৫. দুঃস্বপ্ন
আমি জানি আমি ঘুমিয়ে আছি। মানুষ কখনো কখনো ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে আছে, স্বপ্ন দেখেও বুঝতে পারে এটি স্বপ্ন। আমিও স্বপ্ন দেখছি, বেশির ভাগই দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে অপেক্ষা করে আছি এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের জন্যে। কতকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি কে জানে! কত যুগ কেটে গেছে। হয়তো লক্ষ বছর, হয়তো কয়েক মুহূর্ত। সময়ের যেখানে অর্থ নেই, সেখানে সময়ের হিসেব হয় কীভাবে?
এর মাঝে কেউ-একজন ডাকল। কাকে ডাকল? কে ডাকল?
কোনো উত্তর নেই, নিঃসীম শূন্যতা চারদিকে, কে উত্তর দেবে?
কেউ-একজন আবার ডাকল। কোনো উত্তর নেই, তাই সে আবার ডাকল, তারপর ডাকতেই থাকল। কোনো শব্দ নেই, কথা নেই, কোনো ভাষা নেই, কিন্তু তবু কেউ-একজন ডাকছে।
বহুদূর থেকে আস্তে আস্তে একজন সে ডাকের উত্তর দেয়। কে? কে ডাকে আমাকে?
আমি, আমি ডাকছি। একটা আশ্চর্য উল্লাস হয় তার, তুমি এসেছ? তুমি আমার ডাক শুনেছ?
হয়তো শুনেছি। কী হয় শুনলে?
আনন্দ, অনেক আনন্দ হয়! কতকাল আমরা অপেক্ষা করে থাকি, তারপর কিছু একটা আসে, কত কৌতূহল নিয়ে আমরা খুলে খুলে দেখি, যখন দেখতে পাই একটা জড় পদার্থ, কী আশাভঙ্গ হয় তখন। কিন্তু তোমার মতো একটা জটিল জৈবিক পদার্থের কি কোনো তুলনা হয়? সারি সারি দীর্ঘ অণু সাজান, কী চমৎকার, আহা! কয়টা অণু তোমার? এক লক্ষ ট্রিলিওন, নাকি এক মিলিওন ট্রিলিওন? তার মানে জান? তার মানে এক ট্রিলিওন আনন্দ!
কেন আনন্দ? কিসের আনন্দ?
দেখার আনন্দ, স্পর্শ করার আনন্দ, সৃষ্টি করার আনন্দ, ধ্বংস করার আনন্দ! আনন্দের কি শেষ আছে! আমি দেখব, স্পর্শ করব, পাল্টে দেব ইচ্ছেমতো। আহা। কোথা থেকে শুরু করি? মস্তিষ্ক থেকে? যেখানে লক্ষ লক্ষ নিউরোন সেলে হাজার হাজার তথ্য সাজানো? এটা হচ্ছে তোমার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। খুলে খুলে দেখতে কত আনন্দ, কী কী তথ্য আছে জানতে কী তৃপ্তি! এটা কি আগে দেখব, নাকি পরে দেখব?
তোমার ইচ্ছা।
এটা সবচেয়ে জটিল, এটা সবচেয়ে পরে দেখব, আগে অন্য অংশগুলো দেখি। এই যে দু’টি অংশ দু দিকে বেরিয়ে আছে, দেখতে একরকম, কিন্তু একটা আরেকটার প্রতিবিম্বের মতো, শেষ হয়েছে ছোট ছোট পাঁচটি অংশে, এটা দিয়ে নিশ্চয় কিছু ধরা হয়—কী নাম এটার? মস্তিষ্কে নিশ্চয়ই আছে, খুলে দেখব? হাত! হাত! এটাকে বলে হাত। হাতের শেষে আছে আঙুল, এটা দিয়ে ছোট ছোট জিনিস ধরতে পার, ভারি মজার ব্যাপার! কীভাবে কাজ করে এটা? খুলে দেখব? এই যে ছোট ছোট হঠাৎ থেমে যায় সে, তারপর থেমে থাকে। কতক্ষণ থেমে থাকে কে জানে! হয়তো এক মুহূর্ত, হয়তো এক যুগ। সময় যেখানে স্থির হয়ে আছে, সেখানে এক মুহূর্ত আর এক যুগে ব্যবধান কোথায়? তারপর আবার শুরু করে, তোমার জানতে ইচ্ছা হয় না আমি কে?
হয়তো হয়।
নিশ্চয়ই হয়। অবশ্যি হয়। যার মস্তিষ্ক এরকমভাবে গুছিয়ে তৈরি করা, তার নিশ্চয়ই সবকিছু জানতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ককে সুপ্তাবস্থায় রাখা হয়েছে, এটাকে তোমরা ঘুম বল। ঘুম। তুমি ঘুমিয়ে আছ। তুমি ঘুমিয়ে থাকলেও আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি, আমি তো আর তোমার ইন্দ্রিয় ব্যবহার করছি না, আমি সরাসরি তোমার মস্তিষ্কে তরঙ্গ সৃষ্টি করছি। কিন্তু তোমার এসব জেনে লাভ কি? এসব কিছু থাকবে তোমার মস্তিষ্কে, কিন্তু আমি তো তোমার মস্তিষ্কের একটা একটা অণু খুলে আবার নূতন করে সাজাব, তখন তো এসব তোমার কিছু মনে থাকবে না! কী আছে, তবু তোমাকে বলি, যতক্ষণ জান ততক্ষণই আনন্দ! আমার যেরকম জেনে আনন্দ হয়, তোমারও নিশ্চয়ই আনন্দ হয়।
হয়তো হয়।
তুমি আমাদের জান গ্ৰহপুঞ্জ হিসেবে। আমাদের নাম দিয়েছ রুকুন গ্রহপুঞ্জ। ভারি আশ্চর্য! সবকিছুর তোমরা একটা নাম দাও। সবকিছুর একটা নাম, নাহয় একটা সংখ্যা! রুকুন-রুকুন-রুকুন! ভারি আশ্চর্য নাম! আমাদের সম্পর্কে আর কিছু তুমি জান না। কীভাবে জানবে, তুমি তো এখানে থাক না। আমরা কয়েক লক্ষ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। তুমি অণু দিয়ে তৈরী, তোমার অণুগুলো বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি দিয়ে আটকে আছে। আমরাও অণু দিয়ে তৈরী, আমাদের অণুগুলোও বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় শক্তি দিয়ে আটকে আছে, কিন্তু সেটা বাইরের ব্যাপার। তোমরা যেটাকে উইক ফোর্স বল সেটা হচ্ছে আমাদের সত্যিকার অস্তিত্ব। তাই আমরা এত বড়, তাই আমরা এত জায়গা জুড়ে থাকি। আমাদের শক্তিও তাই সীমিত। উইক ফোর্সের শক্তি তে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি থেকে কম হবেই! কিন্তু আকারে আমরা অনেক বড়, তাই সেটা আমরা পুষিয়ে নিতে পারি। উইক ফোর্স ব্যবহার করি বলে আমরা তোমার ভেতর পর্যন্ত খুলে দেখতে পারি। নিউট্রিনো পাঠিয়ে করি কিনা! নিউট্রিনো তো জান যেখানে খুশি যেতে পারে, অবশ্যি অনেকগুলো করে পাঠাতে হয়, কিন্তু সে আর সমস্যা কি? কী হল, তোমার কৌতূহল কমে আসছে?
জানি না।
তা অবশ্যি জানার কথা না। সবাই কি সবকিছু জানে? এবারে দেখি আর কী কী আছে। মস্তিষ্কের কাছাকাছি এই দুটি জিনিস দিয়ে তুমি দেখ। দেখা আরেকটা মজার ব্যাপার, তোমার দেখতে হয়, না দেখলে তুমি বলতে পার না জিনিসটা কেমন! আমি যদি তোমার দেখাটা বন্ধ করে দিই? এমন ব্যবস্থা করে দিই যে তুমি আর দেখবে না, কিংবা আরো মজা হয় যে দেখবে, কিন্তু অন্যরকম দেখবে! তুমি যেটাকে চোখ বল, সেটাতে যে-রেটিনা আছে সেটাকে আলট্রা ভায়োলেট আলোতে সচেতন করে দিই? তাহলে স্বাভাবিক জিনিস তুমি আর দেখবে না কিন্তু কত অস্বাভাবিক জিনিস দেখা শুরু করবে! চোখ দুটি এক জায়গায় না রেখে দু’টি দু’ জায়গায় বসিয়ে দিলে কেমন হয়? দেব?
আবার থেমে যায় সে। আর সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে থাকে। ঘুমের মাঝে আমি অনুভব করি কিছু একটা হচ্ছে। আমার স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, অস্তিত্ব আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি যেন আস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি, আমার অনুভূতি যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব তিলতিল করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বহুদূর থেকে আমি কারো আর্তচিৎকার শুনতে পাই, চিৎকার করে বলছে, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে? তোমার জৈবিক সত্তা শেষ হয়ে যাচ্ছে? কেন শেষ হয়ে যাচ্ছে? তুমি শীতল হতে হতে জড় পদার্থে পরিণত হয়ে যাচ্ছ! জড় পদার্থ? তুচ্ছ জড় পদার্থ! প্রাণহীন অনুভূতিহীন জড় পদার্থ? জড় পদার্থ…
ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে আমি অনুভব করি আমার ভেতরে সজ্ঞানে-অজ্ঞানে সবসময়ে যে জেগে থাকত সে হারিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতির ভেতরে যে অনুভূতি, অস্তিত্বের ভেতরে যে অস্তিত্ব, আমার ভেতরে যে আমি, তারা আর নেই। যেঅস্তিত্ব স্বপ্ন দেখে, দুঃস্বপ্ন দেখে, আতঙ্ক নিয়ে বিভীষিকার জন্যে অপেক্ষা করে, সেই অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব যখন নেই, তখন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও কিছু নেই, কোথাও কিছু নেই। শূন্যতা—সে এক আশ্চর্য শূন্যতা, তার কোনো বর্ণনা নেই।
এটিই কী মৃত্যু? এই মৃত্যুকে আমি এতকাল ভয় পেয়ে এসেছি?