৫. প্রথমে দেখেছিল অবু

প্রথমে দেখেছিল অবু। সন্ধের পর তার হঠাৎ খেয়াল হল, গুলতিটা বাগানে ফেলে এসেছে। তারা তিন ভাই আর পাড়ার কয়েকটা ছেলে মিলে যখন মার্বেল খেলছিল তখন পকেট থেকে গুলতিটা বের করে রেখেছিল গাছের একটা ফোকরে। আনতে ভুলে গেছে। সকালে আনলেও চলবে। কিন্তু পড়তে বসার পর বারবার গুলতিটার কথা মনে হচ্ছিল বলে পড়ায় মন দিতে পারছিল না। এক ছুটে গিয়ে নিয়ে এলেই হয়! লাগবে তো এক মিনিট।

একটা বড় টেবিলের চারধারে তারা পড়তে বসে। নিকু, বিকু, লীলা, ছবি, পুতুল। একটু বাদেই মাস্টারমশাই আসবে।

অবুকে উঠতে দেখেই বড়দি লীলা গম্ভীর হয়ে বলল, “এই, কোথায় যাচ্ছিস?”

“এই আসছি একটু বাথরুম থেকে।”

“একটু আগেই তো বাথরুম গিয়েছিলি।”

“নাকে হাত দিয়েছি তো, হাতটা ধুয়েই আসছি।”

বলে আর দাঁড়াল না অবু। ঘর থেকে বেরিয়ে এক ছুটে নীচে নেমে সোজা আমগাছের দিকে ছুটল। জায়গাটা অন্ধকার। তবে চেনা জায়গা বলে অবু টক করে গিয়ে গুলতি আর কয়েকটা পাথরের টুকরো বের করে নিল। আর তখনই ওপরদিক থেকে কার যেন কথা শুনতে পেল সে। খুব মৃদু গলায় কে যেন বলছে, “সদাশিবের বাড়িটা যে কোথায় গেল! কিছুই চিনতে পারি না যে!”

অবু এত ভয় পেল যে, শরীরটা শক্ত হয়ে গেল তার। গায়ে কাঁটা দিল। বুকের মধ্যে রেলগাড়ির শব্দ হতে লাগল যেন। তাকাবে না

মনে করেও সে কাঁপতে কাঁপতে ওপরে তাকিয়ে প্রথমে কাউকেই দেখতে পেল না। একটু তাকিয়ে থাকতেই দোতলায় তাদের পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে যে আলোটা আসছিল তার আবছা আলোয় সে দেখতে পেল, উঁচু একটা ডালে পা ঝুলিয়ে একটা লোক বসে আছে যেন!

“ভূত! ভুত! ভূত!”

খুব চেঁচাল অবু, কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বরই বেরোল না। সে হাঁ করে চেয়ে রইল। দৌড়ে পালানোর মতো পায়ের জোরও যেন নেই। সে শুধু কাঁপছে ঠকঠক করে।

লোকটা ফের আপনমনে বলল, “কিছুই যে খুঁজে পাচ্ছি না! সব ভুলে গেছি।”

হঠাৎ অবুর মনে হল, এ-লোকটা জাদুকর গজানন নয় তো! যাকে ধরার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে! আর এই জাদুকর গজাননই তো দিন-দুই আগে তার দাদুর হাতে আর একটু হলে ধরাই পড়ে যেত, কিন্তু দাদু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় ধরতে পারেনি। আর সেইজন্য কর্তাবাবার কাছে বকুনিও খেয়েছে। খুব। গজানন যদি হয়, তা হলে ভূত নয়। এটা মনে করতেই তার ভয়টা চলে গেল। সে টক করে গুলতিতে একটা পাথর ভরে নিয়ে তাক করে ছুঁড়ে দিল সেটা।

“উঃ!” বলে একটা আর্তনাদ করে লোকটা বুক চেপে ধরল দু’হাতে। তারপর টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল নীচে।

কিন্তু অবু হাঁ হয়ে দেখল, ওই অত উঁচু থেকে লোকটা পড়ল খুব আস্তে-আস্তে, পাখির পালকের মতো বাতাসে ভাসতে ভাসতে। উলটে পালটে খুব ধীরে-ধীরে লোকটা মাটিতে নেমে দু’পায়ে দাঁড়াল। দাড়িগোঁফে আচ্ছন্ন মুখ। বুক্টা এখনও দু’হাতে চেপে ধরে আছে।

তার দিকে চেয়ে লোকটা খুব করুণ গলায় বলল, “আমাকে মারলে?”

“আ-আপনি কে?”

“আমি জাদুকর গজানন। আমাকে মেরো না। আমি চোর নই।”

“আপনি কি ভূত?”

“কী জানি! বুঝতে পারি না বাবা।”

হঠাৎ অবুর বড্ড মায়া হল। গুলতি মেরেছে বলে কষ্টও লাগছিল তার। সে বলল, “আপনার কি খুব লেগেছে?”

“হ্যাঁ বাবা।”

“আমি অন্যায় করেছি। ভয় পেয়ে গুলতি মেরেছিলাম।”

“আমাকে ভয় পেও না।”

“আপনি গাছ থেকে পড়ে গেলেন, কিন্তু লাগল না তো!”

“নাঃ। আমি বড় হালকা হয়ে গেছি।”

“আপনি কি জাদুকর?”

“হ্যাঁ।”

“আপনাকে ধরার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।”

“জানি বাবা। সেইজন্যই পালিয়ে-পালিয়ে থাকি।”

“কিন্তু অনেক লোক যে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

লোকটা জুলজুল করে অবুর দিকে চেয়ে বলল, “ধরা পড়ে যাব নাকি? তা হলে যে বড় বিপদ হবে।”

“আপনি কোথায় থাকেন? আপনার বাড়ি নেই?” লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “কিছু মনে পড়ে না এখন। ছিল কোথাও, কোনওদিন।”

“আপনার মা নেই? বাবা নেই?”

লোকটা মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “না বাবা। কেউ নেই আর। শুধু আমি আছি।”

অবু কিছুক্ষণ লোকটার দিকে চেয়ে থাকে। লোকটার জন্য তার এত দুঃখ হতে থাকে যে, চোখে জল আসে। সে ধরা গলায় বলল, “আমাদের কাছে থাকবেন?”

লোকটা জুলজুল করে চেয়ে তাকে দেখে নিয়ে একটু হাসে, “আমাকে কোথায় রাখবে বাবা?”

“আমাদের বাড়িটা অনেক বড়। নীচের তলায় অনেক ঘর আছে, যেখানে কেউ কখনও ঢোকে না। তালাবন্ধ পড়ে থাকে। আমরা যদি সেখানে আপনাকে লুকিয়ে রাখি?”

লোকটা খুব হাসল, বলল, “তুমি বড় ভাল ছেলে। আচ্ছা, এখানে সদাশিব রায়ের বাড়ি কোথায় জানো?”

“না তো!”

“আমি তার বাড়িটা খুঁজছি। বড্ড দরকার।”

“ও নামে তো এখানে কেউ থাকে না।”

“অনেকদিনের কথা। কোথায় যে গেল তার বাড়িঘর!”

“আপনি আমাদের কাছে থাকুন। কোনও ভয় নেই। আমরা আপনাকে ধরিয়ে দেব না।”

লোকটা তেমনই সুন্দর করে হাসে, “পারবে লুকিয়ে রাখতে?” ঘাড় বেঁকিয়ে অবু বলে, “পারব। আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।”

নীচের তলায় দক্ষিণের দিকের ঘরে বিস্তর পুরনো জিনিসের ডাঁই। সেখানে কেউ কখনও ঢোকে না। ভাঙা চেয়ার, টেবিল, আলমারি, বাতিদান এইসব। অবু মাঝে-মাঝে এ-ঘরটায় ঢুকে বসে থাকে। বসে বসে আকাশপাতাল ভাবে।

অবু আগে দেখে নিল নীচের তলার পেছনের প্যাসেজে কেউ আছে কি না। কেউ অবশ্য এদিকে আসে না বড় একটা। তবু সাবধানের মার নেই। অবু চুপি-চুপি ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বাঁ ধারের দরজার ভেতরদিকে ঝোলানো চাবিটা বের করে এনে তালা খুলল।

তারপর দৌড়ে বাগানে এসে জাদুকর গজাননের হাত ধরে বলল, “আসুন।”

গজানন হাসল। তারপর ধীর পায়ে আসতে লাগল তার সঙ্গে। কিন্তু হেঁটে হেঁটে নয়, যেন ভেসে ভেসে। অনেক সময়ে মাটিতে পা স্পর্শ করছে না।

“আপনি কি ভেসে বেড়াতে পারেন?”

“আগে বায়ুবন্ধন করতাম। তাই থেকেই বোধ হয় এমন হয়েছে।”

ঘরে এনে সাবধানে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে অবু বলল, “আলো জ্বাললে বাইরে থেকে দেখা যাবে। অন্ধকারে কি আপনার অসুবিধে হবে?”

লোকটা বলল, “আমার আলো লাগে না তো! আমি সব দেখতে পাচ্ছি।”

“দেখতে পাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ। ওই তো, জানলার ধারে একটা আরামকেদারা, পাশে একটা গোল টেবিল। ঠিক বলেছি?”

অবু অবাক হয়ে বলে, “হ্যাঁ। একদম ঠিক। আপনি ওখানে বসে বিশ্রাম করুন। আমি রাতে আপনার খাবার নিয়ে আসব। এখন আমি পড়তে যাচ্ছি। মাস্টারমশাই বসে আছেন।”

“যাও বাবা।”

অবু বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চাবিটা প্যান্টের পকেটে পুরে ওপরে ছুটল।

আজ পড়াশোনায় তার একদম মন লাগছিল না। তিনটে অঙ্ক ভুল করে মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেল। ট্রানস্লেশন করতে গিয়ে যাচ্ছেতাই গণ্ডগোল হল। অবশেষে মাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পর হাঁফ ছাড়ল।

তারপর ভাইবোনদের ডেকে সে গোপন মিটিং করতে বসল। জাদুকর গজাননের কথা সব জানিয়ে সে বলল, “তোমরা যদি চাও তা হলে আমরা সবাই মিলে জাদুকর গজাননকে বাঁচাতে পারি। কিন্তু কেউ একজনও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না, বলে দিলাম। আমি তোমাদের সাহায্য চাই। যদি কারও অমত থাকে তা হলে আগেই বলে দাও, আমি জাদুকর গজাননকে চলে যেতে দেব।”

বিকু অবাক হয়ে বলে উঠল, “সে কী? আমি তো জাদুকর গজাননের দেখা পাওয়ার জন্য কবে থেকে বসে আছি। সত্যি বলছিস অবু?”

“হ্যাঁ দাদা, সত্যি। তা হলে তোমরা রাজি?”

সকলেই রাজি, শুধু বড়দি, পনেরো বছর বয়সী লীলা বলল, “কিন্তু লোকটা যদি চোর বা ডাকাত হয়?”

অবু মাথা নেড়ে বলল, “জাদুকর গজানন চোর বা ডাকাত যে নয় তা তোমরা তাঁকে দেখলেই বুঝতে পারবে।”

“তা হলে আমিও রাজি।”

“আমরা সবাই আমাদের খাবারের ভাগ নিয়ে গিয়ে ওঁকে খাওয়াব। আর পালা করে পাহারা দিতে হবে, যাতে হুট করে ওই ঘরের দিকে কেউ না যায়।”

সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে।” ছয় ভাইবোন চুপিসারে নীচে নেমে এল।

অবু দরজা খুলতে খুলতেই শুনতে পেল গজানন মৃদুস্বরে বলে যাচ্ছে, “সদাশিবের বাড়িটা যে কোথায় গেল! এখন তাকে কোথায় খুঁজে পাই?”

তারা ছয় ভাইবোন ঘরে ঢুকে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। সকলেরই বুক ঢিব ঢিব।

অন্ধকারে হঠাৎ দু’খানা চোখ ঝলসে উঠল, ভয় পেয়ে লীলা চেঁচিয়ে উঠেও মুখ চাপা দিল হাত দিয়ে।

গজানন খুব নরম গলায় বলল, ভয় কী খুকি? দুঃখী মানুষকে ভয় পেতে নেই। তোমরা আমার কাছে এসো।”

তারা জড়োসড়ো হয়ে আস্তে-আস্তে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বিকু বলল, “আপনি কি আমাদের দেখতে পাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ, পাচ্ছি।”

“বলুন তো আমি ফরসা না কালো!”

“তুমি খুব ফরসা। তোমার বাঁ গালে একটা তিল আছে। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কাটা দাগ।”

বিকু অবাক হয়ে বলল, “কী করে দেখতে পাচ্ছেন?”

“জানি না বাবা, তবে পাই।”

“আমাদের ম্যাজিক দেখাবেন না?”

“ম্যাজিক! সেই কবে দেখাতাম! ভুলেই গেছি প্রায়। অনেকদিন চর্চা নেই কিনা, তবে এই দ্যাখো একটা সোজা ম্যাজিক।”

বলতেই হঠাৎ একটা আগুনের শিখা জ্বলে উঠল। দেখা গেল জাদুকর গজাননের ডান হাতের তর্জনীটা মশালের মতো জ্বলছে।

পুতুল সবচেয়ে ছোট। সে ভয় পেয়ে বলে উঠল, “আঙুল পুড়ে যাবে যে! নিভিয়ে ফেলুন।”

“তোমরা আমাকে দেখতে এসেছ তো, এই আলোয় দেখে নাও।”

বিকু বলে, “আপনি সত্যিই শূন্যে ভেসে থাকতে পারেন?”

“হ্যাঁ বাবা, পারি, তবে আজকাল কেন যে আপনা থেকেই ভেসে ভেসে যাই কে জানে।”

ওপর থেকে ঠাকুমার ডাক শোনা গেল, “ওরে তোরা কোথায় গেলি এই রাতে? খেতে আয়!”

পুতুল বলল, “খুব খিদে পেয়েছে তো আপনার! চুপটি করে থাকুন। আমি একটু বাদে এসে আপনার খাবার দিয়ে যাব।”

একটু হেসে আঙুলের আগুন নিভিয়ে ফেলে গজানন বলল, “তোমরা বড্ড ভাল।”

বিকু বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না, এখানে কেউ আপনাকে খুঁজে পাবে না।”

ঘরে তালা লাগিয়ে সবাই ওপরে ছুটল খেতে।

খেতে বসে সবাই টপাটপ রুটি-তরকারি লুকিয়ে ফেলতে লাগল পকেটে বা জামার তলায়। রান্নার ঠাকুর সুদর্শন অবাক হয়ে বলল, “আজ দেখছি সকলেরই খোরাক বেড়ে গেছে। পুতুল অবধি সাতখানা রুটি নিয়েছে। কী ব্যাপার রে বাবা!”

সবাই একসঙ্গে গেলে বাড়ির লোকের সন্দেহ হবে বলে অবু আর পুতুল আঁচানোর সময় টুক করে নীচের তলায় নেমে এল। পুতুলের হাতে একটা বাটিতে গজাননের জন্য রুটি আর তরকারি। অবুর হাতে এক গ্লাস জল।

ঘরে ঢুকে তারা অবাক হয়ে দেখল, গজানন আরাম কেদারার ওপর শূন্যে ভেসে শুয়ে আছে। চোখ বোজা। জানলা দিয়ে জ্যোৎস্নার একটু আলো এসে পড়েছে তার মুখে। ঠোঁটে একটু হাসি। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে মুখোনা!

পুতুল আস্তে করে ডাকল, “তুমি কি ঘুমোচ্ছ গজাননদাদা?”

গজানন চোখ চেয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না। ঘুম কি আসে! চোখ বুজে পুরনো যত কথা ভাবছিলাম, কত কথা!”

“এই নাও, তোমার জন্য খাবার এনেছি।”

গজাননের মুখে একটা শিশুর মতো হাসি ফুটে উঠল, হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিয়ে বলল, “ওঃ কত খাবার! তোমরা বুঝি নিজেরা কম খেয়ে আমার জন্য নিয়ে এলে বাবা? কিন্তু আমি কি এত খেতে পারি?”

পুতুলের চোখ ছলছল করছে। সে ফিসফিস করে বলল, “খাও গজাননদাদা, তুমি যে বড্ড রোগা!”

গজানন একটুখানি খেল, বাকিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিয়ে যাও, কাককে দিও, কুকুরকে দিও, পিপঁডেকে দিও, ইঁদুরকে দিও, সবাইকে দিতে হয়, একা খেতে নেই।”

পা টিপে টিপে তারা যখন দোতলায় উঠল তখন বৈঠকখানায় কর্তাবাবা সিংহের মতো পায়চারি করছেন আর বলছেন, “এ তো মগের মুল্লুক হয়ে উঠল দেখছি! আজ কামানের গোলা ছুঁড়ে মেরেছে, কাল হয়তো অ্যাটম বোমাই ছুঁড়ে মারবে! কাল থেকে তোমরা সবাই মাথায় হেলমেট বা সোলার হ্যাঁট পরে বেরোবে আর ছাতা খুলে নিয়ে হাঁটাচলা করবে। আমার তো মনে হয় এ সেই গজাননেরই কাজ। বাড়িতে ঢুকবার তালে ছিল, না পেরে প্রতিশোধ নিচ্ছে।”

পুতুলের বাবা গন্ধর্বকুমার বলল, “না দাদু, তা বোধ হয় নয়। শুনেছি গজানন রোগাভোগা মানুষ। অত ভারী গোলা ছুঁড়ে মারার ক্ষমতা তার নেই। এটা যে ছুঁড়েছে সে পালোয়ান লোক।”

“পালোয়ান! এখানে আবার পালোয়ান কে আছে? থাকার মধ্যে তো আছে আমি আর সাতকড়ি। সাতকড়ি একসময়ে লোহার মোটা মোটা রড দু’হাতে পেঁচিয়ে ফেলত, ঘুসি মেরে কংক্রিটের চাঁই ভেঙে ফেলত, কিন্তু তারও তো বয়স হয়েছে রে বাপু। আর আছি এই আমি, শটপাটে বরাবর ফার্স্ট, দেহশ্রী প্রতিযোগিতায় তিনবারের গোল্ড মেডালিস্ট…”

গন্ধর্বকুমার মিনমিন করে বলল, “যে-ই তোক গজানন নয়, আমাদের মনে রাখা দরকার, গজানন ছিল আমাদের পূর্বপুরুষ সদাশিব রায়ের বন্ধু।”

“ধুস, ওই গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করো নাকি তুমি। ওরে বাপু, মানছি, সদাশিব রায় আর গজাননে গলাগলি ছিল, তা বলে গজানন কি আর দুশো বছর বেঁচে আছে? তুমি না সায়েন্সের লোক?”

“আগে বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এখন কেমন যেন একটু সন্দেহ হচ্ছে।”

“গুলি মারো সন্দেহে। গজানন বলে যে লোকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে সে একটা জোচ্চোর, ইমপস্টার।“

পুতুলের চোখ বড় বড় হয়ে গেল, সে ফিসফিস করে বলল, “এই সেজদা শুনছিস কী বলল?”

অবু মন দিয়ে শুনছিল, বলল, “শুনেছি।”

“তা হলে সদাশিব রায় আমাদের পূর্বপুরুষ!”

“হ্যাঁ, আর গজাননদাদা সবাশিব রায়ের বাড়িই খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

“তা হলে কি আমাদের বাড়িটাই খুঁজছে?”

“বাঃ, আমরা সদাশিব রায়ের বংশধর না? এই বাড়িই তো খুঁজবে।”

“চল সেজদা, খবরটা গজাননদাদাকে দিয়ে আসি।” দু’জনে দৌড়ে নীচে নেমে হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকল। পুতুল ডাকল, “গজাননদাদা! ও গজাননদাদা! কোথায় তুমি?” সিলিঙের কাছ থেকে গজাননের জবাব এল, “এই যে বাবা আমি। নীচে বড় পিঁপড়ে কামড়াচ্ছিল বলে একটু ওপরে এসে শুয়ে আছি।”

“তোমাকে একটা খবর দিতে এলাম। শোনো, এটাই সদাশিব রায়ের বাড়ি।”

“অ্যাঁ!” বলে ধীরে ধীরে গজানন নেমে এল, সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে একটু হেলেদুলে গেল।

“হ্যাঁ গো, এইমাত্র জানতে পারলাম সদাশিব রায় আমাদেরই পূর্বপুরুষ।”

গজাননের সমস্ত মুখটাই এমন আলো হয়ে গেল যে, অন্ধকারেও তাকে স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল, মুখে শিশুর মতো সেই হাসি৷ মাথা নেড়ে বলল, “এই বাড়ি! এই সদাশিবের বাড়ি? তোমরা সব সদাশিবের বংশধর?”

“হ্যাঁ গো গজাননদাদা!”

“আমারও সন্দেহ ছিল, এই বাড়িই হবে। রায়বাড়ি তো এখানে একটাই। কিন্তু সদাশিবের বাড়ি তো মাঠকোঠা ছিল তাই ধন্দ লাগছিল। একবার ঝড়বৃষ্টির রাতে সদাশিব আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। বড্ড ভাল লোক ছিল সে। আর সেজন্যই তোমরাও এত ভাল।”

“কিন্তু তুমি সদাশিবের বাড়ি খুঁজছিলে কেন?”

“বড্ড দরকার। তার কাছে যে আমার ডিবেটা ছিল।”

“কীসের ডিবে?”

“একটা ছোট্ট সোনার কৌটো, তার মধ্যে আমার নস্যি আছে।”

“নস্যি! এ মা, তুমি নস্যি নাও?”

“সে ঠিক নস্যি নয় গো বাবারা। সেটা একটা জড়িবুটি। ওইটে পাচ্ছি না বলে আমার কিছু মনে পড়ে না, খিদে পায় না, দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছি। ওই জড়িবুটি না হলে এখন যদি কেউ আমাকে কেটে ফেলে তা হলে আর জোড়াও লাগব না যে!”

অবু একটু বিস্মিত হয়ে বলে, “তোমার বয়স কত গজাননদাদা?”

“অনেক গো, অনেক, হিসেব নেই।”

অবু বলে, “এটা সদাশিবের বংশধরদের বাড়ি বটে, কিন্তু তোমার ডিবেটা এখনও আছে কি না তা আমরা জানি না, তুমি এই ঘরে যেমন আছ তেমনই লুকিয়ে থাকো, আমরা ভাইবোনেরা মিলে ঠিক তোমার কৌটো খুঁজে বের করব।”

খুব হাসল গজানন, মাথা নেড়ে বলল, “বড্ড ভাল হয় তা হলে, তোমরা যে বড্ড ভাল।”

“তা হলে তুমি এখন ঘুমোও!”

“হ্যাঁ বাবারা, আজ বুকটা ঠাণ্ডা হয়েছে। সদাশিবের বাড়ি খুঁজে পেয়েছি। আজ আমার ঘুম হবে।”

দুই ভাইবোন আবার চুপিসারে ওপরে উঠে এসে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল।