৫. ডাবলবেড রুম

এও ডাবলবেড রুম। কিন্তু তিনজন থাকার জন্য বাড়তি একটা ফোল্ডিং খাটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেটি সোমনাথ নিয়েছিল। বাকি দুটিতে সুমিত ও নায়ার। অন্য দুটি ডাবলবেড রুমে বীতশোক ও ঈশিতা, নীপা ও ক্রিস্নান। এগারোটায় বীতশোক ফিরল। তার ‘কলকাতাটিম’ তখন বারান্দা থেকে উঠে এসেছে। লবি থেকে ঘরগুলোকে আলাদা করার জন্য কাঠের পার্টিশন থাকায় ঘরগুলোর সামনে একটা করিডর হয়েছে। করিডরে পৌঁছে সে থমকে দাঁড়াল!

সোমনাথ বলছিল, “অস্বীকার করে তো লাভ নেই। আমরা প্রত্যেকেই ভয় পেয়েছি। মানুষের ক্ষেত্রে ভয় পেলে অতীতে দু’টো রিঅ্যাকশন দেখা গেছে। হয় তারা জোট বাঁধে, নয় তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হাঃ, এটাই মোটামুটি ঐতিহাসিক নিয়ম ছিল। কিন্তু পোস্ট-মডার্নিস্ট পিরিয়ডে রিঅ্যাকশনটা অন্যরকম। অ্যাবসোলিউট এলিয়েনেশন–চরম বিচ্ছিন্নতা। তবে কাপড়চোপড়ের মধ্যে আমরা প্রত্যেকেই যে উলঙ্গ, এই বোধটা থাকা উচিত। হাঃ! কোনও কোনও ঘটনা আমাদের কাপড়চোপড় খুলে ফ্যালে।”

নায়ার বলল, “ধুর ব্যাটা! তোর মূল বক্তব্যটা কী?”

সুমিত বলল, “মাইরি, এরপর মহিলাদের এখানে বসে থাকা আর উচিত, নয়।”

ঈশিতা বলল, “মাইরি-ফাইরি ছাড়ো! ভাগ্যিস আরিফ এখানে ছিল, তা না হলে এতক্ষণ পুলিশ সত্যি কাপড় খুলে নিত।”

নায়ার বলল, “ঈশিতা! তুমি কেন তখন আরিফকে বললে বীতশোক অ্যারেস্টেড কি না? এ কথা বলার কি বিশেষ কারণ আছে?”

 ঈশিতা বলল, “জানি না। কেন যেন কথাটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ইনস্টান্ট রিঅ্যাকশন!”

বীতশোক এতক্ষণে ঘরে ঢুকল। একটা চাপা হইচই পড়ে গেল। ঈশিতা চোখ বড় করে বলল, “সাংঘাতিক ব্যাপার। ইভনিং ভিলা থেকে এই বাংলোয় কে প্রচুর জুয়েল পাচার করেছে। তার মানেটা বুঝতে পারছ?

নায়ার বলল, “পান্না!”

বীতশোক টেবিলে ব্রিফকেস রেখে খাটে বসল। মুখে ধারালো হাসি এনে বলল, “নিউ টাউনশিপের মোড়ে আরিফের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সব শুনলাম। ও নিয়ে তোমাদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। টেক ইট অ্যাজ আ ফান।”

সোমনাথ বলল, “কিন্তু এ ঘরের বাথরুমে–”

তাকে থামিয়ে বীতশোক বলল, “ছেড়ে দে না বাবা! এই বাংলোর কোনও লোক কাজটা করতে পারে। পুলিশ ঠিকই খুঁজে বের করবে। ঈশু! চাবি দাও!”

ঈশিতা তাদের রুমের চাবি দিলে বীতশোক উঠল। কিন্তু যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে সে ঈশিতার দিকে তাকাল। ঈশিতা বুঝতে পেরে স্বামীকে অনুসরণ করল।

সুমিত হাসল। “মাইরি! চোখে চোখে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সত্যি কথা হয় তা এতদিনে বিশ্বাস করলুম।”

“হাঃ! সেমিওটিকস্!” সোমনাথ বলল। “চিহ্ন এবং সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ। সেভেনটিন সেঞ্চুরির শেষাশেষি দার্শনিক জন লক এটা লক্ষ করেন। তারপর চার্লস পিয়ার্স, চার্লস, মরিস, দা বিহেভিয়ারিস্ট। তো হাঃ। ইভনিং ভিলার কেউ এইভাবে কিছু কমিউনিকেট করার চেষ্টা করেছে কি না, ভাবা যেতে পারে। থ্রু দা সাইনস্ অ্যান্ড সিম্বলস। সেমিওটিকস একেবারে আদিম মানুষের কমিউনিকেশন পদ্ধতি থেকে সূত্র খুঁজে বের করে ডালপালা মেলেছে। ব্যাপারটা হল কমিউনিকেশন সায়েন্স। আমরা একে কাজে লাগিয়ে দেখতে পারি। কেউ কিছু বলতে চাইছে কি না।”

নায়ার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার প্রস্তাব, এই উন্মাদ বুদ্ধিজীবীকে ফেলে রেখে আমরা কিছুক্ষণ প্রমোদপর্যটন করে আসি? উঠে পড়ো সব।”

ক্রিস্নান বলল, “চলো! নীপা! বেশি দূর যাব না আমরা। নিকটে বনে ঢুকব। তোমার পরিশ্রম হবে না।”

নীপা অনিচ্ছার ভঙ্গিতে উঠল। সোমনাথ বলল, “তোমরা কেউ কি আমাকে একটু কাগজ দিতে পারো?”

সুমিত বলল, “নির্ঘাত পদ্য লিখবে মাইরি! সেবার হেসডি ডাকবাংলোয় চৌকিদার বেচারাকে দশ মাইল হাঁটিয়ে কাগজ এনে এগারোখানা পদ্য লিখেছিল। বিলিভ মি!”

নায়ার বলল, “লেখো। তবে আমরা বাইরে থেকে তালা এঁটে দিয়ে যাব। কারণ আবার কে কখন তোমার নাকের ডগা দিয়ে বাথরুমে পান্না রেখে যাবে।”

“নীপু! তোমার কাছে কাগজ নেই?” সোমনাথ বলল। “অন্তত নোটবইয়ের একটা পাতা হলেও চলবে।”

নাপা বলল, “নাহ”।

ক্রিস্নান বলল, “আমি এনে দিচ্ছি। আমার আছে। কিন্তু তুমি কি সত্যই পদ্য লিখতে চাও?”

সোমনাথ বলল, “আমি একটু অঙ্ক কষব। কৃষ্ণা, দেরি কোরো না। আজকাল আমি এক মুহূর্তের কথা অন্য মূহুর্তে ভুলে যাই। হাঃ-নাইট্রাজেপাম আমাকে ঘুম বেচে স্মৃতিশক্তি কিনে নিচ্ছে। বিনিময় পদ্ধতিতে।”

ক্রিস্নান বেরিয়ে গেল। নীপাও তার পিছন-পিছন গেল। হাতের মুঠোয় চারমিনার প্যাকেট ও দেশলাই নিয়ে সোমনাথ বেরুল। বলল, “আমি লবিতে বসে অঙ্ক কষব। অ্যালজেব্রা এবং জিওমেট্রির মাঝামাঝি আ সর্ট অব পিওর ম্যাথস।”

সুমিত বাথরুম সেরে বেরিয়ে এল। বলল, “একটা ব্যাপার লক্ষ করলুম মাইরি! বাথরুমের জানালায় গরাদ নেই। কাঁচের পাল্লাটা কাত হয়ে আছে। কাজেই বাইরে থেকে কেউ ইচ্ছে করলে ভেতরে সত্যিকার একটা ড্রাইসেল ব্যাটারিও ঢুকিয়ে রাখতে পারে। নীচে থেকে ম্যাক্সিমাম ফুট সাতেক উঁচু। পাশে পাইপ আছে। খাঁজে পা রেখে–সো ইজি!”

নায়ার ব্যস্তভাবে বলল, “পাল্লাটা আটকে দেওয়া উচিত।”

“দিয়েছি।” সুমিত চাপা গলায় বলল, “বাইরে থেকেই কেউ ওই হ্যাভারস্যাকটা পাচার করেছিল।”

নায়ার ফিসফিস করে বলল, “আরিফ কোনও গুরুত্ব দিল না! কর্নেল ভদ্রলোকও খালি দূরবীক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত।” সে দুই হাতের তালু গোল করে চোখে রেখে কর্নেলের ভঙ্গি অনুকরণ করল এবং ফিক করে হাসল। নায়ার মাঝে মাঝে চমৎকার ক্যারিকেচার করে।

ক্রিস্নান ও নীপা এসে গেল। ক্রিস্নানের হাতে একটা লাইনটানা বিদেশি কাগজ। সোমনাথ সেটা নিয়ে বলল, “হাঃ। এবার আমার একটা কলম চাই। কেউ কি আমাকে একটা কলম দিতে পারো?”

ক্রিস্নান তার জিনসের জ্যাকেটের হাতা থেকে একটা কলম বের করে দিল। সোমনাথ লবিতে গিয়ে বসে পড়ল।

গেটের কাছে গিয়ে নায়ার থমকে দাঁড়াল। বলল, “বীতশোক আর ঈশিতাকে ডাকা উচিত ছিল।”

সুমিত মুখে গাম্ভীর্য এনে বলল, “ওদের ডিসটার্ব করা উচিত হবে না।”

“কেন?”

 “তুই একটা গাড়ল মাইরি!” সুমিত হঠাৎ থেমে চোখে হেসে বলল, “ভদ্রমহিলারা এগোতে থাকো। আমি নায়ারকে একটা এরিয়ান মিথলজি শোনাব। মেয়েদের শুনতে নেই।”

নীপা ক্রিস্নানের হাত ধরে টানল। দু’জনে উৎরাইয়ে নামতে থাকল। নায়ার বলল, “তুই বলতে চাস কী?”

সুমিত হাসল। “কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত শোন। মাইরি! অসাধারণ। শোন না। স্বর্গে এক অসুর হানা দিয়েছে। দেবতাদের বেদম পিটোচ্ছে। তখন সবাই গেল ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা গেলেন শিবের খোঁজে। এ দিকে শিব ও পার্বতী তখন হেভি সেক্সে ব্যস্ত। বুঝলি তো? ব্রহ্মাকে দেখে শিব ধুড়মুড় করে উঠে পড়লেন। পার্বতী লজ্জায়–মাইরি! অ্যান্ড দা এনার্জি ফেল ডাউন বিসাইড দা রিভার সরস্বতী। কাশবন চিনিস তো? তার মধ্যিখানে পড়েই জিনিসটা বাচ্চা হয়ে গেল। ওঙা ওঙা করে কান্না। সেই সময় চাঁদের ছয় বউ কৃত্তিকারা এসেছে। স্নান করতে। তারা কান্না শুনে গিয়ে দেখে, একটা বাচ্চা! সবাই ব্রেস্ট ফিড। করতে চায়। মেয়েছেলের ব্যাপার–বুঝলি তো? এ বাবা শিবের বাচ্চা। ছ’খানা। মুখ দিয়ে ছ’জনের–মাইরি, বিলিভ মি! তাই কার্তিকের আরেক নাম ষড়ানন। সে বড় হয়ে অসুর ব্যাটাচ্ছেলের বডি ফেলে দিয়েছিল।”

নায়ার হঠাৎ চটে গেল। “ধুর ব্যাটা! তোর মাথার মধ্যে শিবলিঙ্গ প্রোথিত আছে। সেক্স-পার্ভার্ট!”

একটু পরে ঈশিতা বেরিয়ে এসে বলল, “বারোটায় লাঞ্চ খেয়ে রেডি থাকতে হবে। অশোক একটা গাড়ি ঠিক করেছে। হাথিয়া ফলস দেখতে যাব আমরা। সেখান থেকে পাতালেশ্বরীর মন্দির। তারপর ইভনিং ভিলা। কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

আশেপাশে একটুখানি ঘুরে আসি।” সুমিত পা বাড়াল। “আধ ঘণ্টাটাক ঘুরব নেচারে। মাথাটা ভো ভো করছে।”

উৎরাইয়ে একটু দূরে গাছের তলায় পাথরে বসে পড়েছে নীপা। ক্রিস্নান ভিউফাইন্ডারে দৃশ্য দেখছে। হাঁটতে হাঁটতে ঈশিতা বলল, “সোমনাথ লবিতে বসে কবিতা লিখছে দেখলুম। জিজ্ঞেস করলুম। মুখ তুলল না।”

নায়ার বলল, “বুদ্ধিজীবী অঙ্ক কষছে। সেমিওটিকসের সঙ্গে অঙ্কের কী সম্পর্ক আমি জানি না। অবশ্য আজকাল পরিসংখ্যান সবকিছুতে লাগে।”

ঈশিতা বলল, “তোমরা এই সব বিদ্যা-টিদ্যা আর ফলিও না তো! আমারও মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।”

নায়ার ফিক করে হেসে গোঁফ ঢাকল। “সঙ্গে বিদ্বান এনেছ। আমাকে দোষ দিও না। আমি সামান্য বার্তাজীবী। তা-ও নেহাত অন্যের কপিতে টিক মারি। বানান সংশোধন করে দিই।”

সুমিত বলল, “তোদের মর্নিং টাইমসের সার্কুলেশন কত রে?”

“সাতশো। আমার মূল বেতন সাতাশ শো।”

“এই স্টোরিটা খাইয়ে দিস। সার্কুলেশন বেড়ে যাবে। আ মিটিরিয়াস মার্ডার ইন দা ইভনিং ভিলা। জুয়েলস ডিসকভার্ড ইন আ হ্যাভারস্যাক।”

নায়ার গোঁফ মুছে বলল, “পুলিশের বক্তব্য ছাড়া আমাদের কাগজে কিছু ছাপা হয় না।”

ঈশিতা সুমিতের কাঁধে হাত রেখে আস্তে বলল, “শুধু কৃষ্ণার জন্য আমার একটু ভাবনা হচ্ছে। কারণ ও বিদেশি। তা ছাড়া নীপু বলছিল, ওদের পেপারে কী গণ্ডগোল আছে। পুলিশ ঝামেলা করেছে। আমার মনে হয়, নীপু আরিফকে একটু আভাস দিলে ভাল হত। তাই না?”

সুমিত বলল, “কৃষ্ণা কাল এসেই আরিফের সঙ্গে কত সহজে ভাব করে ফেলল দেখে আমার অবাক লাগছিল। মাইরি! আর আরিফ অবশ্য বরাবর মিশুকে ছেলে। তবে আফটার অল, পুলিশ ইজ পুলিশ।

নায়ার বলল, “না, না! আরিফকে নিয়ে ভাববার কারণ নেই। পুলিশ হিসাবে ও একেবারে অযোগ্য। নেহাত বেঁকের মাথায় আই পি এস করে বসেছিল। আসলে–অ্যাডভেঞ্চারারের বাংলা কী?”

“হঠকারী বলতে পারিস।”

“না। অ্যাডভেঞ্চারারের বাংলা হয় না। জীবনে দুঃসাহসী অভিযাত্রী!”

সুমিত ধমকাল, “চো-ও-প ব্যাটা! খালি বাকতাল্লা। কাল ইভনিং ভিলার অন্ধ ভদ্রলোক সম্পর্কে কী বলছিল যেন? মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি! মাইরি ঈশু! তুমি সেন্ট মেখেছ!”

ঈশিতা বলল, “হ্যাঁ। স্কাউন্ড্রেল।”

 “যা বাবা! গাল দিচ্ছ কেন? নিছক একটা কথা বললুম!”

ঈশিতা হাসতে হাসতে ওকে চেপে নুইয়ে দিল। “স্কাউন্ডেল বিখ্যাত একটা। সেন্টের নাম। এম্মা! এই গাঁইয়াটা তা-ও শোনেনি!”

“কী করে শুনব? ট্রেডিং কনসার্নের বকলমে কেরানি।” সুমিত চাপ সামলে সোজা হল। “নায়ার বলছিল ওর বেসিক স্যালারি সাতাশশো। আমার দু’হাজার। আমার বাপের ভাগ্য! দশ হাজারি মনসবদার একজিকিউটিভের বউয়ের আদর খাচ্ছি।”

ঈশিতা গুনগুনিয়ে গাইল, “মন দিল না বঁধু, মন নিল যে শুধু, আমি কী নিয়ে থাকি।”

নায়ার বলল, “জানি। শচীন দেববর্মণ! কিন্তু তুমি সুরে ভুল করছ।”

সুমিত বলল, “নীপুরা সত্যি বনে ঢুকছে। ওগুলো কী গাছ কেউ জানো?”

 নায়ার বলল, “শালবন। ওই দ্যাখ, শালমঞ্জরী। বসন্তকালের পূর্বাভাস।”

একটা মহুয়াগাছের তলায় যে পাথরে নীপু বসে ছিল, সেখানে পৌঁছে ঈশিতা ডাকল, “কৃষ্ণা! নীপু! যেয়ো না। বনে বাঘ আছে।”

নীপু একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ক্রিস্নান ক্যামেরায় তার ছবি তুলতে পিছিয়ে এল। ঈশিতা, সুমিত, নায়ার তাদের কাছে পৌঁছুল। শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে সবখানে। এলোমেলো বাতাস বইছে। শুকনো পাতা উড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রিস্নান ক্যামেরা এদিকে তাক করলে ঈশিতা বলল, “কডজন ফিল্ম এনেছ তুমি?”

ক্রিস্নান বলল, “সর্বশেষ দ্বিতীয়।”

“তা হলে আর খরচ কোরো না। আমরা একটা নাগাদ হাথিয়া ফলস, তারপর একটা মন্দিরে যাব। মাটির তলায় মন্দির। তোমার পক্ষে অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা হবে, কৃষ্ণা!”

নীপা বলল, “দু’টো ফিল্ম আমার জন্য রেখে দেবে কিন্তু। ভুলো না!”

নায়ার ফিক করে হেসে গোঁফ ঢাকল। “আত্মপ্রতিকৃতির প্রতি তোমার এই অস্বাভাবিক মোহ থেকে প্রমাণিত হয়, তুমি নার্সিসিস্ট।”

নীপা বলল, “আঁতেলের পাল্লায় পড়ে তুমিও আঁতেল হয়ে গেছ দেখছি নায়ারদা!”

“বাঃ রে! তুমি দু’টো ফিল্ম সংরক্ষিত করতে বলছ?”

নীপা একটু হাসল। “ইভনিং ভিলার অন্ধ ভদ্রলোকের অন্তত দুটো ছবি আমার দরকার।”

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ঈশিতা বলল, “কী সর্বনাশ! শেষে তুমি ওই বুড়ো আমেরিকান সাবের প্রেমে পড়লে? না নীপু, তোমার চয়েস ঠিক হয়নি। তুমি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়াও। চয়েসের এ কী ছিরি!”

“হি ইজ অ্যাট্রাকটিভ।”

সবাই হেসে উঠল। ক্রিস্নান বলল, “নীপাকে আমি সমর্থন করি।”

“ওম্মা! কৃষ্ণারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে।” ঈশিতা বলল। “লোকটা একসময় ছিল সাংঘাতিক দুশ্চরিত্র, মাতাল। রাত্তিরে অশোক ওর কথা বলছিল। এরিয়ার মাফিয়া লিডার ছিল লোকটা। ওর চোখ দুটো উপড়ে নিয়েছিল কি সাধে? তা ছাড়া, জানো? ওর জিভ পর্যন্ত কেটে নিয়েছিল। তাই কথা বলতে পারে না। মিঃ বোস ওকে প্রোটেকশন দিয়েছেন। তা না হলে কবে প্রাণে মারা পড়ত। এখনও নাকি সুযোগ পেলে ওর শত্রুরা ওকে ছাড়বে না।”

নীপা শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বলল, “বিশ্বাস করি না।”

ঈশিতা আলতো হাতে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল “তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারছি না, তোমার কেন ওকে অ্যাট্রাকটিভ মনে হল?”

নীপা জবাব দিল না। ক্রিস্নান বলল, “ঠিক আছে। নীপা যা চায়, করা হবে।”

“কীভাবে করা হবে?” ঈশিতা হাসল। “ওকে পাচ্ছ কোথায়? আজ ককটেল-ডিনারে ওকে পাবে ভাবছ? লোকটা কারও সঙ্গে মেশে না। আগামী কাল সকালে আমরা যাচ্ছি কুরভি ড্যাম দেখতে। প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। ফিরে এসে আরিফের কোয়ার্টারে লাঞ্চ খাব। তারপর যাব কোটলা ফরেস্টে। সেখানে নাইট হল্ট এবং বন্যপ্রাণী দর্শন। তারপর সকালে জামশেদপুর হয়ে ব্যাক টু কলকাতা।”

সুমিত বলল, “ঈশু! মাইরি, আমি ককটেল-ফকটেলে নেই। আমি সত্যিই একটু গাঁইয়া। ম্যানার্স জানি না। কী কেলেঙ্কারি করে ফেলব কে জানে। বেশি মাল-ফাল খেয়ে হয় তো মিনিস্টারকেই”

ঈশিতা ওঁর দাড়ি খামছে ধরে বলল, “নেকু! গ্র্যান্ডে তোমার কোম্পানির পার্টিতে আমি যাইনি?”

“ধুর! সে তো আমি বেয়ারা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। নেহাত চাকরির দায়ে।”

নায়ার তার নিজস্ব হাসি হাসল। “সেদিন আমাদের মর্নিং টাইমসে এক সায়েব এসেছিল। বলে কী, ইওর গ্র্যান্ড ইজ নট সো গ্র্যান্ড।”

ক্রিস্নান বলল, “নায়ার! তুমি কখনও ইউরোপে গিয়েছে?”

“ইহজন্মে হবে না।” নায়ার মুখ তুলে শালগাছের ডগা দেখতে থাকল। “কারণ আমার কাগজের মাত্র সাতশো সার্কুলেশন।”

সুমিত বলল, “আমার কাছে খবর আছে। নায়ার এর্নাকুলামের কোথায় ওর গ্রামে সাতশো নারকোল গাছ কিনে ফেলেছে। কাগজ উঠে গেলে দেশে গিয়ে নারকোল আর ছোবড়ার ব্যবসা করবে।”

নায়ার বলল, “পান্নাগুলো আমি পেলে সাত লক্ষ নারকেল গাছ কিনতাম। কে পেল কে জানে?” বলে সে রাস্তার দিকে ঘুরল। “ওই ব্যাটা বুদ্ধিজীবী আসছে। আমার ধারণা, পান্নাগুলো ও-ই হাতিয়েছে। তাই অঙ্ক কষে দাম হিসাব করছিল।”

সোমনাথ লম্বা পায়ে আসছিল। মহুয়া গাছটা পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে সুমিত মুখে হাত রেখে টার্জানের অনুকরণে অদ্ভুত শব্দ করল। তখন সোমনাথ দাঁড়াল। এদের দেখতে পেয়ে শুকনো পাতায় জোরালো শব্দ তুলে এগিয়ে এল। তার হাতে সেই কাগজটা। বলল, “তো হাঃ! ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াল শেষ অব্দি। তো–আ কোট ফ্রম জাঁ পল সার্ত : I was trying to find out New York, But I could not find it.’ মোদ্দা কথা বুঝতে হবে, কী তুমি খুঁজতে চাইছ।”

সে কাগজটা মেলে ধরল। সবাই ঝুঁকে পড়ল। সুমিত ও ঈশিতার মুখে হাসি। নীপা ও ক্রিস্নান গম্ভীর।

চিহ্ন ১। কালো চিতা = সামন্ত প্রভু।

 চিহ্ন ২। এগোনো-পিছনো পা = গতিশীলতা

চিহ্ন ৩। পায়ের ফাঁকে হ্যাভারস্যাক = গুপ্তধন

চিহ্ন ৪। চারমিনার প্যাকেটে রক্ত = সতর্কতা

চিহ্ন ৫। প্যাকেটটা ছেঁড়া = টেংরি খুলে নেব

 চিহ্ন ৬। সবুজ পান্না = গ্রিন সিগন্যাল = এগিয়ে যাও

চিহ্ন ৭। মার্কিন হ্যাভারস্যাক = আমেরিকান কানেকশান (হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে কি কিছু আছে?)

সোমনাথ সিগারেট ধরিয়ে কাগজটা নীপাকে দিল। সুমিত শুকনো পাতার ওপর সোমনাথের ফেলে দেওয়া দেশলাই কাঠিটা জুতোয় ঘষে দিল। নায়ার ফিক করে হেসে বলল, “এই বুদ্ধিজীবী ডেসমন্ড ব্যাগলির থ্রিলার পড়েছে।”

নীপা ও ক্রিস্নান কাগজটা মন দিয়ে দেখতে থাকল। ঈশিতা হেসে অস্থির হয়ে বলল, “এটা ওই ডিটেকটিভদ্রলোকের ঘরে পাচার করে দাও কেউ। বুড়ো দাড়ি ছিঁড়বে।”

সুমিত বলল, “হ্যাঁ রে সোমনাথ! এটাই কি তোর সেমিওট্রিকস?”

“সেমিওটিক্‌স্” নায়ার একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল। “কিন্তু কোনও মেথডলজি অনুসরণ করা হয়নি।”

সোমনাথ বলল, “চিহ্ন ১ থেকে চিহ্ন ৭ অব্দি একটা ল্যাংগুয়েজ পরিষ্কার পড়া যাবে। হ্যাভারস্যাকটা আমাদের বাথরুমে চলে আসা মানে কেউ আমাদের কথাগুলো বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। হয়তো আমাকেই। কারণ সিগারেটের প্যাকেটটা আমার। অথচ প্রবলেম হল, এ বিষয়ে জ্ঞানত আমি কিছু জানি না। কিন্তু অজ্ঞাতসারে কিছু জানি কি, যা কারও পক্ষে বিপজ্জনক? হাঃ। আমি সাত্রের মতো নিউইয়র্ক খুঁজছি। অথচ আমি নিউইয়র্কেই আছি।”

নায়ার বলল, “আমেরিকান কানেকশনটা কী?”

 ঈশিতা বলল, “আমরিকান সাব। তাই না সোমনাথ?”

তার চোখে কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছিল। সোমনাথ কৌতুক গ্রাহ্য করল না। মুখ নিচু করে পায়চারির ভঙ্গিতে কয়েক পা এগিয়ে গেল। তারপর চমকে ওঠা গলায় বলল, “মাই গুডনেস! আরেকটা সাইন আমি মিস করেছি। হ্যাভারস্যাকের। গায়ে ঢ্যারা। এই চিহ্নটাও কথা বলছে। নীপা কাগজটা দাও।”

সে নীপার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে কলম খুঁজল। “এই রে! কৃষ্ণার কলমটা আমি লবিতে ফেলে এসেছি।”

সে হন্তদন্ত এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। নায়ার বলল, “এস! আমরা সিদ্ধান্ত করি, ওই উন্মাদ বুদ্ধিজীবীকে পাত্তা দেব না। দিলে আমাদের প্রমোদ-পর্যটন ব্যর্থ হবে।”

ঈশিতা ঘড়ি দেখে বলল, “এই! তোমরা সব এস। স্নান করবে তো আর দেরি কোরো না।”

সে তাড়া দিলে সবাই পা বাড়াল। হঠাৎ নীপা বলে উঠল, “এ কী!” নীপা সামনে ঝুঁকে লাল-নীল-হলুদ কয়েকটা মার্বেল কাগজের কুচি শুকনো পাতার ফাঁক থেকে কুড়িয়ে নিল। নায়ার গেঁফে হাত রেখে গোল চোখে তাকাল। ক্রিস্নান মাতৃভাষায় কিছু বলল। ঈশিতা নীপার হাত থেকে কাগজ কুচিগুলো নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “হ্যাভারস্যাকটার ভেতরে এইরকম কাগজ ঠাসা ছিল। মনে হচ্ছে, যে ওটা পাচার করতে যাচ্ছিল, সে এখানে বসেই এগুলো ঠেসে ভরেছে।”

নীপা বলল, “এখানে কেন?”

ক্রিস্নান বলল, “আমি একটা ধারণা করতে পারি। যে-লোকের হাত দিয়ে কেউ রত্ন পাঠিয়েছিল, সে এখানে বসে চুরি করেছে। মাত্র একটা রত্ন আমরা দেখেছি। সে অন্ধকারে কাজ করছিল। সুতরাং একটা রত্ন পেতে সে ব্যর্থ হয়েছে।”

সুমিত সায় দিয়ে বলল, “ঠিক, ঠিক। চোরের ওপর বাটপাড়ি।”

ঈশিতা হাসল। “চলো, এগুলো ডিটেকটিভদ্রলোকের ঘরে পাচার করা যাক।”

নায়ার বলে উঠল, “আইয়ো! এন্তা পরেন্তু।”

হাঁটতে হাঁটতে নীপা আনমনে বলল, “আমার কিন্তু ভাল লাগছে না। খালি মনে হচ্ছে–

সে থেমে গেলে ঈশিতা তার কাঁধে হাত রাখল। “ছাড়ো তো বাবা! আরিফ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আমরা সবটাই ফান বলে এনজয় করব। তা ছাড়া নীপু, তুমি তো বালিকা নও। কী সব অদ্ভুত ঘটছে, এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? এতো একটা দারুণ মজা। আরও মজার-মজার ব্যাপার ঘটুক না! রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার হবে। তাই না কৃষ্ণা?”

ক্রিস্নান শ্বাস ছেড়ে বলল, “কিন্তু একটা নরহত্যা হয়ে গেল!”

“এই এরিয়ায় খুনোখুনি সবসময় হচ্ছে।” ঈশিতা হালকা চালে বলল। “আজ ককটেল-ডিনারে মাফিয়ালিডার কেতন সিংকে দেখতে পাবে। মিঃ বোসের ডান হাত নাকি লোকটা। সুমিত! জানো? হিন্দি ফিল্মে যা-সব দেখা যায়, তা নাকি সবই সত্যি। অশোক বলছিল। কেতন সিংকে নাকি লোকে গব্বর সিং বলে আড়ালে। লোকটা একসময় মধ্যপ্রদেশের চম্বল এরিয়ায় ছিল। একটা। থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স হবে। চিয়ার আপ ডিয়ারি!”

সে নীপার কাঁধে চাপ দিল। সুমিত মুখ ফিরিয়ে বলল, “মাইরি! ঈশু, তুমিও দেখছি লেসবিয়ান–সরি! অফুল্যি সরি ম্যাডাম। চালিয়ে যাও।” বলে সে হনহন করে হেঁটে রাস্তায় পৌঁছুল।

ঈশিতা গলা চড়িয়ে বলল, “বডি ফেলে দেব, সুমিত!”

 “দাও। আমি তো কবে থেকে চাইছি।”

 “তবে রে!” ঈশিতা দৌডুল।

সুমিতও দৌডুল। রাস্তায় উঠে ঈশিতা দাঁড়াল। নায়ার, ক্রিস্নান ও নীপা পৌঁছুলে সে বলল, “সুমিতটা সত্যিই চতুষ্পদ প্রাণী। ওর দৌডুনোর ভঙ্গি লক্ষ করলে নায়ার? দেখ, দেখ! মানুষ ওভাবে দৌড়য় না।”

নায়ার হাসল। “তোমাদের দু’জনের সম্পর্ক আমার কাছে রহস্যজনক। সুমিত কি তোমার ক্রীড়াবস্তু?”

“বলতে পারো।” ঈশিতা চোখে ঝিলিক তুলল।

 “তোমারও কি ক্রীড়াবস্তু হতে লোভ হচ্ছে?”

 “নাহ্। আমি পরনারীদের ক্রীড়াবস্তু হতে চাই না।”

 ঈশিতা চোখের কোনা দিয়ে নীপাকে দেখে নিয়ে বলল, “এই অধ্যাপিকাটি যে অলরেডি এনগেজড!”

নীপা এতক্ষণে হাসতে পারল। বলল, “কথাটা ক্রীড়াবস্তু কেন? ক্রীড়নক। তবে আরিফদা বলছিল, নায়ারদা নাকি প্রেম-ট্রেমের ব্যাপারে স্বল্পাহারী।”

নায়ার বলল, “কিন্তু প্রশ্নটা হল, প্রেম বলে সত্যি কি কিছু আছে? আমরা আধুনিক মানুষ।” বলে সে চড়াইয়ের মাথায় বাংলোর গেটের দিকে তাকাল। সুমিত দুই হাঁটুতে হাত রেখে গেটে কিছু দেখছে। তারপর সে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং ঘুরে হাতের ইশারায় ডাকতে থাকল।

কাছে গেলে সুমিত ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, “একটা ঢ্যারা আঁকা। দেখতে পাচ্ছ?”

নায়ার বলল, “নিশ্চয় বুদ্ধিজীবীর কীর্তি! চলো তো! ব্যাটাকে পালাক্রমে আমরা মারব।”