৫. নগ্ন নির্জন হাত

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – নগ্ন নির্জন হাত

সকাল থেকেই ব্যস্ত ছিল শরদিন্দু। প্যান্ডেল সাজানো। বাড়ি থেকে আনা জিনিসপত্তর গুছিয়ে রাখা আর অতিথিদের পানভোজনের বন্দোবস্ত। অনেক কাজ। বিকেল চারটেয় ওঁরা আসবেন। অর্ধেন্দু সঙ্গে নিয়ে আসবে। সকালেই নির্দেশপত্তর আর ফলমূল মিষ্টির বোঝা নিয়ে লোক এসেছে তার কাছ থেকে। ক্যাম্পের ভেতরে খামারের জন্যে ফেলে রাখা জায়গাটুকুতে আয়োজন। বাইরে সবই জলময়। কিন্তু আকাশ আজ প্রসন্নমুখ। বৃষ্টি ধোয়া মাঠে প্রশান্ত রোদ্দুর টলমল করে উঠেছে সবুজ ঘাসে, জলে, গাছের পাতায়। ফার্মের জমিতে আজ কোনো কাজের আয়োজন নেই। নালার ধারে প্লাউয়িং উঠেছে হাজার মুক্তোর দ্যুতি। এখানে হাসিম সেখ চোখ পাকিয়ে ঘুরছে মজুরদের পেছনে। টগর এলোকেশী ঝাব্বু সিং—এর ঘরের সুমুখে পেতে রাখা খাটিয়ায় বসে একরাশ ফুল নিয়ে মালা গাঁথছে। ঝাব্বু কাছেই নিশ্চিন্দি গাছে ঠেস দিয়ে মোড়া পেতে বসেছে। হাতমুখ নেড়ে কীসব বোঝাচ্ছে অবিশ্রাম।

খুঁটি বেয়ে উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে যায় নীলকান্ত। মুনিষ হয়ে এসেছে সে। ধমক দেয় হাসিম, শালা কুড়রের ছা, অথপ্পর ধাড়ি।

বারবার চেষ্টা করেও পারে না। খিস্তি করে হাসিম, আরে শালা, তুদের কাজই তো চিরকাল হাঁড়ি হাতে তালগাছে চড়া। আজ বাবু হইছিস দেখি। না, তখন রং লেগে কলজে পাঁচ হাত ফোলে। শালা ধিনির বাচ্চা কাঁহেকা। চাপ!

করুণ মুখে তাকায় নীলকান্ত। বলে, শরীলে জুত নাই শ্যাকভাই। দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছি। তাতে পেছল বাঁশ, পা সড়কে যায়।

—ও। মাগের শোকে? তা মুনিষ এলি কেনে রে হারামী! চড় তোলে হাসিম।

শরদিন্দু এগিয়ে আসে। কই দেখি। পড়ে থাকা সামিয়ানার কোণে বাঁধা দড়ি দাঁতে কামড়ে ধরে তর তর করে উঠে যায় বাঁশ বেয়ে। এরা অবাক হয়ে আমতা আমতা করে। দড়ি বেঁধে নেমে আসে শরদিন্দু। বলে, মই আনা হয়নি?

হাসিম জিভ কাটে, ওই যাঃ। ভুল হয়েছে সার। গাঁয়ে পাঠাতে হয় তাহলে।

—থাক। গোডাউনের তিন নম্বর রুমে যে ছোট মইখানা আছে, নিয়ে এসো জলদি।

হাসিম ছুটে যায়।

ঝাব্বু সিং ওখানে জমিয়ে রেখেছে। টগর বলে, আপনি সিদিন সরসীদের বাড়ি গেলেন কীজন্যে গো?

ঝাব্বু হাসে, উ দিন বহত গড়বড় হো গয়া।

—আপনি উসব খান তা একদিনও বল্লেন নাতো।

—উ দিন আপনা খেয়ালসে। হাম রসটস তো পি—তা নেহি।

—খামকা পাঁচ—পাঁচটা ট্যাকা নষ্ট কল্লেন।

—রুপেয়া সে ক্যা! তুম একরোজ…..

শরদিন্দু ডাকে, ঝাব্বু সিং!

—হজুর সার।

—ইধার আও। ইধার দেখো তুম।

—হেঁয়াপর………..

—দরকার নেহী।

তক্তাপোশ সাজিয়ে প্ল্যাটফরম তৈরি হচ্ছে। ঝাব্বু সিং ওখানে উঠেই আচমকা থাপ্পড় কসে দেয় নীলকান্তকে। ঐ সা নেহি বে উল্লুক, এ্যায়সা করকে!

নটবরও এসেছে। হেঁ হেঁ করে। ঝাব্বু বলে, ঠিক সে কাম করো। ঠিকসে।

আয়োজন চূড়ান্ত। লাউডস্পীকার গ্রামোফোন দেবদারু পাতা আর সমবায়ের প্রতীক সাতরঙের কাগজে ঝালরটানা প্যান্ডেল। সুদৃশ্য আলপনা আঁকা নরম মসৃণ গালিচা পাতা সভাপতির আসন। দুটো ফুলদানিতে মরশুমি ফুলের তোড়া। চারপাশে খুঁটিতে টাঙানো মাইকের চোঙের নীচে দেশবরেণ্য নেতাদের পূর্ণাবয়ব ছবি। সুগন্ধি ধূপবাতি থেকে নীল নীল ধোঁয়া উঠে মাঠের বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্বপ্নিল মদিরতা। শরদিন্দুর আগামী দিনের সৌরভ। একে একে লোক আসে। মাইকের উদ্ধত স্বর দিগন্তে সমুদ্রতরঙ্গের মতো গর্জাচ্ছে। বেশিরভাগ লোকসংগীত। বর্ষাঋতুর এক অসাধারণ দিন। পরিচ্ছন্ন স্বচ্ছ নীল আকাশের নীচে আশা আর স্বপ্নের এক জীবন্ত পাখি যেন ওড়ার জন্যে ডানা মেলছে।

কৃষি যন্ত্রগুলো সারবদ্ধ একপাশে সাজানো প্রদর্শনীর স্টলের মতো। শরদিন্দুর গবেষণার বিভিন্ন ডেমনস্ট্রেশন। ফসলের নমুনা। অজস্র সার্টিফিকেট।

অনেক অনেক এল। আশার অতিরিক্ত। বিরূপ জনসাধারণের মধ্যে কেমন যেন একটা উৎসাহ আর কৌতূহল। মৃদুতম উচ্ছ্বাসের বেগ অনুভব করে শরদিন্দু। তৃপ্তির আভাস তাই তার সঞ্চরণে। সকলকে হাসিমুখে যুক্তকরে অভ্যর্থনা কর চলে। যন্ত্রের মতো হাসিম শেখ ঝাব্বু সিং দুপাশে দাঁড়িয়ে আদব—সেলাম—নমস্তে ঠুকে চলে। গয়জদ্দি যুগলেশ্বর—ইনতাজদের নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয় শরদিন্দু। চণ্ডালিকার স্টেশন মাস্টার কলোনি হাইস্কুলের হেডমাস্টার। আর এসেছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা। বেশ একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার। ভাবে শরদিন্দু। গত ক’মাস আগেও এসব অত্যন্ত অসম্ভব ছিল। হাঙ্গামার ভয়ে ভদ্রজনেরা কোনোমতে আসতেন না। চাষিরা আসত না ঘৃণায় আক্রোশে। আজ শুধু রবাহুতের ভীড়টুকুই সামলানো যায় না সতরঞ্চি জুগিয়ে। নিমন্ত্রিতেরা সকলে উপস্থিত। কেবল শংকরীপ্রসাদ…………..মেকী আভিজাত্যের খোলসপরা নোংরা একটা মাকড়সা। ভদ্রতাবোধের বালাইটুকু নেই। একটু ক্লান্ত মনে হয় এবার। প্রাণান্ত পরিশ্রমে কিংবা তার স্বপ্নসৌধের কোনখানে ওই রোমশ মাকড়সার অস্তিত্ব কাঁটার মতো বিঁধছে বলে। কথা দিয়েও কথা রাখে না লোকটা। একটা জঘন্য ইতর। অথচ এই আয়োজনের পরবর্তী সবটুকুই নির্ভর করবে তার উপর। রাজা শংকরীপ্রসাদ—এদেশের মুকুটহীন রাজা। প্রাতঃস্মরণীয় রাখো রাজা দুর্গাপ্রসাদ রায়ের একমাত্র সন্তান। সনদে দস্তখত দিলে বাকিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে নির্বাক হলে এরা পাথর হয়ে যাবে।

—অন্তত তাই তার বিশ্বাস।

রাজা ঈশ্বরের অবতার। ইংরেজ ঠিক জায়গায় হাত রেখে কল টিপতো। সেই বৈদ্যুতিক ইন্দ্রজাল! হাঃ হাঃ হাঃ! বিকট হেসে ওঠে শরদিন্দু আনমনে। পরমুহূর্তে সামলে নেয়। হাসি সংক্রামক। তাতে স্বয়ং উদ্যোক্তার! বিশেষ করে অদ্ভুত—চরিত্র এবং কুখ্যাত বিলেতফেরত সায়েব চাষার—যে এখন দেশান্তরে কিছু কিছু লোককথার নায়ক হয়ে যাচ্ছে। তাই চারপাশে হাসি ওঠে পরক্ষণে। পরমুহূর্তে সবাই মিলে কারণ খোঁজে। ঝাব্বু সিং—এর গোঁফ? হাসিমের দাড়ি? নদেচাঁদের বায়ুসঞ্চালিত উড্ডীন শিরোশিখা? বিষয়ান্তরে মনোনিবেশের সুযোগ ঘটেছে। দুখানা জিপ কাঁচাসড়ক থেকে মাঠের ডহর পথে কচ্ছপের মতো হেলতে দুলতে এগিয়ে আসছে। জলকাদা মাটি দিয়ে গতকাল ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

সকলের আগে অর্ধেন্দু। খদ্দরের একপ্রস্থ পোশাকে ভারী মানিয়েছে। দিনে দিনে চেহারা বদলাচ্ছে তার। ভুঁড়ির একটু উপরে একটা ছোট্ট কো—অপারেটিভ ব্যাজ। শরদিন্দু ভাবে,আন্তর্জাতিক সমবায় সপ্তাহ পালন করতে হবে এবার নভেম্বরের শেষ দিকে। ওই ব্যাজ কিছু অর্ডার দিয়ে রাখবে আগে থেকে। অবশ্যি যদি ইতিমধ্যে ফার্মটা রেজিস্ট্রি হয়ে যায়।

ঘর্মাক্ত কলেবর অর্ধেন্দু ফিসফিস করে, মিস্টার কিং এসেছেন?

—না।

—হোপলেস! আমি তোমাকে ওখানেই বেশি প্রেশার দিতে বলেছিলুম।

—আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি।

দাদা যদি জানত ওখানে গেলে মনের অবস্থাটা কেমন হয়। শরদিন্দু আবার অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে। অর্ধেন্দুর স্বর। হেয়ার ইজ মাই ইয়ংগার ব্রাদার শরদিন্দু চক্রবর্তী। জাস্ট থ্রি ইয়ারস, ব্যাক ফ্রম ইউরোপ, ইউ এস এ, ইউ এস এস আর অ্যান্ড ইজরায়েল অ্যান্ড…..

—কনগ্রেচুলেশান ইয়ংম্যান। ভেরী প্লিজড টু মিট ইউ…..।

শরদিন্দু বিরক্ত। যত সব!

মাইকে গান বন্ধ হয়। ফুলের মালা পরে সভাপতি আসন গ্রহণ করেন। স্পীকারটা মুখের কাছে এগিয়ে দেয় অর্ধেন্দু। প্রথম বক্তা শ্রীনিবাস সাহা। ভেটারেন কো—অপারেটর।

আবার সেই ইংরেজি! শরদিন্দু ক্ষেপে উঠে সরে যায়। আসলে এসব লোকেরা জনসাধারণের ভাষায় তাদের বোঝার মতো করে গুছিয়ে বলতে পারে না কোনো কথা।

শ্রীনিবাসের উচ্ছ্বাস সমাপ্ত হল। মাইকে বিকৃত কণ্ঠের ভয়াবহ আস্ফালন থেমে গেল একটু। চুপ করে থাকা গুঞ্জন স্পন্দন আবার জেগে ওঠে সভাতলে। বাবা অবনী চক্রবর্তী ফিসফিস করে কী বলছেন গয়জদ্দি মণ্ডলের কানে। অর্ধেন্দু ইশারা করছে, চুপ করুন এখন।

বক্তার পর বক্তা। বিচিত্র কণ্ঠস্বরের মিছিল। অদ্ভুত বর্ণনাকৌশল। হাস্যকার ভঙ্গি। চণ্ডালিকার পূর্বমাঠে কবিতার বন্যা বয়ে যাচ্ছে একেবারে। শরদিন্দুর কাছে এগিয়ে আসে অর্ধেন্দু। তোমারটা ঠিক সভাপতির ভাষণের আগে, রেডি করেছ তো?

—হ্যাঁ।

—ইওরস গুড বি দি ভাইট্যাল।

শরদিন্দু মাথা নাড়ে। দাদা সরে গেলে হাসে। ক’দিন ধরে ভেবে ভেবে বিশ্লেষণ করে দীর্ঘ বক্তৃতার পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছে সে। আগামী উজ্জ্বল দিনের অফুরন্ত সম্ভাবনার সনদ। মানুষের শ্রেষ্ঠতম বিজয়ের ছবি। তার পথ, সংগ্রামের কৌশল এক এক করে তুলে ধরবে জনগণের সুমুখে পকেট থেকে পাণ্ডুলিপিটা বের করে চোখ বুলোতে চেষ্টা করে। ঠিক সেই সময় ঝাব্বু সিং একখানা চিঠি এগিয়ে ধরেছে।

—শংকরীপ্রসাদ বাবুকা লোক আভি পঁহুছা দিয়া।

চিঠিখানা হাতে ধরে একটু অবাক হয়েছিল সেদিন শরদিন্দু। গোটা গোটা হরফে লেখা তার নাম। মেয়েলি হস্তাক্ষর। তারপর খুলেছিল। বেশ গুছিয়ে লেখা। চিঠিখানা এক নিশ্বাসে পড়ার মতো। সেদিনের হেসে ওঠা মেয়েটার সঙ্গে মেলে না। প্রগলভা নিঃসন্দেহে। কিন্তু ব্যক্তিত্বময়ী! তার সহজ আবেদন প্রতিটি শব্দে। জনমুখর সভামণ্ডপের পাশে বর্ষার দিনশেষের গোলাপি আলোয় চিঠিখানা যেন ক্ষান্তবর্ষণ আকাশের সীমা দেওয়া নির্জন একটুকরো রঙিন মেঘ। শরদিন্দু বক্তৃতা দিতে উঠেছিল। একটু উদ্ধতভাবেই ঘোষণা করেছিল, আমার কথার প্রমাণ আমার কাজ। আড়ষ্ট ভাষায় শরীরে ক্লান্তির আলস্য এসে ঘোষিত ঔদ্ধত্যটা জনসাধারণ হয়তো নিছক ঔদ্ধত্য বলেই মেনে নিল। মানুক। শরদিন্দু আর পারে না। মরিয়া হয়ে যাচ্ছে।

নাবাল জমিতে ছোটখাট বন্যার সৃষ্টি হয়েছে যেন। এবার ফার্মের আমন ধানের ভাগ্যে কী ঘটবে বুঝি। শরদিন্দু চুপচাপ শুয়ে ছিল। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকে আসছে। থাক। বন্ধ করবে না সে। আজ বিশ্রাম। সকাল থেকে অনেক পরিশ্রমে শরীর পীড়িত।

একটা সিগ্রেট ধরায়। এ তার অলস চিন্তার অবলম্বন। জটিল ভাবনা থাকলে খায় না। অন্যসময় তো কদাচিৎ। এখন এই নীল ধোঁয়ার বিস্তারে ছড়িয়ে পড়ুক সহজ চিন্তাবস্তুর আকৃতিগুলো।

একটি প্রগলভ মুখ। হাসি। ঘনকালো ভ্রূ। মিনু। সে চিঠি লিখেছে তাকে।

কিছুই ছিল না, খানিক শৌখিন ভাবনা ছাড়া। কিন্তু চিঠির কথাগুলো সেতারের এক একটি তারের মতো নিপুণহাতে বাঁধা। বিখারী ঝংকার সব। স্নায়ু থেকে সরে না।

মানুষ কতটা পরিমাণে জৈবিক অঙ্ক কষে বের করা যায় না?

অকালে তন্দ্রার মন্থর মায়া। চেতনার বুক বেয়ে কুয়াশার মতো ঘনিয়ে উঠেছে এক অপরিচিত রাগিণী কীজন্যে মিশে যাচ্ছে নিবিড় হয়ে।

একটু সূক্ষ্ম করে তার চেতনাকে। মিনু নামে একটি স্বল্পপরিচিতা গ্রাম্য মেয়ে বসে বসে কলম ধরে একখানি চিঠি লিখেছে তাকে। আরও তীক্ষ্ন হয় চেতনা। সূচীমুখ তুলিতে আঁকা ছবি। গতদিনের রোদ্দুরের মতো কমলারং শাড়ির আরণ্য আদিম পৃথিবী থেকে বিচ্যুত অথবা বিচ্ছিন্ন একখানি হাত আর কিছু নয়। একখানি নগ্ন নির্জন হাত।

যার নির্জনতা ফোটানোর জন্যে অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষিত অকারণ।

হাঃ হাঃ হাঃ।

উৎকট হাসি শুনে চমকে ওঠে ঝাব্বু সিং। হুজরসাব টেবিল চাপড়ে হেসে উঠেছেন। চায়ের কাপ উলটে পড়ে গেছে। তাই কি হাসি? হাসিমের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। হাসিম বলে, ক্যা মালুম!

নদেচাঁদ অধরোষ্ঠ বিস্ফারিত করে বেরিয়ে আসে। ট্রাকটর অ্যাসিট্যান্ট মুকুন্দ নায়েক ডোজারে কালকের অসমতল হয়ে ওঠা প্যান্ডেলের প্রদর্শনীর জায়গাটা আবার ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ থেমে যায়। টগর, এলোকেশী বাসনমাজা ফেলে রেখে মুখ তুলে তাকায়।

পাগলের মতো হাসছে শরদিন্দু। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে দমকে দমকে হাসছে। নদেচাঁদ আরেক কাপ চা এগিয়ে দেয়। উঠে বসে শরদিন্দু।

—চিনি বেশি হয়েছিল সার। পাংশুমুখ নদেচাঁদ।

—অ্যাঁ? পলকে গাম্ভীর্য শরদিন্দুর।

—এবার কম দিয়েছি চিনি।

—কেন?

—চিনি বেশি হয়েছিল আগের কাপে। কীভাবে হয়ে গেল বেশি। কোনোদিন তো হয় না……..আমতা আমতা করে নদেচাঁদ।

—কে বলেছে চিনির কথা?

ধমক খেয়ে পিছিয়ে আসে নদেচাঁদ। ঝাব্বু সিং ফিসফিস করে নিশ্চিন্দিতলায়। হুয়া কুছ অদলবদল। কৈ চীজ মে।

পাণ্ডুর দিন। ঝোড়োবাতাসের ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টিও নামছে। ক্যাম্পের করগেট শেডে থেকে থেকে কর্কশ নাদ। একপাল কাক জমেছে টগরদের সুমুখে। বেড়ার কাঁটাতারে দোল খাচ্ছে ফিঙেপাখি। দূরে তালগাছের বেঁকে পড়া একথড়ি পাতা থরথর করে কাঁপছে অবিশ্রাম পাম্পিং মেশিনের ইঞ্জিনটার মতো। নিবিষ্ট মনে বসে সেখানে শিকরে বাজ।

সিগ্রেট মুখে বাইরে আসে শরদিন্দু। ধোঁয়ার রিং পাকানো যায় না উদ্দাম বাতাসে। রুক্ষ চুল কপালের উপর এঁকেবেঁকে পড়ছে।

—ঝাব্বু সিং।

—হুজুর সাব।

—হাসিম!

—সার।

—মেরা সাথ চলো। নদেচাঁদ।

নদেচাঁদ দৌড়ে বেরোয়। ও মেয়েরা, কাক বসেনা দেখো গো। সাব!

—আমার ফোলিওব্যাগ!

হুকুম সঙ্গে সঙ্গে তামিল। জাব্বু সিং ব্যাগটা হাতে নেয়। দেহরক্ষীসহ সম্রাটের মতো চলে শরদিন্দু আলপথ ধরে গ্রামের দিকে। উদ্ধত ভাবনা ভাবতে ভাবতে চলে সে!

লিবার্টি আত্মস্বাতন্ত্র্য অনন্যতা। কূট স্বার্থপরতার একই লাইনের বিবর্ণ গাড়ি সব। মিনু তাদের স্বাতন্ত্র্যের কথা লিখেছিল। গর্বভরে প্রকাশ করেছিল সে তথ্য। অথচ এসব আসলে কী? ব্যক্তি আপন অনন্যতা নিয়ে বিচরণ করবে। বাঁচবে, ভালোবাসবে, সুখী হবে। এ তো জীবনের চরম মূল্যের ব্যাপার। এসথেটিকাল অনন্যতা। অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের আওতায় যদি তার সঙ্গে কখনো বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে মরতে হবে সেই স্বাতন্ত্র্যকে। এটাই নিয়ম! কাজ। এই হচ্ছে আদত কথা। কাজের মধ্যে দিয়ে সত্যের উপলব্ধি। ব্যক্তি আপন অনন্যতা নিয়ে তার সামাজিক অস্তিত্বের মধ্যে বেঁচে থাকার শেষ সংজ্ঞা খুঁজে নিক। কিন্তু তাকে কাজ করতে হবে তার সামাজিক সত্তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে। ব্যক্তিক মুক্তির নামে অনন্যতাবাদের ছদ্মবেশী পোশাক পরে সামাজিক দায়িত্বকে এড়িয়ে গেলে চলবে না। তাহলে তাকে লিকুইডেটেড হতে হবে। এ কারুর মনগড়া নিয়ম নয়। প্রাকৃতিক অভ্রান্ত বিধান।

মিনুর চিঠি পাওয়ার আগে কি জানত না শরদিন্দু যে এসব লোকেদের স্বাতন্ত্র্যর বুলি কী পরিমাণে মর্মান্তিক হাস্যকর অথবা বিধ্বংসী। জানত। অথচ আজ আবার তার জবাব দিতে যাচ্ছে নতুন করে। কেন? মিনুর চিঠি পেয়েছে বলে? এতদূর এসে আর ফেরা যায় না। আজ শংকরীপ্রসাদের সুমুখে দাঁড়াবে সে তার পূর্ণ আত্মমর্যাদা নিয়ে। তাই কি এই হাসিম সেখ ঝাব্বু সিং? এত পালটা স্বাতন্ত্র্যের হিজিবিজি!

সিগ্রেট ছুঁড়ে ফেলে দেয় এতক্ষণে। স্মিত কৌতুকের হাসি মুখে। আকাশ দেখার ছলে মুখ তুলে মনে মনে বলে। আমি কি এখনও ছেলেমানুষ?

—তুমি এখনও ছেলেমানুষ।

শংকরীপ্রসাদ আরাম কেদারায় ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বলেন। আজ কলকণ্ঠ হাসি নেই। কেমন একটা অপরিচ্ছন্ন শৈত্যের আভাস তাঁর কণ্ঠে।

—আমি আশা করতে পারি যে ওকথাটা চরম জবাব নয়। শরদিন্দু চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দগুলো উচ্চারণ করে।

—না।

—তবে? উত্তেজিত শরদিন্দু। সে আজ শেষ কথা না শুনে যাবে না যেন?

উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারী করেন শংকরীপ্রসাদ। দরজার উপর ভেন্টিলেটারের কাছে চড়ুই পাখির দিকে চোখ তাঁর! বাইরে মত্ত বাতাসে উতরোল প্রাঙ্গণের বনানী। ফুলগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে! ঘাসের বুকে প্রজাপতির ঝাঁক। আবার দরজার মুখে এসে দেউড়ির দিকে তাকান! বারান্দায় দেহরক্ষীরা গতর এলিয়ে বসে আছে মেঝেয়।

হঠাৎ ঘুরে মুখোমুখি দাঁড়ান শংকরীপ্রসাদ! তোমাকে কিছু মিথ্যা বলেছি নান্তু! ইচ্ছাকৃত মিথ্যা!

বিস্মিত চোখে তাকায় শরদিন্দু!

—হ্যাঁ মিথ্যা। কিন্তু আমার……(গলা কাঁপে বলতে) আমার বংশের আমার বিখ্যাত পরিবারের মর্যাদা রাখবার জন্যে বলতে বাধ্য হয়েছি।

—কী মিথ্যা?

—আমি জানি তোমার মতে মত দিলে হয়তো আইনের দিক দিয়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হবে। যখন আমার পারিবারিক সম্মানরক্ষার নিরাপত্তা আসতে পারে।

একটু থামেন। আবার বলেন, কো—অপারেটিভ সোসাইটির হাত থেকে সহজে হয়তো ও সম্পত্তি কেড়ে নিতে সাহস পাবে না। কিন্তু আমার ভয়, যদি সত্যি বাধে, তাহলে….

খানিক পায়চারি করে বলেন, তাহলে সম্পত্তি বেহাতের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন আমার পারিবারিক মর্যাদার। সে বড় ভয়ানক দিন। আমার পক্ষে তা কল্পনা করা অসম্ভব, নান্তু।

শরদিন্দু কিছু বলতে পারে না। কথার উদ্দেশ্য খুঁজতে থাকে অবিশ্রাম।

—তুমি ভাবছ এসব কথা তবে কেন তোমাকে বলছি। বলার কারণ আছে বাবা।

লোকটার কথায় দুশ্ছেদ্য ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হয়ে যায় যেন। শরদিন্দু এই কুটুম্বিতা সইতে নারাজ। বলে, আমি বুঝছি না আপনার কথা।

সেকথায় কান দেন না শংকরীপ্রসাদ। বলেন, আর তোমার কথায় রাজি হলে তোমার আমার বা আরও পাঁচজনের অবশ্যই মঙ্গল হতে পারে, তা আমি বুঝি। অথচ তার ফলে কারুর উপর অবিচার হবে, সেইটে সইতে পারিনে। আমার সবকথা তোমার অস্পষ্ট মনে হবে। কিন্তু……..

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন, এইটুকুই আমার দুর্বলতা। পৈতৃক সংস্কারের ধারাবাহিকতা বলতে পারো। সারাজীবন একে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। কেন জানিনে। ধর্মভয় আমার নেই। ঠাকুর দেবতার বিশ্বাস কোনোদিন ছিল না…….

শরদিন্দু উৎকণ্ঠায় অধীর।

—হ্যাঁ। সত্যি নাস্তিক বলতে পারো আমাকে। বাবার অনেক কিছু পেয়েছি। অনেক পাইনি। তার মধ্যে এই ধর্মবিশ্বাস। বাইরে দেশাচার কুলাচার মেনে চলেছি এই মাত্র। আমার ব্যক্তিগত জীবনে এ নিয়ে আজও বিব্রত আমি। যাক এসব বাজে কথা। সবই করতে পারি, শুধু মানুষের উপর অবিচার করতে পারিনে—এসব শুনে তুমি সম্ভবত হাসবে মনে মনে। তোমাকে আমি ভালোবাসি বলেই অথবা ধরো তোমার প্রতি আমার কোনো মোহ আছে হয়তো তাই আজ সবকথা জানাতে ভালো লাগছে। অবশ্য আমার এসব সংবাদ তোমার জানার কথা নয়।

মাথা নাড়ে শরদিন্দু। এই ভূতুড়ে বাড়ির আদিম অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে সে। প্রাগৈতিহাসিক ঘনকালো এক যবনিকার অন্তরাল থেকে নীলরক্তের কাতর আর্তনাদ কানে আসছে তার। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বাতাস থমকে গেছে। ভিজছে অসহায় কোনো জন্তুর মতো এই সেকেলে দালানটা।

—আমার ধর্মবিশ্বাস নেই। ঈশ্বরে পরকালে আস্থা নেই। অথচ মানুষের উপর অবিচার করতে পারিনে। এ এক অদ্ভুত ঝামেলা!

ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে আছেন শংকরীপ্রসাদ।

কথা বলে শরদিন্দু। সম্পত্তি আপনার মেয়েরও নয়?

—আশা করি, আমার সবকথা তুমি মন নিয়ে শুনেছ।

—কার সম্পত্তি?

—যারই হোক, তোমার জেনে কোনো লাভ হবে না আপাতত।

—আপনার শেষ কথা কি এই?

—না। শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি।

আর কথা বলতে ভালো লাগে না শরদিন্দুর। উঠে পড়ে। স্নায়ুতে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। জরোদগব ব্যারনটার হেঁয়ালিপনা একটা বিশ্রী ন্যাকামির মতো মনে হয়েছে তার।

সিঁড়ি বেয়ে নামছিল শরদিন্দু। ডাকেন শংকরীপ্রসাদ। নান্তু!

শরদিন্দু ফিরে দাঁড়ায়। বলুন।

আমার শেষ কথা শুনে যাও।

শরদিন্দু আর ভাবতে চায় না। যা খুশি বলুক ও।

—তোমার দাদা কিংবা বাবাকে জানতাম। কিন্তু আমার মনে হয় তোমাকে এটুকু জানানো ভালো যে আমি তোমার কথায় রাজি আছি। আর…….একটু এগিয়ে আসেন সিঁড়ির কাছে বারান্দার শেষে। আর যেটুকু, পরে তোমার দাদার মুখে শুনবে। কেমন, খুশি হয়েছ?

—না।

—কেন?

—আমি জানি সেটুকু।

—তুমি জানো? কী?

—আপনার শর্তের কথা।

পলকে মুখ বিবর্ণ শংকরীপ্রসাদের। পরক্ষণেই একঝলক রক্ত উঠে মুখখানা আবার রাঙিয়ে দেয়। চাপা গলায় বলেন, কী শর্তের কথা তুমি জানো?

—আপনার কন্যার পাণিগ্রহণ করতে হবে।

কিছুক্ষণ অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। ঘোলাটে চোখে চেয়ে আছেন শংকরীপ্রসাদ। হয়তো কাঁপছেন। একসময় ধীরে ধীরে বলেন, কে বলেছে তোমাকে?

—নাম বলার প্রয়োজন দেখছি না।

—ও। জানো তো আবার কীজন্যে এসেছিলে নান্তু? বুঝি ভেঙে পড়বেন এবার। সত্যি কাঁপছে শরীর। লুঙ্গির নিম্নভাগ লক্ষ্য করে বুঝতে পারে শরদিন্দু।

—তার সত্যতা যাচাই করতে।

—আচ্ছা। আসতে পারো তুমি।

—কিন্তু এমন শর্ত আপনার মাথায় এল কীভাবে?

—আমি তো অন্যায় দেখিনি নান্তু।

শংকরীপ্রসাদের ভাঙা স্বর আরও উত্তেজিত করে শরদিন্দুকে। বলে, অন্যায় নয় শুধু; অন্যের মর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকর।

—এত মর্যাদাবোধ তোমার নান্তু? দরজার দিকে এগিয়ে যান শংকরীপ্রসাদ। শরদিন্দু সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়।

শরদিন্দু কল্পনা করছিল কীভাবে একটা বিষদন্তবিহীন স্থবির গোখরো সাপ ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে গর্তে লুকিয়ে যাচ্ছে। অভ্যাসমতো দেউড়ির দিকে চোখ তুলে চেয়েই দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। দেহরক্ষীরা তাড়াতাড়িতে ছাতা আনতে ভুলে গেছে। তাই ভিজতে ভিজতে চলল পেছনে।

এবার এতক্ষণে পেছন ফিরল শরদিন্দু। শংকরীপ্রসাদের বাড়ির উপর রোদ্দুরের খেলা। এখানে বৃষ্টি। মেঘের ছায়া এখানে। ওখানে একটা পাখির মতো ডানা মেলেছে খানিক আলো। নির্জন কোনো দ্বীপ বাইরের উদভ্রান্ত সমুদ্রকল্লোলের মধ্যিখানে। অমসৃণ কর্কশ রুগণ এক অতীত বিষাদ। বুকে নিয়ে কাঁপছে কমলারং রোদ্দুরের বিলম্বিত মন্থর একটা টুকরো। যা থেমে পড়া একটু সময়ের মতো। এতক্ষণে মনে পড়ে যায়। ক্ষীণ স্বপ্নের মৃদু মূর্ছন জেগে উঠেই থেমে গেছে আবার। এর পর আর কোনোদিন ওখানে ফেরা যায় না।

মাঠে নেমে প্যান্টের পকেটে হাত ভরে চিঠিখানা বের করে শরদিন্দু। খুলে দেখতে যায়। আবার ভাঁজ করে ভরে রাখে। হাসতে হাসতে পথ চলে। আকাশে শঙ্খচিলের কান্না।

মুকুন্দ নায়েক খাওয়া সেরে সবে সিগ্রেট ধরিয়েছে। জাব্বু সিংকে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে। কী খবর নন্দীভৃঙ্গীদা?

—কোন খবর?

—গয়া থা কাঁহা?

—শংকরীপরসাদ কা ঘর।

—কৈ ঝামেলাকে লিয়ে। না ক্যা?

—আরে, ঝামেলাসে বড়া। চোখ বড় করে বলে ঝাব্বু। মুকুন্দর সঙ্গে কদিন থেকে ভারী ভাব জমে গেছে তার। উপলক্ষ্য কুনাই মেয়েদের সম্পর্কে রসালো আলোচনা। ফিসফিস করে বলে ঝাব্বু উ যো শংকরীবাবুকা বেটী হ্যায় না?

—হাঁ হাঁ। মুকুন্দ অধীর।

—উসিকো তো বিহা করনে লাগে সাহাব।

—কৌন বোলা?

—হাম আপনা কান মে শুনা। আভি তো উও বাচচিৎ করতা থা সব।

মুকুন্দ একগাল হেসে হাত বাড়ায়। আও মেরা জান!

ঝাব্বু সিং উঠে পড়ে। আঃ হা, খানেকা বন্দোবস্ত করনে হোগা ভেইয়া।

উনুনের কাছে যেতেই নদেচাঁদের শান্ত স্বর কানে মধুবর্ষণ করে, বাবু তোমাকে খেতে বলেছেন সিংজী। চান করে এসো।

আকর্ণ হাসে ঝাব্বু। মুকুন্দকে বলে, দেখতা হ্যায় ক্যা? হুজর সাবকা মেজাজ ক্যায়সা আচ্ছা হো গয়া!

আবার হাত বাড়ায় মুকুন্দ। আবার সশব্দ করমর্দন। হাসিম সেখ অবাক।

মেঘমেদুর আকাশের দিগন্তে একফালি রোদ্দুর। এদিকেই এগিয়ে আসছে। কাটা তরমুজের মতো লাল মেঘখানার নীচে সূর্যের বিষণ্ণ মুখ। ক্লান্ত অপরাহ্ণের ঠোঁটে দিনের শেষ গান! পূরবীর ব্যঞ্জনায় কাতর হয়ে উঠেছে মাঠ। তারপর একসময় ধীরে ধীরে মূর্ছিত বাতাসের বুকে ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যায় পদধ্বনি। দিনান্তের দিগন্তে উঁকি মারে ঘোমটাপরা ধূসর মায়া। একটা মোটা লাল তারা উদাস আকাশের বুকে সন্ধ্যার প্রথম চুম্বনের স্বাক্ষর হয়ে জাগে। মাঠ থেকে কৃষকেরা উঠে যাচ্ছে একে একে। মুকুন্দ নায়েক গোডাউনের চাবিগুলো এগিয়ে দিচ্ছে হাসিমকে। হাসিম তালাগুলো টেনে পরখ করে নিচ্ছে। ঝাব্বু সিং খাটিয়ার শুয়ে গুনগুনিয়ে গান ধরেছে। ওদিকে বিসর্পিল ধোঁয়ার অন্তরালে গ্রামের বুকে মিশিয়ে গেল টগর আর এলোকেশী।

ইজিচেয়ারে শুয়ে শরদিন্দু আকাশের দিয়ে চেয়ে আছে।

মিনু শর্তের ব্যাপারটা গোপন করতে লিখেছিল তাকে। উত্তেজনার বশে সে কথা মানেনি শরদিন্দু। তাই একটু দ্বিধা। কিন্তু আর ও—বাড়ি যাবে না সে। বুড়ো হায়নার হাসি শুনে স্নায়ুকে অযথা বিপর্যস্ত করা।

আর রহস্য! নীলরক্তের রহস্য!

এমন অনেক সে শুনেছে, পড়েছে কেতাবে। ওদের অনেক রহস্য থাকে। ঘূণধরা মগজে অকারণ ঘুরে বেড়ায় বিশীর্ণ কঙ্কাল প্রেতের মতো। ওদের জীবন এসব হাস্যকর আতঙ্কের বিষে যন্ত্রণাকাতর হয়ে থাকে।

আর কী আশ্চর্য, বিবেকবুদ্ধি উদারতা মহত্ত্ব এসব গুণে ভরা মানবতার খোলসটা কখনো গায়ে চাপায়। প্রতারণা করে স্বার্থসিদ্ধির জন্যে।

লিখেছিল মিনু, দাদুর কাছে পাওয়া অন্তত একটা জিনিস তারা সযত্নে রক্ষা করে আসছে, তা হল উগ্র আত্মস্বাতন্ত্র্য। মানবতার প্রকাশ যদি কিছু থাকে, তা অপ্রাসঙ্গিকভাবে লব্ধ। আকস্মিক মাত্র।

আর লিখেছিল, শরদিন্দু যেন এই অমর্যাদাসূচক শর্ত মেনে না নেয়। সে অমর্যাদা শুধু ব্যক্তিগত আধারের নয়, মানবতার। অবশ্য শরদিন্দুর কাছে মানবতার প্রশ্ন নিশ্চয়ই অবাস্তব নয়।

না, নয়। ভাবে শরদিন্দু। জমি যারই হোক (মৃণ্ময়ী লেখেনি) তাতে কিছু আসে না। কিন্তু বিয়ে…

সমবায় গড়তে হলে বিয়ে করতে হবে। ভারী অদ্ভুত লোক শংকরীপ্রসাদ। কিংবা সবটাই চাল। আভিজাত্যের আধারে রেখে আত্মস্বাতন্ত্র্যের পচা ডিমটা এসব বানানো কথার পুরু পালকে ঢেকে তা দিতে চায় নির্বিঘ্নে।

একঝাঁক রুপালি তারার পাখি রাত্রির প্রান্তরে কখন বসে পড়েছে নিঃশব্দে। মেঘমুক্ত আকাশ। ওঃ হেয়ার ইউ আর!

একটু নড়ে বসে সে। ধরা যাক কোন গুপ্ত বংশকলঙ্কের অস্তিত্ব এ জমির সঙ্গে জড়িত। তাহলে…

একটু হালকা মন এতক্ষণে। উঠে খানিক পায়চারি করে। গ্রাম্য সামন্তটার কীটদষ্ট মরচেধরা মগজে পৌঁছেছে শরদিন্দু। আমাকে জামাইরূপে লাভ করলে সবদিক থেকে নিরাপদ সে। তাই মানবতার একটু বুলি আওড়ে আমাকে তার সমস্যাটার পশ্চাদ্ধাবন করতে চেয়েছিল। যদি আমি তার অসহায়তার প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হতে পারি!

ভাবল শরদিন্দু আমার অনুমান যদি সত্য হয়, তাহলে আবার আমার ডাক পড়বে ও বাড়িতে। এতদূর এসে আর পিছিয়ে যাবার সাহস শংকরীপ্রসাদের হবে না। জাস্ট টু ওয়েট অ্যান্ড সী দি আলটিমেট।

—নায়েক!

—স্যার।

—গোডাউনের দুনম্বর দরজার তালাটা বদলে ভালো তালা লাগাও।

মুকুন্দ একটু ভয় পেয়ে যায়। ওখানে পেট্রোল ডিজেল কেরোসিনের আড্ডা। কোনো হাঙ্গামা হবে নাকি?

শংকরীপ্রসাদ আবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শরদিন্দু অনুমান হয়তো একেবারে নিখুঁত নিশ্ছিদ্র। অর্ধেন্দুকে তিনিই চিঠি লিখেছিলেন চণ্ডালিকা আসতে। এল অর্ধেন্দু। শরদিন্দু আগে বাড়ি গেল দাদার সঙ্গে। দাদা বললেন, মা তোমাকে ডেকেছেন। ভারী উৎসাহী অর্ধেন্দু। সারাপথ চলল তিল তিল বিশ্লেষণ করে শংকরীপ্রসাদ শর্তের যাথার্থ্য। শরদিন্দু কোনো জবাব দিল না। তাই বুঝি বলল, মা তোমাকে ডেকেছেন। আগে মার সঙ্গে দেখা করো।

বাবা আজকাল অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তক্তপোশে শুয়েছিলেন। মাথার কাছে বোন অনিমা। দাদাদের দেখে ভারী খুশি। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। মা দরজার কপাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর পায়ের কাছে একটা বেড়াল আরামে বসে ছিল। বারান্দায় টাঙানো খাঁচায় ময়নার নিটোল স্বর। নারকেল গাছের পিছল পাতায় সিক্তপক্ষ কাক। পিকাসোর সেই ছবির মতো।

শরদিন্দু চেয়ারের হাতল ধরে দাদার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

মা মাথায় হাত রাখলেন। শরদিন্দুর কান্না পেল। নাক দিয়ে জল এসে গিয়েছিল যথারীতি।

না। সবই দুর্বিপাকে গড়ে তোলা আজগুবি স্বপ্নের বাঁধা। শরদিন্দু বলল, না।

মিনু, মৃন্ময়ী। শুধু নিজের জৈবিক অস্তিত্বের বুকে সূক্ষ্ম একটু স্পন্দন। আর কিছু না। শরদিন্দু জীবন চায়। জৈবিকতার উপরিস্তরের অনিবার অনাবিল জীবন। (আর তার মতে বিজ্ঞানের চরম লক্ষ্য তো এইটেই হওয়া উচিত) ছন্দ চায়। যা চৈতন্যের নিখাদে তরঙ্গ তোলে গভীরতম সত্যের। গানের জন্যে সে তৃষিত—যে গান মুক্ত জীবনের ষড়রাগে ছড়িয়ে দেয় অস্তিত্বের আত্মপ্রতিষ্ঠার বর্ণিল ইন্দ্রধনু। বড় অস্পষ্ট তার এ জীবনবেদ। অনন্য অনবদ্য। কিন্তু আশ্চর্যভাবে। প্রাকৃতিক বিধানের সঙ্গে নিবিড়তম বন্ধনে বাঁধা—যে বিধানকে জয় করেছে, নতি স্বীকার করিয়েছে, তারপর বুকে তুলে নিয়েছে মানুষের জীবন। আশ্চর্য তার সাধ। ভাষায় প্রকাশের চেষ্টায় তা খণ্ডিত হয়ে যায়। অথচ নিজের মধ্যে আপন মহিমায় ভাস্বর। অনুভূতির প্রান্তে প্রান্তে সাবলীল তার ব্যাপ্তি। এরা কেউ বুঝবে না। মা বাবা দাদা অনিমা। আর শংকরীপ্রসাদ। আর মৃন্ময়ী। কেউ না।

শরদিন্দু ছুটে বেরিয়ে এল ভিজতে ভিজতে। অনিমা কেবল চেঁচিয়ে উঠল। সে শুনল না।

জয়েন্ট ফার্মিং কোঅপারেটিভ!

দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল শরদিন্দু। তার জীবনযাপনের এই সোপান ঘিরে সামন্তবাদের এক বিষণ্ণ প্রেত—তার নাকিস্বর ভূতুড়ে কান্না। আর কোনো প্রান্তে এই একটি মেয়ে।

মিনুকে সে দেখেছে আশৈশব। স্মৃতির ধূসর রাজ্যের চিলেকোঠায় হেলাফেলায় একটু সঞ্চয়। দূর বাল্যের জনহীন বনানীতে তার নামে কী ফুল ফুটেছিল একদিন? একদিন বড় হল সে। ভাবতে শিখল, জানতে চাইল। জৈবিক ক্ষুধাতৃষ্ণার বাসনাকামনার আভাস এল তার অস্তিত্বে। তখন মিনু অনেক দূরে। সে তাকে দেখতে পেল না। কলকাতায় ছাত্রজীবন কাটল আগাগোড়া। অনেক মেয়ের সান্নিধ্যে এসেছিল। ভালোবাসা পেয়েছিল। শরীরের তৃষ্ণারা তখন একে একে পাপড়ি মেলেছে সুগন্ধি ফুলের মতো। অথচ সে ছিল আপন অস্তিত্ব নিয়ে উন্মাদ। নিজের তৈরি এক বিচিত্র জগতে ছিল তার বাস। সেখানে পুরনো বর্তমান কোনো সময়ের রেখা নেই, সবটাই ভবিষ্যৎ। চলাফেরায় কথাবার্তায় আকার ইঙ্গিতে সবদিকে প্রকাশ পেত তার অদ্ভুত আগামীত্ব। তাই বন্ধু ছিল অনেক, ছিল না সঙ্গী। কী বিশ্রী কাপট্যের খোলসে ছদ্মবেশ ধরে চলছিল সে। তার তীব্রতা—অসহনীয়ভাবে তুলে ধরা তীব্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনের সঙ্গে ধরার সাধ্যি ছিল না কারুর। সে এক নিঃসঙ্গ জগৎ। তৃষিত পথপরিক্রমা।

আর এই একাকীত্ব তাকে দিয়েছিল দুটো জিনিস। একটা হচ্ছে দূরে দাঁড়িয়ে দেখার ফলে মানুষের আদিঅন্তহীন ব্যক্তির মহাজীবনকে চেনার মতো দুর্লভ শক্তি। ব্যক্তিকে চিনতে শেখেনি সে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে জৈবিক বাসনাকামনাকে নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত দায়িত্ববোধ। যা সহজে নষ্ট হতে পারত সাধারণ্যের নিবিড় স্পর্শে, কেননা আসলে সে ভাবপ্রবণ।

তারপর চারবছর ধরে ক্যালিফোর্নিয়ার মাঠে। মেক্সিকো, ইজরায়েল। ফিরল ভারতবর্ষে। সরকারি কৃষিদপ্তরে ছমাস কাটিয়ে ছুটল ইউক্রেন। ফিরল এবার অবাধ স্বপ্ন আর আশা নিয়ে। শহরে নয় গ্রামে। চণ্ডালিকার পূর্বমাঠে। কোনো বন্ধনের মধ্যে নয়, নিজের পরিবেষ্টনীর মধ্যে থেকে আপন পথে চলার জন্যে তৈরি হল। তারপর কাজে নেমে বুঝল একক প্রয়াসের নিষ্ফলতা। আর ওদিকে অর্ধেন্দু সমবায়ের হিড়িক তুলেছে ঝিকটিপোতায়। শরদিন্দু পথ পেল খুঁজে।

আসলে মাটির সঙ্গে নিবিড় টান বংশানুক্রমিক। অবনী চক্রবর্তীর পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া। এটুকু ছিল বলেই এতদিন দেশবিদেশে যে—চোখ নিয়ে সে ফিরেছে, তা মাটি সম্পর্কে উগ্র এক অনুসন্ধিৎসার। বায়োধর্মের আলো জ্বলেনি সে চোখে।

ভাবতে ভালো লাগে না সে কথা। রক—এন—রোলের উদ্দাম লাস্যলীলার চেয়ে ইউক্রেনের মেয়েদের লোকসংগীত জীবনের জন্যে নিশ্চিত আরাম।

অবশেষে এল মিনু।

যার শারীরিক অস্তিত্ব নিছক এক অস্তিত্বই। যখন আবহমানকাল ধরে জন্ম নিয়েছে বেঁচেছে মরেছে, উদ্ভিদ প্রাণী শ্যাওলা শামুক অ্যামিবা। প্রকৃতির বিলম্বিত লীলানাট্যে এইসব দৃশ্য আর ভূমিকা।

তার কথা ভাবত না কোনোদিন। নাকি ভাবত আপন অজ্ঞাতে। নইলে এই উত্তেজনা, এই উত্তাপ, এই জ্বালা! তার শারীরিক উপস্থিতির বাস্তব এক নগণ্যতম কিছু জীবনে। সেদিন তাকে দেখল শরদিন্দু। যে হেসে উঠেছিল, উচ্ছ্বসিত হয়েছিল, কৌতুকে টলোমলো হয়েছিল এক রাশভারী পুরুষের টুপি পড়ে যাওয়া দেখে। তারপর তার চিঠি। শংকরীপ্রসাদের কুটিল শর্ত। আপাতদৃশ্যে অসংগত অনিপুণ ঘটনা সব। সাধারণ মানুষ এর থেকে চায় অনেক, আশা করে প্রচুর। ভেবে সুখী হয়। আর শরদিন্দু?

শংকরীপ্রসাদের তোরণের আগে বিরাট অশোক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে তখন লজ্জা পেল শরদিন্দু। না, সে কিছু আশা করে না। চিন্তার প্রিজমে ধরে রাখতে চায় এই বর্ণালী। বিশ্লেষণ করতে চায় জীবনের আলোক তরঙ্গ, নিছক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা।

প্রাঙ্গণ পেরোলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠল। শংকরীপ্রসাদ তার জন্যে প্রতীক্ষায় অধীর। শরদিন্দু চোখে চোখে চেয়ে বলল, না।

একটি মাত্র শব্দ। তারপর অখণ্ড নীরবতা। শংকরীপ্রসাদ পায়চারি করলেন। বসলেন। আবার উঠলেন। বাইরে গেলেন। ফিরে এসে আবার বসলেন।

বলল ‘না’। কিন্তু কত বিচলিত হয়ে উঠেছিল ভেতরে শরদিন্দু। মাথার মধ্যিখানে এই ঐতিহাসিক দালানের অন্ধকারে কোণে বুনোপায়রাদের মতো অন্ধ পক্ষবিধুনন, অস্বস্তিকর আলোড়ন। কী যেন সরে যায় জীবন থেকে। মিশিয়ে যায় তার জীবনে কুড়িয়ে পাওয়া একফালি কমলারং রোদ্দুর এই স্থাপত্যের উদ্ভট কারুকার্যের ফাটল দিয়ে।

পিকাসোর ছবির সঙ্গে আল্টামিরা দরঁদোর গিরিগুহায় আঁকা আদিম ছবিগুলোর কোথায় যেন একটা সঙ্গতি আছে। একথা আচমকা মনে হল কীজন্যে!

শংকরীপ্রসাদ বললেন, আচ্ছা, এসো।

বেরিয়ে এল শরদিন্দু। প্রাঙ্গণে পৌঁছে মাথার উপর সহসা একঝাঁক কবুতরের ডানার ধ্বনিপুঞ্জ। ছাদে দাঁড়িয়ে মৃন্ময়ী। হ্যাঁ, মৃন্ময়ী ওড়াচ্ছে। শরতের উজ্জ্বল সত্য ক্ষান্তবর্ষণ আকাশের নীল—নীল বুক বেয়ে স্বর্ণরোদ ধারণ করেছে একঝাঁক শ্বেতধূসর কবুতর।

দেখল শরদিন্দু। মানুষের জীবন কারুর হাতে ওড়ানো পায়রা নয়। হতে পারে না।

ক’জন অতিথি এসেছিলেন শহর থেকে। অর্ধেন্দুর সঙ্গে। অবশ্যই সরকারি লোক। উদ্দেশ্য শিকার আর পিকনিক। গয়জদ্দি মণ্ডল যুগলেশ্বর আর ইনতাজ সরদারও নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কেবল এলেন ইনতাজ সরদার। খানাপিনা স্ফুর্তি চলল রীতিমতো হইচই করে। ইনতাজ টলেছেন। অনেক টাকার মালিক। স্টেশন সোনাডাঙা রোড পাশ করার জন্যে ভয়ানক উৎসাহী। বাস কেনার মতলব আছে ভবিষ্যতে। চলে গেলেন একে একে।

শরতের শিশির জমানো পরিচ্ছন্ন আকাশের নীচে আবার নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে মাঠে।

চারটে হ্যাসাগের আলো নতুন কোনো স্পন্দন তোলে না। শরদিন্দু দাদার রেখে যাওয়া কাগজপত্তর পড়ছিল বসে বসে।

গোডাউনের পাশে একটু ফাঁকা জমি। তরিতরকারির লতানে গাছের মাচা সেখানে। টগর এলোকেশী তখন বাড়ি ফেরেনি। ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ওদের খাওয়া আজ এখানেই। তাই অপেক্ষা করছিল পুরুষদের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত।

ঠিক সেই সময় শুনল মাঠের উত্তর প্রান্তে একটা হইচই। শরদিন্দু কাগজের স্তূপে ডুবে আছে নিবিষ্ট মনে। টগর ছুটে গিয়ে ডাকে রান্নাঘরের সুমুখে, ও ঠাকুরমশাই, ও স্যাকবাবা, খাওয়া হল নাকিন?

মুখ তোলে চারজন পুরুষ।

—মাঠে কী কাণ্ড বেধেছে।

—কতি, কতি?

হাসিম একটু তফাতে খাচ্ছিল। আস্ত এক লুচি গালে ভরে চিবোয় সে।

—হুই শোনো।

হাসিমের ত্রিফলা বল্লমের শানানো মুখে আলো ঝকমক করে ওঠে।

—স্যার, স্যার!

মুখ তোলে শরদিন্দু। তারপর উঠে দাঁড়ায়।

—উত্তর মাঠে দাঙ্গা বেধেছে।

—কার সঙ্গে?

—আমাদের জাগালের সঙ্গে মনে হচ্ছে।

বন্দুক আর টর্চ হাতে বেরিয়ে আসে শরদিন্দু কার্তুজের মালা পরে। তীব্র আলোয় অন্ধকার মাঠ ফালা ফালা করে দেয়। শব্দ ওঠে বন্দুক থেকে। অন্ধকার আদিম হিংস্রতার নিকষকালো পাঁচিলে দোলা লাগে। কেঁপে উঠেছে কী ভয়ংকর আবির্ভাবে নির্জন নিঃশব্দ প্রেতপুরী।

—হাসিম এগিয়ে যাও দ্যাখো।

তার আগেই হাসিম ছুটে গেছে। ঝাব্বু সিং লাঠি হাতে পাশে দাঁড়িয়ে। শরদিন্দু ঘটনাস্থলের দিকে চোখ রেখে বলে, ঝাব্বু সিং।

—হুজুর সাব।

—তুম হেঁয়া খাড়া থাকো। দরজা সব বন্ধ করো। মুকুন্দ!

মুকুন্দর শীর্ণ রোগাপটকা শরীরে ত্রাসের ভার। কাঁপছে দারুণ উত্তেজনায়। অনেক এমন দেখল, তবু ভয় ঘোচে না বুঝি।

—গোডাউনের দরজায় যাও।

ভয়ে ভয়ে মুকুন্দ সরে যায়।

—নদেচাঁদ আমার সঙ্গে এসো।

নদেচাঁদ ভয়ে কাঠ। বিপন্ন মুখে বলে, রান্নাঘর!

—রান্নাঘরে মেয়েদুটো থাক। তুমি এসো। হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। কাঠের পুতুলের মতো পেছনে চলে নদেচাঁদ। শিশিরসিক্ত ঘাসে পা পিছলে যায়। তারপর পেছন ফিরে দেখে। বলে শরদিন্দু, তুমি দূরে থাকবে। কিছু হলে আমার বাড়িতে খবর দেবে।

একটু চুপ করে। দ্রুত চলে। আবার শান্তকণ্ঠে বলে। আমার প্রাণের চেয়েও দামী জিনিস আমার ঘরে আছে।

আছে জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র। পুরনো আমলের প্রজাদের অনেক খাঁটি ও জাল ইস্তফাপত্র নীলামের কাগজ মোকদ্দমার নথিপত্র। আরও অনেক কিছু। অর্ধেন্দু রেখে গেছে আজ। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে বলে গেছে। আইনগত জটিলতার গিঁট ছাড়াতে শরদিন্দুর ওসব ভালোভাবে জানা দরকার। তার ফার্মের মাটির সবকিছুর উপর পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। এতদিন ওসব দেখত অর্ধেন্দু। এবার সে নিজেও দেখতে চায়। তাই রইল ঝাব্বু সিং দৈত্যের বুক ফুলিয়ে লাঠি হাতে তার ঘরের দরজায়।

কোলাহল একটু থেমেছে ততক্ষণে। দিগন্তে চণ্ডালিকা সুঁদিপুর সোনাডাঙার বুকে এলোমেলো আলোর দীপ নড়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকেরা বুঝি টের পেয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। গোডাউনের দরজা থেকে নিঃশব্দে সরে আসে মুকুন্দ নায়েক। ঝাব্বুর কাছে এসে দাঁড়ায়। তর্জনী তুলে দেখিয়ে দেয়। রান্নাঘরের সুমুখে দাঁড়ানো দুটি মেয়ে। ভেজা পায়রার মতো আতঙ্কে নির্জীব। ঝাব্বু চোখ তুলে তাকায় একবার। তারপর মাঠের দিকটা দেখে নেয়। দুজনে এগিয়ে যায় আস্তে আস্তে। নিশ্চিন্ত সুযোগ আর অবসরের পটভূমিতে জেগে উঠেছে আরেক হিংস্র ক্ষুধিত কামনা। দুটি শিকারি বেড়াল এগিয়ে যাচ্ছে সন্তর্পণে। এ মাঠের রক্তপিপাসু জান্তব অবয়ব থেকে আরও দুটি নগ্ন শানিত থাবা।

একটু দীর্ণ আর্তকণ্ঠ। একটু অস্পষ্ট জান্তব শব্দ। তামসীরাত্রির বুক কেঁপে ওঠে মৃদুতম। তার একটুকরো বেদনা সমীকৃষ্ণ এলোনো কেশের আলোড়নে খসে পড়ে মাটির বুকে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর আকাশের প্রান্তে। একটা অতর্কিত উল্কার স্খলন। তারপর দুর্মর তমসা।

এই পলকহারা জাগর রাত্রি অশ্রুর ফোঁটার মতো লাউ—এর পাতার নীচে অন্ধকার, আর্দ্র মাটিতে টুপটাপ নীহারকণার বিষণ্ণ স্বর।

হাসিম সেখ খালের জলে ভাসিয়ে নিয়ে আসছে একটা অতিকায় মাছ। ত্রিফলা বর্শায় বেঁধা।

শরদিন্দু আগেই ফিরেছে ক্যাম্পে। ক্যাম্পে সব ঠিক। টগর এলোকেশী কখন চলে গেছে। শুধু রান্নাঘরের পাশে রাঙা গাঁদার গাছগুলো কোনো জান্তব আস্ফালনে মাটিতে লুটিয়ে গেছে।

জাগালেরা চলে গেছে হাসনাবাদের খোঁয়াড়ে একপাল মোষ নিয়ে। ঘটনা নতুন কিছু নয় এ পরগনায়। তবে ফার্মের ইতিহাসে আকস্মিক এবং একটু অদ্ভুত। সুঁদিপুরের গয়লারা এত দুঃসাহসী হল কীভাবে! তারা অবশ্যি শরদিন্দুর বন্দুকের সাড়া পেয়েই অন্ধকারে গা—ঢাকা দিয়েছিল? কেবল একজন পালায়নি কীজন্যে। তাকে গেঁথে নিয়ে আসছে হাসিম বঁড়শিবেঁধা মাছের মতো।

শরদিন্দু এখানে উদ্বিগ্ন। টর্চের আলোয় কিছুক্ষণ খুঁজেছিল। পায়নি হাসিমের সাড়া। হাসিম খালের ধারে ধারে ঘসে কাদায় পা ফেলে আসছিল তখন। মাছটা ওজনদার। ক্লান্ত হাতের জোর ফুরিয়ে আসছে। লাঠির আঘাতে সর্বাঙ্গ বেদনা জরোজরো। সে রক্তাক্ত শরীরে পৌঁছলো ব্রিজের কাছে। ক্যাম্পের ঠিক নীচেই। মাত্র ক’পা পথ। শেষ শক্তি দিয়ে টেনে তুলল পাড়ে অতিকায় দেহটাকে। তারপর টর্চের কথা ভাবল। নেই। কখন পড়ে গেছে। পকেট থেকে দেশলাই বের করল তখন। জ্বেলে মুখের উপর ধরল। চেনা মুখ। বল্লমের একটা ফলামাত্র বিঁধে রয়েছে মাথায় কানের পাশ দিয়ে। আর দুটো সমান্তরাল হয়ে বাইরে রয়ে গেছে। রক্তাক্ত মুখটা স্পষ্ট চিনতে পারে না সে।

এবার একটু গোঙানি এতক্ষণ পরে। একটু আড়ষ্টস্বর। স্যাক।

—কী রে শালা, মরিসনি দেখছি! হাসিম চমকে ওঠে। মরেছে ভেবে বৃথা টেনে এনেছে সে। কোথাও লুকিয়ে পুঁতে ফেলবে এই ইচ্ছে করে অযথা এত পরিশ্রম।

—শক্ত পেরান স্যাক, জেবন যায় না।

—কোন শালা তুই?

—তুমার আঁতুর খুলে লাও স্যাক। এট্টু পাত্থনা।

মাথায় পা রেখে বাঁশের দণ্ডটা সজোরে টানে হাসিম। ফলার গোড়ায় বাঁধা শক্ত দড়ি ছিঁড়ে যায়। বাঁশ খসে আসে ফলা থেকে। ফলাটা তেমনি রইল। একটুও নড়েনি, বুঝি দাঁতে দাঁত চেপেছিল দুজনেই প্রচণ্ড শক্তিতে টান দেওয়ার সময়। হাঁপায় হাসিম।

খানিক বিরতি। আবার ক্ষীণ স্বর। স্যাক।

—থাম শালা শয়তানের বাচ্চা! পানি খাই এট্টু। বুক পিয়াসে কাঠ। খালের জলে মুখ রাখে উপুড় হয়ে পড়ে শুয়ে। এক পেট জল খেয়ে উঠে বসে। বলে, বলরে শালা গোয়ালা!

আমাকে শ্যাষ করে দাও স্যাক।

—আজরাইল তুকে না লিলে আমি কী করব?

—এট্টু জল দ্যাও তবে।

কথা বলে না হাসিম। ওকে শেষ করার মতো বিন্দুমাত্র মানসিক শক্তি অবশিষ্ট নেই তার! ডাকবে শরদিন্দুকে? খুনখারাবিতে ভয়ানক আপত্তি শরদিন্দুর! ঘটনাচক্রে হয়ে গেল! নিজের জান বাঁচাতে আঁতুর ছুঁড়েছিল সে! নইলে কী যে হত! একটু পরেই হয়তো জান যাবে ওর! কান খাড়া করে হাসিম! আজরাইলের কালান্তক ডানার গর্জন বুঝি আকাশের দূরান্তে বেজে উঠেছে এবার।

—জল।

ক্ষীণতম শব্দ। শিশিরে ভেজা ঘাসে মৃদু পায়ের শব্দ যেন। তারপর টর্চের তীব্র আলো। ছুটে আসে শরদিন্দু। একটু আগে জ্বলেওঠা দেশলাই—এর আলো সে দেখেছিল। তারপর অপেক্ষা করেছে কিছুক্ষণ। শেষে উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে আসছে।

পলকে দেখে নেয় সব। তারপর সজোরে এক চড় মারে হাসিমের রক্তাক্ত গালে। হাসিম চুপ করে থাকে। শরদিন্দু থরথর করে কাঁপছে উত্তেজনায়। ইউ রোগ, বাস্টার্ড!

হাসিম কথা বলে। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করে। আমি মোছলমান হয়ে হেঁদুকে মেরেছি বলে আমাকে মাল্লেন সার?

—না। তুমি একটা জানোয়ার বলে। তোমাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাব আমি।

গর্জে উঠতে গিয়েই চুপ করে যায় হাসিম। শরদিন্দুর হাত তার পিঠে। শরদিন্দু যেন কেঁদে ফেলবে। যেন কেঁপে উঠেছে ভেতর থেকে এক নিষ্পাপ অবোধ শিশু। গাঢ় কণ্ঠে বলে শরদিন্দু, আমি রক্ত দেখলে ঠিক থাকতে পারি না হাসিম। ওঠ ক্যাম্পে যা।

—ওটা?

—ব্যবস্থা হচ্ছে।

ঝিখটিপোঁতায় অর্ধেন্দু উদ্বিগ্ন। আবার মামলা! টাকার শ্রাদ্ধ। শরদিন্দুটা করে কী ওখানে বসে। ভাগ্যিস মরেনি লোকটা। বর্শার ফলাটা মগজে ঢোকেনি। কানের পাশ ঘেসে মাথার চামড়ায় বিঁধেছিল মাত্র, কেটে বের করা হয়েছে। যেমন শক্ত প্রাণ তেমনি সাহস আর শক্তি। এজলাসে প্রকাশ্যে বলল, যদি বাঁকুঘোষের ঔরসে আমার জন্ম হয়ে থাকে, হুজুর বাহাদুর সাক্ষী, এই আঁতুর আমি সেখের জন্যে রেখে দিলাম। অদ্ভুত লোক। নামটা কী যেন, উল্লাস ঘোষ।

বড্ড বোকা শরদিন্দু। লোকটাকে ওখানে বেঁধে রেখে থানায় খবর দিল না। বাড়ি পাঠিয়ে দিল সেবাশুশ্রূষা করে। ব্যাস অমনি শরদিন্দুরাই আসামী। উদারতার ফলাফল স্বরূপ ঘটল এই বিপর্যয়। কী অপমানজনক ব্যাপার, শরদিন্দু ইউরোপ আমেরিকা ঘোরা উচ্চশিক্ষিত ছেলে, হাজত খাটল একবেলা। খাটল ঝাব্বু সিং, হাসিম শেখ, নদেচাঁদ, মুকুন্দ আর দশজন জাগাল। জামিন নেওয়া হল তৎক্ষণাৎ, কিন্তু ঝাব্বু সিং, মুকুন্দর নামে আবার একটা আলাদা কেস। কুনাইপাড়ার দুটো মেয়ের উপর বলাৎকার। এসব মিলিয়ে ক্রমশ একটা বিশ্রী জটিলতার সৃষ্টি হতে চলেছে। গয়জদ্দি—যুগলেশ্বর এরা মুখে উৎসাহ দেখাচ্ছে ভেতরে নিষ্ক্রিয়। বড্ড ভাবায় এরা—এরা চণ্ডালিকা পরগনার লোকেরা। এলাকার সব গ্রামগুলোই হিংস্র দুর্ধর্ষ বন্য। শরদিন্দুর জন্যে ঠিক জায়গা নির্বাচন করা হয়নি। এর উপর নাকি কোনো অদৃশ্য হাতের খেলা চলেছে অন্তরাল থেকে। পাকা খেলোয়াড়ি হাত। লোকটা কে হতে পারে? এজাহারগুলোর মুসাবিদায় অভ্যস্ত নৈপুণ্যের ছাপ আছে। কোথায় চুরি করে ফসল খাওয়ানো, কোথায় রাহাজানি আর বলাৎকারের মামলা। শরদিন্দু নাকি ডাকাতের দল খুলেছে একটা। ফার্মের আবরণের নীচে নাকি আরও অনেক কুৎসিত দিক তার লুকোনো আছে। জাগাল দশজনের, বিশেষ করে হাসিমের অতীত কীর্তিকলাপ সবকিছুর জটিলতর করে তুলেছে।

শ্রীনিবাস সাহা আসে মধ্যে মধ্যে। লোকটাকে হাতে রাখা দরকার। অনেক সূত্র দিয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা মূল্যবান। উল্লাসের বাবা বাঁকু ঘোষ নাকি শ্রীনিবাসের এক বিধবা খুড়িকে নিয়ে দেশান্তরী হয়েছিল। মেয়েটি পরে হাতছাড়া হয়ে যায়। লজ্জায় ভয়ে আর সুঁদিপুরে পা দিতে পারেনি বাঁকু ঘোষ। ওর দৌরাত্ম্যে স্বজাতিকুলও কম তটস্থ থাকত না। সে এল অবশেষে চণ্ডালিকা ওখানে মাঠে জাগালী নিয়েছিল। একসময় অর্ধেন্দুদের জমিতেই ধান চুরির জন্যে অবনী চক্রবর্তীর হাতে ভীষণ প্রহার খেয়ে আবার নিরুদ্দেশ। হ্যাঁ, ক্লু বটে একটা। কিছু পুরানো লোক সাক্ষী হিসেবে চাই। আইনে টিকবে না। তবে আইনওয়ালাদের মনে খানিক ইম্প্রেশান গড়ে উঠতে পারে কেসটা সম্পর্কে।

অর্ধেন্দু উদ্বিগ্নচিত্তে সারা রাত্তির মাথা ঘামায়। মুনিসিপ্যালিটি মার্কেটিং সোসাইটি আর আড়ত চুলোয় যাক। এখন কালো গাউনটা সবসময় গায়ে চড়ানো তার।

হঠাৎ দেখা যায় শংকরীপ্রসাদকে। একদিন কোর্টের আশেপাশে ঘুরছেন। ব্যাপার কী? এগিয়ে গিয়েছিল অর্ধেন্দু।

—নমস্কার। মামলা নাকি?

একটু ইতস্তত করেন শংকরীপ্রসাদ। হ্যাঁ…. না…. ইয়ে একটু কাজ ছিল।

—চলুন। একটু কথাবার্তা কওয়া যাক।

শংকরীপ্রসাদ হেসে উঠলেন। তোমাদের কথাবার্তা মানে তো মামলা। ও আর ভালো লাগে না বাবা।

অর্ধেন্দুও হাসে। তারপর বলে, নান্তুকে সেফসাইড না করলে আপনাদেরও অসুবিধা। ও মাঠে আপনার জমি আছে। প্রতিবার এমন হচ্ছে, একটা স্থায়ী রেমেডি দরকার তো!

—রেমেডি! কিছু করার নেই সন্তু। আগে ও মাঠ থেকে পেতাম ক গাড়ি ব্যানাখড়। এরপর আবার তাই পাব হয়তো।

—যে সব সিরিয়স কাণ্ড চলেছে এরপর তাও পাবেন না বাবুকা। বাঁকীর বাঁধ কেটে দেয় যদি! অসময়ের ফ্লাডে খড়ের আশাও থাকবে না।

একটু ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থাকেন শংকরীপ্রসাদ। তারপর স্বভাবমতো আবার উচ্চহাসি। বলেন, সে ভয় নেই হে। বাঁধ কেউ কাটবে না। কারণ ও—মাঠে সব গ্রামের লোকেরই জমিতে ধান আছে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার দিন আর নেই বাবা। আচ্ছা, চলি তবে।

শংকরীপ্রসাদের হাসি কেমন তির্যক মর্মভেদী। পলকে শ্রদ্ধা পলকে ঘৃণা জন্মে দেয় মনে। অর্ধেন্দু মক্কেলের ডাকে এগিয়ে গেল।

গাবগাছের ঘন সবুজ চিকন পাতায় শারদ জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি। বুকের গাঢ় ছায়ায় পীতাভ দীপ জ্বেলে খেলা পেতেছে দেয়াশিনী জোনাকীকন্যারা। নীচে নগ্ন আর্দ্র বন্ধ্যা মাটিতে অন্ধকারের নির্জন মুখ। নিঃসঙ্গ কোকিলটা এইমাত্র ডেকেই থেমে গেল।

দাওয়ায় হেরিকেনের অস্বচ্ছ আলোয় অলক বসে। যে রতিকান্তর ছেলে। যে রতিকান্ত আর কোনোদিন দেখবে না নিবিষ্টমনে পাঠরত ছেলের মুখ।

পড়তে পড়তে কী একটা শব্দে মুখ তুলে চেয়েছে অলক। তারপর তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছে, ও কাকি, কাকিগো!

ছোটকাকা পটল দৌড়ে বেরোয় পাশের বাড়ি থেকে। কী হল রে অলকা, হল কী; বিন্দুর বাড়ি একটু নির্জনে গ্রামের শেষ প্রান্তে। গজরাতে গজরাতে আসে পটল। ঠিক ভয় পেয়েছে ছোঁড়া। মুখপুড়ির বিবেচনাটা দ্যাখো। একা নাবালক বাড়িতে এখে হাওয়া খেতে যেয়েছে। কী হল রে বাছা; ভয় পেইছিস নাকিন?

মিনমিন করে অলক। না গো। শ্যাল এসেছিল। হুই আড়া হতে মাছ নিয়ে পালাল।

—তাড়াতে পাল্লিনে; ভয় লাগল? হাবা ছেলা কতিকার। লে বাছা; পড় ইবার। দেখি কোন শ্যালের পো মুখ দেয় তুর আড়ায়। পটল বসে বসে পড়া দেবে। একখানা বই টেনে নিয়ে পাতা ওলটায়। সেই সময় বিন্দু আসে।

—ও বউদি, তুর পুঁকড়েটা ভয় পেইছিল শ্যাল দেখে।

হাসে বিন্দু। সত্যি নাকিন; দেরি হয়ে গেল আসতে। পথটা কম তো নয়।

—শহর যেইছিলা বুঝি?

উঠানের একপ্রান্তে ইট দিয়ে বাঁধানো জায়গায় দাঁড়িয়ে হাতমুখ ধোয় বিন্দু। বলে, না গো। ইস্টিশনে।

—কেনে?

—আর বলিস কেনে ভাই, আমার মরণ।

পটল উঠে যাচ্ছিল। ঘর থেকে ডাকে বিন্দু, পটলা যেলি নাকিন রে?

সাড়া দেয় পটল। ডাকো কেনে?

—এক কাজ করবি ভাই? মাথার দিব্যি তুকে।

—ঘোষের বাড়িতো! সি আমি বুঝেছি। কিন্তুক পারবোনা বাপু। ঘোষের মা আমার পিণ্ডি চটকে দেবে।

—দোহাই ভাই, একটিবার যা।

—উল্লেস তো হাসপাতালে।

মুখে কাপড় টেনে হাসে বিন্দু। নামুনে আটকুঁড়ের কথা শোন। হ্যাঁরে, বয়েসে তো কুলকিনের নাই, ঘরে সোমত্ত মাগ। এট্টু বুদ্দি কি হল না তোর কোনোদিন? এমন হাবা লিয়ে ছোটকীর চলে কী করে ভাবি।

—তা আবার কার কাছে?

—ওরে ড্যাকরা, নাড়ু ঘোষের বাড়ি। এই চিঠিটা দিয়ে আয় তো ভাই। বলবি, চণ্ডালিকার আজাবাবু দিয়েছে। খবদ্দার, কাকেও বলিস নে যেন।

—আজাবাবুর কাছে গেইছিলা তবে?

—আঃ জ্বালালে নামুনেটা। দাঁড়া তুর পিণ্ডি চটকে দি। কপট ক্রোধে জালের আড়কাঠিখানা টেনে তোলে বিন্দু। পটল দৌড়ে বেরিয়ে যায়। বিন্দু আসে ছেলের কাছে। ধপ করে বসে জড়িয়ে ধরে বুকে। মাণিক আমার, সোনা আমার, ভয় পেইছিলা গো!

মাথা নাড়ে অলক। ধূর, কে বললে?

—কখনো ভয় পেয়োনা। বেশ!

—যাঃ আমি ভয় পাই কবে। সেই যে কত আত্তিরে তুমি থাকো না, আমি একা থাকি।

—কবে রে বাছা? আমি না থাকলে তো তুকে কাকির কাছে রেখে যাই।

প্রবল মাথা নাড়ে অলক। কেনে, কত আত্তিরে ঘুম ভেঙে দেখি তুমি নাই।

মিষ্টি হাসে বিন্দু। বাইরে ঘাটে যাই হাতমুখ ধুতে।

ঘাটে যাওয়া মানে জৈব তাগিদে যাওয়া, তা বোঝে অলক। বলে অতক্ষণ ঘাটে থাকে নাকি কেউ?

—তুই করিস কী তখন?

—বালিশে এমনি করে মুখ ঢেকে পড়ে থাকি। মায়ের বুকে মুখ গোঁজে অলক। বিন্দু চেয়ে থাকে চাঁদের দিকে। বলে, আজ পড়া থাক। গপ্প শুনবি?

গল্প বলতে বলতে পটলের বউ সুখেশ্বরী আসে। বিন্দু হেসে বলে, তুর প্রাণনাথকে এট্টু কাজে পাঠিইছি ছোটকী, আগ করিসনে।

কাছে এসে বসে সুখেশ্বরী। হ্যাঁ দিদি, উদের মামলা খারাপ হয়ে গেছে।

একটু চমকে ওঠে বিন্দু! কে বললেরে? পটল?

—মরণ! উর কথা আবার মানুষ শোনে, চিনিবাসের পুকুরে আজ খ্যা দিতে যেইছিলাম; বৈকেলে উর জামাই এল ঝিকটিপোতা হতে। কী গপ্প কচ্ছিল তাই শুনছিলাম।

—মিছে কথা। বলে অন্যমনস্ক হয়ে থাকে বিন্দু তারপর। আবার বলে, ওই যে কোন হতচ্ছাড়া চারকপালে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। মরণ নাই লরকখেকোর। শুধু হট্টগোল বাধিয়েই এখেছে।

—উই সায়েবচাষার কথা বলছ?

—হ্যাঁ। উই লিমেগে আটকুঁড়োর।

—আজাবাবুর মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা শুনেছিলাম। কী হল জানিস দিদি?

—কেন? তুই করবি নাকিন?

—যাঃ ভারী কুমুখী তুই, দূর! গায়ে ধাক্কা দেয় সুখেশ্বরী। কিন্তুক নোকটা কেমন যেন বাপু! আজকন্যেতে মোন ভরে না।

বিন্দু ছেলের বই—এর পাতা উলটে ছবি দেখে। সুখেশ্বরীর কথা শোনে।

—তা লোকটার দোষ কী ভাই? অত শিক্ষিত লোক। কেমন চাষ কচ্ছে সোন্দর। গয়লারা গেল কেনে ধান খাওয়াতে? গজরায় সুখেশ্বরী। সিবার অমনি লিদুষী লোকটাকে মেরে ঝিলে ফেলে দিইছিলো। তুর সয়াকে গো।

—বেশ করেছিল। একতারাবাজানো হাতে লাঠি ধল্লে কেনে?

—তুর সয়া আর আসে না কেন?

—মরেছে। আমি জানি নাকিন?

সুখেশ্বরী অবাক হয়। অম্মা, কুটুম চটে যেয়েছে তাহলে। অ্যাদ্দিন বলিসনিতো। চটালি কেনে বাপু? খুব ভালো লোকটা। যেমন চেহারা তেমুনি গান। মানায় বাপু ভালো। বিন্দু মৃদু মৃদু হাসে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে তার এই হাসি আর চোখদুটো। মুখের ভঙ্গি। চাঁদের আলোয় তার দেহে এত মাধুর্য ঘনিয়ে উঠেছে, দুটি মেয়ের কেউ দেখছে না এখন।

বলে বিন্দু তুর পছন্দ হইছিলো সুখী?

রেগে ওঠে সুখেশ্বরী। যাও আর বক্তিমে কত্তে হবে না। অলককে ঘুম নেগেছে। খেতে দ্যাওগে।

অলক সত্যি ঢুলছে। বিন্দু উঠে যায় ঘরের ভেতর। ভাত বেড়ে ছেলেকে দেয়। নিজে নেয়। এখানে সুখেশ্বরী জের টানে কথার।

—যতই বলো দিদি, পাপের পিতিফল সবই। উল্লেস পাপের দণ্ডি পেয়েছে; লিদুষী সোন্দর মানুষটাকে মেরে বিলে ফেলে দিইছিলো। তুমার চোখে না পড়লে তো যেয়েছিল জেবন।

হঠাৎ চাপাগলায় আর্তনাদ করে ওঠে বিন্দু। কে, কে একথা তুলে বললে সুখী?

—অম্মা। সি কি গো। জানো না তুমি? তুমার চোখ থাকে আকাশে কান থাকে সুমুদ্দুরে।

ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে গিয়ে থেমে গেছে হাত। চেয়ে আছে প্রদীপের স্বর্ণালীর মধ্যেখানে ক্ষীণ নীলটুকুর দিকে। অ্যাদ্দিন বলিসনি কেনে রে?

—তুমি জানো না ক্যামনে জানবো সিটা বলো? নাড়ু ঘোষের ব্যাটা চণ্ডী তো সেই দাঙ্গার পরদিনই গপ্প করছিল। উল্লেস গায়েনকে মেরে মোষের পিঠে চাপিয়ে দিইছিলো।

বিন্দুর নিশ্বাস জড়ানো কথায় আলোর গায়ে কাঁপন। কই সিকথা তো একদিনও আমাকে বল্লেনা উল্লেস। কেনে গোপন করেছিলো, কেনে?

শিখা কাঁপছে। একটা পোকা উড়ে এসে পড়েছে। তাকে বুকে চেপে ধরে কাঁপছে উলঙ্গ হলুদ প্রদীপের শিখা।

সুখেশ্বরী বলে, ভাতের গেরাস হাতে কী ভাবছিস দিদি?

—কিছু না।

উল্লাস মেরেছিল গায়েনকে। কী আশ্চর্য, একথা তার কাছে কী জন্যে গোপন হয়ে থাকল এত দিন! একদিনও শুনল না। শুনল এতক্ষণে, যখন উল্লাস ঝিকটিপোঁতার হাসপাতালে? রক্তক্ষয়ে শ্রান্ত বিবর্ণ বিশাল তার। গিয়েছিল একদিন বিন্দু লোকলজ্জার মাথা খেয়ে। এক টাকার ফল কিনে নিয়ে বসেছিল মাথার পাশে।

—তুমি এলা? ব্যান্ডেজের কাপড়ে মুখের মাথার প্রায় সবটাই ঢাকা, বলল উল্লাস।

বিন্দুর চোখের জল। অক্তের নদীতে চান না কল্লে জেবন কি কাটে না তুমার গো? উল্লাস জবাব দিল না। বলল আবার বিন্দু, ফিরে যেয়ে একটা পিতিজ্ঞে কত্তে হবে।

—কী পিতিজ্ঞে বিন্দু?

—লাঠি ছাড়ার।

ম্লান হাসল উল্লাস। তাহলে কী একতারা ধরব?

(কেন, কেন একথা বলেছিল সে?)

বলল বিন্দু, সিও কি ভালো না?

—একতারা ধল্লেও রক্ত মাখতে হয় বিন্দু, বসুমতীর রক্তের ক্ষিদে আছে। সিটা হচ্ছে আসল কথা। নইলে আম্মো তো ভাবি ভালো হবো, দুষ্টুমি করবো না অথচ লাঠি হাতে মাঠে নামলে সাধ যায় খুনখারাপি কত্তে। ইবার অবশ্যি কুলোকের কথায় পড়ে পুবমাঠে নেমেছিলাম। আমি জানতাম না বিন্দু, উই সায়েব চাষার বাবা আমার দ্যাশান্তরী বাবাকে মেরেছিল। অ্যদ্দিন পরে শুনলাম। তখন, বলো বিন্দু, বাবার রক্ত শরীরে বইছে, আর কি মোন মানে?

খুব আস্তে আস্তে টেনে টেনে একথা বলল উল্লাস। নার্সটা পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটু থামল সেকথা শুনে। বললে বিন্দুকে, তুমি কে হও এর?

থতোমতো করল বিন্দু। জবাব কী ছাই মাথায় আসে তখন! বলল উল্লাস, আমার লিকট কুটুম।

—ও। কিন্তু তুমি বেশি কথা বলার চেষ্টা করো না। আবার রক্ত পড়বে।

বিন্দু বলল, উঠি তাহলে। আবার আসব।

—দাঁড়াও এট্টু। কথা আছে। হাত ধরে টানে উল্লাস। ফ্যাকাশে দুর্বল হাত। প্রশস্ত তালুতে কর্কশ শিরার সার। ফোস্কা উঠে আছে সেখানে। বিন্দুর হাত ধরে রাখল সে। পাখির শরীরের মতো নরম হাত, অনেক অনেকবার জলে ভেজা বাগদি মেয়ের বিবশ হাত। আর বিন্দুর মনে হয়েছিল উল্লাসের কঠোর রুক্ষ হাতখানা পাখির নীড়ের মতো শারদশিশিরে সিক্ত হিম ধূসর, কিছু অমসৃণ অথচ নিশ্চিত নীড়।

—বলো। চোখে চাইতে বিন্দুর কান্নার ভয়।

—আর এসো না তুমি।

—কেনে গো? চমকে উঠল বিন্দু।

—আমার মোনে হয় বিন্দু, আমি পাপের শাস্তি পেইছি। আর তুমাকেও একদিন সি শাস্তি লিতে হবে। তুমি আর আমার সংগগে এসো না বিন্দু। ঘরে তুমার নাবালক ছেলা। ইটা বড় খারাপ লাগে বিন্দু…..।

আপন আবেগে বলছিল উল্লাস। নতমুখী বিন্দু শুনছিল।

—তুমি একদিন ঠিকই বলেছিলা। বাবার মতো নিলজ্জ হতে পারিনে।

জানিনে সে মরে না বেঁচে, কিন্তুক আমার সুমুখে কেউ সে নাম কল্লে সইতে পারিনে। সিকথা তুমিও জানো।

উল্লাসের মুখে হাত রাখল বিন্দু। আর কথা বলো না। ডাক্তোর দিদি বকবে!

বিন্দুর অজ্ঞতা দেখে হাসল উল্লাস। না, উ তো নার্স। ডাক্তোর অন্যজন। এট্টু তুলোতে কোলোফম দিয়ে অজ্ঞান করে তবে না ফলাটা বেরোল।

—আঃ চুপ করো না গো। উই আবার আসছে।

—তবে পিতিজ্ঞে কচ্ছি, বিন্দু, শরীলে উঠতে হাঁটতে পাল্লে উই স্যাকের বাচ্চাকে যদি না আমি পিতিশোধ দিই, আমি বাঁকু ঘোষের রক্তে জন্ম লই। হাকিমকে বলেছি সিকথা পেকাশ্য এজলাসে।

উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল উল্লাস। চোখের উপর ব্যান্ডেজের কাপড়ে রক্তের ছোপ। নাকের পাশ বেয়ে রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা। আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠেছিল বিন্দু ও নাসদিদি, অক্ত পড়ছে।

—আর তুমি আমাকে মুখ দেখিয়ো না বিন্দু। বারণ কল্লাম। দ্যাশে ফিরে গেলেও না।

নার্সের ধমক খেতে খেতে উঠল বিন্দু। কান্নায় বুকের কাছে কী আটকে যায়। ফলগুলো আঁচলে বাঁধা ছিল। ফিরে যেতে যেতে মনে পড়ে, আবার রেখে গেল মাথার কাছে। উল্লাস বুঝি অজ্ঞান হয়ে গেছে।

ফিরে গেল বিন্দু। এল বিনোদীয়ার ইস্টিশানে ট্রেনের জন্যে। অপেক্ষা করছিল প্ল্যাটফরমে। সেই সময় দূরে গেটের কাছে একটি মেয়ে ছুটছে। সই ওলাং। বিনোদীয়ার ওর বাবার বাড়ি। তখন গাড়ি এসে গেছে। চাপল বিন্দু ত্রস্ত পায়ে। ছেড়ে দেয় যদি চাপার আগেই! জানালায় মুখ বাড়িয়ে দেখল ওলাংকে। ইস কী রোগা হয়ে গেছে! একেবারে চেনা যায় না। কয়লাকালো ছেঁড়া কাপড় পরণে। রুক্ষচুল। হয় তো বিনুনি বাঁধে না আগের মতো।

বলল ওলাং, সই প্রাণের সই! দেখা না দিয়ে চলে গেলা। কতদিন দেখিনি সই। কাঁদছিল ওলাং। বিন্দু অপ্রস্তুত।

—লজ্জা দিয়ো না ভাই। ইখেনে তুমি আছে খবর পাই কী করে বলো? তাপরে আছো কেমন? কী ছেলা হয়েছে তুমার? খোকা না খুকী! কদ্দিন এসেছো হে? এক নিশ্বাসে শুধোল বিন্দু।

—নামবানা সই? একবেলা থেকে যাও দুখিনীর বাড়ি। অনুনয় করল ওলাং।

আর করো না সই। ছেলেটা একা আছে। আমারও অবস্থা ভালো না। আর একদিন আসব। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। গার্ডের বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ন আর্তনাদ করে উঠল ট্রেন। রাশ রাশ ধোঁয়া তুলে বিকটভাবে চিৎকার করে এগোল। পাশে পাশে চলল ওলাং।

—আমার অনেক কথা সই। সি এক বিত্যেন্ত। কিছু তো শুনলা না। বড় অভাগী আমি হে। এট্টা খোকা হয়েছিল, মারা যেয়েছে। আমি অনেকদিন চণ্ডালিকে ….

কথা শোনা গেল না আর। চেঁচিয়ে কী বলছে ওলাং। চণ্ডালিকের খবর? কীজন্যে? কৌতূহলী হয়ে শুধোতে যাবার আগেই কে একজন পুরুষ তার গা ঘেঁষে জানালায় মুখ বাড়িয়ে থুথু ফেলতে লাগল। বিন্দু কোণ ঘেঁষে সরে এল। মরণ আর কী! চোখের মাথা খেয়েছে। মেয়েলোকের গায়ের ওপর থুথু ফেলছে দেখেছ?

থুথু না, পানের পিচ। পানরাঙা দাঁতে হাসলে কুশ্রী কালো লোকটা। ধুতি পাঞ্জাবি পরণে ধোপদুরস্ত বাবু। ওম্মা, সঙ্গে আবার বউ দেখছি। বেশ ফরসা সুন্দর পাতলা মুখ। সেও খাচ্ছে। ও মুখ যেন চেনা বড্ড। স্মরণ করে বিন্দু। এই মেয়েটি তার জীবনের কোথাও যেন লুকিয়ে আছে। এর চোখের ভাষা বিন্দুর কোনো স্বপ্নে বুঝি দেখা। কীজন্যে এই তীব্র আকুতি মনে? লজ্জা পেয়ে চোখ ফেরাল বিন্দু।

হঠাৎ বউটি পাখির মতো কথা বলে উঠেছিল, তোমার বাড়ি সুঁদিপুর না?

—হ্যাঁ। তুমার?

—পলাশগ্রাম।

—তুমার নামটা কী যেন, ভুলে যেছি, কী যেন…. বিন্দু উথাল পাতাল।

—নৃত্যবালা।

জানালা দখল করে বসেচে নৃত্যবালার স্বামী। বলল, আমার নাম শুধোলে না? রসিকলাল ক্ষত্রিয়। ঝিকটিপোতায় ট্রাকমোটরে ড্রাইভারি করি। হা হা করে হাসছে। মোটা মোটা দাঁতে পানের কুচি। ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে বলল বিন্দু। নৃত্যবালা বলল, তোমাকে চিনি আমি।

উত্তর দিতে ইচ্ছে নেই বিন্দুর। পুরুষটা ভারী অভদ্র। শুধু বলে, হবে। মাছবেচা বেবসা আমার। অনেকেই চেনে।

চণ্ডালিকা স্টেশনে নামল বিন্দু। কোনোদিকে চাইতে ভালো লাগে না। সেবারের প্রদর্শনীর মেলার ওখানে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে সেই অতীত পৃথিবী। চণ্ডালিকা গ্রামের ভিতর দিয়ে পথ। সে পথ ছেড়ে মাঠের পথ ধরল। গ্রামটা পড়ে রইল ডান পাশে। এখন সে নীড়ে ফেরা পাখি। সবকিছুর চেয়ে পবিত্র সুন্দর কামনার বস্তু এখন আপন ঘর। সেখানে বসে আপন রহস্যের মধ্যে ডুবে বিভোর হয়ে থাকা। নইলে সে সহজে নিঃশেষে মুছে যাবে পৃথিবী থেকে।

শরতের কোকিল গাবগাছে ডাকছে। ভোর হল নাকি? তার উল্লাস গায়েনকে মেরে বিলে ফেলে দিয়ে এসেছিল! নিষ্পাপ অবোধ একটি মানুষকে! এত নিষ্ঠুর, এত কুৎসিত উল্লাসের প্রাণ! কোন উল্লাসকে সে ভালোবেসেছে এতদিন!

জননীমনের সবটুকু উত্তাপ, যেমন করে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল সে আহত গায়েনের শরীরে, তেমনি করে ঝরাতে চাইল ছেলের মধ্যে। তার নিবিড় আলিঙ্গনে তন্দ্রা ভেঙে অলক তাকাল চোখ খুলে মা!

—কিছু না। ঘুমোও মানিক আমার।

অনেকদিন পরে আজ রতিকান্তর জন্যেই কাঁদছে বিন্দু।

একটা ছোট্ট ঢেউ উঠেই মিশে গেছে চক্রাকারে চারপাশের স্থাবর পৃথিবীতে। আবার কঠিন মাটি, পাতাল জল। মুক্ত শান্ত নিষ্কম্প। স্বপ্নের শিথিল বিষাদকেশ সরে বেরিয়েছে বাস্তবের কঠোর ঘর্মাক্ত মুখ। শরদিন্দু নিষ্ঠুর হল। হিংস্র হতে চাইল। ঝাব্বু সিং আর মুকুন্দের উপর আগের মতো সহজ হল। আর হাসিম? সে এসেছে আরও কাছাকাছি। শরদিন্দুর ঘরের পাশেই একটা ঘর বানানো হয়েছে তার জন্যে। সেবারে অপ্রয়োজনীয় ভেবে বরখাস্ত করা গাড়োয়ালি সেপাইটা যেখানে টুলের উপর বসে থাকত নিষ্প্রাণ যন্ত্রের মতো, সেখানে বসল হাসিম। শরদিন্দুর বন্দুক আর কার্তুজের মালা তার কাছে। শরদিন্দু যে—কোনো সামরিক ডিক্টেটরের মতো সদম্ভে পায়চারি করতে লাগল ফার্মের জমিতে।

শ্রীনিবাস আসে সবসময়। বিপক্ষের গুহ্যতম সংবাদ জানিয়ে যায়। আর বলে সহজ কৌশলে নির্বিবাদে সমবায় তৈরির পথের কথা। বেনামী শেয়ার, ভূয়া শেয়ার, নকল সভ্য, ঘুষ আর রেজিস্ট্রেশনের পর মোটা অঙ্কের লোন। সরকারি কৃষিদপ্তর থেকে অজস্র সহায়তা। (এগুলো অবশ্যি শরদিন্দুর জানা কথা) শিল্পসংস্থা থেকে কৃষি যন্ত্রপাতি। বলে, নানা আধাসরকারি বেসরকারি উন্নয়ন বোর্ড পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অমুক নম্বর স্কীমের কথা।

কান খাড়া করে শোনে শরদিন্দু মরগ্যান—লাইসেংকোর বই বন্ধ করে রেখে। খোলে সরকারি প্রচারবিভাগ থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন উন্নয়ন বিবরণী কাগজপত্র, সেমিনারের রিপোর্ট। পরিকল্পনা বাজেটের খুঁটিনাটি হিসেবের তালিকাপত্র। বিরক্তিকর বলে একদিন দিল্লির কৃষিদপ্তর ছেড়ে পালিয়েছিল সে। কাজে নামতে চেয়েছিল মাটির বুকে প্যান্ট গুটিয়ে কৃষাণ সেজে। আজ খুলে দেখল বইগুলো। ভালো লাগল। অভ্যেস হয়ে গেল বলে আর আটকায় না। (হায়, ল্যাবরেটরিতে মিশ্র উদ্ভিদের কলমে ডিস্ট্যাবিলাইজেশন সৃষ্টি করার উৎসাহ কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। শরদিন্দুর জানালায় রাখা পেঁপে চারাটা ততদিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।)

একদিন বলল শ্রীনিবাস, একটা অদ্ভুত সংবাদ সংগ্রহ করেছে সে। শরদিন্দু তীক্ষ্ন চোখে চেয়ে থাকে।

—ও পক্ষের মূল গায়েনের সন্ধান পেয়েছি, সার।

—কে?

—রাজা শংকরীপ্রসাদ।

লাফিয়ে উঠল শরদিন্দু। আই মাস্ট কিল দ্যাট ডগ। হাত নাড়ে শ্রীনিবাস। মুচকি হাসে। এত ব্যস্ত হবার কিছু নাই সার। আপসে ঠিক হয়ে যাবে সব। থামুন না একটু। আগে এদিকে রেজিস্ট্রেশনটা করিয়ে নিন।

শরদিন্দু জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। নিজের উত্তেজনায় নিজেই একটু বিরক্ত যেন। তাই প্রসঙ্গ ফিরেছে বলে খুশি।

—আপনার সোসাইটির কথা বলছি।

—জয়েন্ট ফার্মিং রেজিস্ট্রেশন হবে অথচ কোনো কাজ হবে না আসলে, সে এক বিশ্রী ব্যাপার। কারণ মণ্ডলরা যে এবার অনেক দূরে সরে গেছে।

ঝানু শ্রীনিবাস ভ্রূকুঁচকে বলে, কেন সার লাফিয়ে ডাগায় উঠে লাভ কী? বেটার ফার্মিং—এর টোপ ফেলুন। পড়তা বুঝবে যেদিন, জয়েন্ট ফার্মিং করতে ওরাই জ্বালাতন করবে আপনাকে।

—সে অবস্থা এ মামলা বাধার পর নেই মশায়। তাছাড়া অত ধৈর্যও আমার নেই। টুকরো জমিই হচ্ছে মেশিনে চাষের বড় বাধা। লোন রিপে করা আর মেসিনের খরচ জোগানো, ব্যাস দুদিনেই সোসাইটি লিকুইডেশনে চলে যাবে! এধরনের ব্যাপার তো চলছে এদেশে। লাভ কী হয়েছে তাতে?

এবার শ্রীনিবাস একটু ঘাবড়ে যায়। অবাক চোখে চেয়ে শরদিন্দুর ইচ্ছেটা অনুমান করে। অনুমান করে ভয় পায় সে। শরদিন্দু সরকারি লোন নিয়ে নিজের পুঁজি বাড়াতে চায় না তবে। মনে মনে হাসে শ্রীনিবাস। ওসব আদর্শবাদ বাস্তব ক্ষেত্রে নামলে দেখা যাবে কতদূর টিকে থাকে।

তবু আরও একটু টিপে পরখ করতে চায় সে। বলে, তাহলে আমার পথে আসুন। কিছু মিথ্যে নইলে সংসারে কোন জিনিসটে হয়, আমাকে দেখাতে পারেন?

—কী জানি! শরদিন্দু অন্যমনস্ক।

—কী জানি, না স্যার, ফ্যাক্ট। আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি সার, পারবেন না দেখাতে। সবকিছু ওই মিথ্যের উপর গড়া। অন্যসময় চিন্তা করবেন কথাটা। এখন কাজের কথা বলি।

শ্রীনিবাস আবার ব্যাখ্যা করে চলে। ভূয়া শেয়ার ও সভ্য ভূয়া নামে নিজের জমির হস্তান্তর। আরও সব কূটনৈতিক কথা। ভাবে শরদিন্দু মিথ্যার একটা সূচের অগ্রভাগে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বৃহত্তর একটা কিছু। অবশ্যি বিজ্ঞানের বিধানে ওটা অসম্ভব নয়। স্রেফ ভারসাম্যের তত্ত্ব। কিন্তু সে অবাক হয় ভাবতে, তাহলে কি মানুষের হাজার বছরের সভ্যতার ইমারতগুলো এমনি এক একটা মিথ্যার সূচ্যাগ্রে স্থাপিত হয়ে এসেছে, আর তাই কি ঘটেছে ইতিহাসের পথে পতন—অভ্যুদয়—বন্ধুরতা? ইতিহাসের এ মাথায় মন শান্ত হবে না কোনোদিন তার। শ্রীনিবাসকে বলে, ওসব থাক এখন। নাউ এ’প্লেন, কেন সে আমার পেছনে লেগেছে?

—রাজাবাবু?

—ইয়েস। দ্যাট ডেভিল কিং উইদাউট এ ক্রাউন,

—সত্য মিথ্যে জানিনে স্যার তবে…. আমতা আমতা করে শ্রীনিবাস।

—বলুন। আমি শুনতে চাই সেকথা।

—আপনাকে তার জামাই করার সাধ মেটেনি বলে।

—কে বলেছে একথা? কঠোর স্বর শরদিন্দুর।

একটু ঘাবড়ে যায় শ্রীনিবাস। মাথার পশ্চাদ্দেশ চুলকোয় স্বভাবমতো। তারপর বলে, আপনার ক্যাম্প থেকেই রটেছে সার।

শরদিন্দু উঠে পায়চারি করে। সিগ্রেট ধরায়। শ্রীনিবাস বলে, একটা কথা বলতাম, অবশ্যি যদি কিছু মনে না করেন। হিতৈষী হিসেবই বলতে চাই।

—বলুন।

—চান্সটা ভালো ছিল সার।

—কীভাবে?

মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় শ্রীনিবাসের, ইন অল রেসপেক্টস।

এবার শরদিন্দু হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে। সত্যি নাকি?

শ্রীনিবাস উৎসাহিত। সাহস পায়। বলে, নিশ্চয়ই সার। মেয়েও তো রূপেগুণে আপনার যোগ্য।

আশ্চর্য, এরা এসব ভাবে! এই চণ্ডালিকা পরগনার লোকেরা! কৌতুকে আরও হাসে শরদিন্দু। শ্রীনিবাস তাতে আরও উচ্ছ্বসিত। আরও জাঁকিয়ে বসে লাভালাভের খতিয়ান তুলে ধরে শরদিন্দু বলে, নদেচাঁদ, চা।

চা খেতে খেতে শ্রীনিবাসের ভঙ্গি লক্ষ্য করে সে। সঙ্গে সঙ্গে হাসির দমকে চায়ের কাপ সেদিনের মতো উলটে পড়ে যায় প্লেটসুদ্ধ নীচে।

ভ্রূ কুঁচকে চারপাশ একবার দেখে নেয়। তারপর মুখটা একটু এগিয়ে এনে বলে শ্রীনিবাস, বুঝলেন সার, ট্রিকস চাই। টাকাপয়সা হোক—একটু মুচকি হেসে হোক—দুটো তাবড়ানিতে হোক। অ্যাট এনি কসট। অ্যাজ ফর একজ্যাম্পল, আপনার দুটি লোকের নামে রেপকেস করিয়েছে। কুনাইগুষ্টির নিশ্চয় সে সাহস হবার কথা নয়। পেছনে রাজাবাবু আছেন এটা মানতে হবে। কিন্তু এখন পথ খুঁজতে হয় একটা। মেয়েদুটোকে হাত করতে হয়। সহজে না পেলে ওদের পাড়ায় কোনো লোককে হাত করুন। সে ওদের কানে আর আঁচলে গেরো দিলেই ব্যাস। ওসব ছোট জাতের নেচার তো আমি জানি।

—কী ভাবে সম্ভব তা? ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে অলসকণ্ঠে শুধোয় শরদিন্দু।

উৎসাহে আজ ইংরিজি বেরুচ্ছে প্রচুর। শ্রীনিবাস পারতপক্ষে বিলেতফেরত এই সায়েবি চালের লোকটার সুমুখে ও ভাষা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেছে এতদিন। আজ বলে, দে তার নিডি পিপল। অ্যান্ড ইফ পসিবল গিভ দেম সাম আপয়েন্টমেন্ট অ্যাট ইওর ক্যাম্প।

শরদিন্দু ওর উচ্চারণ শুনে হাসে মনে মনে। বলে, সব লোকের চাকরি দেওয়া যায় না তো।—সব লোককে দেওয়া যায় না। বাট ওয়ান অফ দেম—কে যায়। ইয়েস ওনলি ফিফটিন রুপিজ পারমানথ ফর ওয়ান কুনাই। ওই ওদের যথেষ্ট, যেমন তেমন চাকরি মানে ঘি—ভাত,

 সোজা হয়ে বসে শরদিন্দু। বেশ। লোক খুঁজে দিন। আরও একজন মেসিন অ্যাসিসট্যান্ট অবশ্যি দরকার। একা আমি আর মুকুন্দ ম্যানেজ করতে পারিনে। ডেলি অ্যালাউন্সে লোক আনতে হয় বাইরে থেকে। স্থায়ী লোক পেলে কাজ শিখিয়ে চালু করিয়ে নেওয়া যাবে।

টেনে টেনে হাসে শ্রীনিবাস। আমি শীগগির দিচ্ছি লোক।

সত্যি একদিন লোক আনে শ্রীনিবাস। শরদিন্দুর চেনা। অনেক সময় এখানে মজুর খেটে গেছে লোকটা। হাসিম বলে, ওই রোগা ভেড়াটা? তাহলেই হয়েছে।

শ্রীনিবাস বিরক্ত হয়। থামো দিকি বাপু! গোটা পাড়া তল্লাস করে ওই সবেধন নীলমনি। আর কেউ রাজাবাবুর ভয়ে আসতে চায় না। মেসিন চালানো শেখার কথা বললেও ‘না’। অবশেষে উনি ভাগ্যে উদয় হলেন।

শরদিন্দু বলে, নাম কী তোমার?

—আজ্ঞে শিরি নীলকান্ত কুনাই।

—ওইসব মেসিনের কাজ শিখতে হবে। নিজে ট্রাকটর চালাতে হবে। পারবে?

পাথর হয়ে গেছে নীলকান্ত। রূপকথার শ্বেতহস্তী রাখালকে তুলে এনে রাজ্যিপাঠে বসিয়ে দিচ্ছে। স্বপ্নে ঘটেছে বুঝি। কেমন করে সম্ভব হয়। ভগবান, তুমি আছো, অবশ্যই আছো। আমার মোনের দুঃখু তুমি সবই টের পেয়েছ। আবেগের তীব্রতায় ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে।

শরদিন্দু বলে, পারবে না?

হঠাৎ পা জড়িয়ে ধরে নীলকান্ত। পায়ে মাথা খুঁড়তে থাকে। আমাকে দয়া করে যখন ডেকে এনেছেন, ফেলে দিবেন না হুজুর। আমি সব পারব।

হাপরের মতো হাঁপায় নীলকান্ত। জলভরা চোখ তুলে তাকায় নির্বোধের মতো।

শরদিন্দু ডাকে, নায়েক!

মুকুন্দ গ্রিজের কৌটো হাতে ছুটে আসে। স্যার!

—এই তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। কাজ শিখিয়ে তৈরি করে নাও। খুব জলদি।

মুকুন্দ নায়েক হাত ইশারায় ডাকে নীলকান্তকে। বলে, ও জামাকাপড়ে চলবে না জাদুমণি, হাফপ্যান্ট পরতে হবে।

নীলকান্ত বলে, কালই কিনব একটা।

মুকুন্দ হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় তাকে। মুকুন্দ আশান্বিত। নীলকান্ত কুনাইপাড়ার লোক। নির্জন দ্বীপান্তরে শূন্য জীবনে কুনাইপাড়া একটি গোপন ভাবনার অবলম্বন। তন্দ্রাহীন রাত্রের কামনাক্লিষ্ট মনে গন্ধমদির উত্তাপ। অনুতাপহীন মুকুন্দ নায়েক। সারাজীবন ধরে কোনো অনুতাপের ঝুঁকি নেওয়া তার একান্ত অপরিচিত। হাস্যকর কিছু। তার জীবনবিধানে এই এক আইন যে ফুল তুলতে হলে কাঁটা সইতে হবে। মধু পেতে হলে হুলের জ্বালায় অনিবার্যতার জন্যে তৈরি থাকতে হবে। মুক্তোর আবরণে পচাঝিনুকের দুর্গন্ধ অস্তিত্ব। তা না ঘাঁটলে মুক্তো মেলে না। এ হচ্ছে নিয়ম। আর তাছাড়া জীবনীশক্তির গোড়ায় খানিক এসব আবর্জনা দিলে তবেই পত্রপল্লবে ফুলের ভারে ভরে ওঠে জীবনের শ্যামতরু। এই তার জীবনদর্শন। তাই খুশি সে নীলকান্তকে পেয়ে। ভাব জমিয়ে ফেলে। নীলকান্তর হাবা বুদ্ধির জন্যে বিরক্তির চিহ্নও ফোটে না মুখে। সযত্নে বারবার দেখিয়ে দেয়। নিয়ম—কানুন বুঝিয়ে দেয়। মধ্যে মধ্যে অকারণে বলে, বা, বা, ভালো হচ্ছে। ঘেড়! শরদিন্দুর উচ্চারণভঙ্গির আর তার উচ্ছ্বাস প্রকাশের নকল করে মুকুন্দ বলে ঘেড়। ঝাব্বুর সিং হাসিম সেখের উৎকট হাস্যরোলে নীলকান্ত একটু ভ্যাবাচ্যাকা মেরে যায়।

নীলকান্ত বলে, আজ লিড়ানের মেসিনটা তো শিখে নিলাম!

শরদিন্দু সুপারভাইজ করে আসে জমিতে গিয়ে। ফিরে এসে বলে মুকুন্দকে, ওকে এত তাড়াতাড়ি কাজে নামাচ্ছ কেন? ধানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে যে।

মুকুন্দ ধমকায় খানিক। নীলকান্ত উৎকণ্ঠায় থামে। শরদিন্দু বলে ওকে বরং ম্যানিওর স্প্রয়ারে দিয়ো।

নির্দিষ্ট আয়তন মাফিক জমিতে পরদিন একবুক ধানের মধ্যে সার স্প্রে করে বেড়ায় নীলকান্ত। খুবই সোজা। হাতল ঘুরিয়ে নলটা ঠিকমতো সঞ্চালন। কোথাও বেশি হয়ে যায়। মুকুন্দ ছুটে আসে। সারের উগ্রতা—প্রতিরোধী একটা কী ওষুধ জলে গুলে সেখানে ছড়িয়ে দেয়। নীলকান্ত হাবাকান্তর মতো হাসে।

একসময় কাজ শেষ হয়! সূর্য পাটে নামে। বিকেলের পাটকিলে রোদ্দুর আস্তে আস্তে হেরিকেনের অস্বচ্ছ কাচের মতো রং ধরে। অনেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সারসটা হঠাৎ উড়ে যায় দূর মাঠের পত্রঘন অশত্থগাছ লক্ষ্য করে।

পূর্বাকাশে গোলাকার চাঁদের টিপ পরে বিবসনা রাত্রি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসে। বারবনিতার নিলাজ মুখে নিষ্ফল হাসি। মুকুন্দ ঘাড় ফিরিয়ে দেখে ব্রিজে দাঁড়িয়ে। নীলকান্ত বলে, পুন্নিমা।

হঠাৎ ঘাড়ে হাত রাখে মুকুন্দ। নীলকান্ত ডালিং।

—বলুন।

—টগর আমার উপর খুব রেগে আছে, না?

—টগরের কথা বলতে পারিনে। উতো দুষ্টু মেয়ে। তবে এলোকেশী প্রচণ্ড রেগেছে। উইতো সব যেয়ে বলেছিল উর অক্ষম মরদটাকে। সি সম্বাদ দেয় রাজার কাছে।

—এলোকেশী রাগুক! টগর কী বলে, বলো।

টগরের কথা বলব কী দাদা। উই বনমালী নাপিত আছে দক্ষিণপাড়ায়, আজন্ম উর সঙ্গে পেম কচ্ছে। এলোকেশী কিছু না বললে টগর কিচ্ছু পেকাশ কত্তো না।

একটু হাসে নীলকান্ত। বলে, আচ্ছা নায়েক দাদা, ব্যাপারটা সত্যি নাকিন গো?

মুকুন্দ সিগ্রেট ছুঁড়ে ফেলে খালের জলে। বলে, হ্যাঁঃ!

—তা বটে। নইলে মিছিমিছি কি হয়? কিন্তুক ঐ সাধ আছে তো আমাকে বললেই হত। টগরকে পাঠিয়ে দিতাম।

পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় শেয়ালের মতো চোখ জ্বলে উঠেছে মুকুন্দর। পারবি? টাকার অভাব হবে না।

তা নিশ্চয় পারব। কিন্তু উকি ক্যাম্পে আসতে চাইবে? জানতে পাল্লে পাড়ার লোক না হয় চুলোয় যাক রাজাবাবুর কানে গেলেই হয়েছে!

—যাঃ ছোঁড়া। একদিনকার মতো নিয়ে আয় না!

—আপনি চলুন বরঞ্চ।

মুকুন্দ আঁতকে ওঠে। শরদিন্দু চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেবে। কোনো খাতির করবে না। বলে, না। তুই যদি ওকে এখানে আনতে পারিস, তিনদিনে কাজ শিখিয়ে দেব। নীলকান্ত ভাবে।

মুকুন্দ বলে, ওই ট্রাকটর চালানো পর্যন্ত।

নীলকান্ত প্রলুব্ধ। পোষা কুকুরের মতো তার পেছনে গিয়ে ক্যাম্পে ঢোকে।