৫. তিন ভাইবোনের চেঁচামেচি

তিন ভাইবোনের চেঁচামেচি শুনে লোকজন ছুটে এল। অনেক জলের ঝাঁপটা, পাখার বাতাস, জুতোর সুকতলা আর পোড়া কাগজের গন্ধ শোঁকানো সত্ত্বেও জটাই তান্ত্রিকের জ্ঞান ফিরল না। ডাক্তার এসে স্মেলিং সল্টের শিশি ধরলেন নাকে। জটাই তান্ত্রিক তাতেও নড়লেন না। ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন, “অসুখটা ঘোরালো মনে হচ্ছে। হাসপাতালে পাঠানো দরকার।”

জটাইয়ের অসুখের গোলমালে ঘড়ির ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। লাটু আর কদম আর ছানুরও ঘড়ির কথা মনে রইল না।

হাসপাতালের ডাক্তাররা জটাইকে পরীক্ষা করে মাথা চুলকোতে লাগলেন। অসুখটা যে কী তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। হার্ট ঠিক আছে, নাড়ীও চলছে ঠিকভাবে, ব্লাডপ্রেশার স্বাভাবিক। তাহলে হলটা কী?

সারা রাত নানারকম চিকিৎসা চলল। ভোরের দিকে হঠাৎ জটাই চোখ মেলে তাকিয়ে বিড় বিড় করে এক অচেনা ভাষায় কথা বলতে লাগলেন। চোখ দুটোর দৃষ্টিও অস্বাভাবিক।

হারানচন্দ্র বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন।

জটাই তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “লুলু। রামরাহা, রামরাহা। খুচ খুচ। নানটাং। রিকি রিকি। বুত বুত।”

ডাক্তাররা চাপা গলায় হারানচন্দ্রকে জানালেন, “মাথাটা একদম গেছে। সাবধানে কথা বলবেন। কামড়ে দিতে পারে।”

হারানচন্দ্রের মুখ শুকিয়ে গেল। জটাইকে তিনি এমনিতেই পাগল বলে জানেন। তার ওপর আবার পাগলামির কী দরকার?

জটাই ধমকের স্বরে হারানচন্দ্রকে বললেন, “রামরাহা! রামরাহা! নানটাং। র‍্যাডাক্যালি।”

হারানচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো বটেই। “

“খ্রাচ খ্রাচ!”

“হ্যাঁ, তাও বটে। তুমি একটু ঠাণ্ডা হও জটাই।”

জটাই হঠাৎ হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগলেন।

হারানচন্দ্র একটু পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “হাসির কথা বলছ নাকি? তা ভাল, আমিও একটু হাসি তাহলে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…”

জটাই উঠে বসলেন। তারপর অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ফিসফিস করে বললেন, “খুচ খুচ। লুলু। রামরাহা!”

হারানচন্দ্ৰ ভড়কে গিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, “সবই ঠিক কথা হে জটাই। সবই বুঝতে পেরেছি। আজ তাহলে আসি।”

হারানচন্দ্র রাস্তায় এসে হাঁটতে হাঁটতে খুবই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। রামরাহা! ব্রাচ ব্রাচ! নানটাং! র‍্যাডাক্যালি! কথাগুলো এমনিতে অর্থহীন এবং অচেনা বটে। কিন্তু এর আগে ঠিক এইরকমই সব শব্দ তিনি যেন কোথায় শুনেছেন! কোথায়?

খুব সম্প্রতি শুনেছেন বলেই মনে হচ্ছে।

হাসপাতালের সামনে একটা মস্ত শিশুগাছের তলায় নিত্য দাস বসে ছিল। মুখ শুকনো। চোখের দৃষ্টি ভারী ছলছলে।

হারানচন্দ্রকে দেখে নিত্য দাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি, জয় শিবশন্তো?”

হারানচন্দ্র চমকে উঠে বলেন, “তুই আবার কবে থেকে কালীভক্ত হলি?”

“আজ্ঞে, সবই প্রভুর কৃপা। তা প্রভুকে কেমন দেখলেন?”

“ভাল নয় রে। মাথা খারাপের লক্ষণ।”

নিত্য দাস হাসল না। তবে গম্ভীর হয়ে খুব দৃঢ় স্বরে বলল, “আজ্ঞে, ওসব ডাক্তারদের চালাকি। প্রভুর সমাধি অবস্থা চলছে।”

“সে আবার কী?”

“আপনি নাস্তিক মানুষ, ঠিক বুঝবেন না।”

“সমাধি কী জিনিস সে আমি জানি। সবই বুজরুকি। তা জটাইয়ের সে-সব হয়নি। উদ্ভট সব কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে।”

“তা তো বেরোবেই। দেবতারা সব এ সময়ে কথা বলেন তো ওঁদের মুখ দিয়ে। তা কী বলছেন প্রভু?”

“অদ্ভুত সব শব্দ। নানটাং, রামরাহা, র‍্যাডাক্যালি…”

“অ্যাাঁ! বলেন কী! এ যে আমি নিজের কানে কালকেই ভূতেদের বলতে শুনেছি। প্রভুর কাছে বসে ছিলাম সকালে, ভূতপ্রেতরা সব জুটল এসে চারধারে। দারুণ মাইফেল।”

“তুইও শুনেছিস!”

“আজ্ঞে, একেবারে স্বকর্ণে। বাঞ্ছারাম, বাঞ্ছাসীতা আর তাদের সাকরেদরা ওই ভাষাতেই কথা বলে কিনা।”

কথাটা হারানচন্দ্রের খুব অবিশ্বাস হল না। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, সেদিন রাত্রে ঘড়ি বালিশের তলায় নিয়ে শুনেছিলেন। তখন সারা রাত যে সব অশরীরী কথাবাতা তাঁর কানে এসেছে, তার মধ্যে এইসব অদ্ভুত শব্দ ছিল বটে।

হারানচন্দ্র অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “রাম রাম। কী যে ভুতুড়ে কাণ্ড শুরু হল!”

নিত্য দাস হঠাৎ ‘জয়কালী’ বলে হারানচন্দ্রের পায়ের গোড়ায় উপুড় হয়ে বসে মাথা নাড়তে লাগল। “কী বললেন! রাম রাম! এ যে ভূতের মুখে রামনাম গো কতা! অ্যাাঁ। ঘোর নাস্তিকও প্রভুর মহিমায় রামনাম করতে লেগেছে! উঃ রে বাবা, এ যে একেবারে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছেন প্রভু!”

হারানচন্দ্র লজ্জা পেয়ে বললেন, “দূর বোকা! রাম রাম কি আর ভূতের ভয়ে করেছি নাকি? রাম রাম বলেছি ঘেন্নায়। তা সে যাই হোক, জটাল্টা খুব ভাবিয়ে তুলেছে।”

নিত্য দাস মাথা নেড়ে বলে, “কোনও ভয় নেই। আমি বলছি প্রভুর এখন সমাধি চলছে। পিশাচ ভাব। সমাধিটা কেটে গেলেই দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”

হারানচন্দ্র হাঁটতে হাঁটতে কী একটু ভেবে জটাইয়ের বাসার দিকে চলতে লাগলেন। যত নষ্টের মূল সেই ঘড়িটা তাঁকে আর একবার ভাল করে দেখতে হবে। জটাই যখন ভূতের গল্পটা বলেছিল, তখন তাঁর ভাল বিশ্বাস হয়নি বটে, কিন্তু এখন নানা ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তাঁর মনে হচ্ছে, ঘড়িটা বিশেষ পয়া নয়।

জটাই তান্ত্রিকের ভগ্ন্যুপের মতো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটু দ্বিধা বোধ করলেন হারানচন্দ্র। একদম একা ঘড়িটার কাছে যেতে এই দিনের বেলাতেও তাঁর সাহস হচ্ছিল না।

কিছুক্ষণ দোনোমোনো করে তিনি অবশ্য ঢুকলেন। উঠোন পেরিয়ে ঘরে উঁকি দিলেন। জটাইয়ের ঘর তালা দেওয়া থাকে না। কারণ দামি জিনিস বলতে কিছুই প্রায় নেই। একটা কুটকুটে কম্বলের বিছানা, একটা ঝোলা, কমণ্ডল, ত্রিশূল এইসব রয়েছে।

সন্তর্পণে ঘরে ঢুকলেন হারানচন্দ্র। তারপর ঘড়িটা খুঁজতে লাগলেন।

কিন্তু কোথাও ঘড়িটা পাওয়া গেল না। এমন কী, হরি ড্ডামের করোটির ভিতরেও নয়।

হারানচন্দ্রের মুখ শুকিয়ে গেল। ঘড়ি হারানোয় তাঁর বড় বদনাম। জটাই তান্ত্রিক পাগল হয়ে গেছে, তার ঘরে ঘড়িটা নেই। সুতরাং এটাও হারিয়েছে বলেই ধরে নেবে লোকে। বাসবনলিনী যে কী কাণ্ড করবেন কে জানে।

হারানচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলেন। এ ঘড়িটা হারানোয় তিনি খুব একটা দুঃখ বোধ করছেন না। হারিয়ে থাকলে একরকম ভালই। আপদ গেছে। কিন্তু বাসবনলিনী তো কোনও ব্যাখ্যাই শুনতে চাইবেন না। দুঃখ এইটাই।

হারানচন্দ্র বাড়ি ফিরতে ফিরতে নানা কথা চিন্তা করছিলেন। আচমকাই তাঁর কানের কাছে কে যেন খুব অমায়িকভাবে বলে উঠল, “রামরাহা। নানটাং। রামরাহা।”

আপাদমস্তক চমকে উঠলেন হারানচন্দ্র। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। ডান ধারে মজা খালের সোঁতা। বাঁ ধারে গর্ডন সাহেবের বাড়ির পাঁচিল। রাস্তা যতদূর দেখা যাচ্ছে ফাঁকা এবং জনশূন্য।

হারানচন্দ্র তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন। কিন্তু আচমকাই কে যেন কাছ থেকে ধমকে উঠল, “রামরাহা! খ্রাচ খ্রাচ! খুচ খুচ!”

বাঁ ধারে গর্ডন সাহেবের বাড়ির ফটক। যারা জানে, তারা কদাচ হুট বলতে ফটক পেরোয় না। কারণ বাগানে সর্বদা

দশ-বারোটা বিভীষণ চেহারার কুকুর পাহারা দিচ্ছে। ঢুকলেই ফেচিখেউ করে ধরবে এসে।

কিন্তু হারানচন্দ্রের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে। “রাম রাম রাম রাম” জপ করতে করতে তিনি ফটকটা এক ধাক্কায় খুলে ভিতরে ঢুকে প্রাণপণে চেঁচাতে লাগলেন, “গর্ডন! ও গর্ডন! বাঁচাও!”

আশ্চর্য! আজ একটাও কুকুর তেড়ে এল না। নিঝুম বাড়ি। কারও কোনও সাড়া নেই।

হারানচন্দ্র আতঙ্কিত শরীরে দাঁড়িয়ে শুনলেন, বাতাসের মধ্যে ফিসফাস করে নানারকম কথাবার্তা হচ্ছে। ফটকটা বন্ধ করে হারানচন্দ্র অত্যন্ত দ্রুতবেগে গর্ডনের ওয়ার্কশপের দিকে দৌড়াতে লাগলেন।

বেশি দূর নয়। বাগানের পুবদিকের পাঁচিল ঘেঁষে মস্ত টানা একটা. দোচালা। হারানচন্দ্র গিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।

ভিতরে নানা বিটকেল যন্ত্রপাতি। একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় চাকা আর মোটর লাগিয়ে গামলা-মোটরগাড়ি বানিয়েছে গর্ডন মোটর-সাইকেলটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, একটা কলের মানুষ তৈরি করছে গর্ডন, সেটাও অর্ধেকটা তৈরি। হাতুড়ি, ছেনি, বাটালি, হাপর থেকে শুরু করে নানারকম বৈদ্যুতিক যন্ত্র, রাসায়নিক দ্রব্য, কিছুরই অভাব নেই। এই যন্ত্রের জঙ্গলে ঢুকলে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে হয়।

হারানচন্দ্র হাঁফাচ্ছিলেন। চার দিকে চেয়ে হাঁক মারলেন, “গর্ডন! বলি, গর্ডন আছ নাকি?”

সাড়া নেই। আচমকা হারানচন্দ্র নীচের দিকে চেয়ে চমকে উঠলেন। পায়ের কাছে মস্ত একটা ম্যাস্টিফ কুকুর ওত পেতে বসে আছে।

“ওরে বাবা!” বলে হারানচন্দ্র একটা লাফ মেরে একটা টুলের ওপর উঠে পড়লেন। টুলটা ঠকঠক করে নড়তে লাগল। হারানচন্দ্র চোখ বড় বড় করে আতঙ্কিতভাবে কুকুরটার দিকে চেয়ে রইলেন। কিন্তু কুকুরটার নড়াচড়ার লক্ষণ দেখা গেল না। বহুক্ষণ লক্ষ করে হারানচন্দ্র বুঝলেন, কুকুরটা জেগে নেই। কিন্তু এত গাঢ় ঘুম কুকুরের কখনও হয় না। শব্দ হলে তো কথাই নেই, অচেনা গন্ধেই কুকুর ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে ওঠে। ম্যাস্টিফটা কি তাহলে মরে গেছে?

হারানচন্দ্র টুল থেকে নেমে নিচু হয়ে কুকুরটার গায়ে হাত রাখলেন। না, কোনও স্পন্দন নেই। নিচু হয়ে হারানচন্দ্র অতঃপর চারদিকে চেয়ে দেখলেন। তাঁর চক্ষু স্থির হয়ে গেল। টুলের নীচে, বেঞ্চির তলায়, টেবিলের ছায়ায় দশ-বারোটা কুকুর পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছে। সামনের দুই থাবার মধ্যে নামানো মাথা। হুবহু ঘুমন্ত ভাব। কিন্তু ঘুম নয়। তার চেয়ে গভীর কিছু।

হারানচন্দ্রের বুক কাঁপছিল ভয়ে। কুকুরগুলোর হল কী?

ওয়ার্কশপের এক কোণে গর্ডনের নিজস্ব বিশ্রামের জন্য একটা খোপ আছে। হারানচন্দ্র ধীর-পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে একেবারে বাক্যহারা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন।

প্রথমেই নজরে পড়ল, টেবিলের ওপর তাঁর ঘড়িটা পড়ে রয়েছে। পাশেই একটা ছোট্ট ডাইস ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। ঘড়িটা বোধহয় খোলার চেষ্টা করেছিল গর্ডন। পারেনি। গর্ডনের টুলটা কাত হয়ে পড়ে আছে মেঝেয়। গর্ডন নিজে পড়ে আছে আর-একটু দূরে। চোখ ওল্টানো, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। সংজ্ঞাহীন না প্রাণহীন, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

ঘড়িটা নিয়ে হারানচন্দ্র ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলেন। তাঁর চেঁচামেচিতে বিস্তর লোক জমা হয়ে গেল। গর্ডনকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।

হারানচন্দ্র বাড়ি ফেরার পর হৈ-হৈ পড়ে গেল। তাঁর হাতে ঘড়ি। ঘড়িটা যে ফের ফিরে আসবে, এটা কেউ আশা করেনি।

বাসবনলিনী বললেন, “ও ঘড়ি আর পরতে হবে না। এখন থেকে আমার কাছে থাকবে।”

হারানচন্দ্র বিরস মুখে বললেন, “তাই রাখো। ওই অলুক্ষুনে ঘড়ি আমি কাছে রাখতে চাই না।”

বাসবনলিনী অবাক হয়ে বললেন, “অলক্ষুনে কেন হবে? সত্য কলকাতা থেকে আদর করে কিনে এনে দিল, অলক্ষুনে কিসের?”

হারানচন্দ্রের দৃঢ় ধারণা, ঘড়িটা ভুতুড়ে। কিন্তু সে কথা বললে তাঁর মান থাকে না। তাই গম্ভীর মুখে বারান্দার ইজিচেয়ারে গিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলেন। তাঁর মনে হল, ভূত জিনিসটা সত্যিই আছে। এতদিন প্রমাণ না পেয়ে বিশ্বাস করেননি বটে, কিন্তু এবারে হাড়ে-হাড়ে টের পেতে হচ্ছে। কিন্তু ভয়ের কথা হল, ভূতটা ভয়ংকর শক্তিশালী। যে মানুষ ভূত চরিয়ে খায়, সেই জটাই তান্ত্রিক এই ভূতের পাল্লায় পড়ে পাগলা হয়ে আবোল-তাবোল বকছে। ঘড়িটা জটাইয়ের হাত থেকে কী করে গর্ডনের কাছে গেল সেটা তিনি জানেন না, কিন্তু ঘড়ির ভূত গর্ডনের মতো দশাসই জোয়ানকেও কাত করে ফেলেছে তার বিটকেল কুকুরগুলোসহ। এইরকম সাংঘাতিক ভুতুড়ে ঘড়ি বাড়িতে রাখাটা কি ঠিক হবে? বাসবনলিনী খুবই ডাকসাইটে মহিলা বটে, কিন্তু ভূতটাও কম ত্যাঁদড় তো নয়।

নাঃ, বাসবনলিনীর কাছ থেকে ঘড়িটা নিয়ে তিনি নদীর জলে ফেলে দিয়ে আসবেন! এই ভেবে হারানচন্দ্র উঠতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় নীচের তলা থেকে একটা চেঁচামেচি শোনা গেল।

হারানচন্দ্র তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এসে দেখেন বাইরের ঘরে বাড়ির লোকজন জড়ো হয়ে হাঁ করে দেয়ালঘড়িটা দেখছে। সেটার কাঁটা ঘুরছে উল্টোবাগে এবং বোঁ বোঁ করে। হারানচন্দ্র শিউরে উঠলেন। একটা অদৃশ্য হাতই যে এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।

রজোগুণহরি হারানচন্দ্রকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে মাথা চুলকে বলল, “বাবা, গতকাল আমার আর বহুগুণের হাতঘড়ির কাঁটাও উল্টোদিকে চলছিল। তা ছাড়া, আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার। গতকাল সকালে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। একটা ছবিও ওঠেনি। কিন্তু আপনার হাতঘড়িটার ছবি উঠেছে। এসব কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।“

হারানচন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ধীরে বারে ওপরে উঠে এসে রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, নীচের চেঁচামেচি বাসবনলিনীর কানে যায়নি। তিনি রান্নাঘরে একটা টুলের ওপর বসে কানের কাছে হাত রেখে খুব নিবিষ্টমনে কী যেন ভাবছেন।

হারানচন্দ্র বললেন, “শুনছ?”

বাসবনলিনী বিরক্তির স্বরে বললেন, “আঃ, একটু চুপ করে থাকো। “

হারানচন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, “চুপ করে থাকব? কেন?”

“গানটা একটু শুনতে দাও।”

হারানচন্দ্র হাঁ হয়ে গেলেন। বাসবনলিনী গান শুনছেন? এই দুপুরবেলা ঘরের কাজকর্ম ফেলে রেখে গান! তা ছাড়া গানবাজনা তিনি পছন্দও করেন না। এমন কী, তাঁর শাসনে ছেলেমেয়েরা কেউই গান শেখেনি। সেই বাসবনলিনী কিসের গান শুনছেন?

গলা খাঁকারি দিয়ে হারানচন্দ্র বললেন, “ইয়ে, তা গানটা হচ্ছে কোথায়? আমি তো শুনতে পাচ্ছি না?”

বাসবনলিনী বললেন, “হচ্ছে গো হচ্ছে। এই ঘড়িটার ভিতর থেকে। আজকাল কত কলই যে বেরিয়েছে! ঘড়ির মধ্যে রেডিও। গানটাও অদ্ভুত। এত সুন্দর যে গান হয়, তা তো জানা ছিল না।”

“ঘড়ি!” বলে চোখ কপালে তুললেন হারানচন্দ্র। তারপর হাত বাড়িয়ে বললেন, “দাও! শিগগির দাও! ওই অলক্ষনে ঘড়ি এক্ষুনি নদীর জলে ফেলে দিয়ে আসা উচিত।”

বাসবনলিনী ফুঁসে উঠে বললেন, “তা বই কী! সত্য কলকাতা থেকে এনে দিয়েছে রেডিওসুষ্ঠু ঘড়ি, সেটা নদীর জলে না ফেললে তোমার শান্তি হবে কেন? এত তো ঘড়ি হারালে, এটাকে একটু রেহাই দাও না।”

ফাঁপরে পড়ে হারানচন্দ্র বললেন, “ইয়ে, ঘড়িটা ভাল নয়। ওটার জন্য অনেক গোলমাল হচ্ছে।”

“ভাল নয় মানে? কিসের ভাল নয়? আমি তো জন্মে এত ভাল ঘড়ি দেখিনি বাপু। এটার জন্য গোলমালটা কিসের?”

হারানচন্দ্র জানেন, বাসবনলিনীকে কোনও কথা বোঝাতে যাওয়া বৃথা। উনি বুঝতে চাইবেন না। ভূতের কথাটাও বলা যাচ্ছে না। কারণ সকলেই জানে যে, হারানচন্দ্র ভূত বা ভগবান মানেন না।

হারানচন্দ্র তাই সন্তর্পণে বললেন, “তা ইয়ে, গানটা কী রকম বলো তো! একটু শোনা যায়?”

বাসবনলিনী একগাল হেসে মুঠোয় ধরা ঘড়িটা হারানচন্দ্রের কানের কাছে ধরে বললেন, “শোনো, শুনেই দ্যাখো।”

হারানচন্দ্র শুনলেন। ঘড়ির ভিতর থেকে বাস্তবিকই মৃদু ও ভারী সুন্দর গান ভেসে আসছে। কথাগুলো কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু সেই গান আর বাদ্যযন্ত্রের সুরের মধ্যে সমুদ্রের কল্লোল, বাতাসের দীর্ঘশ্বাস, চাঁদের জ্যোৎস্না, ফুলের গন্ধ, সব যেন একাকার হয়ে গেছে। একটু শুনলেই নেশা লেগে যায়। বুকটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কেমন যেন।

চকিতে হারানচন্দ্র ঘড়িটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বললেন, “এটা এখন থাক।”

“থাকবে কেন? তুমি না শোনো, আমাকে শুনতে দাও।”

হারানচন্দ্রের মনে পড়ে গেল জটাই তান্ত্রিক, গর্ডন আর কুকুরগুলোর কথা। প্রত্যেকেই এক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। জটাই জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে উন্মাদের মতো আচরণ করছে। গর্ডনের জ্ঞান ফিরলে সে কী করবে তা বলা যাচ্ছে না। হারানচন্দ্রের হঠাৎ সন্দেহ হতে লাগল, ওদের ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে এই সম্মোহনকারী গানের সম্পর্ক নেই তো?

হারানচন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “এ গান শুনো না। সর্বনেশে গান।”

“কী যে বলো, তোমার মাথার ঠিক নেই। দাও, আর একটু শুনি।”

হারানচন্দ্র ঘড়িটা কব্জিতে বেঁধে ফেলে বললেন, “কটা বাজে সে-খেয়াল আছে? শিগগির ভাত-টাত বাড়ো। ভীষণ খিদে পেয়েছে।

একথায় কাজ হল। কারও খিদে পেয়েছে শুনলে বাসবনলিনী বড় অস্থির হয়ে পড়েন। তাড়াতাড়ি কড়াইয়ের ফুটন্ত ডালনাটা হাতা দিয়ে নেড়ে বললেন, “যাও, তাড়াতাড়ি সবাই স্নান সেরে এসে বসে পড়ো। দিচ্ছি খেতে।”

হারানচন্দ্র ঘড়িটা নিয়ে নিঃশব্দে নিজের ঘরে এলেন। লোহার আলমারিতে ঘড়িটা রেখে আলমারির চাবি নিজের কোমরে গুঁজে নিশ্চিন্ত হলেন।

সারাটা দুপুর হারানচন্দ্র অনেক ভাবলেন। ঘড়িটায় যে রেডিও বা ওই জাতীয় কিছু থাকতে পারে এটা তার অসম্ভব মনে হল না। কিন্তু সত্যগুণহরি কলকাতায় চলে গেছে, সে এমন কথা বলে যায়নি যে, ঘড়িটায় রেডিও ফিট করা আছে। আর রেডিওই যদি হবে তো তার ব্যান্ড কোথায়? কোন সেন্টারের কথা এবং গান শোনা যাচ্ছে? আর সে-গান বা কথা বোঝা যাচ্ছে না কেন? ঘড়িটা যার হাতে যাচ্ছে, সে-ই অদ্ভুত ভাবে ঘুমিয়ে পড়ছে কেন? রহস্যটা কী?

বিকেলে হারানচন্দ্র হাসপাতালে দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আরও অবাক। পাশাপাশি দুটো বেডে জটাই আর গর্ডন বসে আছে। দুজনেরই মুখে হাসি। তারা পরস্পরের সঙ্গে খুব নিবিষ্টভাবে কথাবার্তা বলছে।

হারানচন্দ্র কাছে গিয়ে শুনলেন জটাই বলছে, “রামরাহা। খ্রাচ খ্রাচ।“

গর্ডন জবাব দিল, “রাডাক্যালি। খুচ খুচ।” দুজনের কেউই হারানচন্দ্রকে বিশেষ পাত্তা দিল না। হারানচন্দ্রের মাথাটা ঘুরছিল। কোনওরকমে সামলে নিয়ে তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন।