৫. নন্দপুরের পুবপাড়া যেখানে শেষ হয়েছে

নন্দপুরের পুবপাড়া যেখানে শেষ হয়েছে তার পর থেকে ঘোর জঙ্গল, দিনের বেলাতেও জায়গাটা অন্ধকার। দেড়শো বছর আগে একসময়ে এখানে কুখ্যাত তারা তান্ত্রিকের ডেরা ছিল। জনশ্রুতি আছে এখানে নিয়মিত নরবলি হত। জঙ্গলের একেবারে ভেতরে নিবিড় বাঁশবনের মাঝখানে পুরনো পরিত্যক্ত একখানা কালীমন্দির। মন্দিরের বেশিরভাগই ভেঙে পড়েছে। সাপখোপ আর তক্ষকের বাসা। বাদুড় আর চামচিকের আড্ডা। বহুকাল এই জায়গায় কোনও মানুষ আসেনি। কালীমন্দিরের লাগোয়া পুকুরটাও সংস্কারের অভাবে হেজেমজে গিয়েছিল। তবে মাঝখানটায় এখনও গভীর জল।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে আসছে। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচিরে কান পাতা দায়। কালীমন্দিরের চাতাল দিয়ে ধীর পায়ে দুটো নেকড়ে এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে চলে গেল। বাঁশবন থেকে বেরিয়ে গোটাচারেক শেয়াল দ্রুতবেগে দৌড়ে আরএকধারের বাঁশবনে গিয়ে সেঁধোল। একপাল বুনো কুকুরের ডাক নিস্তব্ধতাকে হঠাৎ খানখান করে ভেঙে দিচ্ছিল।

মন্দিরের ভেতরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। যে বেদিটার ওপর এককালে বিগ্রহ ছিল, তার ওপর ধুলোময়লার মধ্যেই শুয়ে ছিল একটা লোক। পরনে একটা ময়লা প্যান্ট, গায়ে একটা ময়লা হাওয়াই শার্ট। লোকটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। আচমকাই বেদির নীচের ফাটল থেকে একটা মস্ত গোখরো সাপ হিলহিল করে বেরিয়ে এল। তারপর ধীরগতিতে উঠে এল বেদির ওপর। সাপটা লোকটার শরীরের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল ওপাশে। ঘুমন্ত লোকটা বিরক্ত হয়ে একটা হাত তুলে সাপটাকে ঝেড়ে ফেলতে যেতেই প্রকাণ্ড সাপটা প্রকাণ্ড ফণা তুলে দাঁড়াল লোকটার বুকের ওপর। তারপর বিদ্যুৎগতিতে তার ছোবল নেমে এল লোকটার কপালে।

বাঁ হাত দিয়ে সাপের গলাটা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই ধরল লোকটা। তারপর উঠে বসে একটা হাই তুলল। সাপটা কিলবিল করছিল তার হাতের মধ্যে। সাপটাকে দু হাতে ধরে মন্দিরের বাইরে এসে লোকটা চারদিকে চেয়ে দেখল একটু। তারপর সাপটাকে ছেড়ে দিল সামনে। তারপর আবার একটা হাই তুলল।

এই জঙ্গলের ভয়াবহতম প্রাণী হচ্ছে বুনো কুকুর। ক্ষুধার্ত হিংস্র বুনো কুকুরকে বাঘও ভয় খায়। কারণ তারা একসঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটটা করে ঘুরে বেড়ায়, সামনে যে-কোনও প্রাণীকে পেলে সবাই মিলে আক্রমণ করে কয়েক মিনিটের মধ্যে খেয়ে সাফ করে দেয়।

লোকটা বাইরে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বুনন কুকুরদের চিৎকার শুনছিল। কুকুরের পাল এগিয়ে আসছে এদিকেই। লোকটার তাতে কোনও উদ্বেগ বা ভয় দেখা গেল না। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীর পায়ে জঙ্গল ভেঙে এগোতে লাগল। তার শরীরের ধাক্কায় বাঁশঝোঁপের দু-একটা বাঁশ মচকে গেল, ছোটখাটো গাছ কাত হয়ে পড়তে লাগল।

হঠাৎ ঝোঁপঝাড় ভেঙে একপাল বুনন কুকুর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সে তেমন ঘাবড়াল না। দুটো কুকুরকে তুলে অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল! আর বাকিগুলোকে পা দিয়ে কয়েকটা লাথি কষাল। আশ্চর্যের বিষয়, ভয়ঙ্কর বুনো কুকুরেরা কেন যেন কিছু টের পেয়ে থমকে গেল। তারপর লোকটাকে ছেড়ে দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল সকলে।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গাঁয়ের রাস্তায় পা দেওয়ার আগে লোকটা একটা বাঁশঝোঁপের পেছনে দাঁড়িয়ে চারদিকটা ভাল করে লক্ষ করল। সে লক্ষ করল গাঁয়ের এইদিকটা আজ অস্বাভাবিকভাবে জনশূন্য। সে একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এল। ধীর এবং নিশ্চিন্ত পায়ে সে হাঁটছে। চারদিকে একটু দেখে নিচ্ছে মাঝে-মাঝে। না, তাকে কেউ লক্ষ করছে না। গাঁয়ের কুকুররা তাকে দেখে তেড়ে এলেও কাছাকাছি এসেই কেন যেন ভয় পেয়ে কেঁউ-কেঁউ করে পালিয়ে যায়।

পুবপাড়া ছাড়িয়ে কেটপাড়া। আজ সব পাড়াই জনশূন্য। রাস্তা ফাঁকা। দূরে কোথাও একটা কোলাহল শোনা যাচ্ছে। কোলাহলটা কোথা থেকে আসছে এবং কেন, তা লোকটা জানে। আজ গাঁয়ের লোক অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি পাহারা দিতে জড়ো হয়েছে। লোকটা একটু হাসল। ওদের কাছে লাঠিসোটা আছে সে জানে।

কেওটপাড়া পার হয়ে লোকটা রাস্তা ছেড়ে আঘাটায় নেমে গেল। সামনে বনবাদাড়, ঝিল, বাঁশঝোঁপ, জলাজমি। কাঁটাঝোঁপের জঙ্গল পেরিয়ে লোকটা ঝিলের জলে অম্লানবদনে নেমে গেল। ঝিলটা সাঁতরে পার হয়ে সে বাঁশঝাড়ে ঢুকে গেল। সামনে একটা জলাজমি, তার পরেই অঘোর সেনের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়ির চারদিকে লণ্ঠন, মশাল এবং টর্চ নিয়ে বহু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারা হল্লা করছে।

লোকটা কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল, তারপর বাঁশঝোঁপ থেকে বেরিয়ে জলাজমিতে পা রাখল। জলায় কোমর অবধি কাদা। একবার পড়লে আর ওঠা যায় না। কিন্তু লোকটার শরীরের শক্তি যন্ত্রের মতো। সে কাদায় নেমে সেই কাদা ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগল। কোনও অসুবিধেই হল না তার।

জলাজমির প্রান্তে হোগলার বন। লোকটা হোগলার বনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বাড়ির পেছনদিকটা লক্ষ করল। পেছনে জলাজমি বলে ওরা এদিকে পাহারা কম রেখেছে। কারণ জলাজমি দিয়ে কোনও মানুষের পক্ষে হানা দেওয়া সম্ভব নয়। পেছনে মাত্র তিনজন লোক পাহারায় আছে।

এই গ্রহের প্রাণীদের শরীর দুর্বল, প্রাণশক্তিও কম। এদের অস্ত্রশস্ত্রগুলি হাস্যকর। লোকটা ইচ্ছে করলে এদের সব ক’জনকেই ঘায়েল করে কার্যোদ্ধার করতে পারে। কত লোককে হত্যা করতে হবে তা সে জানে না। সে শুধু জানে, সব কাজেরই একটা সময় আছে।

তার চারদিকে লক্ষ-লক্ষ মশা ওড়াউড়ি করছে, গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে জলজ সাপ, জোঁক কিলবিল করছে চারদিকে, ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ছে গায়ে। তার ভূক্ষেপ নেই। সে হিসেব করে দেখল, আরও কয়েক ঘণ্টা পর, বিশেষ করে ভোরের দিকে এই মানুষগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এদের ঘুম পাবে, শিথিল হয়ে যাবে সতর্কতা। এখনই সময়। সুতরাং তাকে অপেক্ষা করতে হবে। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

দারোগা হরকান্ত পোদ্দার রাত্তিরবেলা বিশেষ কিছু খান না। পাঁঠার কালিয়া আর ঘিয়ে ভাজা পরোটা। তা তাঁর জন্য আজ গোবিন্দ বিশ্বাসের বাড়িতে তাই রান্না হচ্ছে। হরকান্ত পোদ্দার বাইরে একখানা কাঠের চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে তাঁর দারোগা-জীবনের নানা বীরত্বের কাহিনী বর্ণনা করছেন। সবাই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে। দু’জন বন্দুকধারী কনস্টেবল ভিড় সামলাচ্ছে।

হরকান্ত পোদ্দার সুবুদ্ধি আর দ্বিজপদর দিকে চেয়ে বললেন, “তোমরা বলছ, লোকটার গায়ে খুব জোর! ওরে বাবা, যত জোরই থাক ট্যারা পালোয়ানের চেয়ে তো আর সে তাকওয়ালা লোক নয়! মোহনপুরের জঙ্গলে সেই ডাকু ট্যারা পালোয়ানের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই হল সেবার। তা লড়েছিল খুব। কিন্তু পারবে কেন? শেষে তাকে কোমরের বেল্ট দিয়ে একস্টা শালগাছের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। লোকটা সেলাম ঠুকে বলেছিল, আপনার মতো মস্তান দেখিনি কখনও।’ নাড় গুণ্ডার নাম শুনেছ? বাহাত্তর ইঞ্চি বুকের ছাতি, দুখানা হাত ছিল এক জোড়া শাল খুঁটি, আস্ত খাসি খেয়ে ফেলত এক-একবার। সেই নাড়কে যখন ধরতে গেলুম তখন কী ফাঁইটিংটাই না হল। হিন্দি সিনেমার ফাঁইটিং তার কাছে নস্যি। নাড স্বীকার করেছিল, ‘হ্যাঁ, ওস্তাদ বটে! বুঝেছ?”

সুবুদ্ধি আর দ্বিপদ ঘাড় নাড়ল বটে, কিন্তু তারা হরকান্ত দারোগার উপস্থিতিতে বিশেষ ভরসা পেয়েছে বলে মুখের ভাবে প্রকাশ পেল না। হরকান্তর চেহারা দশাসই, সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক তেল-ঘি, মাংস-মাছ খেয়ে চেহারাটা বড়ই বিপুল। এ-চেহারায় ফাঁইটিং করতে গেলে কী কাণ্ড হবে কে জানে!

সনাতন বিশ্বাস বা অঘোর সেনের ল্যাবরেটরির কথা এখনও কাউকে জানায়নি তারা। শুধু প্রচার হয়েছে একটা ডাকাত আজ হামলা করতে আসছে। নন্দপুরে বহুকাল কোনও উত্তেজক ঘটনা ঘটেনি। তাই গাঁ ঝেটিয়ে লোক এসেছে।

সনাতন বিশ্বাসকে গোবিন্দ তাঁর বাড়ির একেবারে অন্দরমহলে লুকিয়ে রেখেছেন। নিজের বংশধরদের মধ্যে এসে, সনাতন দুঃখের মধ্যেও কিছুটা সুখ পাচ্ছেন। গোবিন্দ বিশ্বাসের বউকে তিনি বলেছেন, “বউমা, এখন একটাই অসুবিধে। দেড়শো বছর টানা ঘুমিয়েছি, এখন কি আর আমার ঘুমটুম হবে?”

সমাজ মিত্তির তাঁর মোটা লাঠিটা হাতে নিয়ে চারদিকে ঘুরে দেখছেন এবং লোকটা হাজির হলে কী করা হবে তার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছেন।

মাটির নীচে পাতালঘরে ভূতনাথ একা অবস্থান করছেন। তাঁর কপালে ভ্রূকুটি। তিনি বুঝতে পারছেন, অঘোর সেনের এই ল্যাবরেটরি দেড়শো বছর আগেকার প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হয়নি। এতে উন্নত বিজ্ঞানের অবদান আছে। এবং সেই বিজ্ঞান এই পৃথিবীর বিজ্ঞান নয়। হিক সাহেবের কথা তিনি শুনেছেন। বিচার-বিশ্লেষণ করে অনুমান করতে পারছেন যে, এই হিক সাহেবই সেই উন্নত বিজ্ঞানের সরবরাহকারী। আর এও বুঝতে পারছেন, যে লোকটি হামলা করছে সে এসেছে প্রমাণ লোপ করতে এবং কিছু জিনিস বা যন্ত্রপাতি ফেরত নিয়ে যেতে। সম্ভবত সে সনাতন বিশ্বাসকেও নিয়ে যাবে, যাতে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা রহস্যটা ভেদ করতে না পারে।

অনেক ভেবে ভূতনাথ হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটা লোক, কিন্তু সে অমিতবিক্রমশালী। তাঁরা যে পাহারা বসিয়েছেন তা দিয়ে লোকটাকে রোখা যাবে কি না সে-বিষয়ে তাঁর ঘোর সন্দেহ আছে। তিনি আজ কলকাতায় গিয়ে তাঁর রিভলভারটা নিয়ে এসেছেন, দারোগা এবং কনস্টেবলদের কাছেও বন্দুক-পিস্তল আছে। কিন্তু এগুলো তাঁর যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর ভয় এবং দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

ভূতনাথ ল্যাবরেটরিটা খুব ভাল করে ঘুরেফিরে দেখেছেন। শিশি-বোতলের তরল পদার্থগুলোও কিছু কিছু পরীক্ষা করেছেন। বেশিরভাগই পরিচিত রাসায়নিক পদার্থ। তবে সনাতনের বাক্সে যে-শিশিটা রাখা আছে তার ভেতরকার দ্রব্যটা তাঁর পরিচিত জিনিস নয়। অমৃতবিন্দুর একটা পাত্র রয়েছে, সেটাও তাঁর চেনা জিনিস নয়। তবে সবকিছুই ফের ভাল করে ল্যাবরেটরি টেস্ট করা প্রয়োজন। নইলে দেড়শো বছর ধরে একটা লোককে ঘুম পাড়িয়ে রাখার রহস্যটা বোঝা যাবে না। পৃথিবীর বিজ্ঞানে এরকম ঘটনার কল্পনা করা হয় বটে, কিন্তু হাতে কলমে এমন অত্যাশ্চর্য ঘটনার প্রমাণ তো সারা দুনিয়ায় তোলপাড় ফেলে দেবে। কিন্তু সেই সুযোগ কি পাওয়া যাবে?

অঘোর সেন এক আশ্চর্য লোক। এত বড় একটা কাজ করলেন কিন্তু এক্সপেরিমেন্টের কোনও লিখিত বিবরণ রেখে যাননি। বৈজ্ঞানিকদের ধর্ম অনুযায়ী এরকম একটা বিবরণ রেখে যাওয়া তাঁর খুবই উচিত ছিল না কি?

“ছিলই তো!” কে যেন বলে উঠল।

ভূতনাথ গভীর চিন্তার মধ্যে বিচরণ করতে করতে বললেন, “তা হলে লিখে রাখলেন না কেন?” “হিক সাহেব রাখতে দিল না যে!”

এবার ভূতনাথ একটু অবাক আর সচকিত হয়ে চারদিকে চাইলেন। ল্যাবরেটরিতে তিনি একাই আছেন। তা হলে কথাটা বলছে কে? প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় চারদিকটা বেশ ফটফট করছে। তবু তিনি হাতের জোরালো টর্চটা জ্বেলে চারপাশে দেখে নিয়ে বললেন, “নাঃ, আমারই মনের ভুল।”

“ভুল নয়, হে, ভুল নয়। ঠিকই শুনেছ।” কেউ নেই, অথচ তার কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে এরকম ঘটনা তাঁর জীবনে আগে কখনও ঘটেনি। তিনি একটু ভয় খেয়ে বলে উঠলেন, “আপনি কে কথা বলছেন? কাউকে যে দেখছি না!”

“দেখতে চাও নাকি?” ভূতনাথ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আ-আপনি কি ভূ-ভূত?”

গলাটা খিঁচিয়ে উঠল, “ভূত আবার কী হাঁ? বিজ্ঞান শিখেছ আর এইটে জানো না যে, সব জিনিসেরই বস্তুগত রূপান্তর হয়?”

“আজ্ঞে, তা জানি।”

“তা হলে ভূত বলে তাচ্ছিল্য করার কী আছে?”

“তাচ্ছিল্য করিনি তো?”

“করেছ। তুমি ভূতটুত মানো না, আমি জানি।”

“আজ্ঞে মানছি, এখন থেকে মানছি। আপনি কে?”

“আমিই অঘোর সেন।”

ভূতনাথ আঁ-আঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়তে-পড়তেও সামলে গেলেন। হাতজোড় করে বললেন, “আমার হার্ট দুর্বল। আমাকে আর ভয় দেখাবেন না।”

“তোমার মতো নাস্তিককে ভয় দেখাতে এসেছি বলে ভেবেছ। নাকি? আমার অত সময় নেই। তোমাদের বিপদ বুঝেই আসতে হল। একগাদা মর্কট মিলে ওপরে তো কীর্তনের আসর বসিয়ে ফেলেছ প্রায়। হিক সাহেবের ছেলেকে কি ওভাবে আটকানো যায়?”

ভূতনাথ কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “হিক সাহেব কে?”

“সপ্তর্ষি চেনো?”

“যে আজ্ঞে!”

“ওই মণ্ডলেরই বাসিন্দা। অনেকদিন ধরেই যাতায়াত। ওহে বাপু, তুমি যে কেঁপে-ঝেপে একশা হলে। ভয় পাচ্ছ নাকি?”

“ওই একটু।”

“তা ভয়ের কী আছে বলো তো! টেপরেকডারে, গ্রামোফোনে অন্যের গলা শোনো না? তখন কি ভয় পাও? অনেক মৃত গায়কের গানও তো শোনো। তখন তো ভিরমি খাও না!”

“আজ্ঞে, সে তো যন্ত্রে রেকর্ড করা থাকে।”

“কিন্তু সেও তো ভূত, নাকি? সেও তো অতীত, যা নাকি এখন নেই। ঠিক তো!”

“আজ্ঞে।”

“ফোটো দেখো না? ফোটোতে কত শতায়ু মানুষের ছবিও তো দেখো, তখন ভয় পাও?”

“আজ্ঞে, সে তো ইমপ্রেশন।”

“ভাল করে বিজ্ঞানটা রপ্ত করো, তা হলে ভূতপ্রেতও বুঝতে পারবে, বুঝেছ? এসবও ইমপ্রেশন, এসবও সূক্ষ্ম অস্তিত্ব, তবে কিনা বিজ্ঞান এখনও নাগাল পায়নি এই রহস্যের।”

“যে আজ্ঞে!”

“শোনো বাপু, একটা কথা বলতে এই এতদূর আসা। অনেক দূরে থাকি, নানা কাজকর্মও করতে হয়। পরলোক বলে বসে শুয়ে জিরিয়ে সময় কাটানোর উপায় নেই। তবু তোমাদের বিপদের খবর পেয়েই আসতে হল।”

“যে আজ্ঞে।”

“হিক সাহেবের ছেলে পেছনের জলায় ঘাপটি মেরে আছে।”

“সর্বনাশ! তা হলে লোকজনকে খবর দিই?”

“আহাম্মকি করতে চাইলে দিতে পারো। তবে যদি ঘটে বুদ্ধি থেকে থাকে, ওকাজ করতে যেও না। ওর নাম ভিক। ও একাই গাঁসুন্ধু লোককে মেরে ফেলতে পারে।”

“তা হলে কী করব?” গলাটা খেচিয়ে উঠল ফের, “তার আমি কী জানি?”

“তবে যে বললেন, বিপদ দেখে এসেছেন!”

“তা তো এসেছিই। কিন্তু ভূত বলে কি আর আমি সবজান্তা?”

“যে আজ্ঞে।“

“শোনো বাপু, গতিক আমি সুবিধের বুঝছি না। হিকের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল সনাতনের যেদিন ঘুম ভাঙবে সেদিনই সে তার ‘রেসপিরেটর’ আর ‘রিভাইভার’ যন্ত্র সমেত সনাতনকেও নিয়ে যাবে।”

“বটে! তা হলে আমরা আপনার এত বড় আবিষ্কারের কোনও ফলই পাব না?”

“পেয়ে করবেটা কী? লোকে জানতে পারলেই সব ঘুমোতে চাইবে। মরার চেয়ে ঘুম যে অনেক ভাল বলে মনে করে সবাই।”

ভূতনাথ মাথা চুলকে বললেন, “তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আবিষ্কারটা যে মাঠে মারা যাবে।”

“তা যাবে। হিক সাহেব ছাড়বার পাত্র নন। সনাতন যে জেগেছে সে-খবর তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে। তাই ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

“তা হলে কী করা যায় বলুন তো!”

“ভাল করে শোনো।”

“শুনছি।”

“সনাতন খুব পাজি লোক, তা জানিস?”

“আজ্ঞে না। কীরকম পাজি?”

“কীরকম পাজি তা বলা মুশকিল। আমিও জানি না, তবে গাঁয়ের লোক ওকে ভয় পেত।”

“যে আজ্ঞে।”

“তোমরা ওকেই কাজে লাগাও।”

“কীভাবে?”

“তা আমি জানি না। যা মনে এল বললাম। এখন আমি যাচ্ছি। অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জে আমার জরুরি কাজ আছে। সেখানে আজ আর্কিমিডিস বক্তৃতা দেবেন।”

“বলেন কী? আর্কিমিডিস? এ যে ভাবা যায় না!”

“না ভাববার কী আছে! হরবখত দেখা হচ্ছে ওঁদের সঙ্গে। আর্কিমিডিস, নিউটন, গ্যালিলেও।”

“অ্যাঁ!” বলে মস্ত হাঁ করে রইলেন ভূতনাথ। তারপর হঠাৎ পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “স্যর, একটু দাঁড়ান। আমিও আপনার সঙ্গে আর্কিমিডিসের বক্তৃতা শুনতে যাব। এ সুযোগ ছাড়া যায় না।”

“তা বলে মরবে নাকি?”

“না মরলে তো উপায় দেখছি না। একটা মিনিট দাঁড়ান। পিস্তলের ঘোড়া টিপলেই এক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসব।”

“আ মলো! এ তো আচ্ছা পাগল দেখছি! ওহে বাপু, আর্কিমিডিসের বক্তৃতা মেলা শুনতে পাবে। বেঁচে থেকে যা-যা করার, ঠিকমতো আগে করো, নইলে বিজ্ঞানলোকে আসবার পাসপোর্ট হবে না যে!”

ভারী হতাশ হয়ে ভূতনাথ বললেন, “আমার যে তর সইছে।”

“আরে বাপু, আয়ু তো দু’দিনের। তারপর হাতে দেখবে অফুরন্ত সময়। রিভলভারটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলো তো বাপু! আমি চললুম।”

“যে আজ্ঞে।”

অঘোর সেন যে চলে গেলেন তা টের পেলেন ভূতনাথ। একটা শ্বাসের মতো শব্দ ঘর থেকে ফুস করে যেন বেরিয়ে গেল। ঘড়ি দেখে ভূতনাথ চমকে উঠলেন। সর্বনাশ! পৌনে চারটে বাজে! রাত শেষ হতে তো আর দেরি নেই!

তিনি হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে উঠে পড়লেন। সুড়ঙ্গের মুখে মই লাগানো হয়েছে। সেটা বেয়ে ওপরে উঠে যা দেখলেন তাতে

তাঁর একগাল মাছি। বেশিরভাগ.পাহারাদারই শুয়ে বা বসে গভীর

নিদ্রাভিভূত। দারোগাবাবুর নাক ডাকছে। জেগে আছে, শুধু সুবুদ্ধি, সমাজ মিত্তির আর দু-চারটে লোক। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, “শিগগির সনাতনবাবুকে ডাকো তোমরা। আর সময় নেই।”

চেঁচামেচিতে সবাই জেগে গেল। স্বয়ং গোবিন্দবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, “কী হয়েছে? সনাতনদাদু তো ঘুমোচ্ছেন।”

“ঘুমোচ্ছেন! দেড়শো বছর ঘুমিয়েও আবার ঘুম?”

“আজ্ঞে, পরোটা আর মাংস খাওয়ার পর তাঁর ভারী ঘুম পেয়ে গেল যে!”

“শিগগির তাঁকে তুলুন। নইলে রক্ষে নেই।”

অনেক ডাকাডাকির পর সনাতন উঠে বাইরে এসে হাই তুলে বললেন, “প্রাতঃকালেই ডাকাডাকি কেন হে?”

“আজ্ঞে, আপনিই ভরসা।”

“কী করতে হবে, বলো তো বাপু?”

“কী করতে হবে, তা জানি না। দয়া করে একটু পাতালঘরে এসে বসুন।”

“না হে বাপু, আর পাতালঘরে নয়। ওখানে গেলে যদি ফের ঘুমিয়ে পড়ি?”

“সে-ভয় নেই। দয়া করে আসুন।”

সাড়ে তিনটের সময় যখন লোকটা দেখল পাহারা শিথিল, সবাই ঘুমে ঢুলছে, তখন সে ধীরে-ধীরে হোগলার বন ভেদ করে ওপরে উঠে এল। খুবই নিঃশব্দ তার চলাফেরা।

গাড়ির পেছনকার বাগানের পাঁচিলটা ডিঙিয়ে সে ঢুকে পড়ল

ভেতরে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল।

হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে উঠল কার নাম ধরে। অনেক লোক জেগে উঠল। পাশের বাড়ি থেকে দুটো লোক এ বাড়িতে এসে ঢুকল। লোকটা একটু অপেক্ষা করল। গোলমালটা থিতিয়ে আসতেই সে নিঃশব্দ পদচারণায় বাড়ির পেছনের একটা দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। হাতের সামান্য একটু কলাকৌশলেই খুলে গেল দরজা। সে ভেতরে ঢুকল।

সামনেই একটা লোক। তাকে দেখে চেঁচানোর জন্য হাঁ করেছিল। লোকটা তাকে সামান্য একটা কানা মারতেই লোকটা আলুর বস্তার মতো পড়ে গেল মেঝের ওপর।

সুড়ঙ্গর পথ তার চেনা। সে নিঃশব্দে গিয়ে গর্তটার সামনে দাঁড়াল। তারপর নামতে লাগল নীচে।

পাতালঘরের দরজাটা বন্ধ। লোকটা হাতের ধাক্কায় দরজার পাল্লা ছিটকে দিয়ে খোলা দরজায় দাঁড়াল। নীচে দুটো লোক ভীত মুখে ঊধ্বদিকে চেয়ে আছে।

দু’জনের একজন হঠাৎ তাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “ওই… ওই হল হিকসাহেব! ও আসলে ভূত! ও কৌটোয় করে আকাশ থেকে নেমে আসে… ওরে বাবা…”

লোকটা ওপর থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ল।

লোকটার জীবনে যা কখনও হয়নি, যে অভিজ্ঞতা তার সূদূর কল্পনারও অতীত, লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই ঘটল। মেঝের ওপর পড়তেই তার বাঁ হাঁটুটা বেকায়দায় বেঁকে গেল। তারপর মচাৎ করে একটা শব্দ। লোকটা এক অজানা ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল, “সাব সি! সাব সি!”

তারপর যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বাঁ হাঁটু চেপে ধরে বসে রইল। ভূতনাথবাবু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ভূ-ভূত হলে কি অমন

আর্তনাদ করত? ভূত কি ব্যথা পায়?”

সনাতন বিশ্বাস হঠাৎ বলে উঠল, “দাঁড়ান মশাই, মনে পড়েছে। ওই কোণের দিকে টেবিলে একটা শিশি আছে। হিক শিশিটা দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিল।”

সনাতন দৌড়ে গিয়ে শিশিটা নিয়ে এল। তাতে তেলের মধ্যে ভেজানো একটা মরা তেঁতুলবিছে। অনেকে বাড়িতে রাখে।

“ওটা কী মশাই?”

“তেতুঁলবিছে হুল দিলে এই তেল লাগালে উপকার হয়।”

“ওতে ভয় পাওয়ার কী আছে?”

“কে জানে মশাই!”

বলে শিশিটা নিয়ে সনাতন বিশ্বাস লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই ভাঙা পা নিয়ে বিবর্ণ মুখে লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, “খবরদার! খবরদার! ওটা সরিয়ে নে!”

সনাতন হেঃ হেঃ করে হেসে বলল, “এবার বাছাধন?”

লোকটা, অর্থাৎ হিকের ছেলে ভিক হঠাৎ অমানুষিক একটা চিৎকার করে এক লম্ফে ওপরের ফোকরটার কানা ধরে ঝুল খেয়ে ওপরে উঠে পড়ল। আর ঠিক সেই সময়ে ওপর থেকে একটা পাথর আলগা হয়ে খসে পড়ল তার মাথায়। তবু চেঁচাতে-চেঁচাতে লোকটা ওপরে উঠে পড়ল। সুড়ঙ্গ বেয়ে রাস্তায় নেমে ভাঙা পা নিয়েই সে এমন দৌড় লাগাল, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

সনাতন শিশিটা রেখে দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, “হুঁ, গোবিন্দ আবার অপয়া! ছেলেমানুষ মশাই, ছেলেমানুষ। আমি এমন অপয়া ছিলাম যে, কুকুর-বেড়াল অবধি আমার পথে হাঁটত না।”

ভূতনাথ গদগদ স্বরে বললেন, “দিন মশাই, পায়ের ধুলো দিন।”