।। পাঁচ ।। – জীবন্ত কঙ্কালের সন্ধান
কাঁটায় কাঁটায় বেলা একটার সময়ে প্রণবেশ জিপ নিয়ে হাজির হল। আমিও রেডি হয়ে ছিলাম। বেরোতে যাচ্ছি, প্রণবেশ বলল, দাঁড়াও একটা ফোন করে নিই।
বলে যে দুটো কাগজে দু—দিন খবরটা বেরিয়েছিল তার একটাতে ফোন করল। রিং হতেই প্রণবেশ নিউজ এডিটার পরিতোষ শীলকে চাইল।
পরিতোষ প্রণবেশের অনেক দিনের চেনা। প্রণবেশের গলা পেয়ে পরিতোষ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
কী খবর ও. সি. সাহেব? হঠাৎ খবরের কাগজে হামলা? বেয়াড়া কোনো খবর ছেপেছি নাকি?
ঠিক ধরেছ। হেসে বলল প্রণবেশ, আজকাল গাঁজায় দম দিয়ে খবর ছাপছ নাকি?
না, এখনও গাঁজার তেমন আমদানি হয়নি। তবে শীগগির হবে।
কীরকম?
সামনের সপ্তাহে বারাণসীতে কী এক মহাযোগে পুণ্যস্নান আছে। দলে দলে সাধু—সন্ন্যাসী আসতে শুরু করবে। আর তখনই তাদের গাঁজার ধোঁওয়ায় সারা কলকাতা অন্ধকার হয়ে যাবে।
পরিতোষের রসিকতায় গুরুত্ব না দিয়ে প্রণবেশ বলল, দু—দিন ধরে হঠাৎ ওইসব ভূতুড়ে ব্যাপার ছাপতে আরম্ভ করলে কেন? বেশি কাগজ বিক্রির লোভে?
ভূতুড়ে ব্যাপার! ও জীবন্ত কঙ্কালের কথা বলছ তো?
হ্যাঁ।
কী জানি যে খবর আমরা পেয়েছি তা শুধু অবিশ্বাস্য নয়, অকল্পনীয়। আমাদের স্টাফ রিপোর্টার নিজে চোখে দেখেছে। তাও একজন নয় দুজন। আর অবাক কাণ্ড—এতগুলো ছবি তুলল কিন্তু একটা ছবিও উঠল না।
প্রণবেশ হেসে বলল, কেন বলো তো?
পরিতোষ চাপা গলায় বলল, স্টাফ রিপোর্টারদের মতে চামড়া ঢাকা কঙ্কালটার নাকি শরীর বলে কিছু ছিল না। নইলে একটি ছবিও উঠত না?
প্রণবেশ বলল, তা খবরটা দেখে পাবলিক কী বলছে?
উঃ! আর বোলো না। টেলিফোনের পর টেলিফোন আসছে ঘটনাটা কতখানি সত্যি তা জানতে।
উত্তর কী দিচ্ছ?
বলছি প্রত্যক্ষদর্শীরা যা দেখেছে তাই খবর করে দিয়েছি। ওরা জানতে চায় জীবন্ত কঙ্কালটা কোন দিকে যাচ্ছে। সেটা আর আমি কী করে বলব বলো। আমার সঙ্গে তো কঙ্কালটার কথাবার্তা হয়নি। চোখে দেখারও সুযোগ হয়নি।
কোথায় যাচ্ছে সে খবরটা হয়তো তোমাকে দিতে পারব।
আঁ! বল কী! ঠাট্টা করছ না তো?
না। ঠাট্টা করলে তোমায় ফোন করে প্রসঙ্গটা তুলতে যাব কেন? দিন দুই অপেক্ষা করো। চমকে ওঠার মতো খবরটা তোমাকেই আগে দেব।
বলে প্রণবেশ রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
কী ব্যাপার? হঠাৎ খবরের কাগজে ফোন?
জেনে নিলাম কলকাতার মানুষ খবরটা জেনেছে। এটাই চাইছিলাম।
প্রণবেশ আর আমি জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। প্রথমে লালবাজার। সেখানে পুলিশের বড়োকর্তারা আমাদের মুখে নেপাল থেকে হরিদেবপুর পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা শুনে অবাক। তাঁরা কখনোই এ সব ঘটনা বিশ্বাস করতেন না। গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু যেহেতু আমরা দুজনেই পুলিশে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি, যেহেতু আমরা দুজনেই প্রত্যক্ষদর্শী আর দু—দিন দু—টো নামী কাগজে তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর খবর ছাপা হয়েছে সেজন্যে তাঁরা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারলেন না। এটা যে সত্যিসত্যিই ভৌতিক বা অলৌকিক ব্যাপার তা পুরোপুরি না মানলেও জীবন্ত কঙ্কালটাকে খুঁজে বের করবেনই সে আশ্বাস দিলেন। এবং আমাদের সামনেই কলকাতার সমস্ত থানাকে—বিশেষ করে বেলেঘাটা আর উল্টোডাঙা থানাকে জানিয়ে দিলেন রাস্তায় সতর্ক দৃষ্টিতে যেন লক্ষ করা হয় ওইরকম কঙ্কাল জাতীয় কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা।
আমরা দুজনেই খুশি হলাম। অলৌকিক হোক বা না হোক দায়িত্বটা এখন শুধু আমাদের দুজনের রইল না। পুলিশ টেক—আপ করেছে। কাজেই আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত।
এ ছাড়া পাবলিকও কাগজ—মারফত জেনে গেছে ব্যাপারটা। কাজেই কোথাও যদি জীবন্ত কঙ্কালটাকে কেউ দেখতে পায় তাহলে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা জনসাধারণই নেবে কিংবা থানায় জানিয়ে দেবে। আমাদের আর ভাবতে হবে না।
পাবলিক যে এই ব্যাপার নিয়ে কতটা মেতে উঠেছে, বেলেঘাটা মেন রোডে ঢুকতেই তা বুঝতে পারলাম।
যদিও তখন বেলা প্রায় তিনটে—রাস্তায় লোকজন কম তবু দু—ধারের ফুটপাথে লোকের জটলা। বোঝা গেল আজকের কাগজেই খবরটা পড়ে তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। একজন বলছে, সব গাঁজা। খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত আজগুবি খবর ছড়াচ্ছে।
আর একজন প্রতিবাদ করে বলছে, এর আগেও অন্য কাগজে এইরকম খবর বেরিয়েছে। বাজে কথা হলে দু—দুটো বড়ো কাগজে এরকম খবর ছাপা হয়?
আমরা জিপটা থামিয়ে নেমে পড়লাম।
পুলিশ দেখে ওদের কথাবার্তা থেমে গেল। প্রণবেশ এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনারা যা নিয়ে আলোচনা করছেন, আমরাও সে বিষয়ে খোঁজ নিতে বেরিয়েছি। লালবাজার সমস্ত থানাকে জানিয়ে দিয়েছে রাতে হোক দিনে হোক এইরকম কাউকে দেখলে তখনই যেন ধরবার চেষ্টা করে।
পুলিশের মুখ থেকে এই কথা শুনে ওরা খুব উৎসাহ পেল। বলল, আমরা স্যার, ঠিক করেছি রাতের বেলা রাস্তায় রাস্তায় পাহারা দেব।
ইতিমধ্যে পুলিশ দেখে আরও লোক জড়ো হয়ে গেছে।
প্রণবেশ বলল, একটা জিনিস মনে রাখবেন—ওই যার কথা বলা হচ্ছে সে আপনাদের বেলেঘাটায় থাকতে আসেনি। আমরা জেনেছি তার লক্ষ্য সল্টলেক। বেলেঘাটা রোড ধরে ভি. আই. পি. রোডের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু গভীর রাত ছাড়া সে এগোতে পারে না। কাল রাতে এই রাস্তা দিয়ে পাস করেছে।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, আমরা দুটো মোটরবাইক নিয়ে ভি. আই. পি. রোডটা দেখে আসতে পারি।
বললাম, সে তো আমরাও জিপে করে যেতে পারি। তা নয়। দিনের বেলায় সে এগোয় না। কাজেই এখন এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে।
এ কথা শুনে সবাই যেন চনমন করে উঠল।
তা হলে স্যার, আমরা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি?
এমন সময় ভিড়ের ভেতর থেকে একটা অল্পবয়সি ছেলে বলে উঠল, একটু আগে একজনকে একটা ভাঙা পুরোনো বাড়ির কার্নিশের ওপর শুয়ে থাকতে দেখেছি।
প্রণবেশ চমকে উঠে বলল, কীরকম দেখতে?
ছেলেটা বলল, ভালো করে দেখতে পাইনি। শুধু দুটো সরু সরু কালো পা দেখতে পেয়েছি। ভাবলাম নিশ্চয় কোনো পাগল।
প্রণবেশ ব্যস্ত হয়ে বলল, কতক্ষণ আগে দেখেছ?
আধঘণ্টা আগে।
জায়গাটা কোথায়?
আর একটু আগে। শেতলা মন্দিরের কাছে।
তুমি আমাদের সঙ্গে জিপে উঠে এসো।
ছেলেটাকে জিপে তুলে নিয়ে আমরা শেতলা মন্দিরের দিকে চললাম। আর একদল ছেলে—ছোকরা লাঠি, টাঙ্গি হাতে নিয়ে হইহই করে আমাদের পিছনে ছুটে আসতে লাগল।
শেতলাতলা ওখান থেকে বেশি দূরে নয়। আলোছায়া সিনেমা হলের কাছেই। তার একটু দূরেই ভি. আই. পি. রোড চলে গেছে উল্টোডিঙ্গি। আর বাইপাস পার হলেই সল্টলেক। ইস্টার্ন বাইপাসকে ডান দিকে ফেলে যে রাস্তাটা সেটাই সল্টলেকে ঢোকার পথ।
ছেলেটা বললে, এইখানে—সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামালাম। জায়গাটা আলোছায়া সিনেমা হল আর শেতলাতলার মাঝখানে। এখানে মেন রোড থেকে বাঁ দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। আর সেই রাস্তার সামনেই একটা বিরাট তিনতলা বাড়ির জীর্ণ কঙ্কাল দাঁড়িয়ে। ছেলেটার পিছু পিছু আমরা এগিয়ে চললাম। ছেলেটা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাঙা পাঁচিলঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যে বাড়িটা। একতলার জানলা—দরজা সব উধাও। দোতলার বিবর্ণ জানলা যে কটা সামনে থেকে দেখা গেল সবই বন্ধ। তিনতলার ওপর বিরাট লম্বা ছাদ। ছাদের আলসেতে ছোটো ছোটো গাছ, ঘাস গজিয়েছে। বাড়ির পিছনে মস্ত একটা বটগাছ। বোঝা যায় বাড়িটার সামনে—পিছনে যতই আধুনিকতার প্রলেপ দেওয়া হোক না কেন জায়গাটা আসলে খুবই পুরোনো।
ছেলেটার সাহস আছে বলতে হবে। কিংবা জীবন্ত কঙ্কাল সম্বন্ধে কোনো খবর রাখে না। সে জানে শুধু একটি পাগলই বোধ হয় ওই পাঁচিলের ওপর শুয়ে আছে। পাগল না হলে কেউ সরু পাঁচিলের ওপর শুতে পারে?
ছেলেটা দিব্যি কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে পড়ে ছাদের দিকে তাকাল। তারপর হতাশ হয়ে বলল, নাঃ, নেই। চলে গেছে। একটু আগেও ছিল।
চলে গেছে? প্রণবেশ যেন চুপসে গেল।
ছেলেটা বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি না। তবে কাছেই কোথাও আছে—নিশ্চয় আছে। একটা চিমসে গন্ধ পাচ্ছেন না? গন্ধটা আমি তখনও পেয়েছিলাম।
সত্যিই একটা চিমসে গন্ধ গলিতে ঢোকার পর থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল।
প্রণবেশ বলল, ছাদে ওঠা যাবে না?
ছেলেটা মাথা দুলিয়ে বলল, যাবে।
তবে চলো।
এই সময়ে পেছনে যারা লাঠিসোঁটা নিয়ে আসছিল তার হল্লা করতে করতে এসে পড়ল। সত্যি কথা বলতে কী বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে অন্তত আমার খুব ভয় করছিল। এখন এত লোক দেখে সাহস হল।
পেছনের লোকগুলো চেঁচিয়ে উঠল, আমরাও ওপরে উঠব।
আমরা ওদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে সবে মাত্র ভেতরের দিকে পা বাড়িয়েছি এমনি সময় তেতলার ছাদ থেকে কী যেন লাফিয়ে পড়ল বটগাছের ওপর।
এক মুহূর্তের জন্যেই দেখতে পেয়েছিলাম বস্তুটাকে। কোনো কিশোরও নয়, জীবন্ত কঙ্কাল নয়, শুধু লম্বা কালো মতো একটা কিছু—যা মানুষ নয়, বাঁদর বা অন্য কোনো জীবের সঙ্গেও কিছু মাত্র সাদৃশ্য নেই। সেই বস্তুটা গাছের ওপর লাফিয়ে পড়া মাত্র—সমস্ত গাছটা ঝাঁকানি খেল। কতখানি ভারী বস্তুর ধাক্কা খেলে অত বড়ো গাছটা অমন নড়ে উঠতে পারে ভেবে অবাক হলাম। তবু কী বিশ্বাস করতেই হবে বস্তুটা আমাদের সেই চেনা তেরো—চোদ্দ বছরের রাজু সুব্বারই জীবন্ত কঙ্কাল? অসম্ভব।
এদিকে বস্তুটাকে যারা গাছে লাফ দিতে দেখেছে তারা হৈ হৈ করে বটগাছের নীচে ছুটে গেল। কিন্তু ঝাড়া এক ঘণ্টা ধরে সবাই মিলে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না—চোখের দেখাও নয়।