৫. পঞ্চম গল্প

পঞ্চম গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–স্বদেশী কোম্পানী

ডমরুধরের প্রথম উপাখ্যানে চিত্রগুপ্ত, যম, যমনী, পুইশাক, এলোকেশী, এলোকেশীর মাতা প্রভৃতির বিষয় বর্ণিত হইয়াছিল। এলোকেশী ডমরুধরের তৃতীয় পক্ষের পত্নী। সেই উপাখ্যান পাঠের ফল এইরূপ,–

ডমরুচরিত পড় রে ভাই করে একান্ত ভক্তি।
ইহকালে পাবে সুখ পরকালে মুক্তি।।
চিত্রগুপ্তর গলায় দড়ি যমনী বাজায় শাঁক।
পুইশাকের নামে যমের সিঁটকে উঠলো নাক।।
ঝক মক করে সোনার গহনা এলোকেশীব গায়!
আড়নয়নে শাশুড়ী ঠাকরুন পিটির পিটির চায়।।
পয়সা দিয়া ডমরুচরিত কিনে রাখ ঘরে।
ধৰ্ম্ম অর্থ কাম মোক পাবে ইহার বরে।।

বর্তমান ডমরু উপাখ্যানের ফলও সেইরূপ, বরং অধিক।

প্রতিবৎসর পূজার সময় ডমরুধর বন্ধুবান্ধবের সহিত নানারূপ গল্প করেন। পঞ্চমীর দিন বৈকালে তাঁহার পূজার দালানে লম্বোদর, গজানন, হলধর প্রভৃতি বন্ধুবান্ধবের সহিত প্রতিমার নিকট তিনি বসিয়া আছেন। ডমরুধরের মুখের দিকে চাহিয়া লম্বোদর বলিলেন,–একবার পুনরায় স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া তুমি অনেকগুলি টাকা উপার্জন করিয়াছ।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–হাঁ ভাই! স্বদেশী কোম্পানী বৃথা যায় না। কিছু না কিছু দিয়া যায়। কিন্তু ভাই, সম্প্রতি আমি এক ঘোর বিপদে পড়িয়াছিলাম। সে বিপদ হইতে মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিয়াছেন। আমার প্রতি মায়ের অসীম কৃপা। বলিতে গেলে আমি মা দুর্গার বরপুত্র।–সধোদর বলিলেন,—সেবার স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া তুমি অনেক বাড়ী ভুড়ি গরীব দুঃখীর টাকা হাম করিয়াছিলে। একবার মোকদ্দমা হইয়াছিল জানি। কি হইয়াছিল বল দেখি!

ডমরুর উত্তর করিলেন,–মোকদ্দমা স্বদেশী কোম্পানীর প্রধান অঙ্গ। স্বদেশী কোম্পানী খুলিলে সকলকেই মামলা-মোকদ্দমা করিতে হয়। যাহা হউক, এখন সব চুকিয়া গিয়াছে। এই নূতন স্বদেশী কোম্পানীর বৃত্তান্ত এখন আমি তোমাদিগকে বলিতে পারি, শুন।

ডমরুধর এইরূপ বলিতে লাগিলেন,–

গত বৎসর পূজার পর একদিন বেলা দশটার সময় আমি বাহিরে বসিয়া আছি, এমন সময় ব্যাগ হাতে করিয়া এক ছোকরা আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহার বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ বৎসর। রং অল্প গৌরবর্ণ। কালো গোঁপ আছে। দেখিতে সুশ্রী। ভদ্রলোকের ছেলে বলিয়া বোধ হইল।

ব্যাগ হইতে চারিটি শিশি সে বাহির করিয়া বলিল,–এইটি ম্যালেরিয়া জ্বরের আরক, এইটি অজীর্ণ বোগের ঔষধ, এইটি বহুমূত্র রোগের ব্রহ্মাস্ত্র; আর এইটি মুখে মাখিলে রং ফরসা হয়। প্রতি শিশির মূল্য একটাকা আমাকে প্রদান করুন।

আমি বলিলাম,—ঔষধে আমার প্রয়োজন নাই। তুমি বোকা লোকদিগের নিকট গমন কর। তোমার একটিও ঔষধ আমি ক্রয় করিব না।

আমার কথা শুনিয়া সে চলিয়া গেল না। অতি সুমিষ্ট স্বরে সে ঔষধের গুণ ব্যাখ্যা করিতে লাগিল। সে বলিল,–আমি তিনটা পাস দিয়াছি। যে বিদ্যা শিখিলে নানা পদার্থ মিশাইয়া উত্তম উত্তম নূতন বস্তু প্রস্তুত করিতে পারা যায়, আমি সেই বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছি। সেই বিদ্যাবলে আমি এইসব ঔষধ প্রস্তুত করিয়াছি! ইহাদের গুণ অলৌকিক। দিন কয়েক ব্যবহার করিলেই আপনার শরীরে কান্তি ফুটিয়া পড়িবে। আপনি নব-যৌবন প্রাপ্ত হইবেন।

উত্তর করিলাম,–আমার ম্যালেরিয়া জ্বর নাই, অজীর্ণ ও বহুমূত্র রোগ নাই। আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, রং ফরসা হইবার সাধ নাই। তাহা ব্যতীত আমি বৃথা একটি পয়সাও খরচ করি না। তোমার ঔষধ আমি ক্রয় করিব না।।

আমাদের দুইজনে এইরূপ তর্ক-বিতর্ক হইতে লাগিল। কিন্তু সে ছোকরা নাছোড়বান্দা। এমনি সুমিষ্ট ভাষায় সে বক্তৃতা করিতে লাগিল যে, ক্রমে আমার মন ভিজিয়া আসিল। অবশেষে সে বলিল,–আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন সত্য, কিন্তু মন আপনার বৃদ্ধ হয় নাই। মনটি আপনার নবযৌবনে ঢল ঢল করিতেছে। আর কোন ঔষধ লউন আর নাই লউন, আপনাকে এই রং ফরসা হইবার ঔষধটি লইতে হইবে। দিনকতক মুখে মাখিয়া দেখুন। আপনি ফুট গৌরবর্ণ হইয়া পড়িবেন। সুন্দর সুকুমার কুড়ি বৎসরের যুবক হইবেন।

ছোটবেলা হইতে ফরসা হইবার আমার সাধ ছিল। অনেক সাবাং মাখিয়াছিলাম। কিছুতে কিছু হয় নাই। মনে মনে ভাবিলাম,–এই ঔষধটা পরীক্ষা করিয়া দেখি না কেন? যদি আমার রং ফরসা হয়, তাহা দুর্লভী বাগদিনী আমার রূপ দেখিয়া মোহিত হইবে।

শিশির মূল্য একটাকা কিন্তু সে আমাকে আট আনায় দিল। মূল্য লইয়া সে কিছুর গিয়াছে এমন সময় আমার মনে এইরূপ চিন্তার উদয় হইল। আমি ডমরুর। সুমিষ্ট বক্তৃতা করিয়া আমাকে ঠকাইয়া এ আট আনা লইয়া গেল। এ সামান্য ছোকরা নয়। ইহা দ্বারা কি কোনরূপ কাজ করিতে পারা যায় না?

এইরূপ ভাবিয়া আমি তাঁহাকে ডাকিলাম। আদর করিয়া আমার নিকট বসাইলাম। আমি বলিলাম,—বাপু! তোমার নাম কি?

সে উত্তর করিল,–আমার নাম শঙ্কর ঘোষ।

তাঁহার বাড়ী কোথায়, সে কি কাজ করে, প্রভৃতি তাহার পরিচয় গ্রহণ করিলাম,–তুমি তিনটা পাস দিয়াছ। পাঁচ দ্রব্য মিশাইয়া নূতন বস্তু প্রস্তুত করতে পার। ঔষধ বেচিয়া কি হইবে? কোন একটা লাভের বস্তু প্রস্তুত করিতে পার না?

কিছুক্ষণ নীরবে সে চিন্তা করিয়া আমাকে বলিল,–কল্য আসিয়া আপনার এ কথার উত্তর দিব।

পরদিন সে ধবধবে চিকণ কাগজ আনিয়া আমাকে দেখাইল। সে বলিল,–এঁটেল মাটী হইতে আমি এই কাগজ প্রস্তুত করিয়াছি। এক টাকার এঁটেল মাটী হইতে দশ দশ টাকার কাগজ হইবে। নয় টাকা লাভ থাকিবে। প্রথম প্রথম যাহা অল্প খরচ হইবে, তাহা যদি আপনি প্রদান করেন তাহা হইলে আমরা এক স্বদেশী কোম্পানী খুলিব। লাভ অর্ধেক আপনার অর্ধেক আমার।

এঁটেল মাটী ও কাগজ দেখিয়া আমি মনে মনে একটু হাসলাম। স্বদেশী কোম্পানী সম্বন্ধে আমার একটু অভিজ্ঞতা আছে। ভাবিলাম যে এ কাজ হালাগুলো বাঙ্গালীর উপযুক্ত বটে। তাঁহার প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম।

চারি পাঁচ দিন পরে আমরা দুইজনে কলিকাতা গমন করিলাম। ভালরূপ একটা স্বদেশী কোম্পানী খুলিতে হইলে দুই-চারিজন বড়লোকের নাম আবশ্যক। আমরা তাঁহার যোগাড় করিলাম। একটি মিটিং হইল। এঁটেল মাটি ও কাগজের নমুনা দেখিয়া বড়লোকেরা ঘোতর আশ্চর্য হইলেন। তাহাদের মধ্যে কেবল একজন বলিলেন,–এঁটেল মাটী দিয়া কাগজ প্রস্তুত হইতে পারে, তাহা আমি জানিতাম না। আমি মনে করিতাম যে, খড়িমাটী দিয়া কাগজ প্রস্তুত হয়।

শঙ্কর ঘোষ উত্তর করিলেন-খড়িমাটী দিয়া হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে খরচ অধিক পড়ে।

কাগজ সম্বন্ধে ইহার এইরূপ গভীর জ্ঞান দেখিয়া অন্য সকলে তাঁহার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

সেই যাহারা ইংরেজীতে বক্তৃতা করেন, যাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া স্কুল কলেজের ছোঁড়াগুলো আনন্দে হাততালি দিয়া গগন ফাটাইয়া দেয়, আমরা সেইরূপ দুইজন বক্তার যোগাড় করিয়াছিলাম। তাঁহারা ইজের দিয়া কোমর আঁটিয়া রাখেন। তাহাদের একজন বক্তৃতা করিলেন—

আমাদের কোম্পানীর নাম হইল,–গ্র্যাণ্ড স্বদেশী কোম্পানী লিমিটেড। কয়েকজন বড়লোক ও উগ্র বক্তা ডাইরেক্টর বা পরিচালক হইলেন। কারণ, এই সকল বড়লোক ও বক্তারা সকল প্রকার কারুকার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে ধুরন্ধর। ইহারা নাম জানেন না, এমন বিষয় নাই। শঙ্কর ঘোষ ইংরাজী ও বাঙ্গলায় কোম্পানীর বিবরণ প্রদান করিয়া কাগজ ছাপাইলেন ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচার করিলেন। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, যে ব্যক্তি একশত টাকার শেয়ার বা অংশ কিনিবে, প্রতিমাসে লাভস্বরূপ তাঁহাকে পঁচিশ টাকা প্রদান করা হইবে।

দেশে ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। সকলে বলিতে লাগিল যে, আর আমাদের ভাবনা নাই। যখন এটেল মাটী হইতে কাগজ প্রস্তুত হইবে, তখন বালী হইতে কাপড় হইবে। বিদেশ হইতে কোন দ্রব্য আর আমাদিগকে আমদানি করিতে হইবে না। দেশ টাকায় পূর্ণ হইয়া যাইবে। এই কথা বলিয়া কলিকাতায় বাঙ্গালীরা একদিন সন্ধ্যাবেলা আপন আপন ঘর আলোকমালায় আলোকিত করিল।

প্রথম প্রথম শত শত লোক শেয়ার কিনিতে লাগিল। হুড় হুড় করিয়া টাকা আসিতে লাগিল। আমি কোষাধ্যক্ষ ছিলাম। টাকা সব আমার কাছে আসিতে লাগিল।

কয়েক মাস গত হইয়া গেল। এঁটেল মাটী দিয়া শঙ্কর ঘোষ একখানিও কাগজ প্রস্তুত করিলেন না। মাসে যে পঁচিশ টাকা লাভ দিবার কথা ছিল, তাঁহার একটি পয়সাও কেহ পাইল না। আসল টাকার মুখও কেহ দেখিতে পাইল না। জনকয়েক আমাদের নামে নালিশ করিল। শঙ্কর ঘোষ চমৎকার এক হিসাবের বহি প্ৰস্তুত করিয়া কাছারিতে দাখিল করিলেন। লাভ দূরে থাকুক, হিসাবে লোকসান প্রদর্শিত হইল। কোম্পানী লিমিটেড ছিল। মোকদ্দমা ফাস হইয়া গেল। আমাদের কাহারও গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগিল না।

অনেকগুলি টাকা লোকে দিয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, সে টাকাগুলি সমুদয় আমি লইলাম। শঙ্কর ঘোষ ভাগ চাহিল। আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলাম,–হিসাবের বহি তুমি নিজে হাতে প্রস্তুত করিয়াছ। তাহাতে তুমি লিখিয়াছ যে, লোকসান হইয়াছে। কোম্পানী ফেল হইয়া গিয়াছে। টাকা আর কোথা হইতে আসিবে। বরং যাহা লোকসান হইয়াছে, তাহা আমাকে দিয়া যাও।।

আমার কথা শুনিয়া শঙ্কর ঘোষ ঘোরতর রাগান্বিত হইল। তুমি আমাকে ফাকি দিলে; তোমাকে আমি দেখিয়া লইব,—আমাকে এইরপ ভয় দেখাইয়া সে চলিয়া গেল। আমার দ্বিতীয় কোম্পানীর বৃত্তান্ত এই।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–তুমি বলিলে যে সম্প্রতি বড় বিপদে পড়িয়াছিলে। আমরা পাড়ায় থাকি। কোন বিপদের কথা আমরা তো শুনি নাই।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–সে বিপদের কথা আজ পর্যন্ত আমি কাহারও নিকট প্রকাশ করি নাই। আজ তাহা তোমাদিগকে বলিতেছি শুন।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–ভিকু ডাক্তার

ডমরুর বলিতে লাগিলেন,—ফাঁকতালে অনেকগুলি টাকা লাভ করিয়া মন আমার প্রফুল্ল হইল। শরীরটি নাদুসনুদুস নধর হইয়া উঠিল। আমি মনে করিলাম দুর্লভীকে দেখাইয়া আসি। সেবার এই বাগদিনী সম্বন্ধে কি হইয়াছিল, তাহা তোমাদিগকে বলিয়াছি। সুন্দরবনের আবাদ হইতে আমি বাটী ফিরিয়া আসিতেছিলাম। পথে এক বেটা সাঁওতাল আমার কাপড় কাড়িয়া লইয়া আমাকে উলঙ্গ করিয়া ছাড়িয়া দিল। কোন স্থানে একদল বেদিয়া তাবু ফেলিয়াছিল। তাহাদের ছোট একটি লাল ঘাঘরা বেড়ায় শুকাইতেছিল। সেই ঘাঘরা চুরি করিয়া আমি পরিধান করিলাম। আমি মনে করিলাম যে, সন্ধ্যা পর্যন্ত দুলাভীর ঘরে লুকাইয়া থাকি। তাঁহার ঘরে যেই প্রবেশ করিয়াছি, আর কেষ্টা ছোঁড়ার বাপ আসিয়া দ্বারে শিকল দিয়া দিল। কেষ্টা গ্রামের লোককে ডাকিয়া আনিয়া, আমাকে দেখাইল। রাঙা ঘাঘরা পরিয়া পোড়ার মুখে ডেকরা বুড়ো আমার মন ভুলাইতে আসিয়াছে,—এইরূপ গালি দিয়া দুর্লভী আমাকে অনেক ভৎসনা করিল। তাহার পর এলোকেশী আসিয়া আমাকে ঝটার দ্বারা প্রহার করিলেন। এ সব কথা তোমাদিগকে আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি।

সেই অবধি দুর্লভী আমার সহিত কথা কয় না। পথে মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যায়। যখন কন্দর্প পুরুষের ন্যায় আমার নাদুসনুদুস নধর শরীর হইল, তখন আমি মনে করিলাম যে, চুপি চুপি দুর্লভীকে আনি,—যেন এলোকেশী জানিতে না পারেন।

দুর্লভীর ঘরে গিয়া দেখিলাম যে, সে কয়দিন জ্বরে পড়িয়া আছে। তাঁহার বোনঝির নাম চঞ্চলা। পাঁচ ক্রোশ দূরে ঝিঝিরডাঙ্গা নামক গ্রামে তাদের বাস। সে বিধবা। বয়স প্রায় ত্রিশ। রং কালো বটে, কিন্তু দেখিতে মন্দ নহে। আমি মনে করিলাম,ইহার সহিত ভাব করিতে হইবে। তাহা করিলে দুর্লভীর হিংসা হইবে। আমার উপর আর তাঁহার রাগ থাকিবে না। রং ফরসা হইবার জন্য শঙ্কর ঘোষ আমাকে যে ঔষধ বিক্রয় করিয়াছিল, তাহা আমি ব্যবহার করি নাই। সেই ঔষধ দুর্লভীকে আমি খাইতে দিলাম। তাহা খাইয়া দুর্লভীর পেট চাড়িয়া দিল, দুর্লভী মৃতপ্রায় হইল। গ্রামের সকলে আমাকে ছি ছি করিতে লাগিল। পুলিশে সংবাদ দিবে বলিয়া কেষ্টর বাপ আমাকে ভয় দেখাইল।

চঞ্চলা বলিল যে, তাহাদের গ্রামে ভিক্ষু ডাক্তার নামক এক ভাল চিকিৎসক আছেন, তাঁহাকে আনিলে তাঁহার মাসী ভাল হইবে। আমার ঔষধ খাইয়া দুর্লভীর প্রাণ যাইতে বসিয়াছে, সেজন্য ভয়ে আমি খরচ দিতে সম্মত হইলাম। ব্যাগ হাতে করিয়া পাঁচ ক্রোশ দূরে ঝিঝিরডাঙ্গা হইতে ভিক্ষু ডাক্তার পদব্রজে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইনি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রদান করেন।

শুনিলাম যে ভিকু কলিকাতায় কোন ডাক্তারখানায় ছয় মাস কম্পাউন্ডারি করিয়াছিলেন। একবার কোন রোগীকে কৃমির ঔষধের পরিবর্তে কুচিলা বিষ প্রদান করিয়াছিলেন। রোগীর তাহাতে মৃত্যু হইয়াছিল। সেজন্য ভিকুর ছয় মাস কারাবাস হইয়াছিল। এইরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া ভিকু এখন স্বগ্রামে আসিয়া ডাক্তার হইয়াছেন।

ভিকুর বয়স চল্লিশের অধিক। শরীর কাহিল। রং ময়লা, তবে কালো নহে। সচরাচর হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের বিশেষতঃ হাতুড়েদের যেরূপ হয়, ভিকুর মুখ দিয়াও সেইরূপ চড়চড় করিয়া কথার যেন খৈই ফুটিতে থাকে। দুর্লভীকে দেখিয়া ভিকু বলিলেন,–কোন ভয় নাই, সরিষাপ্রমাণ এক বড়িতে ইহাকে আমি ভাল করিব। এ বা কি করিব! আমি কত অসাধ্য রোগ ভাল করিয়াছি। কত মরা মানুষকে জীবন প্রদান করিয়াছি।

এইরূপ ভূমিকা করিয়া ভিকু নিজের বিদ্যার পরিচয় দিতে আরম্ভ করিলেন। ভিকু বলিলেন,–নেহালা গ্রামের ত্রিলোচন সরকেলের পেট ক্রমে ক্রমে ফুলিতে লাগিল; পেট ফুলিয়া ক্ৰমে জালার মত হইল। কত ডাক্তার কত বৈদ্য আসিল। কেহ বলিল উদরী, কেহ বলিল টিউমার। কত ঔষধ তিনি খাইলেন। কিছুতে কিছু হইল না। অবশেষে তাঁহার লোকেরা আমাকে লইয়া গেল। আমি অনেকক্ষণ ধরিয়া বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া তাঁহার পেটটি দেখিলাম। অবশেষে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা কবিলাম, তোমাদের ঘরে মাছ ধরিবার সূতা বঁড়শী আছে? বঁড়শীতে হোমিওপ্যাথিক গুলির টোপ করিয়া সূতার সহিত রোগীকে গিলিতে বলিলাম। মুখের বাহিরে সূতাটির অপর দিক ধবিয়া আমি একদৃষ্টে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। সূতা যেই একটু নডিয়া উঠিল, আর সেই সময় আমি টান মারিলাম। বলিব কি মহাশয়! ধামার মত প্রকাণ্ড একটা কচ্ছপ তাঁহার পেট হইতে আমি বাহির করিলাম! জলের সহিত সামান্য শিশু-কচ্ছপ সরকেলমহাশয় ভক্ষণ কবিয়াছিলেন। উদরে সেই কচ্ছপ ক্রমে বড় হইয়া তাঁহার জীবন সংশয় কবিয়াছিল। আমার চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হইলেন।

আর একবার রাত্রি দুপ্রহরেব সময় আমি ঝিল গ্রামের শ্মশানঘাটের নিকট দিয়া যাইতেছিলাম। দেখিলাম যে, সে স্থানে কয়েকটি ভূত কেহ দাঁড়াইয়া কেহ বসিয়া কমিটি করিতেছে। আমি একটু দূরে বসিয়া ব্যাগ হইতে হোমিওপ্যাথিক পুস্তক বাহির কবিলাম। দিয়াশলাই জ্বালিয়া তাঁহার আললাকে ভূতেব ঔষধ দেখিলাম। তাহার পর যেই ঔষধের শিশি বাহির করিয়াছি, আর তাঁহার গন্ধ পাইয়াই ভূতেরা রুদ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। একটু বিলম্ব করিলে আমার ঔষধের গুণে তাঁহারা ভস্ম হইয়া যাইত। ভূতের ছাই হিষ্টিরিয়া রোগের চমৎকার ঔষধ আমি প্রস্তুত করিতে পারিতাম।

ভিকু ডাক্তার আরও বলিলেন যে,–ভূতগণ যখন পলায়ন করিল, তখন আমি সেই স্থানে গিয়া দেখিলাম যে, তাঁহারা এক মড়া ভক্ষণ করিতেছিল। মড়ার হাত-পা সর্ব্ব শরীর তাঁহারা খাইয়া ফেলিয়াছিল, কেবল মুখটি অবশিষ্ট ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ দুইটি হোমিওপাথিক ঔষধের গুলি বাহির করিয়া তাঁহার মুখে দিলাম। মুখে গুলি দিবামাত্র সে চাহিয়া দেখিল, তাহার পর আশ্চর্য কথা কি বলিব মহাশয়। আমার ঔষধের গুণে তাঁহার শরীর গজাইতে লাগিল। প্রথম গলা হইল, তাহার পর বক্ষঃস্থল হইল, তাহার পর উদর হইল, তাহার পর হাত-পা হইল। সে উঠিয়া বসিল। তখন আমি বুঝিলাম যে, সে হিন্দুস্তানী, বাঙ্গালী নহে। সে বাত্রি আমি তাঁহাকে আমার বাটিতে অইয়া যাইলাম। পরদিন সে আপনার দেশে চলিয়া গেল। এখানে থাকিলে আপনাদিগকে দেখাইতাম। হোমিওপ্যাথিক ঔষধের গুণ আছে বটে, কিন্তু ঠিক ঔষধটি ধরা বড় কঠিন। অনেক দেখিয়া-শুনিয়া আমার বিষয়ে জ্ঞান হইয়াছে। রোগীর চেহারা দেখিলেই আমি ঠিক ঔষধ করিতে পারি। আমার হাতে একটিও রোগী মারা পড়ে না। সেজন্য কলিকাতার হোমরাচোমরা ডাক্তারগণ, যাঁহারা যোলো টাকা বত্রিশ টাকা ভিজিট গ্রহণ করেন তাঁহারা যখন হালে পানি পান না, তখন তাঁহারা বলেন, ঝিঝিরডাঙ্গার ভিকু ডাক্তারকে লইয়া এস, তিনি নাই হইলে এ রোগের ঔষধ কেহ ঠিক করিতে পারিবে না। সেজন্য মাঝে মাঝে আমাকে কলিকাতায় যাইতে হয়।

ভিকু পুনরায় বলিলেন,–আমি আর একটি চমৎকার ঔষধ বাহির করিয়াছি। যে ঔষধে প্রজাপতি দক্ষের গলায় ছাগলের মুণ্ডু জোড়া লাগিয়াছিল, ইহা সেই ঔষধ। হাতপা এমন কি মানুষের মাথা কাটিয়া দুইখানা হইয়া গেলেও, আমি এক বড়িতে পুনরায় জুড়িয়া দিতে পারি।

ভিকু নানারূপ গল্প করিলেন। অবাক হইয়া সকলে তাঁহারা গল্প শুনিতে লাগিল। সকলে মনে করিল যে, ইহার তুল্য বিচক্ষণ ডাক্তার জগতে নাই।

দুর্লভীর চিকিৎসার জন্য আমি তাঁহাকে এক টাকা দিতে চাহিলাম। কিন্তু প্রথমে কিছুতেই তাহা লইবেন না। তিনি বলিলেন,–আমি পাঁচ ক্রোশ পথ হইতে আসিয়াছি। চারি টাকা লইব।

অনেক কচলাকচলির পর আমি বলিলাম যে,—আপাততঃ আপনি এক টাকা লউন, রোগী ভাল হইলে পরে আর তিন টাকা দিব।

এ প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তিনি এক টাকা লইয়া প্রস্থান করিলেন। দুর্লভী ভাল হইল। কিন্তু তাহার পর ডাক্তারকে ঘোড়ার ডিম! রোগ ভাল হইলে অনেকেই ডাক্তার বৈদ্যকে

কলা দেখায়।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–চঞ্চলার গাই গরু

দুর্লভী ভাল হইলে চঞ্চলা আপনার গ্রামে চলিয়া গেল। কিন্তু চঞ্চলার সহিত সদ্ভাব করিতে আমার বাসনা হইয়াছিল। তাহাদের গ্রাম অনেক দূর। সর্ব্বদা আমি যাইতে পারিতাম না। কেবল মাঝে মাঝে যাইতাম। সেই গ্রামের পাশ দিয়া বড় রাস্তা গিয়াছে। তাঁহার উপর দিয়া গরুর গাড়ী সর্ব্বদা যায়। দুই চারিটা পয়সা দিয়া তাঁহার উপর বসিয়া কখন কখন কতক দূর যাইতাম। ফিরতি ঘোড়ার গাড়ীতেও দুই একবার গিয়াছিলাম। এ পথে দুই তিনবার মোটর গাড়ী দেখিয়াছিলাম। স্বদেশী কোম্পানী স্থাপনের সময় বড়লোকদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত শঙ্কর ঘোষ মোটর গাড়ি ভাড়া করিয়াছিলেন। সেই সময় আমি মোটর গাড়ি চড়িয়াছিলাম। কিন্তু অতি বেগে গমন করে। আমার ভয় হইয়াছিল। মোটর গাড়ি টানিবার নিমিত্ত ঘোড়া থাকে না। তবে ইহার ভিতর কোনরূপ বিলাতী জন্তু জানোয়ার থাকে কি না, তাহা আমি জানি না।

মাঝে মাঝে চঞ্চলাদের গ্রামে গিয়া তাহাদের দাওয়ার আমি বসিতাম। চঞ্চলার মা নাই, কেবল বাপ আছে। তাঁহার নাম সহদেব বাণী! সহদেব মজুরি করে। চঞ্চলার একটি গাই গরু আছে। তাঁহার দুধ সে বিক্রয় করে।।

চঞ্চলার দাওয়াতে বসিয়া আমি গল্প-গাছা করিতাম। কখন কখন দুই একটা রসের কথাও বলিতাম। তখন হাসিয়া সে লুটিপুটি হইত। পাড়ার মাগীদের সে ডাকিয়া আনিত। আমার দিকে চক্ষু ঠারিয়া সকলে লুটিপুটি হইত। আমাকে দেখিয়া লোকের আনন্দ হয়। আমার রূপ দেখিয়া তাঁহার মন ভুলিয়া যায়। মাগীগুলা আমার গায়ে যেন ঢলিয়া পড়ে।

চঞ্চলাকে দশ পয়সা দিয়া একখানি গামছা কিনিয়া দিলাম। গামছা পাইয়া তাঁহার আহ্লাদ হইয়াছিল, আমি মনে ভাবিলাম,দুর্লভী একবার এই কথা শুনিলে হয়। তাহা হইলে লে আর মুখ হাঁড় করিয়া থাকিবে না। লম্বোদর। এইবার ভাই সেই ঘোর দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল। এইবার সেই গ্রামে আমাকে প্রায় একমাস কয়েদ থাকিতে হইয়াছিল।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–সে কবে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–আজ পঞ্চমী, ইহার তিনটা পঞ্চমী আগে, প্রায় দুই মাসের কথা। লম্বোদর বলিলেন,–সে কি করিয়া হইবে। তুমি বলিতেছ যে দুই মাস পূর্ব্বে দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল। তাহার পর এক মাস তুমি সেই গ্রামে কয়েদ হইয়াছিলে। কিন্তু গত ছয় মাস ধরিয়া তুমি কোন স্থানে গমন কর নাই। এই ছয়মাস প্রতিদিন তোমাকে আমরা দেখিয়াছি।

ডমরুধর উত্তর করিলেন,–সকলই জগদম্বার মায়া! তাঁহার মায়াতে তোমরা আচ্ছন্ন হইয়াছিলে।–লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—দুর্ঘটনাটা কি?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—তাহা বলিতেছি শুন।

***

প্রায় দুই মাসের কথা হইল। একদিন রাত্রিতে আমি ঘরে শুইয়াছিলাম। শেষ রাত্রিতে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। আর নিদ্রা হইল না। এপাশ ওপাশ করিতে লাগিলাম। চঞ্চলার জন্য একখানি নয়হাতি কাপড় কিনিয়াছিলাম। মনে করিলাম, বিছানায় বৃথা পড়িয়া থাকিব না। কাপড়খানি তাঁহাকে দিয়া আসি। এলোকেশীর ভয়ে কাপড়খানি একস্থানে লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। কাপড়খানি লইয়া চঞ্চলাদের গ্রাম অভিমুখে আমি হাঁটিয়া চলিলাম। যাইতে যাইতে সকাল হইয়া গেল। সূর্যোদয়ের পরে বড় রাস্তায় গিয়া উঠিলাম। বেলা প্রায় নয়টার সময় চঞ্চলাদের গ্রামের নিকট উপস্থিত হইলাম। চঞ্চলার পিতা সহদেবের সহিত বড় রাস্তায় সাক্ষাৎ হইল। চঞ্চলার গাই গরুর দড়ি ধরিয়া বড় রাস্তার উপর দিয়া সে তাঁহাকে মাঠে লইয়া যাইতেছিল। তাঁহার সহিত কথা কহিতে কহিতে আমি কিছুর চলিলাম, অন্যমনস্ক হইয়া আমরা যে দুইজন যাইতেছি, পশ্চাতে যে ভো ভো শব্দ হইয়াছিল, তাঁহার কিছুই শুনিতে পাই নাই। সহসা পশ্চাৎ হইতে এক মোটর গাড়ি আমার উপর আসিয়া পড়িল। গাড়ির চাকায় আমার কোমর পর্যন্ত কাটিয়া দুইখানা হইয়া আমার দুইটা কাটা-পা গাড়ির চাকায় কিরূপে আটকাইয়া গেল। কোমর হইতে আমার পা দুইটি লইয়া মোটর গাড়ি অতি দ্রুতবেগে পলায়ন করিল।

লম্বোদর প্রভৃতি সকলে শিহরিয়া উঠিলেন। সকলে বলিয়া উঠিলেন,—বল কি হে? সত্য?–ডমরুধর উত্তর করিলেন,–হাঁ ভাই, সত্য।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–তাহার পর?

ডমরুর বলিলেন,–রাস্তায় ধূলায় আমার ধড়টি পড়িয়া কাটা ছাগলের ন্যায় ছটফট করিতে লাগিল। তখনও আমার প্রাণ বাহির হইয়া যায় নাই। তখনও সম্পূর্ণ আমি জ্ঞানহারা হই নাই। আমি এ-দিক ওদিক চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, সহদেব বাণী হতভম্ভ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। বোধ হয় যে, তাঁহাকে আঘাত লাগে নাই। সে চঞ্চলার গরুর দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। গরুটিও পথে পড়িয়াছিল। গাড়ীর আর একটি চাকায় তাঁহারও কোমর পর্যন্ত কাটিয়া দুইখানা হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার কোমর ও পা কিন্তু গাড়ীর চাকায় লাগিয়া যায় নাই। একদিকে গরুর ধড় ও অপরদিকে তাঁহার কোমর ও পা রাস্তার উপর পড়িয়াছিল। বিষণ্ণ বদনে সহদেব তাহাই দেখিতেছিল।

সেই পথ দিয়া ভিকু ডাক্তার ব্যাগ হাতে লইয়া চিকিৎসা করিতে যাইতেছিলেন। তিনি দৌড়িয়া আসিলেন। এ-দিক ওদিক চাহিয়া কোমর ও পা দেখিতে পাইলেন না। তখন সেই গরুর কোমর ও পা আমার শরীরে তিনি জুড়িয়া দিলেন। তাঁহার ব্যাগ খুলিয়া দুইটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের গুলি আমার মুখে দিলেন। ঔষধের গুণে সেই গরুর কোমর ও পা আমার শরীরে জুড়িয়া গেল। তাহার পর আর দুইটি বড়ি তিনি আমার মুখে দিলেন। তাহা দেখিয়া আমি শরীরে বল পাইলাম। কিন্তু মানুষের মত গরুর দুই পায়ে আমি সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারিলাম না। গরুর দুই পা আমার দুই হাত মাটীতে পাতিয়া পাতিয়া চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় আমাকে দাঁড়াইতে হইল।

ইতিমধ্যে সে স্থানে অনেক লোক একত্র হইয়াছিল। এই অবস্থায় সকলে আমাকে গ্রামের ভিতর লইয়া গেল। সে স্থানে গিয়া ভিকু ডাক্তার বলিলেন,–ডমরুবাবু তুমি আমার পাওনা টাকা দাও নাই। আমাকে ফাকি দিয়াছিলে। কিন্তু এখন তোমার এই শরীরটি আমার হইল। গরুর কোমর তোমার শরীরে যদি আমি জুড়িয়া না দিতাম, তাহা হইলে এতক্ষণ কোন কালে তুমি মরিয়া যাইতে। দুইদিন পরে তোমার ধড়টি পচিয়া যাইত, অথবা পুড়িয়া ছাই হইত। অতএব তোমার এই শরীর এখন আমার। আমার চাষ আছে। যতদিন বাঁচিবে, ততদিন আমার ক্ষেতে তোমায় কাজ করিতে হইবে।

এই কথা বলিয়া আমার গলায় গরুর দড়ি দিয়া তিনি টানিতে লাগিলেন।

চঞ্চলার পিতা সহদেব তাঁহার হাত হইতে দড়ি কাড়িয়া লইল। সে বলিল,–ভাল রে ভাল! ইনি তোমার? সে কিরূপ কথা? ইহার আধখানা চঞ্চলার গাই। এখনও ইহার দুধ হইবে। আমরা ইহাকে ছাড়িয়া দিব না।

আমাকে লইয়া দুইজনে বিবাদ বাধিয়া গেল। এ বলে ইনি আমার প্রাপ্য, ও বলে আমার প্রাপ্য। ক্রমে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল। অবশেষে গ্রামের লোক সমস্যার এইরূপ মীমাংসা করিয়া দিল। দিনের বেলা আমাকে ভিকু ডাক্তারের কাছে থাকিতে হইবে। সমস্ত দিন তিনি আমাকে খাটাইয়া লইবেন। রাত্রিকালে আমি চঞ্চলার গোয়ালে বাঁধা থাকিব। প্রাতঃকালে চঞ্চলা আমার দুধ দুহিয়া ভিকু ডাক্তারের বাড়ীতে আমাকে পাঠাইয়া দিবে। একবেলা ভিকু ডাক্তার আমাকে খাইতে দিবেন, অন্য বেলা সহদেব বাঙ্গী আমাকে খাইতে দিবে।

প্রথম দিন আর আমাকে কোন কাজ করিতে হয় নাই। সেদিন চঞ্চলার গোয়ালে খোঁটায় আমি বাঁধা রহিলাম, পাছে হাত দিয়া দড়ি খুলিয়া আমি পলায়ন করি, সেজন্য হাত দুইটিও তাঁহারা বাঁধিয়া রাখিল। ইহার পর প্রতি রাত্রিতে তাঁহারা এইভাবে আমাকে বাঁধিয়া রাখিত, স্যাবেলা চঞ্চলা আমাকে দুইটি মুড়ি খাইতে দিল। যতদিন ইহাদের নিকট ছিলাম, ততদিন দুইবেলা দুইটি মুড়ি আমার আহার ছিল। একবেলা ভিকু ডাক্তার দিত, অন্যবেলা চঞ্চলা দিত। আমার দাঁত নাই, মুড়ি চিবাইতে পারিতাম না। প্রাণধারণের নিমিত্ত কোনরূপে গিলিয়া ফেলিতাম।

পরদিন প্রাতঃকালে চঞ্চলা আমার দুধ দোহন করিল। প্রায় দুই সের দুধ হইল। তাহার পর সে বাছুর ছাড়িয়া দিল, বাছুর আমার দুধ খাইতে লাগিল ও মাঝে মাঝে বাছুর আমার পেটে মাথার তঁতো মারিতে লাগিল। তাঁহার গুতোতে আমি অস্থির হইয়া পড়িলাম। ভাগ্যক্রমে এই সময় ভিকু ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি বলিলেন,–ডমরুবাবুর ঐ পেট এখন আমার। পেট আমার ভাগে পড়িয়াছে। পেটে আমি বাছুরকে মারিতে দিব না। তাঁহার ছুঁতে, যদি ডমরুবাবুর নাড়িভূঁড়ি ছিঁড়িয়া যায়, তাহা হইলে তোমাদের নামে নালিশ করিব। সেইদিন হইতে চঞ্চলা বাছুরের দড়ি টানিয়া রাখিত। বাছুর আমার পেটে আর গুঁতো মারিতে পারিত না।

দুধ দোহন হইলে ভিকু ডাক্তার আমাকে তাঁহার ক্ষেতে লইয়া গেলেন। কৃষককে বলিলেন যে,–একটা গরুর সহিত ইহাকে লাঙ্গলে জুড়িয়া দাও।

কৃষক তাহাই করিল। মানুষের হাত কোমল তাহাতে ক্ষুর নাই। কিন্তু এখন আমাকে দুইটি হাত মাটিতে পাতিয়া গরুর ন্যায় চরিতে হইয়াছিল। আমার হাতে কাটা খোঁচা ফুটিয়া যাইতে লাগিল। ঘোরতর কষ্টে আমার চক্ষু দুইটি জলে ভাসিয়া গেল। আমি ভাবিলাম যে, আমার নাদুস-নুদুস নধর শরীরটি এইবার মাটি হইয়া গেল।

আমার সঙ্গে বলদের সহিত সমানভাবে আমি ক্ষেতের উপর লাঙ্গল কাধে করিয়া চলিতে পারিতেছিলাম না, সেজন্য কৃষক আমার আঙ্গুলে সবলে মোচড় দিতে লাগিল। এমন সময় সহদেব সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সহদেব বলিল,–ও কি। তুমি উহার লেজ মলিতে পারিবে না। লেজ তোমাদের নহে, লেজ আমাদের ভাগে পড়িয়াছে।

কৃষক আর আমার লাল মর্দন করিল না বটে, কিন্তু আমার পিঠে ছড়ি মারিতে লাগিল। ফলকথা, আমার দুঃখের আর সীমা রফি-না। সন্ধ্যাবেলা ভিকু ডাক্তার আমাকে চঞ্চলার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন। চঞ্চলা আমাকে তাঁহার গোয়ালে বাঁধিয়া রাখিল। পরদিন প্রাতঃকালে আমার দুধ দুহিয়া পুনরায় আমাকে ভিকু ডাক্তারের নিকট পাঠাইয়া দিল। পুনরায় আমাকে লাঙ্গল ঘাড়ে করিয়া ক্ষেত চষিত হইল।

প্রতিদিন এইরূপ হইতে লাগিল। মনের দুঃখে রাত্রিদিন আমি কাঁদিতেছিলাম। ভাবিতেছিলাম যে, হায় হায়! স্বদেশী কোম্পানী খুলিয়া দেশের লোকের মাথায় হাত বুলাইয়া যে টাকা উপার্জন করিলাম, সে সব বৃথা হইল। এলোকেশী অথবা তোমার বন্ধুবান্ধব কেহ আমার কোন সন্ধান লইল না সেজন্য আমার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

লম্বোদর বলিলেন,–আজ ছয়মাস প্রতিদিন দুইবেলা তোমাকে দেখিতেছি। তোমার আবার সন্ধান কি লইব? কিন্তু তুমি কি বলিতেছ যে, সে সব জগদম্বার মায়া। তবে আমরা আর কি বলিব?

ডমরুধর পুনরায় বলিতে লাগিলেন,—দিন দিন আমি দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিলাম। আমার সে নাদুন-নুদুস নধর শরীর শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেল। অস্থিচর্মসার হইয়া যাইলাম। ভালরূপ লাঙ্গলও টানিতে পারি না, দুধও দিতে পারি না। প্রায় একমাস কাটিয়া গেল। একদিন প্রাতঃকালে চঞ্চলা আমাকে যথারীতি দুহিতে আসিল। কিছুমাত্র দুধ হইল না। পিতাকে গিয়া সে সেই কথা জানাইল। সহদেব বলিল যে,–কাল প্রাতঃকালে আমি নিজে দুহিয়া দেখিব। পরদিন প্রাতঃকালে সে নিজে আমাকে দুহিতে আসিল। একফোটাও দুধ বাহির হইল না। তখন সে বিড় বিড় করিয়া আপনা-আপনি বলিল,পুনরায় বাছুর হইলে দুধ হইবে না, তাঁহার যোগাড় করিতে হইবে।

এই কথা শুনিয়া আমার প্রাণ উড়িয়া গেল। একে লাঙ্গল টানিয়া প্রাণ আমার ওষ্ঠাগত হইয়াছিল। তাঁহার উপর আবার বাছুরের যোগাড়।

সে রাত্রি আমার নিদ্রা হইল না। ক্রমাগত আমি মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম,–মা! চিরকাল তুমি আমাকে নানা বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছ। সন্ন্যাসীর হাত হইতে, বাঘের মুখ হইতে তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়াছ। এখন কেন মা! তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছ?

এই স্তব-স্তুতি মিনতি করিয়া আমি কাঁদিতে লাগিলাম। সহসা কে যেন আমার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল,–ভয় নাই বাছা, ভয় নাই! শীঘ্রই তোমাকে আমি এ বিপদ হইতে পরিত্রাণ করিব। গত বৎসর তোমার পূজায় কিঞ্চিৎ ত্রুটি হইয়াছিল। সেই পাপের জন্য তোমাকে কষ্ট দিলাম।

মা যাহা বলিলেন, তাহাই করিবেন। পরদিন প্রত্যুষে শঙ্কর ঘোষ আসিয়া বলিল,–তুমি আমাকে টাকা ফাঁকি দিয়াছ। চল, তোমাকে আমি পুলিশে দিব।

এই বলিয়া সে আমার দক্ষিণ হস্ত ধরিয়া টানিতে লাগিল। সে সংবাদ পাইয়া ভিকু ডাক্তার দৌড়িয়া আসিলেন, তিনি বলিলেন,–বড়টি আমি রক্ষা করিয়াছি। এ ধড় আমার সম্পত্তি।

এই কথা বলিয়া তিনি আমার বাম হাত ধরিয়া টানিতে লাগিলেন। গোলমাল শুনিয়া চঞ্চলা সে স্থানে দৌড়িয়া আসিল। সে বলিল,–ইহার নীচের দিকটা আমার। আমার গাইগরু।

এই বলিয়া সে আমার পশ্চাৎ দিকের দক্ষিণ পায়ের খুর ধরিয়া টানিতে লাগিল। এমন সময় হু হু পালকির শব্দ হইল। আমি ও অপর সকলে সেইদিকে চাহিয়া রহিলাম। এলোকেশী ঠাকুরাণী উগ্রমূর্তি ধারণ করিয়া পালকি হইতে নামিলেন। আমার নিকট আসিয়া তিনি বলিলেন,–ইনি আমার স্বামী। তোমরা ছাড়িয়া দাও। ইহাকে আমি বাড়ী লইয়া যাইব। বাড়ী গিয়া ঝাঁটা-পেটা করিয়া ইহার ভূত ছাড়াইব।

এই কথা বলিয়া তিনি আমার পশ্চাৎ দিকের বাম পায়ের খুর ধরিয়া টানিতে লাগিলেন। আপন আপন দিক কেহই ছাড়িয়া দিল না। একদিকে শঙ্কর ঘোষ ও ভিকু ডাক্তার আমার দুই হাত ধরিয়া টানিতে লাগিল। অপর দিকে চঞ্চলা ও এলোকেশী দুই খুর ধরিয়া টানিতে লাগিল। তাহাদের টানাটানিতে আমার প্রাণ বাহির হইবার উপক্রম হইল। ছাড়িয়া দাও বলিয়া আমি চীৎকার করিতে লাগিলাম, কিন্তু কেহই ছাড়িল না।

অবশেষে তাহাদের টানাটানিতে আমার শরীর হইতে ফস্ করিয়া চঞ্চলার গাইগরুর কোমর ও পা খসিয়া পৃথক হইয়া গেল। আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।

***

কতক্ষণ অজ্ঞান হইয়াছিলাম, তাহা জানি না; যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন আমি চক্ষু চাহিয়া দেখিলাম যে, আমি আমার ঘরে শয়ন করিয়া আছি। আমি উঠিয়া বসিলাম। পায়ের দিকে চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, মানুষের দুইটি পা, গরুর পা নহে। তাহাতে লেজ নাই, খুর নাই, কেবল মানুষের পায়ের পাতা। ফলকথা, আমার পা। শরীর দিকে চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, আমার নাদুস-নুদুস নধর শরীর যেরূপ ছিল, সেইরূপ রহিয়াছে। শুষ্ক হইয়া যায় নাই। ঘরের ভিতর শঙ্কর ঘোষ অথবা ভিকু ডাক্তার অথবা চঞ্চলা, কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। কেবল দেখিলাম যে, এলোকেশী বার খুলিয়া কাপড় বাহির করিতেছিলেন।

আমি জাগরিত হইয়াছি দেখিয়া এলোকেশী বলিলেন,–কাল রাত্রিতে বিড় বিড় করিয়া ওরূপ বকিতেছিলে কেন? চঞ্চলা কে?

আমি কোন উত্তর করিলাম না। মনে মনে ভাবিলাম যে,সকলই জগদম্বার মায়া। সমুদয় মায়ের লীলা।