৫. তেল ইয়ারিমাহ

০৫. তেল ইয়ারিমাহ

স্বীকার করতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই যে, মিসেস লিডনারকে প্রথম দেখে আমার মনে যে ধারণা হয়েছে সেটা পুরোদস্তুর বিস্ময়কর যেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিসেস লিডনার অতৃপ্ত কামনা-বাসনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন এখন। আমি ভেবেছিলাম, একটা বিশ্রী অবস্থায় ওঁকে দেখতে হবে। কিন্তু আমার সব ধারণা পাল্টাতে হল, আমি যা ভেবেছিলাম উনি তা নন। শুরুতেই বলে রাখি, সুন্দরী, রীতিমত সুন্দরী উনি। তবে ওঁর স্বামীর মতো জাতে উনি সুইডিস নন। স্বর্ণকেশী, স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশের মেয়েদের মতো রূপ ওঁর, সচরাচর এরকম দেখা যায় না। ওঁকে ঠিক যুবতী বলা যায় না। মাঝবয়সী, তিরিশ থেকে চল্লিশ বয়স হবে। ওঁর মুখটা ঈষৎ কৃশ, তবে চোখ দুটো অপূর্ব, ওরকম সুন্দর বেগুনি রঙের চোখ আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। বড় বড় চোখের নীচে সামান্য একটু কালো ছায়ার আস্তরণ। রোগাটে চেহারা। ওঁর চাহনির মধ্যে কি একটা যেন গোপন করবার অদম্য কৌতূহল লুকিয়েছিল।

আমার দিকে তিনি তার হাতটা প্রসারিত করে হাসলেন। মুক্তোর মতো সারিবদ্ধ দাঁতের হাসিটা বড় মিষ্টি বলে মনে হল। নিচু গলায় শান্ত ভাবে তিনি শুধোলেন, চা খাবে? নাকি একেবারে তোমার ঘরেতে গিয়ে উঠবে? তাঁর কথায় আমেরিকান সুর।

চা খাবার ইচ্ছাটা প্রকাশ করলাম আমি। টেবিলটাকে ঘিরে বসে থাকা অভ্যাগতদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বললেন,–ওঁরা হলেন মিস জনসন এবং মিঃ রেইটার, মিসেস মারকাডো, মিঃ টমোট, ফাদার ল্যাভিগনি। আমার স্বামী একটু পরেই এখানে এসে হাজির হচ্ছেন। তারপর ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিস জনসনের মাঝখানের আসনটা দেখিয়ে তিনি বললেন, তুমি ওই জায়গাটায় বস।

মিস জনসন বেশ আলাপী। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমার সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে নিলেন। আমারও বেশ ভাল লাগল তাঁকে। পঞ্চাশের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার কথার মধ্যে যথেষ্ট গভীরতা ছিল এবং মিষ্টি করে কথা বলার সময় একটা ব্যস্ততা লক্ষণীয়। টুইড কোর্ট এবং স্কার্টে তাকে কতকটা পুরুষের মতোই দেখাচ্ছিল। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে তিনি বললেন, ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা তিনি।

ওঁদের মধ্যে ফাদার ল্যাভিগনিকে একটু সতর্ক বলে মনে হল। রীতিমতো লম্বা তিনি, কালো দাড়ি, নাকে স্প্রিং লাগান চশমা। মিসেস কেলসি বলেছিলেন, এখানে একজন ফরাসী সন্ন্যাসী আছেন। এখন ফাদার ল্যাভিগনির পরনে সাদা উলের আলখাল্লা দেখে মনে হল, ইনিই তাহলে সেই ফরাসী সন্ন্যাসী। ওঁকে এখানে এই লোকালয়ে দেখে অবাক হয়ে যাই, কারণ ছেলেবেলা থেকে আমি জেনে এসেছি, সাধু-সন্ন্যাসীরা সাধারণত লোকালয় ছেড়ে নির্জন মঠ বা আশ্রমে বাস করে থাকেন, মঠের বাইরে থাকেন না কখনও তারা।

মিসেস লিডনার বেশির ভাগ সময় ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন তাঁর সঙ্গে। কিন্তু ফাদার ল্যাভিগনি বেশ স্পষ্ট ইংরেজি ভাষায় কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। লক্ষ্য করলাম, ওঁর মুখের ভাব-ভঙ্গী এবং চাহনির মধ্যে একটা চতুরতার ছাপ আছে। ওঁর মেপে মেপে কথার বলার মধ্যে একটা পরিশ্রমের ছাপও পাওয়া যায়।

আমার ঠিক বিপরীত দিকে অপর তিনজন বসেছিল। মিঃ রেইটার বেশ শক্ত সমর্থ যুবক, চোখে চশমা। তার কোঁকড়ানো চুল কাঁধের অনেক নিচে নেমে গেছে। এবং নীল গোলাকৃতি চোখ। প্রখর দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, সে যেন একটা নিষ্পাপ শিশু। কিন্তু তাকে ভাল করে দেখতে গিয়ে আমার মনে হল, শূকরছানার মুখ ধারণ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষের অবয়ব। অপর দুটি যুবকের চুল ছোট করে ছাঁটা। একজনের মুখের দিকে তাকালে আমার কেন জানি না মনে পড়ে যায় একজন ভাড়ের কথা, তার দাঁতগুলো ভারী চমৎকার। হাসলে তাকে ভারী সুন্দর দেখায়। কম কথা বলে সে। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর সে মাথা নেড়ে সায় দেয়। রেইটারের মত সেও জাতে আমেরিকান। শেষ ব্যক্তি হল মিসেস মারকাভো। তার দিকে আমি ভাল করে তাকাতে পারছিলাম না, কারণ যখনই আমি তাকে আড়চোখে দেখতে যাই, বুঝতে পারি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তার ক্ষুধার্ত চোখ দিয়ে। যেভাবে সে আমার দিকে তাকিয়েছিল তাতে মনে হবে যে, হাসপাতালের নার্স মাত্রই যেন এক একটি জানোয়ার; সভ্যতা ভদ্রতা বলে কিছু জানে না তারা।

মিসেস মারকাভোর বয়স খুব বেশি নয়, পঁচিশের কাছাকাছি হবে হয়তো। গায়ের রঙ কালো এবং চেহারা দেখে মনে হয়, বোধহয় এই মাত্র সে গর্ভপাত করিয়ে এসেছে। তবে এককালে সে যে সুন্দরী ছিল তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। গায়ের পুলওভারের রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নখে নখ পালিশ লাগান। পাখির ঠোঁটের মত সরু ঠোঁটে চাপা উত্তেজনা। বড় বড় চোখ দুটো সজাগ সদা সর্বদা। মুখে সব সময় যেন একটা সন্দেহের ছাঁয়া লেগে আছে।

চায়ে চুমুক দিয়েই বুঝতে পারি, ভাল স্বাদ আছে। একেবারে সস্তা দামের কিছু নয়। সঙ্গে জ্যাম-জেলি মাখন টোস্ট। মিঃ এমাট আমার খাবারের তদারকি করছিলেন।

মিসেস লিডনার বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং একবার তার দিকে ফিরে তাকালেন, কিন্তু তাতে কোন ফল হল না।

আমাদের আলাপের একেবারে শেষ পর্বে মিঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো এসে উপস্থিত হলেন সেখানে।

মিঃ লিডনার তার স্বভাব সুলভ সুন্দর ভঙ্গিমায় আমাকে সম্ভাষণ জানালেন। চিন্তিত মুখে তিনি দ্রুত তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, পরক্ষণেই লক্ষ্য করলাম, তার মুখের উপর থেকে সেই ভাবনার ছায়াটা উধাও হয়ে গিয়ে, একটা তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল সেখানে। টেবিলের অপর প্রান্তে বসলেন মিঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো মিসেস লিডনারের শূন্য আসনটা দখল করলেন।

দীর্ঘদেহী মিঃ মারকাভোর মুখটা অজানা আতঙ্ক এবং বিষণ্ণতায় ভরা, স্ত্রীর থেকে তার বয়স অনেক বেশি, অবিন্যস্ত দাড়ি। মনে হয় কোন কারণে নিজের শরীরের উপর তেমন যত্ন তার নেই। তার আগমনে আমি একটু খুশি হলাম, কারণ তিনি সেখানে প্রবেশ করা মাত্র তার স্ত্রী আমার দিকে তাকান বন্ধ করে দিল, এবং তার স্বামীর দিকে নজর দিল। তাকে ভীষণ অধৈর্য এবং চিন্তিত দেখাচ্ছিল, তার এই ভাবগতিক কেমন খাপছাড়া লাগল আমার কাছে। মিঃ মারকাভোর মধ্যেও একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখলাম, যেন স্বপ্নের ঘোরে চা খাওয়া শেষ করলেন নিঃশব্দে, কোন কথা নেই। অন্য কিছু খাওয়ার দিকে তেমন ইচ্ছা নেই। প্লেটের কেক প্লেটেই থেকে গেল।

এখনো একটা আসন ফাঁকা ছিল সেখানে। আর সেই সময় দরজা ঠেলে একটা লোক প্রবেশ করল।

আগন্তুক রিচার্ড ক্যারি। তার মত সুপুরুষ অনেকদিন চোখে পড়েনি। একই সঙ্গে কাউকে যদি একবার সুপুরুষ বলা যায়, এবং পরমুহূর্তে যদি বলা হয় যে, অন্য কোন মৃত সুপুরুষ ব্যক্তির মাথাটা কেটে তার দেহের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, স্বভাবতই কথার মধ্যে একটা বিসদৃশ্য ভাব থেকে যায়, তবু কথাটা সত্যি। এতটুকু বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলা নয়। তার বাদামি মুখে জ্বলজ্বলে নীল চোখ দুটো বড় অদ্ভুত, বড় বেমানান, এরকম বিসদৃশ এর আগে আমি কখনো দেখিনি বোধহয়। লম্বায় ছ’ফুট, বয়স মনে হয় চল্লিশের নিচেই হবে।

নার্স, ইনি হলেন আমাদের প্রত্মতত্ত্ববিদ মিঃ ক্যারি, ডঃ লিডনার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

আনন্দের অতিশয্যে অস্পষ্ট গলায় ইংরাজিতে কি যেন বললো ফিসফিসিয়ে, বোঝা গেল না। তারপর তিনি গিয়ে বসলেন মিসেস মারকাভোর পাশে।

তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হল, তাঁরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছে আগন্তুক, তাঁদের ভাবভঙ্গি দেখলে মনেই হয় না যে তারা পরস্পরের পূর্ব পরিচিত, কেউ কেউ আবার একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের পরিচিত বেশ কয়েক বছরের।

.

০৬.

প্রথম সন্ধ্যা

চায়ের আসরের পর আমাকে ঘর দেখাবার জন্য নিয়ে গেলেন। মনে হয় এখানে ঘরগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া দরকার। বোঝবার কোন অসুবিধা নেই, অতি সহজ সরল প্ল্যান।

বিরাট উন্মুক্ত বারান্দা, বারান্দার দু’দিকেই দরজা, মূল দুটি ঘরের প্রবেশ পথ। ডানদিকে ডাইনিংরুম যেখানে একটু আগে আমরা চা খেয়ে এলাম। অপর দিকে ঠিক সেই রকমই আর একটি ঘর, (এটা আমি শয়ন কক্ষ বলে মনে করি) বসবার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে সেটা। যেখানে কিছু ড্রইং-এর কাজ হয়ে থাকে।

বসবার ঘরের মধ্যে লাগোয়া আর একটা ঘর আমার চোখে পড়ল। খননকার্য চালাবার সময় মাটির নিচে থেকে পাওয়া ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য জিনিসগুলোর প্রদর্শনী ক্ষেত্র বলা যেতে পারে এই ঘরটা। দেওয়ালের সঙ্গে লাগোয়া সেলফ, পায়রার খোপের মত ছোট ছোট খোপগুলোয় জিনিসগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই চোরাকুঠুরি থেকে সরাসরি বেরুবার কোন দরজা নেই।

সেই চোরাকুঠুরির পাশের ঘরটা মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষ। কোর্টইয়ার্ডে যাবার দরজা আছে সেই ঘরের। মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষটা ছিল এক কোণায়। তার পাশের ঘরটা ডঃ লিডনারের, তবে দুটি ঘরের যোগাযোগের সেতু বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ কোন দরজার বালাই ছিল না। বাড়ির পূর্বদিকের এই ঘরটাই ছিল প্রথম। তারপরের ঘরটা আমার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আমার ঠিক পরবর্তী ঘরটা মিস জনসনের। তার পরের দুটি ঘর যথাক্রমে মিঃ অ্যান্ড মিসেস মারকাভোর। তারপর দুটি বাথরুম।

প্রতিটি শয়নকক্ষ প্রায় একই রকম, একটি জানালা এবং কোর্টইয়ার্ডে যাবার একটি মাত্র দরজা। দক্ষিণে ড্রইং অফিস, ল্যাবরেটারি এবং ফটো তোলার ঘর।

অপরদিকের ঘরগুলোর ব্যবস্থাও ঠিক একই রকমের, কোর্টইয়ার্ডে যাবার একটি মাত্র রাস্তা। ড্রইংরুম সংলগ্ন অফিসঘর। মিসেস লিডনারের অনুরূপ ঘরটা ফাদার ল্যাভিগনির, তাকে সব থেকে বড় ঘরটা দেওয়া হয়েছিল।

দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ছাদে যাবার সিঁড়ি। পশ্চিমদিকে শুরুতে রান্নাঘর কোয়ার্টার এবং পর পর চারটি ছোট আকারের শয়নকক্ষের বাসিন্দারা হল চারজন যুবক, ক্যারি, ইমোট, রেইটার এবং কোলম্যানের।

উত্তর-পশ্চিম কর্নারে ডার্করুম, মধ্যে ফটো তোলার ঘর। তার পাশেই ল্যাবরেটরি। তারপরেই একমাত্র প্রবেশ পথ, বিরাট খিলানের নিচে দরজা। সেই দরজাপথ দিয়ে আমরা প্রবেশ করেছিলাম। বাইরে স্থানীয় ভৃত্যদের থাকবার কোয়ার্টার, সৈনিকদের জন্য প্রতীক্ষালয়, ঘোড়াদের আস্তাবল।

বিল্ডিংয়ের একটা পূর্ণ বিবরণ আমি এখানে দিলাম, এই কারণে যে, পরে তার পুনরাবৃত্তি করতে যেন না হয়।

একটু আগে যা বললাম, মিসেস লিডনার নিজে আমাকে সঙ্গে করে সারা বিল্ডিংটা ঘুরিয়ে দেখালেন, অবশেষে আমার থাকবার ঘরে নিয়ে এলেন, উদ্দেশ্য এরপর যাতে করে আমি পূর্ণ বিশ্রামের অবকাশ পাই। ঘরটা দারুণ পরিপাটি করে সাজানো।

মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজের আগে এবং সকালে অবশ্যই ছেলেরা গরম জল দিয়ে যাবে। বাড়তি জলের প্রয়োজন হলে বাইরে বেরিয়ে এসে হাতের ইশারায় ছেলেদের ডাকতে হবে। তারা কাছে এলে বলবে, জিব মাই হার কথাটা মনে থাকবে তো?

মাথা নাড়লাম। নিচু গলায় দু-চারবার কথাটা আওড়ালাম।

 ঠিক আছে। আরবরা সাধারণ ইংরাজি ভাষার এক বর্ণও বোঝে না।

ভাষাটা দেখছি এখানে একটা দারুণ সমস্যা।

তা যা বলেছ, মিসেস লিডনার বলেন, এখানে প্যালেস্টাইনে একটা চার্চ আছে, সেখানে উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে লেখা প্রার্থনা সংগীত বিভিন্ন ভাষায় লেখা আছে।

ঠিক আছে, আমি বললাম সেই লেখাগুলো আমি অবশ্যই লিখে রাখব, পরে আমার কাকীমাকে বলব, তিনি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন।

আমি আশাকরি, এখানে তুমি সুখেই থাকবে, তারপর হঠাৎ মিসেস লিডনার তার বেগুনি রঙের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন –সত্যি করে বল তো নার্স, আমার স্বামী ঠিক তোমাকে আমার সম্বন্ধে কি বলেছেন? আমার কাছে কিছু লুকোবার চেষ্টা করো না।

আমি শুনেছি, আপনার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে মিসেস লিডনার, সহজ ভাবে কথাটা একরকম ছুঁড়ে দিলাম, আর সেই কারণে আপনার দেখাশোনা করবার জন্য এবং আপনার সুখ-স্বাচ্ছন্দের প্রতি লক্ষ্য রাখবার জন্য আপনি আমাকে এখানে এনেছেন।

চিন্তিত ভাবে ধীরে ধীরে মাথাটা একটু কাত করে মিসেস লিডনার বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি আমার উপকারে আসবে বৈকি!

তাঁর কথাটা হেঁয়ালির মত শোনাল। কিন্তু এ নিয়ে আমি আর কোন প্রশ্ন করলাম না। বরং আরো একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, আশা করব, আপনি আমাকে আপনার বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করার সুযোগ দেবেন, আমাকে বেকার হয়ে বসে থাকতে দেবেন না।

হাসলেন তিনি। ধন্যবাদ নার্স।

তারপর তিনি আমার বিছানায় বসে হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলছি এই কারণে যে, তাঁর চোখের দিকে ভাল করে তাকাতে গিয়ে সেই প্রথম আমার মনে হল মিসেস লিডনার একজন মহিলা। আর আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোন মহিলা অন্য কোন মহিলার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামিয়ে থাকে। কিন্তু তিনি যেন তাদের ব্যতিক্রম। আমার সম্বন্ধে সব কিছু জানবার আগ্রহ তার খুব। কোথায় আমি ট্রেনিং নিয়েছি। এখানে আসার কী কারণ থাকতে পারে। আমাকে ডঃ রেলি সুপারিশ করলেন কী জন্য। এমন কি তিনি জানতে চাইলেন, আমেরিকায় আমি কখনো গেছি কি না এবং সেখানে আমার কোন আত্মীয় কিংবা বন্ধু-বান্ধব আছে কিনা। তারপর তিনি এমন কয়েকটা প্রশ্ন করলেন যা ঠিক সেই সময় আমার কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু পরে দেখলাম যথেষ্ট অর্থবাহক বটে।

তারপর হঠাৎ তিনি কেমন বদলে গেলেন। হাসলেন, সূর্যস্নাত উচ্চ হাসি। তার মিষ্টি কণ্ঠস্বর আমার কানে যেন মধু বর্ষণ করল, আমাকে পেয়ে তিনি নাকি খুশি এবং তিনি নিশ্চিত আমি তার অনেক উপকারে আসতে পারি। কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন, ছাদে গিয়ে আমি সূর্যাস্ত দেখতে চাই কিনা। আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং তখুনি আমরা দুজনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

বাইরে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাগদাদ থেকে আসবার সময় নির্দিষ্ট কোন লোক তোমার নজরে পড়েছে?

উত্তরে আমি বললাম, তেমন কোন নির্দিষ্ট লোককে আমার মনে পড়ে নি, তবে রেস্টুরেন্ট-কারে দু’জন ফরাসীকে দেখেছিলাম। আর তিনজন লোককে পাইপ লাইনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে শুনেছিলাম।

তিনি মাথা নাড়লেন। তার মুখ-চোখের অবস্থা দেখে মনে হল, তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

মিসেস মারকাডো বসেছিলেন প্যারালোটের উপর এবং ডঃ লিডনার কতকগুলো টুকরো টুকরো পাথর এবং মাটির বাসনের উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন নিরীক্ষণ করছিলেন নির্দিষ্ট মনে। মনে হয় সেই জিনিসগুলো অতি দুষ্প্রাপ্য। সত্যি কথা বলতে কি অমন অদ্ভুত ধরনের পাথর আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না।

এই যে এখানে এসো’, মিসেস মারকাভোর কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালাম তার দিকে, দৃশ্যটা সুন্দর না?

পাকা টমাটোর মতো লাল সূর্যটা চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, অপূর্ব সেই দৃশ্য, অনস্বীকার্য। অদূরে টাইগ্রিস নদীর কলকল শব্দ। এই মুহূর্তে দূর থেকে হাসানিয়েকে যেন এক স্বপ্নময় দেশের সুন্দরী পরীর মত দেখাচ্ছিল। এই মুহূর্তে আমরাও যেন স্বপ্নের আবর্তে পড়ে একাকার হয়ে গেলাম।

চমৎকার, তাই না এরিক? মিসেস লিডনারের ঠোঁটে কৌতুকের হাসি।

আবিস্ট চোখে তাকালেন ডঃ লিডনার, ফিসফিসিয়ে বললেন, চমৎকার, চমৎকার। কথা বলতে বলতেই তিনি সেই মাটির বাসনপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছিলেন।

মিসেস লিডনার হাসলেন, প্রত্মতত্ত্ববিদরা বড় বেরসিক, তারা তাদের পায়ের নিচের জিনিস ছাড়া অন্য কিছু দেখতে চায় না। তাদের মাথার উপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা একটা সুন্দর আকাশ যে আছে, সেটা বোধহয় তাদের জানা নেই।

মিসেস মারকাডো মুচকি হাসলেন।

ওঃ, ওঁরা যে সন্দেহবাতিক লোক, একটু পরেই তুমি তা টের পাবে নার্স। একটু থেমে ঠোঁটের প্রান্ত রেখায় হাসির একটা সূক্ষ্ম রেখা টেনে তিনি আবার বললেন, তুমি এসেছ, তাতে আমরা সবাই খুব খুশি। আমাদের প্রিয় মিসেস লিডনারকে নিয়ে আমাদের খুব দুশ্চিন্তা ছিল, তাই না লুসি?

তোমার কী খুব দুশ্চিন্তা ছিল? মিসেস লিডনারের কথা শুনে মনে হল, মিসেস মারকাভোর কথায় তিনি খুব একটা স্বস্তিবোধ করলেন না। যাইহোক, আমার ব্যাপারে তোমাকে আর ভাবতে হবে না মেরি। এখন থেকে নার্স আমার যত্ন নেবে।

নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই! আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম।

মিসেস লিডনারের কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি না মনে হল, খুব সহজে তিনি তার শত্রু সৃষ্টি করতে পারেন। তার কথাবার্তায় একটা রুক্ষ্ম, মেজাজের সুর ধ্বনিত হয়–(তবে এর জন্য আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না)।

ওদিকে মিসেস লিডনার ছাদের একেবারে শেষ প্রান্তে তার স্বামীর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন। ভঃ লিডনার টের পাননি তার আগমনের কথা, তার পিঠে কোমল হাতের স্পর্শ পড়তেই তিনি ফিরে তাকালেন চকিতে। ডঃ লিডনার শান্ত চোখে তাকালেন স্ত্রীর পানে, সে চোখে অনেক জিজ্ঞাসা এবং অনেক অজানা কৌতূহল।

মিসেস লিডনার শান্তভাবে মাথা নাড়লেন, তার একটা হাত লিডনারের কাঁধে জড়ানো ছিল।

ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর প্রতি খুবই অনুরক্ত, তাই না? মিসেস মারকাডো প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলেন।

হ্যাঁ, প্রত্যুত্তরে বললাম, দেখতে বড় ভাল লাগে।

কথাটা বোধহয় মিসেস মারকাডোর মনঃপুত হল না। সন্দেহ এবং বিরক্তির ছায়া পড়েছিল তার মুখে চোখে।

ওঁর সম্বন্ধে তোমার সত্যিকারের কী ধারণা বলোত? গলার স্বরটা খাদে নামিয়ে এনে তিনি শুধোলেন।

ওহো, তেমন মারাত্মক কিছু নয়, ব্যাপারটাকে হাল্কা করার উদ্দেশ্যে বললাম, আমার ধারণা, সাময়িক ভাবে ওঁর স্বাস্থ্যটা বোধহয় একটু ভেঙে পড়ে থাকবে।

তখনও তার সন্দেহ বোধহয় ঘাচেনি। হঠাৎ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি কী মানসিক রোগগ্রস্থ রুগীদের নার্স?

ওহো, না, না সে সব কিছু নয়, সঙ্গে সঙ্গে হেসে বললাম, কিন্তু এ কথা আপনার কেন মনে হল বলুন তো?

এক মুহূর্ত নীরব থেকে তিনি বললেন, তুমি জান না কি অদ্ভুত প্রকৃতির মহিলা উনি। কেন, ডঃ লিডনার তোমাকে কিছু বলেননি?

আমার কাজের ব্যাপারে খোশগল্প করতে আমার ইচ্ছা ছিল না। তাছাড়া আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ সব কেসে রুগীর আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে সত্য খবরটা আশা করা বৃথা। নিজের চোখে দেখা না পর্যন্ত কোন গুজবে কান দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শ হলে অন্য কথা। কিন্তু সেরকম কাউকে এখানে দেখা যাচ্ছে না। ডঃ রেলি একজন চিকিৎসক হলেও পেশাদার চিকিৎসক হিসাবে তাকে এখানে ডাকা হয় না। তাছাড়া ডঃ লিডনারও আমাকে খোলাখুলি ভাবে কিছু বলেন নি এখনও পর্যন্ত। ভদ্রলোক স্বল্পভাষী। যাইহোক, সব কিছু ভাল করে জানার পর আমি আমার কর্তব্য ঠিক করব। মনে হয় মিসেস মারকাডো কিছু বলতে চান। কিন্তু তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, মিসেস লিডনারের উপর অহেতুক আক্রোশ বা হিংসে আছে। যাইহোক আমার যা পেশা, তাছাড়া মানবতার খাতিরে তার কথা আমাকে শুনতেই হবে।

আমার যতদূর ধারণা, তাকে বললাম, সম্ভ্রান্ত মিসেস লিডনার এক এক সময় ঠিক স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছেন না। খুব শিগগীর তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন।

স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন? আমি বলছি, তা আর সম্ভব নয়। ওঁর ভয়ে সব সময় আমরা তটস্থ, মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত। ওঁর ভয়ার্ত চিৎকারে আমরা ব্যতিব্যস্ত। একদিন রাত্রে ওঁর ঘরের জানলায় আঙুলের টোকা পড়তে শুনেছেন উনি। তারপর আর একদিন তিনি নাকি দেখেছেন তার জানালার সামনে একটা কাটা হাত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সেই হাতটা ছাড়া দেহের আর কোন অংশ তিনি দেখতে পাননি। একটা হলুদ মুখ জানালায় প্রতিবিম্বিত হতেই দ্রুত ছুটে যান তিনি সেদিকে, কিন্তু জানালার ধারে গিয়ে দেখেন কেউ কোথাও নেই।

এ যেন একটা তাজ্জব ব্যাপার। তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এ ব্যাপারে আমাদের নাক না গলানোই উচিৎ নয় কি? তবু মাথা ঘামাতে হচ্ছে।

মনে হয় কেউ বোধহয় ওঁকে এভাবে ভয় দেখাতে চাইছে, প্রতারণা করতে চাইছে, আমি আমার ধারণার কথা বললাম।

ওহো না, এ সব ওঁর স্থল কল্পনা। এই তো মাত্র তিন দিন আগে নৈশভোজের সময়, এখান থেকে প্রায় মাইল খানেক দূরে একটা গ্রামে গুলির শব্দ হতেই মিসেস লিডনার লাফিয়ে ওঠেন এবং আঁতকে ওঠেন। আর ডঃ লিডনার? তিনি তখন এক হাস্যকর কান্ড ঘটালেন, দ্রুত স্ত্রীর কাছে ছুটে এসে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকেন, ও কিছু নয় প্রিয়তমা। আদৌ ও সব কিছু নয়। আমার মনে হয়, নার্স তুমি নিশ্চয়ই জানো, সব পুরুষরা এমন সব হিস্ট্রিয়াগ্রস্ত নারীদের এমনভাবে উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু এ অন্যায়, এটা একটা খারাপ নজির। প্রতারণাকে কখনই উৎসাহিত করা উচিৎ নয়।

আর সেগুলো যদি প্রতারণা না হয়?

এছাড়া আর কিই বা হতে পারে?

আমি উত্তর দিলাম না, কারণ আমি জানি না কি বলতে হবে। এ এক বড় অদ্ভুত ব্যাপার। গুলির শব্দ শুনে আঁতকে ওঠা ও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেই ভুতুড়ে মুখের গল্প এবং কাটা হাতের গল্প যেন অন্যরকম। ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন মেজাজের, যার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। এ ব্যাপারে আমার দুটো ধারণা হয়েছে। হয় এটা মিসেস লিডনারের বানানো গল্প (ছোট ছেলেরা যেভাবে বানিয়ে গল্প বলে, যা বাস্তবে ঘটেনি, সেই রকম তিনিও হয়তো সবার দৃষ্টি তার প্রতি আকর্ষণ করানোর জন্য গল্পটা নিজে বানিয়ে বলে থাকবেন), কিংবা এমন হতে পারে, আমার যা ধারণা, একটু আগে যে কথা আমি বলেছি, তাকে কেন্দ্র করে এটা একটা কারোর ইচ্ছাকৃত ঠাট্টা-তামাশাও হতে পারে। আমার শেষোক্ত ধারণাটা যদি সত্যি হয়, সেক্ষেত্রে মিঃ কোলম্যানকে আমার কেমন সন্দেহ হয়। ছেলেটি অদ্ভুত ধরণের। এ ব্যাপারে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। তাই আমি ঠিক করলাম, তার উপর কড়া নজর আমি রাখব। নার্ভাস রুগীরা সামান্য একটু ঠাট্টা কিংবা তামাশার ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে।

মিসেস মারকাডো চকিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন :

আচ্ছা নার্স, তোমার কি মনে হয় না, ওঁর চেহারাটা রীতিমত রোমান্টিক ধাঁচের। এমন মেয়ের জীবনে অনেক কিছু ঘটতে পারে।

কেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওঁর জীবনে তেমন কোন ঘটনা ঘটেছে নাকি?

ওঁর প্রথম স্বামী যুদ্ধে যখন নিহত হন এখন ওঁর বয়স মাত্র কুড়ি। বড় করুণ, বড় মর্মান্তিক, এবং বড় রোমান্টিক, তাই না?

হ্যাঁ, এক হিসাবে রাজহংসী এবং রাজহংসও বলা যেতে পারে।

কি উদ্ভুত উপমা? মিসেস মারকাডো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।

অপরাহ্নের শেষ আলোটুকু তখন ছাদের উপর থেকে বিদায় নিয়েছে, অন্ধকার জেঁকে বসতে যাচ্ছে। আমি বললাম, এবার আমাদের নিচে নেমে যাওয়া উচিৎ। মিসেস মারকাডো আমার কথায় সায় দিয়ে জানতে চাইলেন, আমি ল্যাবরেটরি দেখতে চাই কিনা! আমার স্বামী এখন সেখানে আছেন আলাপ হয়ে যাবে।

ল্যাবোরেটরিতে আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু বড় ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। মিসেস মারকাডো ল্যাবোরেটরি ঘুরিয়ে দেখালেন আমাকে, কিছু দামী যন্ত্রপাতি, আমার গহনাপত্র, মোম লাগানো হাড়ের কয়েকটা টুকরো।

কিন্তু জোসেফ কোথায় যেতে পারে? মিসেস মারকাডো স্বগোতক্তি করলেন।

ড্রয়িং অফিসেও নেই। সেখানে ক্যারি তার কাজে ব্যস্ত ছিল। আমরা সেখানে ঢুকতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সে আমাদের দিকে। তার সেই অদ্ভুত ধরনের চাহনি আমাকে বিস্ময়ের আবর্তে ফেলে দিল যেন। এই লোকটি তার নিজস্ব ক্ষমতার একেবারে শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। খুব শিগগীর একটা কিছু ঘটবে নিশ্চয়ই। আমার মনে হয় অন্য

 কেউ নিশ্চয়ই তার মধ্যে এমনি একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করে থাকবে।

চলে আসার সময় আমি আর একবার ফিরে তাকালাম তার দিকে। তখন সে তার কাগজের উপর ঝুঁকে কি যেন নিরীক্ষণ করছিল, শক্ত করে চেপে ধরে রাখা ঠোঁট, না বলা কথার মধ্যে যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে। হয়ত এ রকমই তার অভিব্যক্তি। কিন্তু সে যাই হোক, আমার ধারণা এই মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে, সে যেন কোন এক বয়স্ক নাইট, যুদ্ধে যাচ্ছে এবং সে জেনে গেছে তার মৃত্যু অনিবার্য।

তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে আমার আর একবার মনে হল, সত্যি মানুষকে আকর্ষণ করার কি অদ্ভুত ক্ষমতাই না আছে তার মধ্যে।

শেষ পর্যন্ত বসবার ঘরে মিঃ মারকাড়োকে পাওয়া গেল। তিনি তখন নতুন কোন গবেষণার কাজ নিয়ে আলোচনা করছিলেন মিসেস লিডনারের সঙ্গে। মিসেস লিডনার একটা সাধারণ কাঠের চেয়ারের উপর বসেছিলেন। আর একবার আমি অবাক হলাম তার সেই পোশাক ও অদ্ভুত হাল্কা শরীরটা দেখে। দূর থেকে তাকে তখন ঠিক পরীর মতো দেখাচ্ছিল, রূপকথার দেশের রাজকন্যা আমার চোখের সামনে যেন ভাসছে, রক্তে-মাংসে গড়া দেহের থেকেও বেশি সুন্দরী তিনি।

মিসেস মারকাডো হৈ-হৈ করে ছুটে গেলেন, ওহো জোসেফ তুমি এখানে। আমরা ভেবেছিলাম, তোমাকে ল্যাবোরেটরিতে দেখতে পাব।

লাফিয়ে ওঠেন জোসেফ, স্ত্রীর দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে তোতলাতে তোতলাতে বলতে থাকেন, আমাকে এখন যেতেই হবে। আমি এখন মাঝখানে– কথাটা তিনি সমাপ্ত করলেন না, তবে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

মিসেস লিডনার তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অলসভাবে বললেন, অন্য কোন এক সময় তুমি তোমার কথা শেষ করো, শুনতে আমি খুব আগ্রহী। তারপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে হাসলেন। ওঁর হাসিটা কেমন কৃত্রিম বলে মনে হল।

মিনিট দু’এক পরে মিসেস লিডনার আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ওই বুকশেকে কয়েকটা নির্বাচিত বই রেখেছি, ওগুলোর মধ্যে একটা বই পছন্দ করে নিয়ে এসে বসে পড়।

বুকশেলফের দিকে আমাকে যেতে দেখে মিসেস মারকাডো একবার আমার দিকে। তাকিয়েই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চকিতে তিনি আমার থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিলেন, সেই মুহূর্তটুকু সময়ের মধ্যে মিসেস মারকাডোর মুখটা দেখতে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। রাগে থম থম্ করছে মুখ, চোখে হিংস্র চাহনি। মিসেস কেলসির কথা মনে পড়ল, মিসেস লিডনার সম্বন্ধে তিনি আমাকে মোটামুটি এ ধরণের একটা আভাস অবশ্য দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন আমি তার কথায় আমল দিইনি। এখন যে দিই তা নয়। মিসেস লিডনারকে আমি পছন্দ করে থাকি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও মনে হল, তাদের বক্তব্য কি একেবারে উড়িয়ে দেবার, এতটুকু সত্যের অবকাশ কি নেই তার পিছনে?

তবে মিসেস লিডনারের উপর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। কিন্তু কুরূপা মিস জনসন এবং মিসেস মারকাডোকে সে কথা বোঝানো যায় না, সব সময় তাঁরা যেন অগ্নিশর্মা, মিসেস লিডনারের কথা কিছু বললেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।

বেচারা মারকাডো। আমার মনে হয় না, মিসেস লিডনার এ নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন মনে করেন, কিন্তু মিসেস মারকাডো সত্যি সত্যি মনে করেন, মিসেস লিডনারের তার স্বামীকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়, হাজার হোক তিনি পরস্ত্রী মারকাডোর কাছে।

আমার মনে হল, মিসেস লিডনারকে একটু সাবধান করে দিলে কেমন হয়। ওঁর দিকে তাকালাম, উনি তখন ওঁর হাতের সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত। আমার আরো মনে হল, ওঁকে সতর্ক করে দেওয়া উচিৎ, মানুষ হিংসার বশে যে কোন জঘন্য নিষ্ঠুর কাজ করে বসতে পারে। অতএব ওঁর এখন এমন কোন কাজ করা উচিৎ নয়, যাতে করে ওঁর শত্রুরা তার সুযোগ নিতে পারে।

তারপর আমি নিজেকে বললাম, আমি লিথেরান, তুমি বোকা, মিসেস লিডনার বাচ্চা মেয়ে নয়, ইতিমধ্যে তিনি চল্লিশ পেরিয়ে এসেছেন। আর জীবন সম্বন্ধে ওঁর অভিজ্ঞতা কম নয়।

কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হল, বোধহয় সে অভিজ্ঞতা ওঁর নেই। এক এক সময় তার চোখে আতঙ্ক ভাব দেখে অন্তত তাই মনে হয় আমার।

সত্যি, কি তার জীবন! মাত্র দু বছর আগে ডঃ লিডনারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এবং মিসেস মারকাডোর কথা মতো প্রায় পনেরো বছর আগে তার প্রথম স্বামীর মৃত্যু হয়।

ড. লিডনার আমার ঘরে এলেন, এই রকমই আমি চাইছিলাম। করমর্দন করে বললেন, ও তোমাকে খুবই পছন্দ করে। প্রথম সাক্ষাতেই ও তোমাকে আপন করে নিয়েছে, তাতে আমি খুব খুশি। আমার মনে হয়, এখন থেকে সব ঠিক ঠিক চলবে।

বাচ্চা ছেলের মতো আগ্রহ দেখালেন মিঃ লিডনার।

আমারও তাই মনে হয়, মিসেস লিডনার আমাকে তার আপনজন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু ডঃ লিডনারের মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত আমি হতে পারছি না। আমার কি রকম একটা ধারণা হল, মিসেস লিডনারের ব্যাপারে উনি আরো অনেক কিছু জানেন, যা উনি প্রকাশ করতে চাইছেন না।

হয়তো কিছু, হয়তো এমন কিছু, যার হদিশ আমি পাচ্ছি না, কিন্তু বাতাসে তার আভাস আমি অনুভব করছি। পশমের মত নরম সুন্দর বিছানা, তবু সেই নিবিড় ঘুম যাকে বলে, ঠিক সেই ভাবে চোখের পাতা দুটো এক করতে পারলাম না। এরই মাঝে বিক্ষিপ্ত স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে কয়েকবার।

মনে পড়ে ছেলেবেলায় কীটসের কবিতার দুর্বোধ্য কথাগুলোর অর্থ জানবার জন্যে যে ব্যাকুলতা আমার হয়েছিল, ঠিক সেই রকম কৌতূহল এখন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থ খুঁজতে গিয়ে বারবার আমি ব্যর্থ হই, মনটা খারাপ হয়ে যায়। এটা একটা এমনি কবিতা, যা আমি সব সময় ঘৃণা করে থাকি। আমি মনে করি এবং আমি বিশ্বাস করি, সেটা আমি চাই কি চাই না আগে আমায় জানতে হবে। যাইহোক, অন্ধকারে ঘুম থেকে জেগে উঠতেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা একটা অপূর্ব দৃশ্য যা আমি এর আগে কখনো দেখিনি।

ওঃ কি যাতনা নাইট তোমার, নিঃসঙ্গ একাকী এবং (কি সেটা?) বিষণ্ণ মুখ খুঁজে বেড়াও………? সেই প্রথম আমার মনের আয়নায় সেই নাইটের মুখখানি প্রতিফলিত হতে দেখি, আর সেই মুখ মিঃ ক্যারির টান-টান, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, ঠিক এরকম মুখ আমি ছেলেবেলায় যুদ্ধের সময় বেচারা যুবকদের মধ্যে দেখে ছিলাম, যুদ্ধাতঙ্ক। তার জন্য আমার দুঃখ হল, একটু পরেই আমার চোখে ঘুম নেমে এল। স্বপ্নে আমি আবার দেখলাম, বেলি ডেন সান্ড মারসি যেন মিসেস লিডনার, অশ্বপৃষ্টে আরোহণ করে একদিকে একটু ঝুঁকে পড়েছেন, হাতে এমব্রয়ডারি করা একগুচ্ছ ফুল এবং তারপর ঘোড়াটা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল, হাড়ের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়ানো সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু ভয়ে আমার দেহের কাঁপুনি তখনও থামেনি।

.

০৭.

 জানলায় মানুষের মুখ

আমার মনে হয় শুরুতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার, এ কাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় কোন ঘটনা জড়িত নয়। স্বীকার করতে আমার এতটুকু লজ্জা নেই, প্রত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞান নেই, আর জানবার ইচ্ছাও তেমন নেই। মিঃ ক্যারি আমাকে বলতে শুরু করেছেন, আমার মধ্যে প্রত্মতাত্ত্বিকের মেজাজ নাকি দেখতে পায় না সে, সত্যি কথা বলতে কি তার ধারণা একেবারে মিথ্যা নয়।

আমার পৌঁছানোর পর দিনই ক্যারি জানতে চাইলেন, তার পরিকল্পিত পা্যলেস আমার দেখার ইচ্ছা আছে কিনা। কয়েক যুগ আগের ঘটনাকে আজ সে কি করে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে সে কথা আমার অজানা, স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমার। স্বভাবতই সেই কাল্পনিক দৃশ্যটা দেখার কৌতূহল হওয়া আমার স্বাভাবিক। তাই আমি তাঁর কথায় রাজি হয়ে গেলাম, সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারে আমি নিজেই খুব উৎসাহিত বোধ করছিলাম। প্রায় তিন হাজার বছর আগের পুরনো প্যালেস, তখনকার দিনের প্যালেস কি রকম হতে পারে, সেটা দেখাই আমার একমাত্র কৌতূহল। তুতানখামেনের ছবিতে সে দৃশ্য আমি দেখেছিলাম, সেটা চাক্ষুস দেখার সুযোগটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। কিন্তু আমাকে দারুণভাবে হতাশ হতে হল। বিশ্বাস করা যায়, সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, মাটির ঢিবি ছাড়া আর কিছু না? দু’ফুট উঁচু মাটির দেওয়াল, প্যালেসের ধ্বংসাবশেষ বলতে এই পর্যন্ত। তবু বেশ উৎসাহ নিয়ে মিঃ ক্যারি আমাকে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বোঝাতে থাকে, ওটা একটা বিরাট আদালত, ওখানে কতকগুলো চেম্বার, দোতলা ঘর, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আমার তখন কেবল একটাই চিন্তা, ও কি করে জানল এত সব? খুব মার্জিত ভাবেই প্রশ্নটা রাখলাম তার কাছে। ওরা যে যাই বলুক, আমি কিন্তু খুব নিরাশ হয়েছি ওদের কাজকর্ম দেখে। সমস্ত খননকার্য আমার কাছে মাটির ঢিবি ছাড়া আর কিছু বলে মনে হয়নি। কোথায় সেই মার্বেল পাথরের সৌধ, সোনার কারুকার্য কিংবা, সুদৃশ্য কিছু দর্শনীয় বস্তু? ক্রীলউডে আমার কাকীমার বাড়িতে এর চেয়ে অনেক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এখানে কোথায় সেই অ্যাসিরিও বাসীদের জীবন-ধারার প্রামাণ্যচিত্র, যাদেরকে রাজা বলে আখ্যা দেওয়া হতো?

অবশিষ্ট মাটির ঢিবিগুলো আমাকে দেখানোর ভার সে তুলে দিল ফাদার ল্যাভিগনির হাতে। ফাদার লাভিগনি একজন বিদেশী, তার ওপর তিনি একজন সন্ন্যাসী এবং গম্ভীর প্রকৃতির লোক বলে তাঁর সম্বন্ধে আমার একটু জড়তা ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে মিশতে গিয়ে আমার মনে হল, তিনি অতিশয় সদাশয় ব্যক্তি, যদিও তিনি আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট।

কথায় কথায় তিনি আমাকে জানালেন, আমার এখানে আসাটা নাকি বিস্ময়কর ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত তিনি তো বলেই ফেললেন, আচ্ছা মিসেস লিডনার সত্যি কি তাহলে অসুস্থ?

না, ঠিক অসুস্থ নন। বেশ সতর্কতার সঙ্গে কথাটা বলতে হল।

অদ্ভুত মহিলা উনি। তিনি বললেন, তাছাড়া আমার মনে হয়, উনি বিপজ্জনকও বটে।

এ কথার অর্থ কী? পাল্টা প্রশ্ন করলাম, বিপজ্জনক? কি রকম বিপজ্জনক?

 চিন্তিত ভাবে তিনি মাথা নাড়লেন।

 বড় বেশি নির্দয় তিনি। একটু থেমে তিনি তার নিজের কথার সমর্থনে আবার বললেন, হ্যাঁ, অত্যন্ত নিষ্ঠুর তিনি।

আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার মুখে চোখে অবরুদ্ধ বিরক্তির ঝঝ ফুটিয়ে বললাম, এ আপনার অন্যায় অভিযোগ। ওঁর সম্বন্ধে এ আপনার অবান্তর কথাবার্তা।

মাথা নাড়লেন তিনি।

মেয়েদের আমি যতটা জানি তার থেকে বেশি তুমি জানো না।

মজার ব্যাপার, আমি ভাবলাম, একজন সন্ন্যাসীর মুখ থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনব, আমি ভাবতেও পারিনি। তবে সঙ্গে সঙ্গে আবার এ কথাও ভাবলাম, হয়তো তিনি মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে অনেক তথ্য জেনে থাকবেন। কিন্তু একজন সন্ন্যাসী হয়ে তিনি যে এইসব ঘরোয়া কথায় কান দেবেন, সেটাও কেমন অবিশ্বাস্য লাগে আমার কাছে।

হ্যাঁ, তিনি নিশ্চয়ই একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলা, ফাদার ল্যাভিগনি গভীরভাবে চিন্তা করে বললেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তবে আমি এ কথাও বলতে পারি, তার মনটা পাথরের মতো কঠিন হলেও একটা ব্যাপার তিনি কিন্তু দারুণ ভীত। এখন জানতে হবে, তার সেই ভয়ের কারণটা কী?

হ্যাঁ, আমরা সবাই উদগ্রীব সেই কারণটা জানবার জন্য। আমার ধারণা, তাঁর স্বামী ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তির সেই কারণটার কথা জানার কথা নয়।

ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছে। আমার ধারণা– হঠাৎ তিনি আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন, বোধহয় ডঃ লিডনার নিজেও সে কথা জানেন না। কোন একটা ব্যাপারে তিনিও বেশ চিন্তিত।

তার স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে?

হয়তো সেজন্য হতে পারে। কিন্তু তার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। কি সেই কেমন করে আমি বোঝাব এ যে ভীষণ অস্বস্তিবোধ—

হ্যাঁ, সে কথা অবশ্য ঠিক। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ, একটা অস্বস্তিবোধের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছি আমরা সবাই।

তারপর আর কোন কথা বলা গেল না, কারণ মিঃ লিডনারকে সেই দিকেই আসতে দেখলাম। তখন সবে মাত্র একটা শিশুর কবর আবিষ্কার হয়েছিল, তিনি আমাকে দেখালেন শিশুর সেই কবরটা। বড় করুণ, বড় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। ছোট ছোট হাড়ের টুকরো ইতস্ততঃ ছড়ানো।

কিছুক্ষণ পরে ডঃ লিডনার জানালেন, তিনি বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন চা-পিপাসা নিবারণের জন্য।

মিসেস লিডনারকে আজ একটু ভালো দেখাচ্ছিল, সেই ক্লান্ত, রোগাটে ভাবটা আর নেই। বলতে গেলে চা একরকম তৈরিই ছিল। চায়ের আসরে ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে আজকের আবিষ্কারের বিবরণ দিলেন সংক্ষেপে, তারপর তিনি তার কাজে ফিরে গেলেন।

তারপর মিসেস লিডনার আমাকে সেই চোরাকুঠুরীতে নিয়ে গেলেন সংগৃহীত জিনিসগুলো দেখানোর জন্য। অধিকাংশই জিনিসই ভগ্নঅবস্থায় পড়েছিল এখানে।

আচ্ছা, এই ভাঙ্গা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে রেখে লাভ কি বলুন? এর কি মূল্যই বা আছে?

হাসলেন মিসেস লিডনার। এরিককে তুমি তো চেনো না। এই সব ভাঙ্গা মাটির বাসনপত্র ওঁর কাছে অনেক মূল্যবান। প্রায় সাত হাজার বছর আগেকার পুরানো সব। যা কিছু পুরাতন, ওঁর কাছে বরণীয় সব। একটু থেমে তিনি বলেন, এসো, এবার তোমাকে একটা বিস্ময়কর জিনিস দেখাই। দেখে তুমি চমকে উঠবে নিশ্চয়ই।

শেল্ফের উপর থেকে একটি বাক্স নামালেন তিনি। তারপর সেই বাক্সের ডালাটা খুলতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি।

সোনার ছোরা, নীল পাথর ঘটি ও হাতল।

এ যে দেখছি সোনার ছোরা?

হাসলেন তিনি, হ্যাঁ, সবাই সোনা পছন্দ করে, কেবল আমার স্বামী ছাড়া।

কিন্তু ডঃ লিডনারের পছন্দ না করার কারণটাই বা কি থাকতে পারে মিসেস লিডনার?

প্রথমত সোনা জিনিসটা খুবই মূল্যবান। তাছাড়া শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করার জন্য তার বিনিময়ে কিছু মূল্য দিতে হয়।

কি আশ্চর্য, এর জন্য তাদের টাকা দিতে হবে কেন?

হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। এর ফলে চুরির অভ্যাসটা ওরা ত্যাগ করতে পারে। ধরো, ওরা যদি ওই সোনার ছোরাটা চুরি করতো, তাহলে প্রত্মতাত্ত্বিক মূল্য বলতে কিছু থাকত না ওদের, সেক্ষেত্রে তারা এটাকে গলিয়ে ফেলতে পারত অনায়াসে। তাই আমি ওদের কিছু সৎ হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।

এর পর তিনি আর একটি ট্রে শেল্ফ থেকে নামিয়ে আনলেন। এবং সত্যি সত্যি অত্যন্ত সুন্দর একটি সোনার কাপ তিনি আমাকে দেখালেন। আমি আবার বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে চিৎকার করে উঠলাম।

হ্যাঁ, এটা সত্যি খুব চমৎকার জিনিস। তাই না? এ সবই পাওয়া গেছে রাজকুমারের কবরখানা থেকে। রাজপরিবারের অন্য আরো কবর আমরা আবিষ্কার করেছি বটে, তবে সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ লুণ্ঠিত।

মিসেস লিডনারের চোখে ভ্রুকুটি। চোখের কাছে তুলে ধরা সেই সোনার কাপটা। নখ দিয়ে আঁচড় কাটেন উনি কাপটার উপরে।

কি আশ্চর্য! এই কাপটার উপরে মোমের ফোঁটা পড়ল কী করে? তাহলে মোমবাতি হাতে নিশ্চয়ই কেউ এখানে এসেছিল? মিসেস লিডনারের চোখে কালোছায়া।

বেলা বারোটায় মধ্যাহ্নভোজে আবার আমরা সবাই এক সঙ্গে মিলিত হলাম। তারপর ডঃ লিডনার এবং মিঃ মারকাডো কিছু মাটির পাত্র পরিষ্কার করতে বসলেন। পরিষ্কার করার মাধ্যম হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। পরিষ্কারের পর সুন্দর কিশমি রঙের একটা পাত্র পাওয়া গেল, অপর একটি পাত্রের গা থেকে মাটি পরিষ্কারের পর ফুটে উঠল একটি ষাঁড়ের এক জোড়া শিং। সত্যি এ যেন যাদুমন্ত্রের বলে মাটির পাত্রগুলোর উপরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিত্র ফুটে উঠছে এক এক করে।

মিঃ ক্যারি এবং মিঃ কোলম্যান মাটি খোঁড়ার কাজে চলে যায়। আর মিঃ রেইটার তার ফটো স্টুডিওয় গিয়ে ঢোকে।

তা তুমি এখন কী করবে লুসি? ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার মনে হয় তোমার এখন একটু বিশ্রাম নিলে ভাল হয়।

আমি শুনেছি, দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে থাকো।

ঘণ্টাখানেকের জন্য নেবো। তারপর কিছুক্ষণের জন্য হয়তো বাইরে ঘুরতে যাব।

ভালোই তো। নার্সও তোমার সঙ্গে যাবে। যাবে না তুমি?

 নিশ্চয়ই! সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।

না, না, মিসেস লিডনার বাধা দিয়ে বললেন, একা যেতে ভাল লাগে আমার। তাছাড়া নার্স না ভাবে, চব্বিশ ঘণ্টা সে আমার ডিউটিতে আছে।

না, তাতে কি হয়েছে। আমি নিজেই তো যেতে চাইছি ম্যাডাম।

না, আমি চাই, তুমি যেন যেতে না চাও। কোন যুক্তি তর্ক মানতে চাননা তিনি।

অবশ্য আমিও খুব বেশি জোর করলাম না। কিন্তু ঘুমোবার আগে আমার কেমন সন্দেহ হল, মিসেস লিডনার দারুণ নার্ভাস, একটুতেই ভয় পেয়ে যান, সঙ্গী না নিয়ে কি করে তিনি একা একা ঘুরে বেড়ানোর সাহস পান?

যাই হোক, ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর চায়ের টেবিলে আবার তার মুখোমুখি হলাম। এখন তাকে অনেকটা নরম বলে মনে হল। নিজের থেকেই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নদীর ধারে আমার বেড়ানোর ইচ্ছা আছে কি না! এই মিসেস লিডনার আজ দুপুরে আমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলেছিলেন, ওঁর সঙ্গে আমি যেতে না চাইলে তিনি খুব খুশি হবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি

তারপর অনেক জল ঘোলা হয়েছে, অনেক ঘোলা জল পরিষ্কার হয়েছে। মিসেস লিডনারের মনেও হয়তো বা! তিনি বুঝতে পেরেছেন, আমি তার কথায় আঘাত পেলেও পেতে পারি। তাই তিনি জানতে চাইলেন, আমি তার কথায় রাগ করে বসে আছি কিনা।

কিন্তু আমি তাঁকে বোঝাতে চাইলাম, নার্সদের অমন ঠুককো সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না এবং আমার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার জন্য তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে।

অপরাহ্নের শেষ আলোটুকু উধাও হয়ে গেল নদীর উপর থেকে। একটু পরেই একটা সুন্দর সন্ধ্যা নেমে এল সেখানে।

প্রথমে পথের দু ধারে বার্লির খেত তারপর কিছু ফল আর ফুলের বাগান পেরিয়ে অবশেষে আমরা এসে পৌঁছলাম টাইগ্রিস নদীর ধারে। আমাদের ঠিক পাশেই তেল শ্রমিকরা তাদের অদ্ভুত করুণ সুরে গান গাইতে গাইতে চলেছে।

এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অপূর্ব, তাই না? মিসেস লিডনার আমার দিকে তাকালেন।

আর জায়গাটা ভারি শান্তিপ্রিয়, প্রত্যুত্তরে বললাম, মনে হয় যে কোন জায়গা থেকে এ অনেক, অনেক দূরে।

হ্যাঁ, মিসেস লিডনার সেই সঙ্গে নিজের একটা মন্তব্য জুড়ে দিলেন, এখানে অন্তত যে কেউ নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করতে পারে।

চকিতে তার দিকে আমি ফিরে তাকালাম। কিন্তু আমার মনে হল তিনি আমার সঙ্গে কথা বলার থেকে নিজের সঙ্গে নিজের কথাই বেশি বলছেন যেন। তিনি বুঝতেও পারছেন না যে, তাঁর মনের কথাটা ফাস হয়ে পড়ছে।

এবার ঘরে ফেরার পালা। আমাদের পথ চলা আবার শুরু হল।

হঠাৎ মিসেস লিডনার এমন সজোরে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরলেন যে, আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম।

কে ওখানে নার্স? কি করছে ওখানে?

অদুরে পথটা এক্সপিডিসন হাউসের গা ছুঁয়ে যেখান দিয়ে গেছে, ঠিক সেখানে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল, পরনে তার ইউরোপীয় পোশাক, লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে বুঝি পায়ের আঙুলের ডগার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং একটি জানলা পথে উঁকি মারার চেষ্টা করছিল।

আমাদের চোখে তার চোখ পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের দিকে মুখ করে হাঁটতে শুরু করল। ওদিকে আমি অনুভব করলাম, মিসেস লিডনার আমাকে ক্রমশ শক্ত করে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন।

নার্স, আমার কানে তার ফিসফিস্ শব্দ রিমঝিম বৃষ্টি পড়ার মত শোনায়, নার্স শুনছ?

সব ঠিক আছে ম্যাডাম, সব ঠিক আছে, আমি তাকে আশ্বস্ত করতে বললাম, আপনি ঘাবড়াবেন না।

লোকটা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ইরাক দেশের লোক সে। কাছ থেকে লোকটাকে দেখে মিসেস লিডনার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

যাইহোক, ইরাকের লোক বই তো আর কিছু নয় সে। মিসেস লিডনারের মুখের ওপর থেকে ভাবনার মেঘটা কেটে গেছে তখন।

এক্সপিডিসন হাউসের কাছ দিয়ে যেতে গিয়ে জানালাগুলো দেখলাম ভাল করে। লোহার গরাদ দেওয়াই শুধু নয়, জানালাগুলো খুবই উঁচুতে রাস্তা থেকে। জানালার ওপারে কিছু দেখতে যাওয়া বোকামো।

আমার মনে হয়, এটা একটা মামুলি কৌতূহল ছাড়া আর কিছু নয়, আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। মিসেস লিডনার মাথা নাড়লেন।

হ্যাঁ, তা হতে পারে। কিন্তু এক লহমায় আমি ভেবেছিলাম– কি যেন বলতে গিয়ে চেপে গেলেন তিনি।

আমার কেমন সন্দেহ হল। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা আপনি তখন কী ভেবেছিলেন বলুন তো? আমার জানতে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। সত্যি কী ভেবেছিলেন বলুন তো?

মুখে তিনি কিছু না বললেও আমি তখন একটা কথা বেশ স্পষ্ট ভাবে জেনে গেছি মিসেস লিডনার নিশ্চয়ই একজন কাউকে দারুণভাবে ভয় করে থাকেন।

.

০৮.

 নৈশ বিপদ সংকেত

আমার এখানে আসার পর এক সপ্তাহে ঠিক কী কী ঘটেছে সেগুলো মনে করা একটু কষ্টসাধ্য। পিছনের দিকে ফিরে তাকালে অনেক ছোট-খাটো ভাল ভাল লক্ষণ আমি দেখতে পাই, তবে প্রথমদিকে আমি অন্ধ ছিলাম। যাইহোক, এ কাহিনীর সঠিক বিবরণ দিতে হলে মনে হয় সর্বাগ্রে আমার কৌতূহলগুলো মেটানো উচিত। বিশেষ করে যেসব কৌতূহল আমাকে ধাঁধায় ফেলেছে, অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে এবং আমায় বুঝতে শিখিয়েছে, এ কাহিনীর আড়ালে একটা কোন রহস্য লুকিয়ে আছে।

বিল কোলম্যান, ডেভিড এমোট; এদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তাদের কথার মধ্যেও সেই অজানা রহস্যের একটি প্রচ্ছন্ন আভাস, আমি অনুভব করেছি। কিন্তু তাদের কথায় রহস্যের কোন সূত্র আমি খুঁজে পাইনি এখনও পর্যন্ত।

বরং মিস জনসনের আলোচনার উপর আলোকপাত করলে বোধহয় ভাল হয়। তাকে আমার খুব পছন্দ। ও একজন দক্ষ, বাস্তববাদী এবং বুদ্ধিমতী মহিলা। ডঃ লিডনারকে গুরুর মত শ্রদ্ধা করে।

এই উপলক্ষে ডঃ লিডনারের জীবনের কাহিনী আমাকে শোনায় মিস জনসন, একেবারে তার ছেলেবেলা থেকে। মিস জনসন জানে কোথায় কোথায় তিনি খনন কার্য চালিয়েছিলেন এবং সেই সব খনন কার্যের ফলাফলও ওর বেশ ভাল জানা আছে। মিস জনসন তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা শুনেছে। ও আমাকে বলেছে, ডঃ লিডনারের মতো অমন জ্ঞানী-গুণি প্রত্নতত্ত্ববিদ খুব কমই চোখে পড়ে থাকে।

সত্যি উনি এতই সরল প্রকৃতির মানুষ যে, আমি ওঁর মধ্যে কখনো অহঙ্কার দেখতে পাইনি, আত্মগর্বে উৎফুল্ল হতে দেখেনি ওঁকে। কেবল মহান ব্যক্তিরাই এমন সহজ সরল হতে পারে।

সে কথা ঠিক, আমি বললাম, মহান ব্যক্তিরা নিজেদের ঢাক নিজে পেটায় না। কিংবা এ ওর পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া কথা কখনও বলে না।

শুধু কি তাই? ওঁর মতো অমন মিশুকে তোক বোধহয় হয় না। হাল্কা মন নিয়ে তিনি কথা বলতেন আমার এবং রিচার্ড ক্যারির সঙ্গে। ওঁর সংস্পর্শে এসে আমরা সবাই খুব সুখী। রিচার্ড ক্যারি ওঁর সঙ্গে প্যালেস্টাইন থেকে কাজ করছে, তা প্রায় দশ বছরের বন্ধুত্ব ওঁর সঙ্গে। আর ওঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সাত বছরের।

সুপুরুষ চেহারা মিঃ ক্যারির, আমি বললাম, কিন্তু বড় সে শান্ত, স্বল্পভাষী, তোমার তা মনে হয় না?

ওরকম হবার কথা নয় তার, আগেও এরকম ছিল না সে, মিস জনসন তাড়াতাড়ি বলে, এই কেবল সেদিন কথাটা অসমাপ্ত রেখে হঠাৎ ও চুপ করে গেল।

কেবল সেদিন মানে? আমি ওর কথার পুনরাবৃত্তি করে জিজ্ঞাসা করলাম।

ও হ্যাঁ– মিস জনসন তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, আজকাল কত ভাল ভাল জিনিস কেমন সহজে বদলে যাচ্ছে এই আর কি।

আমি কোন উত্তর দিলাম না। মিস জনসন নিজের থেকেই তার কথার জের যে টানবে, আমি তা জানতাম এবং হলও তাই।

আমি একজন রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের লোক। এক এক সময় আমি ভাবি, প্রত্মতত্ত্ববিদের স্ত্রীরা সত্যি যদি আগ্রহান্বিত না হয়, তাদের উচিত নয় স্বামীদের সঙ্গে এ ধরনের অভিযানে আসা। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর মনোমালিণ্যের কারণ ঘটতে পারে।

মিসেস মারকাডো– আমি জানতে চাইলাম।

ওঃ উনি! মিস জনসন অতি সাবধানে মিসেস মারকাডোর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কি এখন আমার মিসেস লিডনারের কথা ছাড়া অন্য কারোর, কথা মনে পড়ে না। আকর্ষণীয় মহিলা। ওঁকে যে কেউ একটিবার দেখলেই বুঝতে পারবে, ডঃ লিডনার কেন ওঁর প্রেমে পড়েছিলেন?

তবে শেষ পর্যন্ত মিসেস লিডনারই এই অবিশ্বাস্যপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য যে দায়ী মিসেস কেলসির সঙ্গে মিস জনসন একমত হল এ ব্যাপারে।

তারপর একটু ভয়ে ভয়ে মিস জনসন বলে, আমি নিশ্চয়ই তার প্রশংসা করব। চমৎকার মহিলা উনি।

সেই পুরনো খেলা, কেন জানি না আমার মনে হল, মেয়েরাই বোধহয় মেয়েদের পরম শত্রু। কোন মেয়ের বাড়বাড়ন্ত হলে অন্য মেয়েদের হিংসা হয়, কারণে অকারণে তারা তখন তার খুঁত খোঁজে কি করে তাকে অপদস্থ করা যায়। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মিস জনসন খোলাখুলি ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ও ওর প্রধানের স্ত্রীকে পছন্দ করে না (এবং সেটাই বোধ হয় স্বাভাবিক), এবং আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তাহলে ধরে নিতে পারি, মিসেস লিডনারকে দারুণ ভাবে ঘৃণা করেন মিসেস মারকাডো।

আর একজন যিনি মিসেস লিডনারকে পছন্দ করেন না, তিনি হলেন শীলা রেলি। একবার কি দুবার আমি তাকে দেখেছি। তাতেই আমার মনে হয়েছে সেই শান্ত নীরব আমেরিকান যুবক এমাটের উপর শীলার দুর্বলতা আছে। এমাট অন্য কারোর সঙ্গে খুব বেশি কথা না বললেও শীলার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যায়। মনে হয় এমাটও বোধ হয় শীলার প্রতি অনুরক্ত।

একদিন মধ্যাহ্বতভাজের সময় মিসেস লিডনার ওদের রাগ-অনুরাগ পর্বের উপর মন্তব্য করেন।

রেলির মেয়েটি এখনও ডেভিডের মন জয় করতে ব্যস্ত। একটু হেসে তিনি আবার বলতে থাকেন, বেচারা ডেভিড।

মিঃ এমাট উত্তর দিলেন না। কিন্তু তার মুখটা কেমন টান-টান হয়ে গেল। থরথর করে তার লাল মুখটা কাঁপতে থাকে। চোখ তুলে তাকালেন মিসেস লিডনারের দিকে। মিঃ এমাটের মুখে চোখে এক অস্বাভাবিক কৌতূহল। মিসেস লিডনারের চোখে সোজা-সুজি দৃষ্টি রেখে তিনি যেন তার কাছে চালেঞ্জ জানাচ্ছেন।

মিসেস লিডনারের ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি।

আমার মনে হল, ফাদার ল্যাভিগনি ফিসফিস্ করে কি যেন বলতে যান, কিন্তু আমি যখন বললাম, ক্ষমা করবেন, তিনি নিজের থেকেই কি ভেবে মাথা নাড়লেন এবং মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেন।

সেদিনই অপরাহ্নে মিঃ কোলম্যান আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, সত্যি করে বলতে কি মিসেস লিডনারকে গোড়ার দিকে আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। তবে এখন আমি তাকে ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করছি। তার মত দয়ালু মহিলার সঙ্গে এর আগে কখনো মিলিত হয়েছি বলে আমার মনে হয় না। শীলা রেলির সম্বন্ধে তিনি হয়তো তার ভালর জন্যই একটু কড়া সমালোচনা করে থাকবেন, কিন্তু শীলা তার ভদ্রতার সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়ে যেভাবে তার সঙ্গে দুতিনবার রূঢ় ব্যবহার করে, তার সঙ্গে কোন তুলনা হয় না। তখন মনে হয়েছিল ভদ্রতা বলে ও বোধহয় কিছু জানে না।

হ্যাঁ, আমি তা বিশ্বাস করি। আসলে ডঃ রেলিই ওকে নষ্ট করেছেন, শীলার কোন দোষ নেই।

আমার তাতে কোন দ্বিধা নেই। কারণ দুদিন আমি হাতে হাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।

প্রথমতঃ আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে ল্যাবোরেটরি থেকে কিছু রাসায়নিক তরল পদার্থ আনতে যাই। মিঃ মারকাডো তখন আরাম কেদারায় ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়েছিলেন, চোখ-মুখ দেখে মনে হয়েছিল, তিনি ঘুমোচ্ছেন। আমি তাকে বিব্রত করতে চাইনি। তাই নিঃশব্দে আমি আমার কাজ হাসিল করে চলে আসি।

সেইদিনই সন্ধ্যায় আমাকে অবাক করে দিয়ে মিসেস মারকাডো কৈফিয়ত চাইলেন আমার কাছ থেকে।

তুমি কি ল্যাবোরেটরি থেকে অ্যাসিডের বোতলটা নিয়ে এসেছো?

 হ্যাঁ, আমি বললাম, নিয়েছি বৈকি।

কেন, তুমি তো বেশ ভাল করেই জানবে, ওই অ্যাসিডের একটা ছোট্ট বোতল সব সময় মজুত থাকে অ্যান্টিকরুমে। বেশ রাগের সঙ্গে কথাগুলো বললেন তিনি।

তাই নাকি? আমি তো জানতাম না।

 জানতে না বললেই হবে। তুমি ঠিকই জানতে। মুখ ঝামটা দিয়ে মিসেস মারকাডো অভিযোগ করেন, আসলে তুমি গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসেছিলে। আমি জানি হসপিটাল নার্সদের স্বভাবই এই রকম।

অবাক চোখে আমি তার দিকে তাকালাম।

মিসেস মারকাডো, আপনি কি যে বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি তার সব অভিযোগ অস্বীকার করে বললাম, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, কারোর উপর গোপনে নজর রাখার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, এখনও নেই।

হ্যাঁ ছিল এবং এখনও আছে। তুমি কি মনে করো, আমি কিছুই জানি না? এখানে তোমার আসার উদ্দেশ্যটা যে কি, ভেবেছো তা আমি কিছুই জানি না!

বলেন কি ভদ্রমহিলা! আমি স্তব্ধ; হতবাক! সত্যি, মিনিট দুই-তিন নীরবে দাঁড়িয়ে আমি ভাবি, ভদ্রমহিলা ড্রিঙ্ক করেননি তো? কোন কথা আর না বলে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। কিন্তু আমি ভাবলাম, এভাবে চুপচাপ চলে আসাটা কেমন বেমানান।

কোনদিকে না তাকিয়ে আমি তখন দ্রুত পা চালিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দূর থেকে নজরে পড়ল, ফাদার ল্যাভিগনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং সঙ্গে আর একজন। মিনিট খানেকের মধ্যেই আমি উপলব্ধি করলাম, আমার সেই দ্বিতীয় আবিষ্কার হল মিসেস লিডনার, আমার মনে পড়ল ইনিই বোধহয় সেদিন জানালায় উঁকি মারছিলেন।

আপনাদের আমি ঠিক দেখতে পাইনি, ক্ষমা চাইতে গেলে ফাদার ল্যাভিগনি হাসলেন। তারপর মিসেস লিডনার-কে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলেন।

শোন, আমি খুবই লজ্জিত। তিনি বললেন, আমি একজন ওরিয়েন্টাল ভাষার ছাত্র, কিন্তু এইসব ভাষায় শিক্ষারত ছাত্ররা কেউই আমাকে বুঝতে চায় না। এটা একটা ষড়যন্ত্র। একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, আরবি ভাষা শিখছিলাম, কিন্তু খুব বেশি সফল হইনি। তবে লিডনার বলে আমার আরবি ভাষা নাকি খুবই খাঁটি।

সেই রাতটা আমাদের দারুণ আতঙ্কের রাত।

তখন প্রায় রাত দুটো হবে। আমার ঘুম খুব পাতলা, সব নার্সদের যা হয়ে থাকে। ঘুম থেকে জেগে উঠে সবে বিছানায় উঠে বসেছি, সেই সময় আমার ঘরের দরজা খুলে গেল।

নার্স! নার্স!

মিসেস লিডনারের আর্ত চিৎকার বাতাসে ভেসে আসে। দেশলাই জ্বেলে মোমবাতি জ্বালালাম।

দরজার ওপারে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস লিডনার। ভয়ার্ত চোখ, কাঁপা ঠোঁট। পরনে নীল ড্রেসিং গাউনটা থরথর করে কাঁপছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন নীল আকাশে হঠাৎ বিদ্যুতের চমক।

আমার পাশের ঘরে হয়তো কেউ ঢুকেছে–তাকে দেওয়ালে আঁচড় কাটতে আমি শুনেছি।

কথাটা শোনা মাত্র আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে তার কাছে ছুটে গেলাম। এই তো আমি আপনার কাছে এসে গেছি ম্যাডাম, আপনার আর ভয় কিসের? আমি তাকে আস্বস্ত করতে বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।

এরিককে ডাকো, ফিসফিসিয়ে বললেন তিনি।

মাথা নেড়ে আমি তাড়াতাড়ি ছুটে যাই ডঃ লিডনারের দরজায় টোকা মারার জন্য। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনি এসে হাজির হলেন আমাদের মধ্যে। মিসেস লিডনার তখন আমার বিছানায় বসেছিলেন। তার বুকের ওঠা নামা ক্রমশঃ দ্রুত হচ্ছিল।

আমি তাকে– মিসেস লিডনার বলতে থাকেন, আমি তাকে দেওয়ালে আঁচড় কাটতে শুনেছি।

মনে হয় অ্যান্টিক-রুমে কেউ ঢুকেছে, ডঃ লিডনার চিৎকার করে উঠলেন। বলেই তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হঠাৎ, হা হঠাই আমার মনে খটকা লাগল, মিসেস লিডনারের ভয়টা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, কিন্তু ডঃ লিডনারের চিন্তা-ভাবনা তখন তার সংগ্রহশালার জন্য।

অ্যান্টিক-রুম! মিসেস লিডনার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাইতো! সত্যি আমি কি বোকা বলো তো?

মিসেস লিডনার এবার বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন।

তারপর আমরা অ্যান্টিকরুমে গেলাম ডঃ লিডনার এবং ফাদার ল্যাভিগনির সন্ধানে। ফাদার ল্যাভিগনিও নাকি শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন, সেই সঙ্গে অ্যান্টিকরুম থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো তার চোখে পড়েছিল। কিন্তু পায়ে চটি, গলাতে গিয়ে এবং টর্চ খুঁজতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য ঘটনাস্থলে এসে তেমন কোন বিসদৃশ্য তার চোখে পড়েনি, কোন অচেনা লোককে দেখতে পাননি সেখানে। তাছাড়া ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল, যেমন সাধারণত থেকে থাকে।

একটু পরে ডঃ লিডনার এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। তিনিও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যখন কোন কিছু চুরি যায়নি কিংবা ক্ষতি কিছু হয়নি,অতএব সেখানে বাইরের কারোর প্রবেশ ঘটতে পারে না।

রাতের প্রহরীর বক্তব্যও তাই। তার জবানবন্দীতে দেখা যায়, বাইরের কোন লোক তার দৃষ্টি এড়িয়ে অ্যান্টিক-রুমে ঢোকেনি। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবাই যখন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল সেই সময়, তাহলে কি করে তারা এতো জোর দিয়ে বলতে পারে যে, বাইরের কোন লোকের প্রবেশ সেখানে ঘটেনি।

আবার এমনও হতে পারে, ফাদার ল্যাভিগনির পায়ের শব্দে মিসেস লিডনারের ঘুম ভেঙে যায় এবং তাতে তিনি অমন ভয় পান।

আবার কিন্তু ফাদার ল্যাভিগনির কথাও অস্বীকার করা যায় না। কারণ প্রথমত তিনি নিজের কানে তার ঘরের জানালার সামনে তৃতীয় ব্যক্তির পায়ের শব্দ শুনতে পান এবং দ্বিতীয়তঃ অ্যান্টিকরুম থেকে আলোর রেখা, সম্ভবতঃ টর্চের আলো দেখতে পান তিনি।

ওরা ছাড়া অন্য আর কেউ কিছু দেখেনি কিংবা শুনতে পায়নি।

 যাইহোক, পরদিন মিসেস লিডনারের কাছ থেকে যে কাহিনী আমি শুনি তাতে এই ঘটনার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেড়ে যায়।

.

০৯.

মিসেস লিডনারের কাহিনী

মধ্যাহ্নভোজ তখন সবে মাত্র শেষ হয়েছে। রোজকার অভ্যাস মতো মিসেস লিডনার তার শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করলেন বিশ্রাম নেবার জন্য। যথেষ্ট সংখ্যক বালিশ এবং তার প্রিয় কতকগুলো বই বিছানায় রেখে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাব, মিসেস লিডনারের ডাকে পিছন ফিরে তাকালাম।

যেও না নার্স, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।

আমি আবার ঘরে ফিরে এলাম।

 দরজাটা বন্ধ করে দাও।

বাধ্য মেয়ের মত আমি তার কথা রাখলাম।

দরজা বন্ধ। আড়চোখে একবার সেদিকে দেখে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে আপন খেয়ালে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকলেন তিনি। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমাকে কিছু বলবার আগে তিনি যেন নিজের মনটাকে সেই ভাবে তৈরি করে নিচ্ছেন। তাই আমি তাঁকে বাধা দিলাম না।

অবশেষে সেই ইতস্ততঃ ভাবটা কাটিয়ে উঠে আমার দিকে ফিরে তাকালেন তিনি এবং হঠাৎ বললেন, বসো।

শান্ত ভাবে বসলাম। কথা বলার শুরুতেই তাকে একটু নার্ভাস বলে মনে হল আমার। এই সব দেখে শুনে তুমি নিশ্চয়ই ঘাবড়ে গেছ তাই না?

কথা না বলে কেবল মাথা নাড়লাম।

শেষ পর্যন্ত অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমি মনস্থির করলাম, তোমাকে আমি খুলে বলব–সব কিছু। কাউকে না কাউকে আমার বলা একান্ত দরকার, তা না হলে আমি তো পাগল হয়ে যাব।

এই মুহূর্তে তার হাঁটা চলার মধ্যে একটা নিদারুন অস্থিরতার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তার সেই অস্থির পা দুটো হঠাৎ স্তব্ধ হল, তিনি তখন আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

তুমি কি জান আমার কিসের ভয়?

কোন একটি লোককে।

হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো বললাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি নিজেই আবার বলেন, আমার আশঙ্কা আমি বোধ হয় খুন হয়ে যাচ্ছি।

সে সম্ভাবনা এখন আর নেই। তবু এ ব্যাপারে তাকে সান্ত্বনা দেবার কোন প্রয়োজন নেই।

ও, তাহলে এই ব্যাপার?

আমার কথার মধ্যে কি ছিল কে জানে, তারপর হঠাৎ তিনি হাসতে শুরু করলেন। হাসি, হাসি আর হাসি। এবং তারপর কান্না। অশ্রুর বাদল নামল তার দু চোখের কোল বেয়ে।

যে ভাবে তুমি বললে! হাঁফাতে হাঁফাতে তিনি অনুযোগ করলেন, যেভাবে তুমি কথাটা বললে-

এখন, এখন আর ও নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম, ঠাণ্ডা জল এনে তার কপালে ঢালোম তাকে শান্ত করার জন্য।

এখন আর অবুঝ হবেন না,, একরকম ধমক দিয়ে আমি তাকে বললাম, শান্ত ভাবে সব গুছিয়ে আমাকে বলুন আপনার জীবনে কি ঘটেছিল।

তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু, নার্স, তুমি আমাকে এমন বোঝাচ্ছ যেন আমি দু বছরের বাচ্চা মেয়ে। যাইহোক, আমি তোমাকে বলব, সব খুলে বলব।

এই তো ভাল মেয়ের মতো কথা হল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম।

তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, এবার শান্ত এবং সংযত তার কণ্ঠস্বর। কোন তাড়াহুড়া নেই, কোন আবেগ কিংবা উচ্ছ্বাস নেই। মিসেস লিডনার এখন অন্য মানুষ, অন্য মন নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাইছেন।

কুড়ি বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় একজন প্রতিষ্ঠিত যুবকের সঙ্গে। তখন ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ হবে।

জানি, আমি বললাম, মিসেস মারকাডো আমাকে বলেছেন। যুদ্ধে তিনি মারা যান।

কিন্তু, মিসেস লিডনার মাথা নেড়ে আপত্তি জানালেন।

কিন্তু বলে থেমে গেলেন কেন? আমার কেমন কৌতূহল হল।

উনি যা ভেবে থাকেন। শুধু উনি কেন বলছি, সবাই ওই একই কথা ভেবে থাকে আমার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়। জানো নার্স, সেই বয়সে আমি তখন ভীষণ দেশপ্রেমিক উৎসাহী মেয়ে ছিলাম। আমি আমার আদর্শের একচুল বাইরে যেতাম না। বিয়ের কয়েক মাস পরে এক আকস্মিক ঘটনায় আমি জানতে পারি, আমার স্বামী জার্মানদের একজন বেতনভুক গুপ্তচর ছাড়া আর কিছু নয়। তখন আমার কাছে একটা খবর ছিল, আমার স্বামী একটা গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান জাহাজ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, সফল হলে বেশ কয়েকশো লোকের সলিল সমাধি হওয়ায় সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমি জানি না সেই অবস্থায় পড়লে অন্য কোন স্ত্রী দেশপ্রেমিক হিসাবে কি করতে তখন। তবে আমি কি করেছিলাম সেদিন তাই তোমাকে বলছি। সরাসরি আমি বাবার কাছে গেলাম, তিনি তখন যুদ্ধ বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁকে আমি সব খুলে বললাম, কিছুই গোপন করলাম না। এমন কি স্বামী হিসাবেও কোন দুর্বলতা প্রকাশ করা নয়, তখন আমার মানসিকতা ঠিক এরকমই ছিল এই ভাবেই নিজেকে তৈরি করেছিলাম। ফ্রেডরিক যুদ্ধে নিহত হয় পরবর্তীকালে, –কিন্তু আমার কাছে আরো একটা খবর ছিল, আমেরিকায় গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাওয়ার অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

উঃ কি ভয়ঙ্কর। আমি চমকে উঠলাম।

হ্যাঁ, তোমার মতো আমিও তখন দারুণ চমকে উঠেছিলাম। তিনি বলেন, ভয়ঙ্কর সত্যই বটে। সে ছিল অত্যন্ত দয়ালু, ভদ্র এবং সব সময় কিন্তু আমার মনে কোন সংশয় ছিল না, ফ্রেডরিকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আমি একটুও ইতস্ততঃ করিনি। সম্ভবতঃ আমি ভুল করেছিলাম।

বলা মুশকিল, প্রত্যুত্তরে বললাম, জানি না আপনার মতো অবস্থায় পড়লে অন্যরা কি করতো।

তোমাকে যা বলছি বাইরের কেউ জানে না। লোকে জানে, আমার স্বামী ফ্রন্টে গিয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। সৈনিকের বিধবা পত্নী হিসাবে অনেকে আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছিলেন তখন।

কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর কি রকম ভারী হয়ে আসে, উপলব্ধির ভঙ্গিতে আমি মাথা নাড়লাম।

বহু পুরুষ আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাদের সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমার মনটা তখন দারুণ বিষিয়ে উঠেছিল। আমি তখন ভাবতেই পারি না, নতুন করে আবার আমি বিশ্বাস করতে পারব।

হ্যাঁ, আপনার তখনকার মনের অবস্থা আমি বেশ উপলব্ধি করতে পারি।

তারপর হঠাৎ আমি একটি যুবকের প্রেমে পড়ে যাই। আমার মনটা ভীষণ বিচলিত হয়ে ওঠে তার সান্নিধ্যে এসে। সেই সময় একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যায়। ছদ্মনামে লেখা একটা চিঠি পাই ডাকে–চিঠিটা ফ্রেডরিকের। হুমকি দিয়ে লেখা চিঠি, আমি যদি আবার অন্য কোন পুরুষকে বিয়ে করি, তাহলে ও আমাকে খুন করবে।

ফ্রেডরিকের কাছ থেকে? তার মানে আপনার মৃত স্বামীর কাছ থেকে?

হ্যাঁ, আমার স্বামীর কাছ থেকে বৈকি! প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আমি পাগল হয়ে গেছি কিংবা স্বপ্ন হয়ে গেছি। অবশেষে আমি আমার বাবার কাছে যাই। তিনি তখন আমাকে সত্য ঘটনাটা খুলে বলেন। আমার স্বামী নাকি প্রকৃতপক্ষে গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যাননি। কয়েক সপ্তাহ পরে একটি ট্রেন ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হন তিনি এবং তাতেই অন্যদের সঙ্গে তার মৃতদেহ ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পাওয়া যায়। যাইহোক, লোকটা যখন আর জীবিত নেই, তাই তিনি আমাকে তার মৃত্যুর খবরটা দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। একটু থেমে মিসেস লিডনার আবার বলতে থাকেন, কিন্তু সেই চিঠিটা একটা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। তবে কি আমার স্বামী বেঁচে আছেন?

মিসেস লিডনারের বাবা ব্যাপারটা খুব সাবধানে এড়িয়ে যান। তিনি খোলাখুলি ভাবে জানিয়ে দেন, ফ্রেডরিকের মৃতদেহ বলে যাকে কবর দেওয়া হয় সেটি প্রকৃতপক্ষে ফ্রেডরিকেরই। তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন, ফ্রেডরিক মৃত এবং সেই চিঠিটা একটা বিদ্বেষপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়।

এ ঘটনা শুধু একবারই নয়, বারবার ঘটে। কারোর সঙ্গে আমার যদি খুব ঘনিষ্ঠতা থাকত, তাহলে সেই সব হুমকি দেওয়া চিঠিগুলোর অর্থ বুঝতে পারতাম।

আপনার স্বামীর হস্তাক্ষর আপনি চিনতে পারেন?

সেটা বলা মুশকিল, ধীরে ধীরে তিনি বললেন, তার কোন চিঠি আমার কাছে নেই। স্মৃতি শক্তি ছাড়া আমার তহবিলে আর কিছু নেই।

তবে কি এটা কোন অলৌকিক ঘটনা কিংবা সেরকম কিছু।

না, তা নয়। মিসেস লিডনার যা বললেন তা এই রকম, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিগত কতকগুলো সাংকেতিক ভাষায় মনের ভাব বিনিময় হতো, যেমন নিকনেম। কেউ যদি সেই সব ভাষাগুলো তাদের চিঠিতে ব্যবহার করতো তাহলে না হয় বিশ্বাস করা যেত।

হ্যাঁ, অনেক ভেবে-চিন্তে আমি বললাম, এক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত বলেই মনে হয়, চিঠিগুলো আপনার স্বামীর লেখা নয়। তবে কি সে অন্য কেউ হতে পারে?

হ্যাঁ, সেই সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফ্রেডরিকের এক ভাই ছিল, আমাদের বিয়ের সময় তার বয়স ছিল দশ কি বারো। ফ্রেডরিককে সে শ্রদ্ধা করতো এবং ফ্রেডরিক তাকে স্নেহ করতেন। উইলিয়াম তার নাম। তার পর সেই ছেলেটির যে কি হল, জানি না। ছেলেটি তার দাদাকে ভালবাসতো, তাই ফ্রেডরিকের আকস্মিক মৃত্যুর জন্য মনে হয় সরাসরি সে আমাকে দায়ী বলে মনে করে। এমনিতেই আমার প্রতি তার হিংসা ছিল এবং ফ্রেডরিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সে হয়তো আমাকে শাস্তি দেবার জন্য এই পরিকল্পনা করে থাকবে।

হ্যাঁ, এটা সম্ভব, আমি বললাম, শকের ব্যাপারে শিশুদের মনে দারুণ রেখাপাত করে থাকে।

জানি, আমিও জানি। হয়তো এই ছেলেটি প্রতিশোধ নেবার স্পৃহায় তার জীবন উৎসর্গ করতে চায়।

তারপর? আমি ওঁকে তাড়া দিলাম, থামলেন কেন, বলে যান ম্যাডাম।

এরপর বেশি কিছু বলার নেই। তিন বছর আগে আমি এরিকের সঙ্গে মিলিত হই। তবে তাকে বিয়ে করার কথা আমার কখনোই মনে হয়নি তখন। এরিক একটু একটু করে তার ভালবাসা, মমতা দিয়ে আমার মনের মধ্যে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দেয়। আমাদের বিয়ের দিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছিলাম সেই ধরনের হুমকি দেওয়া আর একটা চিঠির জন্য। কিন্তু কোন চিঠিই এলো না। তাই আমার তখন মনে হয়েছিল, পত্রলেখক যেই হোক না কেন, হয় সে মৃত এখন তা না হলে সে তার নিষ্ঠুর খেলা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের বিয়ের দুদিন পরেই এই চিঠিটা আবার পেলাম।

ছোট এ্যাটাচি-কেসের ডালা খুলে একটা চিঠি বার করে আমার হাতে তুলে দিলেন তিনি। চিঠিটা ঈষৎ বিবর্ণ এবং মেয়েলী হাতের লেখা। চিঠির ভাষাটা এই রকম, তুমি আমার অবাধ্য হয়েছ। তাই এখন তুমি আর রেহাই পেতে পারো না। একমাত্র ফ্রেডরিক কানারের স্ত্রী তুমি। অতএব মরতে তোমাকে হবেই!

আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। তবে যত বেশি ভয় পাবার কথা ঠিক ততটা আমাকে পেতে দেয়নি এরিক। ও আমাকে তার একান্ত নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে দেয় তখন। দ্বিতীয় চিঠির ভাষা আগেরই অনুরূপ,আমি ভুলে যাইনি। পরিকল্পনা করছি। মরতে তোমাকে হবেই। কেন তুমি আমার কথার অবাধ্য হলে?

আপনার স্বামী এসব কথা জানেন?

মিসেস লিডনার একটু সময় চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন, আমাকে যে হুমকি দেওয়া হচ্ছে এ কথা তিনি জানেন। দ্বিতীয় চিঠিটা আসতে আমি তাঁকে দুটো চিঠিই দেখাই। সমস্ত ব্যাপারটা তিনি একটি জালিয়াতি বলে মনে করলেন। আমার প্রথম স্বামী জীবিত, এই খবরটা প্রচার করে কেউ হয়তো আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায় বলে তার ধারণা হল।

দ্বিতীয় চিঠিটা পাবার কিছুদিন পরে একটুর জন্য বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যুর হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে যান তারা। ঘটনাটা এই রকম; ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ তাদের এ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে গ্যাসের সুইচটা খুলে দিয়ে থাকবে। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক সময় মিসেস লিডনারের ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং গ্যাসের গন্ধ তাঁর নাকে লাগে। তখন তিনি নার্ভাস হয়ে পড়েন। তিনি তার স্বামীকে সব খুলে বলেন। এও বলেন, কিভাবে তিন বছর ধরে তিনি অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি তাঁর স্বামীকে বলেন, পত্ৰলেখক পাগল হোক, আর যাই হোক, সত্যি সত্যি সে এবার তাকে খুন করতে উদ্যত হয়েছে। কেন জানি না সেই প্রথম তার মনে হল, পত্রলেখক ফ্রেডরিক ছাড়া অন্য আর কেউ হতে পারে না। এর আগেও তিনি তার মধ্যে এমনি একটা নিষ্ঠুর ভাব লক্ষ্য করেছিলেন।

মনে হয়, মিসেস লিডনার আবার মুখ খুললেন, এরিক আমার থেকে একটু কম সতর্ক বলে মনে হল। পুলিশকে খবর দিয়ে সে তার কর্তব্য পালন করতে চাইল। স্বভাবতই আমি তার কথায় তেমন আমল দিলাম না। অবশেষে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে এলাম আমরা, আমি তার সঙ্গে এখানে এসে বসবাস করব। আর গ্রীষ্মবকাশে আমেরিকায় ফিরে না গিয়ে লণ্ডন কিম্বা পারিসে গিয়ে থাকাটাই বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

পরিকল্পনা মতো তাদের সব কাজ ঠিক ঠিক চলতে থাকে এবং তারপর সপ্তাহ তিনেক আগে আর একটা চিঠি পান মিসেস লিডনার। খামের উপর ইরাকের স্ট্যাম্প মারা ছিল। সেই তৃতীয় চিঠিটাও তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন

তুমি ভেবেছ, তুমি রেহাই পেয়ে যাবে। কিন্তু তোমার ভুল ধারণা। অন্যের হয়ে আমার কাছে তুমি বেঁচে থাকতে পারো না কিছুতেই। এ কথা আমি তোমাকে সব সময় বলে আসছি। তোমার মৃত্যু আসন্ন।

আর সপ্তাহ খানেক আগে এই চিঠিটা। এখানে এই টেবিলের উপর পড়েছিল। এমন কি ওটা ডাক ঘরেও যায়নি।

ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠিটা আসেনি? কেমন কৌতূহল হল। তার হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিলাম। তিন অক্ষরের লেখা চিঠি নয়, যেন একটা চিরকুট, কিন্তু ভয়ঙ্কর তার অর্থ, একটা অশুভ ইঙ্গিত।

আমি এসে গেছি।

মিসেস লিডনার অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

বুঝলে, যে আমাকে খুন করতে যাচ্ছে! সে লোক ফ্রেডরিক হতে পারে, আবার ইউলিয়ামও হতে পারে। তবে সে যেই হোক না কেন, সে আমাকে খুন করতে যাচ্ছে।

কথা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর কঁপছিল। আমি তার কব্জিটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

এখন আমরা আপনার অনেক কাছে এসে গেছি। ভয় কি? এখন থেকে আমরা আপনার উপর নজর রাখব। আপনার কাছে স্যাম্ভল্যাটলি (মূৰ্ছাপ্রবণতায় ব্যবহৃত অ্যামনিয়াম কার্বনেট প্রস্তুত ঔষধ) আছে?

মিসেস লিডনার চোখের ইশারায় দেওয়াল-আলমারির দিকে তাকালেন। আমি তাকে ভাল রকম একটা ডোজ দিলাম।

একটু পরে তিনি সহজভাবে বললেন, হ্যাঁ, এখন আমি একটু সুস্থ বোধ করছি। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমার বর্তমান অবস্থার কথা। আমি যখন জানালার সামনে লোকটাকে দেখি, আমি ভাবলাম, সে আসছে–এমন কি তুমি যখন এখানে এলে তখনও আমার সন্দেহ ছিল, তুমি বোধহয়–

একজন সাধারণ হসপিটাল নার্স, এই তো?

না, না ও কথা আমি ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম, বুঝি সেই লোকটার সঙ্গে তোমার আঁতাত আছে।

আপনার চিন্তাধারা বিজ্ঞচিত নয়।

হ্যাঁ, হয়তো, বা তাই। কিন্তু আমার জ্ঞানের পরিধি যেন সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।

হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে যেতেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু যদি মনে করেন তো জিজ্ঞাসা করি, আপনার প্রথম স্বামীকে, আপনি নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।

জোর দিয়ে বলতে পারি না, ধীরে ধীরে তিনি বলেন, পনের বছর আগের কথা, হয়তো তার মুখ আমি চিনতেই পারব না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি কেঁপে উঠলেন।

কেবল একদিন রাত্রে দেখে ছিলাম, তবে সেটা মৃত লোকের মুখ। জানলায় টোকা মারার শব্দ হতেই সেদিকে তাকিয়ে দেখি, সেই মৃত লোকের মুখ। ভয়ে আমি আঁতকে উঠি। আমার চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটে আসে। কিন্তু তারা বলে, কেউ কোথাও নেই।

মিসেস মারকাডোর গল্প মনে পড়ে গেল।

আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না। একটু ইতস্ততঃ করে আমি বললাম, আপনি তখন স্বপ্ন দেখছিলেন?

না, স্বপ্ন নয়, সত্যি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

কিন্তু আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারি না। কারণ এ ধরনের ঘটনা রাতের দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। যাইহোক, কোন রুগীর বিরোধিতা আমি করি না। মিসেস লিডনারকে যতটা সম্ভব আশ্বস্ত করতে গিয়ে আমি বললাম, এ পাড়ায় যে কোন আগন্তুকই আসুক না কেন, আমি নিশ্চিত, সে এখানকার সবার পরিচিত না হয়ে থাকতে পারে না।

এখন তাকে একটু স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। তাই তাকে ছেড়ে আমি চলে এলাম ডঃ লিডনারের কাছে এবং তাকে আমাদের আলোচনার কথা সব খুলে বললাম।

ও যে তোমাকে সব কথা বলেছে, শুনে আমি খুশি হলাম, ডঃ লিডনার বললেন, ওই ঘটনাটা আমাকে দারুণ একটা আতঙ্কের মধ্যে ফেলে রেখেছে। আমার ধারণা ওর বর্ণনা মতে, জানালার উপর টোকা মারা, লোকের মুখের আবির্ভাব ঘটা, এ সবই ওর পক্ষে একটা অনুমান মাত্র। এর প্রতিকারের পথটা আমার জানা নেই। তা সামগ্রিক ভাবে ব্যাপারটা তোমার কি মনে হয়?

তিনি কি বলতে চান ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। ওই সব চিঠিগুলি একটা নিষ্ঠুর আক্রোশের নিটফল ছাড়া আর কিছু নয়।

হ্যাঁ, তা অবশ্য হতে পারে কিন্তু আমাদের তরফ থেকে করণীয় কী থাকতে পারে? চিঠিগুলো ওকে পাগল করে তুলেছে। আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি নিজেই বোধহয় পাগল হয়ে যাব। আমার কিন্তু অতো চিন্তা নেই। আমার মনে তখন একটা কথাই বার বার গুঞ্জন তুলছিল, এ ব্যাপারে কোন মহিলার হাত থাকাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চিঠিগুলির হস্তাক্ষর দেখে মনে হয় তা কোন মহিলার লেখা। এ প্রসঙ্গে মিসেস মারকাভোর মুখটা বার বার উঁকি দিতে থাকে আমার মনে। আচ্ছা যদি ধরে নেওয়া যায় যে, মিসেস লিডনারের প্রথম বিবাহের সমস্ত ঘটনার পূর্ণ বিবরণ তার জানা। সাধারণতঃ মেয়েরাই মেয়েদের পরম শত্ৰু, এই প্রবাদটা সত্যি ধরে নিলে স্বভাবতই মনে হয়, মিসেস লিডনারের উপর আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য তিনি এমন জঘন্য পথ বেছে নিয়েছেন। তবে এই মুহূর্তে আমার এই অনুমানের কথা ডঃ লিডনারকে আমি বলতে চাই না। কারণ সেটা তিনি কি ভাবে নেবেন সেটা বোঝা শক্ত।

ও হ্যাঁ, উৎফুল্ল হয়ে আমি বললাম, আমরা ভাল জিনিসই আশা করব। আমার মনে হয় কথাগুলো খোলাখুলি বলে তিনি এখন যথেষ্ট হাল্কা বলে মনে করছেন নিজেকে।

ও যে তোমাকে সব কথা খুলে বলেছে, এটা খুবই ভাল লক্ষণ। ডঃ লিডনার বলেন। এর থেকে বোঝা যায়, ও তোমাকে বিশ্বাস করে। কি করলে ওর ভাল হয়, ভাবতে ভাবতে আমি একেবারে চরম হতাশার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিলাম।

একবার মনে হল জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি স্থানীয় থানায় ব্যাপারটা জানাবেন, কিন্তু পর মুহূর্তেই আমি নিজেকে সামলে নিলাম কথাটা চেপে গিয়ে।

পরদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। শ্রমিকদের মাহিনার টাকা আনবার জন্য কোলম্যান হাসানিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত। রোজকার অভ্যাস মতো আমাদের ডাকের চিঠিগুলো তার সংগ্রহ করে নিয়ে যাবার কথা। ডাইনিংরুমের একটা কাঠের বাক্সে আমরা যে যার চিঠি ফেলে রাখি, যেখান থেকে চিঠিগুলো সংগ্রহ করে থাকে মিঃ কোলম্যান। সেই চিঠিগুলো গুছিয়ে নিতে গিয়ে হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে।

কি ব্যাপার? আমি তার কাছে গিয়ে শুধোই।

এই দেখো, আমাদের প্রিয় লুসির কাণ্ড দেখো। উনি কাকে যেন চিঠি লিখছেন, ৪২তম স্ট্রীট, প্যারিস, ফ্রান্স। কিন্তু আমার মনে হয় না, ঠিকানাটা ঠিক। তিনি মনে হয় এখন বিছানায়, দয়া করে তুমি ওঁর কাছে গিয়ে সঠিক ঠিকানাটা লিখিয়ে আনবে?

চিঠিটা তার হাত থেকে নিয়ে আমি দ্রুত মিসেস লিডনারের ঘরে ছুটে যাই। এবং ঠিকানাটা তিনি সংশোধন করে দেন সঙ্গে সঙ্গে।

এই প্রথম আমি মিসেস লিডনারের হাতের লেখা দেখি। এবং ভাল করে দেখতে গিয়ে হঠাৎ, হা হঠাৎই কেন জানি না আমার মনে হল, এরকম হাতের লেখাটা আমার কাছে খুব যেন পরিচিত।

মাঝরাতে হঠাৎ আমার খেয়াল হল, হাতের লেখাটা যে কার, সেটা আমি ধরে ফেলেছি। কেবল সেই লেখাগুলো একটু বড় আকারের এবং বিক্ষিপ্ত ভাবে ছাড়ানো। মিসেস লিডনারের হাতের লেখার সঙ্গে সেই ছদ্ম নামের লেখা চিঠিগুলোর একটা অদ্ভুত মিল আছে।

একটা নতুন সম্ভাবনার কথা হঠাৎ অমার মাথায় এল। তবে, তবে কি মিসেস লিডনার কল্পনা করে নিয়ে নিজেই সেই চিঠিগুলো লিখেছিলেন?

এবং সেই সম্ভাবনার কথাটা কি ডঃ লিডনার জেনে গেছেন।