লুটোনিকের লোকজন যখন জাহিদ আর কামালের মুখে শুনতে পেল মহাকাশের সব মহাকাশযান হাকশী ধ্বংস করে ফেলেছে, তখন তাদের বিস্ময়, হতাশা আর আক্রোশের সীমা থাকল না। কিন্তু কিছু করার নেই-বুকের আক্রোশ বুকে চেপে রেখে সবাই নিজের কাজ নিজে করে যেতে লাগল। এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার একটিমাত্র উপায় হচ্ছে আত্মহত্যা করা—কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে। কয়জন

হাকশী কি জন্যে মহাকাশযান, কৃত্রিম গ্রহ, উপগ্রহ ধ্বংস করে বেড়াচ্ছে সেটার ােনো সদুত্তর জাহিদ খুঁজে পায় না। প্লুটোনিকের অনেকে হয়তো হাকশীর কাছে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে শুনেছে, কিন্তু ফ্রিপসির ভয়ে কেউ তাদের কিছু জানাল না। সুযোগ পেয়ে একদিন সে নিজেই হাকশীকে জিজ্ঞেস করল তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি। হাকশী ওকে যা বোঝাল, সেটি যেরকম আজগুবি, ঠিক ততটুকু সঙ্গতিহীন।

সে নাকি পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার একটা মহান পরিকল্পনা নিয়েছে। বিভিন্ন দেশ নিজেদের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে বেড়ায়—কিন্তু সব দেশ মিলে যদি একটিমাত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয় তাহলে যুদ্ধ-বিগ্রহ করার উপায় থাকবে না। কোনো দেশ তো আর নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না! পৃথিবীর সব দেশ একত্র হওয়া নাকি তখনই সম্ভব, যখন একটি মহাশক্তি তাদের পরিচালনা করবে। হারুন হাকশী হবে সেই মহাশক্তি—মহাকাশ পুরোপুরি দখল করে নেয়ার পর সে সমস্ত পৃথিবীর কর্তৃত্ব পেয়ে যাবে যখন খুশি যে-কোনো দেশে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবে। পৃথিবী তখন বাধ্য হবে তার কথা শুনতে।

সব শুনে জাহিদ বুঝতে পেরেছে, হাকশী হচ্ছে একটি উন্মাদ। কিন্তু এই উন্মাদের যে ক্ষমতা রয়েছে এবং সেটাকে কাজে লাগানোর যে প্রতিভা রয়েছে সেটা সত্যিই ভয়ংকর!

প্রথম কয়দিন ছটফট করে জাহিদ আর কামাল কাজে মন দিয়েছে। দু’ জনেই কাজ করে ডিক টার্নার নামে একজন বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর অধীনে। লোকটা একটা ছোটখাট পাষণ্ড। সুযোগ পেলে সে হাকশীর পিঠেও ছোরা বসাতে পারে—কিন্তু হাকশীর নিজের অল্প কয়জন লোকজনের মাঝে ডিক টার্নার হচ্ছে অন্যতম। ডিক টানার নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের বিশেষজ্ঞ। নিজে নূতন ধরনের রি-অ্যাক্টর ডিজাইন করেছে, সেটি আপাতত ফোবেসে কাজ করছে।

জাহিদের কাজ ছিল জ্বালানি তৈরি করার জন্যে ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ আলাদা করা। একঘেয়ে রুটিনবধা কাজ। কাজ করতে করতে জাহিদ হাঁপিয়ে ওঠে, কিন্তু এছাড়া আর কিছু করার নেই। নিজের কাজ সে মন দিয়ে করে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করে, আর সব সময়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে নির্দিষ্ট ভরের ইউরেনিয়াম ২৩৫ আলাদা করে ‘ক্রিটিক্যাল মাস’৬ করে ফেলতে পারে কি না। পারমাণবিক বোমার জন্যে ‘ক্রিটিক্যাল মাস কত সেটি তার জানা রয়েছে—কিন্তু সে পরিমাণ ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ সে কখনও হাতে পায় না। হাকশীর সাথে দেখা হলেই হাকশী হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, কি হে পদার্থবিদ, অ্যাটম বোমা তৈরির কতদূর।

ফ্রিপসির দৌলতে জাহিদ পরিকল্পনা করার আগেই হাকশী সেটা জেনে গেছে।

কামালের কাজ ছিল রি-অ্যাক্টরের কাছাকাছি। অতিকায় রি-অ্যাক্টরের খুটিনাটি অনেক কিছু তাকে লক্ষ করতে হত। কাজে ফাঁকি দেয়ার উপায় ছিল না—ফ্রিপসি সব সময় নজর রাখত। রি-অ্যাক্টরকে বিল করে দেবার অনেকগুলি পথ কামাল ভেবে বের করেছে। হাকশী সেগুলি সবকয়টাই জানত। অবসর পেলে হাকশী কামালের সাথে, সেগুলি নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করত। কারণ হাকশী খুব ভালো করেই জানত, কামাল কোনো দিনও ফ্লিপসির চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেগুলি কাজে লাগাতে পারবে না।”

জেসমিনের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। একটা নূতন ধরনের ভাইরাস নিয়ে তার গবেষণা করতে হচ্ছে। কি রকম অবস্থায় ভাইরাসগুলি কি ধরনের ব্যবহার করে তার একটি দীর্ঘ চার্ট করে তার সময় কাটে। এই ভাইরাসটি মানুষের মস্তিষ্কে আক্রমণ করে মানুষকে বোধশক্তিহীন করে ফেলে। হাকশী কোথায় এটি ব্যবহার করবে ভেবে জেসমিনের দুশ্চিন্তার সীমা থাকে না। জেসমিন কয়দিন হল আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে। হাকশী ফ্রিপসির কাছ থেকে সে খবর পেয়েছে অনেকদিন আগে। তবে এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। জেসমিন যদি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে তা হলে ভালোই হয়—ওকে বাচিয়ে রাখার আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। কামাল আর জাহিদের চাপে পড়ে ওকে বাচিয়ে রাখতে হয়েছে।

আস্তে আস্তে যতই দিন পার হতে লাগল, ওরা তিনজনই বোধশক্তিহীন যন্ত্র হয়ে যেতে লাগল। জেসমিনকে সাহস দিয়ে বেড়াত কামাল—ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করত—কিন্তু আসলে তাতে খুব একটা লাভ হত না। নিজেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী নয়।

একটা অক্ষম স্থবিরতা ওদের গ্রাস করে ফেলছিল ধীরে ধীরে। তার থেকে বুঝি কারো মুক্তি নেই!

 

জাহিদ বুঝতে পেরেছে সে হাকশীর কাছে হেরে গেছে। অনেক অহঙ্কার করে সে হাকশীকে বলেছিল তার প্লুটোনিক ধ্বংস করে দিয়ে সে প্রতিশোধ নেবে কিন্তু তার কথা সে রাখতে পারে নি। ফ্রিপসি নিখুঁতভাবে প্রতিটি চিন্তাভাবনা হাকশীকে জানিয়ে দিয়েছে। মানুষের মনের গোপন ভাবনাটিও যখন একজন প্রতিমুহূর্তে জেনে নেয়, তখন তার মতো অসহায় বুঝি আর কেউ অনুভব করে না। জাহিদ বিষণ্ণমুখে গোল জানালাটি দিয়ে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে—এইদিক দিয়ে কোটিখানেক মাইল দূরে পৃথিবী। পৃথিবীতে ফিরে যাবার প্রচণ্ড আকাঙ্খা তাকে প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিচ্ছে—এ ছাড়া সে বোধ করি পাগল হয়ে যেত। অবসর সময়ে সে হিসেব করে দেখে। দু বছর শেষ হতে আর কত দেরি। গোল জানালা দিয়ে নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখের সামনে পৃথিবীটা ভেসে ওঠে। তার দেশে এখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ কালো করে মেঘ হয়ে বিজলি চমকাচ্ছে, গুরুগুরু মেঘের ডাক—

জাহিদ।

জাহিদ বাস্তবে ফিরে এল—ঘুরে দেখে, কামাল। আজকাল ওদের দেখা হয় কম, কথাবার্তা হয় আরো কম। পূটোনিকের অন্য একজন সাধারণ অধিবাসীর সাথে কামালের পার্থক্য দিনে দিনে কমে আসছিল—সে নিজেও তেমনি একজন প্লুটোনিকের যন্ত্র হয়ে উঠছিল। অনেকদিন পরে কামালকে দেখে জাহিদের হঠাৎ করে আরো বেশি মন-খারাপ হয়ে গেল। কয়দিন আগেও তারা দু’জন একসাথে এন্ড্রোমিডাতে হৈচৈ করে বেড়িয়েছে।

কি রে কামাল, কিছু বলবি?

জাহিদ—কামালের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে।

জাহিদ ভারি অবাক হল। প্লুটোনিকের এই একঘেয়ে জীবনে এমন কী ঘটনা ঘটতে পারে, যা কামালকে এত উত্তেজিত করে তুলতে পারে? কামালকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

কামাল কোনো কথা না বলে জাহিদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাথরুমে। ফ্রিপসির জন্যে প্লুটোনিকের সর্বত্র রয়েছে অজস্র চোখ আর কান টেলিভিশন ক্যামেরা। আর মাইক্রোফোন। কোন ঘরে কোথায় আছে সেটা কারো জানা নেই। কামাল অনেক খুঁজে বাথরুমের টেলিভিশন ক্যামেরাটি বের করেছিল, ডান পাশে আয়নার ঠিক নিচে ছোট্ট একটি গোল ফুটো, তার পিছনেই রয়েছে টেলিভিশন ক্যামেরা। কামাল একটা ভোয়ালে দিয়ে সেটা ঢেকে দিল। তারপর ট্যাপ আর শাওয়ার খুলে পানির শব্দ দিয়ে মাইক্রোফোনটিকে অচল করে দিয়ে জাহিদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

জাহিদ এতক্ষণ কামালের প্রস্তুতি দেখে ভারি অবাক হয়। কামাল এমন কী কথাটি বলবে যেটি ফ্রিপসিকে জানতে দিতে রাজি নয়? ফ্রিপসি জানে না এমন কিছুই যখন তাদের জানা নেই। কামালকে জিজ্ঞেস করল, কি বলবি?

কামাল খুব নিচু গলায় বলল, আমি জেসমিনকে ভালবাসি, তুই জানিস?

শুনে জাহিদ ভারি অবাক হল—এটি এমন কোনো বিচিত্র ব্যাপার নয়। সে নিজে প্রেম-ভালবাসার ব্যাপারে মোটেই স্পর্শকাতর নয়, কিন্তু কামালের জন্যে এটি খুবই স্বাভাবিক বিশেষ করে যখন পরিস্থিতি হঠাৎ করে তাদের এরকম অবস্থায় এনে ফেলেছে। জাহিদ অবাক হল এই ভেবে যে, এ কথাটি বলার জন্যে এত সতর্কতা কেন? সে কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে?

কামাল কাঁপা গলায় বলল, ফ্রিপসি জানে না।

জাহিদ ভীষণ চমকে উঠল—চেচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, কী বললি!

আস্তে। ফ্রিপসি শুনতে পাবে! আজ দুপুরে হাকশীর ঘরে গিয়েছিলাম ভেন্টিলেশান টিউব পরীক্ষা করতে। হাকশীর সাথে গল্প করে আমার সম্পর্কে ফ্রিপসির আজকের রিপোর্টটা দেখতে চাইলাম, এমনি ইচ্ছে হচ্ছিল দেখতে। কি কারণে জানি ব্যাটার মন ভালো ছিল, দেখতে দিল। আমার সম্পর্কে ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। পাঁচটার সময় জেসমিনকে নিয়ে ছ’তলায় গিয়ে নিরিবিলি গল্প করব ঠিক করে রেখেছিলাম—অথচ ফ্রিপসি লিখেছে—পাঁচটার সময় তোর সাথে আলাপ করব। কীভাবে কার্বন মনোক্সাইড ব্যবহার করে হাকশীকে খুন করা যায়–

তুই ঠিক দেখেছিস?

হ্যাঁ তাই জেসমিনের সাথে দেখা না করে পাঁচটা বাজতেই তোর কাছে চলে এসেছি।

ফ্রিপসির তাহলে প্রেম-ভালবাসা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। উত্তেজনায় জাহিদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল, ফিসফিস করে বলল, আমাদের আগেই এটা বোঝা উচিত ছিল—ফ্রিপসি তো যন্ত্র। প্রেম-ভালবাসা বুঝবে না। কেউ প্রেমে পড়লেই তার সম্পর্কে ভুল খবর দেবে।

হ্যাঁ কামালের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই সুযোগ ফ্রিপসি ভাবছে তোর সাথে কার্বন-মনোক্সাইড নিয়ে আলাপ করছি। এই ফাঁকে একটা সত্যিকার পরিকল্পনা করে ফেল।

এত তাড়াতাড়ি। ভাবতে হবে না? সময় দরকার—

আর কখনো সময় নাও পেতে পারিস।

জাহিদ চুল খামচে ধরে বলল, যে-পরিকল্পনাই করিস না কেন, সবচেয়ে প্রথম ফ্রিপসিকে বিকল করতে হবে—এ ছাড়া কিছু করা যাবে না।

সম্ভব না—ফ্রিপসিকে নষ্ট করা যাবে না। ভীষণ কড়া পাহারায় থাকে।

নষ্ট না করে—ওটাকে বিকল করা যায় না?

কামাল দু’-এক মুহূর্ত ভাবল, বলল, যায়।

কীভাবে?

ইলেকট্রিসিটি যদি বন্ধ করে দেয়া যায়।

সেটা কীভাবে করবি?

কামাল মাথা চুলকাল সবার সামনে দিয়ে ফ্রিপসির ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে। দেয়া একেবারেই অসম্ভব!

আচ্ছা। এক কাজ করা যায় না?

কি?

নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরটা বন্ধ করে দেয়া যায় না? তাহলেই তো প্লুটোনিকের পুরো পাওয়ার বন্ধ হয়ে যাবে।

কীভাবে করবি? টার্নার ওখানে শকুনের মতো বসে থাকে।

তুই তো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের ইঞ্জিনিয়ার, এখানে ঢুকে কিছু করতে পারিস না?

কামাল ভাবতে থাকে। অনেকক্ষণ পরে বলে, তুই যদি টার্নারকে খানিকক্ষণ অন্য দিকে ব্যস্ত রাখতে পারিস, তা হলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।

কীভাবে করবি?

বলছি শোন—কামাল জাহিদকে পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বলতে থাকে, জাহিদ গম্ভীর হয়ে শোনে।, ঠিক সেই সময়ে হাকশী ছুটে আসছিল ওদের খোঁজে—ফ্রিপসি জরুরি বিপদসংকেত দিয়েছে।

বাথরুমের দরজা খুলে হাকশী এবং তার পিছনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নাকভাঙা আমেরিকানটাকে দেখে জাহিদ বুঝতে পারল, ওরা ধরা পড়ে গেছে।

হাকশী সরু চোখে ওদেরকে খানিকক্ষণ লক্ষ করল, তারপর কামালকে বলল, তোয়ালেটা ওখান থেকে সরিয়ে রাখ। ট্যাপগুলি বন্ধ কর।

কামাল তোয়ালেটা সরিয়ে নিয়ে খোলা ট্যাপগুলি বন্ধ করে দেয়—এতক্ষণ পানির ঝিরঝির শব্দে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে নীরবতা অস্বাভাবিক ঠেকল।

হাকশী গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী নিয়ে আলাপ করছিলে?

জাহিদ ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল, কিন্তু বাইরে খুব শান্ত ভাব বজায় রেখে বলল, তোমার ফ্রিপসিকে জিজ্ঞেস কর।

ফ্রিপসিকে জিজ্ঞেস করেই এসেছি–

তা হলে আর আমাদের জিজ্ঞেস করছ কেন?

হাকশী খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ভবিষ্যতে এরকম কাজ করবে না।

কী রকম কাজ?

টেলিভিশন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনকে এড়িয়ে যাওয়া।

দু’ -এক মিনিটের জন্যে গেলে ক্ষতি কি?

সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেব না। ফ্রিপসির চোখের আড়াল হওয়া চলবে না। যদি আড়াল হওয়ার চেষ্টা কর, সোজাসুজি মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

বেশ!

আর কার্বন-মনোক্সাইড ব্যবহার করে খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না প্লুটোনিকে বিষাক্ত গ্যাস বিশুদ্ধ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।

জাহিদ চমকে ওঠার ভান করল—তারপর মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ ফুটিয়ে তুলল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ছিল, হাকশী ধরতে পারে নি—ফ্রিপসি ধরতে পারে নি—ফ্রিপসিকে ধোঁকা দিয়ে ওরা ওদের মাথায় করে এক ভয়ানক পরিকল্পনা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

হাকশী চলে যাওয়ার পর জাহিদ খুব ধীরে ধীরে কামালের দিকে তাকিয়ে আছে—যদি কিছু বুঝে ফেলে? কামাল জাহিদের চোখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বুঝে ফেলল। চোখের ভাষা বুঝে নেবার মতো ক্ষমতা ফ্রিপসির নেই, তাই ফ্রিপসি জানতেও পারল না এই দু’ জন কী সাংঘাতিক পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে।

জাহিদ সারারাত (প্লুটোনিকে দিন-রাত নেই—সুবিধের জন্যে খানিকটা সময়কে রাত নাম দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে নেয়) খুব দুশ্চিন্তায় কাটাল—ওর কাজকর্ম ভাবভঙ্গি যদি ফ্রিপসির ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিলে না যায়, তাহলে হাকশী সন্দেহ করতে পারে। জাহিদ খুব সাবধানে কথা বলছিল—যখন ঠিক যেমনটি করা উচিত তখন ঠিক তেমনটি করে যাচ্ছিল। অন্ততপক্ষে একটি সপ্তাহ এভাবে কাটাতে হবে। সবচেয়ে মুশকিল কামালের সাথে এ বিষয়ে আর একটি কথাও বলা যাবে না। অপেক্ষা করে থাকতে হবে কবে কামালের কাছ থেকে সেই সংকেতটি আসে।

 

হাকশী প্রথম দু’দিন খুব অস্বস্তির সাথে দেখতে পেল জাহিদ আর কামালের কথাবার্তা ভাবভঙ্গি প্রায়ই ফ্রিপসির ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে খাপ খাচ্ছে না। যদিও খুবই ছোটখাটো ব্যাপার, কিন্তু বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সে সতর্ক থাকল এবং গোপন পাহারার ব্যবস্থা করল। তিন দিনের মাথায় আবার সব ঠিক হয়ে যাবার পর সে নিশ্চিন্ত হল, যদিও ব্যাপারটি দেখে তার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।

 

খাবার টেবিলে কাপে চা ঢালতে গিয়ে কামালের হাত থেকে খানিকটা চা ছলকে পড়ল। জেসমিন বিরক্ত হয়ে বলল, যেটা পার না সেটা করতে যাও কেন? দেখি, আমাকে দাও।

জেসমিন চা ঢেলে দিতে থাকে। জাহিদ খুব ধীরে ধীরে কামালের চোখের দিকে তাকাল। বুঝতে পারল আজকেই ঘটবে সেই ব্যাপারটা! টেবিলে চা ফেলে দেয়া আকস্মিক ঘটনা নয়—জাহিদকে সতর্ক করে দেয়া। চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল—যার যার কাজে যাবে।

প্লুটোনিকের সমস্ত শক্তি আসে ছ’তলায় বসানো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর থে ব্যাপারটার পুরো দায়িত্বে রয়েছে ডিক টার্নার। জাহিদ টানারের ঘরে নক করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কামাল চলে গেল রি-অ্যাক্টরের কাছে। পাঁচ-ছয়জন টেকনিশিয়ান এখানেসেখানে কাজ করছে সবাই চুপচাপমুখে পাথরের কাঠিন্য। কামাল তার নিজের জায়গা ছেড়ে আরও ভিতরে চলে গেল।

রি-অ্যাক্টরে আজ জ্বালানি প্রবেশ করানোর দিন—জ্বালানিগুলি প্লুটোনিকের ল্যাবরেটরিতেই ইউরেনিয়ামের বিভিন্ন আইসোটোপ থেকে আলাদা করা হয়। প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয় সেসব জ্বালানি খুব সাবধানে রাখা হয়। টার্নার ছাড়া আর কেউ সেখানে হাত দিতে পারে না।

কামাল দ্রুতহাতে স্বচ্ছ একটা পোশাক পরে নিতে থাকে। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের কাছে যেতে হলে এই পোশাক পরে নিতে হয়। উপরে আরো এক প্রস্থ সিলেফেনের পোশাক পরে নেয়া নিয়ম কামাল সে জন্যে অপেক্ষা করল না। সে দ্রুত পায়ে কন্ট্রোলরুমে ঢুকে পড়ে। পরপর তিনটি ভারী দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে হয়। শেষ দরজাটি বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে বাইরে নিশ্চয়ই হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।

ফ্রিপসি যখন দেখবে তার ভবিষ্যদ্বাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কামাল এরকম একটা বেআইনি কাজ করে ফেলছে, নিশ্চয়ই তখন সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেবে। ডিক টার্নার যখন খবর পাবে কামাল কন্ট্রোলরুমে ঢুকে পড়েছে, তখন সে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে পড়বে। বাইরে থেকে পাওয়ার বন্ধ করে দিয়ে তাকে বিপদে ফেলতে পারে, কিন্তু পরবর্তী পনের মিনিট টার্নারকে কোননা-না-কোনোভাবে আটকে রাখার দায়িত্ব জাহিদের। কামাল সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না—খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দিল। জ্বালানির ছোট ছোট টিউবগুলি পাল্টে দিতে হবে। ওগুলি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় রি-অ্যাক্টরের ভেতরে চলে যাবার জন্যে ট্রের উপরে সামনে আছে— কামাল সেগুলি টেনে নামিয়ে আনল। তারপর খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দিল— যদিও সে জানতেও পারল না তাড়াতাড়ি করার আর কোনো দরকার ছিল না। যার ভয়ে সে এত তাড়াহুড়ো করছিল, সেই ডিক টার্নার তখন গুলি খেয়ে টেবিলের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে—আর কোনো দিনও তার ওঠার ক্ষমতা হবে না।

জাহিদ ডিক টার্নারের ঘরে ঢুকে একটা কাল্পনিক সমস্যা নিয়ে আলাপ জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এমনিতে লোকটা নিতান্ত পাষণ্ড হলেও পদার্থবিজ্ঞান এবং যুক্তিবিদ্যায় তার অকৃত্রিম উৎসাহ রয়েছে। সত্যি সত্যি সে জাহিদের সাথে সমস্যাদি নিয়ে আলাপ করতে থাকে। কিন্তু যেই মুহূর্তে ফ্রিপসি সাইরেন বাজিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিল কামাল হঠাৎ করে বেআইনিভাবে জ্বালানিঘরে ঢুকে পড়েছে, তখন টার্নার লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল; কি করবে বুঝতে না পেরে চিৎকার করে জাহিদকে বলল, পাওয়ার বন্ধ কর।

জাহিদ ঠাণ্ডা গলায় বলল, কেন?

সাথে সাথে টার্নার বুঝে গেল যড়যন্ত্রে জাহিদও রয়েছে। সে নিচু হয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ছোট রিভলবার বের করে এবং জাহিদের দিকে তাক করে ধরল। জাহিদ ভেবেছিল ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে এবং কীভাবে আরো খানিকক্ষণ ওকে ব্যস্ত রাখা যায় মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছিল। কিন্তু টার্নার ভয় দেখানোর ধারেকাছে গেল না, সোজাসুজি তাকে গুলি করে বসল। শেষমুহুর্তে লাফিয়ে সরে যাওয়ার জন্যেই হোক, টার্নারের অপটু হাতের ভুল নিশানার জন্যেই হোক, জাহিদের ডান হাতের খানিকটা মাংস ছিড়ে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হল না। জাহিদকে লক্ষ করে দ্বিতীয়বার গুলি করার চেষ্টা করার সময় জাহিদ মরিয়া হয়ে টানারের উপর লাফিয়ে পড়েছে—রিভলবার কেড়ে নিতে গিয়ে হ্যাচকা টানে ট্রিগারে চাপ পড়ে একটা গুলি ওর মাথার ভিতর দিয়ে চলে গেছে। ফলস্বরূপ টার্নার এখন শীতল দেহে টেবিলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে—থিকথিকে রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে আর তাই দেখে জাহিদের গা গুলিয়ে উঠছে।

জাহিদ রিভলবারটা টেবিলের উপর রাখল বাইরে ভীষণ হৈচৈ চেচামেচি শুনতে পাচ্ছে। হাকশী আর তার দলবল ছুটে আসছে। হাকশীও কি টার্নারের মতো দেখামাত্র গুলি করে বসবে? নাকি ওর কথা শোনার জন্যে খানিকক্ষণ সময় নেবে? কামাল এতক্ষণে কী করল কে জানে! জাহিদ রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। দু’মিনিটের ভিতর দরজায় হাকশী এসে দাঁড়াল, পিছনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নাকভাঙা আমেরিকানটা।

জাহিদ সেকেণ্ড দশেক অপেক্ষা করল, না। হাকশী এখন তাকে মারবে না। তাহলে এ-যাত্রায় সে বেঁচে যেতেও পারে। খুব কষ্ট করে জাহিদ মুখে হাসি ফুটিয়ে এনে বলল, টার্নারের কাণ্ড দেখেছ! খামোকা গুলি খেয়ে মারা পড়ল! কী দরকার ছিল আমাকে গুলি করার?

হাকশী কোনো উত্তর দিল না। চোখ দুটিকে ছুরির মতো করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। হাকশীর বিশেষ নির্দেশে সবাই এসে জমা হয়েছে বড় হলঘরে। প্রথমবার দেখা গেল হাকশীর দেহরক্ষীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে হলঘরের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কফিন। কফিনে টার্নারের মৃতদেহ। একপাশে গম্ভীর মুখে হাকশী, অন্য পাশে জাহিদ আর কামাল দু’জনের হাতেই হাতকড়া। উপস্থিত সবাই বিশেষ বিচলিত কথাবার্তা নেই মোটেও। কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে কী ঘটে দেখার জন্যে। জেসমিনকে ভীষণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে—একটা চেয়ার ধরে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে জাহিদ আর কামালকে লক্ষ করছে—দেখে মনে হয় সে যেন ওদের চিনতে পারছে না।

তোমরা সবাই শুনেছ—হাকশী অনেকটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করল, জাহিদ আর কামাল মিলে টার্নারকে হত্যা করেছে–

মিথ্যা কথা। জাহিদ বাধা দিল, আমি কখনোই টার্নারকে হত্যা করি নি। আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল টার্নার ফ্রিপসিকে জিজ্ঞেস করে দেখ। বেকায়দা গুলি খেয়ে নিজেই মরেছে।

হাকশী এমন ভান করল যে, জাহিদের কথা শুনতে পায় নি। চাপা খসখসে স্বরে বলে যেতে লাগল, সে শুধু যে টার্নারের মতো প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে তাই নয়–রি-অ্যাক্টরের কন্ট্রোলরুমে ঢুকেছিল বিনা অনুমতিতে তাদের এই অবাধ্যতার শাস্তি দেয়া হবে এখনই, এখানেই। এমন শাস্তি দেব যে পৃথিবীর মানুষ শুনতে পেলে আতঙ্কে শিউরে উঠবে।

জেসমিন একটা আর্তস্বর করে চেয়ারে বসে পড়ল। সবাই তাকে একনজর দেখে হাকশীর দিকে ঘুরে তাকাল।

জাহিদ আলগোছে হাত তুলে ঘড়িটা দেখল। সাড়ে এগারোটা বাজতে এখনও মিনিট কয়েক বাকি রয়েছে। হাকশীকে আরও খানিকক্ষণ আটকে রাখতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

হাকশী জাহিদ আর কামালের দিকে তাকিয়ে গলার স্বরে বিষ মিশিয়ে বলল, আমার দলের সর্বশ্রেষ্ঠ লোকগুলির একজনকে হত্যা করার অপরাধের শাস্তি নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হও।

কী করতে চায় হতভাগাটা? জাহিদ মনে মনে ঘেমে উঠলেও বাইরে শীতল ভাব বজায় রেখে বলল, হাকশী, তুমি যদি সত্যি সত্যি টার্নারকে হত্যা করার জন্যে শাস্তি দিতে চাও, তা হলে শুধু আমাকেই সে শাস্তি দিতে হবে। তুমি খুব ভালো করে জান দুর্ঘটনাটা যখন ঘটেছে তখন কামাল সেখানে ছিল না।

তার মানে এই নয় পরিকল্পনাটাতে কামালের কোনো ভূমিকা ছিল না। তা ছাড়া হাকশী। কামাল হাকশীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাদের তোমার বিরুদ্ধে যাবার সুযোগ দিয়েছিলে। বলেছিলে, দু’টি সুযোগ দেবে—তৃতীয়বার শাস্তি দেবে! তা হলে প্রথমবারেই আমাদের শাস্তি দিতে চাইছ কেন?

শুনবে, কেন প্রথমবারই তোমাদের শেষ করে দিচ্ছি?

জাহিদ বুঝতে পারল হাকশী কী বলবে—কিন্তু মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?

কারণ তোমরা দুজন কী-একটা আশ্চর্য উপায়ে ফ্রিপসিকে ধোঁকা দিয়েছ। ফ্রিপসি তোমাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছে। তোমাদের এই ভয়ংকর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমায় কিছুই বলে নি।

উপস্থিত সবাই ভয়ানক চমকে উঠল—সেখানে দেয়াল ফেটে একটা জীবন্ত পরী বেরিয়ে এলেও বুঝি লোকজন এত অবাক হত না। সেকেণ্ড দশেক সবাই দমবন্ধ করে থেকে একসাথে চেচামেচি শুরু করে দিল। হাকশী কঠোর স্বরে ধমকে উঠল, থাম—

সাথে সাথে হঠাৎ দপ করে সব আলো নিভে গেল। লোকজনের প্রচণ্ড কোলাহলের মাঝে জাহিদ শুনতে পেল, ঘড়িতে ঠিক সাড়ে এগারোটা বাজার ঘন্টা পড়ছে।

কেউ এক পা নড়বে না—তা হলে গুলি করে সবার বুক ঝাঝরা করে দেয়া হবে। অন্ধকারে হারুন হাকশী নিষ্ঠুরভাবে চেঁচিয়ে উঠল, সবাই মেঝেতে হাত রেখে বসে পড়–মেঝে থেকে দু’ ফুট উচু দিয়ে গুলি করা হবে। সবাই হুড়মুড় করে বসে পড়েছে, জাহিদ তার শব্দ পেল। পরমুহূর্তে একঝাঁক গুলি তাদের মাথার উপর দিয়ে দেয়ালে গিয়ে বিঁধল।

জাহিদ মুখ টিপে হাসল, হারুন হাকশী ভয় পেয়েছে। দারুণ ভয় পেয়েছে। অন্ধকারে সে হাত বাড়িয়ে কামালের হাত স্পর্শ করে চাপ দিল—কামাল সত্যি সত্যি তাহলে জ্বালানির টিউব পাল্টে দিতে পেরেছে। সাড়ে এগারোটায় নতুন জ্বালানি দিয়ে কাজ শুরু করানোর সাথে সাথে তাই সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।

একটা চাপা শব্দ করে প্লুটোনিকের নিজস্ব ডায়নামো চালু হয়ে গেল খানিকক্ষণের মধ্যেই। ধীরে ধীরে মিটমিটে ভৌতিক আলো জ্বলে উঠল। আবছা আলোছায়াতে দেখা গেল, মেঝেতে শ’ চারেক লোক মাথানিচু করে গুড়ি মেরে বসে আছে, হাকশীর গোটা চারেক দেহরক্ষী তাদের দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করে আছে। জাহিদ এবং কামালের দিকে অন্য দু’জন দেহরক্ষী ট্রিগারে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। হাকশী অন্ধকারে সরে গেছে অনেক ভেতরের দিকে, নিরাপদ দূরত্বে। আলো জ্বলে ওঠার পর সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এল। উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ করে বলল, তোমরা একজন একজন করে বেরিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যাও। আজ তোমাদের সবার ছুটি। মনে রাখবে, ঘরের বাইরে কাউকে পাওয়া গেলে সাথে সাথে গুলি করা হবে!

লোকগুলি ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল, ছারপর একজন একজন করে বেরিয়ে যেতে লাগল। শেষ লোকটি বেরিয়ে যাবার পর হাকশী জাহিদ এবং কামালের দিকে এগিয়ে এল। বলল, এটাও তোমাদের কাজ, না?

জাহিদ দাঁত বের করে হাসল। হালকা স্বরে বলল, তোমার কী মনে হয়? ভূতের?

ঠাট্টা রাখ। প্রচণ্ড শব্দে হাকশী ধমকে উঠল—তোমার সাথে আমি তামাশা করছি না।

জাহিদ শীতল স্বরে বলল, দেখ হাকশী, তুমি আর চোখ রাঙিয়ে কথা বলার চেষ্টা করো না। তোমাকে আমরা আর এতটুকু ভয় পাই না। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর নষ্ট করে এসেছি, ওটা যদি ঠিক করতে পার—জাহিদ একটু হাসল হ্যাঁ, যদি তোমার টেকনিশিয়ানরা ঠিক করতে পারে, শুধু তাহলেই প্লুটোনিক বেঁচে যাবে। আর তা যদি পার, তা হলে সেই মুহূর্তে তোমার ঐ ধুকপুকে ডায়নামোটা শেষ হয়ে যাবে—আলো, তাপ, বাতাস, খাবার পানি সবকিছুর অভাব শুরু হয়ে যাবে। খুব বেশি হলে দশ দিন বেঁচে থাকতে পারবে

স্কাউণ্ড্রেল! তোমরা বেঁচে যাবে ভাবছ?

মোটেই না। জাহিদ উদারভাবে হাসে, অনেক দিন বেঁচেছি, আর বাঁচার শখ নেই। তোমাকে শেষ করে যদি মারা যাই, খোদা নির্ঘাত বেহেশতে আমাকে একটা প্রাসাদ। বানিয়ে দেবে। হুর পরী

চুপ কর। তোমার কথাও আমি বিশ্বাস করি না। আমি টেকনিশিয়ানদের পাঠাচ্ছি। ওরা রি-অ্যাক্টর ঠিক করবে। তারপর হাকশী দাঁত চিবিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করে তার আগেই কামাল হো-হো করে হেসে উঠে বলল, হাকশী, জাহিদের কথা বিশ্বাস নাই-বা করলে! আমার কথা বিশ্বাস করবে? তা হলে শোন, আমি হচ্ছি রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিনিয়ার। আমাকে শেখানো হয় রি-অ্যাক্টর কীভাবে তৈরি করা হয়, তার কোথায় কি থাকে, রি-অ্যাক্টরের কোন অংশে কি করলে সেটার কি পরিমাণ ক্ষতি হয়, আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। অবশ্যি টার্নার জানত, কিন্তু বেচারা মাথাগরম করে মারা পড়ল। কামাল চুকচুক শব্দ করে খানিকক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করল।

তুমি কী বলতে চাও?

এখনো বোঝ নি? তা হলে শোন, জাহিদ যখন টার্নারকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছিল, তখন আমি কন্ট্রোলরুমে কী করছিলাম, তুমি জান?

হাকশী কী বলতে গিয়ে থেমে গেল।

হ্যাঁ—ফ্রিপসি জানত। কিন্তু রি-অ্যাক্টর ঠিক না হলে ইলেকট্রিসিটি চালু হবে না, ইলেকট্রিসিটি চালু না হলে ফ্রিপসি চালু হবে না, আর ফ্রিপসি চালু না হলে তুমি জানতেও পারবে না আমি কী করেছি। আর সেটা যদি না জান, কোনোদিন রি-অ্যাক্টর চালু হবে না। কেমন মজা, দেখেছ?

জাহিদ মুখে একটা সরল ভাব ফুটিয়ে এনে হাকশীকে উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করল, তোমার ইমার্জেন্সি ডায়নামোটার পুরো ইলেকট্রিসিটিটা ব্যবহার করে দেখ না, ফ্রিপসিকে চালু করা যায় কি না?

হাকশী জাহিদের কথা না শোনার ভান করল, কারণ সে খুব ভালো করে জানে ইমার্জেন্সি ডায়নামোর ক্ষমতা এত কম যে, প্লুটোনিকের সব ঘরে আলো পর্যন্ত জ্বালাতে পারে না—সেটি দিয়ে ফ্রিপসিকে চালু করা আর ইদুরছানা দিয়ে স্টীম রোলার টেনে নেয়ার চেষ্টা করা এক কথা।

হাকশী সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে সারা হলঘর ঘুরে বেড়াতে থাকে। বুঝতে পেরেছে, এরা দুজন মিলে রি-অ্যাক্টরে একটা-কিছু করে এসেছে, সেটা কী ধরনের কাজ, কে জানে। নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর যথেষ্ট জটিল জিনিস। এটার বিরাট যন্ত্রপাতির খুঁটিনাটি অসংখ্য ইউনিটের কোথায় কি করে এসেছে জানতে না পারলে সেটা ঠিক করা মুশকিল। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ না হলে সেটি একেবারে অসম্ভব। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ছিল টার্নারসে মারা যাওয়ার পর কামাল ছাড়া আর কেউ নেই।

হাকশী কামালের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি যদি রি-অ্যাক্টরটা ঠিক করে দাও তাহলে তোমায় আমি ক্ষমা করে দেব।

ক্ষমা! কামাল খুব অবাক হবার ভান করল, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে? আমি আরো ভাবছিলাম কী করলে তোমায় ক্ষমা করা যায়। হাতে হাতকড়া রয়েছে তো কী হয়েছে—ক্ষমতাটুকু যে তোমার হাতে নেই বুঝতে পারছ না।

ভেবে দেখ কামাল। নির যন্ত্রণাময় মৃত্যু

থাক থাক, মিছিমিছি কঠিন ভাষা ব্যবহার করে লাভ নেই। আমার নিষ্ঠুর মৃত্যু হলে তোমার মৃত্যুটি কি আর মধুর মৃত্যু হবে? একটু আগে আর পরে, এই যা। এ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই।

প্রচণ্ড ক্রোধে হাকশীর চোখ ধকধক করে জ্বলে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বেশ। তাহলে ফোববাসে করে এক্ষুণি আমি পৃথিবীতে যাচ্ছি। পৃথিবীর সেরা সব রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিনিয়ারদের ধরে আনব, তারপর দেখি।

জাহিদ হাসিমুখে বলল, একটা পাল নিয়ে যেও।

মানে?

মানে তোমার ফোবোস তিন মিনিটের বেশি চলবে না। ওটার রি-অ্যাক্টর বন্ধ হয়ে গেলে আর পৃথিবীতে পৌঁছুতে হবে না। মাঝখানে মঙ্গলের উপগ্রহ হয়ে ঝুলে থাকবে। তখন পাল টানিয়ে যদি যেতে পার—

হাকশী রসিকতায় এতটুকু হাসির ভঙ্গি করল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল জাহিদের কথা কতটুকু সত্যি। তারপর ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, বেশ, কী করতে হয় আমি দেখব। সবাইকে যদি মরতেই হয়, চেষ্টা করে দেখব কারো কারো মৃত্যু যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক করা যায় কি না। বিজ্ঞানী হাকশীকে দেখেছ, উন্মাদ হাকশীকে দেখেছ, নিষ্ঠুর হাকশীকেও দেখেছ, স্যাডিস্ট হাকশীকে দেখবে এবার।

জাহিদ ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। হাকশীর দু’জন দেহরক্ষী হাকশীর আদেশে ওদের নিয়ে গেল দু’টি ছোট খুপরিতে। তালা মেরে রাখল আলাদা আলাদা। পরস্পর যেন কথা না বলতে পারে কোনোভাবে।

ছোট ঘরটার শক্ত মেঝেতে শুয়ে শুয়ে জাহিদ পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখে। ঠিক যেরকমটি আশা করছিল সেরকমটিই ঘটেছে। হারুন হাকশীর হাত থেকে তাসের টেক্কা চলে এসেছে তাদের হাতে। এখন ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে হয়। হাকশী নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে নিজের লোকজন দিয়ে রি-অ্যাক্টর ঠিক করে ফেলতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। কামাল অনেক ভেবেচিন্তে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা মাফিক রি-অ্যাক্টর দু’টিকে বিকল করেছে। কেউ যদি ঠিক করতেও পারে তাহলেও সেগুলি চালু করতে পারবে না। কারণ জ্বালানি হিসেবে যে-ছোট টিউবগুলি ব্যবহার করা হবে, তার ভেতরে এখন আসল আইসোটোপগুলি নেই।

জাহিদের ইচ্ছে হচ্ছিল আনন্দে একটু নেচে নেয় কিন্তু সারা দিনের ধকলে খুব ক্লান্ত হয়ে আছে—একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। হাতকড়াগুলির জন্যে অস্বস্তি হচ্ছিল, ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকা ভারি ঝামেলা, তবুও কিছুক্ষণের মাঝে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

চোখে তীব্র আলো পড়তেই জাহিদ ধড়মড় করে উঠে বসল। হাতে টর্চলাইট নিয়ে হাকশীর দেহরক্ষীরা ঘরে ঢুকেছে। জাহিদকে বেরিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল। হঠাৎ করে কী হল বুঝতে না পেরে জাহিদ বাইরে বেরিয়ে আসে। কামালকেও ডেকে তুলে আনা হয়েছে।

কী হল? ঘুমুচ্ছিলাম, ডেকে তুললে, মানে?

জাহিদের কথার উত্তর না দিয়ে নাকভাঙা আমেরিকানটা তাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিল সামনে এগিয়ে যেতে।

খাঁটি বাংলায় একটা দেশজ গালি দিয়ে সে এগুতে থাকে। হারুন হাকশীর ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারে হাকশী হঠাৎ করে কেন তাদের ডেকে এনেছে।

ঘরের মাঝেখানে একটা চেয়ারে জেসমিন বসে আছে। হাত দুটো পিছন দিকে শক্ত করে বাঁধা। জেসমিনের চোখ আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওদের দু’জনকে দেখে সে হু-হু করে কেঁদে উঠল।

কামাল ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল তার আগেই ঘাড়ে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। হাকশীর দেহরক্ষীরা ওকে তুলে ধরে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। জাহিদ যদিও উন্মত্ততার কোনো লক্ষণ দেখায় নি, কিন্তু হাকশীর নির্দেশে তাকেও একটা চেয়ারে বেঁধে ফেলা হল।

এতক্ষণ পর হাকশীর মুখের ভাব সহজ হয়ে আসে। সে হাসিমুখে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলে, তোমরা বুদ্ধিমান ছেলে! নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি কী করতে চাইছি।

কামাল আর জাহিদ কোনো কথা বলল না। তীব্র দৃষ্টিতে হাকশীর দিকে তাকিয়ে রইল।

হাকশী ঘরে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে অনেকটা আপন মনে বলতে থাকে, প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদের উপরই পরীক্ষাটা চালাব। কাউকে কোনো কিছু স্বীকার করানোর জন্যে প্রাচীনকালে কিছু কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা হত। যেমন নখের নিচে গরম সুচ ঢুকিয়ে দেয়া, লোহার শিক গরম করে শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায়। ছ্যাকা দেয়া, পা বেধে উপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা, পানির বালতিতে মাথা ডুবিয়ে রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া আরও বীভৎস পদ্ধতি আছে, যেমন শরীর ছিড়ে সেখানে অ্যাসিড লেপে দেয়া, সীসা গরম করে কানে ঢেলে দেয়া, সাঁড়াশি দিয়ে একটা করে দাঁত তুলে নেয়া, আলপিন দিয়ে চোখ গলিয়ে দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। বলে এগুলি শেষ করা যায় না।

হাকশী তার বক্তৃতার ফলাফল দেখার জন্যে একবার আড়চোখে ওদের দুজনকে দেখে নিল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদের দু’জনের উপর এই পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর সারিয়ে নেব। কিন্তু পরে। মনে হল, তোমরা যেরকম একগুঁয়ে, হয়তো দাঁত কামড়ে মরে যাবে তবু রাজী হবে না। তখন এই মেয়েটার কথা মনে হল। মনে আছে প্রথম যেদিন ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম, ওর জন্যে তোমাদের দরদ কেমন উথলে উঠেছিল?

হারামজাদা—শুওরের বাচ্চা। কামালের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল রাগে।

মিছিমিছি কেন মুখ খারাপ করছ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব—লাভ নেই কিছু। তার চেয়ে আমার কথা শোন। আমি যদি তোমাদের সামনে এই মেয়েটার গায়ে হাত দিই, তোমাদের কেমন লাগবে? যদি মনে কর নখের নিচে সুচ ঢুকিয়ে দিই? কিংবা ঝুলিয়ে রেখে চাবুক মারি—

মেরে দেখ না কুত্তার বাচ্চা—তোর গুষ্টি যদি আমি–

হাকশী হা-হা করে হেসে উঠল। বলল, রক্ত গরম তোমার কামাল সাহেব। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। আমি ইচ্ছে করলে এখন এই মেয়েটার শরীর চাকু দিয়ে চিরে ফেলতে পারি, চোখ তুলে ফেলতে পারি, দাঁত ভেঙে ফেলতে পারি—তোমাদের বসে দেখতে হবে। পারবে?

শুওরের বাচ্চা!

আমার কথার উত্তর দাও। পারবে দেখতে? একটু থেমে বলল, পারবে না। এসব দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে না—বিশেষ করে যদি সেটি কোনো পরিচিত মেয়ের উপর করা হয়। কাজেই আমার প্রস্তাবটা শোন—এই মুহূর্তে তোমরা দু’ জন নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর দু’টি ঠিক করে দাও। যদি রাজি না হও, তাহলে হাকশী দাঁত বের করে হাসল।

জেসমিন এতক্ষণ একটি কথাও বলছিল না। এবারে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ভাঙা গলায় বলল, তোমরা ওর কথায় রাজি হয়ো না। ও একটা পিশাচ। আমার জন্যে ভেবো না—যা হবার হবে! তোমরা কিছুতেই ওর কথায় রাজি হয়ো না।

হাকশী দু’ পা এগিয়ে আসে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার জন্যে ভাবতে নিষেধ করছ? অত্যাচার সহ্য করতে পারবে তাহলে?

জেসমিন ভীত চোখে তাকাল হাকশীর দিকে। হাকশী আরো ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে। হাতের সিগারেটটা তুলে ধরে বলে, পরীক্ষা হয়ে যাক একটা, দেখি কতটুকু সহ্যক্ষমতা।

খবরদার। কামালের চিৎকারে সারা ঘর কেঁপে উঠল, কিন্তু হাকশীর মুখের মাংসপেশী এতটুকু নড়ল না। হাসিমুখে সিগারেটের আগুনটা জেসমিনের গলায় চেপে ধরল।

বন্ধ কর—বন্ধ কর বলছি শুওরের বাচ্চা, নইলে প্রচন্ড ক্রোধে কামাল কথা বলতে পারে না।

জেসমিন শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ঠোট কামড়ে ধরল। মুহূর্তে ওর সারা মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে আর বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজে ওঠে। কুঁচকে ওঠা চোখের ফাঁক দিয়ে উষ্ণ পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে আর সে প্রচণ্ড যন্ত্রণাকে সহ্য করার জন্যে প্রাণপণে ঠোঁট কামড়ে ধরে। ঠোঁট কেটে দু ফোঁটা রক্ত ওর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল—পোড়া মাংসের একটা মৃদু গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ল ধীরে ধীরে।

কামাল চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে নিজের ভিতরের প্রচণ্ড আক্রোশটা আটকে রাখতে চাইছিল। এবারে আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে উঠল, ঠিক আছে শুওরের বাচ্চা, আমি রাজি।

হাকশীর মুখের হাসিটা আরো বিস্তৃত হয়ে উঠল, এই তো বুদ্ধিমান ছেলের মতো কথা। সে সিগারেটটা সরিয়ে এনে সেটাতে একটি টান দিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসে, তাহলে এখনই কাজে লেগে যাও!

এখন পারব না। জাহিদ শীতল স্বরে বলল, বিশ্রাম নিতে হবে, কাল ভোরের আগে সম্ভব না।

বেশ। তাহলে বিশ্রাম নাও। কাল দশটার ভেতরে আমি সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে চাই

মামাবাড়ির আবদার পেয়েছ? একটা জিনিসের বারটা বাজাতে দু মিনিট লাগে কিন্তু সেটা ঠিক করতে দু’ বছর লেগে যায়, জান না?

সে আমার জানার দরকার নেই। দশটার ভেতর ঠিক করে যদি না দাও তোমাদের জেসমিনকে আস্ত দেখতে পাবে না।

হাকশী। বাজে কথা বলে লাভ আছে কিছু? যেটা অসম্ভব সেটা আমরা কেমন করে করব? তুমি কি ভাবছ আমাদের কাছে আলাদীনের প্রদীপ আছে? ইচ্ছে করব আর ওমনি হয়ে যাবে?

কতক্ষণ লাগবে তা হলে?

সেটা না দেখে বলতে পারব না। এক সপ্তাহ লাগতে পারে বেশিও লাগতে পারে।

হাকশী খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ঠিক আছে, তোমাদের এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এর ভেতর সব যদি ঠিকঠাক করে দিতে পার—আমি নিজে সবকিছু পরীক্ষা করে দেখব, তারপর তোমাদের জেসমিন ছাড়া পাবে।

আর আমরা?

তোমরা? হাকশীর মুখে ধূর্ত একটা হাসি ফুটে উঠল। তোমাদের ব্যাপার পরে। ভোমাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ! সেগুলি বিচার না করে কিছু বলতে পারব না।

দেখ হাকশী, জাহিদ নরম সুরে বলল, তুমি তো দেখলে আমাদের ক্ষমতা কতটুকু ফ্রিপসির মত কম্পিউটারকে ঘোল খাইয়ে প্লুটোনিক প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। নেহায়েত জেসমিনের জন্যে শেষরক্ষা করতে পারলাম না। ঠিক কি না?

হাকশী স্বীকার করল যে, সত্যিই তা হতে যাচ্ছিল।

এবারে আমি আর কামাল যদি সুযোগ বুঝে নিজেদের ডান হাতের শিরাটা কেটে দিই তাহলে কেমন হয়?

মানে?

মানে আমরা যদি সুইসাইড করি তাহলে তোমার প্লুটোনিকের অবস্থাটা কী হয়?

কে আর ইচ্ছে করে আত্মহত্যা করতে চায়। তবে প্লুটোনিকের রি-অ্যাক্টর ঠিক করে দেয়ার পর আমাদের যদি তুমি বিচারের নাম করে শেষ করে ফেল, তা হলে আগেই সুইসাইড করে ফেলাটা কি ভালো নয়? তাতে আমরাও মরব; তুমি তোমার দলবল নিয়ে মরবে। জেসমিনও মারা যাবে তবে অত্যাচারটা সহ্য করতে হবে না। আমরাই যদি না থাকি, কাকে ভয় দেখানোর জন্যে ওর উপর অত্যাচার করবে?

হাকশী খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর গম্ভীর মুখে বলল, কি চাও তাহলে তোমরা?

আগে কথা দাও, রি-অ্যাক্টর ঠিক করে দেয়ার পরমুহূর্তে আমাদের তিনজনকে পৃথিবীতে ফেরত দিয়ে আসবে, তা হলেই আমরা কাজ শুরু করব।

হাকশী সরু চোখে জাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বেশ, কথা দিলাম।

তোমার কথায় বিশ্বাস করব কেমন করে?

সেটা তোমাদের ইচ্ছে। কিন্তু আমার কথাকে বিশ্বাস না করলে আর কিছু করার নেই।

জেসমিন হঠাৎ চিৎকার করে বলল, ওর কথা বিশ্বাস করো না। খবরদার, ওর কথা বিশ্বাস করো না—

কিন্তু জাহিদ আর কামাল হাকশীর কথা বিশ্বাস করল, কারণ এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।