৫. দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম

দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। একটা ম্যানিকিন জ্যান্ত হয়ে আমাকে তাড়া করেছে। পালানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। কর্নেলকে আর্তস্বরে ডাকছি।

তারপর জেগে উঠলাম। বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে কৌতুক ঝলমল করছে। সুপ্রভাত জয়ন্ত! উঠে পড়ো। এই সাত সকালে গোঙাভূতের পাল্লায় পড়া ঠিক নয়!

হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে শরৎকালের ঝলমলে রোদ ঢুকেছে। কর্নেলের টুপিতে শুকনো পাতার কুচি, মাকড়সার ভেঁড়া জাল এবং আরও কিছু প্রাকৃতিক আবর্জনা। টুপিটি ব্রাশ দিয়ে সাফ করতে বসলেন। কিটব্যাগ বাইনোকুলার ইত্যাদি টেবিলে রাখা ছিল। প্রজাপতি-ধরা জালটাও গোটানো অবস্থায় অবহেলায় পড়ে ছিল একপাশে। বুঝলাম, প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। টুপি সাফ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়িতে চিরুনি চালিয়ে বললেন, এরকুল পোয়ারোর গোঁফচর্চার সঙ্গে আমার এই দাড়িচর্চাকে এক করে দেখা উচিত নয়। বনে-জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করলে কেন জানি না রাজ্যের পোকামাকড় আমার দাড়ির ভেতর লুকোচুরি খেলতে আসে। এদিকে বড্ড শিশিরের উপদ্রব। দাড়ি ভিজে চবচব করছে।

চুপচাপ বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম। চেতনাউদ্যানের ট্যুরিস্ট লজে দোতলায় দুই শয্যার যে ঘরটি সৌভাগ্যক্রমে আমরা পেয়েছি তা দুর্ভাগ্যক্রমে এখনও এয়ারকন্ডিশন্ড করা হয়নি। ম্যানেজার পি কে দাশ (পুরো নাম জানি না), বলছিলেন, এ মাসেই হয়ে যাবে। আসলে ওপেনিংটা একটু তাড়াহুড়ো করে হল। মিনিস্টার এক মাসের জন্য বিদেশে থাকবেন। তাই ডেটটা এগিয়ে আনতে হয়েছিল। এখনও কিছু কিছু কাজ বাকি।

বাথরুমের কাজ সেরে এসে দেখি, টেবিলে ট্রে-তে সাজানো ছোট-বড় পট, কাপপ্লেট ইত্যাদি এসে গেছে। কর্নেল বললেন, চাফি নয় জয়ন্ত, কফি। তোমাকে গোঙাভূতে ধরেছিল। নার্ভ মিইয়ে গেছে। শিগগির চাঙ্গা করো। আমি বাথরুম সেরে আসি।

একটু হেসে বললাম, গোঙাভুত নয়, জ্যান্ত ম্যানিকিন।

কর্নেল যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন। ম্যানিকিন? বাহ্! তাহলে তো স্বপ্নটা ভালোই! বলে উনি বাথরুমে ঢুকে গেলেন।

ব্যালকনিতে গিয়ে কেমন জায়গায় আছি দেখার ইচ্ছে হল। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এখানে পৌঁছেছি। তখন কিছু বোঝা যায়নি। এখন দিনের আলোয় পরিবেশ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। মনে হল, যেন মন্ত্রবলে আমেরিকা থেকে এক টুকরো কোনও ন্যাশনাল পার্ক তুলে এনে বসানো হয়েছে। লম্বাটে। বিশাল লেক অমিয় সরোবর-এর দু-ধারে ঘাসে-ঢাকা মাটির ওপর বর্ণাঢ্য ফুলবাগিচা এবং সুদৃশ্য লতা-গুল্মের কুঞ্জ, ভাস্কর্য, বসবার জন্য নানা ছাঁদের আসন, ছবির মতো রঙবেরঙের কটেজ এবং দুই ধারে বনভূমি। লেকে কারা। রোয়িং করছে। সায়েব-মেমও এসে গেছে। হ্যাঁ, এক কোটি টাকা খরচ হতেই পারে। বিদেশি অর্থাৎ সায়েব-মেম ট্যুরিস্টদের টানতে আজকাল সরকার নানারকম প্রকল্পের আয়োজন করছেন। শিল্পপতিদের সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্ট শিল্পপতি অমিয় দত্তকে সম্ভবত নিকুঞ্জদার মারফত পাকড়াও করেছিলেন। কিন্তু নিকুঞ্জদা জানতেন না দত্তসায়েবের প্রথম স্ত্রীর পূর্বপুরুষ এই জঙ্গলমহলের জমিদার ছিলেন এবং দত্তসায়েবকে এ ধরনের একটা কিছু করার প্রস্তাব নাকি সেই ভদ্রমহিলাই প্রথম দিয়েছিলেন। কাজেই দত্তসায়েবও এই ভূখণ্ডের কথা জানতেন।

কী দেখছ জয়ন্ত? এসো। কফি খেয়েই বেরুব। তখন সব দেখবে।

 কর্নেলের ডাকে ঘরে ঢুকলাম। কফি খেতে খেতে বললাম, কত দূর ঘুরলেন?

বার্ড-স্যাংচুয়ারি অব্দি। তবে দুর্গম এলাকা। নৌকো ছাড়া পুরোটা দেখা যায় না।

পাখির ছবি তুলেছেন তো?

অনেক রকম পাখি দেখেছি। কিন্তু সেগুলো ছবি তোলার যোগ্য নয়। সাধারণ প্রজাতির।

একটু পরে বললাম, আচ্ছা কর্নেল! ম্যানেজারবাবু বলছিলেন, আগে থেকে টুরিস্ট লজ আর কটেজগুলো বুক করা ছিল বলে দত্তসায়েবের আকস্মিক মৃত্যুতে চেতনাউদ্যান বন্ধ রাখা যায়নি। তাহলেও অন্তত একটা শোকসভার ব্যবস্থা করা যেত। করা উচিত ছিল। আপনি ফিরে গিয়ে বসুন্ধরা ট্রাস্টকে বলুন।

কর্নেল হাসলেন। তুমি চেতনাউদ্যানের প্রেমে পড়ে গেছ, ডার্লিং।

 তা গেছি। প্রেম-ট্রেম তো প্রথম দর্শনেই হয়।

সমস্যা হল, প্রথম দর্শনে অনেক জিনিস চোখে পড়ে না। ইংরেজিতে একটা পুরনো প্রবচন চালু আছে। এভরিথিং গ্লিটারস ইজ নট গোল্ড। বাংলায় সেই কথাটারই অনুবাদ চালু আছে, চকচক করলেই সোনা হয় না!

তার মানে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে আপনি কিছু খারাপ জিনিস আবিষ্কার করেছেন?

আমার আগেই হালদারমশাই আবিষ্কার করে গেছেন। কাজেই আমার আবিষ্কার গুরুত্বহীন।

একটু অবাক হয়ে বললাম, আপনাকেও কেউ খতমের হুমকি দিয়েছে নাকি?

কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন, খতমের কথা সরাসরি বলেনি। শুধু বলেছে, বেলা বারোটা পর্যন্ত সময় দেওয়া হলো। এর মধ্যেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। না গেলে বরাতে অশেষ ভোগান্তি আছে।

আপনাকে মুখোমুখি এভাবে কেউ–

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মুখোমুখি নয়। ভোরে এই ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছি, চোখে পড়ল দরজার তলায় ভাঁজ করা একটা কাগজ ঢোকানো আছে। মজার কথা হল, চেতনা দেবীকে হুমকি দিয়ে যে লোকটা চিঠি লিখেছিল, হাতের লেখাটা তারই। লোকটা ইংরেজিতে বেজায় কাঁচা।

আঁতকে উঠে বললাম, আপনি দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে রেখে বেরিয়েছিলেন। এদিকে আমি একা ঘুমুচ্ছি। এটা ঠিক করেননি!

কর্নেল হাসলেন। দরজায় বাইরে থেকে তালা এঁটে বেরিয়েছিলাম। আমি জানি বাইরে কোথাও গেলে তোমার সুনিদ্রা হয় না। কাজেই আটটা থেকে নটার মধ্যে তোমার ঘুম থেকে জাগার সম্ভাবনা। অবশ্য আমি কোথাও বেঘোরে আটকে গেলে লজের লোকেরা ডুপ্লিকেট চাবিতে তালা খুলে তোমাকে উদ্ধার করত।

কিন্তু তাদের মধ্যেই ওই বজ্জাত লোকটার স্যাঙাত থাকতে পারে?

পারে। কিন্তু ট্যুরিস্ট লজে তোমার ওপর হামলা করার ঝুঁকি সে নেবে কেন? ওদের লক্ষ্য তো আমি।

কর্নেল হাসি-তামাসা করে কথাগুলো বললেও আশ্বস্ত হতে পারলাম না। এই যে এখন কর্নেলের সঙ্গে বেরুচ্ছি, বনবাদাড়ের আড়াল থেকে গুলি ছুড়লেই হলো। চেতনা দেবীর দিকে ছোঁড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। কর্নেলের দিকে ছোঁড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমার গায়ে বিধলে ঠেকাচ্ছে কে? রিভলবার হলে দুটোর বদলে চারটে, পাঁচটা বা ছটা এবং পিস্তল হলে তো আঠারোটা গুলি ছোঁড়া এখানে কত সোজা! এ তো কলকাতার কোনও বাড়ির টেনিস লন নয়। জমাট জঙ্গল।

জনশূন্য লন পেরিয়ে লেকের সমান্তরালে পিচরাস্তায় কর্নেলের পাশাপাশি হাঁটছিলাম। লেকে সেই সায়েব-মেম তখনও রোয়িং করছে। কিছুক্ষণ পরে বললাম, একঘেয়ে লাগছে। একেবারে নিখুঁত সাজানো বাগান যেমন হয়। অগোছালো আদিম বন্যতার একটু-আধটু টাচ অবশ্য রেখেছে। কিন্তু যতটা সুন্দর মনে হচ্ছিল, তত কিছু নয়।

কর্নেল বললেন, পূর্বে এই লেকের সুইস গেটের ওধারে মার্শল্যান্ড আছে। বার্ড-স্যাংচুয়ারি সেখানে গেলে দেখতে পাবে। ওই দুর্গম এলাকায় প্রচুর আদিম বন্যতা! আরও পাঁচ-ছ কিলোমিটার দুরে জলঙ্গী নদী। তার ওপারে বাংলাদেশ।

তার মানে বর্ডার। আর বর্ডার মানে স্মাগলিং!

কর্নেল হাসলেন। চেতনাউদ্যানকে তুমি স্মাগলারদের ঘাঁটি ভাবছ বুঝি?

বললাম, ট্যুরিস্ট সেজে এসে স্মাগলাররা এখান থেকে কারবার চালাবে না, তার গ্যারান্টি নেই।

নেই। সর্ষের মধ্যেও নাকি ভূত থাকে।

কর্নেল! জলের ধারে কোথাও বসা যাক।

বসা যাবে। আগে চেতনাভিলার কেয়ারটেকার লক্ষ্মীবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে চাই। চলো।

কোথায় চেতনাভিলা?

ওই যে রঙিন টালির চালা দেখতে পাচ্ছ, ওটাই চেতনাভিলা।

একেবারে বিদেশি স্থাপত্য মনে হচ্ছে।

ইউরোপ-আমেরিকার কান্ট্রি এলাকায় এমন ধাঁচের বাড়ি দেখা যায়। বরফ পড়লে চালে জমতে পারে না। গড়িয়ে যায়। আবার দেখ, গ্রামবাংলাতে বটেই, পূর্ব আর দক্ষিণ এশিয়ায় একই স্থাপত্যরীতি। কেন জানো তো?

বিরক্তি চেপে বললাম, জানি না।

বরফের বদলে এসব অঞ্চলে প্রচণ্ড বৃষ্টি ঝরে। বলে কর্নেল আমার মুখের দিকে তাকালেন। একটু হেসে বললেন, তুমি মনে-মনে অঙ্ক কষছ এবং ক্রমশ অস্বস্তি বেড়ে যাচ্ছে। ডার্লিং! সবসময় অঙ্ক কষে চললে কিছু উপভোগ করা যায় না।

আপনি নাকি মুখ দেখে মনের কথা টের পান!

অনেক সময় পাই তো তুমি আমাকে লেখা হুমকির চিঠির সঙ্গে ভবানীপুরের রায়ভবনকে জড়িয়ে অঙ্ক কষছ। অঙ্কটা ভুল নয় মোটেও। তবে তুমি যে মাঝে মাঝে এখানে অনি এবং তার গার্লফ্রেন্ডকে খুঁজছ না, না! তোমার চাউনি দেখে বোঝা যাচ্ছে। অথচ জয়ন্ত, অনিকে আমি বা তুমি এখনও চর্মচক্ষে দেখিনি।

হাসি পেল ওঁর কথায়। বললাম, দেখিনি বলেই তো সমস্যা। ওই যে যুবক-যুবতী রোয়িং করছে, কিংবা ওখানে যারা বসে আছে, তাদের মধ্যে অনি আর তার গার্লফেন্ড থাকতেই পারে।

পারে। কিন্তু অনি ভুল ইংরেজিতে চিঠি লিখবে না। তাছাড়া বংশীবাবুর কাছে ডামির অর্ডার দিতে যে গিয়েছিল, সে কখনই অনি নয়।

কাল নার্সিংহোমে অনি গিয়েছিল। হালদারমশাইকে ধমক দিয়েছিল। আপনি ওকে দেখতে পাননি?

লক্ষ্য করিনি। আমার মাথায় ছিল শুধু নিকুঞ্জবাবুর লেখা দুর্বোধ্য শব্দটা।

চেতনাভিলার গেটে পৌঁছে দেখি, মানুষজন নেই। ভেতরে নুড়িবিছানো পথ। বারান্দায় কয়েকটা বেতের চেয়ার এবং একটা গোল টেবিল আছে। কর্নেল একটু ইতস্তত করে ডাকলেন, লক্ষ্মীবাবু আছেন নাকি! লক্ষ্মীবাবু!

অমনি একটা গোলাকার লতাকুঞ্জের আড়াল থেকে হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরা একটা লোক উঠে দাঁড়াল। তার হাতে গাছ ছাঁটবার প্রকাণ্ড কাঁচি। সে গেটের কাছে এসে বলল, বাবু কলকাতা গেছেন স্যার! আজ দুপুরে ফেরার কথা। আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

কর্নেল পকেট থেকে বসুন্ধরার ব্যাজ বের করে ওকে দেখালেন। আমরা কলকাতা থেকে আসছি। এই ব্যাজটা চিনতে পারছ কি? আমরা বসুন্ধরার লোক।

আপনারা স্যার ওনাদের আপিসে যান। ট্যুরিস্ট সেন্টারের কাছেই বসুন্ধরা আপিস।

আমরা তো সেখান থেকেই আসছি। লক্ষ্মীবাবুর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।

তাহলে ওবেলা আসুন।

বাড়িতে আর কেউ নেই?

আজ্ঞে মোজাহার আছে। কিন্তু কথায় আছে না স্যার- মালী লোকটি হাসল। বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর। সেই অবস্থা! মোজাহারের খুব মাছ ধরার নেশা স্যার! ছিপ নিয়ে বউমারির ঝিলে মাছ ধরতে গেল। ওই যে দেখছেন এখন লেক হয়েছে, এটাই ছিল বউমারির ঝিল। সুলুইস গেট আর বাঁধ বেঁধে দু-ভাগ করেছে। ও! আপনি তো স্যার বসুন্ধরার অফিসার। সবই তাহলে জানেন।

তার মানে মোজাহার গেছে পাখিদের এলাকায়?

 বাড-সেংচুরিতে।

কিন্তু ওদিকে তো নৌকো ছাড়া বেশিদূর যাওয়া যায় না।

মোজাহারের তালডোঙা আছে স্যার! তালডোঙা চেনেন তো?

 চিনি। তোমার নাম কী? দেশ কোথায়?

আজ্ঞে বনমালী দাস। মেদিনীপুরে বাড়ি।

তুমি বসুন্ধরার চেয়ারম্যান নিকুঞ্জ ধাড়াকে চেনো? তিনিও কিন্তু মেদিনীপুরের লোক।

আজ্ঞে তিনিই তো আমাকে সায়েবের বাড়িতে কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমে ছিলাম সায়েবের কলকাতার বাড়িতে। গত মাস থেকে এই বাড়িতে কাজ করছি। আমার জায়গায় যে ছিল, সে গেছে সায়েবের কলকাতার বাড়িতে। তবে স্যার, আমি ছোটবেলা থেকে তিরিশ-বত্রিশ বছর নিকুঞ্জবাবুর বাড়িতে কাজ করেছি।

তুমি জানো তো তোমার সায়েব আর নিকুঞ্জবাবু অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন?

বনমালী গলার ভেতর বলল, ভগবানের ইচ্ছে স্যার। যখন যাকে ইচ্ছে হয়, তুলে নেন। তবে সায়েবের অমন অবস্থায় যাওয়া উচিত ছিল না। আসলে কপালের লেখন খণ্ডায় সাধ্যি কার?

কী অবস্থায় তোমার সায়েব বেরিয়েছিলেন?

আজ্ঞে একটু নেশা হয়েছিল। এদিকে টিপটিপ করে বিষ্টিও পড়ছিল।

সায়েব এই বাড়ি থেকেই বেরিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, স্যার। নিকুঞ্জবাবুর ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সায়েব যাবেনই। অগত্যা নিকুঞ্জবাবু বললেন, আপনি এভাবে একা যাবেন, তা হয় না। আমার কষ্ট বেশি হয়েছে নিকুঞ্জবাবুর জন্য। অমন মানুষ আর দেখিনি।

দত্তসায়েবের স্ত্রী চেতনা দেবীকে তো তুমি ভালই চেনো। উনি এ বাড়িতে এসেছেন?

বনমালী এ প্রশ্নে একটু অবাক হল যেন। আসবেন না মানে? মেমসায়েবের প্রাণ এখানে পড়ে থাকে স্যার। এই যে লক্ষ্মীবাবু কলকাতা গেছেন, সে তো মেমসায়েবকে নিয়ে আসবেন বলেই। ফাংশনের দিন আসতে পারেননি। শুনেছি, অসুস্থ ছিলেন।

এখন কি মেমসায়েব আসতে পারবেন বনমালী? ওঁর মনের অবস্থা এখন শোচনীয়।

বনমালী গম্ভীর মুখে বলল, শোনা কথা স্যার! সায়েবের আগের পক্ষের একটা ছেলে আছে নাকি! সে এক সাংঘাতিক গুণ্ডা! সে যে কোনও সময়ে এসে এই বাড়ি দখল করতে পারে। তাই নাকি মেমসায়েব তৈরি হয়েই আসবেন।

কেন? আমরা জানি, এ বাড়ি মেমসায়েবের নামে রেজেস্ট্রি করা আছে।

কী করে রেজেস্টারি হবে? এ সবই তো সরকারি জায়গা!

ঠিক বলেছ। সায়েব এক কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে বাড়ির জমিটা নামমাত্র দামে সরকার লিজ দিয়েছেন তাঁর নামে। তাই না জয়ন্ত?

আমি অগত্যা সায় দিলাম। সেই সঙ্গে এ-ও বললাম, ৯৯ বছরের জন্য লিজ।

বনমালী আরও গম্ভীর হয়ে বলল, এই যে দেখছেন গেটে তালা আঁটা আছে, এর একটা চাবি আছে লক্ষ্মীবাবুর কাছে। একটা আছে মোজাহারের কাছে।

তাহলে তুমি তো বন্দী হে বনমালী!

 কর্নেল হেসে উঠলেন। বনমালীও হাসবার চেষ্টা করে বলল, আমার বাইরে যাবার দরকারটা কী স্যার?

কিন্তু সায়েবের ছেলে যদি দলবল নিয়ে তালা ভেঙে ঢোকে?

বনমালী মাথা নাড়ল। সহজে পারবে না। মোজাহাব্বে দলবল আছে। সে যেখানেই থাক, খবর পেয়ে যাবে। ফরেস্টগাড়রা স্যার তারই লোক। বন্দুক নিয়ে দৌড়ে আসবে।

টের পাবে কী করে, যদি আচমকা হামলা করে সায়েবের ছেলে?

কেন? মেশিন টিপে দেব। সায়েব একটা মেশিন এনে রেখেছেন। ওই দেখুন লম্বামতো নল।

ওটা টি ভির অ্যান্টেনা ভেবেছিলাম।

না, স্যার! টি ভি-র অ্যান্টেনা পেছনে আছে। লক্ষ্মীবাবুকে সায়েব একটা টিভি দিয়েছিলেন। সেটা আছে।

ঠিক আছে বনমালী! চলি!….

আমার মনে হল বনমালী আসলে এখানে এসে হাঁপিয়ে উঠেছে। কথা বলার লোক খুঁজছিল। তাছাড়া সে খুব সাদাসিধে সরল প্রকৃতির মানুষ। কর্নেলকে অনুসরণ করে বললাম, ফ্যান্সি টেলার্সের কার্ডের পেছনে লেখা এম। আলি বা মেজাহার আলি এই মোজাহার কি না খোঁজ নিন কর্নেল! চেহারার বর্ণনা তো বংশীবাবু দিয়েছেন।

কর্নেল সে কথায় কান না দিয়ে বললেন, বনমালী লোকটি মন্দ নয়। নিকুঞ্জবাবুর বাড়িতে মানুষ হয়েছিল। তার মানে, ওঁর হাতে গড়া মানুষ। কোন ইংরেজি বইয়ে যেন পড়েছিলাম, এমপ্লয়িকে দেখলে এমপ্লয়ারকে চেনা যায়। কথাটা আমি মানি।

কিন্তু নিকুঞ্জবাবুর জন্য তত কিছু শোক পেয়েছে বলে মনে হল না।

সত্যিকার শোক নিজের জন্য জমা থাকে। পরকে দেখানো শোক প্রকৃত শোক নয়। তা ছাড়া মালীরা একটু অন্যরকম স্বভাবের মানুষ হয়। তাদের পরম আশ্রয় প্রকৃতি।

ওঃ কর্নেল! আপনার প্রকৃতিতত্ত্ব এখন থাক। মোজাহার সম্পর্কে একটু ভাবুন।

কর্নেল হাসলেন। চলো! সুইস গেটের ওখানে গিয়ে দেখি মোজাহার কোথায় মাছ ধরছে।

প্রায় আধ কিলোমিটার শালবন খুব ভয়ে ভয়ে পেরিয়ে ডাইনে ঘুরে সুইস গেটে পৌঁছুলাম। কর্নেল বাইনোকুলার তুলে ওপারের জলজঙ্গল দেখতে থাকলেন। এদিকটায় বক, সারস এবং নানা জাতের জলচর পাখি দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে স্বগতোক্তি করলেন, দত্তসায়েবের মেশিন মানে রেডিও সিগন্যাল। রেডিও সিগন্যালের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্য কী?

কৌতুক করে বললাম, স্মাগলিং।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে একটু হাসলেন। মোজাহারকে দেখলাম। তবে বংশীবাবুর বর্ণনার সঙ্গে একটুও মিল নেই। এ মোজাহার লম্বা-চওড়া লোক। পাঠান-পাঠান তাগড়াই চেহারা। তালডোঙায় চেপে এখান থেকে সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে।

ছিপ ফেলে মাছ ধরছে না?

না। ছিপের সুতো ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে!

কী করে বুঝলেন?

তুমি দেখলেও বুঝতে পারবে। দেখবে নাকি?

কর্নেল বাইনোকুলার দিলেন। কিন্তু কাকেও দেখতে পেলাম না। জলাভূমিতে অজস্র জলটুঙ্গি দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ মোজাহারকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে বাইনোকুলারটা কর্নেলকে দিলাম। বললাম, খিদে পেয়েছে। চলুন, ফেরা যাক।

হু। ব্রেকফাস্টের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। চলো।

ট্যুরিস্ট বাংলোয় ফেরার সময় আমরা লেকের উল্টো পাড় দিয়ে হেঁটে গেলাম। এ পাড়েও লেকের সমান্তরালে মসৃণ পিচরাস্তা এবং লেকের কিনারা পর্যন্ত সবুজ ঘাসে ঢাকা পার্ক। পার্কে একই রকম ফুলবাগিচা, লতাকুঞ্জ, দেশিবিদেশি বাহারি গাছ, বসার আসন আর ভাস্কর্য। যারা রোয়িং করছিল, তারা উল্টোদিকের ঘাটে রোয়িং বোটগুলো বেঁধে রেখে এতক্ষণে উঠে যাচ্ছে। চেহারা আর পোশাক-আশাকে কলকাতার উঠতি ধনীদের নতুন প্রজন্মের ছাপ। কর্নেলের কাছে শুনেছিলাম চেতনাউদ্যানের প্রবেশমূল্যই একশো টাকা। এর দশ শতাংশ পাবে বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্ট। বসুন্ধরা অফিসের একটা ল্যাবরেটরি-ঘর তৈরি হয়ে গেছে এবং তার বিজ্ঞানীরা শিগগির এসে যাবেন।

ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় ট্যুরিস্ট লজের ম্যানেজার পি কে দাশ খোঁজ নিতে এলেন কর্নেলসায়েবের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না। কর্নেল বললেন, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না মিঃ দাশ! এত ভালো ব্যবস্থা আমি কল্পনাও করিনি।– তো বসুন্ধরা অফিস কটায় খুলবে বলতে পারেন?

ম্যানেজার বললেন, কলকাতা অফিস থেকে আপনাদের আসার খবর অলরেডি পাঠিয়েছি হেমাঙ্গকে। বুঝতেই পারছেন। স্টাফে সান অব দি সয়েল নিলে কী হয়! হেমাঙ্গ ছেলেটি অবশ্য ভালোই। কুসুমপুরে থাকে। যে কোনও সময়ে এসে যাবেখন। তবে কি জানেন? আপনারা–মানে সায়েন্টিস্টরা পাকাপাকিভাবে না এসে বসা পর্যন্ত কাজের কাজ কিছু হবে না।

ফরেস্ট ডিপার্টের অফিসের কী অবস্থা?

ম্যানেজার হাসলেন। ওরা এখানকার পুরনো পাপী। অফিস খোলা থাকে। স্টাফেরা আসে-যায় মাইনে পায়। গার্ডরা বন্দুক কাঁধে করে ডিউটিতে যায়। কিন্তু কোথায় যায় তা বলতে পারব না। এখন অবশ্য কাঁটাতারের বেড়ায় গোটা এরিয়া ঘিরে ফেলা হয়েছে। তবু কাঠচোরদের কি ঠেকানো যাবে? আমি বিশ্বাস করি না।

ওপেনিং ফাংশানের দিন তো আপনি ছিলেন?

আপনাকে তো বলেছি–

হ্যাঁ। বলেছেন। আচ্ছা মিঃ দাশ, সেরাতে দত্তসায়েবের গাড়ি চলে যাওয়ার পর গেট নিশ্চয় বন্ধ করা হয়েছিল?

করারই কথা। তবে এসব দায়িত্ব আপনাদের অফিসের। কাজেই হেমাঙ্গ বলতে পারবে।

হেমাঙ্গবাবু এলে যেন পাঠিয়ে দেন।

নিশ্চয় দেব।

ম্যানেজার আরও কিছুক্ষণ একথা-সেকথা বলার পর চলে গেলেন। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। বললাম, বনমালীর কথা শুনে মনে হল, চেতনাভিলা নিয়ে একটা হাঙ্গামা বাধতে পারে। স্থানীয় পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, বনমালীর শোনা কথার ওপর গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হবে না জয়ন্ত।

তাহলে রেডিও সিগন্যালের ব্যবস্থা কেন? দত্তসায়েব নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন তার গুণধর পুত্র এসে গণ্ডগোল বাধাতে পারে?

আপাতত এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এখন হেমাঙ্গবাবুর জন্য অপেক্ষা করা যাক। ততক্ষণ তুমি নিচে গিয়ে শরৎকালের প্রকৃতি দর্শন করতে পারো।

খুলেই বলছি কর্নেল! এই বয়সে বেঘোরে মারা পড়ার ইচ্ছে আমার নেই।

বালাই ষাট! ও কথা বলতে নেই।

হাসি পেল ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে। দেহাত-গ্রামে-গঞ্জে এলে আপনি দেখছি একেবারে গেঁয়ো হয়ে পড়েন। গ্রাম্যরীতিতে কথাবার্তা বলেন।

যস্মিন দেশে যদাচার। বলে কর্নেল আবার ধ্যানস্থ হলেন। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম।

বসুন্ধরা অফিসের সেই হেমাঙ্গবাবুর প্রতীক্ষায় এগারোটা পর্যন্ত বসে থেকে কর্নেল উঠলেন। তুম্বো মুখে বললেন, আমি বেরুচ্ছি। রোদে ঘুরতে তোমার কষ্ট হবে। বার্ড-স্যাংচুয়ারি এলাকায় বিরল প্রজাতির পাখি খুঁজে বের করা দরকার। ছবি তুলব। সেই সঙ্গে যদি তেমন বিশেষ প্রজাতির প্রজাপতি চোখে। পড়ে তো ভালোই।

বড্ড, বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন কিন্তু!

নাহ্! যারা মারবে বলে ঠিক করে তারা মারে। হুমকি দিয়ে চিঠি লেখে না।

কর্নেল! মিসেস দত্তকে ওরা গুলি করেছিল। ভুলে যাবেন না।

মিসেস দত্তের গায়ে গুলি লাগেনি।

লাগতে পারত।

কিন্তু লাগেনি। বলে কর্নেল গলায় বাইনোকুলার ও ক্যামেরা ঝুলিয়ে এবং পিঠে কিটব্যাগ বেঁধে বেরিয়ে গেলেন। প্রজাপতি-ধরা নেটের স্টিক বেখাপ্পাভাবে কিটব্যাগ থেকে খোঁচার মতো বেরিয়ে থাকল।

ব্যালকনিতে বসে কর্নেলকে লেকের ধারে হাঁটতে দেখছিলাম। কখনও হঠাৎ থেমে বাইনোকুলারে কিছু দেখছেন। কখনও কোনও ফুলন্ত ঝোপের দিকে ক্যামেরা তাক করছেন।

কিছুক্ষণ পরে উনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই সময় মনে হল, ওঁর সঙ্গে আমার যাওয়া উচিত ছিল। এখানে চুপচাপ একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। পাশের তিনটে ঘরে যাঁরা এসেছেন, তাদের সঙ্গে আলাপের সুযোগ পাচ্ছি। না। হোমরা-চোমরা লোকেরাই হবেন। হয়তো আমলা কিংবা ব্যবসায়ী। সঙ্গে বউ কিংবা প্রেমিকা।

অবশ্য এখনও তাদের কাকেও ঘরে ঢুকতে বা বেরুতে দেখিনি।

বারোটায় ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। চোখের পাতা বুজে এল। তারপর কখন দরজায় কেউ কড়া নাড়ল, অমনি ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। কর্নেল ফিরেছেন ভেবে দরজা খুলতেই দেখি, হালদারমশাই সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল স্যার গেলেন কৈ বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঘরে ঢুকেই চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন।

বললাম, আপনি এখানে চলে এলেন যে?

হালদারমশাই চাপা গলায় বললেন, মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। ভবানীপুরের রায়বাড়িতে কাইল বিকালে ভোলা যারে ইশারায় অমূল্যবাবু বলিয়া দেখাইয়া দিল, সে লক্ষ্মীবাবু! আমি তো এক্কেরে অবাক। আইজ মর্নিংয়ে গিয়া ম্যাডামেরে কথাটা জানাইয়া দিলাম। ম্যাডামও অবাক। আমারে কইলেন, আপনি চেতনাউদ্যানে গিয়া ওয়েট করুন। আমি শয়তানেরে উচিত শিক্ষা দিব। হালদারমশাই ঘড়ি দেখে বললেন, ম্যাডাম ফায়ার হইয়া গেছেন। বিকালের মধ্যেই আইয়া পড়বেন। পুলিশ সঙ্গে লইয়াই আইবেন। কর্নেল স্যার কোথায়?….