৫. দিন দুই আগে গুরুপদ

দিন দুই আগে গুরুপদ বলব-বলব করে হঠাৎ বলেই ফেলল, “হ্যাঁ মশাই, আপনি যে পকেটমারি শেখাবেন বলে কথা দিলেন, তা এখন তো দেখছি আপনার মোটেই গা নেই। কেবল খাচ্ছেন দাচ্ছেন, শুয়ে-শুয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছেন, আর আজ না কাল বলে পাশ কাটাচ্ছেন! তা আর কবে শেখাবেন?”

একগাল হেসে বটু সর্দার বলল, “আহা, তাড়াহুড়ো কীসের? তুমি তো বাপু লোকের পকেট মেরে রোজগারপাতি করতে যাচ্ছ না?”

“তা বলে বিদ্যেটা শিখব না মশাই? আমার যে ওইটেই নেশা।”

বটু একটু আনমনা হয়ে বলল, “বৃথা বিদ্যায় কী লাভ বলো তো বাপু? খামোখা শিখে সময় নষ্ট! তার চেয়ে রোজগারপাতি হয়, দুটো টাকা হাতে আসে, এমন কাজই তো ভাল!”

গুরুপদ হতাশ গলায় বলল, “সে আর আমার হওয়ার নয়।” বটু সর্দার সোজা হয়ে বসে হঠাৎ বলল, “তা যদি ফস করে একথোক টাকা তোমার হাতে এসে যায়, তা হলে কী করতে ইচ্ছে যায় তোমার?”

গুরুপদ বিরস মুখে বলল, “সাতমন ঘিও পুড়বে না, আর রাধাও নাচবে না। ওসব ভেবে কী লাভ?”

“আহা ভাবনারও তো একটা সুখ আছে, না কি? মানুষ কি ইচ্ছেমতো সব পায়? খানিকটা পায়, আর খানিকটা ভেবে ভেবে

পূরণ করে নেয়।”

“তা যদি বলেন তা হলে বলতে হয়, হাতে কিছু টাকা পেলে বেশ একটা ঝিনচাক দেখে মোটরবাইক কিনে ফেলতাম। সেইসঙ্গে একটা মনোহারি দোকান খুলে ফেলতাম, আর দেশটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখে আসতাম।”

শুনে খুব হাসল বটু। তারপর অনেকক্ষণ ধরে মাথা নেড়ে-নেড়ে কী ভেবে নিয়ে বলল, “তা সেসব তোমার হয়েই গিয়েছে ধরে নাও। কেল্লা মেরেই দিয়েছ!”

“তার মানে?”

“তোমাকে বলেই বলছি। পাঁচকান কোরো না হে! বলি, গুপ্তধন বলে একটা কথা আছে, শুনেছ কখনও?”

“তা শুনব না কেন?”

“বলি হঠাৎ করে গুপ্তধনই যদি পেয়ে যাও, তা হলে কেমন লাগবে?”

“দূর মশাই, গুপ্তধন-টন পাওয়া কি সোজা নাকি? একশো দেড়শো লটারির টিকিট কিনলাম, তার একটাও লাগল না। আমাদের কি আর সেই কপাল?”

বটু মোটে দমল না। ভারী খুশিয়াল গলায় বলল, “অত হাল ছেড়ে দিয়ো না হে! গুপ্তধনের একটা পাকা খবর আছে বলেই বলছি। কপালটা তোমার বোধ হয় তেমন খারাপ নয়।”

“খবরটা যদি পাকাই হয়, তা হলে আপনি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন কেন? গুপ্তধন তো নিজেই দখল করতে পারতেন?”

বটু উদাস হয়ে বলল, “তা পারতাম। তবে লাভ কী বলো? আমারটা খাবে কে?”

“তার মানে গুপ্তধন পেলে আপনি তার ভাগও চান না?”

একগাল হেসে বটু বলল, “তা চাই না বটে, তবে একজোড়া নতুন জুতো, চুল ছাঁটার পয়সা আর সকালে একদিন ইচ্ছেমতো জিলিপি হলেই চলবে।”

“আপনি বড় গোলমেলে তোক মশাই! খোলসা করে বলুন তো!”

“কথাটা একটু একটু করে ভাঙলে বেশ একটু গা ছমছম ভাব হয়। তাই না?”

“আমার মোটেই তেমনটা হচ্ছে না। ঝেড়ে কাশুন তো মশাই!”

“তোমার তো ওইটাই দোষ! সব ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো। ওরে বাপু, কথা জিনিসটা হল বিস্কুটের মতো। অল্প অল্প করে ভেঙে খেতে হয়। তবে না স্বাদ-সোয়াদ টের পাবে। হালুম-খালুম করে গিলতে গেলে যে গলায় আটকায়!”

“আপনি বড়ই গোলমেলে লোক! তখন থেকে ঝোলাচ্ছেন।”

“আচ্ছা আচ্ছা বাপু, বলছি!” বলে বালিশের তলা থেকে একখানা চামড়ার মোটা বই বের করে গুরুপদকে দেখাল বটু।

“ওটা কী?”

“এই হল হিব্রু ভাষায় লেখা একখানা বহু পুরনো বাইবেল।”

“কোথায় পেলেন?”

“যেখানে ছিল সেখানেই পেয়েছি বাপু! অত কথায় কাজ কী?”

“তা বাইবেল দিয়ে হবেটা কী?”

“আহা, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? এটা শুধু বাইবেল নয়, সোনার খনি।”

বটু বইখানা খুব সাবধানে খুলে পাতার ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা তুলট কাগজ বের করে আনল। ভারী যত্ন করে কাগজটার ভাঁজ খুলে গুরুপদর সামনে তুলে ধরে বলল, “এবার দ্যাখো।”

গুরুপদ দেখল, বহু পুরনো, কীটদষ্ট কাগজটায় একটা আবছা নকশা। বেশ কাঁচা হাতের কাজ। কাগজের উপর পেনসিল দিয়ে লেখা, ‘দি ট্রেজার্স অফ জন আর্চার’। সে উত্তেজিত গলায় বলল, “কোথায় এটা?”

বটু বলল, “ব্যস্ত হোয়য়া না বাপু! জন আর্চারের বাড়ি বেশি দূরে নয়।”

গুরুপদ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল, “জনসাহেবের কবর! এ সেই জনসাহেবের গুপ্তধন নাকি?”

বটু নির্বিকার গলায় বলল, “তা তো বটেই!”

গুরুপদ নকশাখানা হাতে নিয়ে বেশ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল। কাঁচা হাতের কাজ হলেও নকশাটা বিশেষ জটিল নয়। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। জন আর্চারের বাড়ির দক্ষিণের কোণে বড় শয়নকক্ষের নীচে মাটির তলায় তাঁর সব ধনরত্ন পোঁতা আছে। গুরুপদ সোজা হয়ে বলল, “তা হলে আমরা দেরি করছি কেন?”

বটু সর্দার বলল, “দেরি করছি কে বলল?”

“এক্ষুনি বেরিয়ে পড়লে হয় না?”

“দুর পাগল, দিনে-দুপুরে ওসব করতে গেলে বিপদ! পাঁচজনের নজরে পড়বে। পাঁচটা কথা উঠবে। আজ রাত বারোটার পর দু’জনে বেরোব’খন।”

“কী কী লাগবে?”

“দুখানা শাবল আর একখানা হারিকেন।”

“বড় বস্তা-টস্তা নিতে হবে না?”

বটু অবাক হয়ে বলল, “বস্তা? বস্তা দিয়ে কী হবে?”

“ধনরত্ন ভরে আনতে হবে না?”

বটু মাথা চুলকে বলল, “তা বটে!”

সারাদিনটা ভারী উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল গুরুপদর।

রাত বারোটার পর জনসাহেবের জঙ্গলে-ঘেরা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে যখন দু’জনে পৌঁছোল, তখন হাড়কাঁপানো শীত আর কুয়াশা। হারিকেনের মলিন আলোয় কিছুই তেমন ঠাহর হওয়ার উপায় নেই।

গুরুপদ বলল, “একটা টর্চ আনলে বড় ভাল হত মশাই!”

“আরে না। গতকাল এসে আমি জায়গাটা আন্দাজ করে গিয়েছি।”

ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে অতিকষ্টে দু’জন পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল। এক জায়গায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে বটু সর্দার হাত তুলে একটা ইশারা করল।

গুরুপদ উত্তেজিত গলায় বলল, “এইটাই কি সেই শোওয়ার ঘর?”

“হুঁ।”

ভাঙা ইট-কাঠ সরিয়ে একটা বিশেষ জায়গায় শাবল মারল বটু। চাপা গলায় বলল, “ওপাশ থেকে তুমিও লেগে পড়ো হে! সময় নেই।”

খুঁড়তে বেশি মেহনত করতে হল না। নরম ঝুরঝুরে মাটি। বটু সর্দার মাঝে-মাঝেই খোঁড়া থামিয়ে উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শোনার চেষ্টা করছে, আর মাঝে-মাঝে পশ্চিমের দিকে তাকাচ্ছে।

গুরুপদর উৎসাহ বেশি। সে প্রবল বিক্রমে মাটি সরাতে সরাতে হঠাৎ চকচকে একটা জিনিস দেখতে পেয়ে সেটা তুলে আনল। বেশ ভারী এবং বহুঁকালের পুরনো একটা মোমদানি।

“এটা কি সোনার জিনিস নাকি মশাই?”

বটু অন্যমনস্ক গলায় বলল, “হতেও পারে!”

গুরুপদ সোৎসাহে খুঁড়তে থাকল আর মাটি সরাতে থাকল। এর পর উঠল একটা রেকাবি, একটা জং-পড়া তলোয়ার। একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া টাকঘড়ি, তামার হাঁড়ি, সোনালি রঙের একটা ক্রুশ, দু’খানা জং-ধরা পিস্তল। গুরুপদর শরীরে দুনো বল এল। সে দ্বিগুণ বেগে খুঁড়তে লেগে গেল।

হঠাৎ বটু বলে উঠল, “আর নয় হে, এবার গা ঢাকা দিতে হচ্ছে।”

“তার মানে? এই তো সবে শুরু।”

“বাপু হে, পণ্ডিতরা বলেছেন, বিপদকালে অর্ধেক ত্যাগ করতে হয়।”

“দূর মশাই, এখনও তো মোহরের কলসি-টলসি ওঠেনি। অর্ধেক ত্যাগ করার কথা ওঠে কীসে?”

বটু কথা না বাড়িয়ে তার নড়া ধরে একটা এ্যাচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, “ছোটো!”

গুরুপদ গাঁইগুই করতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময় পশ্চিম দিক থেকে কড়াৎ করে একটা শব্দ শোনা গেল। একটা গুলি শিসের শব্দ করে পাশের জারুল গাছটার ডালে বিঁধে গেল। গুরুপদর আর আপত্তি হল না। “বাপ রে!” বলে সে বটুর পিছু পিছু ছুটতে লাগল।

ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে একটা অশ্বথগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দু’জনে চেয়ে দেখল, বন্দুক হাতে একটা বেঁটে আর একটা লম্বা ছায়ামূর্তি তাদের ফেলে আসা হারিকেনের আলোয় গর্তটা দেখছে। টর্চ ফেলে চারদিকটাও একটু দেখে নিল তারা।

“ওরা কারা মশাই?”

“তার আমি কী জানি?”

করুণ গলায় গুরুপদ বলল, “গুপ্তধন কি শেষে ওদের হাতেই যাবে মশাই?”

“রকম-সকম দেখে তাই তো মনে হচ্ছে।”

“বাইবেল আর নকশাখানাও যে ওখানে পড়ে রইল?”

বটু বলল, “তা কী আর করা যাবে বলো? বিপদে অর্ধেক ত্যাগ করতে হয়।”

হতাশ গলায় গুরুপদ বলল, “কিন্তু ধর্মত, ন্যায্যত গুপ্তধনটা তো আমাদেরই প্রাপ্য, কী বলেন? আমরাই তো আবিষ্কার করেছি, খোঁড়াখুঁড়ি করেছি।”

“সে তো বটেই। কিন্তু সেকথা ওদের বুঝিয়ে বলা শক্ত হবে।”

“এটা কিন্তু আমাদের উপর খুব জুলুম হচ্ছে! ইস, কত জিনিস তুলে ফেলেছিলাম! আর একটু খুঁড়লেই মোহরের ঘড়াও পাওয়া যেত!”

“হুঁ।”

“না মশাই, আপনার যেন তেমন হেলদোল নেই? সত্যি করে বলুন তো, আপনার আফসোস হচ্ছে না?”

“হচ্ছে না আবার? খুব হচ্ছে! হওয়ারই কথা কিনা!”

হঠাৎ শোনা গেল, দু’জন লোকের একজন একটু চেঁচিয়ে বলে উঠল, “ওরে পানু, এই যে সেই বাইবেল আর গুপ্তধনের নকশা!”

“কই, দেখি দেখি!”

“এটা নিশ্চয়ই ওই বটু শয়তানের কাজ। ও-ই এসেছিল গুপ্তধন উদ্ধার করতে। খুব সময়মতো এসে পড়েছিলাম রে! চারদিকে নজর রাখতে হবে, বুঝলি! বটু বহুত চালাকি জানে। এবার ওকে খতম করতে পারলে তবে শান্তি।”

গুরুপদ শুকনো গলায় বলল, “ওরা যে আপনার কথা বলছে!”

“তাই তো দেখছি! চলো বাপু, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই। শীতটাও চেপে পড়েছে। খোঁড়াখুঁড়ির মেহনতও হয়েছে কম নয়।”

“চলুন।” খানিকক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর হঠাৎ গুরুপদ বলে উঠল, “আমার কী মনে হয় জানেন?”

“কী মনে হয়?”

“এরকম যে হবে আপনি তা জানতেন।”

“আরে না না। আমাকে কি সবজান্তা ঠাওরালে বাপু?”

“গুপ্তধনটা হাতছাড়া হল, নকশাটা পর্যন্ত বেহাত হল, কিন্তু আপনার যেন তেমন দুঃখ-টুঃখ হচ্ছে না!”

“দুঃখ হচ্ছে বই কী! বেশ দুঃখ হচ্ছে।”

“আমার এমনও মনে হচ্ছে যে, আপনি ওই লোক দুটোকে চেনেন!”

“শোনো কথা! মানুষ চেনা কি আর সোজা কথা নাকি? এত সহজে মানুষ চেনা গেলে তো ভাবনাই ছিল না।”

“আপনি খুব বিটকেল লোক!”

“তা তো বটেই! আমি কি কখনও বলেছি যে, আমি লোক ভাল?”

গুরুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে হাঁটতে লাগল।

বাড়িতে এসে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবল গুরুপদ। গুপ্তধনটা হাতের মুঠোয় এসেও এল না! খুনে দু’জন আর-একঘণ্টা পরে এলেও কাজ হয়ে যেত!

শেষ রাতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল গুরুপদ। সকালে উঠে দেখল, বটু সর্দার তার ঘরে বেশ হাসিখুশি মুখে বসে আছে। হাতে সেই বাইবেলখানা আর নকশাটাও। গুরুপদ অবাক হয়ে বলল, “ওগুলো কোথায় পেলেন?”

বটু হেসে কুটিপাটি হয়ে বলল, “সে আর কোয়ো না বাপু! সকালের দিকে চুপিচুপি কাণ্ডখানা দেখতে গিয়ে দেখি, লোক দুটো বেদম হয়ে হেঁদিয়ে পড়ে আছে। সারারাত খোঁড়াখুঁড়ি করেছে তো! জিনিসও তুলেছে সেথা। একপাঁজা চিনেমাটির বাসন, দুটো বড় বড় লোহার গামলা, গোটাদুই কেঠো চেয়ার, একটা মরচে পড়া গাদাবন্দুক, আতশ কাঁচ, চাবির গোছা, পোড়ামাটির পুতুল, আরও কী সব যেন। তা অত খাটুনিতে দু’জনেই নেতিয়ে পড়েছিল। আমি গিয়ে বাইবেল আর নকশাখানা তুলে নিয়ে এলাম।”

গুরুপদ নাক সিঁটকে বলল, “ওগুলো কেমনধারা গুপ্তধন মশাই? কেবল গুচ্ছের থালা-বাটি-গামলা আর ভাঙা বন্দুক! ঘড়া ঘড়া মোহর বেরোবে তবে না! তা ঘড়া-টড়া দেখলেন না কিছু?”

“আহা, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ঘড়াও কি আর না বেরোবে? আরও খোঁড়াখুঁড়ি করতে দাও না, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে’খন।”

গুরুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বেরোলেই আমাদের কোন লবডঙ্কা হবে বলুন! সবই তো ওদের দখলে যাবে।”

বটু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তা অবিশ্যি ঠিক।”

“না মশাই, আপনার ভাবগতিক আমি ভাল বুঝছি না। ওরা সব সোনাদানা তুলে ফেলছে আর আপনি দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।”

“ওরে বাপু, ভাল দিকটাও তো দেখতে হবে।”

“এর আবার ভাল দিকটা কী মশাই?”

“একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবে। খোঁড়াখুঁড়ির মেহনতটা তো আর তোমাকে পোয়াতে হচ্ছে না। ওদের উপর দিয়েই যাচ্ছে। সেটা ভাল হচ্ছে না?”

“না, হচ্ছে না। একটা কথা আছে না, পেটে খেলে পিঠে সয়। মেহনতে যদি সাতঘড়া সোনা পাওয়া যায় তা হলে সেটা খারাপ হবে কেন?”

বটু হঠাৎ যেন খুব চিন্তিত হয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তাই তো! এটাও তো ভাববার মতো কথা!”

“তাই তো বলছি। একটু ভাবুন। দরকার হলে আরও দশজন লোক জুটিয়ে আমরা ওদের উপর গিয়ে হামলা করতে পারি।”

বটু আঁতকে উঠে বলল, “ওরে সর্বনাশ! খবরদার ও কাজ করতে যেয়ো না। ওরা দুজনেই খুনেগুন্ডা। দশ-বিশটা লাশ লহমায় ফেলে দেবে।”

ভয় খেয়ে গুরুপদ বলল, “তা হলে কী করব?”

“চুপটি করে থেকেই দ্যাখো না। ওদিককার গর্তটা আরও একটু বড় হতে থাক। তারপর দেখা যাবে।”

তা ঘড়াও শেষ অবধি পাওয়া গেল। একটি-দুটি নয়, পরপর সাত-আটটা ঘড়া এবং পাওয়া গেল প্রাণান্তকর পরিশ্রমের পর, দ্বিতীয় রাত্রির শেষে, ভোরবেলার দিকে। তবে তখন পানু আর নিতাইয়ের দম শেষ, টর্চের আলো নিবুনিবু, শরীর ভেঙে আসছে। দু’ রাত্রি আর-একটা পুরো দিন ধরে মাটি খুঁড়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি উপরে এনে ফেলতে হয়েছে। ঘুমোতে পারেনি ভয়ে, ভাল করে খাওয়া হয়নি। গুপ্তধনের নেশায় তারা পাগলের মতো গর্ত খুঁড়েছে। শেষ অবধি জনসাহেবের শোওয়ার ঘরের নীচে পাওয়া গেল একটা ছোট চোরকুঠুরি। নিবুনিবু টর্চের আলোয় অবশেষে চোখে পড়েছে। মাটির উপরে সাত-সাতটা ঘড়ার মুখ জেগে আছে।

ঘড়া তুলতে গিয়ে তারা টের পেল, শরীরে আর একরত্তিও শক্তি অবশিষ্ট নেই। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।

টলতে টলতে কোনও রকমে হেঁচড়ে-হিঁচড়ে দু’জনে উপরে উঠে এল। তারপর মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। বাইরে আলো ফুটেছে, পাখি ডাকছে, সূর্য উঠি-উঠি করতে লেগেছে।

.

কতক্ষণ তারা ঘুমিয়েছে তার হিসেব ছিল না। হঠাৎ একটা হইহই চেঁচামেচি আর বহু লোকের পায়ের শব্দে চমকে দু’জনের ঘুম ভাঙল। দেখল, বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে, চারদিকে ঝলমলে রোদ্দুর। আর সভয়ে দেখতে পেল, পালে-পালে লোক কোদাল, শাবল, গাঁইতি, বস্তা নিয়ে তেড়ে আসছে এদিকেই। অনেকের হাতেই একটা করে কাগজ।

নিতাই চট করে উঠে বসে পিস্তল বের করে গর্জন ছাড়ল, “খবরদার!” তবে গলা ফেঁসে যাওয়ার পর গর্জনটা ফুটল না, একটা ফাসফেসে আওয়াজ বেরোল কেবল।

পিস্তল দেখে লোকগুলো ভয় খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

পানু দুম করে তার পিস্তল থেকে একটা গুলি চালিয়ে দিয়ে বলল, “যে কাছে আসবে সে-ই মরবে।”

একজন মাতব্বর লোক দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, “তোমরা কারা হে? বাইরের লোক গাঁয়ের এলাকায় ঢুকেছ যে বড়? ডাকাত নাকি?”

নিতাই বলল, “কে বলল ডাকাত? আমরা সরকারি লোক, সার্ভে করতে এসেছি।”

“সার্ভেয়ারের তো বন্দুক থাকার কথা নয়!”

নিতাই বলল, “আমাদের সিকিউরিটির জন্য বন্দুক রাখতে হয়। সরকারের কাজে বাধা দিয়ো না, সরে পড়ো।”

সামনের লোকগুলো নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলাবলি করে নিচ্ছিল, তাদের পিছন থেকে হঠাৎ কয়েকজন ছেলেছোঁকরা চেঁচিয়ে বলে উঠল, “এরা আমাদের গুপ্তধন চুরি করে নিতে এসেছে! ওই দ্যাখো কত জিনিস মাটি খুঁড়ে তুলে এনেছে!”

তারপরই মারমার করে ক্ষিপ্ত জনতা তেড়ে এল। দমাদম লাঠিসোঁটা পড়তে লাগল তাদের গায়ে, মাথায়, হাতে।

নিজেদের বাঁচানোর জন্য হাতখানাও তোলার সাধ্য ছিল না নিতাই আর পানুর। ঝিমিয়েই ছিল, মার শুরু হতেই অজ্ঞান হয়ে গেল। তাদের তুলে আনা জিনিসপত্র লুঠপাট হয়ে যেতে তিলার্ধ বিলম্ব হল না।

বহু লোক গর্তে নেমে আরও খোঁড়াখুঁড়ি করে কেউ একখানা কাঁটাচামচ, কেউ কলমদানি, কেউ একখানা মরচে-পড়া ছুরি এইসব পেয়ে যেতে লাগল। শেষমেশ ঘড়াও বেরিয়ে পড়ল বটে। তবে দেখা গেল সেগুলো মোটেই মোহরের ঘড়া নয়, জল রাখবার বেলেমাটির ঘড়া। আগেকার দিনে জল ঠান্ডা করার জন্য মাটির নীচে পাতালঘরে এসব ঘড়ায় রাখা হত।

ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে ফলসাবনের ঝুপসিতে একখানা পাকুড়গাছের ছায়ায় লম্বা, সটান, কালো আর মজবুত চেহারার একজন লোক আড়াল থেকে গোটা দৃশ্যটা খুব ঠান্ডা চোখে দেখে নিচ্ছিল। তার মাথায় বাবরি চুল, মস্ত পাকানো গোঁফ, হাতে একটা পাকা বাঁশের লম্বা লাঠি। তার পিছনে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে আরও জনাচারেক গম্ভীর ও মজবুত চেহারার লোক চুপচাপ খাপ পেতে বসে আছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। তবে তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।

ওগুলো পাওয়া না গেলেও গাঁয়ের লোক বেশ খুশিই। অনেকদিন পর গা গরম করা একটা কিছু তো হল। তা ছাড়া কেউ শুধু হাতেও ফিরছে না। ছোটখাটো জিনিস সবাই এক-আধটা পেয়েছে। তাই বা মন্দ কী? দুপুর গড়ানোর আগেই ধীরে-ধীরে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। মস্ত শিশুগাছের তলায় শুধু নিতাই আর পানু অজ্ঞান হয়ে চিতপটাং পড়ে আছে।

ধীরে-ধীরে লম্বা লোকটা এসে খোঁড়াখুঁড়ির জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চারদিকটা ভাল করে লক্ষ করল। তার পিছনে গম্ভীর চারটে লাঠিধারী ষন্ডা চেহারার মানুষ।

লম্বা লোকটা একটা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে একটু দেখল। তারপর স্যাঙাতদের একজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “এই সেই গুপ্তধনের নকশা।”

স্যাঙাতটা বলল, “হু। এটাই জেরক্স করে বিলি করা হয়েছে তো?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু কেন বেজাবাবু? মতলবটা কী?”

“বুঝলি না? যে বিলি করেছে সে ভালই জানত, এখানে গুপ্তধন নেই। কিন্তু নিতাই আর পানু লোভী। ওদের কোনওভাবে নকশাটা গছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ব্যবস্থা করার জন্য নকশাটার জেরক্স বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়।”

“কিন্তু করলটা কে?”

“যে করেছে তার টিকির নাগাল পেতে গত পাঁচবছর ধরে আমি কম হয়রান হইনি। দু’বার বাগে পেয়েও ছিলাম, কিন্তু পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে।”

“এ কি বটু সর্দারের কাজ বেজাবাবু?”

“বটু সর্দার ছাড়া এমন ট্যাটন আর কে?”

স্যাঙাতদের আর-একজন বলে উঠল, “কিন্তু তাকে তো আপনি ভিটেছাড়া করে দিয়েছেন। তার চেলাচামুণ্ডারাও সব ছিটকে ছড়িয়ে গিয়েছে। তার দলবলও নেই, পয়সাও নেই। বয়সও হয়েছে।”

বেজাবাবু গম্ভীর হয়ে ভ্রুকুটি করে বলল, “আর কিছু না থাক, মাথাভরা শয়তানি বুদ্ধি এখনও আছে। আর সেটা যতদিন আছে ততদিন তাকে জব্দ করা সহজ কাজ নয়।”

কেউ কোনও কথা বলল না। বেজাবাবু তার স্যাঙাতদের একজনের দিকে চেয়ে বলল, “শ্যামলাল, গোপালহাটিতে তোর চেনাজানা কে একজন আছে বলছিলি না?”

“হ্যাঁ। রায়বাড়ির সুজয়পদ রায়। পালোয়ান মানুষ। একসময় নয়াগঞ্জে শচীন তাঁতির আখড়ায় দু’জনেই ডন-বৈঠক করতাম।”

“একটু খোঁজ নিয়ে দ্যাখ তো, বটু গোপালহাটিতেই গা ঢাকা দিয়ে আছে কি না। যত দূর মনে হচ্ছে, আসল নকশাখানা হাতে রেখে বটু একটা জালি নকশা নিতাই আর পানুকে গছিয়েছিল।”

স্যাঙাতদের আর-একজন, নিতান্তই সদ্য গোঁফ গজানো ছোঁকরা বলল, “কিন্তু বেজাবাবু, ধরুন ফস করে যদি বটুসর্দারের সঙ্গে আমাদের কারও মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়, তা হলে কী করতে হবে?”

বেজাবাবু ভ্রুকুটি-কঠিন দৃষ্টিতে ছোঁকরার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, “সেটাও বলে দিতে হবে? দেখামাত্র এক লহমাও দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালিয়ে দিবি। মুখে আর মাথায়। মনে থাকে যেন, এক লহমাও দেরি করা চলবে না। যদি দু’ সেকেন্ডও দেরি হয়, তা হলেই বটু ছায়া হয়ে যাবে, মায়ার মতো মিলিয়ে যাবে। বটুর পিছনে বহু বছর লেগে থেকেও আজ অবধি আমি বুঝে উঠতে পারিনি, বটু মানুষ না ভূত! কায়া না ছায়া! বুঝেছিস?”

কেদার নামের ছোঁকরাটি বলল, “বুঝলাম। কিন্তু ভয় হল, বটু সর্দারকে কখনও চর্মচক্ষে দেখিনি। বটু মনে করে ভুল লোককে মেরে না দিই।”

“তাতে ক্ষতি নেই। যুদ্ধের সময় কত নিরীহ মানুষও তো মরে। সেটা তো ধর্তব্যের মধ্যে নয়। বটু বলে যাকেই মনে হবে তাকেই গুলি করবি। মনে থাকে যেন, যে বটুকে মারতে পারবে তার জন্য পাঁচ হাজার টাকার ইনাম আমার কবুল করাই আছে।”

ছোঁকরা কেদার গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বুঝেছে। পরক্ষণেই সে তলচক্ষুতে তার পাশে আর-এক ছোঁকরা ফটিকের দিকে চেয়ে একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। ফটিক বাঁ চোখটা একটু ছোট করে মৃদুস্বরে বলল, “চেপে যা।”

চোখে-মুখে ঠান্ডা জলের ঝাঁপটা খেয়ে নিতাই আর পানু যখন চোখ মেলল, তখন শীতের বেলা অনেকটাই চলে গিয়েছে। ঝাঁপসা চোখে তারা সামনে কালান্তক যমের মতো বেজা মল্লিককে দেখে আঁতকে উঠে কাঠ হয়ে গেল। কোনওরকমে কেতরে ককিয়ে উঠে বসে নিতাই হ্যাঁদানো গলায় বলল, “আমাদের মারবেন না বেজাবাবু, আমাদের দোষ নেই।”

বেজা মল্লিক অনুত্তেজিত ঠান্ডা গলায় বলল, “তাই বুঝি?”

“আপনাকে না জানিয়ে আপনার এলাকায় কোনও কাজে কখনও হাত দিয়েছি, বলুন?”

বেজাবাবু গম্ভীর হয়ে বলল, “এই জালি নকশা তোরা কোথায় পেলি?”

পানু বলল, “নকশা জালি নয় বেজাবাবু। সেই পুরনো বাইবেল আর আসল নকশা নিয়ে পরশু রাতে স্বয়ং বটু সর্দার এখানে মাটি খুঁড়ছিল।”

“বটু সর্দার! ঠিক জানিস বটু সর্দার?”

“দূর থেকে হ্যারিকেনের আলোয় দেখা। রাতে কুয়াশাও ছিল। হলফ করে বলতে পারব না। তবে দু’জন লোক এসেছিল। বুড়োজনকে দূর থেকে বটু সর্দার বলে মনে হয়েছে আমাদের দু’জনেরই।”

“তারপর?”

“সুযোগ হাতে এসে যাওয়ায় আমরা তাড়া করে যাই। গুলিও চালিয়েছিলাম। ওরা বাইবেলখানা আর নকশাটা ফেলেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়। আমরা দুটো জিনিসই ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছি। সেটা পুরনো সেই বাইবেলই বটে, আর নকশাখানাও আসল।”

“সে দুটো এখন কোথায়?”

“সে দুটো এখানেই থাকার কথা। কিন্তু গাঁয়ের লোকের হুজুতে কী হয়েছে বলতে পারব না।”

বেজাবাবু আষাঢ়ে মেঘের মতো মুখ করে বলল, “দ্যাখ নিতাই, গত দশ বছর ধরে এই মহল্লার গায়ে-গাঁয়ে সেই পুরনো বাইবেল আর তার ভিতরে রাখা নকশাখানার খোঁজ হচ্ছে। কারও কাছে সন্ধান পাওয়া যায়নি। তোরা কি বলতে চাস, পরশু রাতে হঠাৎ করে তোদের হাতের নাগালে বাইবেল আর নকশা স্বয়ং মা কালীই এগিয়ে দিল! না কি আর-একটা গল্প ফেঁদে আমাদের হয়রান করতে চাইছিস?”

নিতাই হাঁফসানো গলায় বলল, “না বেজাবাবু, মাকালীর দিব্যি করেই বলছি, বাইবেল আর নকশা বাস্তবিকই আমাদের হাতে এসে গিয়েছিল। কপালের ফের ছাড়া আর কী বলি বলুন? গাঁয়ের লোকগুলো হুড়ো না দিলে…!”

বেজাবাবু বজ্রকণ্ঠে বলল, “তবে শোন, গাঁয়ের লোকেরা বিস্তর খোঁড়াখুঁড়ি করেও গুপ্তধনের কিছুই পায়নি। আর তারও আগে ওই নকশা জেরক্স কপি করে বাজারে কাল সকালে বিলি করা হয়েছিল। নকশাটা যদি আসলই হবে, তা হলে সেটা কি কোনও আহাম্মক বিলি করে বেড়ায়?”

নিতাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। সে স্খলিত কণ্ঠে বলল, “অ্যাঁ! এ খবর তো আমাদের জানা ছিল না বেজাবাবু!”

পানু হতাশ গলায় বলল, “হ্যাঁ বটে, গাঁয়ের লোকের হাতে লিফলেটের মতো কী যেন ছিল বটে!”

বেজাবাবু বলল, “নিতাই, তুই একসময় বটু সর্দারের চেলা ছিলি, একটা কথার সাফ জবাব দে। তুই কি এখনও বটু সর্দারের হয়ে কাজ করছিস? তোকে সামনে রেখে আড়াল থেকে বটু আমাকে ঘোল খাওয়াবার চেষ্টা করছে না তো?”

“না বেজাবাবু, মা কালীর দিব্যি।”

“তা হলে যা, এবারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। এ তল্লাটে ফের ঢুকবি তো লাশ হয়ে বেরোবি।”